আয়ুর প্রহর পর্ব ১৪

আয়ুর প্রহর পর্ব ১৪
তুশিতা নুর তৃষ্ণা

প্রণয় কে একটা বলিষ্ঠ হাত অনীতার রুমে ঠেলে দিল।প্রণয় অনীতার রুমে গিয়ে পড়লো।পা পিছলে দেয়ালে হাতে স্লিপ খেয়ে সোজা অনীতার বিছানার উপর।
অনীতা সাথে সাথে প্রণয়ের কাছে এলো।প্রণয় মাথা মাথা ঘুরিয়ে দাড়াতেই দেখলো,সামনে অনীতা দাঁড়িয়ে আছে।তার মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
অনীতা তটস্থ হয়ে বললো,
-“ আপনি ঠিক আছেন তো?কোথাও লাগেনি তো?”
এই বলে যখনি প্রণয়ের একটু কাছে যাবে,তখনি প্রণয় এক হাত উঁচু করে ইশারায় না করে দেয়।বলে,

-“ আমার জন্য এতটুকু ভেবেছো। এইটুকুই অনেকখানি অনি।আমি তো ভাবতাম তুমি আমার জন্য ভাবোই না।”
প্রণয়ের মুখে এমন কথা শুনে অনীতা মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো।আর কি বলবে সে।বলার কিইবা আছে।
স্বইচ্ছায় প্রণয়ের থেকে দূরে দূরে থাকলেও তার কাছাকাছি যাওয়ার অদম্য ইচ্ছে অনীতার। কিন্তু সেটা ইচ্ছে পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।কোনো চেষ্টা নেই। চেষ্টা করারও চেষ্টা নেই তার মধ্যে। শুধুমাত্র নিষ্পলক তাকিয়ে থাকা ছাড়া।সে জানে,এই সময়টায় প্রণয়ের কাছাকাছি থাকলে তার এই দিনগুলো বেশ ভালো যাবে। কিন্তু প্রণয়কে কিছু না বলে প্রণয়কে কিছুদিনের অনুভূতি দিয়ে সে হারাতে চায় না।যা হওয়ার হয়েছে।প্রণয়ের যতটুকু সঙ্গ পাওয়ার সে পেয়েছে।প্রণয়ের সাথে কাটানো সময়গুলোকে প্রণয় স্মৃতিস্বরূপ রেখে একা বাঁচুক,তা চায় না অনীতা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তার ও তো ইচ্ছে করে প্রণয়ের বুকে মাথা রাখতে।সে প্রণয়ের বুকে মাথা রাখবে,প্রণয় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবো। দারুন একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি হবে তখন। কিন্তু এই দৃশ্যটা অনীহা শুধুমাত্র কল্পনায়ই আঁকে।বাস্তবজীবনে তা আদৌ পূরণ হবে কি?হয়তো হ্যাঁ কিংবা না।
অনীতা কিছু বলে না।চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে।তখনি তার রুমের জানালায় আবার ঠকঠক আওয়াজ হয়।অনীতা আর প্রণয় একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে।তারা বুঝে উঠতে পারে না এই মুহুর্তে কি করা উচিত।অনীতা প্রণয়ের একটু কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
-“ এখন কি করবো।”

প্রণয় নিজের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারায় অনীতাকে চুপ থাকতে বলে।তারপর নিজেও ফিসফিসিয়ে বলে,
-“ একটু অপেক্ষা করো।দেখো আর কতোক্ষণ নক করে।”
কিন্তু বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না।তখনি অনীতার ফোনে একটা কল এলো। নাম্বারটা দেখেই অনীতা বুঝতে পারলো এটা আয়ুশের নাম্বার।তাই সাথে সাথে রিসিভ করলো।আয়ুশ বললো,-“ জানালার বাইরে আমি।জানালা খোল।”
আয়ুশের তীক্ষ্ণ শ্রবণশক্তি সিঁড়িতে মিস্টার শামসুজ্জামান এর পায়ের আওয়াজ এড়াতে পারেনি।সে স্পষ্ট শুনেছে,কেউ সিঁড়ি দিয়ে ধপধপ করে নামছে।পায়ের আওয়াজ শুনে মানুষটা কে তা চিনতে আয়ুশের আর দেরী হলো না। এমন করে একজনই হাটে।মিস্টার শামসুজ্জামান।হয়তো তিনি এখন নিচে আসছেন।এসে দেখবেন,কে গু’লি খেয়েছে।
আয়ুশ ঝোপের পাশে কিছু কলাগাছ পড়ে থাকতে দেখলো।রাতে প্রবল বৃষ্টির কারণে হয়তো কলাগাছ ভেঙে গিয়েছে।আয়ুশ দুইটা কলাগাছ নিয়ে অনীতার রুমের জানালার কাছাকাছি রাখলো।যেন প্রথম দেখায় কেউ বুঝে হয়তো কোনো মানুষ পড়ে আছে।

তারপর বাড়ির যে দিক থেকে ঘুরে পিছনে আসতে হয়,ওইদিকে কিছু ছোট আর মাঝারি সাইজের ইট রাখলো।
একটা বড় ইট রেখে কয়েকটা কলাপাতা ছিঁড়ে ইটটাকে এমনভাবে চাপা দিল,যেন সহজে কারো চোখে না পড়ে।এমনভাবে সবকিছু রাখলো যেন এই রাতের অন্ধকারে লাইট দিয়েও কারো চোখে না পড়ে।
আয়ুশ এখন এইভাবে বাইরে মিস্টার শামসুজ্জামানের কাছে ধরা খেতে চায় না।সে আগে তার কেস সলভ করতে চায়।তাই সে অনীতার জানালায় আস্তে করে ঠকঠক আওয়াজ করলো।
একটু সময় আওয়াজ করার আয়ুশ বুঝলো অনীতা এমনভাবে আওয়াজ পেলে ভয় পাবে।সহজে জানালা খুলবে না।তাই সে অনীতাকে জানালা খোলার জন্য কল দিল।
অনীতা জানালা খোলার পর আয়ুশ রুমের ভিতরে ঢুকলো।ঢুকেই দেখলো বিছানার পাশে প্রণয় দাঁড়িয়ে আছে।আয়ুশকে দেখে প্রণয় মাথা নিচু করে রইলো। কিছুটা লজ্জায়, কিছুটা দ্বিধায়।
প্রণয়ের মাথা নিচু দেখে আয়ুশ কিছুটা বুঝতে পারলো।প্রণয়ের হাতে পাওয়া আঘাত আয়ুশের দৃষ্টিগোচর হলে সে প্রণয়ের সামনে গিয়ে প্রণয়ের হাত ধরে স্বাভাবিক গলায় বললো,

-“ সে কি ব্রো!তোমার হাত তো অনেকখানি ছিলে গিয়েছে।
প্রণয় মাথা উঠিয়ে মৃদু হেসে বললো,
-“ সেটা তেমন কিছু না।”
আয়ুশ বললো,
-“ তা বললে তো হবে না ব্রো।আমি দেখেছি তুমি কতোটা ব্যাথা পেয়েছো।এখন তুমি বিছানায় বসলো একটু।” বলেই প্রণয়কে বিছানায় বসিয়ে দিলো আয়ুশ। সাথে নিজেও বসে পড়লো।
তারপর অনীতার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“ স্যাভলন আছে অনী?”
-“ হ্যাঁ আছে!”
-“ স্যাভলন দে আর লাইট অফ ডিমলাইট জ্বালিয়ে চুপ করে বসে থাক।আওয়াজ করিস না।যা কথা,পরে বলবো।আমি কথা বলার আগে কোনো কথা বলবি না।”

অনীতা মাথা নেড়ে সায় জানালো।
মিস্টার শামসুজ্জামান রাতে পলাশের জন্য অপেক্ষা করতে করতে জেগেই ছিলেন। হঠাৎই তিনি ব্যালকনিতে আসেন।দেখতে পান একটা ছেলে পাঁচিল টপকে নিচে নেমে বাড়ির ভিতরে ঢুকছে।দূর থেকে দেখার কারণে তিনি ছেলেটিকে ভালো করে চিনতেও পারছিলেন না। বুঝতে পারছিলেন না কে হতে পারে।
চোর বা ডা’কাত ভেবে নয় কোনো গুপ্তচর হতে পারে এই ভেবে মিস্টার শামসুজ্জামা তাড়াহুড়ো করে নিজের রুমে গিয়ে ড্রয়ারে লুকিয়ে রাখা পি’স্তল নিয়ে ব্যালকনিতে আসলেন।

ব্যালকনিতে আসার পর দেখতে পেলেন, ছেলেটির অবয়ব অনীতার রুমের জানালার দিকে যাচ্ছে।তিনি কিছুটা সন্দেহ করলেন।ছেলেটি কিছু বুঝে উঠার আগেই তিনি ট্রিগারে চাপ দিলেন।বিকট আওয়াজ হলো।
মিস্টার শামসুজ্জামানের সম্বিত ফিরে এলো।মনের ভুলে সাইলেন্সার না লাগিয়েই শুট করে ফেলেছেন তিনি।ভুল বুঝতে পেরে তিনি সামনে তাকিয়ে দেখতে পেলেন ছেলেটি গড়িয়ে যাচ্ছে।তিনি আর কিছু দেখতে পারলেন না।নিজের ভুলের জন্য রুমে ঢুকে চুপ করে বিছানায় বসে থাকলেন।
খানিক বাদে উনার মনে হলো,যাকে শুট করেছেন,গু’লি সঠিকভাবে অস্পষ্ট দেখা লোকটির গায়ে লেগেছে কি না তা
একবার হলেও দেখে আসা উচিত।সে কে তাও দেখা উচিত।এতো রাতে এসেছে কেন?কে না কে হতে পারে!আগে তিনি দেখবেন।
তারপর নাহয় লোক দিয়ে বডিটাকে সরিয়ে ফেলা যাবে।

এই ভেবে তিনি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে বাসার ভিতরের মূল দরজা খুলে বাইরে বের হলেন।বাড়ির পিছনের অংশে কিছুটা বাগান হওয়ার কারণে সেখানে বেশ মাটি আছে। বৃষ্টির কারণে রাস্তাটা একটু পিচ্ছিল হয়ে আছে বিধায় জায়গাটুকু পেরোতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল মিস্টার শামসুজ্জামান এর।একবার ভাবলেন,কাউকে ডাকবেন। কিন্তু পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত বদলে তিনি একাই বাড়ির পিছনের দিকে যেতে লাগলেন।
যাওয়ার সময় হঠাৎই তার পা কিছুতে আটকে গেল। আশেপাশে কোনো শক্ত গাছ বা খুঁটি না থাকার অভাবে তিনি নিজের ভারী দেহের টাল সামলাতে তা পেরে ধপ করে মাটিতে পড়ে গেলেন।কাপড়ে কাঁদা ভরলো।
মিস্টার শামসুজ্জামান বিরক্তিকর শব্দে ‘চ’ বাচক শব্দ উচ্চারণ করলেন।রাগে মাথা ফেটে যাবার উপক্রম।কিন্তু এখানে কাকে দোষ দিবেন তিনি।নিজের অসাবধানতায়ই তো হোঁচট খেয়েছেন তিনি।
এখন আবার ভিতরে ফিরে গিয়ে কাপড় পাল্টে আসার চিন্তা করতে পারলেন না মিস্টার শামসুজ্জামান।এমনিতেই ঠান্ডার দিন।তার উপর বৃষ্টিমুখর পরিবেশ।এখন গিয়ে আবার ফিরে এসে যদি হোঁচট খান!
দুই দুইবার কাপড় পাল্টাতে পারবেন না তিনি।

কিন্তু এখন এতোক্ষণ এই কাঁদামাখা কাপড় পড়ে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না মিস্টার শামসুজ্জামানের।তাই এখন আশপাশটা একটুখানি দেখেই বাড়ির ভিতর ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।
এবার মিস্টার শামসুজ্জামান আরেকটা ভুল করলেন। অনেকগুলো টর্চ একসাথে থাকার কারণে কোনটা ভালো কোনটায় ঝাপসা আলো তা ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি।হাত দিয়ে হাতড়ে একটা নিয়ে এসেছেন তিনি। কিন্তু উনার দুর্ভাগ্য,লাইটটার আলো একেবারেই কম।এইদিকে নিজের ফোন ও নিয়ে আসেননি তিনি।
লাইটের আলো অনেক কম থাকায় সামনে কি পড়ে আছে,তা দেখতে খুব কষ্ট হচ্ছিল মিস্টার শামসুজ্জামান এর।একটু এগিয়ে লাইটটা একটু সামনে ধরতেই তিনি অবাক হলেন। দেখলেন উনার সামনে একটা কলাগাছ পড়ে আছে।
মনের ভুল ভেবে আরেকটু সামনে এগিয়ে দেখলেন।না!ঠিকই তো।কলাগাছ পড়ে আছে এখানে।
তাহলে কি তিনি এতোক্ষণ ভুল দেখলেন?কি জানি!বয়স তো আর কম হয়নি।

এই ভেবে আশেপাশে তাকিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন মিস্টার শামসুজ্জামান। হঠাৎই আবার পিছনে ফিরে তাকালেন তিনি।কেউ এসে থাকলে তার জুতা বা পায়ের ছাপ তো মাটির উপরে পড়বে নিশ্চিত।তাই তিনি মাটির উপর টর্চ ধরলেন। কিন্তু টর্চের আলো খুব মৃদু হওয়ায় উনি ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না মাটিতে জুতার ছাপ আছে কি না।
মিস্টার শামসুজ্জামানের মেজাজ আরো বিগড়ে গেল।আজকে শুধু ভুলই হচ্ছে তার।এতো ভুল হচ্ছে কেন?
তখনি মনে পড়লো,আজ তিনি শুধু তাড়াহুড়োই করেছেন।আর তাড়াহুড়ো করা শয়তা’নের কাজ!
যেহেতু বাড়ির এদিকটায় অনুমতি ছাড়া কেউ আসে না তাই স্থির করলেন আগামীকাল সকালে এসে দেখে যাবেন কোনো ক্লু আছে কি না। এজন্য উনাকে আগে এখন তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হতে হবে।সকাল পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করবেন।তারপর একটু ভোর হলেই চলে আসবেন।সকাল সকাল না আসালে যদি কিছু না পাওয়া যায়!যদি আবার বৃষ্টি হয়ে সব ধুয়ে যায় এই আশঙ্কায় মিস্টার শামসুজ্জামান চলে গেলেন।

মিস্টার শামসুজ্জামান সিঁড়ি দিয়ে ধপধপ করে উপরে উঠলেন।উনার পায়ের আওয়াজ খুব জোরেশোরেই হয় সবসময়।তার উপর এখন মধ্যরাত।মধ্যরাতে সামান্য কিছুর আওয়াজ ও জোরেশোরে শোনা যায়,আর এটা তো একটা ভারী দেহের মানুষের পায়ের আওয়াজ।
আয়ুশ ‌মিস্টার শামসুজ্জামানের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার আওয়াজ শুনতে পেল।আওয়াজ ক্রমে ক্রমে মিলিয়ে গেলে আয়ুশ অনীতাকে লাইট জ্বালাতে বললো।
মিস্টার শামসুজ্জামান আর মিসেস শেহনাজ যেহেতু দোতলায় থাকেন আর অনীতা যেহেতু নিচের তলায় একটা রুমে একাকী থাকে তাই অনীতার নিচের তলার রুম থেকে দোতলায় তাদের কথার আওয়াজ যাবার সম্ভাবনা কম।
অনীতা লাইট জ্বালালে আয়ুশ বললো,

-“ অনী?প্রণয় ব্রো তোর ঘরে কি করছে?তাও এতো রাতে?”
-“ তেমন কিছু না ভাইয়া।আমি আজকে বাবাকে মায়ের সাথে কথা বলতে শুনে ফেলেছিলাম।উনারা বলছিলেন,আজকে কেউ একজন খু’ন হবে। কিন্তু কে হবে তা শুনতে পাইনি।তোমায় ফোন দিতাম, কিন্তু আমার কললিস্ট থেকে সব নাম্বার ডিলিট হয়ে গিয়েছিল।আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম খুব।প্রণয়ের ফোন নাম্বার মুখস্থ ছিল।তাই উনাকেই ফোন দিয়ে আসতে বলি।”

আয়ুর প্রহর পর্ব ১৩

অনীতার কথা শুনে আয়ুশ ভ্রু কুঁচকে অনীতার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“ ওর নাম্বার তোর মুখস্থ মানে?প্রণয় ব্রো কি তোর বিশেষ কেউ?তোরা কি একে অপরকে আগে থেকে চিনতি?”
আয়ুশের মুখে আচমকা এমন প্রশ্ন শুনে অনীতা মিইয়ে গেল।কি বলবে সে?নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে গিয়েছে।মোক্ষম জবাব দিতে পারছে না অনীতা।কি হবে এখন?তার ভাইয়ার কাছে কী সে খারাপ মেয়ে হয়ে যাবে?

আয়ুর প্রহর পর্ব ১৫