আরো একটি বসন্ত পর্ব ৩
নূরজাহান আক্তার আলো
আজ শীতলের বাবা মায়ের বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে বাসায় মেহমানদের আনাগোনা বেড়েছে। সকলেই যে যার জীবনের গালগল্পে ব্যস্ত। শীতলের আম্মুও যুক্ত হয়েছেন সেখানে।তবে উনি এখন নীরব শ্রোতার চরিত্রে আছেন। কারণ কিছু বলার নেই উনার। আল্লাহ উনাকে যতটুকু দিয়েছেন তা নিয়ে সুখেই আছেন, ভালো আছেন।
উনি সর্বপরি অঢেল কিছুর প্রত্যাশা করেন না৷ যেখানে শান্তির চেয়ে অশান্তির আনাগোনা বেশি থাকে। আর এখানে উপস্থিত অনেকেই কতশত হতাশার গল্প জুড়েছেন, যেটা উনার অপছন্দ। তাই নিশ্চুপ থেকে সকলের গল্প শুনছেন। তবে সেসব শুনে উনার আক্ষেপ হচ্ছে না। মন খারাপ করে আফসোসের সাগরে ডুবছেনও না। বরং অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে মন ও প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে। এখানে উপস্থিত প্রায় মহিলাদের অভিযোগ স্বামী সন্তানকে নিয়ে। তবে এসব অভিযোগের গুন উনার স্বামী সন্তানের মধ্য কোনোটাই নেই।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
উনার স্বামী পরনারীতে আসক্তি নন। উনার প্রতি বিরক্ত নন এবং অকারণে ক্যাচক্যাচও করেন না। সেই সাথে সন্তানরাও
উনাকে ভীষণ ভালোবাসে, সন্মান করে। অকারণে তর্ক করে না, গায়েও হাত তুলে না। এসব নানান ধরনের গল্পে সময়ের দিকটা কারোরই খেয়াল ছিল না। পরে শিশির এসে উনাদের তাড়া দেয় দুপুরে খাওয়ার জন্য। তারপর সকলে দুপুর খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে শেষ বিকালে নিজেদের পরিপাটি করার যুদ্ধে নেমে পড়েন। কারণ অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ রাতে অনুষ্ঠিত হবে। আর সেই অনুষ্ঠানে একে অন্যের চেয়ে চোখ বাঁধানো সুন্দর লাগতে হবেই হবে।
তারপর রাতে অনুষ্ঠান আরম্ভ করা হলো।কতশত মেহমানের উপস্থিততে হৈ-হুল্লোড় বেড়ে গেছে। শীতল সদ্য বাইরে থেকে ফিরে ঝটপট তৈরি হয়ে অনুষ্ঠানে সামিল হয়েছে। মুখভর্তি হাসি নিয়ে ঘুরঘুর করছে আম্মুর আশেপাশে। কারণ ফিরতে দেরি হওয়াতে ওর আম্মু রেগে বোম হয়ে আছেন। কথাও বলছেন না ঠিকমতো। তবে সেও কম যায় না। উপহারস্বরুপ
আম্মুর জন্য একজোড়া স্বর্ণের চুরি কিনে এনেছে। যদিও সে টাকা হাতিয়েছে শিশিরের থেকে।শিশির প্রথম প্রথম গাঁইগুই করলেও পরে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করাতে রাজি হয়েছে।শীতল এবার সুন্দর ভাবে আম্মুকে ডেকে বালা দু’টো উনার হাতে পরিয়ে দিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,
-”এটা তোমার জন্য। ”
ওর আম্মু বালা দু’টোর দিকে তাকিয়ে আছে। ছলছল চোখ।
শীতল ব্যাপারটা বুঝতে পেরে শিশির জোরপূর্বক টেনে এনে বলল,
-”এই ডিজাইন আম্মুর পছন্দ হয় নি ভাইয়া।”
-“বলিস কি?”
-”তোকে বললাম ওই ডিজাইনটা নিতে।”
-”শুদ্ধ যে বলল এটা নাকি আম্মুর হাত বেশ মানাবে।”
-”শুদ্ধ বললেই হবে নাকি? দেখ আম্মু এখন কাঁদছে।”
-”শালা আসুক ওর আজকে হচ্ছে।
ছেলে মেয়ের মুখ দেখে উনি হেসে ফেললেন। চুরির উপরে চুমু হেসে মুখভর্তি হাসি নিয়ে প্রস্থান করলেন। জবাবে একটা টু শব্দও করলেন না। শীতল আর শিশিরও হাসল উনার এই কাজে। অতঃপর শীতল বাবা- মা আর ভাইয়ের সঙ্গে ডজন খানিক ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করলো। পছন্দ খাবারও খেলো ঘুরে ঘুরে। একটুপরে শুদ্ধ এসে ওর আম্মুর হাতে কী একটা তুলে দিলো।
ওর আম্মু শুদ্ধর মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন, হাসলেন। বাবা-মা, শিশির আর শুদ্ধর দৃষ্টিও তখন শীতলের দিকে। উনাদের হঠাৎ তাকাতে দেখে শীতল বিষম খেলো। নিশ্চয়ই তাকে নিয়েই কিছু বলছেন উনারা। শীতল পানি খেয়ে শুনতে গেল তার নামে কী বদনাম করা হচ্ছে। কিন্তু ওকে যেতে দেখে উনারা প্রসঙ্গ বদলে অন্য কথার সুর টানলেন। শীতল খুঁচিয়েও আর সেকথা জানতে পারল না।
তারপর হৈ-হুল্লোড়ে আনন্দমুখর ওই মুহূর্তটা বেশ উপভোগ করল তারা।
পরেরদিন শুদ্ধ ও শিশির তিনদিনের ট্যুরের কথা বলে বের হয়েছে৷কাজে যাচ্ছে বিধায় কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করেন নি।
শীতলও এই ব্যপারে কথা বাড়ায় নি। কারণ শিশিররা তাকে যতটুকু করতে বলে সে ততটুকুই করে। তাও গোপনে। এখন
তারা কোথায় যাচ্ছে?কেন যাচ্ছে?কবে ফিরবে জেরা করলে
অতিরিক্ত হয়ে যাবে। দেখা যাবে তাকে আর কোনো কাজেই ডাকবে না। এর চেয়ে তারা ফিরে আসুক তখন নাহয় সবটা জেনে নিবে।এসব ভেবে সে ওর আম্মুর থেকে শুদ্ধর ফ্ল্যাটের
চাবি নিয়ে সেখানে গেল। এখন সে ইচ্ছে মতো সময় কাটাবে এখানে। ছুঁয়ে দেখবে তার প্রিয় মানুষটার ব্যবহৃত প্রত্যেকটা জিনিস। শীতলকে শুদ্ধর ফ্ল্যাটে যেতে বারণ করে নি ওর মা। কারণ তিনি মেয়ের মনের কথা জানেন, বোঝেন। এমনকি শুদ্ধর সঙ্গেও উনার এ ব্যাপারে খোলাখুলি কথাও হয়েছে।
সত্যি বলতে, উনি শুদ্ধকে খুব ভালোবাসেন, পছন্দ করেন। শুদ্ধকে জামাতা করতে উনার আপত্তি নেই। এছাড়া আপত্তি
থাকার কথাও না। কারণ উনি ছেলেটাকে ছোট থেকে চিনেন জানেন। শিশির আর শুদ্ধর বন্ধুত্ব ছোটবেলা থেকেই। উনারা একটা সময় মিঠাপুকুর নামের এক গ্রামে থাকতেন। সেখানে
শুদ্ধরাও থাকত। আর খেলার ছলে শিশির আর শুদ্ধর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। দিনকে দিন তাদের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়, টান সৃষ্টি হয়। কাজে কর্মে বোঝাও যায় তারা ঠিক কতটা আপন।কিন্তু শিশিরের বাবার চাকরির সূত্রে তারা শহরে পাড়ি দিয়েছিল।
তারপর ধীরে ধীরে ওরা স্থানীয় হয়ে ওঠে। আর এখানে এসে শীতলের জন্ম হয়। তাকে নিয়ে সকলে ব্যস্ত থাকলেও শিশির আর শুদ্ধর কখনো যোগাযোগ বন্ধ হয় নি। ওরা ঠিকই নিজ দায়িত্বে তাদের বন্ধুত্ব অটুটু রেখেছে।
দুই বন্ধু কতশত গল্পও করেছে ফোনের মাধ্যমে। পরে শুদ্ধ’ও পড়াশোনার তাগিদে শহরে আসলেও মেসে থাকত। বারবার বলেও তাকে বাসায় আনতে পারত না শিশির। তারপর হঠাৎ এক বসন্ত উৎসবে শুদ্ধ তাদের বাসায় আসে। তখনই শীতলের সঙ্গে তার দেখা হয়, কথা হয়। এরপরে আর আসত না শুদ্ধ কারণ অজানায় থেকে গেছে। তারপর পড়াশোনা শেষ করে সৌভাগ্যক্রমে দুই বন্ধুই একই অফিসে জয়েন করে। তাদের চাকরিও হয় এক দিনে। এরপর শুরু হয় ব্যস্ততা আর ব্যস্ততা।এভাবেই তাদের সময় কাটছিল। কিন্তু শুদ্ধ একদিন প্রচন্ড জ্বরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। একথাটা এক কলিগ শিশিরকে ফোন করে জানায়।
তারপরে শিশির প্রচন্ড জোরাজোরি করে তাকে ওদের সঙ্গে থাকার জন্য। কিন্তু শুদ্ধ রাজি না হওয়াতে তাকে শীতলের মা তিন তলার ফ্ল্যাট খুঁজে দেন। তারপর থেকেই শুদ্ধ একা সেখানেই থাকত। আর শিশিরা তার সমস্ত সুবিধা অসুবিধা সম্পর্কে জেনে শুদ্ধর মাকেও জানাতে পারত।
শীতল সারাদিন শুদ্ধর ফ্ল্যাটে থেকে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলো।
রান্নার কাজে আম্মুকে টুকটাক সাহায্য করে শিশিরকে কল করে ঝগড়াও করল। তারপর রাতে একসঙ্গে খেয়ে ঘুমাতে গেল। পরদিন সকালে উঠে দেখে হাতে একদমই সময় নেই। সে ঝটপট উঠে না খেয়েই ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। ভার্সিটি পৌঁছে একটা ক্লাস করতে না করতে সে প্রচন্ড ক্ষুধা অনুভব করে। ওর বান্ধবী মল্লিকার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় ক্যান্টিনের দিকে। তখন শুনতে পায় কার বাসায় জানি বোম ব্ল্যাস্ট হয়েছে। সেই মুহূর্তে বাসার ভেতরে যে বা যারা ছিলেন তাদের চিহ্ন পাওয়া যায় নি। একথা শুনে শীতল মনে মনে বলল,
-”আল্লাহ মাফ করো। এমন বিপদ শত্রুকেও দিও না।”
একথা বলতে না বলতেই সেখানে উপস্থিত হয় রায়হান। সে তাদের এলাকার ছেলে। বয়সে তার থেকে তিন বছরের বড়।
সে দৌড়ে এসে হাঁটুতে ভর দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
-”শীতল তোমাদের বাসায় বোম ব্ল্যাস্ট হয়েছে। কীভাবে কী বলতে পারছি না। তবে শিশির ভাইকে কিছুক্ষণ আগে আমি বাসায় ঢুকতে দেখেছি। জানি না ভাইয়ের এখন কী অবস্থা!
আশেপাশের সবাই পানি দিয়েও আগুন নিভাতে পারছে না। তুমি জলদি চলো।”
রায়হানের কথা শুনে শুদ্ধর বলা একটা কথা শীতলের মনে পড়ল। শুদ্ধ তাকে বলেছিল কেউ যদি কখনো গিয়ে বলে, ওর বাবা-মা ভাই অথবা শুদ্ধ বিপদে আছে অথবা মারাত্মক কিছু ঘটেছে। একথা শুনে ভুলেও যেনো সঙ্গে সঙ্গে ছুটে না যায়। দেখা যাবে বিপদের কথা শুনে ছুটে যাওয়া তার জন্য বিপদের কারণ হবে। অপ্রত্যাশিত ফাঁদ কিন্তু এভাবেই পাতা হয়। একথা স্মরণ হতেই সে বাসায় ফোন দিলো। না কারোর
ফোনেই কল ঢুকল না। এমনকি দারোয়ানেরও না। তারপর সে শুদ্ধকে কল দিলো তবে বেজে বেজে কেটে গেল। শীতল কম্পিত হাতে পুনরায় কল দিতে যাবে তখন পরিচিত এক কন্ঠস্বর কানে ভেসে এলো, ‘শী- শীতল।”
শীতল তড়িৎগতিতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে শুদ্ধ বিধস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। শার্টে লেগে আছে ধুলোবালি। চোখজোড়াতে কেমন অসহায়ত্বের ছাপ। তাকে এভাবে দেখে শীতল এগিয়ে গিয়ে কিছু বলার আগে শুদ্ধ তার হাত ধরে সামনে এগোতে থাকল। শীতল একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। কিন্তু শুদ্ধ নিরুত্তর। শীতল আর নিজেকে সামলাতে না পেরে হাঁটা বন্ধ করে তেজী স্বরে বলল,
-” কি হয়েছে বলছেন না কেন আমায়? বাসায় যাবো, হাত ছাড়ুন।’
-”ধ্বংসস্তুপ না দেখলেই নয়?”
-”মানে ”
-”মানে তোর বাবা-মাসহ বাসাটা আর নেই। সেটা এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। শিশিরকেও খুঁজে পাই নি আমি। অথচ তাকে বাসাতে ঢুকিয়ে ফ্ল্যাটের চাবিটা নিয়ে দো’তলায়
কেবল উঠেছি। এরমধ্যেই যা ঘটার ঘটে গেছে। এখন তুইও সেইভ না এখানে। প্লিজ শীতল আর কথা বাড়াস না। আমার সঙ্গে চল।”
শীতল আর বাক্য ব্যয় না করে উল্টো ঘুরে দৌড় দেওয়ার আগেই শুদ্ধ তাকে ধরে ফেললো। শীতলকে একহাতে ধরে অন্য হাতে পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকে চেপে ধরে বিরবির করে বলল,
-”সরি রে, স্বজ্ঞানে তোকে বিপদে ফেলতে পারলাম না। এই বিষাক্ত শহর তোর আর আমার জন্য নয়। চল ফিরে যাই, নতুন এক বসন্তের রঙিন শহরে। যেখানকার বসন্তরা র/ক্ত ঝরায় না, প্রিয়জনকে কেড়ে নেয় না।”
আরো একটি বসন্ত পর্ব ২
একথা বলে শুদ্ধ নিজের মুখে মাক্স লাগিয়ে শীতলের মুখেও একটা মাক্স পরিয়ে দিলো। তারপর শীতলকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসল। তারপর রওনা হলো মিঠাপুকুর গ্রামের উদ্দেশ্যে।