আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৪৫

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৪৫
সাবিলা সাবি

এল্ড্র প্রাসাদের চারপাশ আজ যেন আলোয় ভেসে যাচ্ছে। সূর্য যখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে, তখন থেকেই রাজপ্রাসাদের আকাশজুড়ে উড়ছে রঙিন পতাকা, ঝুলছে সোনালী ফেস্টুন। সঙ্গীতের মৃদু ধ্বনি বাতাসকেও করে তুলেছে সুরেলা। আজ এল্ড্র রাজ্যের দুই অভিজাত ড্রাগনের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা—রিসেপশন।
প্রাসাদের পশ্চিম চত্বরে তৈরি হয়েছে এক সুবিশাল রাজসভা, যেখানে সজ্জিত হয়েছে অসংখ্য সিংহাসনসদৃশ চেয়ার, মোহরার মত বিছানো গালিচা আর সুবাসিত ফুলের মালা।
রাজার আসনে বসে আছেন স্বয়ং জেনোথ ড্রাকোনিস নিজে এবং তাঁর পাশে আভিজাত্য আর আভার প্রতীক ভেনাস দেবতা আভ্রাহার। অতিথিরা আসছেন দূরদূরান্ত থেকে—ড্রাগনের উপত্যকা থেকে, বিভিন্ন রাজ্য থেকে, মহামহিম যোদ্ধারা, শিল্পী, বিজ্ঞানী, এবং কূটনীতিকদের কাতার।

সন্ধ্যার আলো যখন লাল আভা ছড়াতে শুরু করেছে, ঠিক তখন রাজদ্বার খুলে যায়—
প্রথমে প্রবেশ করেন থারিনিয়াস আর আলবিরা। থারিনিয়াস পরেছে গাঢ় নীল রঙের ব্লেজার স্যুট, তাতে সোনালি বোতাম আর রাজকীয় এমব্রয়ডারি। চুল সামান্য পিছনে ব্রাশ করা, আর এক নির্ভীক কোমল হাসি তাঁর মুখে। আলবিরা আজ এক স্বপ্নময় রূপে হাজির হয়েছছ রূপালি-সোনালি ছায়াযুক্ত একটি লম্বা গাউন পরেছে সে, যেটির ঘন কাঁধজোড়া থেকে নিচের দিকে লেহরার মত ভেসে পড়েছে তার সৌন্দর্য। মাথায় হালকা টিয়ারা, আর গলায় ঝুলছে নীলাভ রত্নের হার।
এরপর প্রবেশ করেন এথিরিয়ন ও সিলভা। এথিরিয়নের পরনে ছিল কালো রঙের স্ট্রাকচারড ব্লেজার, তাতে হালকা লাল ছোপ আর কাঁধে থাকা সোনালি এল্ড্র ক্রেস্টের ব্যাজ। পায়ে চকচকে লেদার বুট, আর মুখে চিরচেনা সেই আত্মবিশ্বাসী কোমলতা। সিলভা এক অসামান্য গাউনে আবৃত—মিষ্টি গোলাপি আর সাদা মিশ্রণে তৈরি গাউনটি তার কোমলতাকে এক স্বর্গীয় রূপ দিয়েছে। তার চোখে একচিলতে সংকোচ, কিন্তু ঠোঁটে ছিল বিশ্বাসের আলো।
দেবতা আভ্রাহা চার নবদম্পতির দিকে তাকিয়ে এক মৃদু হাসি দেন এবং আশীর্বাদ উচ্চারণ করেন— “তোমাদের হৃদয় যেন মেলে ধরে সত্য, ত্যাগ আর ভালবাসার অমল স্বরূপ। আজ হতে তোমাদের বন্ধন চিরন্তন হোক।”
তারা যখন এক এক করে রাজমঞ্চে প্রবেশ করছে, তখনও এল্ড্র প্রাসাদের পূর্বদিকের নারীকক্ষের দরজায় ব্যস্ততা তুঙ্গে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফিওনা এখনও প্রস্তুত হতে পারেনি। তার পরনে এখনো রয়েছে রেশমি অভ্যন্তরীণ পোশাক, চুল খোলা, চোখে একটু অবিন্যস্তর ভাব। সিলভা আর আলবিরাকে সাজিয়ে দিতে গিয়ে কখন যে সময় গড়িয়ে গেছে, সে টেরই পায়নি।
আলবিরার গাউনের পেছনের কুঁচি ঠিক করা, সিলভার কানের দুলের হীরার আলোকচ্ছটা ঠিকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে কি না—এসব খুঁটিনাটি দেখতেই কেটে গেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ফিওনা এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে যায়। তার চোখে ক্লান্তির রেখা, তবুও সেখানে এক অপূর্ব কোমলতা ছড়িয়ে আছে। আজ রিসেপশনে তার উপস্থিতি চাই রাজ্যের সকলের। আর সবচেয়ে বড় কথা—আজ জ্যাসপারের পাশে সে থাকবে, পরিপূর্ণভাবে, একজন এল্ড্র প্রিন্সের প্রিয়জন হিসেবে।
চেম্বারমেইডেরা দৌঁড়ে এসে চুল বাঁধছে, গাউন টান টান করছে, আঙুলে আঙুলে রত্নজড়ানো অলংকার পরাচ্ছে।
এল্ড্র প্রাসাদের আকাশজোড়া রাজপথ আজ যেন আবার একবার নতুন করে জেগে উঠেছে। বর্ণময় পতাকার ঝলকানি, শুভেচ্ছার ধ্বনি, আর আতিথেয়তার ব্যস্ততা ছাপিয়ে আজ এক গৌরবময় আগমনের মুহূর্ত।
প্রাসাদের দক্ষিণদ্বার খুলে দিয়ে গার্ডরা দাঁড়িয়ে থাকে সারি বেঁধে। রাজকীয় রথে ধীরে ধীরে প্রবেশ করেন এল্ড্র রাজপরিবারের সম্মানিত অতিথিরা। জ্যাসপারের মামা, তার পাশে পরিপাটি সাজে মামি, আর তাদের সঙ্গে মামাতো ভাই এলিন্ডর।

জ্যাসপার দ্রুত এগিয়ে এসে সাদর সম্ভাষণ জানায়। মামা হালকা হেসে বলে ওঠেন, “আমার প্রিয় ভাগ্নের এমন ঐতিহাসিক বিয়ে আমরা মিস করলাম, কিন্তু আজ তোকে এভাবে দেখে গর্ব হচ্ছে, জ্যাসপার।”
মামি আদরভরা চোখে ফিওনার খোঁজ করেন।
“আমাদের প্রিয় ভাগ্নের সেই মহারানীর সঙ্গে দেখা হবে তো নিশ্চয়ই আজ?” জ্যাসপার মাথা নাড়ে, “অবশ্যই, মামি। তোমাদের আশীর্বাদই তো ওর সবচেয়ে বড় গহনা আজ।”
এরই মাঝে এলিন্ডর এগিয়ে এসে সোজা থারিনিয়াস আর এথিরিয়নের দিকে যায়।দু’হাত বাড়িয়ে প্রাণখোলা হেসে বলে, “ভাইরা, অভিনন্দন! তোমাদের রাজকীয় বন্ধনে যে ঐক্য গড়ে উঠেছে, তা রাজ্যের জন্য আশীর্বাদ। তোমাদের বরের সাজে অতুলনীয় সুন্দর লাগছে—শুধু রাজকীয় নয়, একেবারে দেবতাদের মত।”
থারিনিয়াস মাথা ঝুঁকিয়ে হাসে, “এখন তুমি এসেছো, এবার তো বন্ধুত্বের সন্ধ্যাও জমে উঠবে।”
এথিরিয়ন হালকা ভ্রু কুঁচকে মজা করে বলে, “তবে এলিন্ডর, এবার বিয়ে করতে হলে তোমাকে কিন্তু ড্রাকোনিসের মুখোমুখি হতে হবে।”
চারপাশে হাসির রোল পড়ে যায়।আজ রাজপথে আনন্দের ঢেউ, আত্মীয়তার বন্ধনে আরও শক্ত হলো এল্ড্র প্রাসাদের ভিত্তি।

এল্ড্র প্রাসাদের বিশাল নৃত্যগৃহে আজ যেন নেমে এসেছে এক জাদুকরী রাত। চারিদিকে ঝলমলে ঝাড়বাতির আলো, সুরের ঢেউয়ে নেচে উঠছে বাতাস, আর রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে আসা অতিথিরা সুশোভিত আসনে বসে নিজেদের গুঞ্জনে মেতে আছে। থারিনিয়াস-আলবিরা আর এথিরিয়ন-সিলভার রিসেপশন শুরু হয়েছে—রাজা ড্রাকোনিস আর জ্যাসপারের পক্ষ থেকে এই অভিজাত আয়োজন যেন এক অলৌকিক রাজউৎসবে পরিনত হয়েছে।

হঠাৎ করেই ফিওনা তার কক্ষের দরজাটা খোলে।রাতের চাঁদের মতো স্নিগ্ধ আর অপার্থিব ভাবে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে সে। তার পরনে রাজকীয় সাদা গাউন, কোমরের নিচে নেমে আসা চুলের ঢেউয়ে লুকিয়ে আছে চাঁদের জ্যোৎস্না, তাকে দেখে মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে যাওয়ার মতোই সুন্দর লাগছে।
সে হাঁটতে থাকে—সাবধান পায়ে, কিন্তু আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণভাবে। ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘটে অপ্রত্যাশিত এক মূহূর্ত।
ফিওনা সিড়ির দিকে মোড় নিতেই হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা লাগে। ফিওনা সামলে ওঠে, মাথা তোলে—তাকে অবাক হয়ে দেখছে এক অচেনা যুবক। চোখে বিস্ময়, মুখে হালকা হাসি। সে যেন ঠিক প্রস্তুত ছিল না এমন কোনো সৌন্দর্যের মুখোমুখি হতে।
“হায়!” যুবকটি অবশেষে বলে ওঠে, কণ্ঠে স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ময় ও মুগ্ধতা। “হু আর ইউ? ইউ আর লুকিং সো বিউটিফুল! লাইক … ইউনিক.”
ফিওনা খানিকটা অবাক হয়, চোখ মেলে তাকায় এলিন্ডরের দিকে। অথচ এলিন্ডরের চোখ যেন আটকে গেছে শুধু তার মুখে। মুহূর্তটা যেন সময়ের বুক চিরে জমে যায় সেখানে—চতুর্দিকে আনন্দ, গান, অথচ তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক নিঃশব্দতা, ফিওনা চোখ রাখে সেই যুবকের চোখে। কণ্ঠে প্রশান্ত অথচ দৃঢ় এক সুরে পাল্টা প্রশ্ন করে, “আপনি কে?”

যুবকটি হেসে ওঠে। সেই হাসির ভেতর ছিল আত্মবিশ্বাস আর এক রহস্যময় উচ্ছ্বাস। “আমি এলিন্ডর,” সে বলে, “নিচে যে বর দেখছো এথিরিয়ন, ও আমার মামাতো ভাই। তুমি কি এই ব্রাইডদের কেউ হও? কোন আত্মীয়?”
ফিওনার ভ্রু একটু কুঁচকে যায়, ঠোঁটের কোণে এক তীক্ষ্ণ হাসি ফুটে উঠে। সে মাথা তোলে, গলায় হালকা গর্বের ছোঁয়া,“আপনি যদি সত্যি ওদের মামাতো ভাই হন, তবে তো জানার কথা আমি কে। আমি প্রিন্স জ্যাসপারের স্ত্রী—এলিসন ফিওনা।”
সেই মুহূর্তে যেন সময় এক দণ্ড থেমে যায় এলিন্ডরের মুখে। তার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে ওঠে, কণ্ঠের স্বর খানিকটা নিচু, যেন নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না, “ওহো… তুমি সেই অর্ধ-মানবী, পৃথিবী থেকে আসা?”
তার দৃষ্টিতে এবার যেন অন্য এক আবেগ খেলে যায়। সে ধীরে বলে, “তাই তো… তাই তোমাকে এত ইউনিক লাগছে দেখতে। ড্রাগন নারীদের থেকে তোমার চেহারায় এক অন্যরকম কোমলতা আছে… একধরনের মানবিক মায়া, যেটা চোখে লেগে থাকার মতোই।”
ফিওনা হালকা হাসিমুখে বলল, “ধন্যবাদ,” তারপর ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে সিঁড়ি দিয়ে নামার জন্য পা বাড়ায়।
তবে ঠিক সেই মুহূর্তেই পেছন থেকে এলিন্ডরের কণ্ঠ ভেসে এল, “এক সেকেন্ড…”
ফিওনা থেমে গেল। সে ধীরে ঘুরে দাঁড়ায়।এলিন্ডর একটু এগিয়ে এসে মাথা নিচু করে কৌশলী ভঙ্গিতে বললো, “তোমার গাউনের পেছনের চেইনটা খোলা…”
ফিওনা সঙ্গে সঙ্গে পিঠে হাত দেয়। চোখ মুহূর্তেই বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়। সত্যিই, পেছনের চেইনটি খোলা। সে এক হাতে পিঠে চেইন ধরে রেখেই দাঁড়িয়ে থাকে, কিছুটা অপ্রস্তুত আর বিব্রত হয়ে। ফিওনা নিজের হাত দিয়ে পিঠের চেইন লাগানোর চেষ্টা করে।

তখনি এলিন্ডর একটু নরম সুরে বলে, “সবাই নিচে ব্যস্ত, চাইলে আমি… আমি সাহায্য করতে পারি? ভয় পেও না, আমি চোখ বন্ধ করে রাখব। কিন্তু তুমি এভাবে নামলে নিচে সবাই তোমার সুন্দর পিঠ দেখে ফেলবে… তোমার মতো একজন প্রিন্সের ওয়াইফের জন্য তা মানায় না, তাই না?”
ফিওনার গলার কাছে কিছু যেন আটকে যায়। সে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই—
ঝড়ের বেগে এক ঝাপটা হাওয়া যেন পাশ দিয়ে বয়ে যায়।
এক মুহূর্তের মধ্যেই ফিওনার সামনে এসে দাঁড়ায় জ্যাসপার।
তার চোখ লালচে, নিঃশ্বাস ভারী। কোনো কথা না বলে এলিন্ডরের কলার ধরে সোজা সিঁড়ির ধারে নিয়ে যায়।
পরবর্তী মুহূর্তেই হঠাৎ এক ভয়ানক ঘুষি। এলিন্ডরের মুখে গিয়ে পড়ে শক্তভাবে।
সে আর দাঁড়াতে পারে না, গড়াতে গড়াতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে পড়ে যায়।
পুরো হলরুম নিস্তব্ধ।সংগীত থেমে গেছে, গলার আওয়াজ নেই কারো।সব চোখ তাকিয়ে আছে সিঁড়ির দিকে—যেখানে এলিন্ডর পড়ে আছে, আর সিঁড়ির উপরে দাঁড়িয়ে আছে জ্যাসপার—তপ্ত দৃষ্টি আর আগুনভরা নিঃশ্বাস নিয়ে।
ফিওনা হতবাক।সে বুঝে ওঠে না কী বলবে।
জ্যাসপার ধীরে তার দিকে ফিরে তাকায়।
তার চোখে এখনো আগুন জ্বলছে। কিন্তু ফিওনার চোখে ধরা পড়ে, সেই আগুনের নিচে লুকানো এক ভয় আর ভালবাসার আবেগ।

হলরুম তখনো স্তব্ধ হয়ে আছে। সবার চোখ ফিওনার দিকে, তারপর এলিন্ডরের দিকে—যে সিঁড়ির দ্বিতীয় ধাপে পড়ে আছে, সিড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে জ্যাসপার আর তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে ফিওনা, পিঠ আড়াল করে রাখা।
তবে হঠাৎ—এক ঝড়ের গতি নিয়ে জ্যাসপার নেমে এল উপরের সিঁড়ি থেকে। উপরের দিক থেকে সারা হলঘরজুড়ে বাজ পড়ার মতো করে গর্জে ওঠে জ্যাসপারের পদক্ষেপ।
রাজকীয় ব্লেজারের বুকের বাম পাশে সোনালী ড্রাগনের শিরার মতো করে বসানো ছিল এক সূক্ষ্ম পিন, যা কেবল রাজপরিবারের সদস্যদের সামরিক সজ্জার অংশ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়—তবে আজ সেটি ছিল জ্যাসপারের জন্য অস্ত্র।
কোনো শব্দ ছাড়াই, কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই, জ্যাসপার সামনে এসে এলিন্ডরের কলার চেপে ধরে তাকে এক টানে তার মুখোমুখি নিয়ে আসে।
“তুই চোখ বন্ধ রাখবি তাইনা?” তার কন্ঠ হয়ে উঠে আগ্নেয়গিরির ভিতরের চাপা গর্জনের মতোই।
সাথে সাথেই সেই পিন তুলে এক নিমিষে এলিন্ডরের ডান চোখে ঢুকিয়ে দেয়।
চিৎকারে ফেটে পড়ে এলিন্ডর।
এক মুহূর্তে মুখ দিয়ে রক্ত বেয়ে নামে, চোখের মণি যেন গলে পড়ে যায় যন্ত্রণার তাপে। হলঘরের বাতাস কেঁপে ওঠে।অতিথিরা হতবাক।কেউ জানে না ঠিক কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে।
কিন্তু জ্যাসপার থামে না।তাঁর চোখে ছিলো আগুনের দাহ, আর দ্বিতীয় চোখ লক্ষ্য করে হাত তুলেছিল—আর এক মুহূর্ত দেরি হলে…

সেই মুহূর্তে থারিনিয়াস, এথিরিয়ন, আর প্রাসাদের প্রহরীরা এগিয়ে আসে। সবাই মিলে জ্যাসপারকে ধরে ফেলে, তার হাত থামিয়ে দেয়—জ্যাসপার আঙ্গুল তখনো র”ক্তমাখা।
জ্যাসপার দাঁত চেপে বলে ওঠে, “আর আমার স্ত্রীর দিকে নজর দেওয়া মানে নিজের জীবনের শেষ ঘন্টা বাজিয়ে দেয়া।”
ফিওনা স্তব্ধ। এলিন্ডর মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে। রক্তে ভেজা হাত দিয়ে সে তার এক চোখ চেপে ধরেছে।
এখানে কেউ আর রাজকীয় আপ্যায়নের কথা মনে রাখলো না।সবাই শুধু চুপ করে দেখলো, একজন প্রিন্স কিভাবে নিজের স্ত্রীকে অপমান থেকে বাঁচাতে আগুন হয়ে উঠলো।
হলঘরে হাহাকার। এলিন্ডর মাটিতে পড়ে ছিল, চোখ চেপে ধরে শুয়ে থাকা সেই ভয়ানক আর্তচিৎকার এখন এক পশুর মতো হাহাকার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাজা ড্রাকোনিস। তাঁর কণ্ঠ ছিল দৃঢ়, যদিও চোখে তীব্র রক্তক্ষরণ ঘটানো এই ঘটনাটিও তাঁকে কিছুটা কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

“তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও। এখনই,”—রাজকীয় আদেশ ছড়িয়ে পড়ে হলঘরের প্রতিটি কোণে।
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে এলিন্ডর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, এক হাত দিয়ে রক্তাক্ত চোখ চেপে ধরে। রক্তে ভেজা আঙুল, কাপা কণ্ঠ—তবুও তার কণ্ঠে ছিল বিষ, আগুন, অভিমান আর এক নিঃশেষ হওয়া গর্বের সুর।
“এই? এই সামান্য পৃথিবীর অর্ধ-মানবীর জন্য… আমার চোখ কেড়ে নিলি তুই জ্যাসপার?” এলিন্ডর কাঁপতে কাঁপতে বলে।
জ্যাসপারকে লক্ষ্য করে এক তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বলে, “তোর কাছে আমি কী? তোর ভাই? নাকি একটা অবাঞ্ছিত আগন্তুক? তুই ভুলে গেছিস আমার বোন তোর জন্য কেমন পাগল ছিল? সে তোকে কতোটা ভালোবাসতো, প্রিন্স! সে তোকে চেয়েছিলো জীবনের চেয়েও বেশি!”
চারদিকে স্তব্ধতা।থারিনিয়াস আর এথিরিয়ন কেউই কিছু বলতে পারে না।
এলিন্ডর এক ধাপ সামনে এগিয়ে আসে। “আমার বোন ছিলো ভেনাসের সবচেয়ে সুন্দরী, সবচেয়ে গুণী, আর সবচেয়ে শক্তিশালী নারী। সে তোকে সম্মান করেছিল, স্বপ্ন দেখেছিল তোকে নিয়ে। তুই বিনিময়ে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলি কষ্ট। আর আজ—আজ তুই বিয়ে করিস এই পৃথিবীর একটা মেয়ে, যার জন্য তুই নিজের ভাইয়ের চোখ উপড়ে ফেললি?”

জ্যাসপার তার গর্জন আর ক্রোধকে আর ঠেকাতে পারছিল না। সে চিৎকার করে বলল, “এই বাস্টার্ড, তুই কাকে ‘সামান্য মেয়ে’ বলছিস? কাকে অপমান করছিস? তোর জিভ কেটে ফেলবো আমি এবার!”
ঠিক সেই সময় এলিন্ডরের মা-বাবা ঝটপট চমকে উঠল।তারা কোথাও একটা গিয়েছিলো আর ফিরে এসে এই অবস্থা দেখলো। দৌড়ে ছুটে এসে ছেলের এই অবস্থায় পড়ে গেল তারা, মুখে উদ্বেগ আর বেদনার ছাপ। তারা তৎক্ষণাৎ ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলো, কিন্তু জ্যাসপার বাধা দিল— “স্টপ! এই মুহূর্তে এখান থেকে কেউ নড়বে না! ও এখন হসপিটালে যেতে পারবে না, এটা আমার আদেশ।”
তার ভয়ানক দৃষ্টিতে সবাই থরথর করে কাঁপল।

“আমি ওকে দেখাবো আমার ওয়াইফ আমার কাছে কতটা মূল্যবান। তারপর ও এখান থেকে যাবে।”
সেই সময় রাজা ড্রাকোনিস বাধা দিতে এগোতেই জ্যাসপার তার ভয়ানক চোখে তাকাল, ড্রাকোনিস হঠাৎ থেমে গেল, কারণ সে বুঝল জ্যাসপারের সামনে এই মুহূর্তে অন্তত অবিচল থাকতে হবে।
মামা ছুটে এসে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, “তুই আমার ছেলের চোখ নষ্ট করে দিলি কেন?”
জ্যাসপার ঠাণ্ডা গলায় বলল, “কারণ আমার ফিওনা আমার ওয়াইফের দিকে ও কুনজর দিয়েছিল।”
সন্ধ্যার আকাশে এখনো রিসেপশনের আলো ছড়িয়ে আছে, কিন্তু হলরুমের ভেতরের বাতাস ভারী হয়ে আছে মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগের ঘটনার রেশে।

এলিন্ডরের এক চোখ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেনা। তার বাবা, চোখে দুঃখ আর ক্ষোভ নিয়ে, জ্যাসপারকে কিছু বলার আগেই এক পা এগিয়ে এসে বললেন, “আমার ছেলেকে এখনই হাসপাতালে নিতে হবে। ও আর এক মুহূর্তও এভাবে থাকতে পারবে না।”
জ্যাসপার ঠাণ্ডা চোখে তাকালো তার দিকে, তারপর থারিনিয়াস আর এথিরিয়নের দিকে কেবল একটি চোখের ইশারা করলো। দুইজন তৎক্ষণাৎ বুঝে নিলো আদেশ। এক ঝাপটায় তারা এলিন্ডরের বাবার দুই হাত ধরে ফেলল, শক্তভাবে চেপে রাখল যেন সে আর নড়তেও না পারে।
ড্রাকোনিস, সিলভা, আলবিরা, —সবাই রাজসিংহাসনের সামনে দাঁড়িয়ে। আজ জ্যাসপারের চোখে একটু অন্যরকম নরম আভা, আর মুখে দৃঢ়তা।

সে একবার হাত তুলতেই, হলরুমের দক্ষিণ দরজাটা খুলে গেল,চারজন রাজকীয় গার্ড ধীরে ধীরে ভিতরে প্রবেশ করল। তাদের আদেশ দেয়া হলো সেই জিনিস আনতে আর তারাও পুনরায় ফিরে যায় আনতে। এরপর তারা আবার প্রবেশ করে হলরুমে তাদের হাতে ছিল এক বিশাল, রাজকীয় জাদু সিন্ধুক।
সিন্ধুকটা ছিল লম্বা, চওড়া, যেন মানুষের দাঁড়ানোর জন্যই তৈরি করা বিশেষ এক আসন। সেই সিন্দুক ছিলো ট্রান্সপারেন্ট—ভিতরটা স্পষ্ট দেখা যায়, অথচ স্পর্শ করা যায় না।এর কাঠামো কাঁচের মতো স্বচ্ছ, কিন্তু ভেতর থেকে আলোর মতোন এক সুরক্ষাবলয় ঘিরে রেখেছে। সোনালী রঙের ড্রাগনের খোদাই, পবিত্র প্রতীকের চিহ্ন—সব মিলিয়ে এক অভিজাত অথচ রহস্যময় আবরণ।

গার্ডরা সেটিকে সিংহাসনের সামনে স্থাপন করল।
ঠিক তখনই দরজা দিয়ে প্রবেশ করল অ্যাকুয়ারা ও লিউ ঝান।তারা বাসরের জিনিস পত্র আনতে গিয়েছিলো।
তাদের মুখে বিস্ময়। সবার চোখ তাদের দিকে ঘুরল, তবে তারা সরাসরি ড্রাকোনিসের দিকে এগিয়ে গেলো।
জ্যাসপার কোনো শব্দ করল না। সবাই নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল।তারপর জ্যাসপার ধীরে ধীরে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।ফিওনা তখনো দাঁড়িয়ে, পিঠে হাত রেখে কিছুটা অপ্রস্তুত ভাবে।
জ্যাসপার তার কাছে গিয়ে, একটিও কথা না বলে, খুব যত্ন করে তার গাউনের চেইন লাগিয়ে দিল।চেইন লাগানোর পর সে ফিওনার হাতটি নিজের হাতে ধরে ফেলল, তারপর রাজকীয় ভঙ্গিতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল।নিঃশব্দে, কিন্তু দৃঢ় পদক্ষেপে।

সবাই তাকিয়ে রইল, কেউ কথা বলল না।নিচে এসে, সে এক মুহূর্ত থামল,তারপর ফিওনার চোখের দিকে তাকিয়ে খুব নরম কণ্ঠে বলল,“তুমি জানো না তুমি আমার কাছে কতটা মূল্যবান।”
তারপর দু’হাতে তুলে ফিওনাকে সেই সিন্ধুকে আলতো করি ঢুকিয়ে দিলো— নয় আতঙ্কে, নয় শাস্তিতে—বরং যেন এক রাজকীয় ঘোষণায় ভেনাসকে জানিয়ে দিল—এই অর্ধমানবী তার জীবন, তার গর্ব, এবং তার সম্মানের প্রতীক।
হলরুম নিঃশব্দ। আলো ঝলমলে রিসেপশন যেন এক মুহূর্তে রূপ নিয়েছে এক রাজকীয় বিচারের মঞ্চে।সব অতিথি তাকিয়ে আছে সেই রাজকীয় সিন্ধুকের ভেতরে,সেখানে দাঁড়িয়ে আছে ফিওনা। একটুও কাঁপছে না। তার চোখে নেই কোনো আতঙ্ক, নেই হতবাক হবার ছায়াও।বরং এক ধরনের স্থিরতা, আত্মবিশ্বাস আর মৌন মর্যাদায় যেন সে ঘোষণা দিচ্ছে— সে শুধু একজন স্ত্রী নয়, সে একজন রাণী।
জ্যাসপার সামনে এসে দাঁড়ায়, সবার চোখের সামনে,
তার চোখ তখন স্থির এলিন্ডরের রক্তমাখা মুখে।
তার কণ্ঠে বজ্রের মতো গভীরতা: “তুই জানিস পৃথিবীর একমাত্র বিরল হিরা কোনটা?”একটি নিঃশ্বাসের জন্য থামে, তারপর উত্তর দেয় নিজেই,“পিংক স্টার ডায়মন্ড।
সেই হিরা, যার একটাই প্রতিলিপি ছিলো। আর আমি…আমি সেটা পৃথিবী থেকে নিয়ে এসেছি। আর সেটাই আমার ফিওনা।”

চারপাশে চাপা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। জ্যাসপার তখন হাত তুলে সিন্ধুকের দিক দেখিয়ে বলে, “এই হিরা আর কেউ পাবে না। কেউ না। সবাই তার মূল্যবান জিনিস রাখে কোথায়? তাকে রাখে সিন্ধুকে।তাকে ঢেকে রাখে, আগলে রাখে, সবার চোখের আড়ালে রাখে।
তার চোখ রাগে জ্বলজ্বল করছে, এবার গর্জে উঠে বলে,
“আমার ফিওনার দিকে যে তাকাবে, আমি চোখ উপড়ে ফেলবো তার। আর দরকার পড়লে… সারা জীবনের জন্য ফিওনাকে সিন্ধুকে ভরে রাখবো, যেন আর কেউ তার কোমল মুখের এক ঝলকও দেখতে না পায়। কারণ সে আমার। আমার রাজত্বের সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন। আর তাকে আমি কারও দৃষ্টির অগোচরে আসতে দিবো না। ”
এক পলকে চোখ রাখে ফিওনার দিকে। সেই চোখে এখন আর রাগ নেই—শুধু সীমাহীন ভালোবাসা আর গভীর অধিকারবোধ।ফিওনাও শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। হলরুমে তখনো কেউ সাহস করেনি নিঃশ্বাস নিতেও। সবাই বুঝে গেল—এটা প্রেম নয় কেবল,এটা এক রাজপুত্রের ঘোষণা—তার রানী কারো নয়, কেবল তারই।
হলরুমে তখনো রুদ্ধশ্বাস নীরবতা। কেউ এগিয়ে আসে না, কেউ বাঁধা দেয় না।এলিন্ডর এক চোখ চেপে ধরে কষ্টে কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে,আর তার বাবা-মা দুজন মিলে তাকে নিয়ে রওনা হচ্ছে হাসপাতালের দিকে।
জ্যাসপারের মামা পেছন ফিরে দাঁড়ায়—চোখে জ্বলন্ত প্রতিজ্ঞার আগুন।তার কণ্ঠ ভারী, ধীরে ধীরে বলে,
“জ্যাসপার…তুই আমার ছেলের চোখ কেড়ে নিয়েছিস।

আমি দেখছি…এই অপমান, এই র*ক্তের বদলা আমি সময়মতো নেবো। তুই আজ শুধু চোখ নষ্ট করিসনি—
আমার আত্মসম্মানকে পুড়িয়েছিস। আমার ছেলেকে সবার সামনে অপদস্থ করেছিস। আমি এটা ভুলবো না।
তোর এই অহংকার… আমি ভেঙে ফেলবো।
সেদিন বেশিদূর না… মনে রাখিস।”
তার চোখে দুঃখ ছিল না, ছিল প্রতিশোধের দাবানল।
সেই আগুনে সারা হলরুম যেন পুড়ে যেতে চায়।

কিন্তু জ্যাসপার থেমে থাকেনি।সোজা তাকিয়ে থাকে তার মামার চোখে।তার ঠোঁটে এক তীক্ষ্ণ, কঠোর হাসি।
তার কণ্ঠে অটল দৃঢ়তা নিয়ে বলে “আপনার চরিত্রহীন ছেলেকে আমার রাজ্যে ঢুকতে দিয়েছি—
এটাই অনেক বড় সৌভাগ্য তার। একটা ছেলে যে একের পর এক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে,তিন তিনটে বিয়ে করে— তারপর ছেড়েও দিয়েছে, যে শুধু দেহ দেখে সম্পর্ক গড়ে…আর আপনি, একজন বাবা হয়ে, সেই ছেলের সবকিছু চোখ বুজে মেনে নেন— আপনি কি সত্যিই ছেলের ভালো চাইতেন?”
জ্যাসপারের চোখ র*ক্তবর্ণ হয়ে উঠছে ক্রোধে।“আজ আপনার ছেলের কুকর্মের ফল সে পেয়েছে। আর আপনি যদি সেই অন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ান—তাহলে আমি বলতে বাধ্য হবো,আপনারও চরিত্র নিয়ে সন্দেহ আছে।সত্যিকারের বাবা হলে আপনি এমন ছেলে জন্মাতেন না, আর তার অপরাধ ঢাকতে আসতেন না।”
জ্যাসপারের শেষ কথায় যেন বজ্রনির্ঘোষ বেজে ওঠে প্রাসাদের দেয়ালে।মামা থমকে যায়—তার মুখ কঠিন, কিন্তু সে কিছু বলে না।সে বুঝে গেছে—এখন কিছু বললে আরও অপমানই কপালে আছে। সে ছেলেকে নিয়ে চলে যায়—কিন্তু পেছনে ফেলে যায় প্রতিশোধের নিঃশব্দ ঘোষণা।
আর জ্যাসপার তখনও দাঁড়িয়ে থাকে,তার সিন্ধুকের পাশে—যেখানে তার ফিওনা দাঁড়িয়ে আছে,একটি হীরের মতো, অমূল্য, বিরল।

হলরুমে তখনো এক রহস্যময় নিস্তব্ধতা। এলিন্ডর আর তার পরিবার রাজপ্রাসাদ ছেড়ে চলে গেছে—একটা ক্ষত নিয়ে, এক অভিমান নিয়ে, আর একটা প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা নিয়ে।
আলো কমে এসেছে,সোনালি ঝাড়বাতির আলোয় সিন্ধুকটা তখনো মৃদু ঝলমল করছে।জ্যাসপার এগিয়ে যায় ধীর পায়ে রাজকীয় ব্লেজারের গলা পর্যন্ত বন্ধ, চোখে এখনো আগুনের রেখা।সে থেমে দাঁড়ায় সেই স্বচ্ছ সিন্দুকের সামনে।তার চোখ ধীরে ধীরে কোমল হয়,কারণ ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে সেই একমাত্র নারী—যাকে সে চোখে চোখে রাখে, প্রাণে প্রাণে বাঁধে।
সে হাত বাড়ায়, সিন্দুকের ঢাকনাটা একটানে খুলে ফেলে।ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা ফিওনা তাকিয়ে থাকে তার দিকে।তার মুখে কোনো ভয় নেই, নেই অপমান, নেই অভিযোগ।শুধু এক নীরব বিশ্বাস, এক নিশ্চুপ শক্তি।
জ্যাসপার হাত বাড়িয়ে দেয়—নিঃশব্দে, কিন্তু অত্যন্ত যত্নে।
“চলো, পিংক স্টার ডায়মন্ড আমার,” সে মৃদু স্বরে বলে।

ফিওনা তার হাত ধরে,আর জ্যাসপার তাকে ধীরে ধীরে তুলে আনে। তার চোখে ছিল গর্ব, তার স্পর্শে ছিল সুরক্ষা।
ফিওনার গালে হাত রেখে ষজ্যাসপার হঠাৎ থেমে বলে “আমি চাইনি এমন কোনো পরিস্থিতি করতে,
কিন্তু আমার সহ্য হয় না কেউ তোমাকে নিয়ে অশোভন কথা বলুক,তোমার দিকে এমন নজরে তাকাক।
তমি জানোনা, তোমাকে নিয়ে কতটা পাগল আমি।”
ফিওনা শুধু তাকায় তার দিকে— তার চোখে জল নেই, কিন্তু জ্যোতির মতো কিছু একটা।
সে বলে, “আমি জানি। আর এটাই যথেষ্ট, প্রিন্স।
আমার রক্ষক তুমি,আমার পৃথিবীও আমার ভেনাস ও।”
হলরুম যেন আবার নিশ্বাস নিতে শুরু করে।
সঙ্গীত আবার ধীরে বাজতে শুরু করে।
রিসেপশনের সেই উত্তেজনার পরে একটু শান্ত, স্নিগ্ধ মুহূর্ত—

সিলভা তখন একটু চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো এক কোণে, রাজসভার নরম আলোয় তার চুল ঝলমল করছিল।
সামনের দৃশ্যটা তার চোখে এখনো ভাসছে—জ্যাসপার কীভাবে পুরো রাজসভায় ফিওনার জন্য সিংহের মতো দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ সে পাশ ফিরে দেখে এথিরিয়ন দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ, গ্লাস হাতে।
সিলভা হালকা করে হেসে বলে, “তুমি ও কি আমাকে এমন ভালোবাসবে রিয়ন?এমন পাগলের মতো, যেমনটা প্রিন্স ভাইয়া ফিওনার জন্য করলো?”
এথিরিয়ন একবার তাকায় তার দিকে, চোখে সেই চিরচেনা ঠান্ডা, কিন্তু গভীর কোমলতা। সে বলে,“আমি তোমাকে যথেষ্ট ভালোবাসি, সিলভা। তবে ভাইয়ার মতো এমন পাগলামি?
তা বোধহয় পুরো মহাবিশ্বে আর কেউ করতে পারবে না।কারণ ওর ভালোবাসা… ওটা ওর রক্তে মিশে থাকা আগুনের মতোই।”

সিলভা চোখ নামিয়ে হাসে, একটু লজ্জা পায়।
তার কণ্ঠে একটু কান্না আর একটু আনন্দ মিশে যায়।
“তোমার ভালোবাসাও আমার কাছে কম কিছু না,”
সে বলে ধীরে।“তুমি আমাকে পাগলের মতো নয়,
বরং প্রতিদিন একটু একটু করে ভালোবেসো।
যেমনটা আমি চাই তাতেই হবে।”
এথিরিয়ন মৃদু হেসে গ্লাসটা নামিয়ে রাখে।
তারপর সিলভার দিকে এগিয়ে এসে বলে,“তাহলে এক কাজ করি—আজ থেকে পাগলামিটাও শিখে ফেলি, শুধু তোমার জন্য।”

রিসেপশনের জৌলুস ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এল।
একটা রাজকীয় সন্ধ্যা শেষ হলো নরম চাঁদের আলো আর মৃদু হাওয়ার ছোঁয়ায়। অতিথিরা ধীরে ধীরে প্রাসাদ ত্যাগ করলো। রুপালী পর্দার আড়ালে রাজবাড়ির ভেতরে তৈরি হলো এক নতুন অধ্যায়ের শুরু—বাসর রাত।
এথিরিয়ন আর সিলভার ঘরটি সাজানো ছিল রূপালি ফুল আর নীলাভ আলোয়। জানালার পাশে রাখা ছিল স্বচ্ছ স্ফটিকের একটি ল্যাম্প, যা থেকে ছড়িয়ে পড়ছিল নরম আলো।বিছানার চারপাশে পর্দার মতো ঝুলছিল হালকা নীল কাপড়, যেন স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝামাঝি এক রাজ্য।
থারিনিয়াস আর আলবিরার কক্ষ সাজানো হয়েছিল রক্তলাল গোলাপ ও সোনালি রঙের পর্দায়।
নিশ্ছিদ্র, চন্দ্রালোকিত রাত্রি। প্রাসাদের দোতলার ঝুলন্ত বাগান ঘিরে হালকা হাওয়া বয়ে চলেছে। সবার চোখের আড়ালে, বাসর রাতের ঘর দু’টি যেন একেকটা আলাদা রাজ্য—একেকটা স্বপ্নের জগৎ।

নিশ্ছিদ্র, চন্দ্রালোকিত রাত্রি। প্রাসাদের দোতলার ঝুলন্ত বাগান ঘিরে হালকা হাওয়া বয়ে চলেছে। সবার চোখের আড়ালে, বাসর রাতের ঘর দু’টি যেন একেকটা আলাদা রাজ্য—একেকটা স্বপ্নের জগৎ তৈরি হয়েছে।
সিলভা ধীরে ধীরে ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। তার গায়ে হালকা নীল রঙের স্যাটিনের গাউন, সোনার মত ঝলমল করছে তার সাদা ত্বক। চোখে জড়ানো একটু দ্বিধা, একটু কৌতূহল।
এথিরিয়ন দরজা বন্ধ করে ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এল। তার চোখে কেমন এক আলো—স্নিগ্ধ, নরম, আগুন ছাড়া উষ্ণতা।
“তুমি কি জানো, এই রাতটার জন্য আমি কতো দিন অপেক্ষা করেছি?” তার কণ্ঠে ছিলো মৃদু বজ্রধ্বনি।
সিলভা মুখ তুলে তাকাল, “তুমি কি ভেবেছিলে আমি তোমার হবো কখনো?”
“আমি কখনো ভাবিনি, আমি শুধু বিশ্বাস করতাম।”
এথিরিয়ন তার কাছে এসে দাঁড়ায়, তার কাঁধে হাত রাখে। তারপর ধীরে ধীরে তার কপালে ঠোঁট রাখে।
সিলভা চোখ বন্ধ করে ফেলে। তার বুকের ভিতর রক্ত গরম হয়ে ওঠে, সে অনুভব করে এথিরিয়নের হাত তার কোমর ঘিরে ধরে, তাকে কাছে টেনে নেয়।

আলবিরা জানালার পাশে বসে চুলে আঙুল চালাচ্ছিল, তখন থারিনিয়াস পেছন থেকে এসে বলে, “চুপ করে বসে থেকো না, বউ হওয়ার পর এত সিরিয়াস হলে চলে নাকি।”
আলবিরা ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে, “আমি ভাবছি আমার জীবনটা এখন থেকে রোমাঞ্চে ভরা হবে কিনা।”
থারিনিয়াস তার পাশে এসে বসে, “তোমার সঙ্গে থাকা মানেই রোমাঞ্চ। তবে এখন আমি চাই তুমি আমাকে একবার সত্যি করে বলো… তুমি আমাকে কতোটা ভালোবাসো?”
আলবিরা একটু চুপ করে থাকে, তারপর বলে, “তুমি আমার দুর্বলতা হয়ে গেছো… এটা কতটুকু ভালোবাসা হয়?”
থারিনিয়াস তার মুখ দু’হাতে ধরে, ধীরে ধীরে তাকে চুমু খায়, তারপর বলে,”তুমি জানো না, আমি কতোবার তোমার মুখটা কল্পনা করে ঘুমিয়েছি… আজ সেই মুখ আমার সামনে… আমার নিজের…”

রাত গভীর। ঘরের বাতিগুলো নিভে আছে, কেবল জানালা দিয়ে চাঁদের আলো পড়ছে বিছানার সাদা চাদরে। সিলভা দাঁড়িয়ে আছে সিল্কের ফিনফিনে গাউনে, যা তার শরীরের প্রতিটি বাঁককে প্রকাশ করছে।
এথিরিয়নের চোখ ঠিক যেন আগুনের মতো জ্বলছে।
সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, প্রতিটি পা তার ভিতরের তৃষ্ণা নিয়ে এগিয়ে আসছে।সে সিলভার গালে হাত রাখে, গম্ভীর কণ্ঠে বলে— “তুমি জানো, আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি না… আমি তোমাকে চাই… প্রতিটি শ্বাসে, প্রতিটি রক্তবিন্দুতে।”
সিলভা কাঁপা গলায় বলে—“তোমার ছোঁয়ায় আমি গলে যাই… ছুঁয়ে ফেলো আমাকে, সম্পূর্ণ করে দাও আজ।”
এথিরিয়ন আর এক মুহূর্তও দেরি করে না। সে এক ধাক্কায় সিলভার কোমরে হাত রেখে তাকে বিছানায় শুইয়ে ফেলে। তারপর ধীরে ধীরে তার গাউনের ফিতে খুলে দেয়। কাপড়ের প্রতিটি খসে পড়া টুকরো যেন চাঁদের আলোতে গলে যায়।
সিলভার শরীরের উপর তার ঠোঁট চলে যায়, গলার হাড় থেকে শুরু করে বুকের মাঝ বরাবর, নাভি পেরিয়ে… প্রতিটি চুমুতে সে লিখে যায় একেকটা কবিতা।
সিলভার দেহ হালকা কাঁপছে, শ্বাস দ্রুত, কণ্ঠে মৃদু কাতর ধ্বনি—“আরও… থেমো না… আমাকে তোমার করে নাও…”

এথিরিয়ন সারা শরীর দিয়ে অনুভব করে সেই আকুলতা। তার নিজের পোশাকটা খুলে ফেলে—পেশিবহুল শরীরে চাঁদের আলো পড়তেই সিলভা চোখ বন্ধ করে ফেলে।
সে ফিসফিসিয়ে বলে— “তোমাকে ছুঁয়ে, তোমার ভেতরে হারিয়ে যেতে চাই… আজ রাতটা শুধু আমার হোক, শুধু আমাদের হোক…”
তারপর এক গভীর মিলনে তারা একে অপরের মধ্যে হারিয়ে যায়। ঘরে নিঃশব্দ ঢেউ—দুজনের গলায় উঠে আসা শ্বাস, দেহে উঠতি উত্তেজনা, আর ঠোঁট থেকে ঠোঁটে আগুন।
তাদের মিলনের শব্দ যেন জানালার বাইরে চাঁদ পর্যন্ত পৌঁছায়। সিলভা কাঁপা গলায় বলে—
“ভালোবাসি তোমায়… রিয়ন,অনেক, অনেক ..”
এথিরিয়ন উত্তর দেয়—“যতক্ষণ আমি বাঁচবো, তোমার এই শরীর, এই মন, সব আমার… আজ রাতের পরে তুমি আর শুধু তুমি থাকবেনা।”

আলবিরা সিল্কের সাদা নৈবেদ্য গাউনে দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে, ঠোঁটে আগুন, চোখে বিদ্যুৎ।
থারিনিয়াস কাছে এসে বলে “তুমি জানো না, আমি আজ সারারাত ঘুমাবো না। তোমার দেহের প্রতিটি রেখা আমি মুখস্ত করতে চাই।”
আলবিরা তার দিকে তাকিয়ে হাসে, “তবে এসো, দেখে নেই কে আগে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়।”
থারিনিয়াস এক ধাক্কায় তাকে কাছে টেনে আনে। চুমু, কামড়, স্পর্শ—সব যেন জ্বালিয়ে দেয় তার র*ক্তে।
আলবিরা ফিসফিসিয়ে বলে, “আমি তোমার, কিন্তু আদেশে নয়, পাগলামিতে…”
সেই রাতে ঘরের প্রতিটি কোণ গরম হয়ে ওঠে। চাদর, বালিশ, বিছানা—সব গলে যায় ওদের উত্তাপে। শরীর বেয়ে নামে ঘাম, ঠোঁট বেয়ে ওঠে শব্দ। “আরও কাছে এসো…” বলে আলবিরা।
“তোমাকে হারাতে চাই,” বলে থারিনিয়াস। তারা জড়িয়ে থাকে, ধীরে ধীরে, গভীরতর ছোঁয়ায়, এমনভাবে যেন কাল আর অস্তিত্ব বলে কিছু নেই। ওদের সেই মিলন রাত শুধু শরীর নয়—অস্তিত্ব পর্যন্ত এক করে দেয়।

পরদিন সকাল।
রাজপ্রাসাদের সম্মেলন কক্ষে সবাই উপস্থিত—ড্রাকোনিস নিজ আসনে বসে আছেন। পাশে ফিওনা, জ্যাসপার, এথিরিয়ন, লিউ ঝান, সিলভা, থারিনিয়াস, আলবিরা, এবং অ্যাকুয়ারা একে একে বসেছে।
ঘরজুড়ে একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।
ড্রাকোনিস ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর চোখে এক বিষণ্ণ দৃঢ়তা।
ড্রাকোনিস বললেন “আজ আমি এমন এক সত্য প্রকাশ করতে যাচ্ছি, যা দীর্ঘদিন গোপনে ছিলো… এমনকি আমার নিজের সন্তানদের কাছ থেকেও।
অ্যাকুয়ারা…”
সবাই চমকে তাকায় অ্যাকুয়ারার দিকে। অ্যাকুয়ারা নিজের নাম শুনে কিছুটা অবাক হয়।
ড্রাকোনিস চোখ নামিয়ে ধীরে বলা শুরু করেন “অ্যাকুয়ারা, তুমি শুধু এই রাজ্যের একজন সাধারণ ড্রাগন মেয়ে নও। তুমি আমার প্রয়াত ভাই—ড্রাইগনাসের মেয়ে।”
ঘরজুড়ে হঠাৎ নিস্তব্ধতার মধ্যে ফিসফাস শুরু হয়। জ্যাসপার উঠে পড়ে, জ্যাসপার অবাক হয়ে প্রশ্ন করে “কী বলছেন আপনি? চাচা তো মারা গিয়েছিলেন বহু আগে… আর তিনি তো কখনও বিবাহ করেননি!”
ড্রাকোনিস গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন জ্যাসপারের দিকে।

ড্রাকোনিস বললেন “সে এক মানবীকে ভালোবেসেছিলো। কিন্তু সেই ভালোবাসা এই রাজ্যের কেউ মেনে নিতে পারেনি। তার সেই মানবী স্ত্রী যখন ছয় মাসের গর্ভবতী ছিলো, আমাদের কিছু অভিজাত সদস্য তাকে হ*ত্যা করে। কিন্তু তার পেটের বাচ্চা তখন ও জীবিত ছিলো।আমি তখন জানতাম, রাজ্যর নিয়ম বাঁচাতে হলে আমার ভাইয়ের সন্তানকেও বাঁচানো যাবে না। কিন্তু…”
তিনি থেমে গেলেন। গলার স্বর কেঁপে উঠল।
ড্রাকোনিস চোখে জল তিনি বলেন “আমি পারিনি। আমি পারিনি আমার ভাইয়ের রক্ত—শেষ চিহ্নটাকে শেষ হতে দিতে। আমি গোপনে সেই বাচ্চাটিকে সরিয়ে ফেলি। তাকে লুকিয়ে রাখি, রক্ষা করি, লালন করি… অ্যাকুয়ারা, তুমিই সেই শিশু।”
ঘরে যেন হঠাৎ বাতাস বন্ধ হয়ে যায়। অ্যাকুয়ারা নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ায়, চোখে বিস্ময়।
অ্যাকুয়ারা হতভম্ব হয়ে বললো “আপনি … আপনি কি বলছেন, আমি একজন রাজকুমারীর মতো… আমি একজন অভিজাত রাজবংশের ড্রাগনের রক্ত বহন করি?”
ড্রাকোনিস মাথা হেঁট করে হ্যাঁ সূচক ভঙ্গি করেন।
ড্রাকোনিস পুনরায় বললেন “আর সবচেয়ে মর্মান্তিক সত্য হলো, পরবর্তীতে জানা যায়, তোমার মা পুরোপুরি মানবী ছিলেন না। তিনি ছিলেন অর্ধ-ড্রাগন, অর্ধ-মানবী। অর্থাৎ তুমি একজন বিশুদ্ধ রাজরক্তের উত্তরসূরি।”
জ্যাসপার, ফিওনা, ড্রাকোনিস, এথিরিয়ন, সিলভা, থারিনিয়াস, আলবিরা, লিউ ঝান ও অ্যাকুয়ারা—সবাই দাঁড়িয়ে, নিঃশব্দ হয়ে আছে।

হঠাৎ করে দেবতা আভ্রাহার উপস্থিত হয় সেখানে আর ধীরে ধীরে অ্যাকুয়ারার দিকে এগিয়ে যান। তাঁর চোখ যেন অতীত আর ভবিষ্যৎ একসঙ্গে দেখতে পাচ্ছে।
আভ্রাহার ধীর ও গভীর স্বরে বলেন “এই কন্যার মধ্যে আমি চিনি এক পুরনো আত্মাকে… এক শতাব্দী আগে, এক সাহসী রাজ্যের এক ড্রাগন কন্যা ছিলো—থেরনের সৎবোন।
এক রক্ত, এক শক্তি। সে যুদ্ধের আগুনে পু*ড়ে মারা যায়… কিন্তু তার আত্মা বিশ্রাম নেয়নি। আজ সে ফিরে এসেছে—অ্যাকুয়ারা রূপে।”
ঘরজুড়ে শ্বাস বন্ধ করে থাকা নীরবতা।
এথিরিয়ন ফিসফিস করে “একই আত্মা… পুনর্জন্ম…”
ফিওনা তখন বলে উঠে “তাহলে অ্যাকু শুধু চাচার মেয়ে নয়… সে একজন পুরনো যোদ্ধার আত্মাও বহন করছে?”
আভ্রাহার মাথা ঝুঁকিয় বলে “তাই। তার রক্তে দুই শক্তির ধারা বইছে। অতীত ও বর্তমানের সেতুবন্ধন সে।
জ্যাসপার চমকে ওঠে “তাহলে যদি অ্যাকুয়ারা আমার সেই সৎবোনের পুনর্জন্ম হয়… তাহলে ফিওনার ভাই আরডন… সেও কি ফিরে এসেছে?”
সভায় গুঞ্জন ছড়ায়। ড্রাকোনিস কঠিন চোখে আভ্রাহার দিকে তাকিয়ে বলে “দেবতা আভ্রাহার, ফিওনার ভাই—আরডন… সে কি ফিরে এসেছে?”
আভ্রাহা কিছুক্ষণ চুপ থাকেন। তারপর খুব ধীরে বলেন “সে এখনো গোপন… সময় এলে জানা যাবে। কিছু আত্মা একসঙ্গে ফিরে আসে, আবার কেউ হারিয়ে যায় সময়ের মধ্যে।”

জ্যাসপার ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে অ্যাকুয়ারার দিকে। তার চোখে এক অদ্ভুত কোমলতা।সে থেমে যায় অ্যাকুয়ারার সামনে। নীরব মুহূর্ত।তারপরে সে হাত বাড়িয়ে অ্যাকুয়ারার মাথার ওপর রেখে বলে—
জ্যাসপার নরম কণ্ঠে বলে “তুমি আমার বোন।
আমাদের র*ক্তের… তুমি কি এখন আফসোস করছো?
তোমার পরিচয় লুকিয়ে ছিলো এতোদিন…?”
অ্যাকুয়ারা মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চুপ থাকে। বাতাসে চুল উড়ে যায়, চোখে জল চিকচিক করে। তারপর মুখ তুলে সরল কিন্তু দৃঢ় গলায় বলে— “না প্রিন্স…
আপনারা যে ভালোবাসা দিয়েছেন আমাকে… তাতে কোনো অভাব ছিলো না।আপনি সবসময় আমাকে বোনের মতোই ভালোবেসেছেন।আমি আফসোস করবো কেনো?”
সে এক পা এগিয়ে আসে। গলা কেঁপে যায় কিন্তু কথায় আত্মবিশ্বাস স্পষ্ট— “আর আমাদের কিং…
তিনি আমাকে বাঁচানোর জন্যই আমার পরিচয় লুকিয়েছিলেন।যদি না লুকাতেন, আমি হয়তো আজ বেঁচেই থাকতাম না। তিনি ছিলেন আমার বাবার ভাই, কিন্তু থেকেছেন আমার জন্য একটা রক্ষকের মতো।”
জ্যাসপার তখন গভীরভাবে চোখে চোখ রাখে। তারপর একটানা বলে—”তাহলে আজ থেকে… তুমি শুধুই অ্যাকুয়ারা নও।তুমি আমার বোন, আমার রাজপরিবারের গর্ব। এখন থেকে কেউ যদি তোমার পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে, আগে তাকে আমাকেই উত্তর দিতে হবে।”

ড্রাকোনিস তখন গম্ভীর কণ্ঠে বলে— “আগামীকাল আমি রাজ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবো তোমার পরিচয়। সবার সামনে আমি জানাবো—তুমি শুধু অ্যাকুয়ারা নও, তুমি আমার ভাইয়ের র*ক্ত। তুমি এল্ড্র রাজ্যের প্রিন্সেস। তারপর…তুমি চাইলে পৃথিবীতে যেতে পারবে লিউ ঝানের সাথে।”
এই কথা শুনে এক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা। তারপর হঠাৎ লিউ ঝান উত্তেজিতভাবে বলে—
লিউ ঝান চোখ বড় বড় করে”তাহলে… অ্যাকুয়ারা শুধু ড্রাগন সদস্যই নয়… সে এল্ড্র রাজ্যের একজন রাজকুমারী?”
তার চোখে সম্মান আর আনন্দ ঝলমল করে।
ফিওনা এগিয়ে আসে। মৃদু হাঁসি নিয়ে, গলা বুজে আসে আবেগে ” আমি আজকে খুব খুশি অ্যাকু, তুমি তোমার একটা সুন্দর পরিচয় খুঁজে পেলে।”
সে অ্যাকুয়ারাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আলবিরাও এগিয়ে আসে, তাদের দুজনকে একসাথে জড়িয়ে ধরে—
অ্যাকুয়ারা চোখের জল ধরে রাখতে পারে না। ধীরে ধীরে ফিসফিসিয়ে বলে—”আমি কৃতজ্ঞ… এত ভালোবাসা পেয়েছি, পরিচয় পেয়েছি, সম্মান পেয়েছি। আমার পরিবার হারালেও, নতুন একটি পরিবার পেয়েছি।”
জ্যাসপার তখন পাশে দাঁড়িয়ে বলে— জ্যাসপার হাসিমুখে “এখন থেকে তোমার কাঁধে শুধু এক বোনের নয়, এক রাজকুমারীর দায়িত্ব… তুমি প্রস্তুত তো?”
অ্যাকুয়ারা মুচকি হেসে বলে— “আপনার মতো ভাই থাকলে… আমি সব দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত, প্রিন্স।”

দুই মাস সময় কেটে গেছে।
ফিওনার পেট হালকা ফুলে উঠেছে, জীবনের এক নতুন আশায় ভরে গেছে সে। ড্রাগনের সন্তান আট মাসের বদলে মাত্র ছয় মাসে ভেনাসের আলো দেখার কথা, তাই ফিওনার অন্তরে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা মিশে আছে। ছোট্ট প্রাণের হার্টবিট স্পন্দিত হতে শুরু করেছে, যেন এক নতুন জীবনের সুর বাজছে তার অন্তরে।
কিন্তু সেই সুখের মাঝেও ফিওনার পেটে এক গভীর যন্ত্রণা বেড়ে চলেছে—তীব্র, অসহনীয় ব্যাথা, যা তাকে ক্রমশ দুর্বল করে দিচ্ছে। সবাইকে ভিন্ন একটা মুখ দেখায় সে, হাসিখুশি আর সবকিছু ঠিক আছে বলার ভান করে, অথচ আড়ালে একলা, নিভৃতে চোখ থেকে অশ্রু ঝরায় সে। কারো কাছে সে এই বেদনা প্রকাশ করতে পারেনা, নিজের ভেতরেই লুকিয়ে রাখে সব যন্ত্রণা।

একদিন সন্ধ্যার সোনালি আলোয়, জ্যাসপার হঠাৎ ফিওনার দিকে নজর দিল। ফিওনা পেটের দিকে হাত দিয়ে চেপে ধরেছে, মুখে অশ্রু ঝরে পড়ছে, বেদনার ছাপ স্পষ্ট। সে নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না—ব্যথার জর্জরিত মন আর দেহের ভার সে আর সহ্য করতে পারছে না।
জ্যাসপারের চোখে সেই দৃশ্য পড়তেই তার হৃদয়ে তীব্র কষ্টের ঢেউ উঠল। সে দ্রুত ফিওনার কাছে এগিয়ে এল, কাঁদতে থাকা ফিওনার হাতগুলোকে আলতো করে ধরল। “ফিওনা… কী হয়েছে তোমার? তুমি আমাকে কিছু বলো না কেন?”

ফিওনার চোখে আরও গভীর বিষাদ, অথচ সে জানে এখন মিথ্যা বলা আর সম্ভব নয়। বুক ভেঙে ওঠা ব্যথা আর হৃদয়ের দ্বন্দ্বের মাঝে সে ধীরে ধীরে জ্যাসপারের দিকে তাকালো, যেন তার সমস্ত আস্থা তাকে সাহায্য করার জন্য।
ফিওনা কাঁদতে কাঁদতে বললো, “পেটটা খুব ব্যথা করছে… অনেক দিন ধরেই কিন্তু আমি কাউকে কিছু বলিনি।”
জ্যাসপার আর দেরি করলো না, সঙ্গে সঙ্গে ডক্টর আগ্নিসকে খবর পাঠালো।ডক্টর আগ্নিস দ্রুত এল, ফিওনার যত্ন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলো।তার মুখে ছিল চিন্তার ছাপ।

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৪৪

“রিপোর্ট কালকে আসবে,” ডক্টর আগ্নিস জানালো, “ততক্ষণ যেন ফিওনা আর বেশি কষ্ট না পায়, খুব সাবধানে থাকো আমি মেডিসিন দিয়ে যাচ্ছি।”
জ্যাসপার ফিওনার হাতে শক্ত করে হাত দিলো, চোখে ছিল অসীম চিন্তা আর আশঙ্কা। সে জানতো, আজকের রাতটা তাদের জীবনের সবচেয়ে কঠিন রাত হতে চলেছে।

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৪৬