আযদাহা পর্ব ৬

আযদাহা পর্ব ৬
সাবিলা সাবি

ফিওনা আর লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষ করে ক্যান্টিনে বসেছে।উভয়েই খাবার নিচ্ছিলো,কিন্তু ফিওনার মন আজ অন্যত্র।খাবারের স্বাদ বা পরিবেশ, কোনো কিছুই যেন ওর ভাবনাকে স্পর্শ করতে পারছিলো না। সে গভীরভাবে মগ্ন ছিল গত রাতের অভিজ্ঞতায়। অবশেষে, লিনের নিরবতাকে ভেঙে দিয়ে ফিওনা এক নিশ্বাসে সব খুলে বললো।
লিন চমকে উঠলো,তার চোখে বিস্ময়ের ছায়া।
“তুমি বলছো লোকটা তার নাম বলেছে ‘জ্যাসপার অরিজিন’?এমন নাম তো কখনো শুনিনি,”
লিন একটু থেমে বললো, “দেখতে কেমন ছিল?”
ফিওনা এক মুহূর্তের জন্য স্থির হলো, তারপর আস্তে করে বললো, “বলেছি না, শুধু তার চোখদুটো দেখেছি। চোখের মধ্যে ছিলো এক ধরনের অদ্ভুততা—অলিভ সবুজ, কিন্তু তার দৃষ্টিতে ছিলো এক মায়াবী নেশা,
যা কোনো মানুষের চোখে দেখিনি আগে। চোখের সেই চাহনি আমার আত্মার গভীরে প্রবেশ করে, এক অদ্ভুত শক্তি নিয়ে।”
লিন কিছুক্ষণ নীরবে ফিওনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ওর মনে প্রশ্নের পাহাড়,কিন্তু কোনো শব্দ মুখে আসছিল না। তারপর ধীরে ধীরে লিন বললো,

“অদ্ভুত! এমন লোক কীভাবে হঠাৎ করে তোর সামনে এলো?”
ফিওনা হালকা নিঃশ্বাস ফেলে বললো, “আমি জানি না। তবে, সে স্বাভাবিক নয়।
ফিওনার কথা শোনার পর লিন গভীর চিন্তায় পড়ে গেলো। কিছুক্ষণ নীরবে থেকে, ও মুখ তুলে বললো, “বিষয়টা খুবই গভীর ভাবনার যোগ্য। পরের বার যদি আবারও দেখা হয়, তুই অবশ্যই তার সম্পূর্ণ মুখ দেখার চেষ্টা করবি। তার পরিচয় জানার চেষ্টাও করবি। যে মানুষ এমন অদ্ভুত রহস্যময় হয়ে তোর সামনে এলো, তার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো রহস্য আছে।”
ফিওনা মাথা নাড়লো,চোখে চিন্তার ছায়া। কিন্তু লিন দ্রুত তাকে সতর্ক করে দিলো,”কিন্তু শোন, লিয়ার সাথে আর কোথাও যাস না। কাল রাতে যা ঘটেছে, তা থেকে বোঝা যায় তোর একটা বড় বিপদ হতে পরতো।”
ফিওনা লিনের দিকে তাকিয়ে রইলো, ওর মনে অস্বস্তি আর কৌতূহল একসাথে। কিন্তু লিনের সতর্কবাণী ওকে নিঃশব্দে ভাবতে বাধ্য করলো।
ফিওনা ভার্সিটি থেকে ডরমিটরির দিকে ধীর পদক্ষেপে ফিরছিল, মনে হাজারো প্রশ্নের ভিড়। মাথায় তখনও ঘুরছে সেই রহস্যময় লোক, তার অদ্ভুত অলিভ গ্রিন চোখ। রুমে প্রবেশ করতেই ফিওনা দেখতে পেলো লিয়া সবে মাত্র ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে বাথরুম থেকে। আজ সকালে লিয়া রুমে ফিরেছিলো,তখন ফিওনা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলো। যখন ফিওনা ভার্সিটির উদ্দেশ্যে ঘুম থেকে উঠেছিলো, তখন লিয়াকে নিজের বিছানায় শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেছিলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

লিয়া ফিওনাকে দেখে একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। মুখে এক ধরনের অপরাধবোধের ছাপ নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল, “ফিওনা, আমি সত্যিই দুঃখিত গত রাতের জন্য। তোমার কোনো বিপদ হতে পারতো, আমার সঙ্গ দিয়ে… আমি সেটা বুঝতে পারিনি।”
ফিওনা লিয়ার দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত ভাবলো, তারপর হালকা হেসে বললো, “থাক, কোনো সমস্যা নেই। তুমি এমনটা তো ইচ্ছে করে করোনি।”
লিয়ার মুখে স্বস্তির একটা ছাপ ফুটে উঠলো। কিন্তু ফিওনা আর কিছু বললো না। জ্যাসপার অরিজিনের কথা তার মনে থাকলেও, সে একবারের জন্যও লিয়াকে সেই লোকটির ব্যাপারে কিছু জানালো না। মনস্থির করে নিলো, এই রহস্য এখনো তার ভেতরে চেপে রাখা উচিত।

ল্যাবের স্নিগ্ধ অথচ চাপা আলোয় বসে আছেন মিস্টার চেন শিং আর ওয়াং লি, দুজনের চোখে গভীর মনোযোগ। এথিরিয়নের বন্দিত্ব তাদের গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে—একটি প্রাণশক্তি যা প্রকৃতির নিয়মকে চ্যালেঞ্জ জানায়, এমন কিছু যা তারা নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়। তাদের প্রকল্প এখন কঠিন পর্যায়ে—ড্রাগনটিকে অন্য কোথাও স্থানান্তর করতে হবে। এই স্থানান্তর শুধু নিরাপত্তার জন্য নয়, এটি তাদের গবেষণার পরবর্তী ধাপ।
মিস্টার চেন শিং নিজের লক্ষ্য নিয়ে তীব্রভাবে ভাবছেন।
“এথিরিয়ন ড্রাগনের শক্তি… পূর্ণ সম্ভাবনা এখনও আমরা স্পর্শ করতে পারিনি। তবে একবার যদি আমরা এটি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারি, মানুষকে আমরা অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবো,” মিস্টার চেন শিং ধীরে ধীরে বললেন।
ওয়াং লি একটু হেসে বললো, “আর যদি তা হয়,তবে বিশ্ব আমাদের হাতের মুঠোয় আসবে। সুপার হিউম্যান—মস্তিষ্কে অপ্রতিরোধ্য শক্তি ধারণ করবে, এমন কিছু যা আগে কখনো হয়নি। তার শক্তি দিয়ে আমরা এমন সব আধুনিক যন্ত্র উদ্ভাবন করতে পারবো যা বিশ্বের ধারণার বাইরে।”

চেন শিং চিন্তিতভাবে মাথা নাড়লেন। “তবে মনে রাখো, এটা শুধু ক্ষমতার প্রশ্ন নয়। এটা মানবদের উন্নতির প্রশ্ন।”
ওয়াং লির চোখে এক ধরনের অদ্ভুত আলো ফুটে উঠলো, যেটা চেন শিং দেখতে পেলেন না। “মানবতার উন্নতি… অবশ্যই। কিন্তু ক্ষমতাও এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, মিস্টার চেন। আর আমরা একবার এথিরিয়নের শক্তিকে কাজে লাগাতে পারলে, আমরা শুধুমাত্র বিজ্ঞানী হিসেবে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে উঠবো।”
চেন শিং সামান্য দ্বিধায় পড়লেন, কিন্তু ওয়াং লির প্রলোভনসঙ্কুল কথাগুলো তাকে আবার দিশা দিলো। তাদের গবেষণার ফলাফল এক সময়ে পৃথিবীর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করতে পারবে—এটা তার লক্ষ্য ছিল সবসময়।
“ঠিক আছে, তবে আমাদের দ্রুত কাজ করতে হবে। সময় আমাদের শত্রু হয়ে উঠতে পারে,” মিস্টার চেন শিং দৃঢ় কণ্ঠে বললেন।
ওয়াং লি আরেকটু হাসলো, তবে এবার তার চোখে ম্লান কৌতূহল, “নিশ্চয়ই, তবে একবার আমরা সফল হলে… সময় আমাদের হাতের মুঠোয় থাকবে।”
এভাবে, তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল সুপার হিউম্যান তৈরি করা—এমন এক সত্তা যার মস্তিষ্কে থাকবে ড্রাগনের শক্তি আর ক্ষমতা, যার মাধ্যমে তারা সৃষ্টি করবে এক অপ্রতিরোধ্য ভবিষ্যৎ। তবে, তাদের উদ্দেশ্যের গভীরে লুকিয়ে ছিল আরও অন্ধকার কিছু।

মিস্টার চেন শিং গভীর চিন্তায় নিমগ্ন থেকে হঠাৎ বলে উঠলেন, “আচ্ছা, তবে সিক্রেট রুমের দরজাটা খোলা হোক। দেখতে হবে ড্রাগনটা এখন কী অবস্থায় আছে।”
ওয়াং লি দ্রুত বাধা দিলেন, মুখে এক ধরনের অস্বস্তি। “আরে, আরে, এখন দেখতে গেলে সমস্যা হতে পারে। যদি ড্রাগনটা আমাদের ওপর হামলা করে বসে?”
চেন শিং এক পলক তাকিয়ে রইলেন। তার কণ্ঠে দৃঢ়তা ফুটে উঠল। “কিন্তু আমরা তো ওকে ক্যামিকেল দিয়ে নিস্তেজ করে রেখেছি। ওর কিছু করার মতো অবস্থাই নেই।”
ওয়াং লি একটু হাসলেন, ঠোঁটের কোণে এক ধরনের ব্যঙ্গ। “আপনার কী আমার ওপর আস্থা নেই, মিস্টার চেন শিং?”
চেন শিং কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন,তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “আস্থা আছে বলেই তো তোমার সঙ্গে এতদূর এগিয়েছি। তবে নিশ্চিত হতে চাই, কারণ এখানে ছোট্ট একটা ভুলেরও কোনো সুযোগ নেই।”
ওয়াং লি মাথা নাড়লেন, তার ঠোঁটের হাসি আরো প্রশস্ত হলো।

অন্ধকারের গভীরে, নির্জন গুহার ল্যাবটিতে হালকা আলো জ্বলছে, যেখানে জ্যাসপার তার বাবা যাকে জ্যাসপার ড্রাকোনিস বলে সম্বোধন করে।
ড্রাকোনিসের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছে।
“ড্রাকোনিস! জ্যাসপার গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে, “আমি এথিরিয়নের কাছে পৌঁছানোর একেবারে দ্বারপ্রান্তে। আমি হিউম্যানদের মতো কিছু কৌশল অবলম্বন করছি—ধোঁকাবাজি, ছলনা। ওই ব্লাডি ফুলিশ হিউম্যানদের সঙ্গে ওদের মতো করেই খেলতে হয়।”
স্ক্রিনের অন্য প্রান্তে ড্রাকোনিসের মুখে উদ্বেগের ছাপ পড়ে। তার কণ্ঠ ভারী হয়ে ওঠে,”মাই সান! যা-ই করো, সাবধানে করো। তোমার কোনো ক্ষতি হলে ভেনাসের ওপর এক চরম বিপর্যয় নেমে আসবে। তুমি শুধু আমাদের আশা নয়, তুমি এই সাম্রাজ্যের প্রিন্স।”
জ্যাসপার চুপচাপ শোনে মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবনা-চিন্তা করে। তারপর তার কণ্ঠে আরেকবার ভেসে আসে দৃঢ় প্রত্যয়, “ড্রাকোনিস, আমি জানি আমার দায়িত্ব কী। আমি ব্যর্থ হবো না।”

সন্ধ্যার আলোতে, ফিওনা তার পড়াশোনার টেবিলের পাশে বসে ছিল। বইয়ের পাতায় তার দৃষ্টি নিবদ্ধ, কিন্তু মনে মনে কিছুটা ক্লান্তি অনুভব করছিল। ঠিক তখনই লিয়া হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়াল।
“ফিওনা,” লিয়ার গলার স্বর মিষ্টি, “কী করছো ফিওনা ? চলো না বাইরে থেকে একটু আইসক্রিম খেয়ে আসা যাক?”
ফিওনার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল।
“আইসক্রিম! সত্যি বলছো? কেন নয়!” সে বলল, উৎসাহিত হয়ে। “অবশ্যই যাবো।”
লিয়া হাসতে হাসতে বলল, “তাহলে চল, দ্রুত রেডি হয়ে নেয়া যাক।”
ফিওনা ফোন তুলল আর লিনকে কল করল। “হ্যালো, লিন! আমি আর লিয়া একসঙ্গে একটু বের হয়ে আইসক্রিম খেতে যাবো। তুই কি আসবি?”
লিনের গলা টেলিফোনে ভেসে এলো, ” কেনো নয় অবশ্যই, আমি আসছি!”
নভেম্বরের হিমেল সন্ধ্যা। বেইজিং শহরের রাস্তা তখন অল্প আলোতে ঝলমল করছে, হালকা ঠান্ডায় শহরের রূপ আরও স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে। ফিওনা আর লিয়া ডরমিটরির দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল। দুজনেই ফ্ল্যানেল স্কার্টে জড়ানো, ফিওনার পরনে সাদা টপস আর লিয়ার কালো। লম্বা স্কার্টগুলো বাতাসে মৃদু দুলছিল, সেই মুহূর্তে শীতলতার সাথে লেপ্টে থাকা কোনো সুর।
ভার্সিটির গেটের কাছে অপেক্ষায় বসে আছে লিন।

তার গাড়ির হেডলাইটগুলো গেটের সামনের প্রাঙ্গণকে আলোকিত করছে। ফিওনা আর লিয়া গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে লিন জানালার কাঁচ নামিয়ে বলে উঠলো,
“অবশেষে রেডি হলে! ঠান্ডা পড়েছে, শীতের রাতের প্রথম আইসক্রিম খেতে যাচ্ছি!”
ফিওনা মৃদু হেসে উত্তর দিলো, “শীত যতই পড়ুক, আইসক্রিমের স্বাদে তো ভাটা পড়বে না।”
তিনজন মিলে গাড়িতে উঠল, লিয়া আর ফিওনা পেছনের সিটে আর লিন স্টিয়ারিং ধরল সামনের দিকে।গাড়ির শব্দের সাথে সাথে রাতের জড়তা কেটে গেল।
বেইজিং শহরের আলো আর ঠান্ডা বাতাসের মাঝ দিয়ে গাড়িটি এগিয়ে চলল। কিছুক্ষণ পর গাড়ি এসে থামল ওনান মার্কেটের সামনে। চারদিকে রাস্তার ছোট ছোট ভেন্ডরদের ভিড়, আইসক্রিম থেকে শুরু করে নুডলস, জিনিসপত্র বিক্রি চলছে মনে হচ্ছে উৎসবের আমেজে। ফিওনা আর লিয়া গাড়ি থেকে নেমেই মুগ্ধ চোখে চারদিকে তাকাল।
“এখানকার খাবারের গন্ধ আমাকে পাগল করে দিচ্ছে,” লিয়া হেসে বলে উঠলো।
“ঠিক বলেছ,” লিন যোগ করে, “আমার তো মনে হচ্ছে আমরা প্রথমে আইসক্রিম না খেয়ে এইবার কিছু গরম গরম নুডলস খেয়ে নেই!”
“হুমম… তোমার কথা শুনেই ক্ষুধা বেড়ে গেল,” ফিওনা চোখ ছোট করে মুচকি হেসে জবাব দিলো, “তবে প্রথমে কিন্তু আইসক্রিম।”
তিনজন একসাথে বাজারের আলো আর ঠান্ডা বাতাসের মাঝে হাঁটতে শুরু করল।

ওদের তিনজনের হাতে তখন রঙিন কাপে ভরা একি ফ্লেভারের আইসক্রিম—মিল্ক চকলেট। শীতল সন্ধ্যার মধ্যেও আইসক্রিমের মিষ্টি স্বাদ তাদের আনন্দ দ্বিগুণ করে দিচ্ছিলো।
ফিওনা একবার চামচে তুলে নিয়ে ছোট্ট কামড় দেয়, ঠান্ডা আইসক্রিমের গন্ধ আর স্বাদ জিভে মিশে যায়। লিয়া আর লিনের কণ্ঠস্বর হাসি-আড্ডায় ভাসছে, অথচ ফিওনার মন অদ্ভুতভাবে ছটফট করতে লাগলো। কিছু একটা যেন ঠিক নেই—কেউ ওকে দূর থেকে লক্ষ্য করছে, এই অস্বস্তিকর অনুভূতিটা তার বুকে হঠাৎ চাপ সৃষ্টি করলো।
ফিওনা তীক্ষ্ণভাবে আশেপাশে তাকালো। ছোট দোকানগুলোতে আলোর ঝিলিমিলি, মানুষের ব্যস্ততা, কোলাহল। কিন্তু কোলাহলের মধ্যেও ফিওনা একটা অদৃশ্য উপস্থিতি অনুভব করল। কারও দৃষ্টি ওর দিকে নিবদ্ধ, নীরব, তবুও তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।
“ফিওনা, তুই কী দেখছিস?” লিন তার কাঁধে আলতো স্পর্শ করে বললো, “শোন, আমরা দুজন সামনের শোরুমটায় একটু শপিং করতে যাচ্ছি। তুই কি আসবি?”
ফিওনা একটু চমকে উঠে হেসে বললো, “না, তোরা যা। আমি এখানে থাকছি। আইসক্রিমটা শেষ করতে চাই।”
লিয়া হেসে বলল, “ঠিক আছে, তবে আমাদের দেরি হলে চলে আসিস। তুই থাকিস না বেশি সময়।”
“আরে না,” ফিওনা নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলো, “আমি এখানে আছি। তোরা যা।”
লিয়া আর লিন চলে গেলো সামনের দিকের শোরুমের দিকে। ফিওনা আবার চারপাশে তাকাল, মনে হলো ছায়ায় ঢাকা কোনো দৃষ্টি ওর প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করছে।

ফিওনা আইসক্রিমের স্বাদে ডুবে আছে, ঠান্ডা বাতাসে মিষ্টি অনুভূতি তার মনকে প্রশান্ত করছে। চারপাশের মানুষের কোলাহল তার কানে ধরা দিচ্ছে না, ফিওনার মনোযোগ একমাত্র তার আইসক্রিমে।
হঠাৎ পেছন থেকে একটা গম্ভীর কিন্তু মৃদু কণ্ঠ ভেসে এলো, যা তার প্রশান্তি ভেঙে দিলো।
“আমাকে আইসক্রিম খাওয়াবেনা? একাই খাবে নাকি?”
ফিওনা চমকে উঠে, হৃৎপিণ্ড মুহূর্তেই দ্রুত গতিতে ধাক্কা দিতে শুরু করলো। দ্রুত পেছনে ফিরে তাকায়,আর তখনই তাকে দেখতে পায়—সেই রহস্যময় পুরুষ, যাকে সে আগেও দেখেছে। আজও তার মুখে মাস্ক, চোখে গাঢ় সানগ্লাস, এবার পরনে সাদা হুডি। আগের মতোই অদ্ভুতভাবে রহস্যময়,আর তার উপস্থিতি এক অজানা শীতলতা বয়ে আনলো ফিওনার চারপাশে।
ফিওনার গলা শুকিয়ে আসে,তবে সে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করে। তার কণ্ঠস্বর ধীর,তবে বিস্ময় স্পষ্ট, “আপনি আবার এখানে?”

জ্যাসপার মৃদু হাসল, যা তার মাস্কের আড়ালেও অনুভব করা গেলো। “আজকে তোমাকে আবার দেখার জন্য আসিনি। কিন্তু মনে হলো, একা একা আইসক্রিম খাওয়া উচিত নয়, তাই ভাবলাম তোমার সঙ্গ দেই।”
ফিওনা তাকিয়ে রইল, তার হাতের আইসক্রিমটা কীভাবে অদ্ভুতভাবে ভারী লাগছে। “আপনি আসলে কে? এভাবে আমাকে ফলো করছেন কেন?”
জ্যাসপার সামান্য হেসে বললো, “ফলো করছি না। দেখা হওয়া তো কাকতালীয়। তবে যদি আমাকে তুমি একটা আইসক্রিম খাওয়াতে চাও, তবে সেটা আপত্তি হবে না।”
ফিওনার মনের ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। তার সামনে দাঁড়ানো লোকটি যেন অন্য কোনো পৃথিবীর—তার উপস্থিতি ব্যাখ্যা করা যায় না, কিন্তু এড়িয়ে যাওয়া আরও অসম্ভব।
ফিওনা সামান্য বিরক্তি আর বিস্ময় মিশ্রিত চোখে জ্যাসপারের দিকে তাকায়, কিন্তু তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। সে ঠান্ডা কণ্ঠে বলল, “আপনি আমাকে সেদিন বাঁচিয়েছিলেন,সেই কৃতজ্ঞতার সুবাদে একটা আইসক্রিম খাওয়াতেন পারি । তো বলুন, কোন ফ্লেভারের আইসক্রিম খাবেন?”
জ্যাসপার নিঃশব্দে কিছুক্ষণ ফিওনার দিকে তাকিয়ে থাকে,অবশেষে তার ঠোঁট থেকে ধীরস্থিরভাবে বেরিয়ে আসে একটি শব্দ, “ফিওনা।”

ফিওনা বিস্ময়ে থমকে দাঁড়ায়, তার কপাল ভাঁজ করে বলল, “কী?”
জ্যাসপার মৃদু হেসে বলল, “না মানে, বলছিলাম, তোমার নাম ফিওনা, তাই তো?”
ফিওনা আরও অবাক হয়। তার নাম জানে এই অজানা লোকটি? এক মুহূর্ত চুপ থেকে সে বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু… আপনি কীভাবে জানলেন?”
জ্যাসপার নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “জানা তো গুরুত্বপূর্ণ নয়। আসল কথা হচ্ছে, আমি চকলেট ফ্লেভারের আইসক্রিম খাবো।”
ফিওনা ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে ঠোঁট কামড়ে ধরে। সেই শীতল,অদ্ভুত আভাস আজও আছে লোকটির আচরণে। একটু ঠোঁট বাঁকিয়ে সে বলল, “আচ্ছা, তবে আইসক্রিম খেতে হলে তো মুখের মাস্ক খুলতে হবে, তাই না?”
জ্যাসপার তার সানগ্লাসের পেছনে লুকানো দৃষ্টিতে হাসল,ফিওনার প্রস্তাবটি শুনে একধরনের অদ্ভুত আনন্দ পেলো। কিন্তু তার চোখের ভাষা অস্পষ্ট রয়ে গেল।
জ্যাসপার এক পা সামনে এগিয়ে এসে ফিওনার দিকে তাকায়। তার ঠোঁটের কোণে একধরনের রহস্যময় হাসি খেলছে। হাওয়ার ঠান্ডা স্পর্শে ফিওনার ত্বক শিহরিত হয়, কিন্তু তার দৃষ্টি জ্যাসপারের মাস্কের দিকে স্থির হয়ে থাকে। জ্যাসপারের স্বর আরও নিচু হয়ে যায়।

“তুমি আমার চেহারা দেখার জন্য বেশ কৌতূহলী,তাই না?” লোকটি ফিসফিসিয়ে বলল। তার কথায় একধরনের বিদ্রূপ ঝরে পড়ে। “আচ্ছা, আমি তোমাকে আমার চেহারা দেখাবো… তবে একটা শর্ত আছে।”
ফিওনার ভ্রু কুঁচকে গেল। শর্ত? তার মনে একটা অস্বস্তি জন্মালেও কৌতূহল আরও জোরালো হলো। “কী শর্ত?” ফিওনা জিজ্ঞেস করল, কণ্ঠে একরকম সতর্কতা।
জ্যাসপার থেমে হালকা হাসল। মনে হলো শিকারীর মতো তার ফাঁদে কেউ পা দিতে যাচ্ছে। “তোমাকে আমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে হবে।”
ফিওনা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। এই লোকের ইচ্ছাগুলো ধোঁয়াশায় মোড়ানো। বন্ধুত্ব? এই অদ্ভুত লোকের সাথে বন্ধুত্ব? ফিওনার মনে নানা প্রশ্ন ভেসে উঠতে থাকলেও তার কৌতূহল তাকে আটকে রাখল। মাস্কের আড়ালে থাকা চেহারাটা দেখতে চাইছে সে—কিন্তু এর মূল্য কী?

“বন্ধুত্ব?” ফিওনা অবশেষে ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করল। “শুধু এই?” লোকটি মৃদু হাসল।
জ্যাসপার হঠাৎ করে ফিওনার কাঁধের পাশ দিয়ে দূর থেকে লিন আর লিয়াকে আসতে দেখল। চোখে একটা সতর্কতার ঝিলিক ফুটে উঠল সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। সে এবার ফিওনার দিকে তাকিয়ে তাড়াহুড়ো করে বলল, “আচ্ছা, তবে আগামীকাল সন্ধ্যায় তুমি আমার সাথে দেখা করো বেহাই লেকের পাড়ে।”

আযদাহা পর্ব ৫

তার কণ্ঠে এমন কিছু ছিল,যা ফিওনাকে বাধ্য করল মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যেতে। কিছু বলার আগেই লোকটি দ্রুত গতিতে পিছিয়ে গেল, তার হুডি বাতাসে হালকা দোল খেলো, আর চোখের পলকেই সে স্রেফ মিলিয়ে গেল জনতার ভিড়ে।
ফিওনা কিছুটা হতভম্ব হয়ে তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইল, জ্যাসপারের কথাগুলো মনের মধ্যে প্রতিধ্বনি তুলছে। ‘বেহাই লেক… কাল সন্ধ্যা…’

আযদাহা পর্ব ৭