আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৫

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৫
সাবিলা সাবি

দরবারের আবহাওয়া তখনও ভারী,যেন ফ্লোরাস প্রাসাদের প্রতিটি ইট-পাথর ফিওনার ফিরে আসার এই অভূতপূর্ব ঘটনার ভার বহন করছে।
সিঁড়ির ধারে দাঁড়িয়ে থাকা লিয়ারা দ্রুত এগিয়ে এলো। ফিওনার অজ্ঞান দেহ তখনও জ্যাসপারের বুকের সঙ্গে মিশে ছিল।তার নিথর মুখে গভীর এক শান্তি,যেন এই অবস্থাতেই সে নিরাপদ।কিন্তু লিয়ারার চোখে সেই নিরাপত্তার ছায়া ছিল না।এক ঝটকায় ফিওনাকে জ্যাসপারের বুক থেকে আলতো করে ছাড়িয়ে নিলো লিয়ারা।ফিওনার কোমল দেহটিকে নিজের হাতে ধরে দ্রুত সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো।অন্য দুই নারী ড্রাগন সদস্য তাকে সহায়তা করছিল।

জ্যাসপার থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। তার অনুভূতিতে যেন একধরনের শূন্যতা ছড়িয়ে পড়লো। মনে হলো, কেউ তার কলিজাটা টেনে নিয়ে গেলো। ফিওনার ওভাবে চলে যাওয়ার দৃশ্য তার হৃদয়ে গেঁথে গেলো।তার হাত আপনা থেকেই সামনের দিকে বাড়ল, যেন ফিওনাকে আরেকবার ছুঁতে চায়। তার পা প্রায় এগিয়ে গেল, কিন্তু সে তখনই থেমে গেল।
ড্রাকোনিস,তার বাবা,শক্ত হাতে তার কব্জা ধরে ফেললেন। জ্যাসপার পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখল,ড্রাকোনিসের চোখে কেমন এক কঠোর অথচ রহস্যময় দৃষ্টি।সেই দৃষ্টিতে ছিল সতর্কতার ইঙ্গিত।যেন বরফের মতো ঠাণ্ডা আর পাহাড়ের মতো অটল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জ্যাসপার ড্রাকোনিসের চোখে তাকাতেই মুহূর্তেই থেমে গেলো।সে চোখে ছিলো এমন কিছু,যা সব কথা না বলেও বুঝিয়ে দিলো যে আর এক পা এগিয়ে যাওয়ার দুঃসাহস করোনা।
জ্যাসপারের মনে তবু অসংখ্য ঝড়।তার সামনে তখন একমাত্র চিন্তা,ফিওনা—অচেতন,নির্জীব,কিন্তু তবু তার অস্তিত্ব যেন সমস্ত ভেনাস ছাড়িয়ে শুধু তার নিজের।তার বুকের ভেতর ক্রমাগত অস্বস্তি আর যন্ত্রণা ছটফট করছিলো। তবু ড্রাকোনিসের সেই দৃষ্টি তাকে স্থির থাকতে বাধ্য করলো। সে জানতো,তার বাবার আদেশ অমান্য করা মানে রাজ্যের বিরুদ্ধে যাওয়া।
ড্রাকোনিস কিছু না বলেই মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে সিঁড়ির দিকে ইঙ্গিত করলো।সেই দৃষ্টি জ্যাসপারকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলো—‘এখানেই থেমে যাও।’
জ্যাসপার গলা শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো।সিঁড়ি বেয়ে লিয়ারা আর বাকিরা ফিওনাকে নিয়ে উপরে উঠে গেলো।তার প্রতিটি ধাপের আওয়াজ যেন জ্যাসপারের কানে ধ্বনিত হচ্ছিলো কোনো শূন্য কক্ষে।সে স্থবির দাঁড়িয়ে রইলো,আর ড্রাকোনিস তার পাশে পাথরের মতো দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে পাহারা দিলো। যেন এই যুদ্ধে জ্যাসপারের কাছে পরাজিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
জ্যাসপার চোখ নামিয়ে ফেলে পেছনে সরে গেলো, কিন্তু তার মন পড়ে রইলো সেই সিঁড়ির ওপর। যেখানে তার কলিজার অংশটুকু কিছু মুহূর্ত আগেই ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

অ্যালিসার ক্রোধ যেন দরবারের পরিবেশকেও উত্তপ্ত করে তুলেছিল।তার ঠোঁট কেঁপে উঠছিল,আর চোখে ছিল এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ,যা সে কোনোভাবেই লুকাতে পারছিল না।তার মুষ্টিবদ্ধ হাত আর দৃঢ় দাঁড়ানোর ভঙ্গি স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছিল, সে এই পরিস্থিতিকে এক বিন্দুও মেনে নিতে পারেনি।
সিলভাও অ্যালিসার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল,কিন্তু তার মুখেও স্পষ্টতই বিরক্তির ছাপ। “কি এক অবস্থা!” ফিসফিস করে অ্যালিসার দিকে ঝুঁকে বলল সে।“এক সাধারণ মানবী হঠাৎ এসে রাজকুমারী হয়ে গেলো!আবার কিছুক্ষন‌ আগের পরিস্থিতি একদম প্রিন্সের বুকেই পড়তে হলো আর বাকি সবাইকে দেখো আপু,যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে মেনে নিচ্ছে!”
অ্যালিসা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“আমি এটা মেনে নেব না। ফ্লোরাসের দরবারে এমনটা আর কখনো হতে দেব না।”

তবে ঠিক বিপরীত দিকের কোণে থারিনিয়াস,আলবিরা, এথিরিয়ন,আর অ্যাকুয়ারা নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের মুখে এক ধরনের মৃদু হাসি খেলা করছিল।তারা যেন পরিস্থিতিকে বেশ আনন্দের দৃষ্টিতে দেখছিল।
থারিনিয়াস আলবিরার দিকে চোখ টিপে বলল,“তোমার কী মনে হচ্ছে,ফিওনা আর প্রিন্সের প্রেম কি আবার হবে?”
আলবিরা মৃদু হেসে উত্তর দিল, “আমার মনে হচ্ছে, প্রিন্সের মুখ দেখেই এই ঘটনার ক্লাইম্যাক্স বুঝে নেওয়া যায়।তার মুখের অভিব্যক্তি বলছে,কিছু একটা বড়সড় হতে চলেছে সামনে।”
অ্যাকুয়ারা এক গ্লাস রক্তরঙা পানীয় তুলে নিয়ে বলল, “রাজনীতি আর রাজকীয় কূটকৌশল,সবই তো চলবে।কিন্তু আমি বাজি ধরে বলতে পারি,প্রিন্স সহজে হাল ছাড়বে না।”
এদিকে এথিরিয়ন ঠোঁটে চেপে থাকা মৃদু হাসি লুকিয়ে বলল, “বাবার মুখের দিকে তাকাও।এমন মনোভাব আমি আগে কখনো দেখিনি,তার চোখে স্পষ্ট চিন্তার ছাপ।”
ড্রাকোনিস সত্যিই অন্য সবার থেকে আলাদা ছিল।তার মুখে চিন্তার রেখা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।তার চোখ গভীর আর ভ্রু সামান্য কুঁচকে আছে।তিনি জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ,যেন তার প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করছেন।

রাজা জারেন,অন্যদিকে,সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সিংহাসনে বসে ছিলেন।তার চোখে কোনো অবাক হওয়ার চিহ্ন নেই। যেন সবকিছুই তার পরিকল্পনার অংশ।তিনি এক হাতে রাজকীয় লাঠি ধরে সবার দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বললেন,“এই ঘটনা আমাদের সবার জন্য আশীর্বাদ।আমরা প্রাসাদের হারানো উত্তরাধিকারীকে ফিরে পেয়েছি।এবার সবকিছু ঠিকঠাক হবে।”

তবে তার এই কথার পরেও দরবারজুড়ে অস্বস্তির বাতাস রয়ে গেল।একপাশে অ্যালিসা আর সিলভা ক্রোধে ফুঁসছিল, আর অন্যদিকে থারিনিয়াস,আলবিরা অ্যাকুয়ারা,আর এথিরিয়ন দৃশ্যটা উপভোগ করছিল।
ড্রাকোনিস চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন,কিন্তু তার মনে একাধিক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল।আর জ্যাসপারের চোখ তখনও ফিওনার চলে যাওয়ার পেছনে স্থির।তার হৃদয়ের গভীরে এক অস্থিরতা বারবার ধাক্কা দিচ্ছিল।

ডাইনিং টেবিলের চারপাশে রাজপরিবারের সদস্যরা সবাই উপস্থিত।টেবিলজুড়ে সাজানো হয়েছে রাজকীয় খাবারের বাহার—হরেক রকমের মাংস,নানারকমের ফলের মিষ্টান্ন আর পাশে রক্তের মতো লাল ওয়াইনের গ্লাস। আলো-আঁধারির এই পরিবেশে যেন এক নিখুঁত চিত্রকল্প তৈরি হয়েছে।কিন্তু এই জমকালো পরিবেশের মাঝেও কারও মুখে স্বাভাবিক আনন্দের ছাপ নেই।সকলেই নিঃশব্দে খাবার খাচ্ছে,কেউ কেউ একে অপরের দিকে সন্দেহমিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।ডাইনিং টেবিলের চারপাশে তখন নীরবতা। অ্যালিসা রাগে আগেই কক্ষ ত্যাগ করেছে, কিন্তু সিলভা যায়নি। তার স্থির সিদ্ধান্ত—এথিরিয়ন যেখানে আছে, সে ওকে একা রেখে যাবে না। তাই সবার চোখ এড়িয়ে সে ধীর পায়ে এসে এথিরিয়নের ঠিক পাশের চেয়ারটায় বসে পড়লো।

এথিরিয়ন চেয়ারের নড়াচড়া আর সিলভার উপস্থিতি অনুভব করেই বুঝতে পারলো, কে এসে বসেছে। ভেতরে ভেতরে তার বিরক্তি ক্রমশ বাড়ছিল। সিলভার এই ধরণের জেদ আর নিজের উপস্থিতি জাহির করার অভ্যাস তাকে বরাবরই অস্বস্তিতে ফেলে। তবে সে মুখে কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো না। ঠোঁটের কোণে হালকা নিরপেক্ষ হাসি ধরে রেখে সে নিজের মনোযোগ সামনে থাকা পানীয়ের দিকে কেন্দ্রীভূত রাখলো।
সিলভা ধীরে ধীরে কথা শুরু করলো, তবে গলায় একধরনের কৌশলী মাধুর্য মেশানো। “এথিরিয়ন, তুমি কেমন করে এতোটা স্থির থাকতে পারো? এতকিছুর মাঝেও যেন তোমার ওপর কোনো প্রভাব পড়ে না। সত্যি বলতে, এই গুণটা কিন্তু বিরল।”

এথিরিয়ন পানীয়ের গ্লাস হাতে তুলে নিয়ে চোখে চোখে রাখলো না। কেবল হালকা স্বরে বললো, “বহু অভিজ্ঞতা মানুষকে স্থির থাকতে শেখায়। তবে তুমি কি এই নীরবতা উপভোগ করছো?”
সিলভা একটু হেসে বললো, “তোমার নীরবতাকে উপভোগ করা তো আমার কাছে অভ্যাস হয়ে গেছে। কিন্তু কখনো ভেবেছো, এই নীরবতার মাঝেই কতকিছু লুকিয়ে থাকে?”
এথিরিয়ন এবার গ্লাস নামিয়ে তাকালো সিলভার দিকে। তার চোখে একধরনের সতর্কতা, যেন সে বোঝাতে চাইছে, সিলভা যতই ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করুক, তার সীমানা অতিক্রম করার অধিকার কেউ পাবে না। “সত্যিই? তাহলে নীরবতায় লুকিয়ে থাকা কথাগুলো তুমি কি জানো, সিলভা?”
সিলভা একটু থমকে গেলেও হাল ছাড়লো না। “আমি জানি, এথিরিয়ন।তবে আমি চাই,তুমি নিজেই একদিন আমাকে বলো। কারণ তোমার কথা শুনতেই ভালো লাগে।”
এথিরিয়ন মুখে একটুকরো হাসি আনলো,তবে তার চোখে কোনো উষ্ণতা নেই

ফিওনা নিজের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিল। নরম বালিশে মাথা রেখে চুপচাপ শুয়ে থাকা তার ক্লান্ত চেহারায় যেন সমস্ত অস্থিরতার ছাপ ফুটে উঠেছে।তার মাথার পাশে বসে ছিলেন তার মা লিয়ারা।এক হাত দিয়ে ফিওনার চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে তিনি মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলেন,“এখন কেমন লাগছে,ফিওনা?”
ফিওনা চোখ খুলে ধীরে ধীরে উঠে বসল।তার মায়ের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।লিয়ারা তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলো,ফিওনার মনে কিছু বলার আছে।তিনি ধৈর্য ধরে ফিওনার মুখ থেকে কথা শোনার অপেক্ষায় থাকলেন।

“মা…” ফিওনার কণ্ঠটা ভাঙা ভাঙা শোনাল।“আমি তোমাকে একটা কথা বলিনি।”
লিয়ারা কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে ফিওনার হাত ধরে বললেন,“কী কথা,মামনি?বলো।”
ফিওনা একটু দম নিয়ে বলল,“আমার গ্র্যান্ডপা আমাকে এখানে আসার আগে বলেছিলেন… প্রিন্স জ্যাসপার অরিজিনের সঙ্গে আমার ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল।
কিন্তু সে আমার মেমোরি রিমুভ করে দিয়েছে।”
লিয়ারার চোখ বড় হয়ে গেল।“তুমি কী বলছ,ফিওনা?”
ফিওনা একদৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে বলল,“গ্র্যান্ডপা বলেছিলেন,আমি আর ওই প্রিন্স একে অপরকে ভালোবাসতাম।কিন্তু সে আমাদের সবকিছু ভুলে যেতে বাধ্য করেছে।আমার সমস্ত স্মৃতি রিমুভ করেছে,যেন আমি তার অস্তিত্বই ভুলে যাই।”

লিয়ারা স্তব্ধ হয়ে গেলেন।তার মনের ভেতর নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে শুরু করল।“এত বড় সত্যি যদি হয়,তবে কেন জ্যাসপার এমন করল?আর কেনই-বা গ্ৰান্ডপা এমন কথা বললেন?”
লিয়ারা গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়লেন।তিনি বুঝতে পারলেন,এই সত্যিটা যদি প্রকাশ পায়,তবে রাজ্যের পরিবেশ আরও জটিল হয়ে উঠবে।তার কন্যার জীবন যে কতটা কঠিন হতে চলেছে,তা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।
ফিওনা মৃদু গলায় বলল,“মা,তুমি বলো,এটা কি সত্যি হতে পারে?”
লিয়ারা শান্তভাবে ফিওনার মাথায় হাত রেখে বললেন,
“আমি জানি না,মা।তবে আমি এটুকু জানি,তোমার জীবনে যা-ই ঘটুক না কেন,আমি তোমার পাশে থাকব।তুমি শুধু স্ট্রং হয়ে থেকো।” ফিওনার চোখে জল এসে গেল।সে তার মায়ের কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে রইল।

ডাইনিং টেবিলে আলো-আঁধারিতে সোনালী ঝাড়বাতির আলো প্রতিফলিত হচ্ছিল। তখন ওপরিবেশটা নিস্তব্ধ,তবুও একটা চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে ছিল চারপাশে।ফিওনা ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো।পুর্বের গাউন পাল্টে নিয়েছে।এখন তার পরনে ছিল হালকা রঙের একটি গাউন যা তার ত্বকের উজ্জ্বলতাকে আরও বেশি ফুটিয়ে তুলেছিল। তার চলাফেরা যেন আত্মবিশ্বাস আর অভিজাত্যের মূর্ত প্রতীক।

লিয়ারার সাথে ফিওনা গিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসল।প্রায় সবাই ইতোমধ্যে নিজেদের জায়গা নিয়েছে।ফিওনা এক মুহূর্তের জন্যও জ্যাসপারের দিকে তাকালো না।তার চোখ সরাসরি গিয়ে পড়লো ড্রাকোনিসের দিকে।ড্রাকোনিস তখন শান্ত ভঙ্গিতে ওয়াইনের গ্লাস হাতে বসে ছিল।কিন্তু ফিওনার চোখে যেন ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠল।
ফিওনা নিজের অনুভূতিকে লুকানোর কোনো চেষ্টাই করলো না।সে ইচ্ছে করে পায়ের ওপর পা তুলে বসল,যেন তার উপস্থিতি সবাইকে বুঝিয়ে দেয়।রাজকীয় শিষ্টাচার রক্ষা করা তার কাছে তুচ্ছ।ড্রাকোনিসের দিকে সে এমন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো,যেন তার চোখ দিয়ে বিদ্রূপ ছুঁড়ে দিচ্ছে।তার মুখে ছিলো এক ধরনের চ্যালেঞ্জের ছাপ।
জ্যাসপার পাশ থেকে ফিওনাকে লক্ষ্য করছিল।তার চোখ এক মুহূর্তের জন্যও ফিওনার উপর থেকে সরেনি।ফিওনার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি,তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি,এমনকি তার চুপচাপ থাকা—সবকিছুই যেন জ্যাসপারকে এক অদৃশ্য টানে তার দিকে আকৃষ্ট করছিল।কিন্তু সে বুঝতে পারছিল না,ফিওনা হঠাৎ ড্রাকোনিসের প্রতি অসম্মান কেনো প্রদর্শন করছে।

ফিওনা তখন প্লেটে খাবার তুলে নিল।খাবার খেতে খেতেও তার দৃষ্টি মাঝে মাঝে ড্রাকোনিসের দিকে চলে যাচ্ছিল।তার চোখে স্পষ্ট এক প্রশ্ন ফুটে উঠছিল—“আপনি কেন আমার আর আমার মায়ের জীবনে এত কিছু করেছেন?আমার মাকে অনেক কষ্টে দেখেছিলেন কেনো?”
ড্রাকোনিস বুঝতে পারছিল ফিওনার দৃষ্টি তাকে বিদ্ধ করছে। কিন্তু সে নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে রইল।তার মুখের এক কোণায় এক ধরনের অদ্ভুত অভিব্যক্তি ফুটে উঠছিল,যেন সে ফিওনার ক্রোধকে তুচ্ছজ্ঞান করছে।
এদিকে,জ্যাসপার নিজের ভেতরে এক অজানা অস্থিরতা অনুভব করছিল।সে ফিওনাকে লক্ষ্য করতে করতে নিজের মনেই ভাবল,“ও কী এতটাই বদলে গেছে?নাকি ওর এই আচরণের পেছনে কোনো গভীর ব্যাথা প্রকাশ পাচ্ছে?”

এই নীরব যুদ্ধের মাঝেই চারপাশে সবার খাবার খাওয়া চলতে থাকল।কিন্তু টেবিলজুড়ে চাপা টানটান পরিবেশ এত ঘনীভূত হয়ে উঠছিল যে, মনে হচ্ছিল কেউ একটুও শব্দ করলেই সবকিছু ভেঙে পড়বে।
ডাইনিং টেবিলে রাজকীয় ভোজের আয়োজন জমে উঠেছে। টেবিলে জমকালো পাত্রে সাজানো খাবারের মধ্যে হঠাৎ ফিওনার চোখ পড়লো এক অদ্ভুত ফলের ওপর। সোনালী-সবুজ রঙের মসৃণ চামড়ার ফলটি দেখতে বেশ আকর্ষণীয়,কিন্তু ফিওনা কখনো এমন কিছু দেখেনি। কৌতূহলের বশে সে ফলটি তুলে নিল হাতে।
ফলের গা স্পর্শ করার সাথে সাথেই ফিওনার মনে হলো এটি অন্যরকম—শীতল,কিন্তু মসৃণ ও নরম।সে একবার টেবিলের দিকে তাকালো।অন্যদের কেউ সেই ফল খাচ্ছে কি না খেয়াল করার চেষ্টা করল,কিন্তু কেউই তার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে না।
ফিওনার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল।কীভাবে এটি খেতে হয়, তা সে জানে না।ফলটি কি চামড়া ছাড়িয়ে খেতে হয়?নাকি সরাসরি কাটা হয়?যদি ভুল করে কিছু করে ফেলে,তবে সবাই কি হাসবে?তার মনে একধরনের সংকোচ বোধ দেখা দিল।

তখনই জ্যাসপার এক পাশে বসে তার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি গভীরভাবে লক্ষ্য করছিল।ফিওনার দ্বিধাগ্রস্ত মুখ দেখে সে বুঝতে পারল কী ঘটছে।এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করেই সে তার নিজের সামনের বাটি থেকে ওই ফলের আরেকটি তুলে নিল। তার লম্বা,চমৎকার আঙ্গুল দিয়ে দক্ষতার সাথে ফলটির খোসা ছাড়াতে শুরু করল।
ফলের সুমিষ্ট গন্ধ মুহূর্তেই টেবিলের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। জ্যাসপার নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে খোসা ছাড়িয়ে,এক টুকরোও খালি না ফেলে,পরিপাটি করে ফলটি ফিওনার প্লেটে দিয়ে দিল।
ফিওনা অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো তবে সাথে সাথে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো।সে নিজেকে সামলে নিল।মুখে কিছু না বলেই প্লেটে রাখা ফলটির দিকে তাকিয়ে রইল।তার হৃদয় ভেতরে ভেতরে কাঁপছিল,যেন অদ্ভুতভাবে এই ছোট ঘটনাটাও তার মনে এক গভীর অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছে।

জ্যাসপার তখন ঠাণ্ডা স্বরে বলল,যেন ঘটনাটি একদম সাধারণ, “এটা এভাবেই খেতে হয়।এটার নাম ‘লুমিসেলা’!
ফিওনা তাকে কোনো উত্তর দিল না।কিন্তু তার হৃদয়ের গভীরে অদ্ভুত এক উষ্ণতা অনুভব করল।এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো,জ্যাসপারের এই ছোট আচরণ যেন তাকে অজান্তেই সুরক্ষার একটা অনুভূতি দিচ্ছে।
টেবিলের অন্যরা কেউ এই ছোট্ট ঘটনায় মনোযোগ দিল না। তবে ড্রাকোনিসের চোখের কোণে এক কঠিন অভিব্যক্তি ফুটে উঠল।সে জ্যাসপারের দিক থেকে চোখ সরিয়ে,নীরবে খাবারে মন দিল।
ফিওনা ধীরে ধীরে ফলটি খেতে শুরু করল।এটি ছিল নরম, রসালো,আর একেবারে অদ্ভুত মিষ্টি স্বাদের।তার মনে হলো এমন কিছু সে আগে কখনো খায়নি।তবে এই নতুন স্বাদের চেয়েও বেশি ওজন ছিল তার ভেতরের সেই প্রশ্নের,যা সে এড়িয়ে যেতে পারছিল না।

ফলের প্রতিটি কামড়ে তার চোখ যেন জ্যাসপারের দিকে চলে যাচ্ছিল,তবে সরাসরি চোখে তাকানোর সাহস নেই।
মুখের দিকে তাকিয়েই সে ভাবতে লাগল,এই ড্রাগন প্রিন্সটা,যে মুহূর্তে তার সমস্যার সমাধান করল,কীভাবে এত স্বাভাবিক আর নির্লিপ্ত থাকতে পারে?
মনে মনে সে নিজেকেই প্রশ্ন করল,“আমি কি সত্যিই এই প্রিন্সকে ভালোবেসেছিলাম?”
এই প্রশ্নটি যেন তার মস্তিষ্কে জ্বলতে থাকা এক আগুনের মতো।যদি সত্যিই ভালোবেসে থাকি,তবে কেন তাকে মনে নেই?আর যদি কিছুই না থাকে,তবে কেন এই অদ্ভুত হৃদয়ের ধুকপুকানি,কেন তার দিকে তাকালেই বুকের ভেতর এমন শূন্যতা আর আকর্ষণ তৈরি হয়?
তার মনে পড়ে গেল গ্ৰান্ডপার সেই কথাগুলো—“তোমার আর জ্যাসপারের একসময় গভীর সম্পর্ক ছিল।তবে সে তোমার মেমোরি রিমুভ করেছে।”
ফিওনার মন যেন ভেঙে পড়ল।“কেন করবে সে এমনটা?যদি সত্যি সে ভালোবাসত,তবে কীভাবে সে এমন নির্মম কাজ করতে পারল?”
ফল কামড়ে খাওয়ার সাথে সাথে তার ভেতরের এই দ্বন্দ্ব আরও গভীর হচ্ছিল।সে মনে মনে স্বীকার করল,এই প্রিন্সের দিকে তাকালে তার মনের কোণে একটা গভীর টান অনুভব হয়।অথচ এই টান কীসের,কেন,সে নিজেও জানে না।

সে আবার নিজের মনে বলল,“যদি ভালোবাসতাম,তবে সেটা কি সত্যিই মুছে ফেলা সম্ভব?ভালোবাসা কি এতই দুর্বল যে স্মৃতি মুছে দিলেই তা শেষ হয়ে যায়?”
জ্যাসপার তখনও নিজের জগতে,খাবার খেতে খেতে চুপচাপ ফিওনার দিকে নজর রাখছিল।তার চোখে একটা অস্পষ্ট উত্তেজনা,যেন সে ফিওনার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি পড়ার চেষ্টা করছে।
ফিওনা তার মন থেকে এই সমস্ত প্রশ্ন দূরে ঠেলে দিয়ে শেষমেশ নিজেকে বলল,“আমাকে এসব ভাবা বন্ধ করতে হবে।যদি কিছু ছিলও,তবে সেটা এখন নেই।আমি শুধু আমার জীবনটা নিজের মতো করে এগিয়ে নিয়ে যাব।”
তবু তার হাতের ফলটি শেষ হতে হতে,মনের মধ্যে অজান্তেই এক শব্দ আবার ভেসে এল—”প্রিন্স।”

ডাইনিংয়ের পরে সোনালি ঝাড়বাতির আলোয় ভরা বিশেষ কক্ষে সবাই একে একে জড়ো হলো।বড়সড় রাজকীয় টেবিলের চারপাশে বসেছে ড্রাকোনিস,রাজা জারেন, অ্যালিসা,সিলভা,এথিরিয়ন আর প্রাসাদের অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব।কিন্তু এই মুহূর্তে ফিওনার কোনো উপস্থিতি নেই।
ড্রাকোনিস গম্ভীর মুখে রাজা জারেনের দিকে তাকিয়ে বললেন,“যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা উচিত।অ্যালিসা আর জ্যাসপারের বিয়ে দু’টি রাজ্যের মৈত্রী আরও দৃঢ় করবে।”
রাজা জারেন মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।তিনি শান্ত কণ্ঠে বললেন,“আমিও তাই ভাবছি।এনগেজমেন্টটা এই সপ্তাহের মধ্যেই করা যাক।বিয়ের তারিখ নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করতে পারি।”
কথাগুলো শুনে জ্যাসপারের ভেতরে যেন আগুন জ্বলে উঠল।সে শান্ত থাকতে চেষ্টা করলেও,তার চোখে-মুখে এক ধরনের অসন্তোষ স্পষ্ট হয়ে উঠল।

অ্যালিসা,যে এতক্ষণ চুপ ছিল,তার ঠোঁটের কোণে এক গর্বিত হাসি ফুটে উঠল।সে ভাবছিল,তার পরিকল্পনাগুলো সফল হতে চলেছে।তবে জ্যাসপারের সেই দৃষ্টির চাহনি তাকে কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলে দিল।
হঠাৎই,জ্যাসপার গম্ভীর কণ্ঠে বলল,“আমি অ্যালিসার সঙ্গে একটু একান্তে কথা বলতে চাই।”
কথাটা শুনে কক্ষ জুড়ে এক মুহূর্তের নীরবতা নেমে এলো। ড্রাকোনিসের কপালে ভাঁজ পড়ল।তিনি ধীর গলায় বললেন, “তার প্রয়োজন নেই। যা বলার,এখানে সবার সামনেই বলো।”
তবে রাজা জারেন জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে একঝলক হাসলেন। “আমার মতে,এটাতে কোনো সমস্যা নেই।ওদের নিজেদের মধ্যেও কিছু কথা বলার অধিকার থাকা উচিত।”
অ্যালিসা মুখে মিষ্টি হাসি এনে বলল,“আমি তো এমন প্রস্তাবের অপেক্ষাতেই ছিলাম,প্রিন্স।”

ড্রাকোনিস কিছু বলতে যাচ্ছিলেন,কিন্তু রাজা জারেন তার হাতে ইঙ্গিত করে থামিয়ে দিলেন।তিনি সায় দিয়ে বললেন, “ঠিক আছে,তুমরা দু’জনে কথা বলো।তবে বেশি সময় নেবে না।সিদ্ধান্তগুলো দ্রুত নিতে হবে।”
জ্যাসপার কোনো উত্তর দিল না,শুধু মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল। তার চোখে ছিল অনড় এক অভিব্যক্তি।
অ্যালিসা নিজের গাউনের পাড় সামলে উঠে দাঁড়াল।মনে মনে সে বিজয়ের স্বাদ পেতে শুরু করেছিল।তার বিশ্বাস,এই কথোপকথনের পর জ্যাসপার আর কিছুতেই তার থেকে দূরে থাকতে পারবে না।
ড্রাকোনিস ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে জ্যাসপারের দিকে তাকালেন,কিন্তু মুখে আর কোনো আপত্তি করলেন না।তার চোখে এক ধরনের উদ্বেগ ছিল,যেন তিনি আগাম কোনো বিপদের আঁচ পাচ্ছেন।

জ্যাসপার আর অ্যালিসা বিশেষ কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। তাদের চলে যাওয়ার পর,ড্রাকোনিস দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের আসনে বসে রইলেন।তার মনে যেন কিছু একটা অজানা শঙ্কা ভর করল।
রাজা জারেন ড্রাকোনিসের দিকে তাকিয়ে বললেন,“ওদের একটু নিজের মতো থাকতে দাও,ড্রাকোনিস।তুমি জানো তো, কখনো কখনো এ ধরনের কথোপকথন সম্পর্কের জন্য জরুরি হয়।”
ড্রাকোনিস এক মুহূর্ত রাজা জারেনের কথার উত্তর দিলেন না।তার চোখ তখনও দরজার দিকে আটকে ছিল,যেন তিনি বোঝার চেষ্টা করছিলেন,ওই দরজার ওপাশে ঠিক কী ঘটতে চলেছে।
বারান্দার একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে অ্যালিসা তার গাউনের পাড় সামলাতে সামলাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল,কিন্তু তার মনে চলছিল তীব্র এক ঝড়।আর ঠিক তখনই,জ্যাসপার তার শক্ত পায়ের শব্দ করে ধীর পদক্ষেপে তার কাছে এলো।তার মুখে ছিল দৃঢ়তা আর চোখে অনড় এক অভিব্যক্তি।

জ্যাসপার এক মুহূর্ত সময় নিল।তারপর সরাসরি বলল, “অ্যালিসা,তুমি ভালো করেই জানো আমি ফিওনাকে ভালোবাসি।আমার হৃদয়,আমার সমস্ত অস্তিত্ব,সবকিছু শুধু তার জন্যই।এটা নতুন কিছু না, ্বরং বহুদিন ধরেই তুমি এটা জানো।”
অ্যালিসা তার কথা শুনে মৃদু হাসল,কিন্তু সেই হাসিতে কোনো উষ্ণতা ছিল না।বরং তাতে ছিল এক ধরনের গোপন কষ্ট আর অভিমান।
জ্যাসপার তার চোখ থেকে এক মুহূর্ত দৃষ্টি সরাল না।সে আরও বলল,“তুমি যদি ভেবে থাকো,ফিওনা এখানে আছে বলে আমি এই বিয়েতে রাজি হচ্ছি না,তাহলে ভুল ভাবছ। ফিওনা এখানে না থাকলেও আমি তোমাকে এই কথাগুলোই বলতাম।কারণ আমি জানি,আমার হৃদয় কখনোই তোমার জন্য স্পন্দিত হবে না।তুমি আমার থেকে কখনো ভালোবাসা পাবে না,অ্যালিসা।আর শুধু তাই নয়,কোনো দাম্পত্য মিলনও পাবে না।”
অ্যালিসা এবার পুরোপুরি তার দিকে ফিরে দাঁড়াল।তার চোখে ছিল আহত অথচ রাগান্বিত এক চাহনি।তার ঠোঁট কাঁপছিল,কিন্তু সে চুপ করে থাকল।

জ্যাসপার এবার একটু ঝুঁকে এসে বলল,“তুমি যদি আমাকে বিয়ে করো,তবে জেনে রাখো,তুমি নিজের জীবনকেই ধ্বং*স করবে।আমি কখনোই তোমাকে সুখী করতে পারব না।আর যদি তুমি সাহস করে এই সম্পর্কটাকে সবার সামনে না করতে চাও,আমি সেটাকেই সম্মান জানাব।তবে সিদ্ধান্ত তোমার।”
অ্যালিসা এবার ঠোঁট কামড়ে নিজের রাগ সামলানোর চেষ্টা করল।তার কণ্ঠ ভাঙা ভাঙা শোনাল,“আপনি কি জানেন প্রিন্স,এই বিয়ে আমার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ?এটা শুধু আমাদের দুই রাজ্যের জন্য নয়,আমার নিজের সম্মানের জন্যও।আপনি কি একবারও ভেবেছেন,আমি এই অসম্মান সহ্য করব কীভাবে যেখানে অনেক আগে থেকেই আমাদের বিবাহের সফটওয়্যার ম্যাচ করা ছিলো?”

জ্যাসপার শান্ত গলায় বলল,“অ্যালিসা,তুমি ভালো করেই জানো আমার কাছে এসব সফটওয়্যার জনিত বিয়ে প্রেম কোনোটারই মানে নেই।আমি যা বলছি তা মেনে নিতে তোমার কষ্ট হবে,আমি জানি।কিন্তু মিথ্যে সম্পর্ক নিয়ে জীবন কাটানোর চেয়ে সত্যকে মেনে নেওয়া অনেক ভালো। নিজেকে এতটা কষ্ট দিও না।”
অ্যালিসা এবার চোখ নামিয়ে ফেলল।তার মনের ভেতরে যেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল।বারান্দার ঠান্ডা বাতাস তার চুলের গোছাগুলো এলোমেলো করে দিল,আর সে এক মুহূর্তের জন্য জ্যাসপারের চোখে তাকাল।
“তাহলে আমি কী করব প্রিন্স?”অ্যালিসা ধীরে ধীরে বলল। তার কণ্ঠে ছিল ক্লান্তি আর হতাশা।
জ্যাসপার এক পা পেছনে সরিয়ে বলল,“বাকি সিদ্ধান্ত তোমার।তুমি চাও,তো আমাকে বিয়ে করো আর নিজের জীবন নষ্ট করো।আর যদি সত্যকে মেনে নিতে পারো,তাহলে সবার সামনে সাহস করে এই বিয়েতে না করো।”
একটা দীর্ঘ নীরবতা নেমে এলো।অ্যালিসা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল,আর জ্যাসপার নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে চলে গেল বারান্দা থেকে।পেছনে থেকে গেল এক গুমোট পরিবেশ,আর অ্যালিসার হৃদয়ে জমা হলো একরাশ অপূর্ণতা আর ক্রোধ।

অ্যালিসা বারান্দা থেকে কক্ষে প্রবেশ করতেই উপস্থিত সবাই তার দিকে তাকালো।তার মুখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা।চোখেমুখে হতাশা ও রাগ মিশে থাকলেও সেটা যেন এক চতুর মুখোশের আড়ালে ঢাকা পড়েছিল।
সে সোজা রাজা জারেনের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “বাবা,দর্জিদের খবর পাঠাও।পোশাক বানানোর কাজ শুরু করতে হবে।এনগেজমেন্ট আর বিয়ের প্রস্তুতি যেন সময়মতো শেষ হয়।”
কক্ষের ভেতর মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধতা নেমে এলো।কেউই এই কথা শোনার পর কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে বুঝতে পারছিল না।

ড্রাকোনিস চোখ সরু করে জ্যাসপারের দিকে তাকাল।মনে হচ্ছিল,তার মনের ভেতরে কিছু একটা উথালপাথাল করছে। কিন্তু রাজা জারেন স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বলল, “তোমার ইচ্ছাই প্রাধান্য পাবে,মাই প্রিন্সেস অ্যালিসা।আমি দর্জিদের দ্রুতই খবর পাঠাব।”
জ্যাসপার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ অ্যালিসার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।তার মনে হচ্ছিল,এতক্ষণ যা কিছু বলল,তার কোনো প্রভাবই পড়েনি অ্যালিসার ওপর।তার ভেতর তীব্র এক অস্থিরতা কাজ করছিল।
জ্যাসপার এবার আর কোনো কথা না বলে দ্রুত কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।
ড্রাকোনিস এবার নিজের চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “তোমার সিদ্ধান্তে আমি অন্তত খুশি হয়েছি,খুব দ্রুত সবকিছু করতে হবে।”
অ্যালিসা মাথা নিচু করে কেবল বলল,”হ্যাঁ,আমি ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
কিন্তু তার ভেতরে চলছিল অন্য এক যুদ্ধ।অ্যালিসার মুখে দৃঢ়তার আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক গভীর কষ্ট।সে জানত, জ্যাসপার তাকে ভালোবাসবে না। তবু,তার অভিমান আর জেদ আর ফিওনার প্রতি ঈর্ষা তাকে এই বিয়েতে রাজি হতে বাধ্য করছিল।

জ্যাসপার দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সবার কথা শুনছিল।সে এবার বুঝতে পারল,অ্যালিসা এই বিয়েতে এখনো পুরোপুরি রাজি।তার হৃদয়ে এক অজানা ভার নেমে এলো।’অ্যালিসা আমার কথা শুনেও এমন সিদ্ধান্ত নিল কেন?’মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করল সে।কিন্তু কিছুই না বলে জ্যাসপার দ্রুত বেরিয়ে গেল,নিজের মনের এই জটিলতা থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে।
.
.
.
জ্যাসপাররা অবশেষে রাজপ্রাসাদ থেকে বিদায় নিয়ে এল্ড্র রাজ্যে ফিরে যাওয়ার জন্য রওনা হলো।বিদায় মুহূর্তে সবাই যেন নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল,রাজকীয় পরিবেশে একটি অদ্ভুত শূন্যতা নেমে এল।
অ্যালিসা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে রইল,তার মনে এক অদ্ভুত অস্বস্তি।অন্যদিকে ফিওনা নিজের কক্ষ থেকে পুরোটা চুপচাপ পর্যবেক্ষণ করছিল।
বিদায়ের পর অ্যাকুয়ারা একা ফিওনার কক্ষের দিকে এগিয়ে গেল।দরজায় কড়া নাড়তেই ফিওনা কিছুটা বিস্মিত হয়। দরজা খুলে দাঁড়াতেই অ্যাকুয়ারা তার হাসি মাখা মুখে বলল, “আমি অ্যাকুয়ারা।এল্ড্র রাজ্যের একজন ড্রাগন সদস্য,কিন্তু তোমার সাথে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছে হলো তাই এসেছি।”
ফিওনা একটু হেসে বলল, “তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালোই লাগলো,অ্যাকুয়ারা।”

অ্যাকুয়ারা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,”তুমি হয়তো ভাবছো, কেন আমি এখানে এলাম।আসলে,আমি চাই তুমি জানো যে প্রিন্স শুধুমাত্র এল্ড্র রাজ্যের প্রিন্স নন,তিনি একজন ভিন্ন হৃদয়ের ড্রাগন।আর তোমার উপস্থিতি এই ভেনাসের সব পাল্টে দিবে।”
ফিওনা মৃদু হাসল,তবে তার মনে তবুও সংশয় কাজ করছিল। অ্যাকুয়ারা বিদায় নেওয়ার আগে তার দিকে এক গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,”তুমি এই রাজ্যে নতুন,তবে তুমি যে প্রিন্সের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা হয়তো এখনো বুঝতে পারোনি।”
ফিওনা কিছু বলার আগেই অ্যাকুয়ারা নিচের দিকে এগিয়ে গেল।
শেষ পর্যন্ত জ্যাসপার ও তার সঙ্গীরা চলে গেলো।প্রাসাদ একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল।তবে ফিওনার মনের মধ্যে এক গভীর দোলাচল কাজ করতে থাকল।অ্যাকুয়ারার কথা যেন তার হৃদয়ে অজানা এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে গেল।

ফিওনা তখন তার কক্ষের জানালার ধারে বসে ছিলো,বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে।হঠাৎ দরজা খুলে তার মামা,রাজা জারেন,প্রবেশ করলেন।চোখে-মুখে স্পষ্ট বিরক্তি।তিনি কক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সরাসরি বললেন,
“ফিওনা,তুমি ড্রাকোনিস কে জানো?তিনি ভেনাসের কিং। তাঁর সামনে তুমি পায়ের ওপর পা তুলে বসলে!আর সেই সঙ্গে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলে কেনো?এটা কি রাজকীয় আচরণ?”
ফিওনা ধীরে ধীরে জানালা থেকে সরে এসে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।তার চেহারায় একধরনের কঠোরতা ফুটে উঠলো, যেন সে নিজেকে কোনোভাবে দুর্বল দেখাতে চায় না।শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে সে বলল, “হ্যাঁ,আমি জানি ড্রাকোনিস কে। পুরো ভেনাসের কিং।কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি তাঁকে ভয় পেয়ে নিজের সম্মান বিসর্জন দেবো।আমি যেমনটা অনুভব করি,তেমনটাই প্রকাশ করি।তিনি যদি আমার আচরণে অসন্তুষ্ট হন,সেটা তাঁর সমস্যা,আমার নয়।”

রাজা জারেন এত স্পষ্ট ও কঠিন উত্তর আশা করেননি।তাঁর কণ্ঠে কঠোরতা ফিরে এলো,”তুমি বুঝতে পারছো না তুমি কী বলছো,ফিওনা। ড্রাকোনিস এই রাজ্যের নিয়ম ও সম্মানের প্রতীক।তাঁর সামনে এমন আচরণ মানে পুরো ফ্লোরাস রাজ্যের মর্যাদার অবমাননা।তুমি একজন সাধারণ মেয়ে নও, তুমি এখন ড্রাগন।”
ফিওনা একধাপ এগিয়ে এলো।তার চোখে তীব্র আত্মবিশ্বাস। সে বলল, “মামা,সম্মান জোর করে অর্জন করা যায় না।আর আমি ফ্লোরাস রাজ্যের মর্যাদা নষ্ট করতে চাই না।কিন্তু ড্রাকোনিসের সামনে আমি নিজেকে ভয় পেয়ে ছোট করে তুলতে পারি না।যদি ভেনাসের রাজা হয়েও তিনি ড্রাগনদের মনের ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হন,তবে তিনি আমার কাছ থেকে কোনো সম্মান আশা করতে পারেন না।”
রাজা জারেন ফিওনার এমন তীক্ষ্ণ যুক্তিতে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে গেলেন।তিনি ধীরে ধীরে বললেন, “তোমার এই আচরণ শুধু তোমার জন্য নয়,আমাদের সবার জন্য বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে,ফিওনা।ড্রাকোনিস যা করার ক্ষমতা রাখেন, তার সামনে আমাদের কারো কোনো শক্তি নেই।তুমি যদি তাঁর রোষানলে পড়ো,পুরো ফ্লোরাস তার খেসারত দেবে।এটা মনে রেখো।”

ফিওনা ধীরে ধীরে রাগে ফুঁসতে লাগলো।রাজা জারেনের কথা শুনে তার চোখে জল চলে এলেও সে নিজেকে কোনোভাবে সামলে রাখলো।সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে,চোখে তীব্র ক্রোধ আর দুঃখ নিয়ে ফিওনা বলল,
“আমি তাকে ঘৃণা করি,আর আমিও আপনাকেও আমার মামা হিসেবে ভাবতে পারছি না।কিভাবে পারলেন নিজের বোনের সঙ্গে এমনটা করতে?আমি জানি,সবকিছু ওই রাজা ড্রাকোনিসের আদেশেই হয়েছে।আমার মাকে বন্দি করা হয়েছে গত ১৮ বছর ধরে।তিনি স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত এক অন্ধকার কারাগারে ছিলেন।কেন?শুধুমাত্র আমার বাবাকে ভালোবাসার অপরাধে?কারণ আমার বাবা একজন পৃথিবীর সাধারণ মান ছিলেন?”
ফিওনার কণ্ঠ আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো,আর তার চোখে যেন আগুন জ্বলছিল।সে এক পা এগিয়ে এসে আরও বলল,

“আপনারা কি জানেন,আমার মা আমার মুখ পর্যন্ত দেখতে পাননি আমি জন্মানোর পরে?তাকে এতটাই শাস্তি দেওয়া হয়েছে যে নিজের সন্তানের মুখটাও দেখতে পারেননি।আর আমার বাবা?তাকে শেষবারের মতো দেখার অধিকারটুকুও পাননি আমার মা।আমার মা কি এতটা অপরাধ করেছিলেন, যে এই শাস্তি তাঁর প্রাপ্য ছিলো?”
রাজা জারেন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।তিনি ফিওনার চোখের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিতে চাইলেন,কিন্তু পারলেন না।ফিওনার প্রতিটি কথা তাঁর হৃদয়কে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছিল।কিন্তু ফিওনা থেমে থাকলো না।তার ভেতরের সমস্ত জমে থাকা রাগ,দুঃখ,আর হতাশা যেন এবার বেরিয়ে এলো।
“ওই রাজা ড্রাকোনিস কি কোনোদিন এটা বুঝবে?তিনি সন্তানের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হননি,তাই এর মূল্যটা কখনো বুঝবেন না।আমার মাকে তাঁর নিজের পরিচয় থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে এতোটা বছর, আর আমাকে আমার সত্যিকারের পরিচয় থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।কিন্তু এবার সময় এসেছে।এবার তিনিও বুঝবেন,যন্ত্রণা কাকে বলে।”

ফিওনার চোখে ঝকঝকে অশ্রু ছিলো,কিন্তু তার ভেতরের শক্তি আর প্রতিজ্ঞা ছিলো অপরাজেয়।রাজা জারেন কিছুক্ষণ চুপ করে ফিওনার দিকে তাকিয়ে রইলেন।তাঁর মুখে কিছু বলার ভাষা ছিল না।ফিওনার প্রতিটি কথা যেন তাঁকে নাড়িয়ে দিয়েছে।দীর্ঘক্ষণ পর,গভীর এক শ্বাস নিয়ে তিনি শুধু বললেন,”ফিওনা,তুমি যা বললে,তা আমি বুঝি।কিন্তু সবকিছুর পেছনে একটা কারণ থাকে।সময় আসলে সবকিছু জানবে।”

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৪

তিনি ধীরে ধীরে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন।ফিওনা একা দাঁড়িয়ে রইলো।তার মুখে কঠোরতা,চোখে প্রতিজ্ঞা।জানালার বাইরে বৃষ্টি থেমে গিয়েছিলো,কিন্তু ফিওনার মনে ঝড় যেন আরও জোরে বইতে শুরু করলো।

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৬