আযদাহা সিজন ২ পর্ব ২৮
সাবিলা সাবি
ফিওনার চোখ ধীরে ধীরে খুলে গেলো। সকালের নরম আলো ঘরের পর্দা ছুঁয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছে, হালকা বাতাসে জানালার কপাট কেঁপে উঠছে। সে জানেই না, ঠিক কতক্ষণ ধরে সে ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু ঘুম ভাঙার পর প্রথমেই যা দেখলো, তা তাকে মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ করে দিলো।
জ্যাসপার…
সে পাশেই শুয়ে আছে, নিঃশ্বাস ভারী, নিখুঁত এক প্রশান্তির ঘুমে আচ্ছন্ন। তার মুখটা এখন যেন আগের চেয়ে অনেক বেশি কোমল, অনেক বেশি নিষ্পাপ। সারাদিনের তীব্রতা, আগ্রাসন, দাবিদাওয়া—সব হারিয়ে গেছে ঘুমন্ত মুখের স্নিগ্ধতায়।
ফিওনা নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলো, সময়টা স্থির হয়ে গেছে।
জ্যাসপারের চোখের পাপড়ির দিকে তাকিয়ে ফিওনার মনে হলো, ওর মতো ঘন আর লম্বা পাপড়ি সে আর কারো দেখেনি।মনে হলো রাতের আকাশে ভিজে থাকা সাইপ্রেস গাছের পাতা, অন্ধকারকে আগলে রাখার জন্য গজিয়ে উঠেছে।
তারপর তার দৃষ্টি ধীরে ধীরে নেমে এলো নাকের দিকে—একটা নিখুঁত বাঁক,যা মনে হবে কোনো শিল্পী বহু যত্নে এঁকে দিয়েছে।
আর ঠোঁট…
সেই গভীর রক্তিম বেগুনি রঙ, পৃথিবীর কোনো মানুষের ঠোঁট এমন হয়? মনে হয় সন্ধ্যার আকাশে সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে একটুখানি রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে। নিঃশ্বাসের সাথে সেই ঠোঁট সামান্য ফাঁক হয়ে আছে,মনে হচ্ছে স্বপ্নের মধ্যে কিছু ফিসফিস করছে।
ফিওনার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেলো।
তার হাত অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে এলো, নিঃশব্দে ছুঁয়ে দিলো জ্যাসপারের চোখের পাপড়ি। এত নরম, এত কোমল… তার চেয়েও অনেক বেশি।
তারপর ফিওনার দৃষ্টি নামলো জ্যাসপারের খালি বুকে।
কালকের রাতের সমস্ত মুহূর্ত মনে পড়তেই গাল রঙিন হয়ে উঠলো, কিন্তু তার চোখ আটকে গেলো যেখানে কালো কালিতে আঁকা নতুন দাগ জ্বলজ্বল করছে—
“Fiona”
তার নাম… জ্যাসপারের গায়ে, চিরদিনের জন্য।
ফিওনা এক মুহূর্তের জন্য নিশ্বাস নিতে ভুলে গেলো। এই ড্রাগনটা… এই নিষ্ঠুর, দুঃসাহসী, ভয়ঙ্কর ড্রাগন… কাল নিজের শরীরে তার নাম খোদাই করেছে।
তার ঠোঁট অজান্তেই হাসির রেখায় বাঁক নিলো।
সে একবারও ভাবে না যে সে পালিয়ে যাবে।
কারণ এবার সে বুঝতে পেরেছে—
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সে জ্যাসপারের প্রতি দুর্বল হচ্ছে।
ফিওনা সামান্য হাসলো। কাল রাতের স্মৃতিগুলো তার মনে ক্ষীণ এক রেশ রেখে গেছে, কিন্তু আজকের সকাল নতুন কিছু নিয়ে এসেছে। সে ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে বাথটাবে ঢুকে লম্বা একটা শাওয়ার নিলো। গরম পানির ছোঁয়ায় ক্লান্তি ধুয়ে গেল, আর তার মনের কোণে লুকিয়ে থাকা এক অনভিজ্ঞ আবেগ জেগে উঠলো।
শাওয়ার শেষে, সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকালো। তার ত্বক যেন কালকের উত্তাপে এখনো লালচে, চোখের গভীরে এক অদ্ভুত ঝলক। নিজেই নিজেকে নতুন লাগছে তার কাছে।
সে চুপচাপ নিজের ভেজা চুল মুছে, একটা আরামদায়ক পোশাক পরে রান্নাঘরে চলে এলো।
আজ সে নিজেই ব্রেকফাস্ট বানাবে।
একটু পরেই চুলায় প্যানের নিচে শিখা জ্বলতে লাগলো, ফিওনার হাত দ্রুততার সঙ্গে কাজ করতে লাগলো। কিচেন থেকে মৃদু টুং টাং শব্দ উঠলো—চামচ, কাপ, কফির বাটির খসখস ধ্বনি।
তারপর সে জ্যাসপারের জন্য এক কাপ সুমাত্রা ডার্ক রোস্ট কফি তৈরি করলো।এটা জ্যাসপারের সবচেয়ে পছন্দের। গভীর কালো, শক্তিশালী স্বাদ, যেন জ্যাসপার নিজেই।
এদিকে, জ্যাসপারের ঘুম ভাঙতে বেশ সময় লাগলো।
সে আধঘুম চোখে বিছানার পাশে হাত রাখলো, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই শূন্যতা অনুভব করলো।
ফিওনা নেই।
বুকের ভেতর ধক করে উঠলো।
তার চোখ মুহূর্তের মধ্যে ফোকাস ফিরে পেলো, আর সে এক লাফে উঠে পড়লো। পুরো শরীর অ্যালার্ট হয়ে গেল, কিছু একটা ভুল হয়ে গেছে।
ফিওনা কোথায়?
তারপরই রান্নাঘর থেকে আসা টুং টাং শব্দ কানে এলো।
সে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো, ফিওনাকে খুঁজতে।
আর সেখানে…
সে দেখতে পেলো, সকালবেলার আলোয় ফিওনা রান্নাঘরে ব্যস্ত।
চুল তার কোমড় ছুঁয়ে আছে, একপাশে এলোমেলোভাবে পড়েছে, আর সে ঠাণ্ডা কফির মগ হাতে নিয়ে একবার না দেখেই বললো—
” আপনি উঠে পড়েছেন ?”
জ্যাসপার দরজার ফ্রেমে দাঁড়িয়ে রইলো, তার ঠোঁটের কোণে অজান্তেই এক ম্লান হাসি ফুটে উঠলো।
ফিওনা পালায়নি।
বরং, সে তার জন্যই সকালের কফি বানাচ্ছে।
জ্যাসপার কিচেনে গিয়ে দরজার ফ্রেমে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। চোখেমুখে এখনো ঘুমের ছাপ, তবে তার গভীর দৃষ্টি ঠিকই ফিওনার ওপর আটকে গেল।
“কি ব্যাপার, আজকে সকাল সকাল উঠে ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছো?”
ফিওনা ভেতরে একটু চমকে উঠলেও মুখে কিছু বুঝতে দিলো না। ঠাণ্ডা গলায় বললো, “খিদে পেয়েছে তাই।”
জ্যাসপার একপাশে ভ্রু তুলে তাকালো, যেন সে ঠিক বিশ্বাস করলো না। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে এলো, রান্নাঘরের টেবিলে হেলান দিয়ে বললো,
“আমার জন্য কফি বানিয়েছো?”
ফিওনা কফির কাপ হাতে এগিয়ে দিয়ে বললো, “হ্যাঁ, আপনি তো প্রতিদিন আমার জন্য খাবার বানান, তাই আমিও আজকে বানাচ্ছি।”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো, তারপর মৃদু হাসলো। কফির কাপ হাতে নিয়ে এক চুমুক দিলো, চোখ বন্ধ করলো এক মুহূর্তের জন্য।
তারপর ফিওনার দিকে তাকিয়ে বললো, “হুম… তোমার বানানো কফি খারাপ হয়না। তবে আমি যা চাই, তা কি দিতে পারবে?”
ফিওনা একটু ধাক্কা খেলো, তবে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, “আপনার যা চাই সেটাই কি দিতে হবে?”
জ্যাসপার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি টেনে বললো, “অবশ্যই। কারণ, আমি এখন যা চাই, তা আমার হাতের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে।”
ফিওনার গাল লাল হয়ে উঠলো, সে দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো, কিন্তু জ্যাসপার তার প্রতিক্রিয়া দেখে স্পষ্টতই উপভোগ করছিলো।
লিউ ঝান ল্যাবের গভীরে বসে ছিল, তার চোখ স্থির, মন সম্পূর্ণ নিমগ্ন এক মহা পরিকল্পনায়। তার চারপাশে ছড়িয়ে থাকা গবেষণার নথি, রাসায়নিক বোতল আর স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করা ডাটা—সবই ছিল একটাই লক্ষ্য অর্জনের জন্য।
জ্যাসপার।
এক সময় সে ভেবেছিল, ড্রাগনরা কেবল এক কিংবদন্তি, কিন্তু এখন সে জানে—ওরা বাস্তব,আর জ্যাসপার এক ভয়ংকর শ*ত্রু হয়ে উঠেছে।
তার ঠোঁটের কোণে এক নিঃশব্দ হাসি ফুটে উঠলো।
“তোমার শক্তি যতই হোক, দুর্বলতা থাকবেই, জ্যাসপার। আমি সেটা খুঁজে বের করবো।”
লিউ ঝান স্ক্রিনে সবুজ ড্রাগনের জীনগত গঠন পরীক্ষা করছিল। তার বিশ্বাস, প্রতিটি প্রাণীরই একটি দুর্বল বিন্দু থাকে। “কোথায় সেই বিন্দু? কোথায় সেই মুহূর্ত যেখানে আঘাত করলেই সব শেষ?”
সে পুরোনো নথি ঘাঁটলো, কিংবদন্তি আর বৈজ্ঞানিক গবেষণা মিলিয়ে বিশ্লেষণ করতে লাগলো। হঠাৎ, একটা সম্ভাবনা উঠে এলো—”সবুজ ড্রাগনের শারীরিক গঠনে এমন কিছু আছে যা হয়তো ওদের ধ্বংস করতে পারে!”
লিউ ঝানের হাত মুষ্টিবদ্ধ হলো। এবার আর ভুল করা যাবে না। এবার তাকে একবারেই নিশ্চিত করতে হবে—
“জ্যাসপারকে শেষ করতে হলে ঠিক কোথায় আঘাত করা উচিত?”
সে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো, তার পরিকল্পনা এখন স্পষ্ট।
“এইবার তোমার পালা, জ্যাসপার। তুমি ভয়ং*কর? তবে আমি আরও ভ*য়ংকর হতে জানি।
লিউ ঝান ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিল। তার ল্যাবের আলো ঝিমঝিম করছিল, স্ক্রিনের নীল আলো তার মুখে প্রতিফলিত হচ্ছিল। আঙুলগুলো দ্রুত কিবোর্ডের ওপর চলছিল, কোডের পর কোড রান হচ্ছিল, কিন্তু তার পুরো মনোযোগ ছিল একটাই—জ্যাসপারের ইমেলের রিপ্লাই।
সে জানে, জ্যাসপার খুব চালাক। সরাসরি তার অবস্থান প্রকাশ করবে না। কিন্তু প্রতিটি ইমেল, প্রতিটি সংকেত, প্রতিটি ট্রেস—সবকিছুই কিছু না কিছু রেখে যায়। এখন শুধু দরকার একটা সুযোগ।
“তুই যেখানেই থাকিস, জ্যাসপার, আমি তোকে খুঁজে বের করব। আর ফিওনাকে তোর কাছ থেকে ছিনিয়ে আনব।”
লিউ ঝান এবার প্রস্তুতি নিতে লাগলো। তার সামনে একটাই লক্ষ্য—জ্যাসপারকে ধ্বং*স করা আর ফিওনাকে মুক্ত করা!
রাতের নরম চাঁদের আলো সিলভার বারান্দার রেলিং ছুঁয়ে পড়ছে। বাতাসে হালকা ঠাণ্ডা আমেজ, কিন্তু তার থেকেও বেশি শিহরণ জাগানো কিছু যেন অনুভব করল সিলভা।
আচমকা পেছন ফিরে দেখে—এথিরিয়ন!
সিলভা হতভম্ব নয়, বিরক্ত। এটাই তো তার স্বভাব! যখন তখন বারান্দা দিয়ে চলে আসে,মনে হয় এটা একদম স্বাভাবিক বিষয়!
সে ভ্রু কুঁচকে বলল, “এভাবে হুট করে কারও বারান্দায় ঢুকে পড়া মোটেও ভদ্রতা নয়,রিয়ন! একটা মেয়ের প্রাইভেসি বলে কিছু থাকতে পারে, সেটা বোঝো?”
এথিরিয়ন হালকা হেসে এগিয়ে এলো, চোখে অদ্ভুত এক প্রশান্তি। “আমি শুধু তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি,” মোলায়েম গলায় বলল সে। “আর জানতে এসেছি, তুমি আমাদের ভার্সিটিতে ভর্তি হবে কিনা।”
সিলভা এক মুহূর্ত চুপ থেকে ধীর অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “মোটেও না! তোমার আশেপাশে থাকার কোনো ইচ্ছা নেই আমার।”
এথিরিয়ন থমকাল না, তার চোখে খেলা করছিল এক গভীর কৌতুক। “ওহ?”
সিলভা রাগে গাল ফুলিয়ে বলল, “হ্যাঁ! আর তুমি এবার যাও!”
এথিরিয়ন হালকা হাসল,সিলভার এই প্রতিক্রিয়াটাই চেয়েছিল। এক পা পেছনে সরিয়ে বলল, “ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি। তবে মনে রেখো, সিলভা—তুমি যতই দূরে থাকো না কেন, আমি কিন্তু ঠিকই তোমার কাছে চলে আসবো!”
সিলভা দু’হাত বুকে গুটিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, ঠোঁটে এক ঝাঁঝালো হাসি। চোখের কোণে তাচ্ছিল্যের ঝিলিক।
“তুমি না বলেছিলে আমি সবসময় ছ্যাসড়ামি করি? তোমার গায়ে পড়ি? এখন তুমি কি করছো,রিয়ন?”
এথিরিয়নের চোখ গভীর হয়ে উঠল। রাতের অন্ধকারে তার রূপ যেন আরও রহস্যময় লাগছিল। এক ধাপে এগিয়ে এলো, কিন্তু সিলভা সরল না।
“ভুলের মাশুল দিচ্ছি,” তার কণ্ঠ নিচু, তবু তাতে এক অদ্ভুত তীব্রতা। “আমি কতবার সরি বলেছি, আর কতবার বলব বল হ্যাঁ? একবার আমার দিকে তাকিয়ে দেখো, সাড়া দাও আমার ডাকে। আমি প্রতিজ্ঞা করছি—এই পাঁচ বছর যে অবহেলা করেছি, সেই অভাব পুষিয়ে দেব।”
সিলভা তার চোখের দিকে তাকাল এক মুহূর্তের জন্য। এথিরিয়নের চোখে যে অনুতাপ, যে আকুলতা—তা কি সত্যিই ভান?
সিলভা ভ্রু উঁচিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল এথিরিয়নের দিকে। ঠোঁটে সামান্য বিদ্রুপের হাসি খেলে গেল।
“কীভাবে পুষিয়ে দেবে? চুমু খেয়ে?”
এথিরিয়ন ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় হাসি টেনে আনল, চোখ দুটো ঝলসে উঠল যেন।
“ওহ হ্যাঁ, সেদিনের চুমুটা কিন্তু দারুণ ছিল,” সে একধরনের প্রশংসার স্বরে বলল, “একদম ফ্যান্টাসি… এক কথায় বলতে গেলে ফরেস্ট কিস।”
সিলভার গাল একটু লাল হয়ে উঠল, কিন্তু সে দ্রুত সেটা সামলে নিল। চোখ ছোট করে তাকিয়ে বলল, “তুমি নিজেকে অনেক বেশি চালাক ভাবো, তাই না?”
এথিরিয়ন কাঁধ ঝাঁকালো, যেন তার কোনো তাড়া নেই। “আমি শুধু সত্যিটা বলছি, সিলভা। আর সত্যি কথা বলতে, আমি আবার সেই মুহূর্তটা ফিরিয়ে আনতে চাই।”
সিলভা চোখ ঘুরিয়ে বলল, “স্বপ্ন দেখে লাভ নেই,রিয়ন। ওই একবারই হয়েছিল, আর কখনো হবে না!”
থারিনিয়াস, আলবিরা, আর অ্যাকুয়ারা একসঙ্গে বসে গভীর আলোচনা করছিল। তাদের মনে এক অজানা শঙ্কা দোলা দিচ্ছিল। জ্যাসপার বারবার আশ্বস্ত করেছিল যে সে ভালো আছে, কোনো সমস্যা নেই। তবু কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না।
থারিনিয়াস চিন্তিত কণ্ঠে বললো, “প্রিন্স কখনো এভাবে নিশ্চিন্ত থাকতে বলে না, বিশেষ করে যখন সে সত্যিই বিপদে পড়ে। এটা কেমন অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না?”
আলবিরা ধীর স্বরে সম্মতি জানিয়ে বললো, “আমার মন বলছে সামনে কোনো বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। হয়তো এমন কিছু, যার জন্য আমরা প্রস্তুত নই।”
অ্যাকুয়ারা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “তাহলে আর দেরি করা ঠিক হবে না। এখনই রওনা দিতে হবে। পৃথিবীতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তিনদিন লেগে যাবে। যদি কিছু ঘটে যায়, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যাবে।”
তিনজন একে অপরের দিকে তাকালো। সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। তারা আর দেরি করবে না। যত ঝুঁকিই থাকুক না কেন, প্রিন্সকে আর একা ছেড়ে দেওয়া যায় না।
আজকের দিনটা ফিওনার জন্য বেশ স্বস্তির ছিল। অনেকদিন পর একটু হালকা অনুভব করছিলো সে। ঝঞ্ঝামুক্ত কিছু মুহূর্ত কাটানোর পর, সন্ধ্যা নামতেই বুঝলো প্রাসাদটা বেশ নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।
জ্যাসপার সারাদিন ল্যাবে ব্যস্ত ছিল। কী যেন করছিলো, সময়ের বোধই হারিয়ে ফেলেছিল। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলে সে কোথায় যেন বেরিয়ে গেল, একবারও কিছু না বলে। ফিওনা একা পড়ে গেল বিশাল প্রাসাদে।
কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক হাঁটার পর তার মনে হলো, আজকের রাতটাই সঠিক সময় হতে পারে। এতদিন ধরে যে জায়গাটা নিয়ে কৌতূহল জমা হয়েছিল, আজ সেই ল্যাবে ঢোকা দরকার।
প্রাসাদের করিডোর ধরে ধীরে ধীরে এগোতে লাগলো সে। তার হৃদস্পন্দন একটু দ্রুত হয়ে গেল। জ্যাসপার কখনো তাকে ওই জায়গায় ঢুকতে দেয়নি। আজ যদি জানতে পারে, তাহলে কী হবে?
তবুও কৌতূহলকে দমন করতে পারলো না। দরজার সামনে এসে এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ালো ফিওনা। ল্যাবের দরজাটা বন্ধ, তবে তালাবদ্ধ নয়। গভীর শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে দরজাটা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো সে…
ফিওনা ল্যাবের দরজা ঠেলে ঢুকতেই দেখতে পেলো, চারপাশে বিশাল বিশাল স্ক্রিন জ্বলজ্বল করছে, বিভিন্ন ধরণের যন্ত্রপাতির আলো ঝলমল করছে। কিন্তু সামনে এগোতেই সে থমকে গেল।
ল্যাবের মেইন কক্ষে ঢোকার জন্য দরজায় একটা ডিজিটাল পাসওয়ার্ড সিস্টেম সেট করা। ফিওনা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো স্ক্রিনের দিকে। জ্যাসপার কী পাসওয়ার্ড দিতে পারে?
সে চেষ্টা করলো সাধারণ কিছু— Jasper, Dragon, Venus—কিন্তু কোনোটা কাজ করলো না। এরপর ভাবলো, জ্যাসপার কি এমন কিছু দিয়েছে যা খুব ব্যক্তিগত?
সে হাত এগিয়ে টাইপ করলো— Fiona।
“Access Denied”—লাল আলো জ্বলে উঠলো স্ক্রিনে।
ফিওনার ভ্রু কুঁচকে গেল। তাহলে কি ওর নাম নয়?
তারপর এক মুহূর্তে মনে পড়লো জ্যাসপারের দেওয়া ডাকনাম— Hummingbird।
সে দ্রুত টাইপ করলো— Hummingbird।
এক সেকেন্ডের জন্য স্ক্রিনটা নিস্তব্ধ হয়ে রইলো, তারপর সবুজ আলো জ্বলে উঠলো—”Access Granted.”
ফিওনার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। জ্যাসপার তার ল্যাবের পাসওয়ার্ড হিসেবে তার ডাকনাম ব্যবহার করেছে?
কিছু বুঝে ওঠার আগেই দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে যেতে লাগলো। ভিতরে কী অপেক্ষা করছে, সে জানে না। কিন্তু তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠলো, কারণ এবার সে এমন কিছু দেখতে যাচ্ছে যা জ্যাসপার কখনোই তাকে জানতে দিতে চায়নি…
ফিওনা ধীরে ধীরে ল্যাবের ভেতরে পা রাখলো। জায়গাটা ঠান্ডা, নিস্তব্ধ। চারপাশে টিমটিমে নীলচে আলো, বিশাল বিশাল স্ক্রিনে ঝলমল করা ডেটা,মনে হচ্ছে কোনো ভিনগ্রহের গবেষণাগার।
কিন্তু এক মুহূর্তে তার গা শিউরে উঠলো—ল্যাবের দেয়ালে সারি সারি অদ্ভুত ছবি টাঙানো। কিছুতে মানুষের শরীর কিন্তু চোখ… একেবারে শূন্য, অনুভূতিহীন। কিছুতে বিশাল সব ড্রাগনের কঙ্কাল আঁকা, কোনোটা লাল রঙে ডুবে আছে। আর এক কোণায় একটা ছবি… দেখতে অবিকল জ্যাসপারের মতো, কিন্তু তার চারপাশে কালো আগুনের রেখা!
ফিওনার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো।
কম্পিউটারের স্ক্রিনটা তখনো জ্বলজ্বল করছিলো, হয়তো জ্যাসপার তাড়াহুড়োয় বন্ধ করতে ভুলে গেছে। ফিওনা কাছে এগিয়ে দেখলো স্ক্রিনে একটা বিশাল চার্ট, তাতে মানবদেহের সঙ্গে ড্রাগনের ডিএনএ-র তুলনা করা হচ্ছে। নিচে কিছু লাল মার্কিং—”অতিরিক্ত সংমিশ্রণে মানবদেহ ধ্বংস হয়ে যাবে”।
ফিওনার কপাল ঘামে ভিজে গেল। জ্যাসপার এখানে কী গবেষণা করছে?
সে আরও সামনে এগিয়ে দেখলো একটা ছোট্ট কাচের চেম্বার, তার ভেতরে একটা নীলচে তরল… কিন্তু সেই তরলের মাঝখানে কিছু ধীরে ধীরে নড়ছে!
তার হাত কাঁপতে লাগলো।
ফিওনা ধীরে ধীরে কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকালো। জ্যাসপার কম্পিউটার চালু রেখেই চলে গিয়েছে।
সেখানে দুটি ফাইল—”লুকিয়ান” আর “থালাস”। মনে কৌতূহল জাগলেও, মনের গভীরে একটা অদ্ভুত আশঙ্কা খোঁচা দিচ্ছিল। তবু সে ক্লিক করলো।
ভিডিওটা চালু হতেই স্ক্রিনে ফুটে উঠলো এক ভৌতিক বাস্তবতা।
একটি ধাতব কক্ষ, নিখুঁতভাবে সজ্জিত এক পরীক্ষাগার। কক্ষের মাঝে লুকিয়ান ও থালাস চিৎকার করছে, কিন্তু কোনো শব্দ নেই—শুধু তাদের আতঙ্কিত মুখ। আর সামনে দাঁড়িয়ে আছে জ্যাসপার!
ফিওনার চোখ বড় হয়ে গেল। সে তো নিজে দেখেছে কীভাবে জ্যাসপার তাদের শেষ করেছিল, কিন্তু… ভিডিওর নিচে দেওয়া তারিখ?!
“এই ভিডিওটা তো আগেই তৈরি করা হয়েছে!”
তার শরীর শিউরে উঠলো।
এটা কি কোনো কাকতালীয় ব্যাপার? নাকি… জ্যাসপার আগেভাগেই জানতো যে এটা ঘটবে?
ফিওনার আঙুল কাঁপছিল, সে কীবোর্ডের উপর দিয়ে হাত চালিয়ে ভিডিওর ডাটা এনালাইসিস করলো।
ভিডিওটি ছিল এআই-জেনারেটেড, কিন্তু এত নিখুঁত, এত বাস্তব, যেন কেউ ভবিষ্যৎ থেকে এটা রেকর্ড করে নিয়ে এসেছে!
তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিল কিছুক্ষণের জন্য।
“জ্যাসপার কি এই ঘটনার স্ক্রিপ্ট আগে থেকেই লিখে রেখেছিল?”
এবার ফিওনা চোখ বড় করে স্ক্রিনে তাকিয়ে রইলো,মনে হলো সে কিছু ভুল দেখছে। তার সামনে যা ফুটে উঠলো, তা ছিল আরো এক ভয়ংকর চিত্র—”লিউ ঝান” নামে একটি ফাইল, আর সেই ফাইলে থাকা ভিডিওটি তার শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো।
ভিডিও শুরু হতেই, দৃশ্যটি ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে। এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘর, ঠান্ডা বাতাসে ঢেউ খেলানো কিছু পাতলা পর্দা, আর সেখানেই লিউ ঝান দাঁড়িয়ে। তার চোখে ভয়, অসহায়তা, কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল জ্যাসপারের উপস্থিতি—কঠিন, অপ্রতিরোধ্য, নিষ্ঠুর।
“তোর শেষ হবে আজ,” ভিডিওতে জ্যাসপার তার ঠান্ডা গলায় বলছিলো। ফিওনার হৃদপিণ্ড দ্রুত কাজ করতে লাগলো, চোখ সাঁতরে যাচ্ছিলো স্ক্রিনের দিকে।
জ্যাসপার কি সত্যি লিউ ঝানকে শেষ করতে চলেছে? কেন?
ভিডিওতে আরো দেখা গেলো, জ্যাসপার কীভাবে লিউ ঝানকে কোণঠাসা করে ফেলে, তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন এক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। ফিওনা শরীর থেকে শক্তি হারিয়ে ফেললো। তার ভেতরে এক অদ্ভুত শীতলতা ছড়িয়ে পড়লো। “কী হচ্ছে এখানে?”
এক মুহূর্তে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেলো।
ফিওনা তাড়াতাড়ি মাথা চুলকে উঠলো,আর দ্রুত ভাবতে লাগলো। যদি জ্যাসপার লিউ ঝানকে মারতে বেরিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে এখন তাকে থামাতে হবে। তবে কীভাবে?
ফিওনা তখন দ্রুত ইমেল পাঠানোর জন্য গ্র্যান্ডপা’র ইমেল অ্যাকাউন্টে ঢুকলো। সেখানে গিয়ে দেখলো, লিউ ঝান অসংখ্য ইমেল পাঠিয়েছে, তবে জ্যাসপার একটিও রিপ্লাই দেয়নি। ফিওনার মনে সন্দেহ জাগলো,আর সে তৎক্ষণাৎ লিউ ঝানকে ইমেল পাঠালো, যেখানে সে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি এখন কোথায় লিউ ঝান,আপনি ঠিক আছেন ?”
কিছুক্ষণ পরেই, ফিওনার স্ক্রীনে এক নতুন ইমেল এল। লিউ ঝানের রিপ্লাই। সে বুঝতে পারলো যে লিউ ঝান খুব দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
লিউ ঝান তার ফোনের সাথে ল্যাবের কম্পিউটার কানেক্ট করে রেখেছিল, যাতে সে জ্যাসপারের ইমেল থেকে সরাসরি রিপ্লাই পায়।ইমেল ট্র্যাকার মুহূর্তেই লোকেশন ডিকোড করতে শুরু করলো। সংকেত আসছিল পাহাড়ি কোনো জায়গা থেকে।আর ঠিক তখনি, লিউ ঝান লোকেশন ট্র্যাক করার মাধ্যমে চিহ্নিত করে ফেললো কোথায় রয়েছে ফিওনা।
ফিওনা বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর লিউ ঝানের সাথে ভিডিও কল শুরু করল।
“লিউ ঝান,” ফিওনা তীব্র কণ্ঠে বললো, “জ্যাসপার পরিকল্পনা করছে তোমাকে মেরে ফেলবে। তুমি সাবধানে থেকো।”
লিউ ঝান ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে একটু সময় নিলো, তারপর শীতলভাবে বলল, “তুমি ভয় পেয়ো না ফিওনা।
কিন্তু কিছু করার আগে, আমি একটা পরামর্শ দিতে চাই তোমাকে। তবে এখনই সেটা বলবো না। সময় মতো তোমাকে জানাবো।”
ফিওনা হতাশ হয়ে কিছু বলার আগে লিউ ঝান তার ফোনের স্ক্রীনটা টেনে এনে তার একটি দিক দেখিয়ে বলল, “সব মেসেজ ডিলিট করে ফেলো, সব কিছু পরিষ্কার রাখো। আর সাবধানে থাকো।”
ফিওনা তার পরামর্শ মেনে ল্যাবের সমস্ত কম্পিউটার থেকে মেসেজগুলো ডিলিট করে দিলো। লিউ ঝান ফোনের স্ক্রীনে অদৃশ্য হয়ে গেলো। ফিওনা এখন আরও বেশি চিন্তিত ছিলো, তবে লিউ ঝানের কথা মনে রেখে সে প্রস্থানের জন্য প্রস্তুত হতে লাগলো, কারণ তার সামনে এখন আরও এক কঠিন সময় আসছে।
রাতে জ্যাসপার ফিরেছে, ফিওনা তখন গভীর ঘুমে। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতেই দেখলো, জ্যাসপার ফিরে এসেছে আর রাতের ডিনার সাজিয়ে রেখেছে টেবিলে। ফিওনা আস্তে করে চেয়ারে বসে পড়লো। খাবারের দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ থাকলো, তারপর হঠাৎ করেই সে নিজে থেকে খাবার সার্ভ করতে লাগলো জ্যাসপারকে।
জ্যাসপার একটু অবাক হয়ে গেলো। এতদিন তো কখনো এমন করেনি ফিওনা! তবে কিছু বললো না, শুধু কপালে সামান্য ভাঁজ পড়লো।
ফিওনা তার প্রতিক্রিয়া দেখে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো, ধীরে ধীরে পেছন থেকে জ্যাসপারের গলা জড়িয়ে ধরলো। শরীরের উত্তাপ জ্যাসপারের অনুভব হলো, কিন্তু তার চেয়েও বেশি অনুভূত হলো ফিওনার কণ্ঠের অদ্ভুত কোমলতা।
“চলুন আমরা ভেনাসে ফিরে যাই,” ফিসফিস করে বললো ফিওনা। “আমি সত্যি বলছি, আমি আর আপনার থেকে পালাবো না। আপনি যেমন, আমি ঠিক সেভাবেই আপনাকে মেনে নেবো।”
জ্যাসপার নিঃশব্দে বসে রইলো, তার চোখে একধরনের অজানা ভাব। জ্যাসপার চুপ করে রইলো। তার হাতে থাকা কাঁটাচামচ থেমে গেলো, চোখেমুখে কিছুটা বিস্ময়ের ছাপ। ফিওনার আচরণ আজ কিছুটা অস্বাভাবিক লাগছে। এতদিন যে মেয়ে তার থেকে পালানোর জন্য মরিয়া ছিল, সে হঠাৎ করে এত সহজেই তার নিয়তি মেনে নেবে?
ফিওনা তার শক্ত আলিঙ্গনটা আরও দৃঢ় করলো, কাঁপা কণ্ঠে বললো, “আমরা ভেনাসে ফিরে যাই, প্রিন্স। এখানে আর থাকতে চাই না। আমি ক্লান্ত… আর পালাতে চাই না।”
জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিওনার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঘুরে তার দিকে তাকালো। ফিওনার চোখের গভীরে সে খুঁজে দেখলো সত্যি কি সে তার কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করেছে, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ লুকিয়ে আছে।
একটা দীর্ঘ মুহূর্ত চুপ থেকে সে হালকা হেসে বললো, “এতদিন তোমার যত বোকামি সহ্য করেছি, তার মধ্যে এটা সবচেয়ে বড়। তুমি কি সত্যিই ভেবেছো আমি এত সহজে তোমার কথায় বিশ্বাস করবো, হামিংবার্ড?”
ফিওনার হৃদস্পন্দন মুহূর্তেই বেড়ে গেলো। জ্যাসপার তার চোয়াল শক্ত করলো, গলায় অদ্ভুত ঠাণ্ডা ভাব এনে বললো, “তুমি কিছু লুকাচ্ছো, তাই না?”
জ্যাসপার হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলো। মুহূর্তের মধ্যে তার হাতে থাকা চামচ টেবিলে ফেলে দিলো, আর এক ঝটকায় ডাইনিং টেবিলের কার্পেট উল্টে দিলো। সমস্ত খাবার, প্লেট, গ্লাস মেঝেতে ছিটকে পড়লো, কাঁচ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। ফিওনা চমকে উঠলো, বুক ধকধক করতে লাগলো।
এরপর, কোনো কিছু বোঝার আগেই জ্যাসপার সামনে এসে দ্রুত ফিওনার ঘাড় চেপে ধরলো। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে, মুখে একধরনের হিংস্র*তা। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“আমার সাথে ছলনা করছো?এত সহজেই আমাকে বোকা ভাবলে? তুমি কি মনে করো, আমি তোমার চালাকি বুঝতে পারবো না?”
ফিওনার শরীর কেঁপে উঠলো, নিঃশ্বাস আটকে এলো। সে কিছু বলতে যাবে, তখনই জ্যাসপার আরও কাছে ঝুঁকে গভীর গলায় ফিসফিস করলো, “তুমি ল্যাবে প্রবেশ করেছিলে কেন?”
ফিওনার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। শরীর জমে গেলো আতঙ্কে। সে জানে, এই মুহূর্তে যদি ভুল কিছু বলে, তাহলে কী হতে পারে!
ফিওনা নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু জ্যাসপারের হাতের শক্তি ছিলো অবিশ্বাস্য রকমের দৃঢ়। তবুও এক ঝটকায় সে নিজেকে সরানোর চেষ্টা করতেই জ্যাসপার ওকে ছেড়ে দিলো, তবে এমনভাবে যে ফিওনা ভারসাম্য হারিয়ে পিছনে গিয়ে ছিটকে পড়লো।
মেঝেতে হাত দিয়ে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলেও ফিওনার ভেতর একধরনের বিস্ফোরণ হচ্ছিলো। চোখ দুটো ক্রোধে জ্বলতে লাগলো। সে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো, তারপর হঠাৎ করেই গর্জে উঠলো—
“আপনি কেন লিউ ঝানকে মারার পরিকল্পনা করছেন?”
তার কণ্ঠে স্পষ্ট হতাশা, ক্ষোভ আর একটা অজানা ভয় ছিলো। সে জ্যাসপারের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, তার প্রতিটি শব্দের জবাব চাই।
জ্যাসপার বিরক্তিভাবে নিজের কপাল ঘষতে লাগলো, নিজের ধৈর্য হারানোর শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে।
তারপর এক ঝটকায় মেঝে থেকে ভাঙা কাচের একটা ধারালো টুকরো তুলে নিয়ে ফিওনার গলায় চেপে ধরলো।
তার চোখে ভয়ংকর আগুন জ্বলছিলো, কণ্ঠে শীতল বিষ—
“তুমি কোন সাহসে আমার অনুপস্থিতিতে ল্যাবে প্রবেশ করেছো?”
কাচের ধারালো অংশটা ফিওনার ত্বকের এতটাই কাছে ছিলো যে সামান্য নড়লেই কেটে যাবে। কিন্তু জ্যাসপার সেখানেই থামলো না, তার কণ্ঠ আরও নিচু আর তীব্র হয়ে উঠলো—
“উল্টে আবার আমার কাছেই কৈফিয়ত চাইছো?”
ফিওনা শ্বাস আটকে যাওয়ার অনুভূতি নিয়ে তাকিয়ে রইলো জ্যাসপারের জ্বলন্ত চোখের দিকে, যেখানে ধরা পড়ছিলো অবিশ্বাস, রাগ আর… হয়তো কিছুটা ব্যথাও।
জ্যাসপার হঠাৎ কিছু একটা মনে করে এক ঝটকায় ফিওনাকে ছেড়ে দিলো।
ফিওনা হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়ালো, চোখে আগুনের মতো রাগ আর ঘৃণা ঝলসে উঠছিলো। ঠোঁট কাঁপছিলো, কিন্তু কথাগুলো দৃঢ়ভাবে বেরিয়ে এলো—
“I hate you!”
এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না সে। পায়ের শব্দের প্রতিধ্বনি রেখে দ্রুত চলে গেলো নিজের কক্ষে, দরজা বন্ধ করে দিলো এমনভাবে যেন আর কখনো খুলতে চায় না।
জ্যাসপার সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো, মুষ্টিবদ্ধ হাতে নিজের শ্বাস নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো। ফিওনার সেই শেষ কথাগুলো যেন পুরো ডাইনিং কক্ষ জুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো।
“I hate you…”
কিন্তু কেন যেন সেই কথাগুলো শুনে রাগ কমার বদলে বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত শূন্যতা ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।
সারারাত কেটে গেছে, সকালও গড়িয়ে দুপুর। তবুও ফিওনা দরজা খুলেনি।
জ্যাসপার রান্না শেষ করে ট্রেতে খাবার সাজিয়ে নিলো। তারপর ধীর পায়ে ফিওনার কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ালো। কয়েকবার দরজায় নক করলো, অপেক্ষা করলো—কোনো সাড়া নেই।
তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যেতে লাগলো। ফিওনার এমন অবহেলা তাকে আরও ক্ষুব্ধ করে তুললো। গভীর শ্বাস নিলো, তারপর কণ্ঠ কঠিন করে বললো—
“তুমি যদি পাঁচ মিনিটের মধ্যে দরজা না খোলো, আমি দরজাটা ভেঙে ফেলবো!”
অন্য সময় হলে হয়তো ফিওনা ভয় পেয়ে যেতো, কিন্তু আজ সে অবিচল। দরজার সাথেই ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় বললো—
“ঠিক আছে, ভেঙে ফেলুন। আমি দরজার সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছি। এবার আমাকে সহ দরজা উড়িয়ে দিন।”
জ্যাসপারের হাত শক্ত হয়ে এলো। কপালের শিরাগুলো টানটান হয়ে উঠলো, আঙুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেলো।
ভেতরে ফিওনার অবস্থান জানার পরও কি সে সত্যিই দরজা ভাঙতে পারবে?
দৃঢ় কণ্ঠে সে আবার বললো—
“নাটক করো না, ফিওনা। চুপচাপ দরজা খুলে খাবার খেয়ে নাও।”
কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া নেই।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে ট্রেতে রাখা খাবারটা মেঝেতে রেখে দরজার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
অপেক্ষা, শুধু অপেক্ষা…
ফিওনা দরজার হাতল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, মনে মনে ভাবছিল জ্যাসপার চলে গেছে। এতক্ষণ কোনো শব্দই তো আসেনি।
দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত।
পেটের ক্ষুধা অসহ্য হয়ে উঠলো।কাল রাতে থেকে না খাওয়া আরেক রাত চলে এলো। আর সহ্য করা সম্ভব না, তাই ধীরে ধীরে দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিলো।
চারপাশ নিস্তব্ধ।
কোথাও জ্যাসপারের দেখা নেই।
নিঃশ্বাস ছেড়ে এক পা বাড়াতেই ফিওনা হঠাৎ আঁতকে উঠলো!
দরজার পাশেই দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে জ্যাসপার।
মাথা সামান্য একপাশে হেলে পড়েছে, চোখ বন্ধ, নিঃশ্বাস গভীর—সে ঘুমিয়ে আছে। পাশে খাবারের ট্রে রাখা, খাবার ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
ফিওনার বুকের ভেতর কেমন যেন একটা মোচড় দিয়ে উঠলো। তার মানে কি জ্যাসপার দুপুর থেকে এখানেই বসে ছিল, অপেক্ষা করছিল?
কিন্তু কেন?
অন্য সময় হলে তো রাগের মাথায় দরজা ভেঙে ফেলতো!
ফিওনা ধীরে ধীরে জ্যাসপারের দিকে ঝুঁকলো, ভালো করে দেখলো। ক্লান্ত মুখ, চোখের নিচে হালকা কালচে ছাপ—হয়তো কাল রাতেও সে ঘুমায়নি।
এমন একরোখা, অহংকারী, ভয়ঙ্কর এক জীব… অথচ এখন তাকে দেখে মনে হচ্ছে কতটা শান্ত, কেমন যেন নিঃসঙ্গ।
ফিওনার মনে হঠাৎ করেই এক ধরনের মায়া জন্ম নিলো।
সে কি জ্যাসপারকে ডাকবে?
না কি এভাবেই তাকিয়ে থাকবে কিছুক্ষণ…
জ্যাসপারের চোখ ধীরে ধীরে খুলে গেলো।
সে গভীর দৃষ্টিতে ফিওনার দিকে তাকালো,সে ঘুমের মাঝেই ফিওনার উপস্থিতি অনুভব করেছিল।
তারপর ক্লান্ত অথচ কোমল কণ্ঠে বললো, “হামিংবার্ড, তুমি বেরিয়ে এসেছো।”
সে পাশে রাখা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া খাবারের দিকে তাকিয়ে বললো, “এই খাবার আর খাওয়ার উপযুক্ত নেই। নতুন করে বানিয়ে দিচ্ছি, নিশ্চয়ই তোমার খিদে জ্যাসপারের চোখ ধীরে ধীরে খুলে গেলো।
সে গভীর দৃষ্টিতে ফিওনার দিকে তাকালো, যেন সে ঘুমের মাঝেই ফিওনার উপস্থিতি অনুভব করেছিল।
তারপর ক্লান্ত অথচ কোমল কণ্ঠে বললো, “হামিংবার্ড, তুমি বেরিয়ে এসেছো।”
সে পাশে রাখা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া খাবারের দিকে তাকিয়ে বললো, “এই খাবার আর খাওয়ার উপযুক্ত নেই। নতুন করে বানিয়ে দিচ্ছি, নিশ্চয়ই তোমার খিদে পেয়েছে।”
আযদাহা সিজন ২ পর্ব ২৭
এটা বলেই জ্যাসপার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু পায়ের ভারসাম্য কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেলো। মনে হলো শরীরে শক্তি নেই, হয়তো অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকার কারণে।
ফিওনা দ্রুত হাত বাড়িয়ে তাকে থামিয়ে দিলো।
“আপনাকে কিছু বানানোর দরকার নেই,” ফিওনা বললো দৃঢ় কণ্ঠে, “আপনি বসুন, আমি ইনস্ট্যান্ট নুডলস বানিয়ে আনছি।”
জ্যাসপার অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো, যেন এই ফিওনাকে সে চিনতে পারছে না। তবে কিছু বললো না, শুধু চুপচাপ ফিওনার চোখের গভীরে তাকিয়ে রইলো।