আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৩২

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৩২
সাবিলা সাবি

আকাশ নীলের গায়ে আজ গর্বের মুকুট—ফ্লোরাস রাজ্যে আজ ড্রাগন প্রিন্স জ্যাসপার অরিজিন ও রাজকুমারী এলিসন ফিওনার এনগেজমেন্ট।
ভেনাসের এল্ড্র প্রাসাদ থেকে আগত এই প্রিন্সকে ঘিরে সজ্জিত হয়েছে এক অনন্যতা—যা শুধু ঐতিহ্যে নয়, পোশাকের ঐশ্বর্যেও মুগ্ধ করছে সকলকে।
আজকের ফ্লোরাস রাজপ্রাসাদ পরিণত হয়েছে এক রূপকথার পর্বতচূড়ায় বসবাসকারী দেবরাজ্যের প্রাসাদে। চারদিক ঝলমল করছে সোনালি আলোয়। প্রবেশপথের দুই পাশে স্থাপিত হয়েছে মার্বেলের দুটি বিশাল ড্রাগনের মূর্তি—একটি রৌপ্য আর অন্যটি অগ্নিরঙা, তাদের চোখে বসানো ছিল ছোট ছোট রত্ন যা সূর্যের আলোতে ঝিকমিক করে উঠছিল।
প্রাসাদের বড় হলঘরটিকে সাজানো হয়েছে এল্ড্র প্রাসাদ থেকে আনা কৃত্রিম তারামালায়। ছাদের নিচে ঝুলছে হাজারো তারার মতো জ্বলজ্বলে বাতি, যেগুলো এক বিশেষ প্রযুক্তিতে ভেনাস থেকে তৈরি। মেঝেতে ছিল নরম সাদা কাশ্মীরি কার্পেট, তার ওপর বোনা ড্রাগনের প্রতীক।

দেয়ালে ঝুলছিলো স্বর্ণালংকৃত পর্দা, যার আঁচলে সূচীকর্মে লেখা ছিল ফ্লোরাস রাজবংশের শ্লোক। ফুলের তোড়া সাজানো হয়েছিল লাল গোলাপ, হোয়াইট পিওনি আর কিছু অজানা নীল ফুলে, যেগুলো পৃথিবীতে নেই—এগুলো ছিল ভেনাসে থেকে পাঠানো সুগন্ধ ছিল নরম জাদুর মতো।
ফিওনা পরেছে এক ঝলমলে গোলাপি আর সাদা রঙের লেয়ারড গাউন,যার ফ্রিলগুলো ফুলের পাপড়ির মতো চারপাশে ছড়িয়ে। কোমরে রাজ পরিবারের প্রতীক খচিত একটি সিলভার বেল্ট, আর ঘাড়ে বসানো ক্রিস্টাল ও মুক্তার কাঁথার মালাটা তার রাজকীয় রূপকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে। চুলে গাঁথা ছিল সাদা গোলাপ আর তারার আকারে সজ্জিত হেয়ারপিন—ভেনাসের এক খণ্ড আকাশ নেমে এসেছে তার কপালে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জ্যাসপার পরেছে একটি হালকা সিলভার ব্লু রঙের রক্তচন্দনের গন্ধমাখা লং কোর্ট, যার কাঁধে ছিল ড্রাগনের আঁকা। বুকের উপর হালকা ব্ল্যাক এম্ব্রয়ডারি, আর কোমরে ছিল হীরকখচিত এক বিশেষ তলোয়ার—যেটি কেবল এল্ড্র রাজপরিবারের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীই পরিধান করে। তার চোখে ছিল ঠান্ডা কিন্তু গভীর দৃষ্টি।
অ্যকুয়ারা পরে ছিল এক নীল রঙের লেয়ারড গাউন,যার নিচে ছিল সাগরের ঢেউয়ের মতো চলমান ডিজাইন। কোমরে ছিল মুক্তার বেল্ট আর কানে ছোট ছোট ঝুমকা—একটা নকশা যা কেবল সমুদ্রের রাজকুমারীরাই ধারণ করে।
সিলভা পরেছে হালকা সবুজ আর সোনালি মেশানো ফ্লেয়ারড গাউন,তার লম্বা চুল খোলা আর পেছনে এক পাখার মতো সিলভার অ্যাকসেসরি—যা তাকে এক রহস্যময় পরির মতো লাগছিল।
অ্যালিসা পরে ছিল ডিপ মারুন রঙের রেশমি গাউন, গলায় হালকা রুবি পাথরের নেকলেস, আর ঠোঁটে ক্লাসিক রেড লিপস্টিক। তার মধ্যে ছিল এক অভিজাত, সংযত সৌন্দর্য।

এথিরিয়ন পরে ছিল ব্ল্যাক আর গ্রে রঙের ড্রাগন জ্যাকেট, হাতের রিস্টব্যান্ডে ছিল আগুনের সিম্বল। তার দৃষ্টি ছিল তীক্ষ্ণ, আর সিলভার দিকে মাঝে মাঝেই ছুঁয়ে যাচ্ছিল তার চোখ।
থারিনিয়াস হালকা সোনালি ধূসর রঙের চাইনিজ-স্টাইল লং কোট, কোমরে বাঁধা ছিল লাল রেশমি কাপড়, আর হাতে ছিল এক ঐতিহাসিক দস্তানা—যেটা কেবল এল্ড্র যোদ্ধারাই পরে।
আলবিরা সাদা আর ল্যাভেন্ডার রঙের গাউন, যার নিচে ছিল ক্রিস্টাল জড়ানো নকশা। তার কাঁধে ঝুলছিল এক শাল, যার কিনারা দিয়ে ড্রাগনের পাখার ছাপ আঁকা ছিল।

স্টেজটি তৈরি করা হয়েছিল এক বিশাল স্ফটিক খণ্ডের ওপরে। নিচ থেকে আলো উঠছিল পুরো স্টেজ জ্যোতির্ময়। পেছনে ছিল এক ড্রাগনের খোলা ডানা আর পাশ দিয়ে প্রবাহিত হালকা কুয়াশা—একটি ম্যাজিকাল ডিভাইস থেকে নির্গত যা মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে নিচ্ছিল রঙ।

স্টেজের মাঝে বসানো ছিল একটি গোল্ডেন ট্রে, যেখানে রাখা ছিল ভেনাসের সবচেয়ে দামী পাথর বসানো আংটি—”অ্যাস্ট্রাল ফায়ারস্টোন” এই পাথর পৃথিবীতে নেই, তবে যদি থাকত, তাহলে এর মূল্য হতো প্রায় ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, কারণ এটি শুধু সৌন্দর্যেই নয়, শক্তি-উৎপন্ন ক্ষমতায়ও অতুলনীয়। পাথরটি ছিল গাঢ় লাল আর সোনার মাঝে এক অপার্থিব দীপ্তিতে জ্বলজ্বল করা এক নিঃশব্দ আগুনের শিখার মতো।
ফিওনার আংটিটা পাতলা প্লাটিনামের ওপর বসানো একটি বড় ফায়ারস্টোন যার চারপাশে ছিল ছোট ছোট তারা পাথর।
জ্যাসপারের আংটি ছিলো মোটা কালো ম্যাট প্লাটিনাম ব্যান্ড, যার মাঝে অগ্নিসংকেতের মতো আঁকা একটি লালচে দীপ্তিময় ফায়ারস্টোন।
স্টেজের দুই পাশে দাঁড়িয়ে ছিল এল্ড্র ও ফ্লোরাস রাজপরিবারের সদস্যরা।ৎবায়ুতে সুগন্ধী,বাদ্যযন্ত্রের সুর আর সবার মুখে এক অপার্থিব প্রত্যাশা—সবকিছু মিলিয়ে সেই মুহূর্তটি চিরন্তন হয়ে উঠেছিল।

হলঘরের আলো একটু নিভু নিভু হয়ে এলো। চারদিকে জমাট বাঁধলো নিস্তব্ধতা। শুধু বাজছিল এক মৃদু ঐশ্বরিক সুর— দূর কোনো গ্রহ থেকে বয়ে আসা সুরভিত বাতাসের মতো।
স্টেজের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে জ্যাসপার—হালকা সিলভার ব্লু স্যুটের ভিতর দপদপ করে জ্বলছে তার আগুনি হৃদয় চোখে তীব্র কোমলতা। পাশে সাদা-গোলাপী গাউন পরে দাঁড়িয়ে ফিওনা, মাথার ওপরে ঝুলছে ছোট ছোট তারা সদৃশ ঝাড়বাতি, তার চোখে একসাথে স্বপ্ন আর অভিমান আর ঠোঁটে এক ম্লান মধুর হাসি।
রাজা ড্রাকোনিস নিজের চিরচেনা গাম্ভীর্যে সামনের সারিতে বসে আছেন, চোখের কোণায় আবেগের একটুকরো স্নেহ।রাজা জারেন,ফ্লোরাস রাজ্যের মহান অধিপতি, হাতে একটি বিশুদ্ধ স্ফটিকের পদক ধরে আছেন, যা এনগেজমেন্ট সাক্ষ্য হিসেবে ফ্লোরাস প্রথায় প্রদান করা হয়। আর লিয়ারা—মেয়েকে সোনার মত জড়িয়ে রেখেছেন হৃদয়ে, চোখে জল কিন্তু মুখে গর্বিত প্রশান্তি।
এক সোনালি প্লেট এক ড্রাগন সেনা এগিয়ে দিলো। প্লেটে রাখা দু’টি আংটি যেন দু’টি ছোট্ট গ্রহ—প্রতিটির মাঝে মিশে আছে অজানা গ্রহের ধ্বনি।

জ্যাসপার ফিওনার হাত তুললো নিজের হাতে। তার দীর্ঘ আঙুলে ফিওনার হাত এক ছোট পাখির ডানার মতো। ধীরকন্ঠে বললো “আমি,এল্ড্র রাজ্যের প্রিন্স জ্যাসপার অরিজিন, তোমার হাতে এই আংটি পরিয়ে দিচ্ছি। এই আগুন শুধু পাথরের না—এই আগুন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে জন্ম নেওয়া প্রতিজ্ঞার প্রতীক।” সে আংটি পরিয়ে দিলো ফিওনার অনামিকায়।
এরপর ফিওনা ধীরে হাত বাড়ালো, তার সমস্ত দ্বিধা, অভিমান, ভালোবাসা আর বিশ্বাস মিলেমিশে একটি স্পর্শ হয়ে উঠেছে। জ্যাসপারের আঙুলে আংটি পরিয়ে বললো “আমি, এলিসন ফিওনা, তোমাকে এই আংটি পরিয়ে দিচ্ছি—আমার আস্থা, ভালোবাসা, আর ভবিষ্যতের প্রতিটা শ্বাসের প্রতীকস্বরূপ।”
প্রেক্ষাপট তখন হঠাৎ ভরে উঠলো এক নরম আলোর ঢেউয়ে। ছাদ থেকে রূপালি পাপড়ি ঝরতে লাগলো, মহাকাশের তারা নেমে এসেছে তাদের আশীর্বাদ জানাতে। দূরে বাজতে লাগলো ফ্লোরাস ঐতিহ্যবাহী বাঁশির সুর, যা কেবল রাজবংশের মিলনেই শোনা যায়।
রাজা ড্রাকোনিস চোখ মুছলেন চুপিচুপি। লিয়ারা ফিসফিস করে বললেন, “আমার ছোট্ট ফিওনার বিয়ে হয়ে গেলো।” রাজা জারেন মাথা নত করে বললেন, “আজ ইতিহাস রচিত হলো, দুই জগৎ এক হলো।”
এই ছিল সেই মুহূর্ত—যেখানে একটি আংটি শুধু ধাতু বা পাথর ছিল না, ছিল দুইটি ভিন্ন রাজ্যের, দুইটি হৃদয়ের, দুইটি জীবনের চিরন্তন মিলনের সীমানা।

আঙটি বদলের পরে চারদিক একটু থেমে গেল। মুহূর্তটা কেমন শান্ত,গম্ভীর আর আবেগমথিত। তারপর হঠাৎ করে রাজপ্রাসাদের ছাদজুড়ে ছড়িয়ে পড়লো সোনালি আতশবাজি—একটি নয়, দুইটি নয়, পুরো সাত রঙের শিখা একসাথে আকাশ ছুঁয়ে ছড়িয়ে পড়লো।মনে হচ্ছে অলৌকিক কোনো নক্ষত্ররাজি তাদের আশীর্বাদ জানাতে নেমে এসেছে।
সিলভা— এগিয়ে এসে বললো “ব্রাদার-ইন-ল আপনি শুধু আমাদের রাজ্যের নয়,ফ্লোরাসের হৃদয় জিতে নিয়েছেন আজ। ফিওনা হচ্ছে আমাদের তারার রাণী ওকে সবসময় ভালো রাখবেন।”
অ্যাকুয়ারা নীলরঙা গাউনের আঁচল সামলে, ফিওনার দিকে এগিয়ে এলো। “তুমি তো প্রিন্সকে একবারে বদলে দিয়েছো, ফিওনা। আগুনের ড্রাগনকে কেমন কোমল করে তুলেছো! ভালোবাসা বড় জাদুকর।”
থারিনিয়াস আর আলবিরা একসাথে বললো,
“আজ থেকে আপনারা শুধু রাজবংশের উত্তরাধিকারী নন, বরং এই দুই জগতের মৈত্রীর প্রতীক। আপানাদের ভালোবাসাই ভবিষ্যতের আলো।”

এথিরিয়ন তার ক্লাসিক ঠান্ডা ভঙ্গিমায় ফিসফিস করে বললো,“ভালোবাসা সহজ না। কিন্তু আজ তোমরা যা করেছো, তা চিরস্মরণীয় হবে।”
এদিকে জ্যাসপার ফিওনার কানে ধীরে ধীরে বললো—
“চলো, একটু দূরে যাই। এতো মানুষের মাঝে তোমার চোখে হারিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না।”
সে ফিওনার হাত ধরে নিয়ে গেলো রাজপ্রাসাদের এক নির্জন বারান্দায়। দূর থেকে আতশবাজির আলো পড়ছে তাদের মুখে। ফিওনার চোখে জল, কিন্তু ঠোঁটে সেই চেনা জেদি হাসি।
জ্যাসপার বললো—“তুমি জানো, এই আঙটির পাথরটা—ভেনাসের ‘লুমেনস্টার’। এটা এক লক্ষ বছর পরে একবার জ্বলে ওঠে পাহাড়ের অভ্যন্তরে। পৃথিবীর কেউ এটা আনতে গেলেই তাপেই সব গলে যাবে। আমার বাবা এটাকে তরল অবস্থায় ছাঁকা দিয়ে পাথর করেছেন। পৃথিবীতে এর দাম প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার… কিন্তু তোমার আঙুলে এটা এক ফোঁটা ভালোবাসার মতোই হালকা মনে হচ্ছে।”
ফিওনা মুচকি হেসে বললো—
“আমি তো চিরকালের জন্য এই লুমেনস্টার চুরি করে নিয়েছি তবে যেটা সবচেয়ে বেশি দামি জিনিস সেটা তো আমি ভেনাসের প্রিন্স আর আমি তো তাকেই চুরি করে নিয়েছি।”
জ্যাসপার হেসে তার কপালে একটি চুমু এঁকে দিলো।
আর আকাশে তখন নতুন করে জ্বলে উঠলো একটা শব্দ— আতশবাজির রঙে রঙে ভেসে উঠলো ফ্লোরাসের আকাশে।

এনগেজমেন্টটা শেষ। রাজপ্রাসাদ ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ। অতিথিরা ফিরে গেছে। ঝলমলে হলঘরের আলো নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন শুধু রাজপরিবার ও ঘনিষ্ঠজনেরা প্রাসাদে।
ফিওনা আর জ্যাসপার একসাথে হেসে হেসে নিজেরা কথা বলছিলো, হাতধরা অবস্থায় প্রাসাদের করিডোর ধরে হাঁটছিলো নিজেদের কক্ষের দিকে। ঠিক তখনই সামনে এসে দাঁড়ালেন লিয়ারা, রাজকীয় পোশাকে কিন্তু মুখে তার পরিচিত কঠিন-মায়াবী অভিব্যক্তি।
লিয়ারা হালকা কাশলেন,“একটু কথা বলবো আমি আমার মেয়ে আর হবু জামাইয়ের সাথে।”
ফিওনা আর জ্যাসপার দুজনেই একটু সোজা হয়ে দাঁড়াল।
লিয়ারা দৃঢ় গলায় বললেন, “আজ এনগেজমেন্ট হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এখনো বিয়ে হয়নি। তাই বিয়ের আগপর্যন্ত তোমরা দুজন আলাদা কক্ষে থাকবে। একসাথে থাকা চলবে না।”
ফিওনা চোখ বড় করে বললো, “মা! আমি তো এখন প্রায় প্রিন্সের বউ! আর কক্ষ আলাদা করে কী লাভ?”
লিয়ারা চোখ সরু করে বললেন, “তুমি জানো না ও কেমন? বিয়ের আগে যদি কিছু… অতিরিক্ত হয়ে যায়, তাহলে আমি কিন্তু রেগে যাবো, দেবতা আভ্রাহারের আদেশ আছে ভেনাসের নিয়মে বিয়ের আগে একসাথে থাকা চলবেনা।”
জ্যাসপার মুচকি হেসে বললো,

“আমি চেষ্টা করবো,মাদার-ইন-ল।”
লিয়ারা তখন ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “তুমি চেষ্টা করবে না,তুমি করবে। আমি নিজে তোমাদের রুম আলাদা করে দিয়ে যাচ্ছি। একটাতে থাকবে ফিওনা, আরেকটাতে তুমি।”
জ্যাসপার মুখে কৃত্রিম কষ্টের ছায়া এনে ফিওনার দিকে তাকিয়ে বললো, “তোমার মায়ের মনটা পাথর দিয়ে তৈরি বুঝলে?”
ফিওনা ফিসফিস করে বললো,“তুমি জানো না মা আমার বিষয়ে কেমন সেন্সিটিভ থাকে।”
লিয়ারা দূর থেকে শুনে বললেন, “আমি কিন্তু এখনও শুনতে পাই, হিয়ারিং ফাংশনাল এখনো একদম ঠিকঠাক আছে আমার।”
ফিওনা হেসে ফেললো তবে জ্যাসপারের মুখে এখনও একটু কষ্টের ছায়া—আজকের রাতটা ফিওনার পেছনে ঘুম না-ই হোক,ফিওনার পাশেই থাকতে চেয়েছিল সে।
কিন্তু আজকের জন্য লিয়ারা জিতলেন।

প্রাসাদের রাজকীয় ভোজ শেষে ধীরে ধীরে অতিথিরা যার যার কক্ষে চলে যাচ্ছে। হলঘর এখন তুলনামূলক শান্ত, তবে ঝুলন্ত ঝাড়বাতির নিচে কয়েকটি ছোট গোল টেবিলে রাখা আছে স্ফটিকের গ্লাসে লাল ওয়াইন। সেই গ্লাসগুলো হাত ঘুরে ঘুরে পৌঁছে যাচ্ছে রাজ্যের কনিষ্ঠ সদস্যদের হাতে—তারা একে অপরকে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে, অনেকটা আনুষ্ঠানিক অথচ বন্ধুত্বপূর্ণ।
জ্যাসপার তখন এক কোণে দাঁড়িয়ে, এক হাতে তার নিজের গ্লাসটি ধরে আছে, চোখ হারিয়ে গেছে কোনো দূর আকাশে। ব্যালকনির পাশের খোলা জানালা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া এসে তার লম্বা, ঢেউ খেলানো কোট ছুঁয়ে যাচ্ছে। তাকে দেখতে কোনও প্রাচীন শিল্পীর আঁকা ক্যানভাস থেকে উঠে আসা কেউ—শান্ত, অপ্রতিরোধ্য, আর ভেতরে লুকানো কোনো ঝড়ের মতো লাগছে।

ঠিক সেই সময়ে, অ্যালিসা ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে এলো। গায়ে সেই মেরুন রঙের সিল্কের গাউন, ঠোঁটে তীব্র লাল লিপস্টিক। তার চোখে স্পষ্ট, কথার চেয়ে বেশি কিছু বলার আকাঙ্ক্ষা।
“প্রিন্স,” মৃদু কণ্ঠে ডেকেই সে হঠাৎ কার্পেটের ঢেউয়ে হোঁচট খেল— সেকেন্ড খানেকের মধ্যে সে সরাসরি এসে পড়লো জ্যাসপারের বুকের ওপর। কিন্তু জ্যাসপার কোনও হাত বাড়িয়ে ধরলো না। সে কেবল এক চিলতে বিস্ময় নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো,শরীর কিছু না করলেও মন মুহূর্তের মধ্যেই অনেক কিছু বুঝে ফেলেছে।
অ্যালিসা তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ালো, কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে। তার গাঢ় লিপস্টিকের দাগ লেগে গেছে জ্যাসপারের কোটের ভেতরের সাদা শার্টে—হৃদয়ের একেবারে বাম পাশে।
ঠিক তখনই—
ফিওনা প্রাসাদের দ্বিতীয় তলার মার্বেল সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল। তার চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়ালো। এক পলকেই সে দেখতে পেলো সবকিছু।
চোখে জল আসেনি, তবুও সেই চোখের চাহনিতে এমন কিছু ছিলো, যা বুক কাঁপিয়ে দেয়। সে সিঁড়ির পাশের মর্মর পাথরের রেল ধরে থেমে গেলো। গাল শক্ত হয়ে উঠলো, চোখ নেমে এলো ঠান্ডা হয়ে। তার এক হাতে ধরা ছিলো গাউন সামলানোর কুচি, অন্য হাতে সে সিরির ধাতব হাতল চেপে ধরলো—এমন করে মনে হচেছ তা না ভাঙলেও অন্তত কাঁপিয়ে দেবে।

জ্যাসপার চোখ তুলে দেখলো তাকে।
এক মুহূর্ত—শুধু একটিই মুহূর্ত—দুই জগতের আলো মুখোমুখি দাঁড়ালো।
তারপর জ্যাসপার ধীরে ধাপে এগিয়ে যেতে লাগলো ফিওনার দিকে। চারপাশে কাচের মতো টলোমলো নীরবতা। আতশবাজির উৎসবের রঙ মুছে গেছে এখন, আসছে এক নতুন রাতের সূচনা।
জ্যাসপার সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই ফিওনা তার হাতে এক ঝটকায় টান দিলো। একটাও শব্দ না করে, কেবল চোখের ইশারায় সে তাকে নিয়ে চললো দ্বিতীয় তলার নির্জন করিডরের এক কোণায়। সেখানে বিশাল মার্বেল পিলারের পাশে এসে দাঁড়ালো—যেখানে আলো কম, আর রাজকীয় গম্ভীরতা চারদিক থেকে চুপ করে তাকিয়ে আছে।
জ্যাসপার থেমে দাঁড়ালো। তার চোখে বিস্ময় আর উদ্বেগ, কিন্তু ফিওনার চাহনি তাকে নিঃশব্দে বলে দিচ্ছে—আজকের রাত্রি শুধু এক উৎসব নয়, এক পরীক্ষাও।
“ফিওনা…” জ্যাসপার ফিসফিস করে বললো, হাতটা তুলে তার মুখ ছুঁতে চাইল।
কিন্তু ফিওনার দৃষ্টি তখনও তার শার্টের দিকে।
জ্যাসপার ঠিক বুঝে গেলো—সে কী দেখেছে।
এক পলকের জন্য চোখ বুজে ফেললো সে। কিছু বলার আগেই, ফিওনার নরম অথচ দৃঢ় হাত উঠে এলো তার কাঁধে—এক ঝটকায় তার রাজকীয় কোট খুলে ফেললো।
জ্যাসপার এক চুল সরলো না, শুধু তার চোখ বড় হয়ে গেলো অবাক হয়ে। “ফিওনা…” সে আবার বলার চেষ্টা করলো।

কিন্তু ফিওনা তখন আগুনে রূপ নিয়েছে—চোখে বেদনা, ঠোঁটে একধরনের বিজয়।
এক টানে বুকের কাছ থেকে ছিঁড়ে ফেললো তার শার্ট—স্ন্যাপ!
জ্যাসপার হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, একবার তার ছেঁড়া শার্টের দিকে, একবার ফিওনার চোখে।
ফিওনা এক ধাপ এগিয়ে এলো, একেবারে কাছে। তারপর ধীরে মাথা ঝুকিয়ে—জ্যাসপারের খোলা বাম বুকে এক গাঢ়, লিপস্টিকের চুমু আঁকলো।
একটা ঠোঁটের দাগ, একধরনের অধিকার, জ্যাসপারের মালিকানা।
আর শুধু চুমু নয়… তার ঠোঁট সরেইনি এখনও… হঠাৎ ফিওনার দাঁত একটুখানি চেপে ধরলো জ্যাসপারের ত্বক—একটা নরম কিন্তু দাবি জানানো কামড়।
জ্যাসপার নিশ্বাস আটকে ফেললো, বুকের গভীর থেকে উঠলো চাপা এক দীর্ঘ শ্বাস।
ফিওনা আস্তে বললো, চোখে ঝলসানো আগুন—
“ওর লিপস্টিকের চিহ্ন ছিলো তোমার শার্টে তাই ওটাকেই ছিঁড়ে দিলাম, আর একবারে আসল জায়গায় আমার লিপস্টিকের চিহ্ন দিয়ে দিলাম…”
জ্যাসপারের বুক তখনও জ্বলছে ফিওনার চুমু আর কামড়ের পরশে। চোখে আগুন, কিন্তু ঠোঁটে এক ধরনের অসহায় মুগ্ধতা।

সে নিচে তাকিয়ে নিজের ছেঁড়া শার্টের দিকে চাইল, তারপর ফিওনার চোখে।
“ফিওনা… আমি এই অবস্থায় নিচে যাবো কীভাবে?”—তার গলায় ছিল এক চিমটি খুশি, এক চিমটি লজ্জা।
ফিওনা ঠোঁট চেপে ধরলো নিজের। তারপর এক পাশে থাকা মণিময় দরজার দিকে ইঙ্গিত করে বললো—
“ওই ঘরে আমাদের বিয়ের সব পোশাক রাখা আছে, প্রিন্স। আজকের রাত শুধু এনগেজমেন্ট নয়, তোমার লুকও পাল্টাবে। আরেকটা পরে এসো, এখনো অনেক কিছু বাকি…”
জ্যাসপার একবার সেই ঘরের দিকে তাকালো, তারপর ফিওনার দিকে।
“তুমি কি সবসময় এমনই থেকো,হামিংবার্ড?” তার কণ্ঠে ছিল ভরা ভালোবাসা আর মাথা নত করার এক মিষ্টি সুখ।
ফিওনা কিছু বললো না, শুধু চোখ টিপে একটা উড়ন্ত চুমু ছুঁড়ে দিলো তার দিকে।
আর জ্যাসপার দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ভেবে নিল—এই মেয়ের কাছে থাকলে সব যুদ্ধই মিষ্টি!

রাজপ্রাসাদের এক কোণ তখন উৎসবমুখর, সিলভা তার ড্রাগন বান্ধবীদের নিয়ে হেসে খেলে আড্ডায় মেতেছিলো। ক্যালিক্সও ছিলো সেখানে—চিরচেনা সৌন্দর্য আর কথার খেলায় মোহিত করার মতো। সিলভা হাসছিলো, কথা বলছিলো, মাঝে মাঝে ক্যালিক্সের দিকে ঝুঁকে কানে কিছু বলছিলো।
দূর থেকে এথিরিয়নের চোখ ঠিক সেখানেই আটকে ছিলো। ঠোঁটের কোণে রাগের আঁচ,চোখে আগুনের মতো ঈর্ষা। হঠাৎ সে এগিয়ে এসে কারো কিছু বোঝার আগেই সিলভার কব্জি চেপে ধরলো।
“চলো আমার সাথে,” কণ্ঠে ছিলো নিঃশব্দ ঝড়ের পূর্বাভাস।
সবার সামনে দিয়েই এথিরিয়ন সিলভাকে টেনে নিয়ে গেলো রাজপ্রাসাদের উপরের একটি নির্জন বারান্দায়। চারপাশে অন্ধকার, শুধুমাত্র চাঁদের আলো এসে পড়ছিলো সিলভার মুখে।

“তুমি পাগল নাকি রিয়ন?” সিলভা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো, “এইভাবে টেনে আনলে কেন?”
এথিরিয়নের চোখ তখনো লাল। এক মুহূর্তের জন্য কোনো উত্তর না দিয়ে, সে তার দু’হাত দিয়ে সিলভার মুখ চেপে ধরলো। তারপর এক হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়া আগুনের মতো তার ঠোঁট সিলভার ঠোঁটে বসিয়ে দিলো।
এটা কোনো কোমল চুমু ছিলো না—এটা ছিলো দাবানলের মতো আগ্রাসী, অজস্র রাগ আর ঈর্ষার বহিঃপ্রকাশ। এথিরিয়নের দাঁত সিলভার ঠোঁটে হালকা কামড় বসালো, সেই কামড় আর চুমু বলে দিচ্ছে—”তুমি শুধু আমার।”
সিলভা ধাক্কা দিতে চেষ্টা করলেও এথিরিয়নের গম্ভীর, জেদি স্পর্শ তাকে দুর্বল করে ফেললো। তার শরীর থরথর করছিলো, কিন্তু ভিতরে কোথাও এক চুমুর গভীরে কেঁপে উঠছিলো অনুভব।
একটু পরে যখন এথিরিয়ন অবশেষে নিজেকে সরালো, সিলভার ঠোঁট লাল হয়ে উঠেছে, চোখে জল আর রাগ মিশ্র এক দৃষ্টি।

“তুমি কি করে সাহস পাও এইভাবে—” সিলভা শুরু করলো।
এথিরিয়ন ধীর স্বরে বললো, “কারো সাথে ভাগ করতে পারবো না তোমায়, সিলভা। ক্যালিক্স হোক, আর যেই হোক…”
রাজপ্রাসাদের এক কোণে লিয়ারা দাঁড়িয়ে ছিলো। সিলভা আর এথিরিয়নের সেই দৃশ্যটা চুপচাপ দেখে যাচ্ছিলেন। তার চোখে ক্ষোভ, দুঃখ, আর কিছুটা শঙ্কা ছিলো। যখন এথিরিয়ন সিলভাকে ঠোঁটে চুমু দিলো, তার দেহের ভাষায় কিছু একটা খারাপই ঘটছে, সে বুঝতে পেরেছিলো।
হালকা ফিসফিস শব্দে, যা অন্য কারো কান পর্যন্ত পৌঁছানোর আগে একেবারে মৃদু ভাবে বেরিয়ে এসেছিলো লিয়ারার ঠোঁট থেকে, সে নিজের মনেই বললো,
“এক ভাই আমার মেয়ের জীবনে ঢুকে ধ্বংস করে যাচ্ছে, এখন আবার আরেক ভাই আমার ভাতিজির জীবনটা। এই দুই ভাই মিলে আমাদের মেয়েদের লাইফ নষ্ট করেই ছাড়বে।”

অ্যাকুয়ারা খাওয়া দাওয়ার পরেই এল্ড্র রাজ্যতে ফিরে গেছে।অ্যাকুয়ারা পথে গাড়িতে বসে বসেই ভাবতে লাগলো তখনকার কথা।
ফ্লোরাস রাজ্যে এনগেজমেন্টে আসার কিছুক্ষণ আগে…
অ্যাকুয়ারা নীল রঙের ড্রাগনগ্লোয় করা একটি রেশমি পোশাক পরে প্রস্তুত হয়েছিলো। তার কাঁধে ঢলে পড়া চুলের মাঝে ছোট ছোট মুক্তার মতো ঝিলমিল করছিলো আলো। কিন্তু চোখে মুখে ছিলো একটু ব্যস্ততা—কারণ সে জানতো, লিউ ঝান এখনো একাই পড়ে আছে।
সে হাতে একটি ট্রে নিয়ে লিউ ঝানের কক্ষে প্রবেশ করলো। ট্রেতে ছিলো হালকা খাবার, কিছু ফল, আর নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়ার ওষুধ।
লিউ ঝান তখন বিছানায় বসে ছিলো।অ্যাকুয়ারাকে দেখে হালকা হাসি দিলো।
অ্যাকুয়ারা মৃদু হেসে বললো, “আপনার জন্য খাবার আর ওষুধ এনেছি, সময় হয়ে গিয়েছে।” সে ট্রেটা টেবিলে রেখে গ্লাসে পানি ঢেলে দিলো।

লিউ ঝান হঠাৎ প্রশ্ন করলো, “তুমি কখন ফিরবে, অ্যাকুয়ারা?”
অ্যাকুয়ারা এক মুহূর্ত থেমে গেলো। তারপর কোমল কণ্ঠে বললো, “ওরা সবাই আজ রাতটা প্রাসাদেই থাকবে। আমি সন্ধ্যার পরেই ফিরে আসবো। আপনি একদম চিন্তা করবেন না।”
লিউ ঝান চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ, যেন বলতে চাইছে—”তুমি না থাকলে আমার একা একা লাগবে ।”
অ্যাকুয়ারা তখন তার দিকে একটু ঝুঁকে এসে বললো,
“আপনার জন্য আমি রোজ ফিরে আসি এই কক্ষে লিউ ঝান, আজও ফিরবো।”
তারপর ধীরে ধীরে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলো, রুপালি ড্রেসের ঘের মেঝেতে নরম শব্দ তুলতে তুলতে মিলিয়ে গেলো।

রাত গভীর। প্রাসাদের চারদিক নীরব। পাহারায় থাকা ড্রাগনরাও ক্লান্ত হয়ে ঢুলছে। চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে রাজপ্রাসাদের করিডোরে। এই নিঃশব্দ রাতেই, নিঃশব্দ পায়ে জ্যাসপার ফিওনার কক্ষে প্রবেশ করলো।
ফিওনা তখন গভীর ঘুমে, মুখে এক শান্ত হাসি। জ্যাসপার ধীরে ধীরে তার পাশে বসে, ফিসফিস করে বললো—
“তোমার মা আমাকে আলাদা কক্ষে পাঠিয়ে দিয়েছে, কিন্তু আমি তো থাকতে পারবো না,… ঘুম আসছেনা তোমাকে ছাড়া।”
সে ধীরে ধীরে নিচু হয়ে ফিওনার কপালে চুমু দেয়… তারপর গালে… তারপর ঠোঁটে। ঠিক সেই মুহূর্তেই ফিওনার চোখ খুলে যায়।
ফিওনা চমকে উঠে চেঁচিয়ে বললো
“তুমি এখানে কি করছো প্রিন্স?
জ্যাসপার তৎক্ষণাৎ তার মুখে হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বলে, “শান্ত হও,হামিংবার্ড। চেঁচালে প্রাসাদ জুড়ে ঝড় উঠবে, কারণ আমি এখন তোমার ঠোট চুরি করতে এসেছি।”
হঠাৎই কক্ষের বাথরুমের দরজা খোলে।
সিলভা দাঁড়িয়ে, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলে—

“ব্রাদার ইন ল আপনি এখানে?”
ফিওনা লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নেয়, আর জ্যাসপার একটু হেসে বলে, “সিলভা,তুমিও তো দেখছি এখন খুব বিপজ্জনক হয়ে গেছো!”
সিলভা গম্ভীর গলায় বলে, “ফুপি আমাকে বলেছে নজর রাখতে… আপনি প্লিজ চলে যান। বিয়ের আগে মুখ দেখা অমঙ্গল।”
জ্যাসপার দাঁড়িয়ে পড়ে, ফিওনার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে
“আমি এখন যাচ্ছি, কিন্তু শোনো ছোট ড্রাগনসিস্টার—আমাদের মাঝে অমঙ্গল বলে কিছুই নেই। আমরা নিজেদের নিয়তিই বদলে দিয়েছি… এবার আর কোন ভাগ্য বাঁধা দিতে পারবে না।”
সিলভা কড়া গলায় বলে, “ভাগ্য বাঁধা না দিলেও আমি দিবো, এখন বের হন। নাহলে আপনার শাশুড়ি মা নিজে এসে বের করে দেবেন।”
জ্যাসপার কিঞ্চিত বিরক্ত নিয়ে দরজা দিয়ে বের হয়ে যায়। ফিওনা তখন বালিশে মুখ লুকিয়ে ফিসফিস করে— “এই ফায়ার মনস্টার এতো অধৈর্য কেনো…”

পরদিন সকালের সূর্য হালকা সোনালি আলো ফেলে ধুয়ে দিচ্ছিল ফ্লোরাস প্রাসাদের প্রতিটি বারান্দা, করিডোর, আর দৃষ্টিনন্দন বাগানগুলো। রাজপ্রাসাদের বিরাট ডাইনিং হলে একে একে সকলে বসেছে সকালের নাশতার টেবিলে। ক্রোকস ফুলের গন্ধ মৃদু হাওয়ায় মিশে এসে তাদের ইন্দ্রিয় জাগিয়ে দিচ্ছিলো।
ফিওনা আর জ্যাসপার পাশাপাশি বসে নাশতা করছিলো, দুজনেই এখনও আগের রাতের ঘটনার রেশ কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তখনই হলের বিশাল দরজা ঠেলে এক মেয়ে প্রবেশ করলো।
তার উপস্থিতি মুহূর্তেই নিস্তব্ধতা এনে দিলো পুরো কক্ষে।
সে এক অনন্য রূপসী—চুল ছিলো চকচকে হালকা নীল রঙের,হিমবাহ থেকে ঝরে পড়া জলধারার স্বচ্ছের মতো। চোখ দুটো রূপালি,পাথরের মতো দীপ্তিময়। তার পরনে ছিলো এক মিহি ক্রিস্টাল হেমড পোশাক, যেটা বিশেষভাবে তৈরি শুধুই ভেনাসের রাজপরিবারের জন্য।

“আমি আলাইরা, ভেনাসের প্রধান বিবাহ পরিকল্পনাকারী।”—কণ্ঠে ছিলো এক নিঃশব্দ অথচ দৃঢ় আত্মবিশ্বাস।
“আমার দায়িত্ব প্রিন্সেস ফিওনা আর প্রিন্স জ্যাসপারের রাজবিয়ে’র সমস্ত আয়োজন—ডেকোরেশন, রীতি, পোশাক, স্টেজ সবকিছুর হোস্ট। আজকে আমি তাদের পোশাকের ডিজাইন দেখাতে এসেছি আর কিছু গুরুত্বপূর্ণ মাপ নিতে হবে।”
সবাই চুপ। আলাইরার দৃষ্টিতে কারও উপর অহংকার ছিলো না, তবে সে জানত তার ক্ষমতা।
সিলভা কৌতূহলে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কি নিজেই পুরোটা হোস্ট করবে?”
আলাইরা শান্ত হেসে বললো, “না, আমি শুধু হোস্ট না, এই বিয়ের প্রতিটি মুহূর্তের শিল্পী।”
ফিওনা তাকিয়ে রইলো আলাইরার দিকে। এ মেয়েটা যেন স্বপ্ন থেকে নেমে আসা এক গঠনশীল ঝড়, যার ছোঁয়ায় তার নতুন জীবনের প্রতিটি রঙ ধীরে ধীরে সাজতে চলেছে।

টেবিলে তখন কেবল তিনজন—জ্যাসপার, ফিওনা আর আলাইরা। সকালের আলো জানালার পর্দা ছুঁয়ে রূপালি সুর ছড়িয়ে দিচ্ছিল রাজপ্রাসাদের বিশাল নৈশভোজ কক্ষে। ইতিমধ্যেই ফিওনার ব্রাইডাল গাউনের মাপ নেয়া শেষ।
“প্রিন্স অরিজিন, আপনার বিয়ের পোশাকের মাপ নেওয়া এখন বাকী,” আলাইরা ফাইল বন্ধ করে মুখ তুলেই বললো।
ফিওনার কপাল কুঁচকে গেল। সে এক ঝটকায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “এক্সকিউজ মি? আপনি কেনো প্রিন্সের মাপ নেবেন? কোনো পুরুষ হোস্ট নেই?”
আলাইরা কপট হাসি দিয়ে বললো, “আরেহ ম্যাডাম, শুধু ব্লেজারের মাপটা নেবো—কোনো অস্বস্তির কিছু নেই।”
ফিওনার চোখ বড় বড়। সে স্পষ্টত অস্বস্তিতে।
“ফিতে দিন, আমি মেপে দিই,” সে গম্ভীর গলায় বললো।

আলাইরা তখনও স্বভাবসুলভ হালকাভাবে জবাব দিলো, “না না, সমস্যা নেই ম্যাম। আসলে উনার ব্লেজারের মাপ আমি কিছুটা মনে রেখেছি। আগে যেকোনো রাজ অনুষ্ঠান বা ইভেন্টের আগে মাপ আমি-ই নিতাম…”
সেই পর্যন্ত শুনেই ফিওনার ধৈর্যের সীমা ফুরিয়ে গেল।
সে সামনে রাখা নিজের প্লেট থেকে একটা ধারালো কাঁটা চামচ উঠিয়ে, মেয়েটার প্লেটের উপর সটান ঠাস করে চেপে ধরলো—চোখের এক বাক্য দাগার আগে অস্ত্র ধারালো করে নিচ্ছে।
চোখে তীব্র আগুন নিয়ে ফিওনা ধীর কণ্ঠে বললো,
“আগে কি করেছো না করেছো সেটা আমার দেখার বিষয় না।এখন থেকে কোনো মাপ না নিয়ে ড্রেস বানাবে—একদম আন্দাজে। বুঝলে?”
এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা।

জ্যাসপার তখন এক কোণায় বসে, দুই ঠোঁট চেপে রেখেছে—কিন্তু হাসি চাপতে পারছে না। চোখে তার লুকানো আনন্দ, ঈর্ষায় জ্বলে উঠা এক রাজকন্যার এই উত্তেজনা তাকে গোপনে পুলকিত করে যাচ্ছে।
ফিওনা হঠাৎই তার দিকে ঘুরে তাকালো—চোখে রাগের ঝিলিক।
জ্যাসপার ঠোঁট কামড়ে হাসি চাপলো।
ফিওনা কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে সোজা হেঁটে বেরিয়ে গেলো হল থেকে, গর্জনের মতো তার পদধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছিলো মেঝের মার্বেলে।
আলাইরা কাঁধ ঝাঁকালো, নীরবে বলে উঠলো,
“হায় ভেনাস, প্রেমে ঈর্ষার রঙ বড্ড গাঢ়…”
নিচে তোমার চাওয়া মতো দৃশ্যটা রোমান্স, রাগ আর রসিকতা মিশিয়ে সাহিত্যিকভাবে সাজিয়ে দিলাম:
ফিওনা বজ্রের মতো হল ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলো, আর জ্যাসপার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে ওর পেছনে ছুটে গেলো।
পেছন থেকে ডাকলো, “ফিওনা… থামো, শুনো তো!”
কিন্তু ফিওনা থামলো না। নিজের ঘরের দরজা খুলে ঢুকে যাওয়ার পর দরজা খোলা রেখেই জ্যাসপারকে বললো, “যদি এখন ঢোকো, তাহলে আমি কিছু ছুঁড়ে মারবো!”
জ্যাসপার হালকা হাসি নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলো, তারপর ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকলো, “তুমি রাগ করছো কেনো হ্যাঁ? আমি তো যাইনি মাপ দিতে!”

ফিওনা তখন পেছন ফিরে এক ঝটকায় জ্যাসপারের হাতটা ছেড়ে দিলো, “তবু তো ওই মেয়েটা বললো, আগে সব সময়! ওই তোমার ড্রেসের মাপ নিতো, এর মানে কী?”
জ্যাসপার একটু গম্ভীর হলো। তারপর হালকা গলায় বললো, “ফিওনা, সেটা অনেক আগের কথা। তখন তো আমি… আমি একরকম রোবোটিক ছিলাম। আমার ‘লাভ ফাংশন’ তো ছিলোই না। নারীদের দিকে তাকানোও হতো না, না কিছু অনুভব করতাম, না কিছু চাইতাম। ওইসব আমার কাছে কিছুই ছিলো না তখন।”
ফিওনা চুপ করে থাকলো কিছুক্ষণ। চোখ দুটো আরও বেশি ভিজে গেলো রাগে না অভিমানে—সে নিজেও বুঝে উঠতে পারলো না।

অবশেষে ধীর কণ্ঠে বললো, “সরি… এটা শোনার পর আর ভালোই লাগছে না। তুমি যাও এখান থেকে।”
জ্যাসপার দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ—চোখে তার এক চিলতে বেদনা আর কপালে চিন্তার ভাঁজ। তারপর হালকা গলায় ফিসফিসিয়ে বললো, আমি এখন আর সেই পুরোনো প্রিন্স না। আমি এখন সেই প্রিন্স যে শুধু একটা মেয়েকে চোখে দেখে—তার নাম ফিওনা…”
ফিওনা তখনো পিঠ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ঠোঁট কামড়ে চোখের কোণে জমা অভিমান লুকানোর চেষ্টা করছিলো। হঠাৎ পেছন থেকে জ্যাসপার ঝট করে তাকে জড়িয়ে ধরলো।
“ছাড়ো আমাকে!” ফিওনা হাত-পা ছুঁড়তে লাগলো, কাঁধে ধাক্কা দিতে লাগলো, কিন্তু জ্যাসপার শক্ত করে ধরে রাখলো।

“না ছাড়বো না!” তার গলা কাঁপছে, নিঃশ্বাস ভারি,মনে হলো নিজের ভুলে নিজেই পুড়ছে।
জ্যাসপার ফিওনার কানের কাছে মুখ এনে একটার পর একটা বলে যাচ্ছিলো, “সরি… সরি… সরি… ফিওনা সরি, আমার হ্যামিংবার্ড, সরি….. সরি…”প্রায় একশো বার… একইভাবে।
ফিওনা হালকা করে বললো, “তোমার সরিতে আমার বুক ব্যথা কমবে না প্রিন্স…”
জ্যাসপার অস্থির হয়ে গেলো, আলতো করে তার গাল ঘেঁষে বললো, “তুমি চাইলে আমাকে যেকোনো শাস্তি দিতে পারো , কিন্তু রাগ করে দূরে চলে যেও না… প্লিজ… রাগ করে থাকো, কিন্তু আমার বাহুর ভেতরেই থেকো…”
ফিওনার চোখে পানি জমে উঠলো। জ্যাসপারের কণ্ঠের কম্পনে একটা শিশুর মতো ভাঙন ছিলো।
শেষমেশ ফিওনা হালকা করে বললো, “আমাকে যদি এত ভালোবাসো, তাহলে শুধু কথা দিয়ে নয়, বিশ্বাস দিয়ে প্রমাণ দাও।”

জ্যাসপার বললো, “আমি প্রমাণ দেবো… প্রতিদিন… প্রতিরাত… যতদিন শ্বাস থাকবে…”
আর তখনও ফিওনা গলে যাওয়ার আগেই জ্যাসপার তার গালে আদর করে একটা চুমু দিলো।
ফিওনার চোখে তখনো অভিমান লেগে আছে, কিন্তু জ্যাসপারের ওকে জড়িয়ে ধরা, কান ঘেঁষে অসংখ্য “সরি”—সব মিলিয়ে বরফ গলার শব্দটা ওদের মাঝেই শোনা যাচ্ছে।
একটু থেমে ফিওনা ধীরে ধীরে জ্যাসপারের বুক থেকে সরে দাঁড়ায়। চোখে পানি, কিন্তু ঠোঁটে এক চিলতে হাসি।
“ঠিক আছে,” সে বলে, “আমি নিজেই মাপ নিয়ে দেই…”
সে একরাশ কৌতুক নিয়ে পাশের আলমারি থেকে একটা ফিতে বের করে আনলো। জ্যাসপার চুপচাপ দাঁড়িয়ে, চোখে প্রেমের রঙ।
ফিওনা তার দিকে এগিয়ে এসে ফিতেটা জ্যাসপারের ঘাড় থেকে বুক পর্যন্ত টেনে নিলো। একবার পেটের কাছে, আবার কোমরের চারপাশে।

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৩১

“এইটা ৩৭ না ৩৮? থাক, ধরেই নিচ্ছি ৪০…”
জ্যাসপার একটু হেসে বললো, “তুমিতো আমার ওজন বাড়িয়ে দিচ্ছো হামিংবার্ড?”
ফিওনা ইচ্ছে করে তার কলার ধরে বললো, “তোমার তো ওজন আছেই… শরীরের জন্য না, একগুঁয়েমির জন্য!”
জ্যাসপার তখন তার কোমরে হাত রেখে বললো,
“তুমি যেভাবে চাও, সেভাবেই মাপ দাও। শুধু এটুকু জানো—তোমার দেয়া মাপেই আমি ড্রেস পড়বো, কারণ ওটা তোমার ভালোবাসার মাপ…”
ফিওনার গাল টকটকে লাল হয়ে উঠলো। সে মুখ ফিরিয়ে ফিতে গুটাতে শুরু করলো, আর পেছনে দাঁড়িয়ে জ্যাসপার তার চুলে মুখ গুঁজে হাসতে লাগলো।

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৩৩