আযদাহা সিজন ২ পর্ব ১
সাবিলা সাবি
আজ চীনের বেইজিং শহরে মিস্টার চেন শিং-এর বিশাল বাড়ি আলোয় ঝলমল করছে।বিশাল অট্টালিকার প্রতিটি কোণ সাজানো হয়েছে চীনা ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে।জিন শির চমৎকার কাগজের লণ্ঠন,রেশমি কাপড়ে মোড়ানো সজ্জা আর সুবাসিত ফুলের তোড়ায় পুরো বাড়ি যেন এক স্বপ্নপুরীর রূপ নিয়েছে।
অনুষ্ঠানটি কোনো সাধারণ দিন নয়;আজ ফিওনার এনগেজমেন্ট।মিস্টার চেন শিং-এর একমাত্র নাতনিকে চীনের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ওয়াং লির নাতী যে সম্ভ্রান্ত চিকিৎসক,ডক্টর লিউ ঝান-এর সঙ্গে বাগদান বাঁধতে চলেছে।অতিথিদের মধ্যে রয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী,এবং উচ্চপদস্থ ব্যক্তিত্বরা।বাড়ির কেন্দ্রীয় হলে বিরাট এক মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে,যেখানে এনগেজমেন্ট রিং আদান-প্রদান হবে।
ফিওনা একটি লাল রেশমি চীনা চংসাম পরে রয়েছে,যার সোনালি সূচিকর্ম যেন তার সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।তার চুলগুলো কুন্দনের ক্লিপে বাঁধা,আর কানের দুলের নকশায় সজ্জিত মুক্তোগুলো তার মুখের কোমলতাকে আরও ফুটিয়ে তুলছে।কিন্তু তার চেহারায় একধরনের অদ্ভুত অন্যমনস্কতা।
অন্যদিকে,লিউ ঝান সুদর্শন এবং মার্জিত,মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে।সে সাদা জ্যাকেট এবং কালো প্যান্ট পরে আছে, আর তার মুখে এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাসের ছাপ।অতিথিরা একে একে মঞ্চের চারপাশে জড়ো হতে থাকে,ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলসে ওঠে।
মিস্টার চেন শিং একপাশে দাঁড়িয়ে এই আনন্দঘন মুহূর্তটি দেখে গর্বিত।কিন্তু কেউ জানে না তার মনেও একধরনের দ্বন্দ্ব লুকিয়ে আছে।ফিওনার মুখে সেই অন্যমনস্ক অভিব্যক্তি যেন তাকে চিন্তিত করছে।ফিওনার স্মৃতিতে নেই কোনো দ্বিধা বা পুরনো ব্যথা। তার মনে নেই কোনো অপরিচিত অনুভূতি। সে জানে না, কেন তার মন খালি খালি লাগে। শুধু এক শূন্যতা তার হৃদয়কে বেঁধে রেখেছে।
দুই মাস আগে…………..
সেদিন ছিল ভোর।বাড়ির জানালা দিয়ে মিষ্টি রোদ পড়ছে, কিন্তু চেন শিং-এর ঘর ভরে ছিল উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠায়। ফিওনাকে বাড়িতে আনার পর তার চোখ ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করে।ফিওনার জ্ঞান ফিরল,সে একটি পরিচিত ঘর,যেখানে সূর্যের আলো মিষ্টি করে ভাসছে,সেটাতে উঠে বসে।তার চারপাশে নানান জিনিসপত্র সাজানো,কিন্তু সবকিছুই যেন ভাসা ভাসা।তার মনে হচ্ছে সে এক দীর্ঘ ঘুম থেকে জেগে উঠেছে।কিছুই মনে করতে পারছে না। কেবলমাত্র একটা দুঃসহ শূন্যতা তার মনে খোঁজ দিচ্ছে।
ফিওনার চারপাশে চেন শিং আর মিস ঝাং উদ্বিগ্ন চেহারায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।।ফিওনা চোখ মেলে তাকালেও তার চোখে ছিল অস্পষ্টতা,যেন সে কিছুই মনে করতে পারছে না।সে নরম স্বরে বলল,
“আমি… আমি কোথায়?”
চেন শিং এগিয়ে এসে তার পাশে বসলেন।তাঁর কণ্ঠ শান্ত কিন্তু ভারী,যেন তিনি কথা বলতে গিয়ে নিজেকেই সান্ত্বনা দিচ্ছেন।”তুমি বাড়িতে আছো,ফিওনা। সব ঠিক আছে।তুমি আমাদের কাছে ফিরে এসেছো।”
ফিওনার কপালে হাত রেখে চেন শিং নরম গলায় বললেন,”তুমি অনেক বড় এক দুর্ঘ*টনার শিকার হয়েছিলে।তোমার শরীর অনেক সময় নিয়েছে সেরে উঠতে।”
মিস ঝাং একটু এগিয়ে এসে বললেন,”তুমি এক বছর কোমায় ছিলে,ফিওনা।আজ তুমি আমাদের কাছে ফিরে এসেছো।এটা আমাদের জন্য আশীর্বাদ।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ফিওনা তাকিয়ে রইল,কিন্তু তার চোখে বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট।এই খবর শুনে ফিওনার হৃদয়ে একটি বড় ধাক্কা।এক বছর?দুর্ঘ*টনা?তার মনে কিছুই আসছে না।তার মাথায় যেন কুয়াশার চাদর জড়িয়ে আছে।
“কিন্তু…কী হয়েছিল আমার?কেন কিছু মনে পড়ছে না?” ফিওনা জিজ্ঞাসা করল।তার কণ্ঠে ছিল ভয় আর বিভ্রান্তি।
চেন শিং তার কাঁধে হাত রেখে শান্ত গলায় বললেন,”তোমার মনে এখন অনেক কিছুই অস্পষ্ট লাগবে।এটা স্বাভাবিক।কিন্তু তুমি চিন্তা করো না,আমরা তোমার পাশে আছি।ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
ফিওনা তাকিয়ে রইল,কিন্তু তার হৃদয়ে কেমন একটা শূন্যতা অনুভূত হচ্ছিল।তার মনে হচ্ছিল,কিছু যেন হারিয়ে গেছে—কিছু যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,কিন্তু সে ধরতে পারছে না।
চেন শিং আর মিস ঝাং তাকে সান্ত্বনা দিতে থাকলেন।কিন্তু সেই শূন্যতা আর অস্পষ্টতার ভার যেন ফিওনার হৃদয়ে একটি গভীর চিহ্ন রেখে গেল।যে স্মৃতিগুলো তার থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে,সেগুলো তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।কিন্তু ফিওনা তা জানে না।ফিওনা ধীরে ধীরে অনুভব করে,যে সে ফিরে এসেছে,তবে এর সঙ্গে তার একটি খালি জগত রয়েছে। তাকে নতুন করে সবকিছু শুরু করতে হবে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে,সে কি সত্যিই প্রস্তুত?
দিনগুলো ধীরে ধীরে গড়িয়ে যাচ্ছিল।ফিওনা অনেকটাই সুস্থ,কিন্তু তার হৃদয়ের অদ্ভুত শূন্যতা তাকে স্থির থাকতে দিচ্ছিল না।একদিন,যখন ফিওনা ভার্সিটিতে ফেরার ইচ্ছা প্রকাশ করল,মিস্টার চেন শিং তার মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন।তিনি জানতেন,ফিওনার স্মৃতি ফিরে পাওয়া মানেই তার জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকির মুখে পড়া।
চেন শিং তাকে শান্ত গলায় বললেন,”ফিওনা,আমি তোমার জন্য নতুন কিছু পরিকল্পনা করেছি।আমি চাই তুমি একটি নতুন ভার্সিটি ভর্তি হও,যেখানে তুমি সেইফ থাকবে।”
ফিওনা কিছুটা অবাক হলেও রাজি হলো।তার মনে প্রশ্ন উঠছিল,কেন তাকে তার পুরোনো জীবনে ফিরতে দেওয়া হচ্ছে না।তবে চেন শিংয়ের সিদ্ধান্তকে সে কখনোই প্রশ্ন করতে সাহস পেত না।
এদিকে,চেন শিং ফিওনার বান্ধবী লিন আর লিয়াকে সবটা খুলে বললেন।তারা প্রথমে অবাক হয়ে গেল।
“কীভাবে ফিওনার থেকে এই সত্যটা লুকানো সম্ভব?” লিন জানতে চাইল।
চেন শিং দৃঢ় গলায় বললেন,”এটা করতে হবে ওর ভালো থাকার জন্য।সে যদি কখনো তার আসল স্মৃতিগুলো জানে,তাহলে সেটা ওর জন্য ধ্বং*সাত্মক হতে পারে।আমি চাই না সে সেই দুঃখ আর যন্ত্র*ণা বয়ে বেড়াক।”
লিন আর লিয়া ফিওনার জন্য উদ্বিগ্ন ছিল।তারা জানত,ফিওনা কতটা স্ট্রং।তবে তারা চেন শিংয়ের কথা মেনে নিল।
ফিওনা বাড়িতে দিন কাটাচ্ছিল।বই পড়া,ছবি আঁকা আর জানালার পাশে বসে সময় কাটানো যেন তার নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে গিয়েছিল।সন্ধ্যা হলে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকা ছিল তার পছন্দের কাজ।
জানালার বাইরের সন্ধ্যাতারা ফিওনার মনোযোগ টানত। প্রতিদিন,যখন আকাশের প্রথম তারা দেখা যেত,ফিওনার মনে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হতো।
“কেন জানি না,এই সন্ধ্যাতারা ভেনাস আমাকে কিছু বলতে চায়।যেন কোথাও কেউ আমাকে ডাকছে,” ফিওনা নিজেকেই বলত।
ভেনাসের সেই উজ্জ্বল আলো তার হৃদয়ে এক অদ্ভুত কম্পন সৃষ্টি করত। সে জানত না,এই তারার সাথে তার অতীতের অদৃশ্য এক বন্ধন আছে।আর জানত না,এই ভেনাস তারাই একদিন তার জীবনের দিক পরিবর্তন করবে।
আজকের দিনটা যেন অদ্ভুত রকমের ভারি মনে হচ্ছিল ফিওনার।জানালার বাইরে আকাশ ছিল মেঘলা,ঠান্ডা বাতাস গাছের পাতা দোলাচ্ছিল।ফিওনার মন অস্থির ছিল,কারণ আজ সে পুনরায় ক্লাস শুরু করতে যাচ্ছে।মিস্টার চেন শিং তাকে নিয়ে যাচ্ছিলেন বেইজিংয়ের অন্যতম বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ত্সিংহুয়া ইউনিভার্সিটিতে।
ফিওনা নিরব ছিল।গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিল।মনের ভেতর অজানা উত্তেজনা আর এক ধরনের অদ্ভুত শূন্যতা কাজ করছিল।
“তুমি তো এতোদিন বাড়িতে ছিলে।এখন নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে।তবে তুমি স্ট্রং গার্ল আমি জানি।সব সামলে নিতে পারবে,” মিস্টার চেন শিং বললেন।
ফিওনা হালকা হাসল,তবে তার চোখে এক ধরনের অদৃশ্য দুশ্চিন্তার ছাপ ছিল।
বিশাল ত্সিংহুয়া ইউনিভার্সিটির প্রবেশদ্বারে পৌঁছালে ফিওনা কিছুটা বিস্মিত হয়ে গেল।বিশাল ক্যাম্পাস,সবুজ ঘাসে ঢাকা রাস্তা,আর ব্যস্ত শিক্ষার্থীদের ভিড়—সবকিছু তাকে যেন নতুন এক জীবনে প্রবেশের আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল।
“এখানে তোমার নতুন শুরু।তোমার যা যা প্রয়োজন,সব ব্যবস্থা করেছি।আর হ্যাঁ,যদি কোনো সমস্যা হয়,আমাকে ফোন করতে দ্বিধা করবে না,” চেন শিং বললেন।
ফিওনা মাথা নাড়ল।তাকে ভর্তি কার্যক্রম শেষ করার জন্য প্রশাসনিক ভবনে নিয়ে যাওয়া হলো।অফিসিয়াল প্রক্রিয়া শেষে ফিওনাকে তার ক্লাসরুমে নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রথম ক্লাসে ঢুকে ফিওনার মনে হল সবাই তার দিকে তাকাচ্ছে।নতুন শিক্ষার্থী হিসেবে সে যেন সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল।তবে তার স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্ব আর নির্ভীক চোখ তাকে এক মুহূর্তে আলাদা করে দিল।
“তোমার নাম ফিওনা,তাই তো?”এক মৃদু হাসি নিয়ে পাশে বসা এক মেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ।তুমি?” ফিওনা জানতে চাইল।
“আমি সু লি। তুমি কি নতুন ভর্তি হয়েছো?”
ফিওনা হেসে মাথা নাড়ল।
দিন শেষে,ক্লাস শেষ হলে ফিওনা ক্যাম্পাসের একটি সুন্দর ফোয়ারা পাশে দাঁড়িয়ে থাকল।তার চোখ আবার আকাশের সন্ধ্যাতারার দিকে চলে গেল।হঠাৎ করেই তার মনে হল কেউ যেন তাকে দূর থেকে দেখছে।কিন্তু সে যখন চারদিকে তাকাল,কেউ ছিল না।
আজকের দিনটি শুরুতে অদ্ভুত মনে হলেও ফিওনা বুঝল, এটি তার জীবনের নতুন অধ্যায়।যদিও তার হৃদয়ে শূন্যতার গভীর ছায়া ছিল,তবুও সে নিজেকে এই নতুন জীবনে মানিয়ে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত করল।
ফিওনা তার নতুন জীবনের প্রথম সপ্তাহে অস্বাভাবিকভাবে স্বাভাবিক বোধ করছিল।সবকিছুই বেশ মসৃণভাবে চলছিল, কিন্তু আজকের ভূগোল ক্লাসে ঘটে গেলো এক বিপত্তি।
ক্লাসের শিক্ষক একটি বিশেষ পাঠে ড্রাগন প্রাণী এবং ভেনাস সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেছিলেন।যখন তিনি বললেন,”ড্রাগনরা অত্যন্ত শক্তিশালী এবং রহস্যময় প্রাণী,” ফিওনার মস্তিষ্কে এক অদ্ভুত টান অনুভব হলো।
প্রথমে সে অবাক হয়ে শুনছিল,কিন্তু কিছুক্ষণ পর তার মাথায় চাপ তৈরি হতে শুরু করল।মনে হচ্ছিল যেন অসংখ্য স্মৃতি তার মাথায় ঘুরছে,কিছু দূরবর্তী,কিছু খুব কাছের।সে চোখ বন্ধ করে দুহাতে মাথা চেপে ধরলো,যেন মাথার ব্যথা কমানোর চেষ্টা করছে।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে,এই চাপ সহ্য করতে পারল না।এক মুহূর্তের মধ্যে,ক্লাসের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সে বেঞ্চ থেকে পড়ে গেল।
“ফিওনা!”এক ভয়ে ভরা গলার আওয়াজ ভেসে এল। একজন ছাত্র দ্রুত উঠে এসে তার কাছে ছুটে গেল।
ক্লাসরুমে সবাই থমকে গেল।ফিওনার চোখের সামনে সবকিছু আবছা হয়ে আসছিল।অবচেতন অবস্থায় সে অনুভব করছিল,কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছিল না।
শিক্ষক দ্রুত তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলেন,”শান্ত থাকো,ফিওনা।” তিনি তার মাথায় হাত রেখে বললেন,”দীর্ঘ শ্বাস নাও।”
কিছু সময় পর,ফিওনার মাথার ব্যথা কমতে শুরু করল,কিন্তু সে এখনও মাটিতে পড়ে ছিলো।ক্লাসের অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীরা আশঙ্কায় তার দিকে তাকিয়ে ছিল।
সে চোখ খুলে চারপাশে তাকাল,কিন্তু সবকিছু এখনও আবছা লাগছিল।মনে হচ্ছিল,যেন সে একটি অন্ধকারের গভীর সমুদ্রের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে।কিন্তু সেই অন্ধকারের মধ্যে, মাঝে মাঝে ঝলক হয়ে ভেসে উঠছিলো ভেনাসের দৃশ্য—রঙিন গাছপালা,বিশাল ড্রাগন,আর একটি সুদর্শন পরিচিত মুখ।
হঠাৎ করেই সে অনুভব করল,তার মাথার ব্যথা কমে আসছে আর পরিবেশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।সে বুঝতে পারছিল,এটা কেবল একটা অস্থায়ী আ*ক্রমণ ছিল,তবে কেন এটি ঘটলো,তা জানতে তার খুব আগ্রহ হচ্ছিল।
“ফিওনা,তুমি কেমন আছো?” ক্লাসের সহপাঠী সু লি তার পাশে এসে দাঁড়াল।
“আমি…আমি ঠিক আছি,” ফিওনা কষ্টে হাসলো।
কিন্তু তার মনে তখনও অশান্তির আঁচ ছিল।তাকে এভাবে ভেনাস ও ড্রাগন সম্পর্কে পড়ানোর পর হঠাৎ মাথা ব্যথা—এটি কি কাকতালীয়?অথবা এর পেছনে কোনো গভীর কারণ রয়েছে?
ফিওনা বাসায় ফিরে মিস ঝাং এবং মিস্টার চেন শিংকে ভুগোল ক্লাসের ঘটনাটা জানায়।ফিওনার কথাগুলো শুনে তাদের দু’জনেই গভীর দুশ্চিন্তায় পড়ে যান।তারা বুঝতে পারেন যে ফিওনার মানসিক এবং শারীরিক অবস্থার উপর বেশ চাপ পড়েছে।
এরপর থেকে ফিওনার জীবনে শুরু হলো আরেক অদ্ভুত অধ্যায়। প্রতিদিন রাতে ফিওনা স্বপ্ন দেখতে শুরু করল, তবে সেই স্বপ্নগুলো যেন সম্পূর্ণ আবছা। স্বপ্নে দেখা দেয় একটি মুখ—ধূসর,অস্পষ্ট, কিন্তু খুবই পরিচিত মনে হয়। ফিওনা যতই চেষ্টা করে, ততই সেই মুখ স্পষ্ট হওয়ার বদলে আরও ঝাপসা হয়ে যায়।
কখনো কখনো স্বপ্নে সে দেখত অদ্ভুত কোনো স্থানের ছবি—প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে কোনো দ্বীপ, ঝলমলে নক্ষত্রে ভরা আকাশ,কিংবা এক বিশাল ড্রাগনের ছায়া। সেই ছায়া যেন তার চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, তাকে রক্ষা করে, আবার কখনো দূরে সরে যায়। ফিওনার মন বারবার অনুভব করছিল যে এই সবকিছু তার জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত, কিন্তু কীভাবে বা কেন,তা সে বুঝতে পারছিল না।
ফিওনা একদিন মিস ঝাং-এর সঙ্গে তার এই স্বপ্নের কথা শেয়ার করে। মিস ঝাং তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,”তুমি হয়তো ক্লান্ত মানসিক চাপে আছ। এ জন্যই এসব অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছ। কিছুদিন ঠিক মতো বিশ্রাম নাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
কিন্তু ফিওনার মনে হচ্ছিল, এই স্বপ্নগুলো কোনো সাধারণ স্বপ্ন নয়।এগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে তার জীবনের কোনো গভীর রহস্য।
ফিওনার শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে লাগল। তার ঘন ঘন মাথাব্যথা, আবছা স্বপ্ন দেখা এবং অদ্ভুত স্মৃতির ঝলকানির কারণে চেন শিং গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। তিনি বুঝলেন, এই অবস্থায় ফিওনার চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি।
চেন শিং দীর্ঘ চিন্তাভাবনার পর সিদ্ধান্ত নিলেন, ফিওনার চিকিৎসার দায়িত্ব ডক্টর লিউ ঝানকে দেবেন। ডক্টর লিউ ঝান একজন স্নায়ু বিশেষজ্ঞ এবং মানসিক চিকিৎসায় দক্ষ। মিস ঝাং যখন অসুস্থ ছিলেন, তখন লিউ ঝান অত্যন্ত যত্ন এবং নিষ্ঠার সঙ্গে তার চিকিৎসা করেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে চেন শিং জানতেন যে ফিওনার জন্য লিউ ঝানের চেয়ে ভালো ডাক্তার আর কেউ হতে পারে না।
চেন শিং লিউ ঝানের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন এবং ফিওনার অবস্থার বিস্তারিত জানালেন।লিউ ঝান ফিওনার রিপোর্টগুলো দেখে বললো, “এটা শুধু শারীরিক সমস্যা নয়,মানসিক দিকটাও অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে।ফিওনার গভীর কোনো মানসিক আঘাত থাকতে পারে,যা তাকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিচ্ছে।আমি যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা শুরু করব।”
লিউ ঝান প্রথমেই ফিওনার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলো, তাকে স্বাভাবিকভাবে তার সমস্যাগুলো প্রকাশ করতে সাহায্য করলেন।সে ফিওনার অস্বাভাবিক স্বপ্ন আর স্মৃতির ঝলকানি নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ শুরু করলো।ফিওনার পাশে থেকে ধৈর্য ধরে লিউ ঝান তার চিকিৎসা চালিয়ে যেতে লাগলো।
ডক্টর লিউ ঝান শুধুমাত্র একজন চিকিৎসক হিসেবে নয়,একজন সহানুভূতিশীল বন্ধু হিসেবেও ফিওনার পাশে দাঁড়ালো।সে ফিওনার মানসিক অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করলো আর তার সমস্যাগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সঠিক চিকিৎসার পথ খুঁজে বের করলো।
ফিওনার সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে লিউ ঝান তার মানসিক যন্ত্রণা,ভয় এবং অস্পষ্ট স্মৃতির রহস্য উদঘাটনে সাহায্য করতে লাগলো।সে ফিওনাকে ধীরে ধীরে তার অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে উৎসাহিত করলো আর তাকে বুঝিয়ে বললো যে,তার সমস্যাগুলোকে স্বাভাবিকভাবে নেওয়া উচিত।
লিউ ঝানের ধৈর্য,যত্ন আর আন্তরিকতা ফিওনাকে ধীরে ধীরে স্বস্তি এনে দিল।ফিওনা তার অভিজ্ঞতা আর অনুভূতিগুলো লিউ ঝানের সঙ্গে ভাগ করে নিতে শুরু করল,যা তাকে মানসিকভাবে হালকা হতে সাহায্য করল।
এই চিকিৎসার সময়,লিউ ঝান আর ফিওনার মধ্যে এক ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠল।ফিওনা লিউ ঝানকে একজন নির্ভরযোগ্য মানুষ হিসেবে দেখতে শুরু করল,যাকে সে তার মনের কথা বলতে পারে।লিউ ঝানও বুঝতে পারলো,ফিওনা শুধু একজন রোগী নয়,বরং এমন একজন মানুষ যার জীবনের গভীরে কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে।এই বন্ধুত্ব তাদের দুজনকেই এক নতুন ধরণের বিশ্বাস আর সম্মানের জায়গায় নিয়ে গেল।
মিস্টার চেন শিং নিজের ল্যাবে বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলেন।সন্ধ্যার আকাশে লালচে আলোর আভা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে।তার মনের ভেতরে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব চলছে। ফিওনার জন্য তিনি সর্বদা যা করেছেন, সবই ছিল তার মঙ্গল চিন্তা থেকে। কিন্তু আজ যেন তার হৃদয় দ্বিধার ভারে ভারাক্রান্ত।
লিউ ঝানকে তিনি জানেন দীর্ঘদিন ধরে—একজন যোগ্য ডাক্তার,দায়িত্বশীল মানুষ,এবং সবচেয়ে বড় কথা,ফিওনার প্রতি তার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা।চেন শিং বুঝতে পারছেন,ফিওনার জীবনে একজন শক্ত ভিত্তি দরকার,যে তাকে শুধু সুরক্ষা দেবে না,বরং তাকে মানসিক স্থিরতাও এনে দেবে।
অতঃপর গভীর শ্বাস নিয়ে তিনি লিউ ঝানকে ল্যাবে ডেকে পাঠালেন।লিউ ঝান তার প্রস্তাব শোনার পর এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেলো।তার চোখে আনন্দ আর বিস্ময়ের মিশ্র প্রতিক্রিয়া ফুটে উঠল।
“আমি…আমি তো স্যারের কাছে এমন কিছু আশা করিনি।” লিউ ধীরে ধীরে বললেন। “তবে সত্যি বলতে, আমি ফিওনাকে অনেক দিন ধরেই…আমার হৃদয়ের খুব কাছের মানুষ ভাবি।”
চেন শিং মাথা নাড়লেন। “আমি জানি,ঝান।তাই তো আজ তোমার কাছে এই প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।ফিওনা তোমার মতো একজন মানুষের সঙ্গেই সুখী হবে।তবে সিদ্ধান্তটা তার নিজের হবে।আমি কখনোই তাকে বাধ্য করব না।”
লিউ ঝান কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মাথা নত করলো। “স্যার, আপনি যা করছেন,তা শুধুই ফিওনার মঙ্গলের জন্য। আমি কথা দিচ্ছি,আমি তাকে কখনো কষ্ট দেব না।”
চেন শিং তার কাঁধে হাত রাখলেন। “আমার ফিওনা অনেক কষ্ট পেয়েছে,ঝান।আমি চাই,সে যেন আবার হাসতে পারে। তুমি কি পারবে, তার জীবনে সেই হাসি ফিরিয়ে আনতে?”
লিউ ঝান মৃদু হেসে বললো,”আমি আমার সর্বোচ্চটা করব,স্যার।”
তবে ফিওনার সামনে এই প্রস্তাব পেশ করা এত সহজ হবে না,চেন শিং তা জানতেন।
রাতের খাবারের টেবিলে তিনি বেশ কিছুক্ষণ নীরব রইলেন।ফিওনার ম্লান মুখের দিকে তাকিয়ে তার বুক মোচড় দিয়ে উঠল।অবশেষে তিনি কথা শুরু করলেন।
“ফিওনা,তোমার কথা আমি সবসময় ভাবি।তোমার জীবনে যদি এমন একজন থাকে,যে তোমার পাশে দাঁড়াবে,তোমার যত্ন নেবে,তাহলে আমার মন শান্তি পাবে। আমি লিউ ঝানের কথা ভাবছি। তুমি কী বলো?”
ফিওনা স্তম্ভিত হয়ে চেন শিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে বলল, “গ্র্যান্ডপা,এ কী বলছো তুমি!আমি…আমি এখন এসব কিছু ভাবতে পারছি না।”
চেন শিং তার হাতটি ধরে বললেন, “বুঝতে পারছি, ফিওনা। কিন্তু ভাবনা থেকে পালিয়ে গেলে চলবে না। সময় নিয়ে ভেবে দেখো। ঝান তোমার জন্য সঠিক মানুষ হতে পারে।”
ফিওনা অসহায়ভাবে তার গ্ৰান্ডপার চোখে তাকিয়ে রইল। কিছু বলল না। মন যেন দ্বিধায় পড়ে গেল।
রাত গভীর।ফিওনা নিজের ঘরে জানালার পাশে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল।তার ভেতরে চলছে এক অদ্ভুত টানাপোড়েন।মিস্টার চেন শিং-এর কথাগুলো তার কানে এখনও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
“ফিওনা,আমি জানি তুমি রাজি হতে চাও না।কিন্তু আমার কথা একটু ভেবে দেখো।আমি কি চিরকাল তোমার পাশে থাকতে পারব আমার তো এখন অনেক বয়স হয়েছে।আমার যদি কিছু হয়ে যায়,তোমার কী হবে?তুমি কি একা একা এই বড় পৃথিবীতে চলতে পারবে?”
চেন শিং-এর কণ্ঠে ছিল গভীর দুঃখের আভা।ফিওনা সে মুহূর্তে কোনো কথা বলতে পারেনি।কিন্তু তার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল।
“আমি চাই,তোমার জীবনে এমন একজন থাকুক,যে তোমার পাশে থাকবে।লিউ ঝান খুব ভালো ছেলে।সে তোমার যত্ন নেবে,তোমাকে সুখী রাখবে।আমি যদি তাকে তোমার কাছে রেখে যেতে পারি,তাহলে আমি মরেও শান্তি পাব।”
ফিওনা ধীরে ধীরে জানালার কাচ স্পর্শ করল।মনের মধ্যে একটা তীব্র দ্বন্দ্ব।সে কখনোই চায়নি এমন কিছু করতে,যা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে।কিন্তু গ্র্যান্ডপা?তার কথাগুলো?
চেন শিং তাকে আরও বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। “ফিওনা,তুমি কি জানো,তোমার মা-বাবাকে হারানোর পর আমি তোমাকে কেমন করে বড় করেছি? তুমি আমার জীবনের সবকিছু।কিন্তু আমি আজ খুব অসহায়।তোমার ভবিষ্যৎ চিন্তা করে আমি এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি। তুমি কি চাইবে,আমি দুশ্চিন্তায় মা*রা যাই?”
এই কথাগুলো ফিওনার হৃদয়কে ভেঙে দিয়েছিল। তার চোখে পানি চলে এসেছিল।সে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলেছিল,”গ্র্যান্ডপা,আমি বুঝতে পারছি।কিন্তু আমি সত্যিই জানি না,আমি এই সিদ্ধান্ত নিতে পারব কি না।”
চেন শিং ধীরে ধীরে উঠে এসে ফিওনার পাশে বসলেন। তার কাঁধে হাত রেখে বললেন,”আমি জানি,তুমি স্ট্রং গার্ল।আমি জানি,তুমি আমাকে হতাশ করবে না।”
সেই রাতে ফিওনা ঘুমাতে পারেনি।তার মনের ভেতরে চলছিল অসংখ্য প্রশ্ন। শেষ পর্যন্ত,যেন নিজেরই পরাজয় মেনে নিয়ে,পরদিন সকালে চেন শিং-এর সামনে এসে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, “গ্র্যান্ডপা,আমি তোমার কথায় রাজি।তবে আমি বুঝতে পারছিনা,এটা ঠিক হবে কি না।”
চেন শিং ফিওনাকে জড়িয়ে ধরলেন। তার মুখে তৃপ্তির একটা হাসি ফুটে উঠল। “তোমার এই সিদ্ধান্তই আমাকে শান্তি দেবে, ফিওনা। তুমি ঠিক করেছ।”
ফিওনা তার চোখ বন্ধ করল।এই মুহূর্তে তার মন শূন্য। তবে সে জানে,এই শূন্যতায় তাকে একাই ভেসে থাকতে হবে।
ফিওনা চোখ খুললো,অতীতের ভাবনা থেকে বাস্তবতায় ফিরলো।বিয়ের আঙটি বদলের মুহূর্তটা যেন সময়ের স্রোতকে থমকে দিয়েছে।সাজানো অডিটোরিয়ামে উপস্থিত সবাই নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে।আলো-আঁধারিতে ফিওনা যেন কোনো স্বপ্নের জগতে দাঁড়িয়ে আছে।তার মনের গভীরে স্মৃতি আর বর্তমানের মিশ্রণ এক অদ্ভুত কোলাহল তৈরি করেছে।
লিন আর লিয়া একটু দূর থেকে ফিসফিসিয়ে ফিওনাকে ডাকছিল। “ফিওনা!তোর পালা।”
ফিওনা একটু চমকে উঠল। তার চোখ যেন বাস্তবে ফিরে এল। সামনে দাঁড়ানো লিউ ঝানের মুখে এক ধরনের স্নিগ্ধতা। তার হাতে ছোট্ট মখমলের বাক্সে রাখা আঙটি ঝিকমিক করছে। লিউ ধীরে ধীরে ফিওনার হাতটি ধরে বলল,”ফিওনা,আমি প্রতিজ্ঞা করছি, তোমাকে সবসময় আগলে রাখব।”
তারপর সে ফিওনার হাতের দিকে আঙটি এগিয়ে দিল। পুরো হলরুম নিস্তব্ধ। একমাত্র আঙটি পরানোর মুহূর্তের মৃদু আওয়াজই যেন শোনা যাচ্ছে।
ফিওনা দেখল, তার হাতের অনামিকায় আঙটি ঠিকঠাক বসে গেছে,কিন্তু তার নিজের পালা যখন এল, তার হাত কাঁপতে শুরু করল।বুকের ভেতর এক অজানা শূন্যতা যেন তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
সে যখন লিউ ঝানের আঙুলে আঙটি পরাতে গেল, হাত থেকে সেটা মাটিতে পড়ে গেল।পুরো হল ঘরজুড়ে শ্বাসরুদ্ধকর নীরবতা।ফিওনা বিব্রত হয়ে তাড়াতাড়ি আঙটি তুলল।এবার তার হাত আরও বেশি কাঁপছিল।
লিউ ঝান মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “তুমি ঠিক আছ তো?”
ফিওনা কিছু না বলে মাথা নাড়ল। এরপর কাঁপা হাতে আঙটি পরিয়ে দিল লিউ ঝানের অনামিকায়।মুহূর্তটি সম্পূর্ণ হতেই সবাই হাততালিতে ফেটে পড়ল।কিন্তু ফিওনার মন যেন দূরে কোথাও আটকে ছিল, অজানা কোনো ডাকে।
ফিওনা হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু তার চোখে এক ধরনের ফাঁকা দৃষ্টি। লিন আর লিয়া তার পাশে এসে দাঁড়াল, একমাত্র ওরাই জানে যে এই হাসির পেছনে কতটা লড়াই লুকিয়ে আছে।
ভেনাসের এল্ড্র রাজ্যঃ
জ্যাসপার বসে আছে তার বিশাল কক্ষে।চারপাশে জ্বলজ্বলে স্ফটিকের আলো,কিন্তু তার মনের অন্ধকার ছাপিয়ে গেছে এই আলোকময় পরিবেশকে। ফিওনাকে হেলিকপ্টারে তুলে দেয়ার সেই মুহূর্তটি বারবার মনে পড়ছে।এক অদ্ভুত শূন্যতা তাকে ঘিরে ধরেছে। তার ভেতর আগুন জ্বলছে,যা সে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে।
সেদিন যখন ফিওনার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল, তার মনে হচ্ছিল পুরো পৃথিবীটা যেন ফিকে হয়ে গেছে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল,পুরো দ্বীপটা ধ্বংস করে দিতে,কিন্তু তার মন বলল,”না, এ অন্যায়।” কারণ সেই দ্বীপে ছিল ছোট্ট লিটল এঞ্জেল সিলভেরা।সেই নিষ্পাপ সত্তার জন্যই নিজেকে দমিয়ে রাখে জ্যাসপার।
এথিরিয়ন,আলবিরা,আর থারিনিয়াস দ্বীপে পৌঁছানোর পর জ্যাসপার পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে তাদের সাথে ভেনাসে ফিরে আসে।ফিরে আসার আগে প্রশান্ত মহাসাগরের কাছে দাঁড়িয়ে,তার হাতে ছিল ফিওনার লকেট।সেই লকেটে ছিল সমস্ত স্মৃতি,সমস্ত ব্যথা।লকেটটা চুমু দিয়ে সে সাগরের গভীরে ছুঁড়ে ফেলে।মনে মনে বলল, “আমি আমার প্রতিজ্ঞা রেখেছি তোমার মস্তিষ্ক থেকে আমার সব স্মৃতি মুছে দিয়েছি, এই মহাবিশ্বে আমি বিলীন হয়ে গেলেও,তুমি সুখে থেকো, হামিংবার্ড।”
ভেনাসে ফিরে আসার পর জ্যাসপার আর আগের মতো নেই।এল্ড্র রাজ্যের সকলে তার বিষণ্ণ অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন। রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজই সে করছে না। খাবার, পানীয়,এমনকি বিশ্রাম নেয়াও ভুলে গেছে। দিন-রাত কেবল তার কক্ষের এক কোণে চুপচাপ বসে থাকে।
তার কক্ষের জানালা দিয়ে ভেনাসের উজ্জ্বল আকাশ দেখা যায়,কিন্তু জ্যাসপারের চোখের সামনে এখনো ভাসে ফিওনার মুখ।তার প্রতিটি হাসি, প্রতিটি অশ্রু যেন একটি মুদ্রার দুই পিঠ,যা থেকে জ্যাসপার মুক্তি পেতে চায় কিন্তু পারছে না।
তার চারপাশে রাজ্যের লোকেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে,কিন্তু কেউ সাহস করে তার কাছে আসতে পারে না। এল্ড্র রাজ্যের এই রাজপুত্রের গর্জন একসময় শত্রুকে কাঁপিয়ে দিত।কিন্তু আজ তার নীরবতাই যেন সবার হৃদয়ে আতঙ্ক ঢেলে দেয়।
জ্যাসপার জানে,সে ফিওনাকে ফিরে পেতে চায় না। কিন্তু তার মনের গভীরে এক শূন্যতা বারবার তাকে টেনে নিয়ে যায় সেই পৃথিবীর দিকে,যেখানে তার হৃদয় প্রথমবার কোনো মানবীর জন্য স্পন্দিত হয়েছিল।
জ্যাসপার গভীর চিন্তায় মগ্ন, তার কক্ষে এক অদ্ভুত নীরবতা। হঠাৎ করেই অ্যাকুয়ারা দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। অ্যাকুয়ারার চেহারা দেখেই বোঝা যায়, কিছু গুরুত্বপূর্ণ বলার আছে।
“প্রিন্স,”অ্যাকুয়ারা নীরবতা ভেঙে বলল,”ফিওনার এনগেজমেন্টের খবর পেলাম।”
জ্যাসপার মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল।সে বিশ্বাস করতে পারল না,তার হামিংবার্ড অন্য কারো হতে যাচ্ছে।”এটা কি করে সম্ভব?”তার কণ্ঠে অসন্তোষ আর অবিশ্বাস স্পষ্ট।
“আমি জানি,এই খবর আপনার জন্য কঠিন।কিন্তু আপনি তো জানেন, আমি কখনো মিথ্যা বলি না।আমি নিজে খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হয়েছি,”অ্যাকুয়ারা বলল।
জ্যাসপারের মুখে বিষণ্ণতার ছাপ পড়ল।মনে হচ্ছিল যেন কেউ তার হৃদয়ের গভীরে ছুরি চালিয়েছে। ফিওনার অন্য কারো সাথে বিয়ে! তার সাথে বাসর রাত! এসব ভাবতেই তার ভেতর কেমন আগুন জ্বলে উঠল।
সে জানত,ফিওনার থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্তটা ঠিক ছিল। সে ভেবেছিল,ফিওনা ভালো থাকবে,সুখে থাকবে।কিন্তু এই খবর শোনার পর,তার আত্মা যেন বিদ্রোহী হয়ে উঠল।
“কিন্তু কেন?কিভাবে? সে কি সত্যিই ভুলে গেছে আমাকে?” জ্যাসপার নিজেকেই প্রশ্ন করতে লাগল।
অ্যাকুয়ারা নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। সে জানত, জ্যাসপার নিজেকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, কিন্তু তার মনের অস্থিরতা স্পষ্ট।
জ্যাসপার উঠে দাঁড়াল। তার চোখ দুটো আগুনের মতো লাল হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছিল, পুরো ভেনাস কেঁপে উঠবে তার ক্রোধে।
“আমি নিজেই দেখব।আমাকে পৃথিবীতে যেতে হবে। আমি এটা মেনে নিতে পারছি না।”
অ্যাকুয়ারা কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু জ্যাসপার তখন তার নিজের রাগে আর ক্ষোভে পাগলপ্রায়। “আমি কি সাইকো হয়ে গেছি?কেন মনে হচ্ছে তাকে হারানোর চেয়ে আমার পৃথিবী ধ্বং*স করাও সহজ হবে?”
জ্যাসপার তার পায়চারি থামাল।সে জানে,এই যন্ত্রণা তার নিজের সৃষ্টি। কিন্তু ফিওনাকে অন্য কারো পাশে ভাবাটাই যেন তার জন্য অসহ্য হয়ে উঠল।
জ্যাসপার আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে পারছিল না।তার হৃদয় যেন আগুনে জ্বলছে।সে দ্রুত বেরিয়ে পড়তে গিয়ে অ্যাকুয়ারার সামনে এসে দাঁড়ায়।
“প্রিন্স আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”অ্যাকুয়ারা উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করে।
“পৃথিবীতে।” জ্যাসপারের উত্তর সংক্ষিপ্ত এবং স্পষ্ট।
এমন সময়ে খবরটি ড্রাকোনিসের কানে পৌঁছায়।সে তৎক্ষণাৎ জ্যাসপারকে থামাতে আসল। “জ্যাসপার, তুমি সেখানে যেতে পারবে না!”
জ্যাসপার অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল।”কেন না?আমি ফিওনাকে অন্য কারো হতে দিতে পারি না।সে শুধু আমার!”
ড্রাকোনিস অনেক চেষ্টা করলেও জ্যাসপারের দৃঢ় সংকল্পকে নাড়াতে পারল না।”তুমি জানো,পৃথিবীতে গেলে তোমার জন্য বিপদ অপেক্ষা করছে।তুমি নিজের শক্তি হারাবে!”
কিন্তু জ্যাসপার কিছুতেই শোনেনি।তার মাথায় র*ক্ত উঠেছে, এবং সমস্ত নিয়ন্ত্রণ যেন তার হাতের বাইরে চলে গেছে।সে অল্প সময়ের জন্য ড্রাগনরুপ ধারণ করে আগুনের শিখা প্রবাহিত করতে লাগলো।
আকাশে গর্জন শুরু হলো।ভেনাসের চারপাশে আকাশে আগুনের গোলা উড়ে যেতে লাগল।তার চারপাশের পরিবেশ অন্ধকার হয়ে উঠল।
“আজ যদি আমি পৃথিবীতে না যেতে পারি,তাহলে আমি ভেনাসকেই ধ্বং*স করে দেব!”জ্যাসপারের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসা কথা যেন ভেনাসের প্রতিটি কোণায় পৌঁছে যায়।
ড্রাকোনিস দেখল, জ্যাসপার যেন দুঃস্বপ্নের মধ্যে প্রবেশ করেছে। সে দেখছিল, রাজ্যের সব ড্রাগন তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, কিছুটা আতঙ্কিত, কিছুটা উদ্বিগ্ন।
“মাই সান,থামো!” ড্রাকোনিস আবারও চেষ্টা করল। “এভাবে কিছুই লাভ হবে না।তোমাকে আর কতোবার বোঝাবো?”
কিন্তু জ্যাসপারকে থামানো সম্ভব ছিল না। তার রাগ এবং হতাশার আগুন পুরো এল্ড্র রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ছিল। সে তার যন্ত্রণা, হতাশা, এবং প্রেমকে একত্রিত করে আগুনের বিশাল আক্রমণ চালিয়ে যেতে লাগল, যেন পৃথিবীই তার একমাত্র লক্ষ্য।
জ্যাসপার জানে,যদি সে অপ্রতিরোধ্যভাবে এগিয়ে যায়, তাহলে তার জন্য যা অপেক্ষা করছে,সেটি শুধুই ধ্বং*স। কিন্তু তার হৃদয়ের গভীরে,তার হামিংবার্ডের জন্য সেই ধ্বং*সের পথ বেছে নিতে চেয়েছিল।
জ্যাসপার নিজের আবেগের তাড়নায় পুরো ভেনাসকে জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। তার আগুনের আক্রমণ একের পর এক সৃষ্টি করছিল ভয়াবহতা, আর রাজ্যের প্রতিটি ড্রাগন সেই দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল।
ড্রাকোনিস জানত, তাকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। সে রাজ্যের সমস্ত ড্রাগনদের জরুরি সভায় ডাক দেয়। “শুনো, আমাদের প্রিয় রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য জ্যাসপারের থামানো খুবই জরুরি। তার ক্রোধ আমাদের সবাইকে ধ্বংস করে দিতে পারে!”
ড্রাগনরা একত্রিত হয়ে সভায় আসে, প্রতিটি ড্রাগনের চোখে ছিল উদ্বেগ ও হতাশার ছাপ। “কীভাবে তাকে থামানো যাবে?” একজন ড্রাগন জিজ্ঞাসা করে।
ড্রাকোনিস তাদের উদ্দেশ্যে বলে,”আমাদের পরিকল্পনা করতে হবে।আমাদের শক্তি একত্রিত করে জ্যাসপারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। সে যে পথে চলছে, তাতে শুধু নিজেরই ক্ষতি করবে না,বরং পুরো ভেনাসকেও ধ্বংস করবে।”
ড্রাগনদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়। কিছু ড্রাগন তোয়ালে তুলে নেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। “কিন্তু সে তো আমাদের সবার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী!” অন্য একজন ড্রাগন শঙ্কা প্রকাশ করে।
“ঠিক আছে,” ড্রাকোনিস নির্ধারিত কণ্ঠে বলে, “আমাদের শক্তি এবং একতা নিয়ে কাজ করতে হবে। আমরা যদি একত্রিত হয়ে তাকে থামাতে পারি, তবে হয়তো আমরা ভেনাসকে রক্ষা করতে পারব।”
তবে জ্যাসপারের আগুনের আক্রমণের তীব্রতা বেড়ে চলছিল। চারপাশের পরিবেশ পুড়ে যাচ্ছিল, এবং তার ক্ষোভের ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া আকাশে ছড়িয়ে পড়ছিল। ভেনাসের নীল আকাশ আজ কালো এবং ধূসর হয়ে উঠছিল।
জ্যাসপারের চোখের লাল অগ্নি ক্রমাগত আরো প্রজ্জ্বলিত হচ্ছিল,যেন তার অভ্যন্তরীণ ক্ষোভের সাথে এক হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু ড্রাকোনিস এবং অন্যান্য ড্রাগনরা বুঝে গেছে, এই যুদ্ধে তাদের একতা ও সাহসই হবে মূল হাতিয়ার। তারা মিলে প্রস্তুতি নিতে থাকে, জ্যাসপারকে থামানোর জন্য তাদের সমন্বিত শক্তির প্রয়োজন ছিল।
ড্রাকোনিসের ল্যাবে এক তীব্র চাঞ্চল্য ছিল। বিজ্ঞানীরা দ্রুত বিভিন্ন উপকরণ প্রস্তুত করছিলেন, কারণ তারা জানত, জ্যাসপার যদি এইভাবে ধ্বংসাত্মক হয়ে থাকে, তবে তাকে থামানোর জন্য বিশেষ কিছু করতে হবে। ড্রাকোনিসের নির্দেশে তারা একটি নতুন কেমিক্যাল তৈরি করেছিল, যা জ্যাসপারের ড্রাগন শক্তিকে কমিয়ে দিতে সক্ষম।
কেমিক্যালটির নাম ছিল “ড্রাগোনিক ফিজিক্যাল রিজার্ভ,” যা মূলত ড্রাগনের শক্তি শোষণ করে এবং তাদের মেটাবলিজমে একটি ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। এর উপাদান ছিল নির্দিষ্ট রাসায়নিকগুলি, যা শুধুমাত্র ড্রাগনের দেহে প্রবাহিত হলে তার শক্তি কমিয়ে দেয়।
“এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক,” এক বিজ্ঞানী বলল। “যদি এটি সঠিকভাবে প্রয়োগ না করা হয়, তবে জ্যাসপারের মৃত্যু হতে পারে।”
“তবে আমাদের কোন বিকল্প নেই,” ড্রাকোনিস সঙ্কল্পের সঙ্গে বলল। “জ্যাসপার আমাদের রাজ্যকে ধ্বংস করছে। আমাদের তাকে থামাতে হবে।”
যেমনই প্রস্তুতি সম্পন্ন হল, ড্রাকোনিসের নেতৃত্বে অন্যান্য ড্রাগনরা বিশাল ড্রাগন রূপে পরিণত হল। তারা বিশাল শিকল প্রস্তুত করল, যা বিশেষ কেমিক্যালে প্রলেপিত ছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল জ্যাসপারের শক্তিকে অবরুদ্ধ করা।
জ্যাসপার তখন পুরো ভেনাসে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হঠাৎ, চারপাশের ড্রাগনরা তার দিকে তীব্র গতিতে ছুটে আসতে শুরু করল। জ্যাসপারের তীব্র গর্জন শোনা গেল।
“জ্যাসপার!” ড্রাকোনিস ডাক দিল। “তুমি আমাদের রাজ্যের জন্য বিপদ ডেকে আনছো!”
ড্রাগনরা একসঙ্গে জ্যাসপারের দিকে এগিয়ে গেল। তাদের শক্তি এবং সমন্বিত প্রচেষ্টা দিয়ে তারা তাকে আক্রমণ করল। বিশাল শিকলটি জ্যাসপারের শরীরে লেপটে গেল।
জ্যাসপার গর্জন তুলে শিকলগুলো ভেঙে ফেলতে চেষ্টা করল, কিন্তু কেমিক্যালের প্রভাব তার শক্তি কমিয়ে দিয়েছিল। ধীরে ধীরে সে মানব রূপে পরিণত হল, কিন্তু শিকলটি তখনও তার শরীরে ছিল।
“এটি অসম্ভব!” জ্যাসপার চিৎকার করে বলল। “ড্রাকোনিস আপনি আমার সাথে এমনটা করতে পারেন না আমি এই ভেনাসের প্রিন্স আমি গোটা রাজ্যের প্রিন্স!”
ড্রাকোনিস এবং অন্যান্য ড্রাগনরা শিকলটি আরও শক্ত করে ধরল। জ্যাসপার অবিশ্বাস্যভাবে চেষ্টা করে গেল,কিন্তু তার শক্তি আর সেই আগের মতো ছিল না।
এথিরিয়ন,আলবিরা,থারিনিয়াস এবং অ্যাকুয়ারা সমস্ত কিছু দেখছিল।তাদের চোখের কোণে জল চলে আসে। এথিরিয়নের চোখ দিয়ে র*ক্ত অশ্রু পড়তে লাগল।
“জ্যাসু ভাইয়া আমরা তোমাকে ভালোবাসি,”এথিরিয়ন বলল, তার গলা ভেঙে আসছিল। “আমরা চাই না তুমি এত কষ্ট পাও।”
থারিনিয়াস মুখ লুকাতে লাগল,আর অ্যাকুয়ারা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে বলল,“এভাবে শেষ হবেনা।আমাদের একত্রিত হতে হবে। আমরা আপনাকে শান্ত করবো।”
ড্রাকোনিসের চোখেও জল জমে গিয়েছিল।সে বুঝতে পারছিল,তার পুত্ররের অবস্থা সত্যিই করুণ।
“আমি তোমার কখনো ক্ষতি করতে চাইনি,মাই সান,” ড্রাকোনিস বলল। “তুমি আমার জন্য আর এই গোটা ভেনাসের জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলে।”
ড্রাকোনিসের ঘোষণা শোনার পর ভেনাসের রাজ্যে শোকের ছায়া পড়ে গিয়েছিল।সমস্ত ড্রাগন একত্রিত হয়ে ম*র্মাহত হয়ে শুনতে লাগল যে,তাদের প্রিয় প্রিন্সকে ব*ন্দি করা হবে একটি বিশেষ কাঁচের বক্সে,যা সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে তৈরি। ড্রাকোনিস জানিয়ে দিলেন,”এটি একমাত্র উপায়,যাতে আমরা রাজ্যকে রক্ষা করতে পারি আর আমার পুত্রকেও।”
বক্সটি ছিল প্রায় দুই মিটার উঁচু এবং এক মিটার চওড়া, স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে তৈরি।এটি একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার অভ্যন্তরীণ পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করত। বক্সের ভিতরে একটি বিশেষ কেমিক্যাল প্রলেপিত করা হয়েছিল, যার নাম ছিল “ট্রাঙ্কুলিন-৯,” যা ড্রাগনের মেটাবলিজমকে উল্লেখযোগ্যভাবে ধীর করে দেয় এবং তাদের শক্তি ও ক্ষতিপূরণ ক্ষমতা হ্রাস করে।
এই কেমিক্যালটি একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল,যাতে মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল ড্রাগনের দেহ থেকে সংগৃহীত প্রোটিন এবং একাধিক রাসায়নিক উপাদান।যখন একটি ড্রাগন এর সঙ্গে যোগাযোগ করত,তখন এটি দ্রুত তার শক্তি শোষণ করে নিত।
বক্সটি তখন তৈরি করা হল বিশাল এক সিলিন্ডার আকারে, যাতে ভিতরে কোনও আলো প্রবাহিত না হয়। এটি সম্পূর্ণ অন্ধকার ছিল, যা জ্যাসপারের মনোযোগকে আরো নিবদ্ধ করতে সহায়ক হবে। বক্সের উপরে একটি ডিভাইস লাগানো ছিল, যা জ্যাসপারের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিবিধি ও হৃদস্পন্দনকে মনিটর করবে।
ড্রাকোনিস জানালো,এক বছর জ্যাসপারকে এখানেই থাকতে হবে।সে যদি তার অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তবে তাকে মুক্ত করা হবে।”
জ্যাসপারকে যখন শিকল ধরে বক্সের ভিতরে প্রবেশ করানো হচ্ছিল,তখন সে হতাশ ও বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিল।ড্রাগন রূপের শক্তি তার মধ্যে ছিল,কিন্তু সে জানত,এখন তার কিছুই করার নেই।
“আমাকে এখানে বন্দি করবেন না,”সে ভয়ঙ্কর গর্জন করল।কিন্তু ড্রাকোনিসের দৃঢ় মনোভাব তাকে বাধা দেয়।
“এটি আমাদের সবার নিরাপত্তার জন্য।তুমি যদি সত্যিই আমাদের সবার ভালো চাও,তবে আমাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে আমার নিজের পুত্র বলে আমি তোমাকে ছাড় দিবো না,মনে রেখো আমি এখনো এই ভেনাসের ড্রাগন কিং”ড্রাকোনিস বলল।
আযদাহা পর্ব ১
বক্সের ভিতর গিয়ে জ্যাসপার বুঝতে পারল, এ যেন এক অন্ধকারের কুঠুরি, যেখানে তার নিজেকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। কেমিক্যালের প্রভাব তাকে ধীরে ধীরে ঘুমের রাজ্যে নিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু মনোযোগের নেশা তাকে পাগল করে দিচ্ছিল।
ড্রাকোনিসের ঘোষণা ভেনাসের রাজ্যের সবাইকে একত্রিত করে ফেলেছিল,সবাই তাকে সমর্থন করতে প্রস্তুত ছিল।কিন্তু তারা জানত,প্রিন্স বন্দি হলে তাদের নিজেদের নিরাপত্তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা।