আযদাহা শেষ পর্ব
সাবিলা সাবি
রাতের আকাশে নক্ষত্ররা ঝিকমিক করছে।জ্যাসপার আর ফিওনা দ্বীপের পাথরের ওপর বসে ছিল।ফিওনা জ্যাসপারের কাঁধে মাথা রেখে নিঃশব্দ প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছিল।কিন্তু হঠাৎই আকাশে দূরে একটা ছোট আলো দেখে ফিওনার চোখ স্থির হয়ে গেল।
“ওটা কী,প্রিন্স?”ফিওনা বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করলো।
জ্যাসপার আলোকবিন্দুর দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তেই বুঝতে পারলো ওটা হেলিকপ্টার।তার বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো।সে জানতো,মিস্টার চেন শিং এসে গেছে ফিওনাকে নিয়ে যেতে।
ফিওনার দিকে চোখ না ফিরিয়েই জ্যাসপার শান্ত কণ্ঠে বললো,”হেলিকপ্টার।”
হেলিকপ্টারটা কাছাকাছি আসতেই ফিওনা স্পষ্ট দেখতে পেলো।তার মুখে বিস্ময়ের ছাপ আরও স্পষ্ট হলো।”হেলিকপ্টার?এখানে হেলিকপ্টার আসলো কীভাবে?আর কারা আসছে?”
জ্যাসপার জানতো,উত্তর দেওয়ার সময় আসেনি।সে নিঃশব্দে ফিওনার পাশে বসে রইলো,তার হৃদয়ে এক অনির্বচনীয় শূন্যতা নিয়ে।
হেলিকপ্টারটি দ্বীপের আরও কাছে আসতেই বাতাসে ঝড়ের মতো ঝাপটা শুরু হলো।ফিওনা আর জ্যাসপারের চুল বাতাসে উড়তে লাগলো।ফিওনা চমকে গেলেও তার চোখে একটা প্রশ্ন ভেসে উঠেছিল,”কে আসছে?”
জ্যাসপার তখন ফিওনাকে ধীরে ধীরে তুলে দাঁড় করালো।তার চোখে এক ধরনের স্থিরতা,যেন সে সবকিছু আগে থেকেই জানে।
হেলিকপ্টারটি দ্বীপে নেমে থামলো,আর দরজা খুলতেই বেরিয়ে এলেন মিস্টার চেন শিং।ফিওনা প্রথমে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো,তারপর আনন্দে চিৎকার করে বললো,”গ্র্যান্ডপা!”
ফিওনা খুশিতে দৌড়ে গিয়ে তার গ্র্যান্ডপার বুকে জড়িয়ে ধরলো।চেন শিং ফিওনাকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন,”তোমাকে নিতে এসেছি ফিওনা।”
ওদিকে,জ্যাসপার দ্রুত তার স্মার্ট ঘড়িতে একটা সিগন্যাল পাঠালো।এটা এমন এক সিগন্যাল যা সরাসরি ভেনাসে পৌঁছে তার লোকেশন ট্র্যাক করতে সাহায্য করবে।সে জানে,তার শক্তি এখন কম,একা ভেনাসে ফেরা তার পক্ষে সম্ভব নয়।তাই তার সদস্যদের দ্বীপে আসার জন্য এই সংকেত পাঠালো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জ্যাসপার নিজেই যেন দ্বিধায় ছিল—একদিকে ফিওনাকে নিরাপদে দেখতে চাওয়ার তীব্র ইচ্ছা,আর অন্যদিকে তাকে ছেড়ে যাওয়ার যন্ত্রণার দংশন।কিন্তু সে জানে,এই মুহূর্তে ফিওনাকে তার স্থানে ফিরে যেতে দিতে হবে।
ফিওনা খুশিতে উজ্জ্বল মুখে বললো,”প্রিন্স,দেখেছো? গ্র্যান্ডপা আমাদের নিতে এসেছে!”
তারপর সে আনন্দে চেন শিং-এর হাত ধরলো।কিন্তু হঠাৎ তার মনে প্রশ্ন জাগলো।ফিওনা তার গ্র্যান্ডপার চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো”গ্র্যান্ডপা,তুমি কিভাবে জানলে আমরা এখানে?এই দ্বীপের লোকেশন তুমি কিভাবে পেলে?”
ঠিক তখনই হেলিকপ্টার থেকে চেন শিং-এর বন্ধু হুয়াং ঝি নেমে এলেন।তিনি ফিওনার দিকে তাকিয়ে বললেন,”তোমার শিপ যখন ব্লা*স্ট হলো,তখন তোমার গ্র্যান্ডপা অনেক ভেঙে পড়েছিলেন।এমনকি তিনি স্ট্রো*ক করেছিলেন,যদিও এখন পুরোপুরি সুস্থ আছেন।আর এই লোকেশনের কথা জানতে পেরেছি জ্যাসপারের থেকে।সে আমাদের সিগন্যাল পাঠিয়েছিল।”
ফিওনা তার গ্র্যান্ডপাকে জড়িয়ে ধরে চিন্তিত স্বরে বললো,”গ্র্যান্ডপা,তুমি এতটা কষ্ট পেয়েছো?আমি জানতাম না!”
তারপর সে ধীরে ধীরে জ্যাসপারের দিকে ঘুরে তাকালো।তার চোখে অবিশ্বাস আর অভিমান মিশে ছিল।”তুমি সিগন্যাল পাঠিয়েছিলে?তাহলে তুমি জানতে গ্র্যান্ডপা আসবে?আমাকে একবারও জানাওনি কেনো?”
জ্যাসপার তার চোখ নামিয়ে নিলো।তার কণ্ঠ ছিল শান্ত কিন্তু গভীর, “কারণ আমি জানতাম,ফিওনা,তুমি যদি জানতে,তাহলে হয়তো আমাকে ছেড়ে যেতে চাইতে না।কিন্তু তোমাকে তো নিরাপদে বাড়িতে ফিরিয়ে দিতেই হতো।আমি শুধু চাই,তুমি সেইফ থাকো।”
ফিওনা হতভম্ব হয়ে গেলো।তার হৃদয়ে জ্যাসপারের কথাগুলো গভীরভাবে বাজলো,কিন্তু অভিমান আর ভালোবাসার মধ্যে একটা টানাপোড়েন চলতেই থাকলো।
ফিওনা বিস্মিত কণ্ঠে বলল,”তুমি কি বলছো,প্রিন্স?আমি কেন তোমাকে ছেড়ে যাবো?তুমি তো আমাদের সাথেই যাবে,চীনে যাবে,তাই না?”
জ্যাসপার শান্ত গলায় উত্তর দিল, “না,ফিওনা।আমাকে ভেনাসে ফিরতে হবে।তুমি তাদের সাথে যাও,নিরাপদে চীনে ফিরে যাও।”
জ্যাসপারের এই কথা শুনে ফিওনার চোখ ছলছল করে উঠলো।সে দৌড়ে এসে তার হাত শক্ত করে ধরে ফেললো।”কখনোই না!একবার তোমাকে ভেনাসে যেতে দিয়েছিলাম।তারপর তুমি ফিরে আর আসোনি।কত মাস অপেক্ষা করেছি তোমার জন্য।কত কষ্ট নিয়ে সেই দিনগুলো কাটিয়েছি।”
তার কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠলো। “তোমাকে ভেনাসে পাঠানোর পর আমি যখন ভেনাসে গিয়েছিলাম,তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলে,আমার হৃদয় ভেঙেছিল।আমি আর সেই ভুল করতে পারবো না,প্রিন্স!আমি তোমাকে আর ভেনাসে ফিরতে দেবো না!”
ফিওনার কণ্ঠে জেদ আর ভালোবাসার মিশ্রণ ছিল। জ্যাসপার নীরব হয়ে ফিওনার দিকে তাকিয়ে রইলো।
জ্যাসপার ফিওনার দুই বাহু ধরে নরম গলায় বলল, “হামিংবার্ড,বোঝার চেষ্টা করো,আমাকে ভেনাসে যেতেই হবে।তুমি যদি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো,তাহলে এখনই তোমার গ্রান্ডপাকে নিয়ে ফিরে যাও।”
ফিওনা তার কথায় কেঁপে উঠলো।চোখে জল জমে উঠল।সে জ্যাসপারকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি যাবো না,প্রিন্স।আমি তোমাকে রেখে কিছুতেই যাবো না।একবার তোমাকে হারিয়েছিলাম,আর হারানোর মতো শক্তি আমার নেই।তুমি আমার সব,আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারবো না।”
তার কণ্ঠ ভেঙে এল,আর কান্নারত চোখ দিয়ে জ্যাসপারের দিকে তাকালো।জ্যাসপার ফিওনার এই অবস্থা দেখে মুহূর্তের জন্য নীরব হয়ে গেল।তার হৃদয়ে এক অজানা বেদনা খেলে গেল,কিন্তু সে জানতো তার সিদ্ধান্তের পেছনে একটা বড় কারণ আছে।
দ্বীপের বাতাস ভারী হয়ে উঠলো,মাটি কাঁপছিল।হঠাৎ করেই একটা বড় আগুনের গোলা জ্যাসপারের পাশ দিয়ে ছুটে গেল।সেই আগুনের তীব্র ধাক্কায় ফিওনা দূরে ছিটকে পড়লো।জ্যাসপার দ্রুত তার দিকে ছুটে যাওয়ার আগেই আকাশে তাকিয়ে দেখলো—দুইটা বিশাল ড্রাগন ভেসে আছে।
মিস্টার চেন শিং ফিওনার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করতেই তাদের ওপর আক্র*মণ শুরু হলো।জ্যাসপার বুঝতে পারলো,এরা সেই ড্রাগন যারা অনেক বছর আগে ভেনাস থেকে বিতাড়িত হয়েছিল।তবে তাদের আচরণ স্পষ্ট করছিল,তারা ভেবেছে হেলিকপ্টার আক্রমণের জন্য এসেছে,তাই পাল্টা আক্রমণ করছে।
জ্যাসপার জোরে চিৎকার করে বললো, “মিস্টার চেন শিং,এখনই ফিওনাকে নিয়ে এখান থেকে চলে যান!
এই জায়গাটা এখন আর নিরাপদ নয়।”
চেন শিং দৌড়ে ফিওনার কাছে এগিয়ে যাচ্ছিলেন,কিন্তু ফিওনা দ্রুত উঠে জ্যাসপারের বুকে জাপ্টে পড়লো। চারপাশে গাছে গাছে আ*গুন জ্বলছিল,দ্বীপটা যেন এক ভয়াবহ যু*দ্ধে রূপ নিয়েছে।
জ্যাসপার ফিওনার হাত ধরে বললো,”হামিংবার্ড,তুমি যদি এখানে থাকো,তাহলে আমি লড়াইয়ে মন দিতে পারবো না।তোমার নিরাপত্তাই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।প্লিজ,ফিরে যাও।”
কিন্তু ফিওনা কেঁদে বললো, “আমি তোমাকে ছাড়তে পারবো না,প্রিন্স।তুমি এখানে একা বিপদে থাকবে,আর আমি সরে যাবো?কখনোই না!”
দূর থেকে ড্রাগন দুটো আরেকবার আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল।জ্যাসপার দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে বুঝতে পারলো।
দ্বীপের পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়াবহ হয়ে উঠছিল।মিস্টার চেন শিং বারবার ফিওনাকে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করলেও সে নড়তে রাজি নয়।ফিওনা বারবার জ্যাসপারের নাম ধরে চিৎকার করছে,তার চোখে আতঙ্ক আর দুঃখের ছাপ স্পষ্ট।
জ্যাসপার ততক্ষণে ড্রাগন রূপ ধরে ড্রাগন দুটির সঙ্গে তীব্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল।আগুন আর ধোঁয়ার কুণ্ডলী ভরে উঠছিল চারপাশে।ফিওনার চিৎকার তার মনোযোগ বিচলিত করছিল,কিন্তু সে জানত,এই মুহূর্তে তাকে মনোযোগ ধরে রাখতেই হবে।
অনেকক্ষণ তীব্র লড়াইয়ের পর,শেষমেশ জ্যাসপার ড্রাগন দুটিকে পরাস্ত করলো।তারা গর্জন করতে করতে দ্বীপের অন্য প্রান্তে পালিয়ে গেল।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে মানব রূপে ফিরে এল।কিন্তু তার শরীর ছিল র*ক্তাক্ত—গলায় আর গালে গভীর ক্ষ*তচিহ্ন,শরীরজুড়ে আঁ*চড়ের দাগ।সে কাতর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল,তার নিঃশ্বাস ভারী।
ফিওনা এবার আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না।তার গ্র্যান্ডপা তাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছিলেন,কিন্তু ফিওনা হাত ছিঁড়ে ছুটে গেল।কয়েকবার মাটিতে হোঁচট খেলেও থামেনি।শেষমেশ জ্যাসপারের কাছে পৌঁছে তার বুকে জাপটে পড়লো।
“তুমি ঠিক আছো,প্রিন্স?এত র*ক্ত কেন?আমি তোমাকে এভাবে দেখব ভাবিনি!” ফিওনার কণ্ঠ কাঁপছিল,চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল।
জ্যাসপার তার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললো, “আমি ঠিক আছি,হামিংবার্ড।
ফিওনা জোরে কাঁদতে লাগলো,আর জ্যাসপার তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিল।
দ্বীপের আকাশে ঘন ধোঁয়া আর দূর থেকে ড্রাগনের গ*র্জন যুদ্ধের ভয়াবহতা ঘোষণা করছিল।আগুনে পুড়ে যাওয়া গাছপালার ভেতর লড়াইয়ের প্রথম রাউন্ড শেষ হলেও উত্তেজনা থামেনি।পরিস্থিতি ক্রমেই আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছিল।
এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই জ্যাসপার ফিওনাকে কঠোরভাবে নির্দেশ দিলো, “হেলিকপ্টারে ওঠো,এখনই!” তার কণ্ঠে তীব্র দৃঢ়তা।কিন্তু ফিওনা জ্যাসপারকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলো,যেন তাকে ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। “আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না!” ফিওনার কণ্ঠে ছিল ভীষণ ভালোবাসা আর অবিশ্বাস্য জেদ।
চেন শিং পরিস্থিতি সামলাতে ফিওনাকে পুনরায় টেনে হেলিকপ্টারে তুলতে চাইছিল।কিন্তু ফিওনা বারবার তার বাঁধন আরও শক্ত করছিল জ্যাসপারের চারপাশে।তার চোখে যেন স্পষ্ট বার্তা—জ্যাসপার ছাড়া সে নিরাপদ থাকতে চায় না।
জ্যাসপার এক মুহূর্তের জন্য ফিওনার চোখের দিকে তাকালো।সেখানে ছিল ভালোবাসা,ভয় আর জেদ—সবকিছু একসাথে।সে শান্ত গলায় বললো, “হামিংবার্ড,বোঝার চেষ্টা করো।ফিরে যাও।এটা তোমার নিরাপত্তার জন্য।”
কিন্তু ফিওনা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,”তুমি আমার নিরাপত্তা,প্রিন্স!আমি তোমাকে আর একবার হারাতে পারবো না।”
এদিকে,দ্বীপের আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ঘন হতে থাকলো।আগুনে জ্বলতে থাকা গাছগুলো থেকে লেলিহান শিখা আরও ছড়িয়ে পড়ছিল।জ্যাসপার বুঝতে পারলো,পরিস্থিতি আর হাতের বাইরে যেতে দেরি নেই।
চেন শিং একবার আবার ফিওনাকে টানতে গিয়ে বললেন, “ফিওনা,সময় নেই।আমাদের এখান থেকে যেতে হবে!”
কিন্তু ফিওনা তার গ্ৰান্ডপার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে জ্যাসপারের দিকে ফিরে দাঁড়ালো।চোখ ভেজা,কিন্তু কণ্ঠে দৃঢ়তা, “তোমাকে একা রেখে আমি কোথাও যাবো না প্রিন্স।”
ঠিক তখনই ভুমিকম্পের মতো কেঁপে উঠলো পুরো দ্বীপ।আকাশে ভেসে উঠলো আগুনের বিশাল গোলা। জ্যাসপার বুঝলো,তাদের সময় শেষ হয়ে আসছে।সে চিৎকার করে বললেন, “মিস্টার চেন শিং,ফিওনাকে নিয়ে এখান থেকে চলে যান!এখনই!”
কিন্তু ফিওনা দাঁড়িয়ে ছিল জ্যাসপারের সামনে,যেন তাকে ছাড়ার জন্য প্রস্তুত নয়।জ্যাসপার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।পরিস্থিতি যে কতটা জটিল হয়ে উঠেছে,সেটা তার চেয়ে ভালো কেউ জানে না।কিন্তু এই মুহূর্তে তার লক্ষ্য ছিল একটাই—ফিওনার সুরক্ষা।
ড্রাগনদের গর্জনে পুরো দ্বীপ কেঁপে উঠছিল,আকাশে ঘন কালো মেঘ জমে উঠেছে,আর আগুনের ছটা চারপাশকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে।জ্যাসপার নিজের রূপান্তর শুরু করলো,তার ড্রাগন রূপে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।ফিওনা বারবার তার বুকে জড়িয়ে ধরে বলছিল, “আমি তোমাকে এভাবে বিপদে রেখে যেতে পারবো না,প্রিন্স!”
জ্যাসপার গভীর কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,”হামিংবার্ড, আমার জন্য এই একবার কথা শোনো।তোমাকে এখানে রাখলে আমি পুরো শক্তি দিয়ে লড়াই করতে পারবো না।তুমি চলে যাও।”
ফিওনা মাথা নেড়ে কাঁপা কণ্ঠে বলল,”না,আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারবো না।মরে গেলেও না।”
ঠিক তখনই আকাশ ফেটে যেন আরও ভয়ঙ্কর ড্রাগনের গর্জন শোনা গেল।চারপাশে আগুনের বড় বড় গোলা পড়তে লাগলো।কয়েকটি ড্রাগন ইতোমধ্যেই নেমে এসেছে।তাদের লাল চোখ আর আগুনের নিঃশ্বাস দেখে বোঝা যাচ্ছিল,এ লড়াই সহজ হবে না।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিওনার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছিল,কিন্তু ফিওনা তাকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল যে জ্যাসপারের শক্তিও ব্যর্থ হচ্ছিল।সে চিৎকার করে বলল,”মিস্টার চেন শিং,তাকে নিয়ে যান!এখনই!এরা খুব ভ*য়ংকর ওরা সবাইকে মেরে ফেলবে।”
চেন শিং আর হুয়াং ঝি দ্রুত ফিওনার দিকে এগিয়ে এলো।দুজনে মিলে ফিওনাকে টেনে নিতে শুরু করলো।কিন্তু ফিওনা বারবার তাদের হাত থেকে ছুটে আসার চেষ্টা করছিল।তার মুখে ছিল কাঁপা কণ্ঠ আর অশ্রুভেজা চোখ। “প্রিন্স!আমাকে যেতে দিও না।
আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না!”
জ্যাসপার ফিওনার দিকে শেষবারের মতো গভীরভাবে তাকালো।তার চোখে ছিল বেদনা আর কঠিন সিদ্ধান্তের ছাপ।তারপর সে ড্রাগন রূপে রূপান্তরিত হয়ে আকাশে উড়ে গেল।
ফিওনা চিৎকার করে বলছিল,”প্রিন্স!আমি তোমাকে ছেড়ে এখান থেকে এক পা ও নড়বোনা!”
চেন শিং আর হুয়াং ঝি কাঁপা হাতে তাকে ধরে রেখেছিল,কারণ তারা জানতো—এটাই ফিওনার সুরক্ষার একমাত্র উপায়।আর আকাশে,জ্যাসপার ড্রাগনদের সাথে এক মহারণে লিপ্ত হলো।
ড্রাগনদের গর্জনে পুরো দ্বীপ কেঁপে উঠছিল যখন আকাশে পাঁচটি বিশাল ড্রাগন এসে হাজির হলো।তাদের চোখগুলো ছিল আগুনের মতো লাল,আর পাখার ছায়া যেন পুরো দ্বীপকে ঢেকে ফেলছিল।প্রতিটি ড্রাগন তাদের গর্জনে আর অগ্নিশিখায় জ্বলন্ত শত্রুতা প্রকাশ করছিল,স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল তারা প্রতিশোধের জন্য এসেছে।
জ্যাসপার,ড্রাগন রূপে রূপান্তরিত থাকা অবস্থায় তাদের দিকে গভীরভাবে তাকালো,সে বুঝতে পারলো,ড্রাকোনিসের আদেশে তারা ভেনাস থেকে বিতাড়িত হয়ে ছিলো।আর আজ তারা তার সে কারনেই জ্যাসপারের উপর হামলা চালাতে চাচ্ছে।তাদের শত্রুতা যেন কোনো ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের ফল,আর জ্যাসপার এতে দিশেহারা হতে লাগলো।
তবে জ্যাসপার নিজেকে ভেঙে পড়তে দিতে চাইল না।তার ভয়ের কারণ ছিল ফিওনা—যার নিরাপত্তা নিয়ে সে চিন্তিত ছিল।সে জানতো যদি যুদ্ধ শুরু হয়,তাহলে ফিওনার জন্য তা কতটা বিপজ্জনক হতেপারে।তার মনে হয়েছিল,যদি সে নিজেকে রক্ষা না করে,তাহলে ফিওনার জীবনও হু*মকির সম্মুখীন হতে পারে।
ড্রাগনদের গর্জন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছিল,আর জ্যাসপার এর মাঝে একটি স্থিরতা খুঁজছিল।তার মনের মধ্যে একটি সঙ্কল্প ছিল—যাই হয়ে যাক না কেন সে ফিওনাকে রক্ষা করবে।
আর তখন,জ্যাসপার ড্রাগনদের দিকে নজর রেখে,নিজের শক্তি একত্রিত করতে শুরু করলো।তার গর্জন যেন আকাশের বুকে বাজের মতো প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল,আর সে প্রস্তুতি নিচ্ছিল।আজকের এই লড়াইয়ে,সে কেবল নিজের নয়,বরং ফিওনার জীবনও রক্ষার সংকল্প নিয়েছে।
জ্যাসপার যখন আকাশে লড়াই করছিল,তখন মিস্টার চেন শিং আর হুয়াং ঝি ফিওনাকে হেলিকপ্টারের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন।তাদের মুখে উদ্বেগের ছাপ ছিল,কারণ তারা জানতো,ফিওনাকে রক্ষা করা কতটা জরুরি।
হঠাৎ করেই,পাঁচটি ড্রাগন আক্রমণ শুরু করলো।তাদের বিশাল শরীরের সাথে জ্যাসপারের সংঘর্ষ হল।একটি ড্রাগনের আক্রমণের ফলে জ্যাসপার একটি বড় গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে নিচে আঁচড়ে পড়লো।
ফিওনার হৃদয়ে যেন বিদারক ধাক্কা লেগে গেল।সে চিৎকার করে উঠলো,”প্রিন্স!” আর তার দিকে ছুটে আসতে চাইলো।কিন্তু চেন শিং দ্রুত তাকে ধরে রাখলেন।“না,ফিওনা!ওখানে যেও না!”চেন শিংয়ের কণ্ঠে অশান্তি ছিল।
ফিওনার চোখে জল জমে গেল।সে বুঝতে পারছিল না, কিভাবে সে তার ভালোবাসাকে রক্ষা করতে পারে।
“আমি কি কিছু্ই করতে পারবো না আমার প্রিন্সের জন্য!” সে আর্তনাদ করলো।
হুয়াং ঝি ফিওনাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন,“আমরা তাকে সাহায্য করতে পারবো,কিন্তু তুমি যদি এখানে থাক,তাহলে তুমি বিপদের সম্মুখীন হবে।অন্য উপায় ভাবতে হবে।
কিন্তু ফিওনার চোখে ছিল দৃঢ়তা।“আমি তাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবো না!” সে চিৎকার করে বললো,তার প্রতিটি শব্দ যেন তার প্রেমের শক্তি প্রকাশ করছিল।
জ্যাসপার তার দুর্বল মানব শরীর থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো।এক মুহূর্তের জন্য সে আকাশের দিকে তাকালো,তারপর তার অন্তরের শক্তি সঞ্চয় করে আবারও ড্রাগন রূপে ফিরে এল।বিশালাকৃতির ড্রাগন হিসেবে সে আকাশে উড়তে লাগলো,চেতনাতে গর্জন আর আগুনের শিখা নিয়ে।যুদ্ধের ময়দানে সে প্রান দিতে প্রস্তুত ছিল,তবুও হার মানবে না—কারণ সে ড্রাগন প্রিন্স।যার রক্তে প্রবাহিত হচ্ছে যুদ্ধের ইতিহাস আর বীরত্বের গর্ব।
ফিওনা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল।মিস্টার চেন শিং-এর দিকে তাকিয়ে বলল,“গ্রান্ডপা,হেলিকপ্টারে ওঠো।” তার কণ্ঠে ছিল সংকল্প।দ্রুততার সঙ্গে সে নিজেই হেলিকপ্টারে উঠলো।
হেলিকপ্টারটি শক্তি নিয়ে উড্ডয়ন করছিল,কিন্তু ফিওনার মনে ছিল জ্যাসপারের জন্য উদ্বেগ।তার চিন্তা ছিল কেবল একটাই—প্রিন্সকে রক্ষা করতে হবে,সে যতদূরই হোক।এ মুহূর্তে,সবকিছু তার জন্য স্পষ্ট ছিল: লড়াই শুরু হয়ে গেছে আর সে প্রস্তুত ছিল।
ফিওনা জানতো,এটি সাধারণ কোনো হেলিকপ্টার নয়। দ্বীপের সাইলেন্সে প্রবেশ করার মতো বিশেষ প্রযুক্তিতে সজ্জিত একটি যু*দ্ধের হেলিকপ্টার।বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররা তাদের প্রাকটিক্যাল ক্লাসে এই হেলিকপ্টারের উচ্চ প্রযুক্তির অস্ত্র ও অপারেশন পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন।এই যন্ত্রের গোপন শক্তি ছিল বিরুদ্ধ বাতাস ও শব্দ শোষণের ক্ষমতা,যা তাদের সুরক্ষা দেবে।
পাইলটের সিটে বসা হুয়াং ঝি,আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে মেশানো একটি জটিল কন্ট্রোল প্যানেল ব্যবহার করে হেলিকপ্টারটিকে আকাশে নিয়ে গেল।ফিওনা পাশে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মনোযোগ দিল।যখন হেলিকপ্টারটি উচ্চতায় উঠতে শুরু করল,তখন সে সেই লেজার সিস্টেমের দিকে তাকালো যা উন্নত টার্গেটিং প্রযুক্তি দিয়ে সজ্জিত ছিল।
একটি কমান্ডের মাধ্যমে,ফিওনা অস্ত্রের বোতাম চাপলো,আর সাথে সাথে হেলিকপ্টারের বাহির থেকে একটি প্যাম্পিং সাউন্ড শোনা গেল।অস্ত্রগুলি কার্যকরভাবে গু*লি ছুঁড়তে শুরু করলো,আর প্রতিটি গু*লি দ্রুততার সাথে শত্রু ড্রাগনদের দিকে যেতে লাগলো।যুদ্ধক্ষেত্রে তার আত্মবিশ্বাস ও কৌশল যেন একত্রিত হয়ে নতুন শক্তি এনে দিল।
জ্যাসপার ড্রাগন রূপে উড়তে উড়তে ফিওনার দিকে তাকালো,তার চোখে ছিল গর্ব ও আশ্চর্য।কিন্তু এ মুহূর্তে কিছুটা হতাশাও ছিল।চেন শিং তখন ফিওনাকে লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে বললেন,”ফিওনা,তুমি কি করছো?”
“গ্রান্ডপা,আমি আমার প্রিন্সকে রক্ষা করবো!”ফিওনা দৃঢ় কণ্ঠে বলল।তার মধ্যে এক অদ্ভুত শক্তি প্রবাহিত হচ্ছিল,যেন সে জানতো,এই যুদ্ধে তার উপস্থিতি অপরিহার্য।
চেন শিং তখন সংকেত দিলেন,”হুয়াং ঝি,লেফট! রাইট!” হেলিকপ্টারটি তাৎক্ষণিকভাবে কৌশলীভাবে পিভট করলো,আর ফিওনা দ্রুততার সাথে সেই লেজার সিস্টেম থেকে আবার গুলি চালাতে শুরু করলো।গুলি ও ড্রাগনের আগুনের মধ্যে সমন্বয়ের সৃষ্টি করে সে তার লক্ষ্য ঠিক করতে লাগলো—জ্যাসপারকে রক্ষা করা।
যুদ্ধের ময়দান ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল।এই উত্তপ্ত পরিবেশে ড্রাগনদের ক্ষিপ্ত আচরণ আরও বেড়ে গেল। তারা বিশাল অগ্নিশিখা নিয়ে হেলিকপ্টারের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলো।ফিওনার চোখ ঝলমল করলো।সে তৎক্ষণাৎ বললো,”মিস্টার ঝি,লেফট!”
হুয়াং ঝি পাইলট সিটে তার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো,হেলিকপ্টারটি দ্রুত বাম দিকে ঝুঁকে পড়লো।অবরুদ্ধ বাতাসে চিত্কার করে বেরিয়ে আসা ড্রাগনদের অগ্নিরাশির মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসতে পেরে ফিওনার হৃদয়ে তাজা শক্তি অনুভব হচ্ছিল।
ফিওনার হেলিকপ্টার এখন জ্যাসপারের ড্রাগন রূপের পাশেই অবস্থান করছে।তারা একে অপরের দিকে তাকালো,ফিওনার চোখে ছিল দৃঢ় সংকল্প।সে ইশারায় বুঝালো—একসাথে লড়াই করতে হবে।
জ্যাসপার একমুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলো।আগুনের গোলা ও দগ্ধ অগ্নিশিখার সঙ্গে লড়াই করার জন্য তার মনোবল চাঙ্গা হয়ে উঠলো।সে আকাশে এক বিশাল বি*স্ফোরণের মতো অ*গ্নিশিখার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ফেলে আর একটি বড় আগুনের গোলা তৈরি করে ছুঁড়ে মারলো ড্রাগনদের দিকে।
এদিকে,ফিওনা হেলিকপ্টারের অস্ত্র থেকে তীব্র গতিতে গু*লি ছুঁড়ছিল।প্রতিটি গু*লি নিখুঁতভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করছিল।ড্রাগনরা যখন আগুনের শিখা ছড়িয়ে দিতে ব্যস্ত ছিল,তখন ফিওনার গু*লি তাদের হামলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল।
ড্রাগনদের হামলা যখন তীব্রতর হচ্ছিল,তখন একের পর এক গু*লি জ্যাসপারের আগুনের গোলার সাথে মিলিয়ে একটি ভয়ংকর সংঘর্ষ তৈরি করছিল।যেন আকাশে বিশাল রণাঙ্গনের সৃষ্টি হয়েছিল।ফিওনা আর জ্যাসপার একসাথে,সমান্তরালে লড়াই করছিল,তাদের সমন্বিত আক্রমণ ড্রাগনদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছিল।
দুই পক্ষের মধ্যে সৃষ্টি হলো ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ,যা আকাশে এক ভিন্ন শোরগোল সৃষ্টি করল।ফিওনা আর জ্যাসপার—উভয়েই প্রাণপণে লড়াই করছিলো,তাদের হৃদয়ে ছিল একটিমাত্র উদ্দেশ্য:নিজেদের ও নিজেদের ভালোবাসার রক্ষা করা।
ড্রাগনরা অবশেষে পরাস্ত হয়ে একে একে মাটিতে আছড়ে পড়লো,যুদ্ধের প্রমাণ হয়ে তাদের বিশালাকার শরীরগুলো জমিতে ছড়িয়ে পড়লো।এই যুদ্ধে সুপার পাওয়ার ব্যবহার করে জ্যাসপারের শক্তি অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে গেছে।ক্লান্তি ও অশক্ততায় সে এক মুহূর্তে মাটিতে নেমে এলো,সবকিছু অন্ধকার হতে লাগলো।
ফিওনার নির্দেশে হুয়াং ঝি হেলিকপ্টার নিচে নামাতে লাগলো। হেলিকপ্টার নামতেই ফিওনা দৌড়ে গিয়ে জ্যাসপারকে জড়িয়ে ধরলো,যেন সে তার শক্তি খুঁজে পায়।জ্যাসপারের গালে ও কপালে পরপর অনেকগুলো চুমু খেয়ে গেলো।জ্যাসপারও কিছুক্ষণ পর পর চুমু দিলো ফিওনাকে।
এই মুহূর্তে,এথিরিয়ন,আলবিরা,এবং থারিনিয়াস বহু আগে ভেনাস থেকে রওনা দিয়েছে।তারা কাছে চলে এসেছে,আর জ্যাসপারের স্মার্ট ঘড়িটি সিগন্যাল দিচ্ছে যে তারা প্রায় পৌঁছেছে।
তবে,জ্যাসপার নিজেকে একটি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করলো।এক মুহূর্তও না ভেবে সে বললো, “এবার তো ফিরে যাও,হামিংবার্ড!” তার চোখে জল জমে গেছে,যা সে কোনোভাবে আটকাতে পারছিল না।
ফিওনা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “কেন,প্রিন্স?এখন কেনো আমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছো?কেনো আমাকে নিজ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছো?”
জ্যাসপার তার ক্লান্ত মুখে কিছুটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,”তুমি মানবী,আর আমি ড্রাগন।তোমার আমার জগৎ আলাদা।তোমার আর আমার জীবন আলাদা।আমরা কখনোই এক হতে পারবো না যদি হই তবে একজনকে মরতে হবে আর আমি মরলেও আমার দুঃখ নেই কিন্তু তুমি।”
এই কথাগুলি ফিওনার হৃদয়ে যেন আঘাত হেনেছিল।সে অনুভব করলো,তাদের মধ্যে এক গভীর সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও,এক অদৃশ্য দেওয়াল তাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে।শোক, ভালোবাসা,আর বিচ্ছেদ—সবই তার মনে ভীড় করে উঠল।
ফিওনা তখন ক্রন্দনরত কন্ঠে প্রশ্ন করলো “প্রিন্স তুমি আমাকে ভালোবাসো না তাইনা?আমাদের মধ্যে এতো কিছু হয়ে যাওয়ার পরেও তুমি কিভাবে আমাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছো??
জ্যাসপারের মুখটি টনটন করতে লাগল,ফিওনার প্রশ্নের চাপের কাছে।তার ভেতরকার দ্বন্দ্ব ক্রমশই গভীর হয়ে উঠছিল।সে ধীরে ধীরে বললো, “হামিংবার্ড,আমি তোমাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাই না।কিন্তু আমার প্রথম অগ্রাধিকার হলো তোমার বেঁচে থাকা।”
ফিওনার চোখে আগুন জ্বলে উঠলো। “আমাদের সম্পর্ক কি তোমার কাছে কোনো মূল্য নেই?যদি আমাদের মিলন লেখা নাই থাকতো তাহলে কেনো সৃষ্টিকর্তা দুটো ভিন্ন জগতের ভিন্ন জীবের মধ্যে ভালোবাসার সঞ্চার করলো?”
“এই প্রেম,এই অনুভূতি—এটা আমাদের হৃদয়ের জোড়া” জ্যাসপার বললো,তার গলার স্বরে এক ধরনের তীব্রতা ছিল। “কিন্তু আমাদের জগত আলাদা।আমি চাই না তোমার কোনো ক্ষতি হোক।তুমি পৃথিবীর একজন মানবী।আর আমি ভেনাসের একজন ড্রাগন।আমাদের পথ পৃথক।”
ফিওনার চোখের কোণে জল চলে এল। “কিন্তু আমি তোমার সাথে থাকতে চাই।তুমি কি জানো,আমি কীভাবে বাঁচবো তোমায় ছাড়া?আমার জীবন তোমার সঙ্গেই পূর্ণতা পায়।”
জ্যাসপার কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে রইল,মনে হচ্ছিল,তার নিজের অনুভূতিগুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকা গভীরতার কাছে হার মেনে যাচ্ছে।কিন্তু সে জানতো,ফিওনার বেঁচে থাকা তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। “আমি চাই,তুমি ভালো থাকো।আমি তোমাকে ভালোবাসি হামিংবার্ড।কিন্তু আমাদের পথ ভিন্ন।”
ফিওনার হৃদয় ভেঙে যাচ্ছিল। “কিন্তু আমি তোমার জন্য সব করতে প্রস্তুত।আমি তোমাকে হারাতে চাই না।আমাদের মিলন কি এভাবে ভেঙে যাবে?”
জ্যাসপারের কণ্ঠে একটি দুঃখের ছোঁয়া ছিল। “আমি জানি,আমাদের মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে,কিন্তু আমাদের ভাগ্য ভিন্ন।তোমাকে রক্ষা করতে আমাকে দূরে থাকতে দাও,অন্তত তুমি নিরাপদে থাকবে।”
দুই জগতের প্রেমিকের মধ্যকার কথোপকথনটি এক ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে গেল।চারপাশে তখন সাদা মেঘের আচ্ছাদন,আর তাদের হৃদয়ের মধ্যে যেসব অনুভূতি ছিল,সেগুলো যেন সবকিছু ছাপিয়ে যাচ্ছিল।কিন্তু তারা জানতো,তাদের মাঝে যে অদৃশ্য প্রাচীর,সেটি পার হতে পারবে না।
ঠিক তখনই,একটি শক্তিশালী বাতাস বয়ে গেল,যেন তাদের প্রেমের গল্পের প্রতিধ্বনি তুলে ধরছিল,একটি নতুন সম্ভাবনার দিকে তাদের ঠেলে দিতে।
জ্যাসপার মিস্টার চেন শিংকে ইশারা করলো।কিন্তু ফিওনা তখন যেন সময় থেমে গেছে এমন অনুভূতি নিয়ে জ্যাসপারকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। তার চোখের কোণে অশ্রুর স্রোত বয়ে গেল,আর সে ডুকরে কেঁদে উঠলো। “আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবো না, প্রিন্স! আমাকে দূরে সরিয়ে দিওনা,” সে বলে উঠলো,তার কণ্ঠে শূন্যতা এবং আতঙ্ক।“যদি তোমার কাছে থাকলে আমার মৃ*ত্যু হয়,তবে তোমার বুকের মধ্যেই আমাকে মরতে দাও।আমি পরম শান্তিতে মরবো।কিন্তু তোমার থেকে দূরে গেলে আমি কঠিন যন্ত্রণা পেয়ে মরবো।আমি বাঁচবো না।”
জ্যাসপারের হৃদয় থমকে গেল,ফিওনার কথাগুলো যেন তার প্রাণের গভীরে প্রবেশ করলো।তার চোখে অশ্রু ঝরে পড়লো,লাল র*ক্তবর্ণ অশ্রু।এক হাতে সে তা মুছে ফেললো,কিন্তু অনুভূতিগুলোকে নিঃশব্দে প্রতিফলিত করতে পারছিল না।
“হামিংবার্ড,”সে আলতো স্বরে,“আমি জানি তোমার কষ্ট হচ্ছে।আর আমারও হচ্ছে কষ্ট।কিন্তু আমি চাই না তোমার কিছু হোক।তোমার জন্য এই ত্যাগ আমাকে করতেই হবে।তুমি নিরাপদ থাকলে আমি বাঁচবো।”
ফিওনা জ্যাসপারের চোখে চোখ রেখে বললো,“তুমি তো বলেছিলে,আমাকে প্রমিজ করেছিলে।তুমি বলেছিলে,তোমার জন্য আমাকে আর কখনো কাঁদতে হবে না,আমি তোমাকে ভেবে আর কখনো কষ্ট পাবো না।তাহলে কেন তুমি তোমার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করছো?” জ্যাসপার মুখে কোনো কথা আসছিল না।
জ্যাসপার কিছু একটা ভেবে হঠাৎ ফিওনার কানের নিচে দুই আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিতে শুরু করলো।
তার আঙুলগুলো একটি বিশেষ পয়েন্টে আঘাত করছিল,যা মানবদেহের স্নায়ুতন্ত্রের সাথে সংযুক্ত ছিল। এই পয়েন্টটি চন্দ্র-পদ্ম নামক একটি নাড়িতে অবস্থান করে,যা অতি সংবেদনশীল এবং দ্রুত উত্তেজিত হয়।
জ্যাসপার জানতো,এই পদ্ধতি ব্যবহার করে সে ফিওনাকে সাময়িকভাবে অজ্ঞান করতে পারবে।সে তার শক্তি কাজে লাগিয়ে,ধীরে ধীরে চাপ বাড়িয়ে দিল।মুহূর্তের মধ্যেই ফিওনার চোখে অস্পষ্টতা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো এবং সে অজ্ঞান হয়ে পড়লো জ্যাসপারের বুকে।
মিস্টার চেন শিং এগিয়ে আসতে চাইলে জ্যাসপার হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দেয়।তার মুখে একটি তীব্র সিদ্ধান্তের ছাপ ফুটে ওঠে।সে জানতো,ফিওনার নিরাপত্তা তার জন্য সবকিছু।নিজেই ফিওনাকে কোলে তুলে নিয়ে হেলিকপ্টারের দিকে এগিয়ে যায়।সেখানকার পরিবেশে এক ধরনের উদ্বেগ আর তীব্রতা বিরাজ করছিল।
হেলিকপ্টারের সিটে সযত্নে ফিওনাকে শুইয়ে দেয়।তার চেহারায় গভীর চিন্তার ছাপ ছিল।কিছুক্ষণ অশ্রুসিক্ত নয়নে ফিওনাকে দেখার পর,হঠাৎ করেই তার মন একটি অদ্ভুত সংকল্প নিয়ে দোলা খেতে থাকে।সে ফিওনার গলার লকেটটা খুলে ফেলতে উদ্যত হয়,যেটা সে নিজেই ফিওনাকে দিয়েছিল।
লকেটটি অমূল্য ছিল এতে ফিওনার সঙ্গে তাদের প্রেমের প্রতীক খোদাই করা ছিল।জ্যাসপার জানতো,লকেটটি তার জন্য শুধুমাত্র একটি অলঙ্কার নয়,বরং তাদের সম্পর্কের গভীরতার একটি চিহ্ন।সে বুঝতে পারছিল,এই পদক্ষেপ তার জন্য কঠিন,কিন্তু ফিওনার বেঁচে থাকা তার কাছে সবকিছুর উপরে ছিল।
লকেটটি তার হাতে নিয়ে জ্যাসপার অনুভব করলো, যেন তার হৃদয় থেকে একটি অংশ আলাদা হয়ে গেছে। সে এটি ধীরে ধীরে খোলার চেষ্টা করে,যেন এটি তার আবেগের একটি উন্মোচন হয়ে উঠুক।
হেলিকপ্টারের সিটে শুয়ে থাকা ফিওনার নিস্তেজ মুখের দিকে তাকিয়ে জ্যাসপার গভীর শ্বাস নিলো।তার চোখে ভেসে উঠলো তাদের প্রথম দেখা,সেই মুহূর্তগুলো যখন ফিওনা তার কাছে প্রথমে রহস্যময় মানবী ছিল,পরে হয়ে উঠলো তার হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতির কেন্দ্র।কিন্তু আজ,সে সব কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে—তার নিজের ভালোবাসার থেকেও।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে লকেটটি খুললো।লকেটের ভিতরে থাকা ডিভাইসটি সক্রিয় করতেই একটি ক্ষুদ্র নীল আলো জ্বলে উঠলো।ভেনাসে জ্যাসপার তৈরি করেছিলো এই প্রযুক্তি—একটি অত্যাধুনিক স্মৃতি সংগ্রহ ডিভাইস,যা কোনো ব্যক্তির মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট স্মৃতিগুলো ক্যাপচার করে রাখতে পারে।সেদিন যখন ভেনাসে ফিওনা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো সেদিন জ্যাসপার ডিভাইসটি ফিওনার মস্তিষ্ক থেকে জ্যাসপারের সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তের স্মৃতিকে সযত্নে তুলে নিয়ে লকেটের মধ্যে সংরক্ষণ করেছিল।আজ সেই লকেট খুলে ফেলে,জ্যাসপার নিশ্চিত করলো যে ফিওনার মস্তিষ্ক থেকে তার অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে মুছে গেছে।
জ্যাসপার তার আঙুল দিয়ে ফিওনার গাল স্পর্শ করলো।তার কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে গেলো। “আমি আমার প্রমিজ রেখেছি,হামিংবার্ড।আর কখনো তুমি আমাকে ভেবে কাঁদবে না।আর কখনো আমার জন্য তোমার কোনো কষ্ট হবে না।তোমার স্মৃতিতে আর কোনোদিন জ্যাসপার অরিজিন থাকবে না।তোমার মস্তিষ্ক থেকে তোমার প্রিন্স সরে গেছে।আমি শুধু চাই,তুমি ভালো থেকো।এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় চাওয়া।”
তারপর জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিওনার কপালে,গালে,ঠোঁটে শেষবারের মতো চুমু খেলে।
প্রতিটি চুমু যেন বিদায়ের এক একটি চিহ্ন।তার হৃদয় ভেঙে পড়লেও,সে জানতো এটাই সঠিক।
মিস্টার চেন শিং ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে জ্যাসপারের কাঁধে হাত রাখলেন।তার চোখেও জল ছিল।তিনি বললেন, “আমি সবসময় ভেবেছিলাম এই পৃথিবীতে ফিওনাকে আমার চেয়ে বেশি ভালো কেউ বাসতে পারবে না।কিন্তু আজ আমি বুঝলাম,এই মহাবিশ্বে যদি কেউ তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসে থাকে,তবে সেটা তুমি।তোমার এই ত্যাগ তার জন্য এক অমূল্য উপহার।”
জ্যাসপার এক মুহূর্ত চুপ থেকে হালকা মাথা নাড়লো। “তার ভালো থাকা নিশ্চিত করাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য।বিদায়,মিস্টার চেন শিং।ফিওনার খেয়াল রাখবেন।”
তারপর জ্যাসপার ধীরে ধীরে পেছনে সরে দাঁড়াল।ফিওনার জীবন থেকে তার নাম মুছে গেলেও, তার ভালোবাসার স্মৃতি থেকে যাবে মহাজাগতিক বাতাসে চিরকাল।
হেলিকপ্টারটি ক্রমশ আকাশে মিলিয়ে যেতে লাগলো। জ্যাসপার স্থির দাঁড়িয়ে রইল দ্বীপের তীর ঘেঁষে। তার বিশাল দেহ মনে হলেও মুহূর্তে ভঙ্গুর মনে হচ্ছিল। হেলিকপ্টারের ছোট হতে থাকা আকারের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো,যেন সেই আকাশের দূরত্বটা তার হৃদয়ের ভেতরের শূন্যতার প্রতিচ্ছবি।
তার চোখে লাল রক্তবর্ণ অশ্রু অনবরত গড়িয়ে পড়ছিল।পৃথিবীর বাতাসে সেই অশ্রু শুধু দুঃখের প্রতীক হলেও, যদি এটা ভেনাসে হতো, তবে এতক্ষণে তার তীব্র শক্তি পুরো ভূমি কাঁপিয়ে তুলতো। তার কষ্টের তেজে হয়তো ভেনাসের মাটিতে ভূমিকম্প সৃষ্টি হতো।
কিন্তু এখানে,পৃথিবীতে,তার শক্তি শুধু নীরব চোখের জলে সীমাবদ্ধ।বাতাসে তার দীর্ঘশ্বাস মিশে যাচ্ছিল,যেন মহাবিশ্বেও এই ব্যথার ভার অনুভূত হচ্ছে।
“হামিংবার্ড,”জ্যাসপার ফিসফিস করে বললো,
তার কণ্ঠ ভারী আর গভীর।”আমি চাইনি এভাবে আমাদের সম্পর্কের শেষ হোক।কিন্তু তোমার ভালো থাকার জন্য এটাই করতে হলো।”
তার চারপাশের সমুদ্রের গর্জন যেন তার মনের গভীর যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি।জ্যাসপার কিছুক্ষণ আর কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইল।তার চোখে ততক্ষণে ব্যথার শেষ বিন্দুটুকু নিয়ে ফিওনার হেলিকপ্টারটি দৃষ্টির অগোচরে হারিয়ে গেলো।
আযদাহা পর্ব ৫৮
এরপর সে ধীরে ধীরে পেছনে সরে দাঁড়ালো।দ্বীপের মাটি তখনো তার দুঃখের স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে থাকলো,আর প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউগুলো তার বিদায়কে শ্রদ্ধা জানিয়ে যেন নীরবে বয়ে চললো।