আশার হাত বাড়ায় শেষ পর্ব 

আশার হাত বাড়ায় শেষ পর্ব 
ইশরাত জাহান

অহির কথা শুনে তিহান চৌধুরী তেড়ে আসতে নেয় কিন্তু তূর্য হাত দেখিয়ে থামিয়ে দেয়।ওখানেই দাড়িয়ে যায় তিহান চৌধুরী।অহির দিকে তাকিয়ে বলে,”নিজের ছেলের ক্ষতি চুপ করে দেখলে!আসলে তো তুমি ওকে নিজের ছেলে হিসেবে মেনেই নেওনি।”

অহি চোখ বড় বড় করে তাকালো তিহান চৌধুরীর দিকে।ঘৃণাভরা দৃষ্টি দিয়ে বলে,”যেনো মনে হচ্ছে তোমার ছেলে আমাকে তার মা ভেবেছিলো?তুমি আমাকে নিজের বউ ভেবেছো?যেখানে তোমরা আমাকে নিজের ভাবতেই পারোনা আমি কেনো তোমাদের আপন ভাবতে যাবো?আমার কোন ঠেকা পড়েছে তোমাদের জন্য ভাববার?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“মা!”(ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে তূর্য বলে)
“কিসের মা?আমাকে তোর আপন মায়ের স্থান দিয়েছিলি?আচ্ছা তূর্য,তোর যদি আপন মা বাবার থেকে একটা ভাই বা বোন আসতো তাহলেও কি তুই তাকে এভাবে অবহেলা করতে পারতিস?তোর বাবার কাছে ইমোশনাল সেজে তোর মাকে মার খাওয়াতে পারতিস?”

কোনো উত্তর নেই তূর্যের।অহি তিহান চৌধুরীর দিকে ফিরে বলে,”আমার মেয়েটাকে জন্ম দিয়ে যে অবহেলা আমরা মা মেয়ে পেয়েছি এমন অবহেলা তোর বাবা আর তুই কখনও তোর আপন মা বোনের সাথে করতিস না।কিন্তু দেখ ভাগ্য আমাকে তোদের চাকরানী রূপে মা আর অহনাকে আশ্রিতা হিসেবে বোন দিয়েছিলো।আমার মেয়েটাকে তোরা কেউ সমর্থন করিসনি।আমার মেয়েটাও এভাবে নাইট ক্লাবে যাওয়া আসা করতে শুরু করে তোদের স্মার্টনেস দেখে।নিজেকে তোদের স্ট্যান্ডারে রাখার চেষ্টায় ছিলো কারণ তার বাবা স্মার্টনেস পছন্দ করে ভাই স্মার্ট হয়ে চলে।

তাই ও নিজেও স্মার্ট হতে চায়।সঠিক শিক্ষা না পাওয়ার ফলে স্মার্ট হতে গিয়ে নষ্ট জীবন পেয়েছে মেয়েটা।মা হয়েও আমি আটকানোর ক্ষমতা রাখিনি।প্রথম দিকে শাসন করি তারপর মারধর কিন্তু আমার প্রতিটা শাসনের বিপরীতে আমার দিকে অহনার আঙুল ঘুরে আসতো।অহনার একেকটা প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি অক্ষম ছিলাম।মেয়েটা একদিন আমাকে প্রশ্ন করেছিল যে,আমি ওকে লাস্ট কবে ফিডিং করাই আমি উত্তর দিতে ব্যার্থ।অহনা আমাকে প্রশ্ন করেছিল,আমি ওকে কবে শেষ ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি।আমি ওখানেও উত্তর দিতে ব্যার্থ।

মেয়েটা আমার কাছে যে পাঁচটা প্রশ্ন করেছিল তার একটা প্রশ্নের উত্তর আমি ঠিকঠাকভাবে দিতে পারিনি।কিন্তু আমি এটা বলতে পারি আমি তোর হাতে খড়ি কবে দিয়েছিলাম।আমি এটা বলতে পারি তোর জ্বর আসলে রাত কয়টা পর্যন্ত জেগেছিলাম।আমি এটাও বলতে পারি আমি কবে শেষবার তোর সাথে স্কুলে গিয়েছিলাম।পরের ছেলের জন্য জীবন দিয়েও আমি কিছু পাইনি কিন্তু নিজের মেয়ের জীবনটা হাহাকার করে দিলাম।প্রশ্ন এতদিন শুধু আমার মেয়ের দিকে আসতো।আজ তোদের বাবা ছেলের দিকেও আমার প্রশ্ন।বিয়ের পর বউকে নিয়ে সুখে সংসার করতে পারলি না কেনো?তোদের মনের মতো বউ থাকতেও সে তোদের জীবন আলোকিত করতে পারল না কেনো?তোদের ছেলেটার এই দুর্দশা কেনো?কোথায় গেলো বাবা মায়ের দায়িত্ব?”

মাথা নত করে আছে তূর্য।তিহান চৌধুরী অসাড় হয়ে দাড়িয়ে আছে।শ্রেয়া নিজেও অবাক হয়ে শুনছে অহির কথাগুলো।অহি কান্না করছে।শাড়ির আচল মুখে গুজে হুহু করে কান্না করছে অহি।গা কেপে উঠছে তার।শ্রেয়া এক পা দুই পা করে এগিয়ে আসলো অহির কাছে।কিন্তু শ্রেয়ার আগে অহির কাছে এসে পৌঁছালো জিনিয়া।অহির বাহু ধরলো।অহি তাকালো জিনিয়ার দিকে।জিনিয়া নরম কণ্ঠে ক্ষমাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,”আমিও জীবনে অনেক ভুল করেছি।তোমার সাথে ভুল করেছি আমিও।

জীবন আমাকে কোনো পরিস্থিতিতে না ফেললেও একটা শিক্ষা ঠিকই দিয়েছে।বলতে গেলে আমার জীবনের চলাচল তোমার মতই।স্বামী সন্তান কেউই আমাদের উপর ডিপেন্ড করে না।আমার ক্ষেত্রে আমি এসবের জন্য নিজে দায়ী তোমার ক্ষেত্রে অন্যরা।সবকিছুর বিনিময়ে আমি তুমি একই নৌকার মাঝি।তাই দুঃখটাও আমি বুঝতে পারছি।এভাবে কান্নাকাটি করে হার মেনে নিও না।আমরা আছি তোমার কাছে।”
শ্রেয়া অহির বামপাশে এসে বলে,”এই পুরো পরিবারের ভালোবাসা আপনার কাছে আছে।আপনার নাতি আছে নাতনি আছে।আপনার দুঃখের সমাপ্তি হবেই কাকিয়া।”

শ্রেয়া হাত বাড়িয়ে মিমিকে আসতে বলে।অহির কান্না দেখে মিমি নিজেও কান্না করে দিয়েছে।ছুটে আসল অহির কাছে।ফারাজ গলা খাকারি দিয়ে বলে,”মিমি আমার মেয়ে আমার জীবন আমার কলিজার টুকরা কিন্তু মিমির বায়োলজিকাল মা আছে।এটা আমি শিকার করি।সে খারাপ থাকার সময় আমি তাকে মিমির আশেপাশেও আসতে দিতাম না।তার পরিবর্তনের জন্য আমারও কোনো অসুবিধা নেই আমার মেয়েটা তার কাছে গেলে।শুধু এই মিথ্যা কথা বলে বা কোনোকিছু না লুকিয়ে গেলেই হবে।”

অহি এমনকি বাড়ির সবাই অবাক হলো ফারাজের কথা শুনে।অহনা পরিবর্তন হয়েছে এটা ফারাজ জানে!কিভাবে জানে ভাবছে অহি।ফারাজ বলে ওঠে,”নিবিড় শাহ আমার স্কুল লাইফের বন্ধু।তোমার বান্ধবী মিসেস নাজমার মতোই আমরাও আলাদা হয়ে যাই এক সময়ে।ও যেদিন ওর ছেলেকে নিয়ে দেশে আসে তখনই অহনাকে দেখে অবাক হয়।আমাকে ইনফর্ম করে দেয়।জানতে পারলাম অহনার পরিবর্তনের কথা।”
ফারহান চৌধুরী ফারাজের কাছে এসে বলে,”তাহলে আমাদের জানাওনি কেনো?”

“প্রথমত কাকিয়ার মেয়ে কোথায় এটা কাকিয়া জানে এটা আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম।কারণ কাকিয়ার একটা কনভারসেশন আমি শুনতে পাই।মিমির ঘরে আসছিলাম ওই সময়।আমার কাছে সবকিছু ক্লিয়ার হয়ে যায় কাকিয়া তার মেয়েকে পরিবর্তন করতে চায়।কিন্তু আমি জানতাম না কার কাছে আছে।পরে জানতে পারলেও আমার কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি।কারণ আমার জীবনের সেই অধ্যায়টা শেষ যাকে নিয়ে পথ চলতে চেয়েছিলাম।আমি আর তাকে নিয়ে ভাবতে চাই না।

তাই আমি কাউকে জানাতে চাইনি।আর আমার জানানো দিয়ে কি হবে?যার মেয়ে তারই তো কোনো আগ্রহ ছিল না।কাকিয়া না থাকলে হয়তো মেয়েটা আজ এতটা পরিবর্তন হতে পারত না বরং রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করতো।বাবা হয়েও সে তার মতো বিন্দাস জীবন কাটাচ্ছে।ধিক্কার জানানো উচিত এমন বাবাকে।”
তিহান চৌধুরী পিছিয়ে গেলেন।এই কয়েকমাস ধরে তিনি নিজের ভুলগুলো বুঝতে সক্ষম কিন্তু সে যা করেছে তাকে ভুল না অপরাধ বলে।নিজের রক্তের প্রতি অন্যায় করা বলে।সোফায় এসে বসে পড়লেন।অতসী এসে তূর্যের হাত ধরে ক্ষমা চায়।তূর্য হাত ঝাড়া দিয়ে বলে,”আমার কাছেও আসবে না।কথা এখানেই শেষ না।আরও আছে।”

“কি?”
“আমার ডিভোর্স চাই।”
“কি বলছ তুমি?আমাদের ছেলে আছে তূর্য।”
“যার খোঁজ খবর তুমি রাখোনাই কখনও।”
“আমার ভুল হয়েছে।এবারের মতো মাফ করে দেও।”
“তোমাকে নিয়ে আমি সুখে সংসার করতে পারব না অতসী।”
“কেনো?”
“আমার চাকরি নেই।আমার ব্যাবসা ডাউন হয়ে গেছে।”
“কিভাবে?”(অবাক হয়ে)

“তোমার প্রাক্তন প্রেমিক।যাকে তুমি গরীব আনস্মার্ট বলে ইগনোর করে আমার কাছে এসেছিলে।আমার টাকার মায়ায় ডুব দিয়েছিলে।সে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আমাকেই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিয়েছে।এখন যাও তার কাছে।আমাকে তালাক দিয়ে তুমি তার সাথে সুখে সংসার করো যাও।”

অতসী একবার তুষারের দিকে তাকালো আবার তূর্যের দিকে।চোখের পানি মুছে সবার দিকে তাকালো।সবাইকে দেখে নিয়ে মাথা নত করে অতসী বলে,”আমাকে কি একটা সুযোগ দেওয়া যায় না?একটা সাধারণ জীবন কাটানোর চেষ্টা কি আমি করতে পারি?”
তূর্য অতসীর দিকে তাকিয়ে বলে,”পারবে তুমি?তোমার বড়লোক বয়ফ্রেন্ড রেখে গরীব স্বামীকে একসেপ্ট করতে?তোমার তো দিনে দিনে মত পাল্টায়।”

“দেখো তূর্য।আমি পার্টি করি ড্রিংক করি কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়া কারো সাথেই আর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়িনি।তুমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারো।আমি শুধু লাইফ ইনজয় করতে চেয়েছিলাম।কারও প্রতি এক্ট্রেক্ট হইনি।এইটুকু বিশ্বাস করো তুমি আমাকে।আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি।তুমি বললে আমি পরিবর্তন হয়ে যাবো।”
ফারাজ তূর্যের কাছে এসে বলে,”যে মন থেকে পরিবর্তন হতে চায় তাকে সুযোগ দেওয়া উচিত।এমনটা হলে আমিও হয়তো কাউকে সুযোগ দিতাম।”

শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,”শ্রেয়া নিজেও হয়তো তার অতীতকে একটা সুযোগ দিতো।কিন্তু ভাই আমরা সেই সুযোগ দেওয়ার সুযোগটা পাইনি।তুই কিন্তু পাচ্ছিস।তুই দেখ তুই কি করবি?”
তুষার ধীর পায়ে এসে দাড়ালো অতসী আর তূর্যের কাছে।বলে,”আমার এত বিলাসিতা লাগবে না।আমার শুধু ড্যাডি আর মাম্মির লাগবে।আমি তোমাদের অনেক মিস করি।আমার এমনিতেও বোর্ডিংয়ে ভালো লাগেনা।আমার বাবা মায়ের কাছে থাকতে চাই আমি।”

তুষারকে জড়িয়ে ধরে অতসী।তুষার কান্না করে বলে,”প্লীজ ড্যাডি একটা সুযোগ দেও মাম্মিকে।”
তূর্য ঠোঁট প্রসারিত করলো।মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলো এবার সুযোগ পেলো অতসী।নিজেকে বিলাসিতার বাইরে জীবন কাটানোর একটা সুযোগ দিলো।তিহান চৌধুরী এসে দাড়ালো অহির সামনে।দুই হাত এক করে অহির কাছে আবেদন করে,”আমাকে মাফ করে দেও।আমি অনেক অন্যায় করেছি। পাপের পাল্লা ভারী হয়েছে আমার।”
অহি মলিন হেসে বলে,”আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে কি হবে?আমার মেয়েটার সুস্থ জীবন তো ফিরে আসবে না।”
কেউ কিছু বুঝলো না।জিনিয়া বলে ওঠে,”মানে?”

“আমার মেয়েটার ক্যান্সার ধরা পড়েছে।জানি না খোদা আর কতদিন বাঁচিয়ে রাখবে তাকে।”
তিহান চৌধুরীর দুই হাত আপনাআপনি আলাদা হয়ে নিচে পড়ে গেলো।ফারাজ যেনো স্থির থাকতে পারলো না।পিছিয়ে গেলো দুই পা।শ্রেয়া তাকালো সেদিকে।মিমিকে কাছে ডেকে কানে কানে বলে,”পাপার কাছে যাও। পাপাকে জড়িয়ে ধরো।”

মিমি দৌড়ে গেলো ফারাজের কাছে।ফারাজ জড়িয়ে ধরলো মেয়েকে।কান্না আসছে তার নিজেরও।চোখ বন্ধ করতেই ভেসে আসল সেই মুখটি।বেনারসি পড়ে হাসিমুখে ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়ে ছবি তোলা অহনা।ঘোমটা ধরে এদিক ওদিক লুক দিয়েছিলো।অহনার হাসি খুব কম দেখেছে ফারাজ।যতটুকু দেখেছে মোহিত নয়নে দেখেছে।চোখ ভিজে গেছে আজ।মিমি চোখের পানি মুছে দিলো।তিহান চৌধুরী বলে,”আমি যাবো আমার মেয়ের কাছে।ক্ষমা চাবো আমি।ফিরিয়ে আনবো ওকে।”

“আসবে না ও।এই বাড়ির প্রতি কোনো মায়া নেই ওর মনে।যেখানে আছে ভালো আছে।শুধু মিমিকে একটু মাঝেমাঝে নিয়ে যেতে বলেছে।”(অহি)
“আমাকে নিয়ে চলো ওর কাছে।দোহাই লাগে মেয়েটার ইচ্ছা এতদিন পূরণ করতে না পারলেও এখন পূরণ করতে চাই।”

অনেক অনুনয়ের পর অহি নিয়ে গেলো তিহান চৌধুরী ও তূর্যকে।সাথে করে চৌধুরী বাড়ির সবাই গেলো।কিন্তু ফারাজ যায়নি।শ্রেয়া বলেছিলো যেতে কিন্তু ফারাজ যাবে না।অহি বুঝতে পারল ফারাজের বিষয়টি।সম্মুখীন হতে চায়না অহনার সাথে।

শাহ বাড়িতে এসে পৌঁছেছে সবাই।অহনা বিকালের নাস্তা বানিয়েছিলো।টেবিলে সাজাচ্ছে তখন পুরো চৌধুরী পরিবারের সদস্যকে দেখতে পেলো।শুধু ফারাজ আর শ্রেয়া বাদে।শ্রেয়ার এক্সিডেন্ট এর ব্যাপারে শুনেছে অহনা।ফারাজ আসেনি বলে আফসোস হচ্ছে না।নিজের বাবাকে দেখে অবাক হলেও রাগ দেখালো না।মিসেস নাজমার দিকে তাকিয়ে থাকে।মিসেস নাজমা হাসলেন শুধু।তিহান চৌধুরী অহনার সামনে এসে দাড়ালো।দুই হাত উচু করে ডুকরে উঠলেন।

অহনার মনটা গলে গেলো।হাতটা ধরলো অহনা।আগের অহনা হলে হয়তো ধরত না।এখন অহনার আত্মসম্মানের থেকেও নরম মনটা বেশি গড়ে উঠেছে।ক্ষমা করে দেওয়ার মানসিকতা তার মধ্যে এসেছে।বাবার কাছে মন শক্ত করে রাখা সম্ভব হলো না।তিহান চৌধুরী জড়িয়ে ধরলেন মেয়েকে।অহনা নিজেও হাউমাউ করে কান্না করলো।অহি এগিয়ে এসে নিজেও কান্না করছে। তিহান চৌধুরী বলে,”আমাকে ক্ষমা করে দে মা।আমি পাপ করেছি তোর সাথে।এই পাপের মাফ শুধু তুই করতে পারবি।বাবার পাপের ক্ষমা করে পাপের ভার কমিয়ে দে।”

“আমি তো অনেক আগেই তোমাদের প্রতি মান অভিমান মন থেকে মুছে দিয়েছি।এখন আর এসব নিয়ে অভিমান হয়না।”
খুশি হলো সবাই।তূর্য এসেও ক্ষমা চাইলো।অহনা ক্ষমা করে দিলো।সবশেষে অহনাকে সবাই নিয়ে যেতে চাইলে না করলো অহনা।বলে,”আমি এখানে অনেক ভালো আছি। দয়া করে আমাকে জোর করতে এসো না তোমরা।আমি যেতে চাইনা ওখানে।আমাকে এখানেই থাকতে দেও।শুধু তোমরা আমাকে দেখতে এসো।”

তিহান চৌধুরী অনেক অনুরোধ করলেও অহনার কাছে হার মেনে নিলেন।তবে হাসিমুখেই সবাই ফিরলেন বাসায়।অহনার সাথে সবার সম্পর্ক ঠিক।তবে কি আদৌ সবার সাথে সম্পর্ক ঠিক হলো?না কখনোই না।একজন আছে যার সাথে কখনোই এই মান অভিমানের পাল্লা শেষ হবেনা।সে হয়তো পেরেছে ক্ষমা করে দিতে কিন্তু কখনও তারা একে অপরের সম্মুখীন হতে পারবে না।তাই তো আজ অহনা গেলো না চৌধুরী বাড়িতে।নিবিড় শাহ এর নিজস্ব ল্যাপটপ এখন অহনার কাছে থাকে।মিসেস নাজমা দিয়েছে ওটা।অহনা এখন ফ্রিল্যান্সিং এর কাজ করে।নিজের জন্য ওটুকুতেই অনেক।মিসেস নাজমা বাধা দেয়নি অহনাকে।অহনা নিজের জন্য কিছু করলে তার মন শান্তি পাবে।বাধা দিলে উল্টো কষ্ট দেওয়া হবে।

থানায় রনিকে দেখতে আসলো রুবিনা।রনির সামনে এসে দেখছেন শুকিয়ে যাওয়া ছেলেকে।কষ্ট হচ্ছে ছেলেকে দেখতে।ভেজা চোখে ছেলেকে ডাক দিলো,”বাবু।”
হাঁটুর মাঝে মাথা দিয়ে ছিলো রনি।মায়ের ডাক শুনে তাকালো রুবিনার দিকে।মাকে দেখে উঠে দাড়ালো।রুবিনার কাছে আসতেই বাধা হিসেবে দেখা গেলো কারাগারের দরজা।ওখানে দাড়িয়েই চোখের পানি ফেলছে রনি।রুবিনা তার অচল দিয়ে মুছে দিলো।বলে,”আর তো মাত্র তিনটা বছর কয়েক মাস আছে।এরপর আগের মতো জীবন পাবি।”
“আগের মতো জীবন না মা বলো জীবন পাল্টে যাবে।আচ্ছা বোনেরা কেমন আছে।”

“রুহির বর ওকে খুব অত্যাচার করে।শাশুরি তো জিনিস পত্রের আবদার করতেই আছে।”
“এগুলো সব আমরা এক সময় করতাম তাই না মা?”
“আজ সেই মেয়েটাও সুখে আছে।খোঁজ পেয়েছিলাম।আমাদের এলাকায় একজনের সাথে শ্রেয়ার মায়ের কথা হয়।জানালো শ্রেয়া নাকি এখন নিজের পেস্ট্রি হাউজ খুলেছে আবার বড়লোক বাড়ি বিয়ে করেছে।ওই যে যার বউয়ের সাথে তুই সম্পর্ক করেছিলি।”

অবাক হলেও মুখটা মলিন হলো রনির।ভাবছে জীবন কতটা পাল্টে যায়।এক সময় শ্রেয়া ছিলো তার পায়ের নিচে আজ তার স্থানটা শ্রেয়ার পায়ের নিচেও হতে পারলো না।বরং সে কারাগারে বন্দি।এটাই জীবন।

কেটে গেলো দুইমাস।শ্রেয়ার হাত এখন ঠিক হয়েছে।কাল রিমলি ও শিহাবের বিয়ে হলো।এতদিন শুধু অপেক্ষায় ছিলো শ্রেয়ার সুস্থ হওয়ার।শ্রেয়া সুস্থ হতেই বিয়ের আয়োজন করা।সকালে উঠে শিহাব বাইরে যায়।রিমলি বাসার সবার সাথে দেখা করে ঘরে আসে।ফোন হাতে নিয়ে ম্যারিটাল স্ট্যাটাস দেয়।শিহাব বাসায় এসে রিমলির কাছে খাবার চায়।রিমলি খাবার আনতে গেলে শিহাব নিজের ফোন বের করে ফেইসবুকে ঢুকে।লেখিকা ফারজানা ইয়াসমিন বিয়ে করেছে।ম্যারিটাল স্ট্যাটাস দেখে অবাক।এতোদিন তো এই ফারজানা ইয়াসমিনকে বুড়ি ভাবতো।আজ বুড়ির কি না বিয়ে হলো।শিহাব কমেন্টে কংগ্রাচুলেশন লিখে দেয়।ইতিমধ্যে রিমলির ফোন ভাইব্রেট করে।পরপর ম্যাসেজ আসতেই থাকে।ভ্রু কুঁচকে শিহাব ফোন হাতে নিয়ে ঢুকলো ম্যাসেঞ্জারে।আইডিতে অনেকেই লিখেছে,”অবশেষে লেখিকার বিয়ে হলো।কিন্তু দাওয়াত দিলো না লেখিকা।”

শিহাব হা হয়ে গেলো।নিজের আইডিও দেখলো।ফেইসবুকে ঢুকে অবাক হয়ে বলে,”এতদিন বুড়ি ভেবে যার কাছে আমার প্রেমের কথা বলেছি সে আসলে আমার ভালোবাসার ছুরি!”
রিমলি খাবার এনে বলে,”আপনার খাবার।”
শিহাব পিছনে ঘুরে বলে,”তুমি লেখিকা?”
“কেনো?আপনার সমস্যা আছে?”

“তুমি আমার সাথে এতদিন ফেইসবুকে কথা বলতে।কিন্তু একবারও বলোনি যে তুমি সে যাকে আমি…”
“ভালোবাসি বলতে আপত্তি আছে?ঠিকই তো বুড়ি ভেবে আমাকে নিয়ে কত কথা বলতেন।”
“ওরে মেয়ে!পেটে পেটে এত?আমাকে বলোনি কেনো?আর তুমি কিভাবে জানতে যে আমি সে?”
“অনেক আগেই জেনেছি।আপনার নাম আপনার প্রফেশন আর সবথেকে বড় কথা আপনার গিটার।ছবি আর বাস্তবে মিল পেয়েছিলাম।আপনাকে এতদিন ধরা দেইনি কারণ আমি চেয়েছিলাম আপনি আমাকে কতটা ভালোবাসেন এটা জানতে।”

“এভাবে?”
রিমলি শিহাবের কাছে এসে শিহাবের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,”ভালোবাসা জানতে হলে এমন টেকনিক এপ্লাই করতে হয় মিস্টার পুলিশ।”
“আমার স্ট্রবেরি লেখিকা।”
বলেই রিমলিকে নিজের কাছে আনলো শিহাব।
সুস্থ হওয়ার কয়েকদিন আগে থেকেই অফিসে যায় শ্রেয়া।ফারাজ সাহায্য করে এই দিক থেকে।আজও রেডি হতে থাকে।তবে আজকে ফারাজের দেওয়া ড্রেস পরে।শ্রেয়া আয়নার সামনে দাড়িয়ে হিজাব বাধার পর ফারাজকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে,”অফিসে আপনি কবে থেকে নরমাল পোশাক পরা শুরু করলেন?”

“যেদিন আমি হানিমুনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি।ওইদিন থেকে।”
“হানিমুন?”
“হুম,আমাদের হানিমুন।”
বলেই পাসপোর্ট দেখালো ফারাজ।শ্রেয়া হেসে দিয়ে বলে,”বিয়ে করেছে আমাদের ভাই বোন।হানিমুন করবো আমরা।”
“ওদের হানিমুন নিয়ে ওরা ভাববে।আমি আমার হানিমুন নিয়ে ভাবতে চাই।চলো তাহলে যাই হানিমুনে।”
“কবে প্ল্যান করলেন?”

“অনেক আগেই।সারপ্রাইজ কেমন লাগলো?”
“অনেক ভালো।মিমি রেডি আছে কি?”
“মিমি কেনো?”
“মিমিকে রেখে যাওয়া কি উচিৎ হবে?”
“একদম হবে।বাবা মায়ের হানিমুনে মিমি গেলে মিমির তো আর কোনো ভাই বোন আসবে মা শ্রেয়াময়ী।”
“শুরু করেছেন আপনি!”

“তুমি কি চাও?লোকে বলুক ফারাজ চৌধুরী বয়স হয়েছে বলে অক্ষম।সে তার দ্বিতীয় বউকে সন্তান দিতে পারে না।আমি কিন্তু একদমই এমনটা চাই না।আমার মিমির আরেকটা ভাই বা বোন এনে আমি আমার শ্রেয়াময়ীকে পরিপূর্ণ দেখতে চাই।”
হেসে দিলো শ্রেয়া।বের হলো বাইরে।অর্পা সোফায় বসে আছে।সে এখন দুই মাসের প্রেগনেন্ট।জানতে পারে কিছুদিন আগে।জিনিয়া নিজ দায়িত্বে তার যত্ন নিচ্ছে।শ্রেয়া অর্পার কাছে এসে বলে,”কখন কি ঠিক করেছে কিছুই জানতাম না।”

অর্পা স্মিত হেসে বলে,”জানলে তো তুই হানিমুন করতে যেতে চাইবি না তাই।”
“তোকে এভাবে রেখে যেতে ইচ্ছা করছে না।”
মিরাজ অর্পার কাছে এসে বলে,”চিন্তা নেই আমি আছি আমার বউয়ের সাথে।আর আমার মাও আছে।তোমরা যাও হানিমুনে।যাবে দুজনে আসবে কিন্তু তিনজনে।”
লজ্জা পেয়ে শ্রেয়া এসে দাড়ালো ফারাজের পাশে।মিমি তার ছোট ল্যাগেজ নিয়ে বাইরে আসে।শ্রেয়া ভ্রুকুটি করে বলে,”মিমি নাকি আমাদের সাথে যাবে না।”

“মিমি ওর মায়ের কাছে থাকবে এই কয়েকদিন।”
“ওহ।”
মিমি এসে শ্রেয়াকে জড়িয়ে ধরে।বলে,”তোমরা ঘুরতে যাও।আমি মাম্মির কাছে যাচ্ছি।এসে আমরা অনেক মজা করব।”
“আচ্ছা মা।সাবধানে থাকবে।আর কল করলে ধরবে।”

ফোকলা দাঁতের হাসি দিয়ে ঘাড় কাত করলো মিমি।অহি আর মিমি এক গাড়িতে করে চলে যাচ্ছে শাহ বাড়ির দিকে।শ্রেয়া আর ফারাজের ব্যাগগুলো গাড়িতে ঢুকাতে থাকে ড্রাইভার।শ্রেয়া আর ফারাজ মিলে দেখছে জানালা দিয়ে উকি দেওয়া মিমির দিকে।মিমি চলে যাচ্ছে কিছুদিনের জন্য তার মায়ের কাছে।ফারাজ শ্রেয়ার দিকে ফিরে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”তাহলে চলো শ্রেয়াময়ী।আমাদের জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করি।আমি আমার আশার হাত বাড়িয়ে দিলাম।এবার তুমিও তোমার আশার হাত বাড়িয়ে দেও।”

শ্রেয়া তার হাত রাখলো ফারাজের হাতের উপর।একসাথে মিষ্টি হাসি দিয়ে দুজনে গাড়িতে উঠে বসে।চলে যাচ্ছে তাদের মধুচন্দ্রিমার উদ্দেশ্যে।ব্যালকনি দিয়ে দেখছে মিরাজ আর অর্পা।একে অপরের হাত ধরে দেখছে ফারাজ আর শ্রেয়াকে।আলতো হাসলো অর্পা।মিরাজ তার ভালোবাসার বউকে আগলে নিলো দুই হাতের মাঝে।বলে,”অবশেষে সফল হলো আমাদের আশার হাত বাড়ানো।বলেছিলাম না অপেক্ষা করো ফল পাবে।আমরাও পূর্ণতা পেলাম আর ভাইয়েরাও পূর্ণতা পেলো।”

আশার হাত বাড়ায় পর্ব ৪১

অর্পা মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলো হ্যাঁ।
গাড়ি চলতে থাকে।ফারাজ আর শ্রেয়া পাশাপাশি বসে আছে।ফারাজ ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলে,”ভাই একটা গান চালিয়ে দিন।
ড্রাইভার মিউজিক অন করলো।গাড়িতে বাজতে থাকে,”হয়তো তোমারই জন্য।হয়েছি প্রেমেতে যে বন্য।জানি তুমি অনন্য।আশার হাত বাড়ায়।”

আশার হাত বাড়ায় শেষ পর্ব 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here