আলোর ভীড়ে পর্ব ১৪

আলোর ভীড়ে পর্ব ১৪
ইশরাত জাহান অধরা

ইনাম শাওয়ার শেষে তোয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বারন্দায় গিয়ে ভেজে তাওয়াল ছড়িয়ে দিয়ে এসে ডাইনিং রুমে এসে এক গ্লাস পানি খাওয়ার জন্য গ্লাসে পানি ঢেলে খেতে খেতে ড্রয়িংরুমের দিকে চোখ গেলো।আবছা আলোয় সোফার মধ্যে এক গাছা চুল দেখে ভয়ে কেঁপে উঠল ইনাম।গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে ড্রয়িং রুমে গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে সোফার কাছে আসতেই দেখলো সোফায় গুটিসুটি হয়ে প্রিয়তা শুয়ে আছে।ভ্রু কুচকে এলো ইনামের কিছুক্ষন আগেই না দেখল প্রিয়তা রুমে ঘুমিয়ে আছে।এখানে আসলো কি করে?

“এখানে ঘুমাচ্ছো কেন?রুমে গিয়ে ঘুমাও!”
প্রিয়তা কোন উত্তর দিলো না।ইনাম বিরক্ত হয়ে খানিকটা জোরে চিল্লিয়ে বলল,
“কি হলো?উঠো!”
প্রিয়তাকে এইবারও চুপ থাকতে দেখে একটা শ্বাস নিলো।ভেবেছিলো এভাবেই ফেলে নিজের রুমে চলে যাবে।কিন্তু প্রিয়তাকে ঘুমের মধ্যে হাত পা চুলকাতে দেখে বুঝলো এখানে মশা কামড়াচ্ছে।তাই নিজের রুমে গিয়ে একটা কয়েল খুঁজে জ্বালিয়ে ড্রয়িংরুমে এনে রাখলো।চলেই যাবে হঠাত পিছন থেকে প্রিয়তা হাত টেনে ধরলো।ইনাম পিছনে ফিরতেই প্রিয়তা বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘মশা কামড়াচ্ছে।”
“কয়েল দিয়েছি।”
“তাও মশা কামড়াচ্ছে।”
“তো?উঠেছো যখন নিজের রুমে যাও।”
“আপনি নিয়ে যান।”
“কিহ?”
“আমি হাঁটতে পারছি না।আমার মাথা ঘুরাচ্ছে।উঠে দাঁড়ালেই মনে হচ্ছে এখনই পরে যাবো।”
ইনাম হঠাত প্রিয়তার মুখের কাছে নিজের মুখ নিলো।কিছুক্ষন পর সরে এসে চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
“তোমার মুখ থেকে এমন বিশ্রী গন্ধ আসছে কেন?তুমি কিছু খেয়েছো?”
প্রিয়তা সোফায় হেলান দিয়ে বলল,

“জানি না।আমার মাথাকে স্থির রাখতে পারছিনা।আমাকে রুমে নিয়ে যান।আমার গা গুলাচ্ছে।মনে হচ্ছে এখনি বমি করে দিবো।”
“তুমি বসো।আমি লেবু পানি নিয়ে আসছি।”
প্রিয়তা আবার হাত ধরে বলল,
“আগে আমাকে রুমে দিয়ে আসেন।এখানে ভালো লাগছে না।”
ইনাম বিরক্ত হয়ে বলল,
“তোমাকে রুমে দিয়ে আসব কিভাবে?তুমি যদি নিজে না হেঁটে যাও!”
প্রিয়তা হেসে বলল,

“কোলে করে নিয়ে যান!”
ইনাম চোখ বড় করে বলল,
“মাথা ঠিক আছে তোমার?কি বলছো?”
প্রিয়তা বিরক্ত হয়ে মুখ ফুলিয়ে বলল,
“দুর!আপনি কোন কাজেরই না।অকর্মার ঢেকি একটা।”
বলেই সোফায় উঠে দাঁড়ালো।ইনাম বাধা দিয়ে বলল,
“সোফায় উঠলে কেন?”

প্রিয়তা ইনামের কথায় কোন পাত্তা না দিয়ে লাফ দিয়ে দুই হাত আর দুই পা দিয়ে ইনামকে জড়িয়ে ধরলো।প্রিয়তা পরে যাচ্ছে বলে ইনাম দুই হাত দিয়ে প্রিয়তাকে ধরে ফেলল।প্রিয়তা হেসে ইনামের কাধে মুখ গুজতেই ইনামের সারা শরীরে বিদ্যুৎ বয়ে গেলো।ইনামের শ্বাস আস্তে আস্তে ভারী হয়ে যাচ্ছে।প্রিয়তা মুখ উচু করে ইনামের কানের কাছে গিয়ে বলল,

“এখন আমাকে আমার রুমে রেখে আসুন।আমি আপনার কাজ সহজ করে দিয়েছি।”
প্রিয়তার কথা ইনামের কানে লাগতেই কেঁপে উঠলো ইনাম।প্রিয়তা কি ওকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে? নাকি ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিচ্ছে?একটা শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলিয়ে প্রিয়তাকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলল,
“আমার কোল থেকে নামো।আমি তোমাকে ধরে রেখে দিয়ে আসছি।”

বলেই সোফায় নামাতে গেলে প্রিয়তা আরও শক্ত করে দুই হাত আর পা দিয়ে জড়িয়ে ধরল ইনামকে।প্রিয়তার দুই হাত ইনামের গলা জড়িয়ে ধরে আছে।আর দুই পা ইনামের কোমড়কে জড়িয়ে আছে।
“আপনি যতক্ষন না আমাকে আমার রুমে দিয়ে আসছেন আমি আপনাকে ছাড়ছি না।এভাবেই চেপে ধরে রাখব!”
ইনাম একটা শ্বাস ফেলে রুমের দিকে ঘুরলো।প্রিয়তাকে ধরে রুমে নিয়ে বিছানায় ফেলে বলল,
“লেবু পানি নিয়ে আসছি।”

বলে যেতে নিলে আবারও প্রিয়তা পিছন থেকে হাত টেনে ধরলো।ইনাম এবার বিরক্ত হয়ে বলল,
“আবার কি?আর কি চাও?রুমে এনে দিয়ে গেলাম তো!আবারও হাত ধরার মানে কি?”
“আমি যা চাই তা আমাকে আপনি কোনদিনও দিতে পারবেন না!”
“মানে?”

“আমি চাই আপনি আমাকে ভালোবাসুন।আপনি আমার মায়ায় পরুন।আমাতে আসক্ত হন।আমি ছাড়া আপনার জীবনে অন্য কোন নারীর ছায়াও না পরুক।এগুলো চাই আমি আপনার কাছে।দিতে পারবেন?”
ইনাম চুপ করে রইলো।ইনামকে কিছু বলতে না দেখে প্রিয়তা বলল,
“দিতে পারবেন না!”
বলেই চোখ দুটো বন্ধ করে বলল,
“আমার কিছু লাগবে না।যান আপনার রুমে যান।”
“কিন্তু….”
“যা বললাম তাই করুন!”

ইনাম কয়েক কদম হেঁটে দরজার সামনে যেতেই কারোর কান্নার আওয়াজ পেয়ে থেমে গেলো।পিছু ফিরে দেখল প্রিয়তা কান্না করছে।কান্না করতে করতে বলল,
“আপনি এশার সাথে রেস্টুরেন্টে যেতে পারেন।হাসাহাসি করতে পারেন শুধু আমার বেলাতেই আপনি মুখ কালো করে রাখেন।বিয়ের পরে এতদিন গেল আপনাকে আমি কোনদিন আমার সামনে হাসতে দেখি নি।ভালো করে চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে দেখিনি।আমার ক্ষেত্রে এতো অবহেলা কিসের জন্য? এশা আমার থেকে সুন্দর বলে?আপনার ছোটবেলার বান্ধবী বলে?”

ইনাম স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।প্রিয়তা এসব জানলো কিভাবে?ও কি নিজ চোখে দেখেছে?
‘তুমি যেরকম ভাবছো অইরকম কিছুই না।আমি আর এশা রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম….”
“আমাকে কেন কৈফিয়ত দিচ্ছেন?আমি জানতে চেয়েছি?”
“কিন্তু তুমি ভুল বুঝছো!”

“আমাকে সত্যি জানিয়ে ই বা কি লাভ?আমাকে এই সম্পর্কে না জড়ালেই পারতেন।মাঝখান থেকে আমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছেন আপনি!আমার জায়গায় অন্য কোন মেয়ে হলে এতদিনে আপনার সংসার ছেড়ে কবেই চলে যেতো!আপনাকে ঘৃণা করতো!কিন্তু আমি কেন জানি চাইলেও আপনাকে ঘৃণা করতে পারছি না।কেন যেন খুব করে চাইলেও চলে যেতে পারছিনা।”
ইনাম মনে মনে বলল,

“আমি তো তাই চাই।আমি তো চাই তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাও।এই সম্পর্ক থেকে চলে যাও।”
প্রিয়তা শুয়া থেকে উঠে বসে ইনামের কাছে আসলো।ইনাম আর ওর দুরত্ব কেবল কয়েক ইঞ্চির।প্রিয়তা এক হাত ইনামের পিছনের দেয়ালের উপর রেখে বলল,

“আমি এখানে পরে আছি কেন জানেন?আমি যতদিন না আপনার করা আচরনের কারন জানব,আপনি কেন আমাদের বিয়ে মানেন না সেটা জানবো ততদিন আমি এখানে মাটি কাঁমড়ে ধরে পরে থাকব।আমার যতো কষ্টই হোক,যতো কান্না পাক,নিজেকে অবহেলিত মনে হোক আমি কারন জেনে তবে যাবো এখান থেকে।তবেই আপনাকে এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি দিব।আপনি ভাববেন না আমি আপনাকে এমনে এমনে ছেড়ে দিব।সুপার গ্লুয়ের মতো আটকে থাকব আপনার সাথে।চাইলেও ছুটাতে পারবেন না আমাকে।”

প্রিয়তার এমন অদ্ভুদ কথা বার্তা শুনে ইনাম তাকিয়ে রইলো প্রিয়তার দিকে।প্রিয়তা ঢুলতে ঢুলতে পরেই যাচ্ছিলো ইনাম এক হাত দিয়ে প্রিয়তার পিঠ ধরে ফেলল।ইনাম চাইছিলো এখনি সবকিছু বলে দিতে কিন্তু প্রিয়তাকে এই অবস্তায় দেখে নিজেকে দমিয়ে নিলো।এখন বললে প্রিয়তা কোন কথাই বুঝবে না।

সকালে,
ঘুম থেকে উঠতেই প্রিয়তা অনুভব করলো ওর মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা,আর ঝিম ধরে আছে।নাড়াতেই পারছে না।কোনমতে টেনেটুনে বিছানা থেকে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানির ছিটা দিতে দিতেই চোখের সামনে কাল রাতের ঘটনা একটা একটা করে ভেসে উঠলো প্রিয়তার চোখে।প্রিয়তা অবাক হয়ে নিজের মুখ চেপে ধরলো।এ সে কি করে ফেলেছে?ইনামের সামনে কান্না করেছে?তাও কিনা এশার জন্য?রাগে মাথার চুলগুলাকে এলোমেলো করে দিলো।এখন ইনামের সামনে কিভাবে যাবে?কিভাবে মুখ দেখাবে?আল্লাহ!এ আমি কি করলাম?
প্রিয়তা আস্তে আস্তে ওয়াশরুমের দরজা খুলে রুমের ভিতর গেলো।রুম থেকে উকি দিতে দেখল ইনাম এদিকেই আসছে।প্রিয়তা সরাসরি গিয়ে খাটে বসে পরল।ইনাম রুমে এসেই প্রিয়তাকে বসে থাকতে দেখে বলল,

“নাও লেবু পানি খেয়ে নাও।”
প্রিয়তা হেসে কাপটা নিয়ে খেতে লাগলো।কয়েক চুমুক দিয়ে বলল,
“কাল রাতে কখন বাসায় ফিরেছেন?”
“যখন ঘুমিয়ে ছিলে!”
“অহ।কাল রাতের কথা মনে নেই আমার।”
ইনাম ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো।ইনামকে এভাবে তাকাতে দেখে প্রিয়তা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
“মানে রুমে এসে শুয়ার পর আর কিছুই মনে নেই।অফিস থেকে এসে রুমে ঢুকেছি।তারপর আর কিছুই মনে নেই।”
“কাল মদ খেয়েছিলে?”

“ইয়ে মানে…”
“যেকারনেই খেয়ে থাকো এরপর আশা করি আর খাবে না।”
“হুম।”
“ব্রেকফাস্ট রেডি করা আছে টেবিলে।খেয়ে অফিসে আসো।আমি গেলাম।আর তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
“বলুন।”
“রাতে এসে বলব।এখন সময় নেই।আমার মনে হলো তোমাকে কথাগুলা জানানো প্রয়োজন।নইলে তোমাকে ঠকানো হয়।আমি চাইনা কাওকে ঠকাতে।আমার জন্য কারোর ক্ষতি হোক।সবকিছু শুনে তুমি যা ডিশিসন নিবা আমি তাই এপ্রিসিয়েট করব।মেনে নিবো।”
ইনাম যেতেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে।যাক কিছুই বুঝেনি তাহলে।কিন্তু ইনাম কি বলবে ওকে?ওকে কেন ঠকানো হবে?

অফিস শেষে প্রিয়তা সরাসরি হাসপাতালে চলে গেলো।ইরার মাকে দেখার জন্য। লিফটে ঢুকে দাঁড়িয়ে ছিলো একপাশে।হঠাত সামনে একজনের দিকে চোখ পরলো।ইনাম এই হাসপাতালে কি করছে?ভ্রু কুচকে এলো প্রিয়তার।প্রিয়তা পিছনে থাকায় ইনাম দেখেনি।প্রিয়তা ডাক দিতেই যাবে হঠাত লিফটের দরজা খুলে গেলো।ইনাম বের হয়ে গেলো লিফট থেকে।প্রিয়তাও ইনামের পিছু নিলো।পিছু নিতে নিতে দেখলো ইনাম একটা রুমের ভেতর চলে গেছে।প্রিয়তা দরজার সামনে যেতেই দেখলো দরজা লক করা ভেতর থেকে।দরজার উপর ডাক্তারের নামের উপর চোখ রাখতেই দেখল সেখানে লেখা আয়ান চৌধুরি।কিসের ডাক্তার পড়তেই যাবে হঠাত ইরা এসে বলল,

“কিরে এখানে কি করছিস?চল! আম্মুর অপারেশন শুরু হয়ে যাবে।”
“হুম চল।”
প্রায় ১৫ মিনিট থাকার পর ইরাকে প্রিয়তা বলল,
“শুন।আমার না একটু কাজ আছে।আমি একটা জিনিস চেক করতে চাই।আমাকে জানতে হবে। আমি গেলাম।”
“কিন্তু….”

আলোর ভীড়ে পর্ব ১৩

“পরে আমি ফোন করে আন্টির খবর জেনে নিব।আমি গেলাম।কিছু মনে করিস না প্লিজ!”
প্রিয়তা দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামলো চারতলায়।রুমের দিকে যেতেই যাবে হঠাত থেমে গেলো।সামনে তাকাতেই দেখলো…..

আলোর ভীড়ে পর্ব ১৫