আযদাহা সিজন ২ পর্ব ১২

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ১২
সাবিলা সাবি

কেটে গেছে অনেকগুলো দিন।সময় চলছে আগের নিয়মেই,কিন্তু থমকে আছে ফিওনার ভাবনাগুলো।
তারা এখনো বন্দী হয়ে আছে সেই স্টাডি রুমের স্মৃতিতে—যেখানে জ্যাসপার বিদায় নেওয়ার আগে শেষ মুহূর্তে তাকে দাবী করেছিল।তার সেই গাঢ় সবুজ চোখ,দাবিদার ঠোঁট আর প্রতিটি আদেশ যেন ফিওনার মনের গহীনে চিরস্থায়ী দাগ কেটে গেছে।
কিন্তু এইসব ভাবনার সুযোগ নেই এখন।দুদিন বাদে পরীক্ষা,আর ফিওনার মনোযোগ পুরোপুরি এক জায়গায় রাখতে হবে।ভেনাসের উচ্চ পদের জন্য শুধু প্রভাব বা শক্তি থাকলেই হয় না,মেধাও প্রয়োজন।আর সে তো ফ্লোরাস রাজ্যের রাজকন্যা!
তবে যতই পড়াশোনায় মন বসানোর চেষ্টা করুক,কিছুতেই সেই বিশেষ মুহূর্তগুলোর হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারছে না ফিওনা।মাঝে মাঝে মনে হয়,জ্যাসপার যেন কাছেই আছে,অদৃশ্য হয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে।তার প্রতিটি চিন্তার ভেতরে সে ঢুকে গেছে।
ফিওনা চোখ বন্ধ করলো।কিন্তু বন্ধ চোখের ভেতরেও শুধু একটাই ছবি ভেসে উঠলো—সেই চাহনি,সেই স্পর্শ,আর সেই দাবিদার কণ্ঠস্বর।

ভেনাসের আকাশের গাঢ় কমলা রঙ ছাপিয়ে নিচে নেমে এলো ছোট্ট একটি স্পেসশিপ।ধীরে ধীরে দরজা খুলে গেল, আর ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো লিউ ঝান।
কোনো স্পেসসুট নেই,কোনো অক্সিজেন মাস্কও না—তবুও সে অনায়াসে দাঁড়িয়ে আছে এই আগুনের মতো উত্তপ্ত গ্রহের মাটিতে।
কারণ একটাই।
সে তার গ্র্যান্ডফাদার ওয়াং লির গবেষণাগার থেকে এক অমূল্য তথ্য পেয়েছে—একটি বিশেষ রাসায়নিক,যা মানুষের শারীরিক গঠনকে যেকোনো পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করে।
ওয়াং লি এটিকে “EvoNex-7” নাম রেখেছিলেন।
এই ক্যামিক্যাল একবার শরীরে প্রবেশ করলে—
অক্সিজেনের সংকট থাকলেও শরীর তার নিজস্ব উপায়ে প্রয়োজনীয় গ্যাস উৎপাদন করতে পারে।
চরম তাপমাত্রা বা বিষাক্ত বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করলেও শরীর সেগুলোর সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে।
কম মাধ্যাকর্ষণ বা অতিরিক্ত ভারী মাধ্যাকর্ষণেও স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করা সম্ভব হয়।
এটি ছিল ওয়াং লির “Project Eternal Genesis”-এর অংশ,যেখানে তিনি চেয়েছিলেন মানুষকে অমরত্বের দিকে নিয়ে যেতে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

লিউ ঝান জানে,এই ক্যামিকেল তার ভেনাস অভিযানের জন্য অপরিহার্য ছিল।এখন সে এখানে এসেছে তার ভালোবাসার মানুষকে খুঁজতে।
ভেনাসের লাল বালুকারাশির ওপর ধীরে ধীরে পা রাখলো লিউ ঝান।
“আমি এসে গেছি ক্যামেলিয়া!…”~
স্পেসশিপের দরজা বন্ধ হয়ে গেল পেছনে।এখন শুধুই সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা।
লিউ ঝান হাতে থাকা ছোট ডিভাইসটির স্ক্রিনের দিকে তাকালো।
ডিভাইসটি একটানা ঝিমঝিম শব্দ করছে।স্ক্রিনে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে ফ্লোরাস রাজ্যের অবস্থান।
এটাই তার টার্গেট।
এই পুরো ম্যাপ পাওয়ার পেছনে ছিলো ফিওনার সেই ইমেলে চেন শিংকে পাঠানো।
যখন সে তার গ্র্যান্ডপা চেন শিংকে ইমেইল করেছিল,তখনই সেই ডাটা হ্যাক করে লিউ ঝান পুরো ভেনাসের মানচিত্র বের করে ফেলেছে।
আর চেন শিং যে তথ্য জানিয়েছে তাতেই স্পষ্ট—ফিওনা এখন ফ্লোরাস রাজ্যের প্রিন্সেস।
তবে সমস্যা একটাই—

এই দীর্ঘপথ সে কীভাবে অতিক্রম করবে?
এখানে তার নিজস কোনো যানবাহন নেই,আর স্পেসশিপ নিয়ে রাজ্যের ভেতরে প্রবেশ করা অসম্ভব।
কিন্তু লিউ ঝান সবসময়ই প্ল্যান বি নিয়ে চলে।
সে জানে ভেনাসের মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর তুলনায় অনেক কম। তাই দ্রুত চলার জন্য সে সঙ্গে করে এনেছে বিশেষভাবে তৈরি করা স্কেটিং গিয়ার।এটি সাধারণ স্কেটিং গিয়ারের মতো নয়। এটি “HyperGlide-X”—একটি অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি স্কেটিং ডিভাইস।
এর চৌম্বকীয় শক্তি মাধ্যাকর্ষণকে শূন্যের কাছাকাছি নামিয়ে আনতে পারে।এই গিয়ার পায়ে পরার সঙ্গে সঙ্গে শরীর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়।
উচ্চ গতিতে চলতে এটি বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, তাই কয়েক ঘণ্টার পথ মিনিটের মধ্যেই অতিক্রম করা সম্ভব।লিউ ঝান HyperGlide-X পায়ে পরলো, এবং এক মুহূর্তের মধ্যেই সে হাওয়ায় ভেসে উঠলো।
তার চোখে একটাই লক্ষ্য—ফ্লোরাস রাজ্য।

আর তার মন বলে দিচ্ছে—ফিওনা বেশি দূরে নেই…
হাওয়ায় ভেসে থাকা অবস্থায় লিউ ঝান অনুভব করলো—
সে এখন কেবল একজন ডাক্তার নয়।
বিজ্ঞানই তার অস্ত্র।
নিজের প্রতিটি সিদ্ধান্ত,প্রতিটি পদক্ষেপ এখন তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে—সে একজন দক্ষ বিজ্ঞানীও হয়ে উঠেছে।
তার দাদা ওয়াং লির ল্যাবে কাটানো সময়,অসংখ্য গবেষণা, রাতজাগা হিসাব—এসব বৃথা যায়নি।
এতদিন সে শুধু একজন চিকিৎসক হিসেবেই পরিচিত ছিল, কিন্তু এখন…ভেনাসের আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে সে বুঝতে পারছে,সে তার দাদার উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

সকালের নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে ফ্লোরাস রাজ্যের আকাশে।লিয়ারা দিনের প্রথম আলোতেই উঠে পড়েছেন। রাজপ্রাসাদের সার্ভেন্টরা সকালের নাস্তা তৈরিতে ব্যস্ত,তবে লিয়ার চোখ আটকে গেলো বাইরে—
দুজন গার্ডের কণ্ঠস্বর ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
তর্কের শব্দ শুনে তিনি দ্রুত সেদিকে এগিয়ে গেলেন।
প্রাসাদের প্রবেশদ্বারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন যুবক—অপরিচিত,অচেনা,কিন্তু তার দৃষ্টি যেনো চেনা কিছু খুঁজছে।
যুবকটি দেখতে স্পষ্টতই ভেনাসের কোনো ড্রাগন নয়।
সে কে?
লিয়ার কপালে ভাঁজ পড়লো।
গার্ডরা তাকে আটকে রেখেছে,কিন্তু যুবকের মুখে কোনো ভয় বা দ্বিধার ছাপ নেই।
লিয়ারা সরাসরি প্রশ্ন করলেন,”তুমি কে?এখানে কেন এসেছ?”
যুবক বিন্দুমাত্র হকচকায়নি,শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিলো,

“আমার নাম লিউ ঝান।আমি পৃথিবী থেকে এসেছি।আর আমি ফিওনার জন্য এসেছি।ওকে একটু ডেকে দিন,ও আমাকে চিনবে।”
লিয়ার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেলো।পৃথিবী থেকে?ফিওনার জন্য?তার হৃদয়ে অস্বস্তির সুর বাজতে থাকলো।
লিয়ার চোখ সরু হয়ে এলো।
তিনি দৃঢ় কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, “তুমি ফিওনার কে হও?”
লিউ ঝান এক মুহূর্তও দেরি না করে জবাব দিলো,”আমি ফিওনার ফিয়ান্সে।”
এই কথায় লিয়ার মনে ঝড় বয়ে গেলো।
ফিওনা একবার সত্যিই বলেছিল যে,পৃথিবীতে তার একজনের সঙ্গে এনগেজমেন্ট হয়েছে। কিন্তু লিয়ার কখনো ধারণা ছিল না যে,সেই যুবক একদিন সত্যিই ফ্লোরাস রাজ্যে এসে হাজির হবে।
তবে অবাক হওয়ার মতো আরও কিছু ছিল।
একজন মানুষ… কীভাবে ভেনাসের কঠিন পরিবেশে এত স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে?
সাধারণত, পৃথিবীর কোনো প্রাণীর পক্ষে এই রাজ্যের বাতাসে শ্বাস নেওয়া সম্ভব নয়।
লিয়ার চোখ এবার আরও গভীর হলো।

তবে তিনি আপাতত কিছু বললেন না।
গভীর চিন্তায় ডুবে গিয়ে কিছুক্ষণ লিউ ঝানকে পর্যবেক্ষণ করলেন,তারপর ধীরে বললেন,
“ভেতরে এসো।”
গার্ডদের ইঙ্গিত দিতেই তারা সরে গেলো।
লিউ ঝান আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে এগিয়ে গেলো,আর লিয়ার মনে হাজারো প্রশ্নের ভিড় তৈরি হলো।এই যুবক কি সত্যিই ফিওনার ফিয়ান্সে?নাকি তার আগমনের পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে?
ফিওনা ঘুম থেকে সবে মাত্র উঠেছে।চোখে এখনো ঘুমের ঘোর লেগে আছে,কিন্তু লিয়ারার কণ্ঠ তাকে পুরোপুরি জাগিয়ে তুললো।
“ফিওনা,নিচে এসো।তোমার জন্য একজন এসেছে।”
ফিওনা অবাক হয়ে তাকালো,”আমার জন্য?কে?”
লিয়ারা সামান্য থেমে বললেন,”ও নিজেই বলছে সে তোমার ফিয়ান্সে!”
ফিওনার মনে এক মুহূর্তের জন্য যেন সবকিছু স্থির হয়ে গেল।
ফিয়ান্সে?ফিওনার চোখ ধীরে ধীরে বিস্তৃত হলো।
“লিউ ঝান?”

সে তো জানতো,গ্ৰান্ডপা বলেছিলো,লিউ ঝান রওনা দিয়েছে ভেনাসের উদ্দেশ্য।কিন্তু এত দ্রুত সে এখানে পৌঁছে যাবে, সেটা কল্পনাও করেনি!
লিয়ারার কণ্ঠে দৃঢ়তা ছিল,”ও ড্রইং রুমে বসে আছে,তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
ফিওনা দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।ঘুম জড়ানো ভাব এখন পুরোপুরি উধাও।সে কিছুটা বিভ্রান্ত ছিল,কিছুটা অস্বস্তিতেও।তার পৃথিবীর জীবন আর ভেনাসের জীবন যেন সম্পূর্ণ আলাদা দুইটা অধ্যায়।লিউ ঝান এখানে এলে… সবকিছু আরও জটিল হয়ে যেতে পারে।
ফিওনা তার আলগা চুলগুলো একপাশে সরিয়ে দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।নিচে নামার সময় তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছিলো।লিউ ঝান… সত্যিই কি ভেনাসে পৌঁছে গেছে?
ফিওনা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নামছিলো।তার মনে হাজারো প্রশ্ন—কিভাবে লিউ ঝান এখানে আসতে পারে এতো বড় রিস্ক নিয়ে?সে কি জানে ভেনাসে মানুষের বেঁচে থাকা সম্ভব নয়?

লিউ ঝান সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো,তার গভীর দৃষ্টি সরাসরি ফিওনার মুখে আটকে গেলো।
সে আগের মতোই আছে—হয়তো একটু বেশি আত্মবিশ্বাসী, একটু বেশি দৃঢ়।তীক্ষ্ণ চোয়াল,মোহনীয় চোখ আর স্বাভাবিক কৌতুকপূর্ণ হাসি তার ঠোঁটের কোণে খেলা করছে।তবে আজ তার চোখে সাদা ফ্রেমের চশমা,যা তাকে আরও বুদ্ধিদীপ্ত দেখাচ্ছে।সে পরেছে সাদা শার্ট,যা নিখুঁতভাবে কালো প্যান্টের সাথে ইন করা।হাতে দামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি,কাঁধে বড় একটা ব্যাগ ঝুলছে। তার উপস্থিতি দেখে মনে হচ্ছিলো,যেন ভেনাসের পরিবেশ তাকে কোনো প্রভাবই ফেলতে পারেনি।

ফিওনা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিলো,আর লিউ ঝানের চোখ এক মুহূর্তের জন্যও তার ওপর থেকে সরেনি। ফিওনা যেন এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না,যে মানুষটাকে সে পৃথিবীতে ফেলে এসেছিলো,সে আজ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে—ভেনাসের মাটিতে,কোনো সুরক্ষা পোশাক ছাড়াই।
ফিওনা একদম কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো,চোখে বিস্ময়ের ছাপ।”মিস্টার লি… আপনি?”
লিউ ঝান মৃদু হাসলো,কিন্তু তার চোখের গভীরে ছিলো অভিমান আর একরাশ অভিযোগ।
“ফিওনা,কেমন আছো তুমি?চলে আসার আগে তুমি একবারও দেখা করলে না আমার সাথে??”
তার কণ্ঠে এক ধরনের চাপা ব্যথা ছিলো,যা ফিওনার কানে কাঁপন তুললো।
ফিওনা একটু চুপ করে রইলো,তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো— “কিভাবে দেখা করতাম?আমি সেরকম পরিস্থিতিতে ছিলাম না। হঠাৎ ড্রাগন হয়ে যাওয়া,সবকিছু বদলে যাওয়া…এতকিছুর মধ্যে তোমার সামনে দাঁড়ানোর মতো সাহস আমার ছিলো না।”

লিউ ঝান তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো,যেন কিছু খুঁজে পেতে চাইছে তার চোখের ভেতর।
“তুমি ভেবেছিলে আমি বুঝতে পারবো না তোমার পরিস্থিতি?আমি কি এতটাই অচেনা ছিলাম তোমার কাছে?”
ফিওনা কিছু বললো না,শুধু একপাশে মুখ ফিরিয়ে নিলো। তবে লিউ ঝান এত সহজে ছাড়ার মানুষ নয়,সে আজ উত্তর নিয়েই যাবে।
ফিওনা যেন দ্রুতই প্রসঙ্গ পাল্টে দিলো।তার কণ্ঠ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেও ভেতরের অস্বস্তিটা লুকানো যাচ্ছিলো না।”মিস্টার লি,উনি আমার মা,” ফিওনা হালকা হাসলো।
লিউ ঝান এক মুহূর্ত দেরি না করে দু’হাত জোড় করে মাথা হালকা নিচু করলো,যেন শ্রদ্ধা জানাচ্ছে।
“সরি, আন্টি,আপনাকে প্রথমে চিনতে পারিনি।”
লিয়ারা মৃদু হেসে বললেন, “ইটস ওকে,তোমরা বসো,আমি খাবার আনছি।”
তিনি চলে গেলে ফিওনা লিউ ঝানকে বসতে বললো।লিউ ঝান তার ব্যাগটা নামিয়ে সোফায় বসল,আর ফিওনা আরেকটা সোফায় একটু দূরে জায়গা নিলো।

কিছুক্ষণ কারো মুখে কোনো কথা নেই।লিউ ঝান ফিওনার দিকে তাকিয়ে ছিলো,যেন বোঝার চেষ্টা করছে,কতটা বদলে গেছে সে।
ফিওনা চোখ নামিয়ে নিজের আঙুল নিয়ে খেলছিলো,যেন বুঝতেই পারছে না কী বলবে।কিন্তু লিউ ঝান এত সহজে চুপ থাকবে না।
“তুমি আসলে আমকে দেখে নার্ভাস,তাই না?” লিউ ঝানের কণ্ঠ ছিলো নরম কিন্তু দৃঢ়।ফিওনা কিছু বললো না,শুধু একটু হাসলো, যেন তার প্রশ্নটা শোনেনি। কিন্তু লিউ ঝান জানে,এই হাসির আড়ালে কিছু একটা লুকিয়ে আছে।
হঠাৎ ফিওনা একসাথে অনেক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,”আপনি এখানে এলেন কিভাবে?ফ্লোরাস রাজ্যের পথ চিনলেন কীভাবে? আর সবচেয়ে বড় কথা,সুট ছাড়া কীভাবে ভেনাসের পরিবেশে পা রাখলেন?”
লিউ ঝান মুচকি হেসে বললো, “রিল্যাক্স ফিওনা!এতোগুলো প্রশ্ন একসাথে করলে আমি কোনটা আগে উত্তর দেব?”
সে আরাম করে সোফায় হেলান দিলো, এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নিলো ঘরের আশপাশে, তারপর ফিওনার দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি তো আর সাধারণ মানুষ না,আমি একজন বিজ্ঞানীর নাতী।আমার গ্ৰান্ডফাদার ওয়াং লি-এর ল্যাব থেকে কিছু তথ্য পেয়েছিলাম।সেখানে একটা বিশেষ কেমিক্যালের কথা বলা ছিলো,যা শরীরে প্রবাহিত হলে ভেনাসের পরিবেশে অক্সিজেনের মতো কাজ করবে, তাপমাত্রার সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করবে।সেই কেমিক্যাল ব্যবহার করে আছি এখন।”

ফিওনা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো,যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।
লিউ ঝান আবার বললো, “আর ফ্লোরাস রাজ্যের পথ চিনেছি তোমার পাঠানো ইমেলের মাধ্যমেই।জানো তো,গ্ৰান্ডপা চেন শিং-এর প্রযুক্তি বেশ উন্নত,ওনার ল্যাব থেকে ভেনাসের একটা ম্যাপ বের করতে পেরেছি।তারপর লোকেশন ট্র্যাক করে তোমার কাছে চলে এলাম।”
ফিওনা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো,এত কিছুর পরেও লিউ ঝান ঠিক তার কাছে পৌঁছে গেছে!
ফিওনা গভীরভাবে লিউ ঝানের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, “গ্র্যান্ডপা কেমন আছেন? আর মিস ঝাং?”
লিউ ঝান মৃদু হাসলো, “তারা ভালো আছে,কিন্তু তোমাকে খুব মিস করে ফিওনা।গ্র্যান্ডপা সবসময় তোমার কথা বলেন, আর মিস ঝাং তো তোমার রুম একদম আগের মতোই গুছিয়ে রেখেছে, যেন তুমি যেকোনো মুহূর্তে ফিরে আসবে।”

ফিওনার চোখে হালকা জল চিকচিক করলো।নস্টালজিয়া যেন এক মুহূর্তে তাকে গ্রাস করলো—পৃথিবীতে তার ছোট্ট রুম,গ্র্যান্ডপা চেন শিং-এর কড়া শাসন,মিস ঝাং-এর যত্ন… এসব যেন এখন কেবলই স্মৃতি।
কিন্তু ফিওনা দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো।সে মুখের অনুভূতি আড়াল করে নরম গলায় বললো, “আমি ওনাদের অনেক মিস করি, কিন্তু…” সে থেমে গেলো, বাক্য শেষ করলো না।
লিউ ঝান তার চশমাটা একটু ঠিক করলো, গভীর দৃষ্টিতে ফিওনার দিকে তাকিয়ে বললো, “তোমাকে ফিরে পেতেই আমি এখানে এসেছি,ফিওনা।”

ফিওনা কি বলবে তা বুঝে ওঠার আগেই লিয়ারা খাবার নিয়ে হাজির হয়।টেবিলে খাবার রাখার পর সেই অদ্ভুত ফলটাও দেখতে পায় ফিওনা।ফিওনা জানে লিউ ঝান নিশ্চয় এই ফল কিভাবে খেতে হবে তা জানবে না।
ফিওনা হাত বাড়িয়ে ফলটা তুলে নিলো, কিন্তু তার মনে তখন অন্য কিছু চলছে। সেই প্রথম দিনটার কথা মনে পড়ে গেল—যেদিন ফ্লোরাস রাজ্যে এসেছিল, যেদিন জ্যাসপারের সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল।
সেই স্মৃতি যেন এক ঝলকে ফিরে এলো—জ্যাসপার নিঃশব্দে তার সামনে বসেছিল, ফিওনা তখনো নতুন এই রাজ্যের নিয়ম-কানুন জানতো না, এমনকি কীভাবে এই অদ্ভুত ফল খেতে হয়, সেটাও জানতো না। অথচ, জ্যাসপার বিনা বাক্যব্যয়ে ফলটা নিয়ে খোসা ছাড়িয়ে তার প্লেটে রেখে দিয়েছিল।
এক মুহূর্তের জন্য ফিওনা থমকে গেলো। যেন সেই পুরোনো মুহূর্তটা ফিরে এসেছে, কিন্তু সামনে জ্যাসপার নেই, আছে লিউ ঝান।

লিউ ঝান ফিওনার দৃষ্টি লক্ষ্য করলো, তারপর বললো,”ফিওনা?”
লিউ ঝানের কণ্ঠ শুনে ফিওনা সম্বিত ফিরে পেলো। সে তাকিয়ে দেখলো,লিউ ঝান প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
ফিওনা দ্রুত মুখের ভাব পাল্টে নিলো,যেন কিছুই হয়নি, তারপর হাসি হাসি মুখে বললো,”এই ফলটা খেতে জানে তো?”
লিউ ঝান একটু ভ্রু কুঁচকে বললো, “আসলে না… দেখতে অদ্ভুত লাগছে। কিভাবে খেতে হয়?”
ফিওনা নিজেও জানে,প্রথমবার সে ও পারেনি … কিন্তু এবার সে জ্যাসপারের মতো ফলের খোসা ছাড়িয়ে লিউ ঝানের প্লেটে রাখলো, মৃদু হেসে বললো, “এভাবেই খেতে হয়।”
কিন্তু ভিতরে ভিতরে ফিওনার মন অন্য কোথাও হারিয়ে গেছে…

লিয়ারা আবার এসে বললো,”লিউ ঝান অনেক দূর থেকে এসেছে, ওর বিশ্রামের দরকার।”
তার কণ্ঠে অতিথির প্রতি আন্তরিকতা আর কর্তৃত্বের মিশ্রণ। তারপর তিনি ফিওনার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি ওকে অতিথি কক্ষে নিয়ে যাও,যাতে ও একটু বিশ্রাম নিতে পারে।”
ফিওনা মাথা নাড়ল,যদিও তার ভেতরে এক অজানা অস্বস্তি কাজ করছিল।
লিউ ঝান রাজপ্রাসাদের অলঙ্কৃত করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চারপাশটা অবাক হয়ে দেখছিল।সোনালী আলোর নিচে ফুলের নকশা করা দেয়াল,ছাদের ঝুলন্ত জ্যোতির্ময় স্ফটিক—সবকিছু যেন রাজকীয় সৌন্দর্যের এক অপূর্ব মিশেল।
অতিথি কক্ষে পৌঁছে ফিওনা দরজার সামনে থামল। “এটাই আপনার থাকার জায়গা,” সংক্ষিপ্ত স্বরে বলল সে।
লিউ ঝান একবার চারপাশটা দেখে মৃদু হেসে বলল, “ভেনাসের সৌন্দর্য তো কল্পনার চেয়েও বহুগুণ বেশি।”
ফিওনা ঠোঁট চাপা দিল, তার মনে পড়ল প্রথমবার যখন সে এখানে এসেছিল, ঠিক এই একই বিস্ময় তাকে ঘিরে ধরেছিল।

“হ্যাঁ,” ফিওনা আস্তে বলল, “আমি প্রথম দিন অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।তবে শুধু রাজপ্রাসাদ নয়,এখানকার বিশ্ববিদ্যালয় আর গবেষণাগারও অসম্ভব উন্নত—আধুনিকতার সীমানা ছাড়িয়ে গেছে।”
লিউ ঝান বিছানায় বসে ফিওনার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। চারপাশটা ভালোভাবে লক্ষ্য করলো সে—প্রাচীরের গায়ে ফুলের নকশা,মেঝেতে নরম কার্পেট,জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল দূরে বিস্তৃত রঙিন ফুলের বাগান।
“তাহলে বিজ্ঞান আর ঐতিহ্যের এক মিশ্রণ বলা যায়,তাই না?” লিউ ঝান হেসে বললো।
ফিওনা মাথা নাড়লো। “হ্যাঁ,এখানে রাজকীয়তা যেমন আছে, তেমনি প্রযুক্তিও আছে। প্রথমে ভাবতেই পারিনি,এতো আধুনিক ভার্সিটি আর গবেষণাগারও এখানে থাকবে।”
লিউ ঝান জানালার দিকে এগিয়ে গিয়ে বাইরে তাকালো। একটা অদ্ভুত আলোয় ঝলমল করছিল পুরো ফ্লোরাস রাজ্য।

“আমি সত্যি ভাবিনি,অন্য কোনো গ্রহেও এমন উন্নত সভ্যতা থাকতে পারে।” লিউ ঝান গভীরভাবে বললো।”তবে তুমি এখানে কেমন আছো,ফিওনা?তোমার মন কি এখানে টিকে আছে?”
ফিওনা একটু চুপ করলো,তারপর বললো, “আমি জানি না। কিছু কিছু জিনিস এখানে আমার জন্য একদম নতুন, কিছু কিছু জিনিস আবার খুব আপন মনে হয়। তবে…”
সে বাক্য শেষ করলো না।
লিউ ঝান ফিওনার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। “আমি বুঝতে পারছি,ফিওনা। তোমার পুরো জীবন বদলে গেছে, তাই না?”
ফিওনা কোনো উত্তর দিলো না।জানালার বাইরে অপার মহাকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো।হয়তো সে নিজেও জানে না,তার ভবিষ্যৎ ঠিক কোন দিকে যাচ্ছে।

দুপুরের আলো ঝলমল করছে রাজপ্রাসাদের সোনালি ঝাড়বাতির নিচে।ডাইনিং টেবিল ইতিমধ্যেই সুস্বাদু খাবারের সুবাসে ভরে উঠেছে।একে একে সবাই এসে বসেছে—রাজা জারেন,প্রিন্সেস অ্যালিসা,সিলভা,লিয়ারা,আর এবার নতুন অতিথি লিউ ঝান।
প্রথমে রাজপরিবারের সদস্যরা কিছুটা বিস্মিত হয় লিউ ঝানকে দেখে।তাদের চোখে একটাই প্রশ্ন—মানব হয়েও কীভাবে সে এত অনায়াসে ভেনাসের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে?তবে লিয়ারা ধীরে ধীরে তার পরিচয় দিলে সবাই স্বস্তি পায়।
কিন্তু সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বসিত হয় অ্যালিসা।লিউ ঝান যে ফিওনার বাগদত্তা,এটা শুনে তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।সে হাসিমুখে ফিওনার দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে তুই আমাদের থেকে এটা লুকিয়েছিলি ফিওনা?”
ফিওনা কিছু বলতে যাচ্ছিল,কিন্তু তখনই রাজা জারেন কথা বললেন, “আমাদের রাজ্যে একজন মানব অতিথি,সত্যিই দারুণ ব্যাপার।” তার কণ্ঠে ছিল বিস্ময় ও মৃদু প্রশংসার মিশ্রণ।

খাবার পরিবেশিত হতে শুরু করল।রাজকীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী,খাবার পরিবেশন সাধারণত দাস-দাসীদের কাজ। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে লিউ ঝান নিজেই রাজা জারেনের দিকে খাবারের পাত্র এগিয়ে দিল।
রাজা জারেন কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলেন,তারপর মৃদু হাসলেন।মানুষের প্রতি সম্মান ও বিনয়ের এমন নিদর্শন দেখে তিনি খুশি হলেন।
“খুবই চমৎকার ব্যবহার,লিউ ঝান,” প্রশংসাসূচক কণ্ঠে বললেন তিনি। “তোমার মধ্যে সৌজন্যবোধের অভাব নেই।”
লিউ ঝান বিনীতভাবে মাথা নাড়ল। “ভদ্রতা সব সংস্কৃতিতেই গুরুত্বপূর্ণ,মহারাজ আঙ্কেল,”সে শান্ত গলায় বলল।
তার ব্যবহার দেখে টেবিলে উপস্থিত সবাই খুশি হলো,কিন্তু ফিওনা এক অদ্ভুত দ্বিধায় পড়ে গেল।
কিয়ৎক্ষন বাদে রাজা জারেন খানিকটা গম্ভীর হয়ে খেতে খেতে প্রশ্ন করলেন, “লিউ ঝান তুমি তো মানব,আর ফিওনা ড্রাগন।তোমাদের বিবাহ তো ভেনাসের নিয়মের বাইরে। তাহলে এই সম্পর্ক কীভাবে সম্ভব?”
ডাইনিং টেবিলে মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এলো।সবাই লিউ ঝানের দিকে তাকিয়ে রইল, যেন তার জবাবের অপেক্ষায়।

লিউ ঝান একগাল হেসে সোজা হয়ে বসল। তারপর একপ্রকার আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, “সায়েন্সের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে,এটা আসলে অসম্ভব কিছু নয়,মহারাজ আঙ্কেল।ফিওনার জিনগত গঠন সম্পূর্ণ ড্রাগনের মতো নয়। তার শরীরে মানুষের জিনও রয়েছে,যা তাকে দুটো ভিন্ন প্রজাতির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে।”
“মানে?” রাজা জারেন ভ্রু কুঁচকালেন।
লিউ ঝান একটু থেমে ব্যাখ্যা করল, “ফিওনার জীনে জিনোম স্ট্রাকচারে এমন কিছু এলিমেন্ট রয়েছে,যা তাকে মানব ও ড্রাগনের মাঝামাঝি অবস্থানে রাখে।তার সেল মেমব্রেনে রয়েছে বিশেষ ধরনের ‘মেটা-অ্যাডাপটিভ প্রোটিন’, যা ভিন্ন গ্রহের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।একারণেই সে পৃথিবীতেও বেঁচে থাকতে পারে আবার ভেনাসেও।”

রাজা জারেন ও বাকিরা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন।
“এখন আসি আমাদের বিবাহের প্রসঙ্গে,” লিউ ঝান একটু হেসে বলল। “যেহেতু ফিওনার জেনেটিক স্ট্রাকচার ড্রাগনদের থেকে কিছুটা আলাদা,তাই সে সম্পূর্ণ ড্রাগনদের আইন মেনে চলতে বাধ্য নয়।সে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে আর তার শরীর দুই গ্রহের পরিবেশে সহনশীল বলে তার সঙ্গী মানব হলেও কোনো সমস্যা হবে না।অর্থাৎ, ভেনাসের নিয়ম আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।”
অ্যালিসা মুগ্ধ হয়ে বলল, “বাহ!আপনি তো শুধু সুদর্শন নন, অনেক বুদ্ধিমানও!”
সিলভাও মাথা নেড়ে বলল, “এত বিজ্ঞানসম্মতভাবে কেউ এই বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে পারবে,ভাবতেই পারিনি!”
রাজা জারেন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “বিজ্ঞান সত্যিই আশ্চর্যজনক।তুমি আমার রাজ্যে এসে অনেক কিছু শিখিয়েছো,লিউ ঝান।”
লিউ ঝান মাথা নিচু করে নম্রতার সাথে বলল, “আমি শুধু সত্যিটা ব্যাখ্যা করলাম,মহারাজ আঙ্কেল।”
ফিওনা পুরো সময়টাই চুপ ছিল,কিন্তু তার চোখে বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট ছিল।লিউ ঝান শুধু একজন ডাক্তারই নয়, একজন অসাধারণ বিজ্ঞানীও হয়ে উঠেছে—এটা সে ভালোভাবেই বুঝতে পারল।

খাবারের পর্ব চুকে যাওয়ার পর ফিওনা লিউ ঝানের কক্ষে গেল।দরজায় কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে লিউ ঝানের কণ্ঠ ভেসে এলো, “ভেতরে এসো,ফিওনা।”
ফিওনা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখলো, লিউ ঝান বিছানায় আধশোয়া হয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে।
“আপনার কিছু লাগবে?” ফিওনা জিজ্ঞেস করলো।
লিউ ঝান ফিওনার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললো, “না, কিন্তু কক্ষে বসে খুব বোর ফিল করছি।চলো,একটু বাইরে ঘুরে আসি।”
ফিওনা ভ্রু কুঁচকে বললো, “কোথায় ঘুরবেন?আমি তো এখানকার কিছু চিনিই না।”
লিউ ঝান চোখের সামনে একটা ছোট ম্যাপ খুলে দেখিয়ে বললো, “আমার কাছে ম্যাপ আছে। আর এখানে একটা বিশাল গেম জোন আছে আর সিলভার সাথে কিছুক্ষণ আগে আড্ডা দিয়েছিলাম ও জানিয়েছে অনেক কিছু গেম বিষয়ে। চলো,সেখানে যাই,একটু ফান করা যাক।”
ফিওনা একটু অবাক হলো, “গেম জোন ভেনাসে?”

লিউ ঝান হেসে বলল, “হ্যাঁ, আমি ম্যাপে দেখেছি।এই রাজ্যে শুধু রাজপ্রাসাদ আর গবেষণাগারই নেই,বিনোদনের জন্যও অনেক কিছু আছে বিশাল গেম জোন রয়েছে,যেখানে ভার্চুয়াল সিমুলেশন থেকে শুরু করে নানান প্রযুক্তির খেলা আছে।আমি সত্যিই দেখতে চাই,ভেনাসের প্রযুক্তি আসলে কতটা উন্নত!”
ফিওনা একটু দ্বিধায় পড়ল, “কিন্তু আমরা সেখানে ঢুকতে পারবো তো?আমার তো জানা নেই রাজপরিবারের বাইরের কেউ ওখানে যেতে পারে কি না।”
লিউ ঝান আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, “তুমি এখন এই রাজ্যের একজন প্রিন্সেস।আমি তোমার অতিথি,আমাদের প্রবেশে কোনো বাধা হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া,আমি যদি এই রাজ্যের উন্নত প্রযুক্তি সম্পর্কে কিছু না শিখতে পারি, তাহলে আমার আসার উদ্দেশ্যও অপূর্ণ থেকে যাবে।”
ফিওনা একটু ভেবে বলল, “ঠিক আছে,তাহলে চলুন।”

দুজন একসাথে রাজপ্রাসাদের প্রবেশদ্বার পেরিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।তাদের একজন ড্রাগন গার্ড তাদের জন্য একটি স্বয়ংক্রিয় উড়ন্ত বাহন প্রস্তুত করেছিল,যা আলোসজ্জিত একটি ছোট এয়ারক্রাফটের মতো দেখাচ্ছিল।
লিউ ঝান বাহনটি দেখে মুগ্ধ হয়ে বলল, “তোমাদের পরিবহন ব্যবস্থা তো একেবারে সাই-ফাই মুভির মতো!পৃথিবীতে এরকম কিছু ভাবাই যায় না।”
ফিওনা হাসল, “আপনি তো এখন বিজ্ঞানী,তাই এ ধরনের জিনিস দেখে এত অবাক হচ্ছেন যে!”
লিউ ঝান মজা করে বলল, “আমি বিজ্ঞানী,ম্যাজিশিয়ান নই! এগুলো বাস্তবে দেখার অভিজ্ঞতা একেবারে অন্যরকম।”
বাহনটি বাতাসে ভেসে উঠলো ইর গেম জোনের দিকে দ্রুতগতিতে রওনা দিলো।ভেনাসের আকাশের নিচে,নতুন এক অভিজ্ঞতার অপেক্ষায় ছিল তারা দুজন।

অবশেষে তারা বিশাল এক এলাকায় এসে পৌঁছালো,যা ছিল ভেনাসের সবচেয়ে আধুনিক আর বৃহৎ গেম জোন। প্রবেশদ্বারেই বড়সড় একটি হলোগ্রাফিক বোর্ড ঝুলছিল, যেখানে বিভিন্ন গেমের নাম আর স্কোরবোর্ড ভাসছিল। জোনের চারপাশে ঝলমলে আলো,শূন্যে ভাসমান স্পোর্টস এরিনা এবং বিভিন্ন ধরনের রোবটিক সহকারী ব্যস্ত ছিল খেলোয়াড়দের সাহায্য করতে।
লিউ ঝান কিছু সময় সিলভার সাথে আড্ডা দিয়েছিলো তখন,আর সিলভা তাকে এখানকার গেম সম্পর্কে জানিয়েছিলো।সিলভা বলেছিলো “এখানে মাধ্যাকর্ষণ নিয়ন্ত্রণের ফুটবল,ভার্চুয়াল যুদ্ধ খেলা,সময়-চালিত ধাঁধা আর ন্যানো-প্রযুক্তির টেডি ক্যাচার গেম আছে।”
লিউ ঝানের চোখ চকচক করে উঠলো “টেডি ক্যাচার? এখানে সেই গেমও আছে,যেখানে বাক্সের মধ্যে অনেকগুলো পুতুল থাকে আর কয়েন দিয়ে কন্ট্রোলার চালিয়ে পুতুল তুলতে হয়?”
সিলভা মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ,তবে এটি সাধারণ মেকানিক্যাল নয়।এই গেমে প্রতিটি পুতুল আসলে মিনি-রোবট। যারা স্মার্ট সেন্সর ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে।”
লিউ ঝান মুগ্ধ হয়ে বলল, “অসাধারণ! পৃথিবীতে এত উন্নত কিছু কল্পনাও করা যায় না।”
সিলভা হেসে বললো, “তাহলে আপনার আর ফিওনার দুজনের টিকিট কাটাই?একবার খেলে দেখুন!”

লিউ ঝান আর ফিওনা একসাথে টিকিট সংগ্রহ করে গেম জোনে প্রবেশ করলো।মুহূর্তেই তাদের চারপাশে এক অন্যরকম অনুভূতি ছড়িয়ে পড়লো।বিভিন্ন ভার্চুয়াল আর ফিজিক্যাল গেমের স্টেশন সাজানো ছিল,সবগুলোই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে নির্মিত।
প্রবেশের সাথে সাথে তাদের দুজনকে বিশেষ ধরনের সুট দেওয়া হলো। “এই সুট শরীরের মুভমেন্ট ট্র্যাক করে আর কিছু বিশেষ গেমের জন্য এক্সোস্কেলেটন হিসেবে কাজ করবে,” এক রোবটিক সহকারী ব্যাখ্যা করলো।
লিউ ঝান সহজেই সুট পরে ফেললো,কিন্তু ফিওনার সুটের চেনটা অনেক শক্ত ছিল।সে নিজেই লাগানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু পারছিল না।
লিউ ঝান হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো,”ড্রাগন হয়েও এতটুকু শক্তি নেই তোমার ?”
ফিওনা একটু অস্বস্তি বোধ করলো,কিন্তু কিছু বলার আগেই লিউ ঝান একটানে চেনটা লাগিয়ে দিলো।ফিওনা কিছুটা বিস্ময়ে তার দিকে তাকাল,কিন্তু লিউ ঝান মজা করেই বলল, “দেখলে?মানব হয়েও আমি তোমার থেকে বেশি শক্তিশালী!”

ফিওনা চোখ ঘুরিয়ে বললো, “আমার শক্তি দেখার সুযোগ পেলে তখন বোঝা যাবে মিস্টার !”
লিউ ঝান হেসে উঠলো, “ঠিক আছে, তাহলে দেখা যাক, কে আগে গেম জেতে!”
এবার তারা গেম স্টেশনগুলোর দিকে এগিয়ে গেল, যেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ভেনাসের অবিশ্বাস্য সব চ্যালেঞ্জ।
ফিওনা প্রথমে বেশ উৎসাহ নিয়ে টেডি ক্যাচার গেম শুরু করলো।বিশাল কাঁচের বাক্সের ভেতর অসংখ্য রঙিন,নরম, সুন্দর টেডি পুতুল ছিল,যারা মৃদু নড়াচড়া করছিল যেন তারা নিজেই ধরা না দিতে চায়।প্রতিটি পুতুলের গায়ে ছোট ছোট ন্যানো সেন্সর বসানো ছিল,যা তাদের আরও চতুর করে তুলেছিল।
ফিওনা মনোযোগ দিয়ে কন্ট্রোলার ধরে ক্রেনটি নিচে নামালো।প্রথমবার একটু এদিক-সেদিক হয়ে গেল।সে আবার চেষ্টা করলো,কিন্তু পুতুলটি ঠিকমতো ওঠার আগেই ফসকে গেল।তৃতীয়বারও একই হলো।
লিউ ঝান পাশ থেকে দাঁড়িয়ে মজা দেখতে লাগলো,তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি।ফিওনার ব্যর্থতা দেখে সে একটু কৌতুক করে বললো, “হুম, এত সহজ একটা গেমও পারছো না?”
ফিওনা বিরক্ত হয়ে বললো, “এটা সহজ হলে আপনি নিজেই খেলছেন না কেন?”
লিউ ঝান হাসলো, “আমি চাইলেই পারি,কিন্তু আমি দেখতে চাই তুমি নিজের চেষ্টায় জিতো কি না!”
ফিওনা ঠোঁট কামড়ে আবার মনোযোগ দিলো।কিন্তু যখন আবারো ব্যর্থ হলো,তখন লিউ ঝান হঠাৎ তার হাতের উপর হাত রাখলো।

ফিওনা চমকে উঠলো।সে একটু সরে যেতে চাইল,কিন্তু লিউ ঝান মৃদু স্বরে বললো, “থাকো,একটু ধৈর্য ধরো।”
তারপর সে ফিওনার আঙুলের উপর আলতো করে তার হাত রেখে কন্ট্রোলারের ওপর চাপ দিলো।ফিওনার হৃদস্পন্দন একটু বেড়ে গেল অসস্থিতে।লিউ ঝান এতটা কাছে ছিল যে তার নিঃশ্বাস স্পষ্ট অনুভূত হচ্ছিল।
অবশেষে ক্রেন ধীরে ধীরে নিচে নামলো,একবার দুললো, তারপর হঠাৎ করেই একটাকে ধরে ফেললো!
ফিওনার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল, “আমি…আমি ধরেছি!”
লিউ ঝান হাসলো, “তুমি না আমি?”
ফিওনা ভ্রু কুঁচকে বললো, “আপনার সাহায্য ছাড়া আমিও পারতাম!”
লিউ ঝান কাঁধ ঝাঁকালো, “ঠিক আছে,তাহলে আরেকটা ধরো দেখি!”
ফিওনা মুখ বাঁকালো,কিন্তু মনে মনে স্বীকার করলো—হয়তো একটু সাহায্য পেয়ে যাওয়াটা খারাপ ছিল না।
গেম জোনের অন্য গেমগুলো
টেডি ক্যাচার গেমে সাফল্যের পর ফিওনা আর লিউ ঝান আরও কয়েকটি ইউনিক গেম ট্রাই করার জন্য এগিয়ে গেল। চারপাশে নানান রঙিন আলো,হোলোগ্রাফিক স্ক্রিনে চলতে থাকা বিজ্ঞাপন আর খেলোয়াড়দের উত্তেজনাপূর্ণ চিৎকার গেম জোনকে যেন এক নতুন জগতে পরিণত করেছিল।

“গ্র্যাভিটি চ্যালেঞ্জ” এটা ছিল এক ধরনের ভারহীনতার অভিজ্ঞতা দেওয়া গেম।অংশগ্রহণকারীদের একটি চেম্বারে ঢুকতে হয়,যেখানে গ্র্যাভিটি পরিবর্তন করা যায়।কেউ নিচে হাঁটছে তো হঠাৎ ছাদে উঠে যাচ্ছে!
ফিওনা প্রথমে একটু দ্বিধায় পড়লো,কিন্তু লিউ ঝান মজা দেখতে চায় বলে সে রাজি হয়ে গেল।
গেম শুরু হওয়ার পরই ফিওনা ভারহীন হয়ে বাতাসে উড়ে গেল!সে কিছুতেই নিজের ভারসাম্য রাখতে পারছিল না। লিউ ঝান পাশ থেকে হেসে বললো, “এবার তো তোমার ড্রাগন শক্তি কাজে লাগাও!”
ফিওনা বিরক্ত মুখে বললো, “এই গেমটা আপনার জন্য সহজ,আপনি তো পৃথিবীর মানুষের মতো নিয়ম মেনে চলেন না!”
লিউ ঝান তখন একপাশে লাফ দিয়ে ওয়ালের সাথে হালকা ধাক্কা দিয়ে মাটিতে নেমে এলো,যেন ওজন পরিবর্তন করা তার কাছে সাধারণ ব্যাপার!ফিওনা অবাক হয়ে গেল—সে কীভাবে এত সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো?

এরপর তারা ঢুকলো “রংধনু শ্যুটিং” নামের একটি গেমে, যেখানে খেলোয়াড়দের হাতে বিশেষ পেইন্ট গানের মতো বন্দুক দেওয়া হয়।এই বন্দুক থেকে রঙিন তরল বের হয়ে প্রতিপক্ষকে চিহ্নিত করে।
ফিওনা আর লিউ ঝান আলাদা দুই দলে ভাগ হলো।ফিওনা দ্রুত একটা ব্যারিকেডের পেছনে লুকালো,লিউ ঝানও অন্যদিকে অবস্থান নিলো।
হঠাৎই ফিওনা লক্ষ্য করলো,লিউ ঝান নিঃশব্দে তার দিকে এগিয়ে আসছে। সে সাথে সাথে বন্দুক তাক করলো!
প্যাঁচ!
একটা নীল রঙের দাগ লিউ ঝানের বাহুতে লাগলো।
লিউ ঝান অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো, “হুম! তুমি তো বেশ ভালো শুটার!”
কিন্তু ঠিক তখনই লিউ ঝান তার বন্দুক তুললো আর ফিওনার দিকেও গুলি ছুঁড়লো।
প্যাঁচ!
ফিওনার সাদা সুটে গাঢ় লাল রঙের একটা দাগ বসে গেল।
“আহ্! আপনি আমাকে মেরে দিলেন!” ফিওনা নাটকীয়ভাবে অভিনয় করলো,যেন সে হেরে গেছে।
লিউ ঝান হাসলো, “যুদ্ধের ময়দানে দয়া দেখানো যায় না,ফিওনা!”
ফিওনা চোখ কুঁচকে বললো, “ওহ্ তাই? তাহলে দেখি কে জেতে!”
এবার তারা একে অপরকে তাড়া করতে লাগলো,একের পর এক রঙিন গুলি ছোঁড়ার সাথে সাথে পুরো গেম এরিয়াটি যেন রঙধনুর মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো!

“হ্যালুসিনেশন মিরর মেজ” এই গেমটিতে খেলোয়াড়দের একটি বিশাল আয়নার গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে বের হতে হয়, কিন্তু আয়নাগুলো এমনভাবে সাজানো যে কোনটা আসল পথ,আর কোনটা প্রতিফলন—তা বোঝা অসম্ভব!
ফিওনা প্রথমে আয়নাগুলোতে দেখে নিজের প্রতিচ্ছবি চিহ্নিত করার চেষ্টা করলো,কিন্তু বারবার ধাক্কা খাচ্ছিল। লিউ ঝান তখন আয়নার গায়ে হাত রেখে মৃদু বললো, “তোমার চোখ নয়,তোমার মন ব্যবহার করো!”
ফিওনা গভীরভাবে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করলো। ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারলো—আসল পথের আয়নার গায়ে সামান্য কম আলোর প্রতিফলন হয়।

অবশেষে ফিওনা প্রথমেই বেরিয়ে গেল,আর লিউ ঝান এখনও ভেতরে ছিল।
ফিওনা মজা করে বললো, “কি হলো মিস্টার লি?আমিতো ভেবেছিলাম আপনি বুদ্ধিমান!”
লিউ ঝান আয়নার ভেতর থেকে বললো,”আমি শুধু তোমাকে সুযোগ দিয়েছি!”
এভাবেই তারা একের পর এক ইউনিক গেম খেলতে থাকলো, একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলো,আর কিছুক্ষণের জন্য সব দুশ্চিন্তা ভুলে পুরোপুরি আনন্দে মেতে উঠলো।
গেম জোন থেকে বেরিয়ে আসার সময় ফিওনার চোখে ছিল উজ্জ্বল আনন্দের ঝিলিক,মুখে প্রশান্তির হাসি।আজকের দিনটা যেন তার জীবনের অন্যতম সেরা দিন হয়ে থাকল। সারাদিনের দৌড়ঝাঁপ,হাসি-মজা আর প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে লিউ ঝানকে সে এক নতুন রূপে আবিষ্কার করলো—একজন বন্ধুর মতো,একজন সঙ্গীর মতো,এমন কেউ,যার ওপর সে ভরসা করতে পারে।

হালকা শীতল বাতাস বইছিল চারপাশে।সন্ধ্যার আকাশে ফ্লোরাস রাজ্যের তারারা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে,নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্যের অলিগলিতে।ফিওনা কিছুটা হাঁপিয়ে গিয়ে লিউ ঝানের পাশে দাঁড়াল।এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হালকা স্বরে বলল, “সত্যি,আজকের দিনটা অসাধারণ ছিল!”
লিউ ঝান তার দিকে তাকিয়ে হাসলো,চোখে প্রশান্তির ছোঁয়া। “তাহলে কি আমাকে ধন্যবাদ দেবে?”
ফিওনা হেসে বললো, “হয়তো, কিন্তু একটা কথা বলি?”
“কি?”
ফিওনা গভীরভাবে তাকিয়ে বললো, “আপনার মতো একজন বন্ধু জীবনে থাকা দরকার।”
লিউ ঝানের হাসিটা তখন একটু ম্লান হয়ে গেল,তবে তার ভেতরে একটা উষ্ণ অনুভূতি ছড়িয়ে পড়লো। শুধু বন্ধু? হয়তো সে চাইতো আরও কিছু,কিন্তু এই মুহূর্তে ফিওনার মুখে এই কথাটুকুই তার জন্য যথেষ্ট ছিল।
অন্যদিকে,লিউ ঝান নিজেও অনুভব করছিল যে আজকের দিনটা তার জন্য কতটা বিশেষ।তার ভালোবাসার মানুষটির সাথে এতগুলো সুন্দর মুহূর্ত কাটাতে পেরে সে যেন নিজের জীবনকে আরও অর্থবহ মনে করছিল।
ফিওনার চোখে যে প্রথম দিন লিউ ঝানকে দেখে যে অস্বস্তি ছিল,তা আজ যেন কোথাও মিলিয়ে গেছে।আজকের পর থেকে লিউ ঝান শুধুই একজন অতিথি নয়,বরং ফিওনার জীবনের এক বিশেষ অংশ হয়ে উঠছে—যা সে নিজেও টের পেতে শুরু করেছে।

বাড়িতে ফেরার পর রাতের খাবারের আয়োজন ছিল বেশ জমকালো।সবার মধ্যেই ছিল দিনের আনন্দের রেশ।ফিওনা ও লিউ ঝান সারাদিনের ক্লান্তির পরও বেশ প্রাণবন্ত ছিল। খাবারের টেবিলে বসে রাজা জারেন লিউ ঝানের দিকে তাকিয়ে সন্তুষ্টির হাসি দিলেন।
“তুমি বেশ বুদ্ধিমান ছেলে,লিউ ঝান,” রাজা বললেন, “আরো কিছুদিন থাকো,দেখবে,ফ্লোরাস রাজ্য তোমাকে আপন করে নেবে।”
লিউ ঝান মাথা নাড়িয়ে সৌজন্যের হাসি দিল।

এদিকে,সিলভা আর লিউ ঝানের মধ্যে যেন দারুণ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে।খাবারের ফাঁকে ফাঁকে সিলভা লিউ ঝানের কাছে পৃথিবীর বিভিন্ন মজার জিনিস সম্পর্কে জানতে চাইছিল,আর লিউ ঝানও আগ্রহ নিয়ে সবকিছু ব্যাখ্যা করছিল।
খাবার শেষে সবাই যার যার কক্ষে ফিরে গেল।ফিওনা নিজের কক্ষে এসে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া ফ্লোরাস রাজ্য দেখতে লাগলো। আজকের দিনটা সত্যিই অন্যরকম ছিল।লিউ ঝানের আগমনের পর রাজপ্রাসাদে যেন একটা নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে।
অন্যদিকে,লিউ ঝান অতিথি কক্ষে বসে নিজের দিনের স্মৃতি রোমন্থন করছিল।তার মনে হচ্ছিল,এই রাজ্য,এই ড্রাগনগুলো, বিশেষ করে ফিওনা—তার জীবনে সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
একই রাতে, আলিসা তার ঘরে বসে চিন্তায় মগ্ন ছিল। ফিওনার জন্য তার মনে সবসময় ঈর্ষা ছিলো।লিউ ঝানকে দেখে বেশ আনন্দ লাগছে।এখন আর তার প্রিন্স জ্যাসপার ওই ফিওনার হবেনা, শুধু তার হবে।
ফ্লোরাস রাজ্যে রাত গভীর হচ্ছিল,কিন্তু রাজপ্রাসাদের ভেতরে কারও কারও মনে নতুন নতুন অনুভূতির জন্ম হচ্ছিল—কেউ আনন্দে,কেউ দ্বিধায়,কেউবা হালকা ঈর্ষায়।

ফিওনা এখনো স্টাডি রুমে বসে পড়ছে।আগামীকাল পরীক্ষা,তাই সে এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করতে চায় না।টেবিলে বইয়ের স্তূপ,পাশে কিছু নোট,আর সামনে রাখা চায়ের কাপ—সব মিলিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ার পরিবেশ।
হঠাৎ দরজার সামনে একটা পরিচিত ছায়া পড়লো।ফিওনা বই থেকে মুখ তুলতেই দেখলো লিউ ঝান দাঁড়িয়ে আছে।
“মিস্টার লি!আপনি এখানে?”
লিউ ঝান হালকা হাসলো,তারপর ধীরে ধীরে ভেতরে এসে একটা চেয়ারে বসলো। ফিওনা তাকে বসতে বলেছিল,কিন্তু তার চোখ পড়লো লিউ ঝানের হাতের দিকে।সে পকেট থেকে কিছু বের করছে।
একটা চকোলেট!কিন্তু এটা তো সাধারণ কোনো চকোলেট নয়—এটা পৃথিবীর এক বিশেষ ব্র্যান্ড,যা ফিওনার সবচেয়ে প্রিয়!

ফিওনা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলো।লিউ ঝান চকোলেটটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “মনে আছে তোমার?তুমি যখন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে,আর আমি তোমার ট্রিটমেন্ট করছিলাম, তখন রোজ আমি তোমার জন্য এই চকোলেট আনতাম?”
ফিওনা বিস্মিত কণ্ঠে বললো, “আপনি এত দূর থেকে এই চকলেট এনেছেন শুধু আমার জন্য?”
লিউ ঝান এক মুহূর্তের জন্য চুপ থাকলো, তারপর হালকা হাসলো। “তোমার পছন্দের জিনিসগুলো আমি ভুলি নি, ফিওনা।”
ফিওনার হৃদয় এক অদ্ভুত অনুভূতিতে ভরে গেল।এতদিন পরও লিউ ঝান তার ছোট্ট পছন্দটাও মনে রেখেছে।সে চকোলেটটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করলো,মনে পড়লো সেই দিনগুলোর কথা,যখন প্রতিদিন লিউ ঝান এটাই এনে দিত, যাতে তার মন ভালো থাকে।
“ধন্যবাদ, মিস্টার লি,” ফিওনা মৃদু হেসে বললো।
হঠাৎ করেই লিউ ঝানের পকেট থেকে একটা ছোট্ট কিছু মেঝেতে পড়ে গেল। ফিওনার দৃষ্টি সেদিকে যেতেই সে অবাক হয়ে দেখলো—ওটা সেই ছোট টেডি!
“আরে, মিস্টার লি! এটা তো সেই টেডি, যেটা আজ গেমে পেয়েছিলাম আমরা!” ফিওনা হেসে বললো। “আপনি এখনো এটা রেখে দিয়েছেন?”

লিউ ঝান নিচু হয়ে টেডিটা তুলে নিলো, তারপর সেটাকে একবার দেখে মৃদু হাসলো। “হুম,কেন রাখবো না?”
ফিওনা তার দিকে তাকিয়ে বললো,”এটা তো খুবই ছোট্ট! কালকে আমি আপনার জন্য একটা বড় টেডি কিনে দেবো। এটা তো ঠিক নেই!”
লিউ ঝান টেডিটাকে হাতের মধ্যে ঘুরিয়ে বললো, “তুমি কী বলছো?এটা দেখো কত কিউট!আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো—এটা তুমি নিজের হাতে ক্যাচ করেছিলে। এটা আমার কাছে শুধুই একটা খেলনা না,এটা একটা স্মৃতি।”
তার কণ্ঠে এক ধরনের আন্তরিকতা ছিল,যা ফিওনার মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি করলো।সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে হাসলো,তারপর বললো, “আচ্ছা ঠিক আছে, যেহেতু এটা আপনার কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ, তাহলে এটা আপনি রাখতেই পারেন!”
ওদের কথার ফাঁকে স্টাডি রুমের জানালা দিয়ে চাঁদের আলো পড়ছিল, আর ফিওনা অনুভব করলো, আজকের দিনটা সত্যিই অন্যরকম ছিল।

ফিওনার আগামীকাল গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা।রাত গভীর হলেও তাকে সারারাত পড়তে হবে।লিউ ঝানও পাশে বসে আছে, মাঝে মাঝে তাকে কিছু কঠিন বিষয় বুঝিয়ে দিচ্ছে। বিজ্ঞানের কিছু জটিল তত্ত্ব ফিওনার জন্য সহজ করে ব্যাখ্যা করছিল সে।
কিন্তু কিছুক্ষণ পর লিউ ঝান খেয়াল করলো,ফিওনার কলমটা হাত থেকে পড়ে গেছে।তার মাথাটা টেবিলের ওপর রাখা বইয়ের পাশে হেলে পড়েছে,আর গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে।
লিউ ঝান একটু চুপ করে রইলো।এরপর ধীরে ধীরে টেবিলে কনুই রেখে হাতের ওপর থুতনি ঠেকিয়ে ফিওনার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
চাঁদের আলো জানালা দিয়ে পড়ে ফিওনার মুখটা আলতোভাবে আলোকিত করছিল।শান্ত,প্রশান্ত মুখ।যেন কোনো চিন্তার ছাপ নেই,কেবল গভীর ঘুম।তার নিঃশ্বাসের ওঠানামা পর্যন্ত লিউ ঝান খেয়াল করছিল।
একটা মুহূর্তের জন্য, লিউ ঝানের মনে হলো—এই মুহূর্তটা যেন একদম স্থির হয়ে থাকুক। মহাবিশ্বের সব কিছু থেমে যাক, শুধু এই নির্ভেজাল প্রশান্তির দৃশ্যটা চলতে থাকুক অনন্তকাল।

তারপর নিঃশব্দে উঠে দাঁড়িয়ে তার গা থেকে কোট খুলে আলতোভাবে ফিওনার গায়ে জড়িয়ে দিলো।একটু হেসে বললো, “এত পরিশ্রম করলে তো পরীক্ষা ভালোই দেবে, ক্যামেলিয়া!”
কিন্তু ফিওনা কিছু শুনলো না।সে তখনো গভীর ঘুমে…
লিউ ঝান প্রথমে আস্তে করে ফিওনাকে ডাকলো, “ফিওনা…?”
কিন্তু কোনো সাড়া নেই। ফিওনা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে।
লিউ ঝান একটু চুপ করে থাকলো,তারপর নিঃশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে ফিওনার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকালো। মনে মনে ভাবলো, যদি এখন তাকে না নিয়ে যায়,তবে সে সারারাত এখানেই পড়ে থাকবে।
অনেক দ্বিধা করে শেষ পর্যন্ত সে ফিওনাকে কোলে তুলে নিলো। ফিওনার শরীর একদম হালকা লাগলো,যেন নিঃসঙ্গ রাতে চাঁদের আলোকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
ধীরে ধীরে পায়ে পায়ে ফিওনার কক্ষে গিয়ে,বিছানার ওপর আলতো করে শুইয়ে দিলো। তখনই ফিওনার হাতের আঙুলে তার নজর পড়লো।

লিউ ঝানের দেওয়া আংটিটা এখনো ফিওনার আঙুলে!
তার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠলো। হয়তো ফিওনা ভুলেই গেছে যে, এই আঙটিটা খুলে ফেলার কথা। বা হয়তো… সে নিজেও চায়নি খুলতে।
এক মুহূর্ত চুপ থেকে লিউ ঝান নিজের আঙুল বাড়িয়ে ফিওনার আঙুলের সঙ্গে মিলিয়ে ধরলো। তারপর চোখ বন্ধ করে একটুখানি অনুভব করলো সেই স্পর্শ।
তারপর ধীরে ধীরে ফিওনার আঙুলে একটা নরম চুমু এঁকে দিলো।
কম্বলটা ঠিকঠাক গুছিয়ে দিয়ে ফিওনার কপালের একপাশে চুল সরিয়ে দিলো লিউ ঝান। শেষবারের মতো একবার তাকিয়ে, নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো।
ফিওনা তখনো ঘুমের দেশে… কিন্তু হয়তো কোথাও একটা স্বপ্নের আভাস তৈরি হয়ে গেছে।
ফিওনা কিছুক্ষণ বাদে ঘুমের ঘোরে মুখে বিড়বিড় করলো।
শব্দগুলো অস্পষ্ট, কিন্তু একটাই শব্দ স্পষ্ট শোনা গেলো— “প্রিন্স…”

অন্যদিকে, এই একই সময়ে, জ্যাসপার দাঁড়িয়ে আছে শনি গ্রহের বৃহত্তম চাঁদ, টাইটান-এর বালুময় পৃষ্ঠে। তার হাতে সূর্য পাথর জ্বলজ্বল করছে, যার প্রতিফলিত আলো তার চোখে পড়ছে।
হঠাৎ, এক আশ্চর্য অনুভূতি তার ভেতর কাঁপন তুলে দিলো। যেন কোনো দূরত্ব নেই, যেন এক মুহূর্তের জন্য ফিওনার উপস্থিতি সে অনুভব করতে পারছে।
“ফিওনা!”
তার হৃদয় বলছে— সে এখনই আমার কথা ভাবছে।
জ্যাসপার চোখ বন্ধ করলো, সূর্য পাথরটা শক্ত করে ধরলো, তারপর ধীরে ধীরে একটা হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে।
“আমার মন বলছে, তুমি আমার কথা ভাবছো, হামিংবার্ড। আর আমি? আমি তোমাকে কতটা মিস করছি, তা বলে বোঝাতে পারবো না…”
সে আকাশের দিকে তাকালো। অজানা এক কষ্ট তার বুকের মধ্যে ধাক্কা দিলো।
“বলেছিলাম, তোমার ওপর নজর রাখবো। কিন্তু এমন এক জায়গায় এসেছি, যেখানে সেটা সম্ভব হচ্ছে না।”
সে হাতের মুঠো শক্ত করলো, যেন ফিওনার প্রতি প্রতিশ্রুতি নিজের ভেতর বেঁধে রাখছে।
“তবে চিন্তা কোরো না, হামিংবার্ড।আর মাত্র তিনদিন। তারপর তুমি আমার কাছে থাকবে।

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ১১

“বাহাত্তর ঘণ্টা! তিনটি দীর্ঘদিন আর তার প্রতিটি মিনিট ধৈর্যের পরীক্ষা। চার হাজার তিনশ বিশ মিনিটের প্রতিটি ক্ষণ যেন অপেক্ষার এক অনন্ত প্রহর।আর যদি সেকেন্ডে ভাঙে, তবে দুই লাখ ঊনষাট হাজার দুইশো বার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন,প্রতিটি নিঃশ্বাসের হিসাব।কিন্তু ন্যানোসেকেন্ড? অবিশ্বাস্য এক সংখ্যা— দুই দশমিক পাঁচ নয় দুই গুণিত দশের চৌদ্দ ঘাত!এত ক্ষুদ্র অথচ এত বিশাল,যেন প্রতিটি মুহূর্তের প্রতিটি কণা পর্যন্ত সময়ের ভার বহন করছে।”
তারপর জ্যাসপার আবার সূর্য পাথরটা শক্ত করে ধরলো।
তুমি অপেক্ষা করো,হামিংবার্ড… আমি আসছি।

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ১৩