আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৩১

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৩১
সাবিলা সাবি

রাত গভীর। এল্ড্র প্রাসাদের এক কোণে জ্বলছে মৃদু আলো। জ্যাসপার তার কক্ষে বসে তার সামনে একটি কালো রঙের শিশা। উপরে ফয়েল দিয়ে ঢাকা, নিচে জলের চেম্বার,আর তাতে সংযুক্ত একটি লম্বা ধোঁয়াভরা পাইপ। ধীরে ধীরে সে টান দিচ্ছে, শিশার মাথা থেকে মিষ্টি সুগন্ধি ধোঁয়া উঠে যাচ্ছে বাতাসে, কক্ষের নিস্তব্ধতা সেই ধোঁয়ার সঙ্গেই মিলিয়ে যাচ্ছে।
তার ভেতরের অস্থিরতাগুলোও ধোঁয়ার আকারে আকাশে উড়ে যাচ্ছে।
দরজার পাশে হঠাৎই এক পরিচিত ছায়া ভেসে উঠল। রাজা ড্রাকোনিস, গম্ভীর চোখে ছেলেকে লক্ষ্য করে বললেন,
“তুমি তাহলে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছো, ওই মেয়েটাকেই বিয়ে করবে?”
জ্যাসপার ধীরে শিশা নামিয়ে রাখলো। চোখের কোণে এক টুকরো ক্লান্তি, একরাশ আবেগ। তারপর সোজা হয়ে বসে বলে উঠল,“হ্যাঁ, কতবার বলেছি …ফিওনা আমার অক্সিজেন। আর অক্সিজেন ছাড়া কেউ বাঁচে?”
তার গলায় ছিলো স্থির গভীরতা আর চোখে ছিল অদম্য প্রেমের দীপ্তি। কিন্তু রাজা ড্রাকোনিস থেমে গেলেন না।
“তাহলে সেই অক্সিজেনের জন্য নিজের বাবাকে বন্দি করতে তোমার হাত একবারও কাঁপেনি?”
এই কথায় মুহূর্তেই নিস্তব্ধতা নেমে এলো কক্ষে। জ্যাসপার ঠিক সেই মুহূর্তে নিজের অন্তরের গভীরে ডুবে গেলো।তার চোখ নিচু হয়ে গেল, কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠলো—

“আমি ভুল করেছি,বাবা। আমি জানি… আপনি আমার ভালোর জন্যই সব করেছিলেন। আপনি আমাকে সুরক্ষিত রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি… আমি নিজের আবেগে হেরে গিয়েছিলাম। আমি আপনাকে ব*ন্দি করেছিলাম—এটা আমার জন্য বড় ভুল। আমাকে ক্ষমা করে দিন প্লীজ! কিন্তু আমাকে ফিওনাকে আমার কাছ থেকে আলাদা করবেন না। আমি তাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না, আমি মরে যাবো।”
তার কণ্ঠে ছিল অনুশোচনা আর অসহায়তা।
রাজা ড্রাকোনিস কিছুক্ষণ চুপ থেকে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি দেখলেন সেই ছেলে, যে ছিল এক সময় ভেনাসের গর্ব, গোটা ভেনাসের প্রিন্স, যে সর্বোচ্চ শক্তির অধিকারী, আজ তার ভেতরে যে কষ্ট, সেই কষ্টের উৎস শুধুমাত্র ফিওনা।একসময় যে জ্যাসপার ছিল কঠোর, অদম্য, আজ সে প্রেমে পড়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে, এক অজানা কষ্টে হারিয়ে যাচ্ছে। অবাক হয়ে ভাবলেন ‘ভালোবাসা কীভাবে একজন অদম্য পুরুষকেও ভেঙে দিতে পারে?’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, “তুমি যাকে ভালোবাসো, তাকে ছেড়ে দেওয়া কখনোই সহজ নয়। কিন্তু তুমি জানো, আমি চাই তোমার জীবন সুখী হোক, তবে সেই সুখ যেন তোমাকে অন্ধকারে নিয়ে না যায়। আমি বুঝতে পারছি, তোমার হৃদয়ের আক্ষেপ কিন্তু এতোটা দুর্বল হয়ে যেওনা যাতে তোমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়।
জ্যাসপার চুপচাপ শোনে। চোখে জল জমে যায়।
“আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, বাবা—আমি দুর্বল হব না। আমি শুধু ওকে পাশে চাই। ফিওনা ছাড়া আমি অপূর্ণ।”
রাজা ড্রাকোনিস ধীরে মাথা নাড়লেন,
“তোমাকে সময় দিলাম। কিন্তু এই সম্পর্কের জন্য তোমাকে যে দায়িত্ব নিতে হবে, সেই দায়িত্ব থেকেও পেছাতে পারবে না। মনে রেখো, প্রেমের পাশাপাশি রাজ্যও তোমার অপেক্ষায়।তবে এখন, তুমি যা চাও, সেটাই পাবে।”
এই মুহূর্তে, ধোঁয়ার কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা জ্যাসপার বুঝে গেল—ভালোবাসা সহজ নয়, কিন্তু সেটার জন্য যদি লড়তে হয়, সে লড়বেই।

আজকের দিনটি অন্যরকম আবেশ নিয়ে এসেছে। ফ্লোরাস রাজ্যের আকাশে আজ এক ভিন্ন আলো, ষৎএক ভিন্ন উত্তেজনা। রাজপ্রাসাদজুড়ে সাজসজ্জার আয়োজন, প্রাচীন ধ্বনিতে বেজে উঠছে সুরম্য বাদ্যযন্ত্র।
রাজা জেনথ ড্রাকোনিস, এল্ড্র রাজ্যের সর্বশক্তিমান সম্রাট, তার দুই পুত্র—প্রথম পুত্র জ্যাসপার অরিজিন আর কনিষ্ঠ পুত্র এথিরিয়ন ফায়ারলক—সহ ফ্লোরাস রাজ্যে পা রেখেছেন। তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন থারিনিয়াস আর আলবিরা। তবে অ‌্যাকুয়ারা আজকের সফরে উপস্থিত হতে পারেনি, কারণ তাকে লিউ ঝানের দেখভালের দায়িত্বে থাকতে হয়েছে।
এই আয়োজনের মূল কারণ একটাই—জেনথ ড্রাকোনিস তাঁর পুত্র জ্যাসপারের জন্য ফ্লোরাস রাজ্যের রাজকন্যা, এলিসন ফিওনাকে বধূরূপে প্রস্তাব দিতে এসেছেন।
রাজপ্রাসাদের অলিন্দে এখনো শোনা যাচ্ছে পায়ের শব্দ, কণ্ঠস্বর আর প্রস্তুতির গুঞ্জন। এই আগমনে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে চলেছে।

প্রাসাদের প্রধান হলঘর ইতোমধ্যেই ভরে উঠেছে রাজকীয় আবহে। সোনালি আলোয় ঝলমল করছে স্ফটিক ঝাড়বাতি, দেয়ালজুড়ে ঝুলছে রাজবংশের ইতিহাস বর্ণনা করা বিশাল চিত্রকলাগুলো। ঠিক কেন্দ্রে রাখা হয়েছে একচেটিয়া তৈরি করা মখমলি সোফাসমূহ।
সেই সোফায় বসেছেন ফ্লোরাস রাজ্যের একমাত্র রাজা—জারেন। গম্ভীর, ধীর স্থির, অথচ চোখে একধরনের প্রশ্রয় মাখানো দৃষ্টি। তাঁর ডান পাশে বসেছেন তাঁর ছোট বোন, লিয়ারা—ফিওনার মা, যার চোখে-মুখে মিশে আছে অস্থির ভালোবাসা আর ভেতরে জমে থাকা একরাশ শঙ্কা।
সবার চোখ তখন সিঁড়ির দিকেই, কারণ ফিওনা এখনো আসেনি। সাজসজ্জার শেষ স্পর্শে ব্যস্ত সে। কক্ষের বাইরে অপেক্ষা করছে সিলভা—যে কিছুক্ষণ পরেই ফিওনাকে নিয়ে প্রবেশ করবে। আর এই অপেক্ষার মধ্যেই জমে উঠছে নতুন সম্পর্কের শুরু, পুরনো ভুলের হিসেব, আর এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের গুঞ্জন।

প্রাসাদের উপরের কক্ষে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ফিওনা এক পরীর মতো রূপ নিয়েছে। তার শরীরে জড়ানো আছে কোমল পিংক রঙের স্যাটিন আর টুলের গাউন, যার নিচে সূক্ষ্ম সোনালী সূচিকর্ম নরম দুপুরের আলোয় ঝিকিমিকি করে উঠছে। তার কাঁধ ছুঁয়ে ঝুলে থাকা কেশগুলো আলতো কার্ল করা, একপাশে সাজানো হালকা ফুলের অলংকার। চোখে হালকা রঙের মেকআপ, ঠোঁটে এক চিলতে গোলাপি হাসি।
সিলভা এসে তার হাত ধরলো, কানে ফিসফিস করে বললো, “তোমাকে কোনো স্বর্গের রানীর মতো লাগছে।”
ফিওনা একটু লাজুক হেসে মাথা নিচু করলো।
তারপর দুজন একসাথে ধীরে ধীরে নামতে শুরু করলো প্রাসাদের স্ফটিক-সিঁড়ি দিয়ে।
নীচে বসে থাকা জ্যাসপারের দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্যও সরে না। তার গভীর সবুজ চোখদুটো থমকে গেছে সিঁড়ির ওপর, পুরো রাজ্য হঠাৎ থেমে গেছে সেই এক দৃশ্যের জন্য। তার চোখে ছিল বিস্ময়, আকর্ষণ আর একরাশ অধিকারবোধ—মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে, আর সেই স্বপ্নের নাম ফিওনা।
অন্যদিকে এথিরিয়নের চোখ সরে না সিলভার দিক থেকে। সে দেখে, কিভাবে সিলভা ফিওনার গাউন ঠিক করে দেয়, কিভাবে তার চোখে আশ্বস্তির স্পর্শ রাখে। সেই কোমল ব্যবহারে কোথাও যেন এথিরিয়নের আগুনমাখা হৃদয়ে হালকা এক পরশ লাগলো।

এই মুহূর্তে রাজপ্রাসাদ আর কোনো শব্দ করে না। সবার দৃষ্টি শুধুই সেদিকেই—যেখানে ভালোবাসা, সৌন্দর্য আর ভবিষ্যতের গল্প একত্রে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে।
সোফাগুলিতে সবাই একত্রিত হয়ে বসে ছিল। বিশাল রুমটি গর্জন করে শীতল বাতাসের সাথে শান্তিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, রাজা ড্রাকোনিস প্রাসাদের এক কোণে স্থির হয়ে বসেছিলেন, তার চোখে ছিল গম্ভীরতা। তিনি ধীরে ধীরে জ্যাসপার আর ফিওনার দিকে তাকালেন, তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “এখন সময় এসেছে আমাদের কথা বলার, ফিওনা আর আমার পুত্রের জ্যাসপারের বিয়ে আগেই হয়েছে,তবে সেটা পৃথিবীর নিয়মে,এবার ওদের বিয়ে ভেনাসে দেবতা আভ্রাহারের প্রাসাদে সম্পুর্ন করতে হবে।”
ফিওনার মা, লিয়ারা, উন্মুক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। তার চোখে একাধিক প্রশ্ন ছিল, তার মনে সন্দেহের ঝড় উঠছিল। মেয়েটি, যার ভবিষ্যৎ তার হাতেই, এমন এক পুরুষের সাথে যুক্ত হতে চলেছে, যাকে তিনি উগ্র, আক্রমণাত্মক আর অত্যন্ত টক্সিক মনে করেন। তিনি জ্যাসপার এর দিকে তাকালেন আর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “জ্যাসপার, তুমি কি নিশ্চিত যে তুমি ফিওনাকে খুশি রাখতে পারবে? তুমি জানো, তুমি যে ধরনের ছেলে—তোমার সাথে জীবন কাটানো কি সম্ভব?”

লিয়ারার কথা শোনার পর, রুমে একটা স্তব্ধতা নেমে এলো। ফিওনা সবার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, তার মুখের অভিব্যক্তি ছিল অস্থির। তার মা যে কথা বলছিল, সেটি সত্যিই তার জন্য কষ্টকর ছিল, তবে তার অনুভূতি ছিল স্পষ্ট। সে জানত, তার মা কোন ভুল করছেন না। তিনি সত্যিই চিন্তা করছিলেন, ফিওনা কতটুকু নিরাপদ থাকবে।
জ্যাসপার কিছুক্ষণ চুপ থাকলো তার চোখ তীক্ষ্ম হয়ে উঠলো। সে তার গা আরও সোজা করে বসলো তারপর দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিল, “ফিওনার জন্য আমি সব করতে প্রস্তুত। যদি আমার স্বভাব,আচরণ কিছু আপনাদের কাছে দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করে থাকে, তবে আমি কথা দিচ্ছি,আমি নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করবো।ফিওনা আমার কাছে অমূল্য। তাকে আমি কখনো ব্যথিত হতে দেব না।”

লিয়ারা তার কণ্ঠের উত্তেজনায় কিছুটা হলেও শীতলভাবে বললেন, “তুমি বলছো, কিন্তু আমি জানি না তুমি এটা সত্যিই মানবে কিনা। তুমি তো আগে আমাদের সাথে এমন আচরণ করেছো যা কখনো কোনো কেউ সহ্য করবেনা”
ফিওনার মায়ের কথায় শোনার পর, জ্যাসপার কিছুটা ভারী মনোভাব নিয়ে মাথা নীচু করে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তার মুখের দিকে কেউ আর তাকাতে সাহস পেল না। কিন্তু তার মধ্যে একটা গভীরতা ছিল, সে জানে, তাকে এই সম্পর্ককে ঠিক করতে হবে—এমনকি নিজের অন্ধকার দিকগুলোও।
এদিকে, ড্রাকোনিস আবারও শ্বাস টেনে ধীরে ধীরে বললেন, “লিয়ারা, আমি জানি তোমার চিন্তা অনেক বড়, কিন্তু কিছু সময় দিয়ে দেখো, ফিওনা আর জ্যাসপার একসাথে কীভাবে নতুন পথ তৈরি করে।”
ফিওনা তখন ধীরে ধীরে বললো, তার চোখে অনেক কিছু ছিল, কিন্তু সবচেয়ে বড় যে অনুভূতি ছিল, তা ছিল—বিশ্বাস। “মা, আমি জানি তুমি আমার জন্য চিন্তা করো, কিন্তু আমি প্রিন্সেকে ভালোবাসি, আর এই ভালোবাসাকে আমি অস্বীকার করতে পারব না। তুমি শুধু আমাদের সময় দাও, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।”
এখন সবার চোখ ছিল ফিওনার ওপর। লিয়ারা কিছুটা হতাশ হলেও, সে ফিওনার কণ্ঠে একরকম বিশ্বাস দেখতে পাচ্ছিল, আর এটাই তাকে কিছুটা প্রশমিত করেছিল।

লিয়ারা ধীরে ধীরে তার চোখে এক ধরনের সঙ্কল্প নিয়ে বললেন, “আমি একমাত্র আমার মেয়ের দিকে তাকিয়ে, তার ভালোবাসা আর মনের কথা চিন্তা করে রাজি হচ্ছি। তবে আমি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই, যদি কোনো কারণে আমার মেয়ের একটুকুও কষ্ট হয়, যদি সে এক মুহূর্তের জন্যও যন্ত্রণা পায়—তাহলে আমি পুরো ভেনাস জুড়ে যুদ্ধের ডাক দেবো। তোমরা সবাই জানো, আমি কোনো চুক্তি বা প্রতিশ্রুতি ছাড়া নিজের মেয়েকে কিছুতেই কষ্ট সহ্য করতে দেব না।”
লিয়ারার এই কথাগুলো পুরো প্রাসাদে এক গভীর নীরবতা সৃষ্টি করেছিল। তার গা থেকে যে তীব্র শক্তি বের হচ্ছিল, তা যেন গোটা রুমকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছিল। তার কথা ছিল একেবারে সোজা, স্পষ্ট—ফিওনার সুখের জন্য তার মা কোনো ত্যাগ করতে দ্বিধা করবেন না।

ড্রাকোনিস, যিনি এতক্ষণ একপাশে নিরব ছিলেন, এবার গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “লিয়ারা, আমি তোমার কথা বুঝি। আমরা সবাই জানি, ওদের সুখই আমাদের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য।
জ্যাসপার হালকা হাসি দিয়ে, কিন্তু তার কণ্ঠে এক শক্তি নিয়ে বললো, “আরে মাদার-ইন-ল, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। ফিওনার মনে কষ্ট দেয়া তো দূরের কথা,ওকে যদি কেউ কষ্ট দেয়—তাহলে আমি তাকে এই মহাবিশ্ব থাকছে সরিয়ে দিবো। আমি ওকে সবসময় সব বিপদ থেকে আগলে রাখবো।”
জ্যাসপারের কথাগুলো যেন পুরো ঘরটা কম্পিত করল। তার চোখে এক অদ্ভুত উন্মাদনা ছিল,পৃথিবী বা মহাবিশ্বের সমস্ত শক্তি তার হাতে। লিয়ারা কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে, অল্প একটু ঠাণ্ডা কণ্ঠে বললেন, “এটা যদি সত্যি হয়, তবে আমি শান্তি পাবো। কিন্তু তোমাকে জানিয়ে রাখছি, তোমার প্রতিশ্রুতি যদি ভঙ্গ হয়, তাহলে যে কোনো কিছু হতে পারে।”

ফিওনা, তার মায়ের কঠোর কণ্ঠে কিছুটা চিন্তিত হলেও, একরকম শক্তি অনুভব করলো। সে জানতো, তার মা যেভাবে তার জন্য লড়াই করবে,তার মতো কেউ নয়। কিন্তু সে তার ভালোবাসাকে এই ধরণের চাপের মধ্যে দেখতে চায়নি। সে ধীরে ধীরে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “মা, আমি জানি তুমি আমার জন্য কতটা উদ্বিগ্ন, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি প্রিন্স আমাকে কখনো কষ্ট দেবে না। আমি জানি, আমাদের ভালোবাসা শক্তিশালী, আর এটা আমাদের সব বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করবে।”
তবে, লিয়ারা তার মেয়ের দিকে এক দীর্ঘ তাকিয়ে থেকে বললেন, “তবে মনে রাখবে, ফিওনা, যদি কোনোদিন তুমি নিজেকে একা অনুভব করো, যদি তোমার হৃদয়ে কোনো গোপন কষ্ট থাকে,সবার আগে আমাকে জানাবে।”

এল্ড্র রাজ্যর অতিথি কক্ষের ভেতর অন্ধকারের ছায়া জমে ছিল। লিউ ঝান শুয়ে ছিল, তার শরীর পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যন্ত্রণা। তার বুকের পাশে গভীর ক্ষতরং ব্যাথা।সে কঠিনভাবে শ্বাস নিচ্ছিল।
হঠাৎ, দরজা খুলে ঢুকলো অ্যাকুয়ারা। তার চোখে ছিল চিন্তার ছাপ, তবে মুখে কোনো তীব্রতা ছিল না। সে চুপচাপ এসে লিউ ঝানের পাশে দাঁড়ালো। “আপনি কিছুদিন গোসল করতে পারবেন না,” অ্যাকুয়ারা বলল, তার সুরে কিছুটা সহানুভূতি মিশ্রিত ছিল, “আপনার শরীর মুছে দিতে হবে।”
লিউ ঝান মাথা তুলে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার বুকে তির লেগেছে, হাতে নয়”।
অ্যাকুয়ারা কিছুক্ষণ চুপ থেকে তার সামনে একটি বড় পানি ভর্তি পাত্র আর একটি টাওয়াল রেখে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে, তাহলে আপনি নিজেই করুন।” তারপর, এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে, সে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
লিউ ঝান কিছুটা হতবাক হয়ে গেল। তার চোখে একটু অভ্যস্ত না হওয়ার মতো ভাব ফুটে উঠল। একা একা তার মুখে এক ছোট্ট হাসি উঠে গেল, “মেয়েটা কি একটু পাগল টাইপের নাকি?”
তার চোখে কিছুটা বিরক্তি, আবার কিছুটা অবাক হওয়া ভাব ছিল, কিন্তু সে ভাবলো, হয়তো অ্যাকুয়ারা সবসময় একটু আলাদা ধরনের, একটু ব্যতিক্রমী।

দুপুরের রাজকীয় খাবারের আয়োজন সম্পন্ন। সোনালী রঙের কারুকার্য করা ডাইনিং টেবিলের চারপাশে বসেছে অতিথিরা—জেনথ ড্রাকোনিস আর তার পুত্রেরা, থারিনিয়াস, আলবিরা, ফ্লোরাস রাজ্যের রাজা জারেন, বড় রাজকুমারী লিয়ারা, ফিওনা, সিলভা আর—সবচেয়ে চমকপ্রদভাবে—অ্যালিসা।
অ্যালিসা আজ একটু বেশিই পরিপাটি। গাঢ় লাল রঙের একটি সিল্কের গাউনে তার উপস্থিতি ঝলসে দিচ্ছে চারপাশ। সে নিঃসঙ্কোচে জ্যাসপারের পাশে এসে বসল। ঠোঁটে খেলছিল এক রহস্যময় হাসি।
“প্রিন্স,”—সে বললো মৃদু গলায়—“আপনি তো এখন আমার বোনের হবু বর, মানে আপনি আমার বোন জামাই। তাহলে আমি তো ফ্লার্ট করতে পারি, তাই না?” এই বলে সে নিজে হাতে জ্যাসপারের প্লেটে এক চামচ খাবার তুলে দেয়ার চেষ্টা করলো।
জ্যাসপার হালকা ভ্রু কুঁচকে একরকম বিরক্তিভরে উঠে পাশের চেয়ার ছেড়ে ডাইনিং টেবিলের উল্টো দিকের এক চেয়ারে গিয়ে বসল।

আর সেখানেই ফিওনা ধপ করে এসে বসে পড়লো তার পাশে।
তার চোখে-মুখে স্পষ্ট এক অস্বস্তি। ঠোঁট চেপে ধরে কিছু বললো না, কিন্তু তার মুখের সেই লালচে ভাব, ভ্রু কুঁচকে যাওয়া আর চোখের কোণে হালকা রাগ—সবই বলে দিচ্ছিল সে কি অনুভব করছে।
পরক্ষণেই, সে চুপচাপ জ্যাসপারের প্লেটের দিকে এগিয়ে নিজের হাতে একটি কাঁটাচামচে খাবার তুলে তার মুখের কাছে ধরে বললো, “তুমি তো আমার প্রিন্স, তাই না? খাবার তো আমার হাত থেকেই খেতে হবে।”
জ্যাসপার হেসে চোখ নামিয়ে বললো,
“তুমি যদি এভাবে খাওয়াও, তাহলে প্রতিদিন খাবার সময় আমি শুধু তোমার পাশে বসে থাকতে চাই।”
অন্যদিকে, অ্যালিসা হালকা বিরক্তমাখা চোখে চেয়ে থাকলো
এথিরিয়ন তখন হালকা গলায় ফিসফিস করে থারিনিয়াসকে বললো,“এই দৃশ্যটা দেখে মনে হচ্ছে এখনই কেউ কাউকে টেবিলের নিচে লাথি মারবে।”
থারিনিয়াস হেসে বললো, “আমি তো মনে করি, যুদ্ধের থেকেও এই প্রেমের টানাটানিটা বেশি রোমাঞ্চকর।”

ডাইনিং হলটা মুখরিত ভোজন আর রাজকীয় আলাপনে। সার্ভেন্টরা ব্যস্ত, রাজারা গম্ভীর, আর যুবরাজ-যুবতীরা হাসিমুখে কথা বলছে। কিন্তু টেবিলের নিচে জমে উঠেছে এক অদৃশ্য উত্তাপ।
এথিরিয়ন তার পা ধীরে ধীরে বাড়িয়ে দেয় সিলভার পায়ের দিকে। প্রথমে হালকা স্পর্শে, এরপর একটুখানি ঘষে দেয় তার পায়ের পাতায়। সে জানে, কেউ কিছু দেখবে না—তবে সে দেখতে পায় সিলভার মুখের হালকা পরিবর্তন।
সিলভা চমকে উঠে সামান্য থেমে যায়। তার গালের কড়া রেখা কঠিন হয়ে ওঠে। সে কোনো কথা বলে না, কোনো শব্দ নয়—শুধু তার চোখ তীক্ষ্ণভাবে ছুঁড়ে দেয় এথিরিয়নের দিকে।

এথিরিয়নের ঠোঁটের কোণে একটুকু দুষ্টু হাসি খেলে যায়, কিন্তু সে থামে না। আবার স্পর্শ করে পায়ে। এবার সিলভা চেয়ারে সামান্য সোজা হয়ে বসে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলো।
সে চোখে চোখ রাখে এথিরিয়নের। সেই দৃষ্টিতে ধিক্কার, রাগ—তবে একফোঁটা কৌতূহলও লুকিয়ে আছে।
দু’জনের চোখে চোখ রেখে চলছে এক নিঃশব্দ যুদ্ধ। চারপাশের কেউ বুঝতে পারে না, তারা কেবল ভদ্রতায় খাবার খাচ্ছে মনে হয়। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে, টেবিলের নিচে চলেছে এমন এক খেলা, যেখানে শব্দের প্রয়োজন নেই—চোখই সব কথা বলে দিচ্ছে।
এথিরিয়ন ধীরে তার পা ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু তার দৃষ্টিতে সেই একই বার্তা: “খেলা তো এখনো শুরুই হয়নি…”
সিলভা চোখ সরিয়ে নেয়, কিন্তু তার নাকের ডগা লাল—রাগে, আর হয়তো একটু লজ্জায়ও।
ডাইনিং টেবিলে, সবাই সবার দিকেই নজর রাখছিল। তবে ফিওনা আর জ্যাসপার একে অপরের মধ্যে হারিয়ে গেছে। তারা একে অপরকে খাবার খাইয়ে দিচ্ছিল,মনে হচ্ছিলো তাদের আশেপাশের কেউ নেই শুধুমাত্র তারা দুজনেই আছে।

ফিওনা, একদিকে একটু জেলাসি দেখিয়ে, আরো বেশি করে খাবার খাইমে দিচ্ছিলো জ্যাসপারকে আর খুনসুটিতে মেতে ছিলো।যখন সে একটাবিশেষ আইটেম জ্যাসপারকে খাইয়ে দিলো,জ্যাসপার মুচকি হেসে বললো, “এটা তুমি কুক করেছো?”
ফিওনা তার চোখে হাসি নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, কেমন হয়েছে খেতে?”
জ্যাসপার ধীরে ধীরে এক টুকরো খাবার মুখে রেখে বলল, “ নিয়ে মুগ্ধভাবে উত্তর দেয়, “ইটস ডেলিশিয়াস, বাট নট মোর দ্যান ইউ।”
এ কথা শুনে, অপরপ্রান্তে বসে খাবার খেতে থাকা রাজা ড্রাকোনিসের মুখে একটু অস্বস্তি চলে আসে। তিনি একটু কেশে উঠলেন, তার চোখে ক্ষণিকের জন্য কিছু তিক্ততা ফুটে উঠেছিল। তবে তিনি চুপ করে থাকলেন শুধুমাত্র কিছুটা সংকোচ বোধ করেছিলেন।

এদিকে, লিয়ারা, ফিওনার মা, কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করে উঠে দাঁড়িয়ে টেবিল থেকে সরে যান। তিনি বুঝতে পারছিলেন, এই মুহূর্তের আবেগ কিছুটা অপ্রত্যাশিত হয়ে উঠছে আর সে নিজেকে সংযত করে নিতে চাইছিলেন।
ড্রাকোনিসের হালকা সংকেতে জ্যাসপার ফিওনা সম্বিত ফিরে পায়। জ্যাসপার নিজের দৃষ্টি সরিয়ে একটু দেখতে থাকে তার বাবার দিকে। তার চোখে ছিল এক ধরনের সতর্কতা, সে বুঝতে পারছিল তার বাবার মনোভাব। রাজা ড্রাকোনিসের দিকে তাকানোর পর, জ্যাসপার কিছুটা থেমে গিয়ে, কিছুটা নীরবতা বিরাজ করতে থাকে।
ফিওনা লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করে ফেলে, তার লজ্জায় আড়ষ্ট চোখগুলো কারো দিকে তাকাতে সাহস পাচ্ছিল না।

ডাইনিং টেবিলের চারপাশে অস্থিরতার কোমল ছায়া ছড়িয়ে পড়লো।সবার মুখে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, সময় নিজের গতিতে চলতে চলতে এক মুহূর্তের জন্য থেমে গিয়েছিল। ফিওনার হৃদয়ের গভীরে এক অনুক্ষণ,এক উত্তেজনা—তবে সে কিছুই বললো না, শুধুমাত্র তার অস্থির হৃদয়কে শান্ত করার চেষ্টা করছিল। তার চোখ একে একে সবার দিকে আবার জ্যাসপারের দিকে, তারপর তার প্লেটের দিকে নামিয়ে আসছিল।
তখন, জ্যাসপার উঠে দাঁড়াল, তার এক হাতে হাতে খাবারের প্লেট, আর চোখের দৃষ্টি সরাসরি ফিওনার দিকে। কোনো শব্দ ছাড়াই,সে তার হাত ধরল,কিছুই বলা হলো না, শুধু
মাত্র ফিওনার হাত ধরে ডাইনিং টেবিল ছেড়ে সোজা বারান্দার দিকে চলে গেল বারান্দায় এসে, জ্যাসপার ফিওনাকে এক কোণে দাড় করালৌ,তার হাতে খাবারের প্লেটটা তখন ও আছে,কিন্তু তার চোখ, তার সমস্ত মনোযোগ ছিল শুধুমাত্র ফিওনায়। ফিওনার স্নিগ্ধ হাসি, তার মৃদু নিঃশ্বাস, এক মুহূর্তে তাদের মধ্যে সব কিছু নিষ্কলুষ হয়ে গিয়েছিল।
জ্যাসপার ফিওনাকে তার প্লেটে থাকা খাবারের দিকে ইঙ্গিত করে বললো, “এবার আমাকে নিশ্চিন্তে খাওয়াও, ফিওনা।” ফিওনার চোখে একটু চমক, প্লেটে রাখা সসের দিকে ফিওনার দৃষ্টি চলে গেলো। টক সসটি এতটা তীব্র ছিল যে একে খাওয়া খুব সহজ ছিল না। সে মৃদু হেসে বললো, “চলো, একটা গেইম খেলি। তুমি যদি সত্যিই আমায় ভালোবেসে থাকো, তাহলে এই সসটা খালি খেয়ে দেখাও।”

ফিওনার কথায় একটু অবাক হলেও জ্যাসপারের চোখে একটা চাহনি ছিল—সে চ্যালেঞ্জ মেনে নিলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে নিজের প্লেটের দিকে তাকাল,যেখানে কিছু ঝাল কাঁচা মরিচ ছিল। তার মুখে মুচকি হাসি ফুটে ওঠে,আর সোজা ফিওনার দিকে তাকিয়ে বললো, “ওকে, তাহলে তুমি যদি আমাকে ভালোবাসো, তাহলে এইটা খেয়ে দেখাও।” সে কাঁচামরিচের দিকে ইঙ্গিত করলো, এটা তার নিজের দেয়া চ্যালেঞ্জ ছিল ফিওনার জন্য।
ফিওনা কিছুটা সঙ্কোচে, কিছুটা হাসিমুখে কাঁচামরিচটা হাতে তুলে নিয়ে বললো, “আচ্ছা, তাহলে দেখাও তোমার ভালোবাসা আর আমিও দেখাবো।”

ফিওনা প্লেট থেকে টক সসটা তুলে সোজা জ্যাসপারের সামনে এগিয়ে দিলো। জ্যাসপার দানার মতো সস এক দমে খেয়ে ফেললো। কিন্তু পরের মুহূর্তেই জ্যাসপারের মুখে কেমন অদ্ভুত এক কুঁচকানি দেখা গেলো। তার চোখে একটু অবাক হওয়া, আর তীব্র টকতার জন্য একেবারে মুখটি সঙ্কুচিত হয়ে গেলো।
এদিকে ফিওনা, ঝাল কাঁচামরিচটি হাতে তুলে নিয়ে, নিজের চোখে অস্থিরতা লুকাতে পারলো না। মুচকি হাসি দিয়ে সে সে কাঁচামরিচে কামড় বসিয়ে দিলো। কিন্তু ঝালের তীব্রতা তাকে একদম অস্থির করে তুললো। মুখে তীব্র ঝাল আগুনের মতো দাউ দাউ করে জ্বলছিল। সে দ্রুত একটু জল খেতে চেষ্টা করলো, কিন্তু ঝালের তাপ ছিল অবিশ্বাস্য। তবে, হাসি না ধরে থাকতে পারলো না,আর দুজনেই একে অপরকে দেখে কাঁচামরিচের ঝাল আর টক সসের পরিণাম নিয়ে একে অপরের হাসির সঙ্গে মুহূর্তটিকে আরো উজ্জ্বল করে তুললো।
ফিওনা তখন ঝালের তীব্রতায় অস্থির হয়ে পড়েছে, আর জ্যাসপার নিজের প্লেটটা পাশের টেবিলে রেখে ফিওনার দিকে হালকা ঝুঁকে এসে বললো, “অনেক বেশি ঝাল লাগছে… আসো, মিষ্টি দিয়ে দেই।” এটা বলেই জ্যাসপার ফিওনাকে চুমু দিতে যাচ্ছিল,ঝালের তীব্রতা কমিয়ে দেয়ার জন্য।

কিন্তু হঠাৎই লিয়ারা, যিনি দূর থেকে এই দৃশ্য দেখছিলেন, তার দৃষ্টি ফেলে দিয়ে তিনি পলকে একটি ফ্লাওয়ার ভাস ফেলে দিলেন ফ্লোরে।ফ্লাওয়ার ভাসের টুকরোগুলো মেঝে থেকে ছড়িয়ে পড়ল আর ফিওনা এক মুহূর্তে চমকে উঠে পেছনে ফিরে গেলো।তার মধ্যে অস্বস্তি গাঢ় হয়ে উঠলো।
জ্যাসপার, এই অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণে বিরক্ত হয়ে তার কণ্ঠে রুক্ষতাও ফুটে উঠলো।সে ঘাড় ঘুরিয়ে একটু তীক্ষ্ণভাবে বললো, “মনে হচ্ছে, এটা শশুরেরপ্রাসাদ না, কাবাব মে হাড্ডি প্রাসাদ।” তার কথায় তিক্ততা ছিলো তার কাছে মনে হলো সমস্ত পরিস্থিতির পেছনে কোনো অদৃশ্য নাটক চলছে, যা তাকে অসন্তুষ্ট করছে।
জ্যাসপার তখন এক মুহূর্তের জন্য নীরব হয়ে গেলো, তার চোখে এক গভীর ভাবনা। তারপর, তার কণ্ঠে তীক্ষ্ণ মনোভাব ফুটে উঠে, “একবার তোমাকে এল্ড্র প্রাসাদে নিয়ে যাই,আর জীবনে আর কখনো এই প্রাসাদে পা রাখতে দিব না।”
তার মুখে কঠিন এক গভীরতা ছিল,তার হৃদয়ের অন্ধকার কোণে লুকানো কোনো কথা সে এবার বাইরে এনে ফেললো।

ফিওনার মুখে এক চরম আভাস, সে বুঝতে পেরেছিলো জ্যাসপার রেগে আছে, কিন্তু তার রাগের মধ্যেও এক অদ্ভুত স্নেহ ছিল।ফিওনার মনটা কিছুটা চঞ্চল হয়ে উঠল, কিন্তু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পরিবর্তে সে এক ঝলক সিদ্ধান্ত নিলো। এক মুহূর্তে, সে জ্যাসপারের সামনে এগিয়ে গেলো, তার চোখে শান্ত কিন্তু গভীর এক ইচ্ছা জাগলো।
ধীরে ধীরে সে তার হাতটি সামনে বাড়াল, আর তার চমৎকার গোলাপী আঙুলগুলি জ্যাসপারের গালের উপর রাখলো। ফিওনার মুখে এক হালকা হাসি ফুটে উঠলো, সে বুঝে ফেলেছে, এই ছোট্ট আচরণ জ্যাসপারের রাগ কমানোর জন্য যথেষ্ট হতে পারে।
তারপর, এক চমক দিয়ে ফিওনা জ্যাসপারের গালে একটা চুমু দিয়ে দিলো, একদম নরম, অতি কোমলভাবে, চুমুর স্পর্শের সঙ্গে, পুরো বারান্দায় এক মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এলো। জ্যাসপার তার উচ্চতা,শক্তি আর অহংকারের মহিমায় দাড়িয়ে ছিল পর্বতশৃঙ্গ মতো।

ফিওনাকে পা উঁচু করতে হলো,কারণ তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ৬ ফুট ২ ইঞ্চির ড্রাগন প্রিন্সের তুলনায় সে ছিল অনেক ছোট এক হামিংবার্ডের মতোই।
জ্যাসপার অস্থিরভাবে শ্বাস ফেললো,কিছুটা হতভম্ব গেলো, কিন্তু তারপর তার চোখের কোণে যে সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠলো, তা ছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তির প্রতীক।
ফিওনা তখন তার গাল টেনে, মুখে একটি মিষ্টি হাসি রেখে, বললো, “এবার তোমার রাগ কমেছে ফায়ার মনস্টারটার।”

প্রাসাদের বিশাল হলরুমে সকলের সামনে যখন গম্ভীর পরিবেশ বিরাজ করছিল, তখন রাজা ড্রাকোনিস এক মুহূর্তে গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “ফিওনা আর আমার পুত্র জ্যাসপার—আজকের দিন থেকে নিজেদের জীবনের নতুন পথযাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে।তাদের একে অপরকে ভালোবাসার অঙ্গীকারের পর, আমি ঘোষণা করছি,তাদের এনগেজমেন্টের দিন ঠিক করা হয়েছে।”
ফিওনা আর জ্যাসপার একে অপরকে ধীরে ধীরে তাকিয়ে দেখলো। তাদের চোখে ছিল নিশ্চিত ভালোবাসার এক গভীরতা, আর হৃদয়ে এক অদৃশ্য সুর যে তাদের জীবনের নতুন অধ্যায়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।ফিওনার মুখে এক মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো,সে অনুভব করলো যে জীবনের এই পরিবর্তনটি তার জন্য এক নতুন উপহার হতে চলেছে।

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৩০

রাজা ড্রাকোনিস আবার বললেন, “এনগেজমেন্টের দিন হবে আগামী ১১ তারিখ।”
তারপর, একে অপরের হাত ধরেই, তারা সেই মুহূর্তে এক অদৃশ্য প্রতিজ্ঞা করল, যে তারা এই পথ একসাথে চলবে, সমস্ত বাধা-বিপত্তির মধ্যেও। এই ঘোষণা সবার সামনে করা হলেও, ফিওনা আর জ্যাসপার নিজেদের মধ্যে একমাত্র তারা দুইজনের অনুভূতি ভাগ করে নিচ্ছিলো। তাদের চোখে এক আশার ঝিলিক, এক নতুন শুরুর স্বপ্ন।

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৩২