আযদাহা সিজন ২ পর্ব ২৮ (২)

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ২৮ (২)
সাবিলা সাবি

ভোরের প্রথম আলো যখন পাহাড়ের গায়ে স্বর্ণাভ ছায়া ফেলছিল, তখনো অরণ্যমণি প্রাসাদের আকাশ ভারী ছিল নিস্তব্ধতায়। ঝরনার অনবরত স্রোত দূর থেকে এক সুরেলা গুঞ্জনের মতো শোনা যাচ্ছিল, আর ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শে গা ছমছমে অনুভূতি হচ্ছিল ফিওনার। কিন্তু আজ সে অন্য কিছু ভাবছে।
তার ইচ্ছে পাহাড় ঘুরে দেখা, কিন্তু সেটাই বা সহজ হয় কীভাবে?
“আমি আজকে পাহাড় ঘুরে দেখতে চাই,” ফিওনা সকালের নরম আলোয় দাঁড়িয়ে জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে বললো।
জ্যাসপার তখন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, তার চোখ বরাবরের মতোই গাঢ়, অনড়। কোনো আবেগের ছাপ নেই তাতে, নেই কোনো বিস্ময় বা প্রশ্ন।

“অসম্ভব,” সে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো।
ফিওনার ভ্রু কুঁচকে গেল। “আমি কি ব*ন্দি? একটু বাইরেও যেতে পারবো না?”
জ্যাসপার তার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে থাকলো। ফিওনার মুখের জেদ, চোখের তীক্ষ্ণতা সে খুব ভালো করে চিনে গেছে। সে জানে, এই মেয়ে সহজে কিছু চায়না কিন্তু একবার কিছু চাইলে সেটা না পাওয়া পর্যন্ত নড়বে না।
এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে অবশেষে সে বললো, “ঠিক আছে, তবে বেশি দূর নয়। অরণ্যমণি প্রাসাদের বাইরে যেতে পারবে, কিন্তু আমি সঙ্গে থাকবো।”
ফিওনার ঠোঁটের কোণে ম্লান হাসি ফুটে উঠলো। তার পরিকল্পনার প্রথম ধাপ সফল হয়েছে।
ফিওনার মন আজ অন্য কিছুতে বিভোর। এই পাহাড় দেখা তার আসল উদ্দেশ্য নয়। তার লক্ষ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন, আরও গভীর।
লিউ ঝান তাকে সেদিন বলেছিল এক বিশেষ শেকড়ের কথা—একবার জ্যাসপার সেটি খেয়ে ফেললে, কয়েক ঘণ্টার জন্য গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে, আর ঠিক তখনই ফিওনা পালিয়ে যেতে পারবে।
লিউ ঝানের কথাগুলো এখনো তার কানে বাজছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমি তোমাকে ভেনাসে নিয়ে যাবো, ফিওনা। দেবতা আভ্রাহারের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে পারবো আমরা জানতে পারবো আমাদের ভবিষ্যৎ সময় কিভাবে গড়বে আর কিভাবে তুমি এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাবে। এখান থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় এটাই।”
ফিওনার মনে এক মুহূর্তের জন্য অস্বস্তি খেলে গেল। সত্যিই কি সে পালাতে চায়? নাকি সে পালাচ্ছে নিজের অস্তিত্বের দ্বিধা থেকে?
কিন্তু সে নিজেকে দৃঢ় করলো। যা-ই হোক, তাকে যেতে হবে।

পাহাড়ের পথ ধরে কিছুক্ষণ হাঁটার পর জ্যাসপার তাকে এক বিস্ময়কর জায়গায় নিয়ে এলো। এক অপূর্ব বাগান, যেখানে অসংখ্য ফুল বাতাসে দুলছে, সুবাস ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশে।
ফিওনা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো। “এতো সুন্দর ফুলের বাগান!”
জ্যাসপার তার পাশে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো, “যে যে ফুল নিয়ে ইচ্ছে হয়, নিয়ে নিতে পারো।”
ফিওনা আর দেরি করলো না। সে বুনো ফুলের মাঝে হাত বুলিয়ে একের পর এক তুলতে লাগলো। ঝুড়ি ভরতে থাকলো সাদা, গোলাপি, বেগুনি রঙের ফুলে।
ঠিক তখনই, সে খুঁজে পেল সেই বিশেষ ফুল। কালচে বেগুনি রঙ, পাপড়ির কিনারায় হালকা রূপোলি আভা—লিউ ঝান যেমন বর্ণনা করেছিল, ঠিক তেমনই।
ফিওনার ঝুড়ির মধ্যে থাকা অসংখ্য রঙিন ফুলের মাঝে একটিই আলাদা, রহস্যময়। সেটি ছিল এক অদ্ভুত রঙের ফুল
—গাঢ় বেগুনি পাপড়ি, যার কিনারায় হালকা রূপোলি আভা। এই ফুলের নাম “মরণস্পর্শী অলকনন্দা”—একটি ফুল যা ড্রাগনদের জন্য বিষসম।

সবুজ ড্রাগনদের একমাত্র দুর্বলতা তাদের হৃদয়। আর এই ফুলের নির্যাস হৃদয়ে প্রবেশ করলেই, তাদের শক্তি শুষে নেয়, এমনকি মৃ*ত্যু ঘটাতে পারে। কিন্তু ফিওনা তা জানেনা।
ফিওনার আঙুল ফুলের পাপড়ি ছুঁতেই অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল তার শরীরে।এই ফুলের মধ্যে লুকিয়ে আছে অশুভ কোনো শক্তি, এক ভয়ঙ্কর পরিণতির পূর্বাভাস।
সে এক মুহূর্ত দ্বিধা করলো। সত্যিই কি সে এই পথে এগোতে চায়?
কিন্তু পরক্ষণেই তার চোখে এক দৃঢ়তা ফুটে উঠলো।
তার হাত একটু কেঁপে গেল।
জ্যাসপার তখন দূরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন এই মুহূর্তটায় সে একান্তই নিজের মধ্যে ডুবে আছে।
ফিওনা আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো না। সাবধানে ফুলটিকে ঝুড়ির নিচে লুকিয়ে ফেললো।
আজ রাতের জন্য পরিকল্পনা সম্পুর্ন।

সারাদিন পাহাড়ের পথে ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যার আগেই ফিরে এলো তারা। দিনের ক্লান্তি শরীরে জড়িয়েছিল, তবে মনটা অন্য রকমভাবে ভারী লাগছিল ফিওনার।
রাতের খাবার তারা একসঙ্গে করলো, নীরবতার মাঝে শুধুই চামচের আওয়াজ আর মাঝে মাঝে চোখাচোখি। জ্যাসপার স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু ফিওনার মনে হচ্ছিল, তার চোখ দুটো সবকিছু বুঝতে পারছে।
খাওয়ার পর, ফিওনা এক কাপ ডার্ক রোস্ট কফি বানালো। এটা জ্যাসপারের প্রিয়।
সে কফির ধোঁয়ার মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে প্রশ্ন করলো—সত্যিই কি সে এটা করতে পারবে?
কিন্তু লিউ ঝানের কথা মনে পড়তেই তার সিদ্ধান্ত কঠিন হয়ে উঠলো।
ফিওনা কফিতে মরণস্পর্শী অলকনন্দার রস মিশিয়ে দিলো। এক ফোঁটাও বেশি নয়, ঠিক যতটা প্রয়োজন, ততটাই।
জ্যাসপার কফির কাপে এক চুমুক দিলো, তারপর আরেকটি। গভীর কালো তরলের তেতো স্বাদ তার জিহ্বায় ছড়িয়ে পড়লো, কিন্তু সে কিছু টের পেল না।
ফিওনা নিঃশ্বাস চেপে ধরে অপেক্ষা করলো।
কিছুক্ষণ পর, জ্যাসপার চোখের পাতাগুলো ভারী করে শুয়ে পড়লো। ফিওনাকেও নিজের বাহুর মধ্যে জড়িয়ে নিলো,মনে হলো সে নিশ্চিত করতে চায় যে ফিওনা এখানেই আছে, নিরাপদে।
তার গরম নিঃশ্বাস ফিওনার ঘাড়ে লেগে আসছিল, শক্ত অথচ কোমল বন্ধন এক অদৃশ্য শেকলে তাকে বেঁধে রেখেছে।

ফিওনা নিঃশব্দে হাত সরিয়ে দিলো, আস্তে আস্তে উঠে বসল।
চাঁদের আলোয় জ্যাসপারকে তাকিয়ে দেখলো সে।
জ্যাসপার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
ফিওনার বুকের ভেতর এক অজানা কষ্ট মোচড় দিয়ে উঠলো। কেনো?
সে তো এখান থেকে পালাতে চেয়েছিল, তার তো খুশি লাগার কথা!
কিন্তু মনে হলো, আজ কিছু একটা শেষ হয়ে যাচ্ছে, যা হয়তো আর ফিরবে না।
কিন্তু সে জানে, এখন থামার সময় নয়।
সে দ্রুত বেরিয়ে এলো, নিঃশব্দে এগিয়ে গেল ল্যাবের দিকে।
কম্পিউটারের সামনে বসে লিউ ঝানকে ইমেইল করলো।
“আমি সফল হয়েছি। জ্যাসপার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।”
তারপরই রিপ্লাই এলো।

“ভেরি গুড! পাহাড়ের কিনারায় চলে যাও অপেক্ষা করো আমি আসছি।”
ফিওনা দ্রুত ল্যাব থেকে বেরিয়ে প্রাসাদের প্রধান দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো।পুরো প্রাসাদ অন্ধকারে ডুবে আছে, শুধু চাঁদের মলিন আলো মার্বেলের মেঝেতে পড়েছে। বাতাস স্থির,মনে হচ্ছে অপেক্ষা করছে কিছু ঘটার জন্য।
তার হাত কাঁপছিল, কিন্তু সে নিজেকে দৃঢ় করলো। দরজার পাশে ডিজিটাল লকটি জ্বলজ্বল করছিল, তার সামনে অপেক্ষা করছিল এক কঠিন বাধা—পাসওয়ার্ড।
কিন্তু ফিওনা জানে, জ্যাসপার কী ভাবতে পারে।
তার মনে পড়লো সেই মুহূর্ত, যখন প্রথমবার জ্যাসপার তাকে এই নামে ডেকেছিল—”হামিংবার্ড।”
সে ধীরে ধীরে প্যানেলে টাইপ করলো—

H U M M I N G B I R D
এক সেকেন্ডের জন্য কিছুই ঘটলো না।
তারপর, ছোট্ট একটা বিপ্ শব্দ হলো, সঙ্গে সঙ্গেই লক খুলে গেল।
ফিওনা স্তব্ধ হয়ে গেল।
জ্যাসপার… তার সবচেয়ে গোপন জায়গার দরজার পাসওয়ার্ড তার নাম দিয়েছিল?
কেন?
কেনো তার মতো একজনকে বিশ্বাস করেছিল এতটা?
কেন তার প্রাসাদ থেকে পালানোর চাবিকাঠি এত সহজেই তার হাতে তুলে দিলো?
কিন্তু ভাবার সময় নেই।
সে দ্রুত দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো। বাইরে পাহাড়ের বাতাস তীক্ষ্ণ হয়ে বইছিল, দূরে আকাশের কোণে কালো মেঘ জমছে।
লিউ ঝান চলে আসবে।
ফিওনা শেষবারের মতো পিছনে তাকালো।
তার মনে হলো, এই দরজা শুধু একটা প্রাসাদের ছিল না—এটা ছিল এমন একটা সম্পর্কের প্রতীক, যা সে আজ চিরতরে পেছনে ফেলে যাচ্ছে।

তারপর সে ছুটে চললো, অজানা ভাগ্যের দিকে…
ফিওনা পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে, হিমেল বাতাস তার চুল উড়িয়ে নিচে গহীন অন্ধকারে মিশিয়ে দিচ্ছে। দূরের উপত্যকা ঘন কুয়াশায় ঢাকা, রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে মাঝে মাঝে কোনো দূরবর্তী প্রাণীর ডাক ভেসে আসছে।
সে অপেক্ষা করছে।
সময় যেন থমকে গেছে।
হঠাৎ, দূর আকাশে একটা জ্বলন্ত ছায়া দেখা গেল। আগুনের মতো লাল আলোয় চারপাশ রঙিন হয়ে উঠলো, যেন রাতের আঁধার চূর্ণ করে আগুনের এক মহাপ্রলয় নামতে চলেছে।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেই আলো স্পষ্ট হলো—
লিউ ঝান এসে পৌঁছেছে।
ফিওনাকে দেখে তার চোখে এক মুহূর্তের জন্য আবেগের ঝলক ফুটে উঠলো। কিন্তু এখন আবেগ প্রকাশ করার সময় নেই।

সে একটাও কথা না বলে ফিওনার সামনে এসে দাঁড়ালো।
পরক্ষণেই তার শরীর বদলে যেতে লাগলো—
তার হাত দুটো প্রসারিত হলো, পিঠের হাড়গুলো ফেটে বেরিয়ে এলো শক্তিশালী পাখা, আর পুরো শরীর এক লাল জ্যোতিতে ঘিরে গেলো।
ফিওনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল, ভয়ংকর রক্তচোখের লাল ড্রাগন।
তার ডানার শক্তিশালী ঝাপটায় বাতাস প্রচণ্ড গতিতে ধাক্কা দিলো ফিওনার শরীরে, কিন্তু সে পিছু হটলো না।
লিউ ঝান মাথা নিচু করলো, তার ড্রাগনের চওড়া পিঠ ইঙ্গিত করলো ফিওনাকে ওঠার জন্য।
ফিওনা এক মুহূর্তের জন্য পিছনে তাকালো—পাহাড়ের ওপারে রয়ে গেছে এক জীবন, এক আবদ্ধ অধ্যায়।
তারপর সে কোনো দ্বিধা না করে উঠে বসলো লাল ড্রাগনের পিঠে।
পরের মুহূর্তেই, লিউ ঝান বিশাল ডানা মেলে আকাশে উঠে গেলো, আগুনের শিখার মতো ভেসে চললো তারা অসীম শূন্যতার দিকে…

গাড়ির ইঞ্জিনের গর্জন বাতাসের শব্দ ছাপিয়ে যাচ্ছে। রাতের আঁধারে ফিওনা জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল, তবে বাইরের কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। গাড়িটি দ্রুতগতিতে ছুটছিল, আর ফিওনার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেল।
“আমরা কোথায় যাচ্ছি?” ফিওনা অবাক হয়ে লিউ ঝানের দিকে তাকাল।
লিউ ঝান গাড়ির স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরে রেখেছিল, তার চোখে ছিল একধরনের অদ্ভুত দৃঢ়তা। “এখন ভেনাসে ফিরে কী লাভ, ফিওনা? জ্যাসপার যখন ঘুম থেকে উঠবে, সে পুরো ভেনাস তছনছ করে ফেলবে আমাদের খুঁজে বের করার জন্য। আমি তোমাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি, যেখানে সে কোনোভাবেই আমাদের খুঁজে পাবে না।”
ফিওনার বুক ধক করে উঠল। “কিন্তু কেন? আমাদের তো দেবতা আভ্রাহারের কাছে যেতে হবে, আমার ভবিষ্যৎ জানার জন্য!”
লিউ ঝান এবার এক মুহূর্তের জন্য ফিওনার দিকে তাকাল, তারপর মুখে এক রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে বলল, “আমাকে আরো শক্তিশালী হতে হবে, ফিওনা। জ্যাসপারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে আমার প্রস্তুতি দরকার। তার জন্য কিছুদিন আমাদের লুকিয়ে থাকতে হবে। তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না, ক্যামেলিয়া?”
ফিওনার চোখ বড় হয়ে গেল। “ক্যামেলিয়া?” সে বিস্ময়ে ফিসফিস করে বলল।
লিউ ঝান হালকা হাসল, যেন কিছুই হয়নি। “মানে, ফিওনা। আমি ভুল করে বলে ফেলেছি,” সে দ্রুত কথা ঘুরিয়ে নিল।

ফিওনা আরো কিছু বলার জন্য ঠোঁট খুললো, কিন্তু শব্দগুলো আটকে গেলো গলার মাঝে। লিউ ঝান গভীর দৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলো, অপেক্ষায় যেনো একটা উত্তর চাই। গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে, নিস্তব্ধতার মাঝে শুধু ফিওনার দ্রুত ওঠানামা করা শ্বাস শোনা যাচ্ছে।
ফিওনা মুখ ফিরিয়ে জানালার বাইরে তাকালো। অন্ধকার রাত, রাস্তায় ছায়ার মতো পড়ে থাকা লাইটের ঝলক, আর তার মনের মধ্যে কেমন একটা দ্বিধা খেলা করছে। সে কি সত্যিই লিউ ঝানকে ভালোবাসে? সে কি সত্যিই ওর ওপর পুরোপুরি বিশ্বাস রাখতে পারে?
লিউ ঝান ধীরে ধীরে ফিওনার হাতটা নিজের হাতে নিলো। তার স্পর্শ গরম, অথচ কোথাও একটা অনিশ্চয়তা লুকিয়ে আছে।

“তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না,ভালোবাসো না আমাকে আর ?” লিউ ঝানের কণ্ঠে ব্যথার ছোঁয়া।
ফিওনা চোখ বন্ধ করলো এক মুহূর্তের জন্য। তার হৃদয় বড্ড এলোমেলো।
ফিওনা লিউ ঝানের দিকে তাকিয়ে রইল। রাতের ম্লান চাঁদের আলো গাড়ির জানালা দিয়ে এসে পড়েছে, লিউ ঝানের চোখে একধরনের উন্মাদনা, একধরনের দাবী জ্বলজ্বল করছে। তার কথাগুলো হাওয়ায় প্রতিধ্বনি তুলল—
“ভুলে গেলে আমি তোমার আগের জন্মের ভালোবাসা? তোমার জাইরন? আমাদের মিলন হওয়ার কথা ছিলো?”
ফিওনার শ্বাস আটকে এল। তার মনে হলো,সে দু’টি ভিন্ন বাস্তবতার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। একটা বাস্তবতা যেখানে সে এখন, আরেকটা লিউ ঝানের কথায় জেগে ওঠা অতীত, যা সে স্পষ্ট মনে করতে পারছে, কিন্তু কোথাও অনুভব করতে পারছেনা।

ফিওনা শক্ত গলায় বলল, “কিন্তু পৃথিবীর নিয়মে আমার তো জ্যাসপারের সাথে বিয়ে হয়ে গেছে।”
এই কথাটা বলতেই লিউ ঝানের মুখ পাথরের মতো কঠিন হয়ে গেল। তার চোখের গভীরতা আরও অন্ধকারময় হয়ে উঠল। মুহূর্তের জন্য মনে হলো, সে কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে থামিয়ে নিল। কিন্তু তারপরই তার ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি ফুটল।
“তাতে কী? ওটা নিয়মের আর নিয়তির বিরুদ্ধে বিয়ে,” লিউ ঝান গভীর স্বরে বলল,মনে হলো নিজের মধ্যেই নিজেকে বোঝাচ্ছে, “আমি আর তুমি ভেনাসের মাটিতে বিয়ে করবো, তবেই আমাদের অসম্পূর্ণ ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে।”
ফিওনার কানে বজ্রপাত হলো। ভেনাসের মাটিতে বিয়ে? অসম্পূর্ণ ভালোবাসা? তার মন এলোমেলো হয়ে গেল। একদিকে জ্যাসপারের প্রতি তার অপরিচিত অনুভূতি, অন্যদিকে লিউ ঝানের দাবি—সে কি সত্যিই অতীতের কোনো বন্ধনে বাঁধা ছিল?
তার বুক ধকধক করতে লাগলো। এই রাতে, এই গাড়ির মধ্যে, দুটো পৃথিবীর টানাপোড়েনে সে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, সেটাই বুঝে উঠতে পারছিল না।

রাত গভীর। শহরের রাস্তা তুলনামূলক ফাঁকা, কিন্তু বাতাস ভারী উত্তেজনায়। লিউ ঝান স্টিয়ারিংয়ে শক্ত করে হাত রেখে গতি বাড়িয়ে দিলো। তার পাশে বসে থাকা ফিওনা জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকলেও অনুভব করছিল গাড়ির অস্বাভাবিক গতিবৃদ্ধি।
একটা কালো Aston Martin Vantage, তার তীক্ষ্ণ হেডলাইট শহরের আলোকে কেটে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। ইঞ্জিনের গর্জন গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ছিন্ন করে যেন গর্জন করছে। চাকার ঘর্ষণে রাস্তার ডামার যেন একটু একটু করে গলে যাচ্ছে।
লিউ ঝান ডানপাশের গ্লাসে তাকিয়ে এক মুহূর্ত থমকে গেলো। একটা Ducati Panigale V4—গাঢ় লাল রঙের ধাতব দেহ, হেডলাইটের ফাঁকে এক ধরণের শিকারীর চোখ—পেছন পেছন আসছে, ছায়ার মতো লেগে আছে তাদের পিছু।

লিউ ঝান ভ্রু কুঁচকে গতি আরো বাড়িয়ে দিলো। গিয়ার শিফট করতেই গাড়ির ইঞ্জিন গর্জে উঠলো, রাস্তার ওপর দিয়ে বিদ্যুতের গতিতে ছুটে গেলো। বাইকটা যেন সেটা আশা করেই এসেছিল।
সামনে রাস্তায় লাল বাতি জ্বললো। লিউ ঝান গতি কমিয়ে রাস্তা পার হয়ে গেলো ঠিকই, কিন্তু বাইকটা আটকে গেলো সিগন্যালে। ফিওনা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে যাবে, তখনই ঘটলো অবিশ্বাস্য কিছু।
বাইকের চালক সোজা সামনে তাকিয়ে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো। তারপর হঠাৎই সে থ্রোটল চেপে দিলো! একটার পর একটা গাড়ির ছাদ বেয়ে বাইকটা লাফিয়ে উঠতে লাগলো!
প্রথম গাড়ির ছাদে চাকা পড়তেই ধাতব শব্দে কেঁপে উঠলো গাড়িটা, দ্বিতীয় গাড়ির ছাদ স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় অপেক্ষারত মানুষ স্তব্ধ হয়ে গেলো। বিশটি গাড়ির ছাদ পেরিয়ে, একের পর এক ধাক্কায় জানালার কাঁচ কাঁপিয়ে, সব পুলিশকে স্তম্ভিত করে বাইকটা লাল সিগন্যালকে উপেক্ষা করলো।
ফিওনা হতবাক, লিউ ঝান চোয়াল শক্ত করে আবার গতি বাড়ালো।
কিন্তু বাইকটা এবারও হারায়নি।

মিনিটখানেকের মধ্যে, একটা তীক্ষ্ণ শব্দে বাতাস কাঁপিয়ে Ducati-টা তাদের ঠিক পেছনেই এসে পড়লো। এবারও সেই একই হেডলাইট, সেই একই শিকারীর দৃষ্টি।
“বাঁধা দিয়ে লাভ নেই,” ফিসফিস করে বললো লিউ ঝান।
ফিওনা চুপ। বাইকের আরোহী এবার কী করতে যাচ্ছে?
লিউ ঝান হালকা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল যখন দেখল বাইকটা তাদের সামনে দিয়ে বাতাসের মতো বেরিয়ে গেলো। Ducati Panigale V4—তার ধাতব শরীর যেন বিদ্যুতের মতো ছুটে গেলো রাতের আঁধারে, যেন সেটি বাতাসের সাথেই মিশে গেলো।
কিন্তু স্বস্তি মুছে যেতে বেশি সময় লাগলো না।
এক ঝলক আলো, এক ঝড়ো আওয়াজ।

বাইকটা এবার উল্টো দিক থেকে ছুটে আসছে! রাস্তার বাতিগুলো তার প্রতিফলিত আলোয় ঝলসে উঠছে। এক দানবীয় গতিতে বাইকটা এবার একদম তাদের মুখোমুখি!
লিউ ঝান তৎক্ষণাৎ ডানপাশে গাড়ি ঘুরিয়ে ব্রেক চেপে ধরলো।
চাকা স্কিড করলো, রাস্তার ওপর রাবারের চিহ্ন ফেলে গাড়ি থমকে দাঁড়ালো।
একই সময়, বাইকও থামলো—ঠিক গাড়ির সামনে।
নীরবতা।
তারপর ধোঁয়ার ভেতর থেকে বাইক আরোহী ধীরে ধীরে নামলো।
একজন দীর্ঘকায় পুরুষ, কালো জ্যাকেট গায়ে, মাথায় হেলমেট, যার ভিতর থেকে দেখা যায় শুধু তীক্ষ্ণ চোখ—এক জ্বলন্ত আগুন!
লিউ ঝান আর ফিওনা মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেলো, যখন সে ধীরে ধীরে গাড়ির সামনে এগিয়ে এলো।
তারপর…
ধমাক্কা!

এক ভয়ংকর ঘুষি গাড়ির সামনের কাঁচ ভেদ করে ভেতরে ঢুকে গেলো!
গাড়ির কাচ বিস্ফোরণের মতো ভেঙে ছিটকে পড়লো চারপাশে!
শার্প গ্লাসের টুকরো ছড়িয়ে গেলো ফিওনা আর লিউ ঝানের ওপর, আলো প্রতিফলিত হয়ে সেই টুকরোগুলোকে যেন ভয়ংকর রূপ দিলো।
লিউ ঝান দ্রুত ফিওনাকে আড়াল করতে চেষ্টা করলো, কিন্তু তার চোখ তখনও জমে আছে সেই লোকের হাতের ওপর।
কারণ, সাধারণ মানুষের মতো তার ঘুষি নয়… তাতে কোনো কিছু লুকিয়ে আছে, এক অতিমানবিক শক্তি।
কে এই আরোহী? কেন সে তাদের পিছু নিয়েছে?
ফিওনা আর লিউ ঝান জবাব খুঁজতে পারলো না, কারণ সেই চোখদুটো তাদের দিকে জ্বলন্ত আগুনের মতো তাকিয়ে আছে…
বিস্ফোরিত কাচের টুকরোগুলো ধীরে ধীরে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। ধোঁয়ার মতো ধুলোর আস্তরণ, রাস্তার বাতিগুলো ঝাপসা হয়ে এসেছে। গাড়ির ইঞ্জিন নিস্তব্ধ, বাইকের গর্জনও থেমে গেছে।
তারপর…

একটা ধীর, অথচ দৃঢ় ভঙ্গিতে বাইক আরোহী হেলমেট খুললো।
লিউ ঝান আর ফিওনার নিঃশ্বাস একসঙ্গে বন্ধ হয়ে গেলো।
সেই চিরচেনা সবুজ চোখ—দুরন্ত, রাগান্বিত, দাবানলের মতো জ্বলন্ত।
শক্ত চোয়াল, দাঁতে দাঁত চেপে রাখা এক অসীম ক্রোধ।
তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে জ্যাসপার।
ফিওনার হৃদস্পন্দন মুহূর্তেই দ্বিগুণ হয়ে গেলো।
অসম্ভব!
সে স্পষ্ট মনে করতে পারছে—আজকে রাতে, সেই ফুল, সেই কফি।
রাতেই সে জ্যাসপারকে ফুলের নির্যাস মিশিয়ে কফি দিয়েছিল, যাতে তার গভীর ঘুম হয়!
জ্যাসপার তখনই ঘুমের অতলে তলিয়ে গিয়েছিল, নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল।
তাহলে…
কীভাবে সে এত দ্রুত ফিরে এলো?
ফিওনার চোখ বড় হয়ে গেলো, তার ঠোঁট কাঁপতে লাগলো।
লিউ ঝান পাশে বসে থাকলেও এখন একেবারে স্থির, তার হাত আস্তে আস্তে স্টিয়ারিং চেপে ধরছে।
কিন্তু জ্যাসপারের চোখ কেবল ফিওনার দিকেই স্থির।
তার দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্যও নড়ছে না।

অন্ধকার রাস্তায় তার উচ্চকায় শরীরটাকে আরও ভয়ানক লাগছে, কালো জ্যাকেটের নিচে থাকা মাংসপেশিগুলো দৃঢ়, এক প্রচণ্ড শক্তি বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে।
“প্রিন্স…” ফিওনার গলা শুকিয়ে গেছে।
জ্যাসপার ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে এলো, গাড়ির ভাঙা কাচের ওপর দিয়ে তার বুটের শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো।
তারপর গভীর, শীতল কণ্ঠে বললো,
“তুমি কী ভেবেছিলে, হামিংবার্ড? আমার কাছ থেকে এতৌ সহজেই পালিয়ে যেতে পারবে?”
জ্যাসপার কোনো দেরি করল না। গাড়ির দরজা ঝাঁকিয়ে খুলে এক ঝটকায় ফিওনাকে টেনে বের করলো।
ফিওনা হঠাৎ এভাবে ধরা পড়বে ভাবেনি, তার পায়ের নিচে মাটি সরে যেতে লাগলো। জ্যাসপারের আঙুলগুলো তার বাহুর চারপাশে লোহার মতো শক্ত হয়ে আঁকড়ে ধরলো।
“ছাড়ুন আমাকে!” ফিওনা ছটফট করলো, কিন্তু তার বাঁধন অটল।
লিউ ঝানও আর বসে থাকতে পারলো না। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে এলো, তার চোখে আগুন জ্বলছে।
“ফিওনাকে ছেড়ে দে, জ্যাসপার!” লিউ ঝান তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো, “ওকে আমার সাথে যেতে দে। ও তোকে চায় না, তোর সাথে থাকতে চায় না!”

জ্যাসপার থমকে দাঁড়ালো, তার সবুজ চোখে একটা অদ্ভুত আলো ঝলসে উঠলো।
“ওকে জোর করিস না,” লিউ ঝান এগিয়ে এলো, “ও তোর সাথে থাকলে শেষ হয়ে যাবে!”
এক মুহূর্তের জন্য হাওয়া থেমে গেলো। জ্যাসপার স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো লিউ ঝানের দিকে।
তারপর, একটা গভীর গর্জন বেরিয়ে এলো তার কণ্ঠ থেকে।
তার দাঁত শক্তভাবে চেপে গেলো, রাগে তার চোয়ালের রগগুলো ফুটে উঠলো।
“একটা শব্দও বলবি না, ফিওনার নামও উচ্চারণ করবি না তোর মুখে!”
“নাহলে তোর জিভ আমি কেটে ফেলবো,” জ্যাসপার গর্জে উঠলো, তার ভয়ংকর তীক্ষ্ণ চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। “তোর কলিজা টেনে বের করে আনবো,বলে দিলাম!”
“তোর এত সাহস?”
“তুই আমার ফিওনাকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেতে চাস?”
একটা ধমক, একটা বজ্রপাতের মতো প্রতিধ্বনি হলো বাতাসে।
লিউ ঝানের শ্বাস ঘন হয়ে গেলো, সে বুঝতে পারলো—এই মুহূর্তে জ্যাসপার রাক্ষসের মতো ভয়ং*কর।
ফিওনার শরীর শিউরে উঠলো।

লিউ ঝান দৌড়ে আসতে শুরু করল, কিন্তু তার আগেই জ্যাসপার রিভলভার বের করলো আর সরাসরি ফিওনার কপালে ঠেকিয়ে দিলো।
ফিওনার শ্বাস আটকে গেলো।
“আর এক পা এগোলেই ফিওনাকে এখানেই শেষ করে দেবো।”
জ্যাসপারের গলাটা ছিলো বরফের মতো ঠান্ডা, অথচ তাতে এক অগ্নিশিখার দহন লুকিয়ে ছিল।
লিউ ঝান হঠাৎ থমকে গেলো।
জ্যাসপার সত্যিই এটা করতে পারে। সে যে রকম উন্মত্ত, যে রকম দানবীয় শক্তিশালী—তার সামনে যুক্তি, ভালোবাসা বা মানবতা কিছুই টিকে না।
“আগের জন্মে আমি ফিওনাকে মারিনি,” জ্যাসপার হিসহিস করে বললো, “আমি তোকে মারতে চেয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু এই জন্মে…”

তার সবুজ চোখগুলো জ্বলতে লাগলো অন্ধকারে।
“এই জন্মে আমি ওকেই শেষ করে দেবো। কারণ ও যদি আমার না হয়,তাহলে আর কারোরই হতে পারবে না!”
“পৃথিবী থেকে মুছে ফেলবো ওকে!”
লিউ ঝানের মুখ শুকিয়ে গেলো। জ্যাসপার সত্যিই এই কাজ করতে পারে।
সে বিশ্বাসঘাতকতা করে না, নিজের কথায় স্থির থাকে—আর সেই কথা যদি মৃত্যু*র হুমকি হয়, তবে সেটাও বাস্তবায়ন করতে সে এক মুহূর্ত দেরি করবে না।
লিউ ঝান থেমে গেলো।
একটা তিক্ত নীরবতা নেমে এলো চারপাশে।
এই সুযোগে জ্যাসপার ফিওনাকে এক ঝটকায় বাইকের সামনে বসিয়ে দিলো।
“বসে থাক চুপচাপ,” তার কণ্ঠে কোনো নরম অনুভূতি নেই।
ফিওনার শরীর অসাড় হয়ে আছে, তার মনে হচ্ছে সে একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে আটকে গেছে।
কিন্তু… সে পালাতে পারবে না।
জ্যাসপার পেছনে বসলো, তার দু’পাশে হাত রেখে বাইকের হ্যান্ডেল শক্ত করে ধরলো।
তারপর…

বাইক বিকট গর্জন করে উঠে গেলো।
এতটাই জোরে যে ফিওনা হতভম্ব হয়ে জ্যাসপারের জ্যাকেটের ওপর শক্ত করে হাত রাখলো।
ভয়, শীতল বাতাস আর প্রচণ্ড গতির চাপে ফিওনা নিজের মুখ জ্যাসপারের বাহুর ভেতর লুকিয়ে ফেললো।
তার বুক ধুকপুক করছে।
সে জানে না জ্যাসপার তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সে জানে—এখান থেকে ফিরে আসা সহজ হবে না।
বাতাসে শীতলতার আভাস, তার মাঝেই ফিওনা কাঁপছে।
জ্যাসপার বাইকের গতিবেগ কমিয়ে এক মুহূর্তের জন্য থামলো।
ফিওনার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো ফিওনার ঠোঁট নীলচে হয়ে গেছে, পুরো শরীর হালকা কাঁপছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে।
তারপর নিজের কালো জ্যাকেট খুলে ফিওনার গায়ে জড়িয়ে দিলো।
“পরে নাও।”

ফিওনা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
এই লোকটা কিছুক্ষণ আগেই হুমকি দিয়েছিলো তাকে মেরে ফেলার, এখন সে কি না তাকে শীত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে?
কিন্তু ফিওনার কথা বলার সুযোগ নেই।
এরপর আবার হ্যান্ডেল শক্ত করে ধরে বাইক চালু করলো জ্যাসপার।
বাইক উড়ে চললো রাতের নিঃসঙ্গ রাস্তায়।
এদিকে…
লিউ ঝান বুঝতে পারলো সময় ঘনিয়ে আসছে।
সেই ফুলের প্রতিক্রিয়া যেকোনো সময় শুরু হবে।
জ্যাসপার দুর্বল হয়ে পড়বে।
এটাই সুযোগ!
এক মুহূর্তও নষ্ট না করে লিউ ঝান ভাঙা গাড়িটাই চালু করলো।
গাড়ির কাচ ভাঙা, সামনে একটা বড় ফাটল, কিন্তু ইঞ্জিন ঠিক আছে।
এটাই যথেষ্ট।
গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলো সে।
জ্যাসপারকে ধরতেই হবে।
এই রাতেই শেষ করতে হবে সবকিছু।

অন্ধকার রাতে লিউ ঝান গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলো, যখন তার চোখে পড়লো আকাশে এক রহস্যময় সবুজ ড্রাগন উড়ে যাচ্ছে। তার মানে—জ্যাসপার ড্রাগনের রূপ ধরে ফিওনাকে নিয়ে যাচ্ছে।
লিউ ঝানের হৃদয়ে তীব্র এক অনুভূতি জেগে উঠলো। সময় গড়িয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু এখন আর দেরি করার সুযোগ নেই। তার চোখের সামনে এক দুঃস্বপ্নের মতো ফিওনার জীবন ঝুঁকির মধ্যে।
আরেক মুহূর্তও নষ্ট না করে, গাড়িটা ঝাঁপিয়ে পড়লো ঘন জঙ্গলে। গাছপালা ছুঁয়ে সাইডের গাছের ডালগুলো ভেঙে পড়তে লাগলো।
গাড়ি থামানোর পর, লিউ ঝান গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে এক অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটালো—তার শরীর ধীরে ধীরে ড্রাগনে রূপান্তরিত হলো।
তার শরীরের লাল আগুনের দাগগুলো জ্বলতে শুরু করলো, চোখগুলো রক্তবর্ণে রাঙালো, এবং বড় বড় ডানা বেরিয়ে আসলো।

অন্ধকার আকাশে আছড়ে পড়ে লিউ ঝান উড়াল দিলো। তার সঙ্গেও যুদ্ধের প্রস্তুতি ছিলো—এটা ছিলো একটি রূপান্তরিত সংঘর্ষ, এক রূপকল্পে পরিণত যুদ্ধ।
একটু পরে, আকাশে জ্যাসপার তার সবুজ ড্রাগনের রূপে উড়ছিলো। তাঁর পিঠে ছিলো ফিওনা, এবং তার গতি একটুও ধীর হয়নি। কিন্তু লিউ ঝান পিছনে পড়ে না থেকে, তার গতিতে আগুনের গোলা ছুঁড়ে দিলো।
গোলাটি আকাশে ফাটল সৃষ্টি করে চলে গেলো।
জ্যাসপার কিছুক্ষণের জন্য দিশেহারা হয়ে পড়েছিলো, কারণ ফিওনা তার পিঠে ছিল—আর তাকে নিয়ে হামলা করা সম্ভব ছিল না।

লিউ ঝান আবারও আরেকটি আগুনের গোলা ছুড়ে মারে, যা জ্যাসপারকে আরও বাধাগ্রস্ত করে, কিন্তু ফিওনার নিরাপত্তার কথা ভেবে জ্যাসপার এতটুকু ঝুঁকি নিতে পারেনি।
তখনই, জ্যাসপার একটি কালো পাহাড় দেখতে পেলো সামনে।
এটা ছিল অদৃশ্য পৃথিবীর এক আশ্রয়স্থল। এক ঝটকায়, সে বড় গতিতে সেই কালো পাহাড়ের দিকে উড়ে চলে গেলো, যেখানে সে এক নিরাপদ স্থানে ফিওনাকে নিয়ে নামলো।
লিউ ঝানও পিছনে পিছনে আসছিল, কিন্তু তার আগেই জ্যাসপার পাহাড়ের গা ঘেঁষে নিরাপদ স্থানে নেমে গিয়েছিলো।
পাহাড়ের নির্জন শিখরে তিনটি ছায়া দাঁড়িয়ে আছে—লিউ ঝান, ফিওনা, আর জ্যাসপার।
হিমশীতল বাতাস বইছে, চারপাশে শুধুই রাতের নীরবতা। কিন্তু সেই নীরবতার নিচে তীব্র উত্তেজনার ঝড় উঠছে।
হঠাৎই…
জ্যাসপার এক ঝটকায় লিউ ঝানের কলার চেপে ধরলো।

“তুই কি ভেবেছিস, আমার ফিওনাকে নিয়ে পালাবি?”
জ্যাসপারের কণ্ঠ বজ্রপাতের মতো।
তার সবুজ চোখে আগুন জ্বলছে।
লিউ ঝান শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেও বুঝতে পারলো, জ্যাসপার একবার আঘাত করলে সেটা বাঁচানো অসম্ভব।
আর ঠিক তখনই…
জ্যাসপার তার শক্ত মুষ্টি তুলে লিউ ঝানকে ঘুষি মারতে গেলো।
কিন্তু তার আগেই…
ফিওনা তার হাত ধরে ফেললো!
“থামুন, প্রিন্স !” ফিওনার কণ্ঠ কাঁপছে, তার চোখে দৃঢ়তা।
জ্যাসপার তার দিকে রাগান্বিত চোখে তাকালো।
এক মুহূর্তের জন্য সময় থমকে গেলো।
কিন্তু জ্যাসপার থামবে না।
সে আবার আক্রমণ করতে উদ্যত হলো, ফিওনা পুনরায় বাধা দিলো—
আর সেই সুযোগেই…
লিউ ঝান ভয়ংকর এক ঘুষি বসিয়ে দিলো জ্যাসপারের মুখে!
জ্যাসপার ছিটকে পড়ে গেলো, আর ফিওনাও ধাক্কায় পড়ে গেলো মাটিতে।
রাগে, আঘাতে, মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেলো জ্যাসপার।
কিন্তু…
সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো, তার মুখ থেকে র*ক্ত ঝরছে।

তারপর…
এক প্রচণ্ড লাথি লিউ ঝানের পেটে!
লিউ ঝান শ্বাস নিতে পারলো না, পেছনে পড়ে গেলো কয়েক কদম!
ফিওনা আতঙ্কে চিৎকার করলো, “থামো তোমরা! প্লিজ থামো!”
কিন্তু এখানে কেউ থামতে রাজি নয়।
এই লড়াই শুরু হয়ে গেছে, আর এর শেষ হবে এক পক্ষের পরাজয়ে।
ফিওনার দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্য ঝাপসা হয়ে এলো।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুই পুরুষ—জ্যাসপার আর লিউ ঝান।
তারা এখন দুই যুদ্ধরত বাঘ।
হঠাৎ…
লিউ ঝান তীব্র গতিতে ছুটে এসে জ্যাসপারকে এক ধাক্কায় নিচে ফেলে দিলো।
কিন্তু জ্যাসপার কি এত সহজে হার মানবে?
না!

সে সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে হাত রেখে শরীর ঘুরিয়ে নিলো, আর এক বিশাল লাথি লিউ ঝানের পায়ে!
লিউ ঝান পেছনে ছিটকে গেলো, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে সামলে নিলো।
তবে, জ্যাসপার এবার সময় নষ্ট করলো না।
এক ঝাঁপে সামনে এসে…
তার বিশাল মুষ্টি লিউ ঝানের মুখে!
“ধড়াম!”
রক্তের স্বাদ টের পেলো লিউ ঝান।
কিন্তু সে আবার উঠে দাঁড়ালো।
তার চোখ রক্তিম… তার নিঃশ্বাস আগুনের মতো গরম।
এবার সে ঝাঁপিয়ে পড়লো জ্যাসপারের ওপর!
এক ঘুষি—আরেক ঘুষি—আরেক ঘুষি!
জ্যাসপার পড়ে গেলো, কিন্তু…
সে ঠিক তখনই লিউ ঝানের কলার ধরে এক ঘুরন্ত লাথি!
লিউ ঝান বাতাসে উঠে গেলো, তারপর সজোরে মাটিতে পড়লো!
ফিওনা চিৎকার করলো, “থামো! প্লিজ থামো!”
কিন্তু এখানে কেউ কারো কথা শুনবে না।
কারণ এটা শুধু একটা লড়াই নয়—
এটা প্রেম, রাগ, প্রতিশোধ,আর বেঁচে থাকার যুদ্ধ!

মাঠে এক ভয়াবহ লড়াই শেষ হওয়া মাত্র, জ্যাসপার স্তব্ধ হয়ে গেলো।
তার চোখের সামনে লিউ ঝান এক ঝটকায় আবার উঠে দাঁড়িয়ে তাকে আক্রমণ করতে যাচ্ছে, কিন্তু তার মুখের রক্ত…
রক্তের স্রোত এক ঝরনার মতো বেরিয়ে আসছে, জ্যাসপার র*ক্ত বমি করতে শুরু করলো।
এমন দৃশ্য দেখে, লিউ ঝান থমকে দাঁড়িয়ে গেলো। কিছু একটা মনে হল। তার চোখে এক ধরনের বিস্ময় ফুটে উঠলো।
ফুলের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।
লিউ ঝান তা বুঝতে পারলো—তার সব পরিকল্পনা ধাক্কা খেয়েছে।
এবার সে ফিওনাকে টেনে নেয়ার জন্য হাত বাড়ালো।
কিন্তু ফিওনা লিউ ঝানের হাত ছেড়ে চলে গেলো, জ্যাসপারের দিকে দৌড়ে।
জ্যাসপার তার বুকে হাত চেপে ধরে সামান্য ঝুঁকে পড়ে।
তার চোখের কোণে এক ধরনের অসহায়তা ছিল, যদিও তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

ফিওনা তার কাছে পৌঁছে, তার হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার কি হয়েছে? কী হচ্ছে আপনার?”
জ্যাসপার এক লহমায় হাসি থামিয়ে ফেললো, তার মুখে এক র*ক্তিম আক্রোশ।
তার হাসি অদ্ভুত ছিল—অথবা, মনে হচ্ছিল, দুঃখের হাসি।
“কেনো জানো না তুমি… কি হচ্ছে?” সে গভীরভাবে ফিওনার দিকে তাকিয়ে বললো।
এখন জ্যাসপার আরও কাছাকাছি চলে এসে ফিওনার দুই বাহু শক্ত করে ধরলো।
তার চোখে এক অস্বাভাবিক উন্মাদনা, রাগ,আর যন্ত্রণার ছাপ।
“তুমি আমাকে ভালোবেসে বিষ পান করালেও আমি সেটা পান করতাম, কিন্তু তুমি ছলনা করেছো আমার সাথে, হামিংবার্ড।”

ফিওনা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে গেলো। এক মুহূর্তের জন্য সে স্থির হয়ে গেলো, গাল বেয়ে এক বিন্দু পানি গড়িয়ে পড়লো।
“তুমি কি ভেবেছিলে আমি কিছুই জানি না?” জ্যাসপার বলতে থাকলো, “তুমি লিউ ঝানের সাথে কথা বলেছো?ওর বলা সেই ফুলটা জোগাড় করেছো, আমাকে কফির সাথে খাইয়েছো?”
ফিওনার চোখে বিষাদ আর বেদনা ফুটে উঠলো।
“তুমি কি মনে করেছিলে যে তুমি পালাতে পেরেছো? না, আমি তোমাকে পালাতে দিয়েছি। আর তোমার দেওয়া বিষফুলও আমি নিজের ইচ্ছায় পান করেছি, ফিওনা।”
ফিওনার শরীর এক ঝাঁকড়ানো অনুভূতির মাঝে ঢুকে গেলো, তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো।
তার মনে এখন একটানা অপরাধবোধের সাগর।
জ্যাসপার তখন চোখ বন্ধ করে, এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে,পুরো পৃথিবী তার ওপর ভেঙে পড়ছে। তার যন্ত্রণা,এক দীর্ঘশ্বাসের মতো আছড়ে পড়লো।
“তোমাকে পাওয়ার লড়াইয়ে তুমিই ছিলে সবচেয়ে বড় বাধা।”
তার কথা ফিওনার হৃদয় গহীন ক্ষত সৃষ্টি করলো। তার কথা শুনে, মনে হচ্ছিল যে সব কিছু থেমে গেছে, সময়ের গতি মন্দ হয়ে গেছে।

“আমি পুরো মহাবিশ্বের সাথে যুদ্ধ করেও তোমাকে জয় করতে পারতাম,” সেৎবিক্ষিপ্ত মনে কথাগুলো উচ্চারণ করছিল,”কিন্তু তোমার মনের গভীরে লুকানো দ্বিধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমি ক্লান্ত।”
এই কথাগুলো ফিওনার হৃদয়ে গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করলো। মনে হচ্ছিল, তার পছন্দের জন্য তাকে অভিশাপ দেয়া হলো।
ফিওনা নিজেকে সামলে রেখে, চোখের জল মুছে ফেললো।
তার মনে নানা প্রশ্ন উকি দিচ্ছিল—যতই জ্যাসপার তার কাছে আসছে, ততই সে একটি চিরন্তন যুদ্ধের অংশ হয়ে উঠছে।
লিউ ঝান ফিওনাকে টেনে নিয়ে আরেকটু দূরে দাঁড়ালো, তার চোখে তীব্র উদ্বেগ ছিল। “ফিওনা, তুমি কি করছো?? আমাদের এখনই পালাতে হবে, এটাই শেষ সুযোগ!” তার কণ্ঠে তাড়া ছিল,এই মুহূর্তে প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান,কিন্তু ফিওনার চোখে সঙ্কটের গভীরতা স্পষ্ট ছিল।

ফিওনা হঠাৎ চেঁচিয়ে বললো, “কি বলছো? দেখতে পারছো না ওনার কি অবস্থা? ওনাকে এভাবে ফেলে রেখে আমি কিভাবে যাবো? আর তুমি বলেছিলে, এই ফুল শুধু ওনাকে দুর্বল করে দিবে,আর কিছুই না তাহলে তার গলা দিয়ে র*ক্ত কেনো বের হচ্ছে?” ফিওনার গলার কাঁপন, আর চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু, তার মনে অজস্র প্রশ্নের ঝড় বয়ে চলছিল। সে কিভাবে এই মুহূর্তে জ্যাসপারকে ত্যাগ করে চলে যেতে পারে? তার হৃদয়ের ভেতর কোনো কিছু তাকে বাধা দিচ্ছিলো,কিছু একটা হারানোর ভয়।
লিউ ঝান তখন মাথা চেপে বললো, “আরে বাবা! ও শক্তিশালী ড্রাগন, ওর এতো সহজে কিছু হবেনা।ও মরবেনা।শুধু দূর্বল হয়ে পড়বে,এটা কিছুক্ষণ পরেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু,ও যদি একবার ঠিক হয়ে যায়, তবে তোমাকে আর আমাকে দুজনকেই মেরে ফেলবে!” তার কণ্ঠে ভয় ছিল, তবে সে জানতো ফিওনাকে নিয়ে পালাতে হলে দ্রুত কিছু একটা করতে হবে। “ফিওনা, চলো প্লিজ!” বলেই সে ফিওনাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু তার কথা শেষ হওয়ার আগেই, এক ঝটকায় জ্যাসপার লাথি মেরে দিলো লিউ ঝানের পায়ের সামনে একটি বড় পাথর। পাথরটি তার পায়ে আঘাত করলে, লিউ ঝান পাহাড়ের কিনারে পড়ে গেলো, একদিকে ছিটকে গিয়ে সামলাতে না পারার কারণে ফিওনা তার হাত থেকে ছুটে পড়ে গেলো পাহাড়ের নিচে।

লিউ ঝান একটুও সময় না পেয়ে পাহাড়ের কিনারা থেকে ফিওনাকে ছুটতে দেখে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।
চিৎকার করে উঠলো “ফিওনা! ড্রাগন রূপ ধরো!” তার চিৎকার কানে বাজলো, কিন্তু ফিওনা আর কোনো সাড়া দিলো না। সে এমন অদ্ভুত অবস্থা অনুভব করছিলো, তার শরীরে শক্তি নেই, তার সমস্ত কিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
লিউ ঝান,শরীরের ও সমস্ত শক্তি যেন শেষ হয়ে যাচ্ছিলো, সে নিজেও ড্রাগন রূপ ধরার চেষ্টা করলো, কিন্তু ব্যর্থ হলো। তার শক্তি কোথাও হারিয়ে গেলো।
ফিওনা পাহাড়ের কিনারা ছেড়ে নিচে পড়তে লাগলো, একেবারে গহীন সমুদ্রের দিকে। চিৎকারে গলা শুকিয়ে আসছিল, বাতাস তার চারপাশে ঝড়ের মতো ঘুরছিল, আর নিচের গভীর সমুদ্রের তীব্র ঢেউ গর্জন করছিল। ঠিক সেই মুহূর্তেই, লিউ ঝানের চোখের সামনে এক অদ্ভুত দৃশ্য তৈরি হলো। জ্যাসপার,যে এক মুহূর্তে রাগ আর কষ্টে থেমে গিয়েছিলো, সে মুহূর্তে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে, ফিওনাকে বাঁচানোর জন্য পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়লো। তার শরীরের শক্তি এক মুহূর্তে তাকে অদ্ভুতভাবে দ্রুত গতিতে গতি দিয়েছিল, আর সে ফিওনাকে খুব দ্রুত তার বাহুতে ধরে ফেললো।

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ২৮

তার বাহুতে ফিওনার দেহ এতটা নরম আর ভঙ্গুর ছিল মনে হবে সে যেকোনো মুহূর্তে উড়ে যেতে পারে। জ্যাসপার শক্তি দিয়ে তার শরীরের ভেতরে ড্রাগন রূপ ধারণের চেষ্টা করলো, তবে কিছুতেই তা হতে পারলো না। সে যতটা চেষ্টাই করুক, কিছুই হচ্ছিল না। তার শরীরের ত্বক থেকে রক্ত ঝরতে লাগলো, শরীর ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু পাহাড়ের অভিশপ্ত শক্তি তাকে তা হতে দেয়নি। এই অভিশপ্ত পাহাড়ের মধ্যে, ড্রাগন রূপে আসতে পারলেও,মানব রূপ থেকে ড্রাগন বা কোনো সুপারন্যাচারাল শক্তিতে পরিণত হতে পারে না, এই অদ্ভুত নিয়ম ভেঙে দেয়া অসম্ভব ছিল।
শেষ পর্যন্ত, জ্যাসপার আর ফিওনা একসাথে নিচে পড়তে থাকলো,তাদের ভাগ্য একসাথে গতি হারাচ্ছিল।
লিউ ঝান চিৎকার করলো, “ফিওনা!!” তার কণ্ঠে অগণিত যন্ত্রণা, হতাশা, আর অবিশ্বাস ছিল। তার চোখের সামনে, তার সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল।তার চোখের সামনে তার ভালোবাসা পুনরায় হারিয়ে যেতে লাগলো।

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ২৯