আয়ুর প্রহর পর্ব ২৫
তুশিতা নুর তৃষ্ণা
এই গোধূলি লগ্নে ব্রিজে হাঁটছে দুইজন। পাশপাশি তবে কাছাকাছি নয়।দূর থেকে দেখলে মনে হবে,কি সুন্দর এক জোড়া সুখী কপোত-কপোতি পাশাপাশি হাঁটছে। কিন্তু মূল বিষয়টা তারাই জানে,তারা কতোটা সুখী!
পাশাপাশি দুজন হেঁটেই যাচ্ছে। দু’জনের একজনের মুখেও কোনো রা নেই।ব্রিজের ওপারে গিয়ে ওপার থেকে আবার ফিরে এলো দুজন। তবুও একজনের মুখে কোনো শব্দটি নেই।
সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। আশেপাশে অন্ধকার হয়ে আসছে।প্রণয়ের ইচ্ছে করছে অনীতার হাতে হাত রেখে হাঁটতে।অনীতার কোমল হাত ছুঁতে ছুঁতে প্রকৃতির নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে।কিন্তু কি একটা বাঁধা যেন তাকে আকড়ে ধরছে বারবার।
প্রণয়ের সাথে পাশাপাশি এতোক্ষণ হাটতে পেরে অনীতার ভালোই লাগছে।মনে হচ্ছে,এক অন্য জগতে আছে সে। প্রণয়ের পাশাপাশি হাঁটা তাকে এক অদ্ভুত রকমের প্রশান্তি দিচ্ছে।তাই সে প্রণয়কে কিছুই বলছে না।
অপেক্ষা করতে করতে যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে চারিদিকে অন্ধকার নেমে এলো,তখন অনীতা দাঁড়িয়ে পড়লো।অনীতার সাথে সাথে প্রণয় ও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অনীতায দিকে তাকালো।এবার অনীতা মুখ খুললো,
-—“ আপনি এখনো কিছু বলছেন না কেন?কি দরকারে ডেকেছিলেন?”
আচমকা অনীতার এমন প্রশ্ন শুনে একটা চুপ থাকে প্রণয়।তারপর বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-—“ দরকার তো অনেকই আছে। কোনটা রেখে কোনটা বলি।”
-—“ একপাশ থেকে শুরু করুন।শুনছি।”
-—“ এখনি?তোমার কি হাঁটতে ভালো লাগছে না?”
-—“ তেমন কোনো বিষয় না। হাঁটতে ভালো লাগলেও শরীরটা….”
-—“ কি হয়েছে অনী? শরীর খারাপ লাগছে?খুব বেশি?তুমি ঠিক আছো?” উত্তেজিত হয়ে বললো প্রণয়।
-—“ না না।শরীর ভালোই লাগছে।আপনি এতো হাইপার হবেন না দয়া করে।ঠিক আছি আমি।আসলে, অনেকক্ষণ হলো এলাম।অনেক তো হাঁটলাম।এইবার মনে হচ্ছে কথা বলতে হবে।আমরা তো কথা বলতেই এসেছি। কথা শেষ হলেই চলে যাবো!যে দরকারে এসেছি,তা তো পুরো করতে হবে।”
নিজের অসুস্থতা লুকালো অনীতা।
অনীতার শরীর ভালো শুনে প্রণয় যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু পরক্ষণেই অনীতার শেষোক্ত কথা শুনে সে খানিকটা কষ্ট পেলো।
সে অনীতাকে শুধালো
-—“ তুমি কি বিরক্ত হচ্ছো অনী?”
‘না একদমই বিরক্ত হচ্ছি না আমি।আপনার হালকা সংস্পর্শই আমায় স্বর্গের অনুভুতি দেয়। সৃষ্টিকর্তা চাইলে আমি সারাজীবন আপনার সাথে থেকে যেতাম। আপনার সংস্পর্শ আমার জীবনের সুন্দর মুহুর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম।আর আপনি বলছেন আমি বিরক্ত হবো?’
মনে মনে কথাগুলো আওড়ালো অনীতা । কিন্তু মুখে বললো,
“ একদমই বিরক্ত হচ্ছি না,এমনটা বলতে পারছি না।তবে রাত হয়ে গিয়েছে।বাসায় ফিরতে দেরী হলে খালমণি বকা দিবে।ভাইয়াকেও বলে আসিনি আজ।যদি জানে এতোরাত করে ফিরেছি,তাহলে ভাইয়াও রাগ করবে।”
-—“ বলে আসোনি কেন?”
-—“ বাহ রে!বলে আসবো কি করে!আপনি বিকেলে ফোন দেওয়ার সাথে সাথেই তো বেরিয়ে পড়েছি।এমনভাবে বললেন,যেন কি জরুরী কথা বলবেন….!”
তক্ষুণি প্রণয়ের মনে পড়ে গেল বিকেলের কথা।
কদিন ধরেই তার মনটা অনীতার জন্য কেমন কেমন করছিলো। অনীতার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কিছু কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো।কিন্তু অনীতাকে কল দিয়ে তার সাথে দেখা করার জন্য বলতে প্রণয়ের নিজেকে প্রস্তুত করতে একটু সময় লেগেছিলো।
অবশেষে আজ নিজের পক্ষ হতেই অনেক বাধা কাটিয়ে অনীতাকে ফোন দিয়ে বললো,তার সাথে দেখা করবে ।কথা আছে।
প্রথমে অনীতা না করলেও পরে প্রণয় এতো জোরাজুরি করলো যে অনীতা আর না বলতে পারলো না। তড়িঘড়ি করে একটা বোরখা আর হিজাব পড়ে চলে এলো।
খালামণির বাসায়ই ছিলো অনীতা।বেরোনোর আগে খালামণিকে বলে এলো,তার ফিরতে একটু রাত হবে।
খালমণি প্রথমে বারণ করতে চাইলেও পরে ভাবলেন,এমনিতেই মেয়েটা একটু মুষড়ে পড়েছে।রুম থেকে সহজে বের হতে চায় না।কথা বলতে চায় না।খেতে চায় না।বাইরে ঘুরার কথা বললে শুধু একটা কথাই বলে,‘তোমরা যাও।আমার শরীর ভালো লাগছে না।’
আজ যখন নিজ থেকেই বাইরে যাওয়ার কথা বলেছে,তখন অনীহার খালামণি তার বাইরে বেরোনোর ইচ্ছায় সম্মতি জানালেন।তবে সম্মতির পাশে বসালেন এক আবদার।
কি আবদার!
উনার আবদার হচ্ছে,উনিও অনীতার সাথে বাইরে যাবেন।উনার আবদার শুনে অনীতা সাথে সাথে বিনয়ের সাথে না বললো।
অনীতা একদমই চায় না,সে যে এখন প্রণয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে এই কথাটি কেউ জানুক।
তাই সে খালমণিকে একথা ওকথা বুঝিয়ে বললো যে,তার ফ্রেন্ড আসবে।আর ওদের সাথে একটু পার্সোনাল টাইম স্পেন্ড করলে তার মন ফ্রেশ হবে।তাই তাকে একা যেতে দিলেই ভালো হবে।
অনীতার সহজ সরল খালামণি ভাবলেন,তাই তো।উনি গেলে হয়তো ওদের খোলাখুলি কথা বলতে অস্বস্তি লাগবে। এরচেয়ে অনীতার একা যাওয়াটাই ভালো।
তাই উনি অনীতাকে একাই যেতে দিলেন।সাথে বলে দিলেন, তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে।
কি মনে করে অনীতা বললো তার বাসায় ফিরতে দেরী হবে।রাতও হতে পারে।
কারণ হিসেবে জানালো,বহুদিন পর ফ্রেন্ডের সাথে দেখা।একটু সময় নিয়েই দেখা করতে হবে।
অনীতা বেরিয়ে সোজা প্রণয়ের পাঠানো লোকেশনে এসে পড়লো।
অনীতার কথা শুনে প্রণয় বললো,
-—“ ও আচ্ছা। তাহলে কথা শুরু করি।”
-—“ হ্যাঁ,বলুন আপনার জরুরী কথা।”
-—“ আমরা কি আমাদের সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক করতে পারি না অনী?তোমার থেকে এতো দূরে থাকা আমার কাছে অনেক কষ্টের মনে হয়।”
-—“ আমাদের সম্পর্ক তো স্বাভাবিকই আছে।”
-—“ একদম স্বাভাবিক নেই অনী।একদম স্বাভাবিক নেই।”
-—“ যেমন?” বুঝেও প্রশ্নটা করলো অনীতা।
-—“ উদাহরণ দিলে কতো কিই বলা যেতে পারে।আমাদের বিয়ে হয়েছে কতো তারিখে বলো তো? আমাদের বিয়ে হয়েছে আজ থেকে পাঁচ মাস আগে।তেইশের সেপ্টেম্বরের চৌদ্দ তারিখ এ।অথচ কেউ এখনো আমাদের বিয়ের বিষয়ে কিছু জানে না।
তোমার কি মনে হয় এসব স্বাভাবিক?আমি এসব আর নিতে পারছি না অনী।আমার মনে হয়, আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক করা উচিত।সবার কাছে প্রকাশ করা উচিত।এইযে তুমি কাছে থেকেও দূরে আছো,এটা আমার কাছে শত শত ধারালো কাঁটার উপর দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে যাওয়ার থেকেও যন্ত্রণাদায়ক মনে হয়।
তুমি কি আমার হবে না অনী?”
বলতে বলতে প্রণয়ের গলা ধরে আসে।তার চোখের কোণে পানি স্পষ্ট।
অনীতা চুপ করে আছে।কোনো উত্তর দিচ্ছে না।কি উত্তর দিবে সে।কিছুই তো বলতে পারবে না প্রণয়কে।তার মনের ভিতর যে হাহাকার চলছে,তার উপশম কি আদৌ আছে নাকি!
সে চুপ রইলো।প্রণয় জিজ্ঞেস করলো,
-—“ চুপ করে থেকো না অনী! কিছু তো বলো।অনেক আশা নিয়ে আজ তোমার কাছে এসেছি।আজ অন্তত ফিরিয়ে দিয়ো না আমায়।”
অনীতা অন্যদিকে ফিরে রইলো।তার চোখের কোণায় ও পানি চিকচিক করছে। কিন্তু প্রণয়ের সামনে তার চোখের জল প্রকাশে সে অনিচ্ছুক।
তাই নিজেকে খানিকটা ধাতস্থ করে প্রণয়কে বললো,
-—“ ব্রিজের ওপাশ থেকে একটু চা নিয়ে আসবেন। ঠান্ডা লাগছে।”
প্রেয়সী আর কিছু না বলুক,তার আবদার তো আর উপেক্ষা করা যায় না।তাই আর কিছু না বলে সাথে সাথেই চা নিয়ে আসতে চলে গেল প্রণয়।
অনীতার চোখের বিন্দু বিন্দু পানি তার গালে টুপটাপ করে পড়লো।ভাঙা গলায় সে গাইতে লাগলো,
দেখোনি তো তুমি,
আমার চোখের পানি।
আমার গাওয়া গানে,
তোমাকে কাছে টানি।
আসো আবার কাছে,
হাতটা ধরে……
আয়ুর প্রহর পর্ব ২৪
আর গাইতে পারলো না অনীতা। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো তিমিরাচ্ছন্ন আকাশের দিকে।আদৌ কি কখনো প্রণয়ের হাত ধরতে পারবে অনীতা?
প্রণয় যেতে যেতে চোখ মুছে চলছে।এমনভাবে চোখ মুছলো সে,যেনো সৃষ্টিকর্তা ব্যাতীত আর কেউ না দেখতে পায় । ঈষৎ হেসে চায়ের দোকানে গেলো সে।
ছেলেদের কাঁদতে নেই।চোখের পানি প্রকাশ করতে নেই।