আযদাহা পর্ব ৫৭

আযদাহা পর্ব ৫৭
সাবিলা সাবি

ভোরের প্রথম আলো অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে,আর দুপুরের সূর্য মাথার ওপর এসে দাঁড়িয়েছে।জ্যাসপার তখনও ঘুমে অচেতন ছিল,কারণ টানা চল্লিশ দিন না ঘুমানোর পর তার দেহ এমন গভীর বিশ্রামেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে।অবশেষে তার ঘুম ভাঙল,চোখ খুলতেই অনুভব করল বুকের ওপর একটি নরম উষ্ণতার অস্তিত্ব।
ফিওনা তার বুকের ওপর নির্ভার হয়ে ঘুমিয়ে আছে,মুখের ছোট ছোট শ্বাসপ্রশ্বাস বুকের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।কিন্তু হঠাৎই জ্যাসপারের মন কিছু অস্বাভাবিক টের পেলো।তার হাত ফিওনার কপালে যেতেই মনে হলো যেন তপ্ত আগুনের উপর হাত রেখেছে।লাভার মতো উষ্ণতা তার দেহ থেকে বের হচ্ছে।

জ্যাসপার দ্রুত উঠে ফিওনাকে নাড়াতে লাগল।”ফিওনা! ফিওনা,ওঠো!”কিন্তু কোনো সাড়া নেই।আগেরবার যা ঘটেছিল,তার স্মৃতি বিদ্যুতের মতো মাথায় ঝলসে উঠল।সে বুঝলোপরিস্থিতি দ্রুত সামলাতে হবে।তার ভেতর এক অজানা আতঙ্ক জন্ম নিতে শুরু করল।
জ্যাসপার ফিওনার নিথর মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল।তার মন বলছিল,”ফিওনার কিছু হতে দিবেনা।”কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কী করবে,সেটাই যেন স্পষ্ট হচ্ছিল না।তার সমস্ত মনোযোগ এখন ফিওনার দিকে নিবদ্ধ, আর সময় যেন প্রতিটা মুহূর্তে তাদের বিরুদ্ধে কাজ করছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এই নির্জন দ্বীপে ফিওনাকে নিয়ে জ্যাসপার অসহায় বোধ করছিল।যতবারই সে তার অবস্থা নিয়ে ভাবতে শুরু করছিল, মনে হচ্ছিল যেন সবকিছু তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।ফিওনার তপ্ত শরীর কম্বলে ঢেকে দিয়ে যত্ন করে পাশে শুইয়ে রেখে,জ্যাসপার তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়ালো। নির্জন দুপুরে আকাশে সুর্যের আলো প্রখর,আর দূরের প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউয়ের আওয়াজ যেন তার অস্থির হৃদয়ের প্রতিবিম্ব।
সে নিজের মাথায় হাত দিয়ে ফুঁসতে লাগলো।নিজের প্রতি রাগ,নিজের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা—সবকিছু যেন একত্রে তাকে পাগল করে তুলছিল।”আমি কেন নিজেকে কালরাতে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না?যদি ফিওনার কিছু হয়ে যায়?!”

এই ভেবে রাগে সে পাশে থাকা একটি বড় গাছে ঘুষি মারলো। গাছের শক্ত বাকলে তার হাত কেটে গেল,আর রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগলো।কিন্তু সে ব্যথা অনুভব করলো না;তার মনের যন্ত্রণা শরীরের যেকোনো ব্যথার চেয়ে বেশি ছিল।
“আমি একজন ড্রাগন প্রিন্স,কিন্তু আমার সামনে আমার ভালোবাসার মানুষ অসহায় অবস্থায় পড়ে আছে,আর আমি কিছুই করতে পারছি না।আমি কি এতটাই দুর্বল?”
উজ্জ্বল দুপুরে ফিওনার অসহায় শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দে জ্যাসপারের হৃদয় ভেঙে যাচ্ছিল।তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতাকে অভিশাপ দিচ্ছিল।
তখনই তার মনে পড়লো,এই দ্বীপে তো তার পরিচিত একজন আছেই সিলভেরা,সেই লিটল এন্জেল যে ফিওনাকে সুস্থ করতে সাহায্য করবে।সিলভেরার কথা মনে পড়তেই সে আবার সেই অন্ধকার গভীর জঙ্গলের দিকে তাকালো।
নিজের হাতের রক্ত মুছতে মুছতে সে বলল,”যতক্ষণ না ফিওনা সুস্থ হচ্ছে,আমি থামবো না।

উজ্জ্বল দুপুরে ফিওনার অসহায় শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দে জ্যাসপারের হৃদয় ভেঙে যাচ্ছিল।তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতাকে অভিশাপ দিচ্ছিল।
এক মুহূর্তও দেরি না করে জ্যাসপার সিলভেরার খোঁজে বের হলো।দ্বীপের পাথুরে পথ হেঁটে,গভীর জঙ্গলের দিকে এগিয়ে চলল।তার প্রতিটি পা যেন ফিওনার জন্য করা প্রতিজ্ঞারই প্রতিফলন।
অবশেষে,একটি দ্বীপের একটি ছোট্ট পাহাড়ের ঢালে জ্যাসপার সিলভেরাকে দেখতে পেলো।তার সাদা পোশাক সুর্যের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছিল। সিলভেরা মুখ তুলে জ্যাসপারের দিকে তাকাল।
“আপনি এখানে কেনো,প্রিন্স?”সিলভেরা জিজ্ঞেস করল।

জ্যাসপার ক্লান্ত গলায় বলল,”জ্যাসপার সবটা খুলে বললো সিলভেরাকে তারপর আবার বার বললো “আমি ফিওনাকে বাঁচাতে চাই।যদি তুমি কোনো উপায় জানো দয়া করে আমাকে বলো।”
সিলভেরা এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,”ফিওনাকে বাঁচানোর একটি উপায় আছে।কিন্তু সেটা সহজ নয় প্রিন্স।”
জ্যাসপার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,”আমি যে কোনো কিছু করতে রাজি।নিজের জীবন দিতেও।তুমি শুধু আমাকে বলো।”
সিলভেরা গভীরভাবে শ্বাস নিল।”দ্বীপের দক্ষিণ শেষ প্রান্তে একটি নিরাময় ঝর্ণা আছে।তার পানিতে এমন ক্ষমতা আছে যা ফিওনার জীবন ফিরিয়ে আনতে পারে।কিন্তু ঝর্ণা সহজলভ্য নয়।”
জ্যাসপারের ভ্রু কুঁচকে গেল। “কেন?”

সিলভেরা ধীরে ধীরে ব্যাখ্যা করল,”ঝর্ণাটি আগুনের লাভার মাঝে অবস্থিত।সেখানে প্রতিটি পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে মৃ*ত্যু সামনে এগিয়ে আসে।আরও বড় সমস্যা হলো,সেখানে আপনার ড্রাগন শক্তি কোনো কাজ করবে না।আপনি শুধুমাত্র একজন মানুষের মতো সেখানে যেতে পারবেন।”
জ্যাসপার এক মুহূর্তের জন্য নীরব হয়ে দাঁড়াল।তারপর কঠিন মুখে বলল,”আমি যাব।ফিওনার জন্য আমি সব কিছু করতে পারি।”

সিলভেরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি জানেন,এই যাত্রায় বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম তবুও আপনি প্রস্তুত?”
জ্যাসপার দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিল,”ফিওনার জন্য আমি নিজের জীবনও উৎসর্গ করতে পারি।সে আমার সবকিছু।”
সিলভেরা চোখে জল নিয়ে বলল, “আপনি সত্যিই ভিন্ন, প্রিন্স।খুব কম ব্যাক্তি এমন ভালোবাসা দেখাতে পারে।”
সিলভেরা জ্যাসপারকে ঝর্ণার পথের দিক নির্দেশনা দিল। “দক্ষিণের দিকে এগিয়ে যান।সেখানে আগুনের রঙে ঝলমল একটি গুহা দেখতে পাবেন।কিন্তু মনে রেখবেন,ঝর্ণার পানি নিতে হলে আপনাকে প্রচণ্ড ধৈর্য আর সাহস দেখাতে হবে।”
জ্যাসপার সিলভেরার কথা শোনার পর ধীরে ধীরে মাথা নোয়াল।”ধন্যবাদ,লিটল এঞ্জেল।
সিলভেরা তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমিও আসছি আপনার সাথে ফিওনাকে দেখতে।”
জ্যাসপার দৃঢ় পায়ে পুনরায় তাঁবুর দিকে রওনা হলো।তার চোখে ছিল ফিওনাকে বাঁচানোর জন্য এক অদম্য আগুন। “যদি আমার জীবনও চলে যায়,আমি তবুও ওকে বাঁচাবোই।কারণ ও আমার সবকিছু।”

তাঁবুর সামনে দাঁড় জ্যাসপার লিটল এন্জেলকে বলল,
“তুমি কিছু সময়ের জন্য ফিওনার পাশে থাকতে পারবে? আমি ওকে একা রেখে যেতে চাই না।”
লিটল এনজেল তার বড় বড় চোখে জ্যাসপারের দিকে তাকাল।কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পর সে বলল,
“আপনি আমার কাছে এমন অনুরোধ করবেন,তা কখনো ভাবিনি প্রিন্স।কিন্তু আমি রাজি।আপনি নিশ্চিন্তে যান,আমি ফিওনার দেখাশোনা করব।”
জ্যাসপার গভীর শ্বাস নিয়ে বলল,

“ধন্যবাদ,লিটল এন্জেল।আমি যত দ্রুত সম্ভব ফিরে আসব। যদি আমার ফিরতে দেরি হয়,তবুও অপেক্ষা করো।”
লিটল এনজেল মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
জ্যাসপার তাঁবুতে ঢুকে ফিওনার পাশে গিয়ে বসল।ফিওনা তখন গভীরভাবে অচেতন,মুখে ক্লান্তির ছাপ।জ্যাসপার ফিওনার চুলে হাত বুলিয়ে মৃদু হাসল।তারপর ধীরে ধীরে ফিওনার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,”আমি ফিরে আসব, হামিংবার্ড।তোমার জন্য যেকোনো ঝুঁকি নিতে রাজি।”
লিটল এন্জেল তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখছিল। জ্যাসপারের প্রতি তার চোখে বিস্ময় আর প্রশংসার মিশ্রণ ফুটে উঠল।সে ধীরে ধীরে বলল,
“একজন ড্রাগন,যে এত শক্তিশালী,এত গর্বিত,সে কীভাবে একটি মানবীর জন্য এভাবে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে? এটা অসম্ভব মনে হলেও আপনি প্রমাণ করেছেন,ভালোবাসা সবকিছুর ঊর্ধ্বে।”
জ্যাসপার লিটল এনজেলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ফিওনা শুধু আমার প্রেয়সী নয়;সে আমার জীবনের অর্থ। আমি ফিরে আসব,তার জন্য যেকোনো বাধা অতিক্রম করে।”

এ কথা বলে জ্যাসপার দৃঢ় পায়ে তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। তার চোখে ছিল অদম্য সাহস আর মনভরা ভালোবাসার শক্তি।লিটল এন্জেল তাঁবুর দিকে তাকিয়ে বলল,
“ফিওনা,তুমি জানো না,তুমি কতটা ভাগ্যবতী।পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণীও তোমার ভালোবাসার কাছে নিঃস্বার্থ।”তার মুখে একধরনের মুগ্ধতা ফুটে উঠল।
“ভালোবাসার এত গভীরতা আগে কখনো দেখিনি।একজন ড্রাগনের মনে এতটা মানবিকতা থাকতে পারে,এটা সত্যিই বিস্ময়কর।”
জ্যাসপার তখন ঝর্ণার দিকে যাওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছিল। তার মনে ছিল একটাই ভাবনা:”আমি তোমার জন্য ফিরে আসব,ফিওনা।তুমি আমার জীবনের আলো।”

জ্যাসপার যখন ঝর্নার গুহার কাছাকাছি পৌঁছালো, দূর থেকে সে ঝর্ণার শীতল পানির ঝলকানি দেখতে পেলো। তার ক্লান্ত হৃদয়ে এক মুহূর্তের জন্য স্বস্তি এলো। কিন্তু সেই ঝর্ণার পথ এতটা সহজ হবে না, তা গুহার প্রবেশপথ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। মাটিতে লাভার উত্তপ্ত ঢেউ, যেন প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে।
জ্যাসপার গভীর শ্বাস নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করলো।
“ফিওনার জন্য আমি সব সহ্য করব,” নিজেকে বলল সে।
যখনই জ্যাসপার তার পা লাভার ওপর রাখলো,জ্যাসপারের পা লাভার উত্তপ্ত মাটিতে পড়তেই ঝাঁঝালো পোড়ার গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো। তার দামি বুট জুতো নিমিষেই গলে গেলো, আর পায়ের ত্বক তাতে আটকে গেল। যন্ত্রণায় চোখ বন্ধ করলেও, সে থামল না। দাঁতে দাঁত চেপে জুতোগুলো পা থেকে টেনে ছুঁড়ে ফেলে দিলো।
জুতোবিহীন পায়ে লাভার মাটিতে আবার পা রাখতেই মনে হলো যেন আগুন তার শিরা-উপশিরা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রতিটি পদক্ষেপে তার পা পুড়ে কালো হয়ে যাচ্ছিল। মাংসের পোড়া গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল, কিন্তু জ্যাসপার এগিয়ে যেতে থাকলো।

তার মনে একটাই চিন্তা—“ফিওনার জীবন আমার চেয়ে বেশি মূল্যবান। আমি যদি না ফিরি, তাও সে বেঁচে থাকুক।”
যতই এগিয়ে যাচ্ছিল, লাভার উত্তাপ যেন আরও বেড়ে যাচ্ছিল। তার পায়ের চামড়া বারবার ফেটে রক্ত ঝরছিল। তার শরীর ঘাম আর রক্তে ভিজে গিয়েছিল, তবুও সে থামেনি। একবার হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেও হাতের মাটির পাত্র শক্ত করে ধরে রাখলো। সেই পাত্র ফেলে দিলে তো সব শেষ।যন্ত্রণায় জ্যাসপারের মাথা ঝিমঝিম করছিল, কিন্তু তার মনের গভীরে ফিওনার মুখ বারবার ভেসে উঠছিল। তার মনের শক্তিই তাকে এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।

ঝর্ণার কাছে পৌঁছানোর পর জ্যাসপারের ক্লান্ত মুখে এক মুহূর্তের জন্য হাসি ফুটেছিল। এতটা যন্ত্রণা সহ্য করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লাভার পথ পেরিয়ে অবশেষে ঝর্ণা তার সামনে। ঝর্ণার ঠাণ্ডা পানির শব্দ তাকে যেন এক মুহূর্তের জন্য শান্তি দিল। কিন্তু সেই হাসি দ্রুত মিলিয়ে গেলো।
ঝর্ণার দিকে আরেকটু এগোতেই জ্যাসপার দেখতে পেলো, ঝর্ণার সামনের পুরো পথ কাঁটা-যুক্ত ফুলে ভরা। প্রতিটি ফুল ছিল রক্তলাল, এবং তাদের ধারালো কাঁটাগুলো রোদে ঝিলমিল করছিল। কোনো সাধারণ ফুল নয় এগুলো, এগুলোর কাঁটা যে কোনো মাংস স্পর্শ করলেই ভেতরে বিষ ঢুকিয়ে দেয়।
জ্যাসপারের মুখ কালো মেঘের মতো গম্ভীর হয়ে উঠলো। একে তো লাভার উত্তাপে পায়ের মাংস প্রায় জ্বলে গেছে, এখন এই বিষাক্ত ফুলের কাঁটার পথ পার হতে হবে। কিন্তু থামার কোনো সুযোগ নেই।
সে নিজেকে বললো, “ফিওনার জন্যই আমাকে এগোতে হবে। এ পথও পেরোবো। এই কাঁটা আমাকে থামাতে পারবে না।”

জ্যাসপার তার পা সাবধানে প্রথম কাঁটাযুক্ত জায়গায় রাখলো। সঙ্গে সঙ্গে একটা কাঁটা তার পায়ের তলায় গভীরভাবে ঢুকে গেল। এক ধাক্কায় তার সারা শরীরের শিরায় যেন বিষ ছড়িয়ে পড়লো। তার পা মুহূর্তেই অবশ হতে শুরু করলো, কিন্তু সে দাঁতে দাঁত চেপে পা তুললো এবং আরও এক ধাপ এগোল।
প্রতিটি কাঁটা তার পায়ে বিঁধছিল, কিন্তু সে নিজের মনের শক্তিকে হারাতে দিলো না। কাঁটার বিষের কারণে তার পা অবশ হয়ে আসছিল, রক্ত ঝরছিল। একসময় তার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল, তাই সে মাটিতে হাঁটু গেড়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে শুরু করলো।

বিষের প্রভাব তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লেও, তার মনের একটাই লক্ষ্য ছিল—ঝর্ণার পানি নিতে হবে।
অবশেষে, ঘণ্টার মতো সময় লেগে গেলো এই বিপজ্জনক পথ পাড়ি দিতে। জ্যাসপার ঝর্ণার কাছে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তার হাত থেকে মাটির পাত্র প্রায় পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু সে সেটা শক্ত করে ধরে রাখলো।
শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে সে উঠে দাঁড়ালো। ঝর্ণার পানিতে পাত্র ডুবিয়ে পানি তুললো। ঠাণ্ডা পানির স্পর্শে তার হাতের যন্ত্রণা কিছুটা কমলো।
যখন পানি ভরে ফেললো, তখন সে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালো। ফিওনার মুখ তার মনে ভেসে উঠলো। ক্লান্ত, রক্তাক্ত মুখে এক ফোঁটা শান্তির হাসি ফুটলো। কিন্তু তখনই বিষের প্রভাবে তার চোখ ঝাপসা হতে শুরু করলো।
নিজেকে বললো, “এখন মরলে চলবে না। আমাকে ফিরতেই হবে। ফিওনাকে বাঁচাতে হবে। মরার সময় পরে আসবে।”

জ্যাসপার পাত্রটা শক্ত করে ধরে ঝর্ণার পথ দিয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। কিন্তু এবার তার শক্তি আরও কম, যন্ত্রণা আরও বেশি। তবু সে নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করে ধীরে ধীরে পথ ধরে এগোতে শুরু করলো।
ঝর্ণার পানি সংগ্রহ করার পর, জ্যাসপার ক্লান্ত এবং রক্তাক্ত শরীর নিয়ে ধীরে ধীরে ফেরার পথে পা বাড়ালো। তবে এবার তার আশপাশের পরিবেশ অদ্ভুতভাবে পাল্টে গেছে। কাঁটা-যুক্ত ফুলের বাগান আর আগুনের লাভা যেন মায়ার মতো মিলিয়ে গেছে।
জ্যাসপার আশ্চর্য হলো, কিন্তু নিজের মনে বললো, “এটা হয়তো কোনো পরীক্ষা। এখানে কিছুই স্বাভাবিক নয়। তবে যা-ই হোক, আমাকে ফিওনার কাছে ফিরতেই হবে।”
যতই এগোতে লাগলো, ততই তার সামনে এক অদ্ভুত পথ প্রকাশ পেলো। মাটির ওপরে একটা লুডোর বোর্ডের মতো জটিল নকশা আঁকা। গোল, ত্রিভুজ, বর্গক্ষেত্র আর অন্যান্য চিহ্ন আঁকা সেই পথ যেন এক ধরনের ধাঁধার মতো।
কিছুক্ষণ নকশাগুলো পর্যবেক্ষণ করার পর, জ্যাসপার বললো, “এটা কোনো সাধারণ পথ নয়। এখানে ভুল করলে বিপদ আসবেই। আমার ড্রাগন শক্তি হয়তো এখানে কাজে দেবে না, কিন্তু আমার ইন্দ্রিয় আর বুদ্ধি তো এখনো আছে।”

জ্যাসপার প্রথমে একটা ত্রিভুজ চিহ্নের ওপর পা রাখলো। মুহূর্তের মধ্যে, ওপর থেকে বিশাল একটা পাথর ঝুলে এসে তার কপালে সজোরে আঘাত করলো। আঘাত এতটাই জোরালো ছিল যে কপাল ফেটে রক্ত ঝরতে লাগলো, এবং তার শার্ট দ্রুত রক্তে ভিজে গেলো।
জ্যাসপার দিশেহারা হয়ে পড়লেও সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিলো। কপাল থেকে গলগল করে রক্ত ঝরলেও সে বললো, “এটা শক্তির পরীক্ষা নয়, এটা বুদ্ধির পরীক্ষা। আমাকে আরও সাবধান হতে হবে।”
সে চারপাশে তাকিয়ে বোর্ডের প্রতিটি চিহ্ন পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। তার ড্রাগন ইন্দ্রিয় আর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সে বুঝতে পারলো, প্রতিটি চিহ্নের মধ্যে লুকিয়ে আছে কোনো না কোনো ফাঁদ।
“ঠিক আছে,” সে নিজেকে বললো, “প্রতিটি পদক্ষেপের আগে আমাকে পুরো বোর্ড বিশ্লেষণ করতে হবে। এখানে তাড়াহুড়ো করলে মৃত্যু নিশ্চিত।”

এবার জ্যাসপার একটা বর্গক্ষেত্র চিহ্ন বেছে নিলো এবং ধীরে ধীরে পা রাখলো। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো—কোনো বিপদ ঘটলো না।
জ্যাসপার দীর্ঘশ্বাস ফেললো, কিন্তু তখনই তার সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ আসলো। বোর্ডের মাঝখানে দেখা গেল একটা বড় সর্পিল চিহ্ন। এবার জ্যাসপার বুঝলো, প্রতিটি চিহ্নে পা রাখার পর তার বুদ্ধিমত্তা এবং পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার আরও পরীক্ষা হবে।
একেকটা পদক্ষেপে সে বোর্ডের ফাঁদগুলো এড়িয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। যাত্রাটা ছিল ধীর, কষ্টকর, এবং প্রাণঘাতী। পায়ের ক্ষত, রক্তাক্ত কপাল, আর দুর্বল শরীর নিয়ে প্রতিটি ধাপ ছিল যেন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার মতো।
তবুও, ফিওনার কথা মনে করে সে থামেনি। প্রতিটি ভুল তাকে আরও সতর্ক করেছে। প্রতিটি সঠিক পদক্ষেপ তাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে।

অবশেষে, দীর্ঘ এক প্রচেষ্টার পর, জ্যাসপার বোর্ডের শেষ চিহ্নে পৌঁছালো। তার শরীর প্রায় নিস্তেজ, কিন্তু তার মুখে ছিল বিজয়ের এক দৃঢ় হাসি।
ঝর্ণার সামনে থেকে হঠাৎ বিশাল এক পাথর গড়িয়ে আসতে দেখে জ্যাসপারের হৃদয় থমকে গেল। পাথরটা এত বড় এবং দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছিল যে মুহূর্তের মধ্যে তাকে পিষে ফেলার জন্য যথেষ্ট ছিল।
জ্যাসপার আতঙ্কে নিজের ডান হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেললো, মনে মনে বললো, “এটাই কি আমার শেষ? ফিওনার কাছে আর ফিরতে পারবো না?”

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, কিছুই ঘটলো না। চারপাশে কোনো আঘাতের শব্দ নেই, কোনো ধ্বংসের অনুভূতি নেই।
ধীরে ধীরে জ্যাসপার হাত সরিয়ে চোখ খুললো। চোখের সামনে যে দৃশ্য দেখলো, তাতে সে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। পুরো গুহা এক অপার্থিব আলোতে ভরে গেছে। ঝর্ণার চারপাশ থেকে রঙিন আলো ছড়িয়ে পড়ছে, যেন রত্নখচিত এক রাজপ্রাসাদের ভেতর এসে পড়েছে। সেই আলো এত উজ্জ্বল, তবু তা চোখে কোনো অস্বস্তি তৈরি করছে না।
এরপর ঝর্ণার পানি থেকে বেরিয়ে এলো এক রহস্যময় রমণী। তার সৌন্দর্য দেখে জ্যাসপার চমকে গেল। রমণীর চেহারায় এমন এক মায়া, এমন এক জ্যোতি ছিল যে তাকে একবার দেখলেই যে কেউ মুগ্ধ হয়ে পড়বে। তার লম্বা সোনালী চুল, হালকা নীলাভ চোখ, আর শরীরে মুক্তোর মতো আলো জ্বলজ্বল করছে। তিনি যেন কোনো দেবী।
জ্যাসপার বিস্মিত কণ্ঠে বললো, “তুমি কে? এই গুহার রহস্য কি? আর কেন তুমি আমার সামনে এলে?”
রমণী হালকা হাসি দিয়ে বললো, “আমি এই ঝর্ণার অভিভাবক। হাজার বছর ধরে আমি এই ঝর্ণার সুরক্ষা করে আসছি। এখানে যে আসে, তার উদ্দেশ্য জানি।

জ্যাসপার স্তম্ভিত হয়ে প্রশ্ন করলো, “তোমার নাম?”
“আমি এই ঝর্ণার রক্ষক, ঝর্ণার রানি সেরেনা,” সে উত্তর দিল।
জ্যাসপার বললো, “ঝর্নার দেবি সেরেনা, আমি তো আমার পরীক্ষায় সফল হয়েছি। এবার আমাকে যেতে দাও।”
“তোমার আসল পরীক্ষা এখন শুরু প্রিন্স অরজিন,” সে বলল।
“কি পরীক্ষা?” জ্যাসপার জানতে চাইল।
“এই ঝরধারার পানি তুমি কেন নিচ্ছো, তা আমি জানি। তোমার মস্তিষ্ক আমি পড়ে ফেলেছি। তবে, এই জায়গা থেকে বের হতে হলে আমাকে খুশি করতে হবে।”
“মানে?”
“মানে, আমি তোমায় প্রতি আকৃষ্ট। তোমার সৌন্দর্য ও সাহস আমাকে মুগ্ধ করেছে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছে তোমার প্রেয়সীর প্রতি তোমার ভালোবাসা।”

জ্যাসপার তার কথায় হতভম্ব হয়ে রইলো।
“আমি তোমাকে কিছু সময়ের জন্য চাই, মানে হচ্ছে তুমি আমাকে কিছু সময়ের জন্য ভালোবাসবে। বুঝতে পারছো কি চাইছি?” সেরেনা বললো, তার চোখে এক আকর্ষণীয় চাহনি।
“দুঃখিত,তুমি যেটা চাইছো সেটা কখনোই সম্ভব নয়। আমি কখনোই ফিওনাকে ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে স্পর্শ করবো না,” জ্যাসপার উত্তর দিলো দৃঢ়ভাবে, তার কণ্ঠে জেদ।
সেরেনার মুখের হাসি ম্লান হয়ে গেল। “তাহলে তো তুমি এই পানি নিয়ে পৌঁছাতেই পারবে না, আর পারবে না তোমার প্রেয়সীকে বাঁচাতে, প্রিন্স। আমার কথা শোনো, এতে তোমার লাভ হবে। তোমার শরীরে যে ক্ষত হয়েছে সেগুলো আমি সারিয়ে দিবো আর নিরাপদে তোমাকে এই ঝর্নার পানি সহ পৌঁছে দেবো।”
জ্যাসপার তখন রেগে বললো, “একদম চুপ করো। আমি নিজেই যেতে পারবো।সারা পথ এত কষ্ট করে পানি নিয়ে আসার পর আমি অবশ্যই বাকিটা অতিক্রম করতে পারবো। কিন্তু তোমার এই কুপ্রস্তাব কখনোই ড্রাগনের প্রিন্সের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়!”

সেরেনা তখন বললো, “ঠিক আছে,তুমি আমার কথা মানবেনা তো এবার দেখো কি হয়।”
কিছুক্ষণ বাদে জ্যাসপারের মনে হলো তার গলা তৃষ্ণার্ত, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। তৃষ্ণায় গলায় আটকে যাচ্ছে। জ্যাসপার এতোটাই তৃষ্ণার্ত অনুভব করলো যে সে ঝর্নার পানি পান করতে ঠোঁটের কাছে ছোঁয়ালো। কিন্তু মুহূর্তেই তার মনে পড়লো, এটি ফিওনার জন্য!জ্যাসপার থেমে গেল,মনে মনে ফিওনার কথা ভাবতে লাগলো।
কিন্তু তৃষ্ণায় সে যেন মরে যাচ্ছিল।সেরেনা তখন মুখ বাঁকিয়ে হাসতে লাগলো,তার চোখে যেন জয় ও আনন্দের ঝিলিক।
জ্যাসপার আর উপায় না পেয়ে নিজের হাতে জোরে কামড়ে বসালো। রক্ত বেরিয়ে এলো, সে নিজেই নিজের রক্ত পান করতে শুরু করলো। সেরেনা অবাক হয়ে গেলো। “এটা কি করছে তুমি?” সে বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো।
“এটা আমার জন্য নয়, ফিওনার জন্য,” জ্যাসপার বললো দৃঢ়তার সাথে।
সেরেনার মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল, তার চোখে কিছুটা ভয় ও বিস্ময় ছিল। “তুমি সত্যিই সেই ভালোবাসার পক্ষে এতটা দৃঢ়?”

জ্যাসপার এবার মনে মনে স্থির করলো—সে যেকোনো উপায়ে ফিওনাকে বাঁচাতে প্রস্তুত,তা সে নিজের ক্ষতির মধ্য দিয়ে হলেও।
সেরেনা তখন বললো, “প্রিন্স, তুমি জানো,আমি তোমাকে প্রথম এই দ্বীপে দেখেছিলাম আরো দশ বছর আগে।সেদিনই তুমি আমার মনে জায়গা করে নিয়েছিলে, কিন্তু কখনো ভাবিনি তুমি কাউকে এভাবে ভালোবাসবে।দয়া করে,কিছু মুহূর্তের জন্য আমার হয়ে যাও।”
জ্যাসপার তখন দৃঢ়তার সঙ্গে বললো,“মরে গেলেও না। আমাকে মেরে ফেলো ঝর্নার দেবী,কিন্তু তোমার এই ইচ্ছা আমি পূরণ করতে পারবো না।”

কিছুক্ষণ পরেই সেরেনা বললো,“সাবাস! তুমি উত্তীর্ণ হয়েছো, প্রিন্স।তুমি সফল।আর হ্যাঁ,দুঃখিত,আমি তোমার লয়ালিটির পরীক্ষা করছিলাম,দেখতে চেয়েছিলাম তুমি তোমার প্রেয়সীর প্রতি কতোটা নিষ্ঠাবান।এমন একজন সুন্দরী রমনী দেখে তুমি কি নিজের লোভ সামলাতে পারো কিনা। তুমি সত্যি চমৎকার তুমি এবার যেতে পারো।তবে তোমার এই ক্ষত আমি সারিয়ে দিতে পারবো না,কারণ এটা প্রকৃতির বিরুদ্ধে।”
“ধন্যবাদ,ঝর্নার দেবী সেরেনা,” জ্যাসপার বললো,তার গলা কাঁপছে।
তারপর জ্যাসপার ধীরে ধীরে গুহা থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো, মনে মনে ফিওনার জন্য সেই ঝর্নার পানি নিয়ে আসার আশায়। তার মন তার প্রেয়সীর জন্য উদ্বেগে ভরপুর ছিল, কিন্তু এখন সে জানতো, সে তার ভালোবাসার প্রতি কতটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

আযদাহা পর্ব ৫৬

জ্যাসপার যখন বেরিয়ে আসলো, তখন তার মনে হচ্ছিলো যেন সে সত্যিই নতুন করে জন্ম নিল। সে ঝর্নার রক্ষকের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে, এবং এখন তার কেবল ফিওনাকে বাঁচানোর একটাই লক্ষ্য।
জ্যাসপার গুহা থেকে বেরিয়ে আসার সাথে সাথে সেরেনা বললো, “আমি সত্যি তোমার প্রতি মুগ্ধ ছিলাম,ড্রাগন প্রিন্স। আমি সেই দশ বছর যাবত অপেক্ষায় ছিলাম যে তোমার সাথে দ্বিতীয়বার দেখা হবে,তবে ভাবতে পারিনি তোমার মনে কোনো এক মানবীর জায়গা হয়ে গেছে।সে সত্যি পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবতী।তোমার ভালোবাসার কাছে আমার এই আকর্ষণ কিছুই না।প্রিন্স,ভালো থেকো।”

আযদাহা পর্ব ৫৭ (২)