আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা গল্পের লিংক || Raiha Zubair Ripti

আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ১
Raiha Zubair Ripti

চার বছর আগে ভালাবাসার মানুষটার বিয়ের দিনে নিজের বাড়ি, শহর, প্রিয়জন ছেড়ে চলে গিয়েছিল সন্ধ্যা। আজ দীর্ঘ চার বছর পর আবারও পা রাখলো সেই চিরচেনা শহরে। শহরটাতে পা রাখতেই পুরোনো সেই অতীতটা আবার মনে পড়ে গেলো। এই চার বছরে শহরের কত কিছু বদলে গেছে অথচ সন্ধ্যার সেই বাজে তিক্ত অনুভূতি গুলোর এখনও বদল ঘটে নি। ভালোবাসার মানুষ টা সহ নিজের পরিবারের থেকে পাওয়া ধোঁকা প্রতারণার যন্ত্রণা টা আজও সন্ধ্যাকে তিলেতিলে শেষ করে দেয়।

আজ আবারও ফিরতে হচ্ছে সেই সব প্রতারকদের মাঝখানে।
এই তো চার বছর আগে নিজের ভালোবাসার মানুষটার সাথে বড় বোনের বিয়ের কথা শুনে রীতিমতো চমকে গিয়েছিল সেদিন সন্ধ্যা। খেতে থাকা খাবার টা আর গিলতে পারে নি সেদিন। সোফায় বসে সন্ধ্যার বাবা আর চাচা সন্ধ্যার বড় বোন শ্রেয়া আর সন্ধ্যার চাচাতো ভাই নিখিলের বিয়ে নিয়ে কথা বলছিল। নিখিল নাকি নিজ থেকে জানিয়েছিল সে শ্রেয়া কে বিয়ে করতে চায়। তারা দু’জন দু’জন কে নাকি ভালোবাসে। অথচ সন্ধ্যার গোটা পরিবার জানতো সন্ধ্যা নিখিল বলতে পাগল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মূলত কয়েকদিন যাবত শ্রেয়ার বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা চলছিলো বাড়িতে। তবে নিখিল সে যে শ্রেয়া কে বিয়ে করতে চাইবে এটা যেনো কল্পনার বাহিরে ছিলো। আর শ্রেয়াও নাকি সম্মতি দিয়েছে শ্রেয়াকে বিয়ে করা নিয়ে। সন্ধ্যা অবাক হচ্ছে এসব কথাবার্তা শুনে। শ্রেয়া তো জানতো সন্ধ্যা নিখিল কে ভালোবাসে। আর নিখিল সে কিভাবে শ্রেয়া কে বিয়ে করতে চায়? নিখিল তো জানে সন্ধ্যা তাকে কতটা ভালোবাসে। আর শ্রেয়া কি করে বড় বোন হয়ে ছোট বোনের ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করতে চাওয়া নিয়ে সম্মতি প্রকাশ করতে পারে! সন্ধ্যা আর খাবার গিলতে পারলো না।
অর্ধেক খাবার রেখেই হাত ধুয়ে উঠে হন্তদন্ত হয়ে বাবা চাচার সামনে দাঁড়ালো। বাবার হাত ধরে বলল-

-“ বাবা তুমি আপুর সাথে কার বিয়ের কথা বললে?
সন্ধ্যার বাবা নজরুল ইসলাম সন্ধ্যার মায়ের দিকে তাকিয়ে আদেশের সুরে বলল-
-“ মেয়েকে রুমে নিয়ে যাও।
সন্ধ্যার মা সন্ধ্যার হাত ধরতে নিলে সন্ধ্যা দূরে সরে গিয়ে বলে-
-“ রুমে কেনো যাবো আমি? তোমরা কিভাবে আপুর বিয়ে নিখিল ভাইয়ের সাথে দিচ্ছ। আমি ভালোবাসি তাকে। তার সাথে বিয়ে হবার কথা আমার। আমি এখনই আপুর সাথে কথা বলবো।
সন্ধ্যা ছুটে যায় বোনের রুমের দিকে। তার এখনই বোনের সাথে কথা বলতে হবে। তার বোন এটা কিভবে করতে পারে? তারপর যাবে নিখিলের সাথে কথা বলতে।
সন্ধ্যা সোজা শ্রেয়ার রুমে গিয়ে দেখে শ্রেয়া ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। সন্ধ্যা শ্রেয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল-

-“ আপু এসব কি শুনছি? তুমি জানতে না আমি নিখিল ভাইকে ভালোবাসি? আর নিখিল ভাই ও আমায় ভালোবাসে তাহলে কি করে তাকে বিয়ে করতে চাও তুমি?
শ্রেয়া স্পষ্ট জানিয়ে দেয় –
-“ নিখিল আমাকে ভালোবাসে সন্ধ্যা। তোকে তো কখনও ভালোই বাসে নি নিখিল। আমরা দুজন দুজন কে ভালোবাসি। তুই মেনে নে সত্যি টা বোন। নিখিল ভাই তোকে ভালোবাসলে ট্রাস্ট মি আমি কখনই তাকে ভালোবাসতাম না।

সন্ধ্যা অবাক হয় বোনের কথা শুনে। আপন বোন কি এরকম হয়? বড় বোন নাকি মায়ের সমতুল্য। তারা নাকি সর্বদা সেক্রিফাইজ করে ছোটদের জন্য। কই তার বোন তো করতে পারে নি। উল্টো তার ছোট বোনের থেকে তারই ভালোবাসার মানুষটাকে কেঁড়ে নিলো সূক্ষ্ম ভাবে। সন্ধ্যা ছুটে নিখিল কে খুঁজতে লাগলো। সারা বাড়ি খুঁজেও নিখিল কে পেলো না। কি একটা মনে হতেই সন্ধ্যা ছাঁদে আসলো। দেখলো নিখিল রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। মানুষটা তো প্রমিস করেছিল সে আর সিগারেট খাবে না, তাহলে খাচ্ছে কেনো?
সন্ধ্যা এগিয়ে আসলো নিখিলের কাছে। গলা তার কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা গলাতেই বলল-

-“ নিখিল ভাই এসব কি শুনছি আমি। আপনি আপুকে ভালোবাসেন? আপুকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন? আপনি জানেন না আমি আপনাকে ভালোবাসি?
নিখিল হাতে থাকা সিগারেট টা ফেলে দিলো। পিছু ফিরে সন্ধ্যার দিকে তাকালো। চোখ ফুলে গেছে। ভীষণ কেঁদেছে মেয়েটা। মিষ্টি কালার গোল জামায় একদম বাচ্চাদের মতো লাগছে।
-“ কি হলো চুপ কেনো? বলুন না নিখিল ভাই।
-“ কি বলবো?
-“ আপনি আপু কে বিয়ে করতে চাইছেন কেনো? আমি তো ভালোবাসি আপনাকে। সেই ছোট্ট বেলা থেকে। আপনি তো জানতেন সব।

-“ আমি শ্রেয়াকে ভালোবাসি সন্ধ্যা। আর আমি এতো দিন নিছকই মজার ছলে নিয়েছি তোর সব কথা গুলো কে।
সন্ধ্যা অবাক হয়। ৫ টা বছর ধরে ভালোবাসি ভালোবাসি বলা একটা লোকের কাছে নিছকই মজা মনে হয়!
সন্ধ্যা এবার কান্নারত গলায় নিখিলের দু হাত চেপে ধরে বলল-
-“ আমি কোনো মজার ছলে বলি নি নিখিল ভাই। আমি আপনাকে আপুর পাশে মানতে পারবো না। প্লিজ কিছু একটা করুন না। বিয়েটা ভেঙে দিন। আমি আপনাকে ভালোবাসি প্রচন্ড। আমার দিকটা বুঝুন।
নিখিল সন্ধ্যার থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল-
-“ আমাকে আমার দিকটাও ভাবতে হবে সন্ধ্যা। তুই বলতে পারবি না আমি কখনও তোকে বলছি আমি তোকে ভালোবাসি,বা আকার ইঙ্গিতে বলেছি। আর আমি শ্রেয়াকে ভালোবাসি।
সন্ধ্যা এবার চিৎকার করে বলে উঠল-

-“ শুনেছি তো আপনি শ্রেয়াকে ভালোবাসেন। কি এমন আছে শ্রেয়ার মাঝে যা আমার মাঝে নেই?
-“ জানি না শ্রেয়ার মাঝে কি আছে যা তোর মাঝে নেই। তবে বিশ্বাস কর শ্রেয়াকে দেখলে যা ফিল করি তোকে দেখলে তা ফিল করি না।
সন্ধ্যার বুকটা ফেটে আসতেছে। মানুষটা আগে কেনো মানা করলো না।
-“ আপনি আমাকে মানা কেনো করেন নি নিখিল ভাই শুরুতে? আপনি যদি শুরুতেই বলে দিতেন আপনি শ্রেয়া কে ভালোবাসেন তাহলে নিশ্চয়ই আজ এতোটা কষ্ট আমাকে পেতে হতো না। আমি না হয় আগে থেকেই মেনে নিতাম। কিন্তু এখন যে মানতে পারছি না। কষ্টে আমার বুকটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তবে শুনে রাখুন এতোদিন আপনাকে শুধু ভালোবেসে এসেছি। আজ থেকে বিশ্বাস করুন প্রচন্ড ঘৃণা করবো আপনাকে। আপনারা সবাই আমাকে ঠকিয়েছেন। আমার বাবা যে কি না জানতো সেও নিজের বড় মেয়ের জন্য আমার সাথে প্রতারণা করলো। আমি কোনোদিন আপনাদের ক্ষমা করবো না।

কথাটা বলে সন্ধ্যা নিজের রুমে এসে খুব কেঁদেছিলো। তার পরিবার এমন টা করতে পারলো? রুমের দরজা বন্ধ করে ছটফট করছিলো গ’লা কা’টা মুরগীর মতো। সেদিন সন্ধ্যার মা চেয়েও ছোট মেয়েকে স্বান্তনা দিতে পারে নি। স্বামীর মুখের উপর কথা তিনি কোনো কালেই বলতে পারেন নি। মুখ বুঝে ছোট মেয়ের কষ্ট তিনি দেখে গেলেন। হাসিখুশি সন্ধ্যা সেদিনের পর থেকে অন্ধকারে গুটিয়ে নিয়েছিল নিজেকে। সারা বাড়ির সবার মুখে হাসি বিয়ে উপলক্ষে অথচ সন্ধ্যা দিন রাত কান্না করতে করতে কাটাতো। তার বুকটা বুকটা ফেটে যেতো শ্রেয়া নিখিল দুজনকে একসাথে দেখলে। পাগল পাগল লাগতো।

সপ্তাহ খানেক পর তাদের বিয়ের দিনও চলে আসলো। কিন্তু সন্ধ্যার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না বিয়েটা নিজের চোখে দেখার। যেখানে এতোদিন নিজেকে তার পাশে বসিয়ে এসেছে আর আজ তার পাশেই তার বড় বোন শ্রেয়া। মানতে কষ্ট হচ্ছিল। দিন শেষে কিভাবে যেনো ঠকবাজ প্রতারক রাই সুখী হয়। যা সন্ধ্যা মেনেই নিতে পারছিলো না। তাই তো সেদিন সন্ধ্যা বাড়ি ছেড়ে খালার বাসায় চলে আসে। আর ফিরে যায় নি নিজ বাড়িতে। ও বাড়িতে থাকলে সন্ধ্যা হয়তো নিজেকে শেষই করে দিত। তবে কথায় আছে না যতই নীড় ছেড়ে চলে যাই না কেনো আমরা। দিনশেষে সেই নীড়েই ফিরতে হয় আমাদের । সেজন্য সন্ধ্যা কেও ফিরতে হলো তার নীড়ে। সন্ধ্যার মা ভীষণ অসুস্থ। পাঁচতালা বিল্ডিং এর নিচে দাঁড়িয়ে আছে সন্ধ্যা ছাতা মাথায় করে। রাত আনুমানিক দশটা বাজে। আষাঢ় মাস ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। এই পাঁচতালা বিল্ডিং এর দু তালায় সন্ধ্যা দের ফ্ল্যাট। সন্ধ্যা ল্যাগেজ টা নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখা হয় দারোয়ানের সাথে। চেয়ারে বসে আছে। সন্ধ্যাকে দেখা মাত্রই চিনে ফেললো। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যা হাসি মুখে সালাম জানালো। দারোয়ান সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করলো-

-“ কেমন আছো সন্ধ্যা মা। চার বছর পর তোমাকে দেখলাম।
সন্ধ্যা মুখে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বলল-
-“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি চাচা। আপনি?
-“ ভালো আছি। আবার চলে যাবা?
-“ যেতেও পারি চলে। মায়ের তো শরীর টা ভালো না।
-“ চলো আমি উপর অব্দি দিয়ে আসি।
-“ না না চাচা তার দরকার নেই। আমি পারবো। আসছি।

সন্ধ্যা চলে আসলো। সিঁড়ি বেয়ে যতই উপরে উঠছে ততই হৃৎপিণ্ডটা জোরে জোরে লাফাচ্ছে। বেখেয়ালি তে আকস্মিক কারো সাথে ধাক্কা লাগায় হাত থেকে ল্যাগেজ টা ছিটকে পড়ে যায়। সন্ধ্যা মাথা উঁচু করে তাকায়। দেখে একটা লোক শরীরে সাদা শার্ট তার উপর সাদা এপ্রন তারাহুরো করে চলে গেলো। সরি বলা তো দূরে থাক ফিরে তাকিয়েও দেখলো না। সন্ধ্যা লোকটাকে বেয়াদব বলে ল্যাগেজ টা তুলে হাঁটা ধরলো। দু তালায় এসে নিজেদের ফ্ল্যাটের দরজায় কলিংবেলটা বাজালো। মিনিট দুয়েক পর দরজাটা খুলে গেলো। সন্ধ্যা দরজার পানে তাকাতেই দেখলো তার চাচি দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যা তার চাচি কে উপেক্ষা করে ভেতরে ঢুকলো। বসার ঘরের সোফাতে বসে ছিল সন্ধ্যার বাবা,চাচা,নিখিল। সন্ধ্যাকে দেখে তারা রীতিমতো চমকে গেলো। আর নিখিল সে পলকবিহীন তাকিয়ে রইলো সন্ধ্যার দিকে। পড়নে অফ হোয়াইট সেলোয়ার-কামিজ। আগের থেকেও স্বাস্থবতী হয়েছে। আগের সেই বাচ্চা বাচ্চা ভাব টা নেই মুখে। কেমন অচেনা লাগলো এই সন্ধ্যা কে।

সন্ধ্যা ভুলেও কারো দিকে তাকালো না। সবাইকে ইগনোর করে মায়ের রুমে চলে গেলো। তার মা বিছানায় শুয়ে আছে। সন্ধ্যা মায়ের মুখের দিকে তাকালো। চার বছর পর দেখলো তার মাকে। কেমন শুঁকিয়ে গেছে তার মা। নিশ্চয়ই কেউ যত্ন করে না তার মায়ের। সন্ধ্যার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়ালো। সন্ধ্যা এগিয়ে গেলো মায়ের কাছে। পাশে বসে কপালে হাত রেখে কাঁপা কাঁপা গলায় সন্ধ্যা বলল-
-“ মা।
সন্ধ্যার মা চোখ খোলার চেষ্টা করলো। আবছা চোখে কাউকে সামনে দেখে বলল-
-“ কে?
-” আমি সন্ধ্যা মা। চিনতে পারছো?
সন্ধ্যার মা চমকালো। কয়েকবার চোখ ঝাপ্টানি দিয়ে বলল-
-“ স…সন্ধ্যা মা আ..আমার এসেছিস তুই!

সন্ধ্যা মাকে জড়িয়ে ধরলো। সন্ধ্যার মা এতোদিন পর মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। চার বছর পর মেয়কে দেখছে তবুও সেটা ঝাপ্সা। চোখের কি একটা যেনো হয়েছে। আজকাল সবই ঝাপ্সা দেখে।
-“ আমাকে ছেড়ে আর যাস না মা। জানিস আমি না তোর চেহারা টা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি না। কি যে হয়েছে চোখে। আমার না তোর চেহারা টা ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে।
সন্ধ্যা মায়ের হাত নিজের গালে রেখে বলল-
-“ আবার তুমি আমাকে দেখতে পারবে মা। আমি এসে গেছি না? তোমাকে সুস্থ করে তুলবো। খেয়েছো রাতে?
-“ হু খেয়েছি তো।
-“ কি খেয়েছো?

-“ জানি না তো। শ্রেয়া ভাতের সাথে কি যেনো খাইয়ে দিয়ে গেছে বুঝতেই পারলাম না।
-“ আচ্ছা ঘুমাও তুমি। রাত অনেক হয়েছে। সকালে তোমাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাব।
সন্ধ্যা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিজের রুমের দিকে বসার পথে দেখলো,, ডাইনিং টেবিলে বসে নিখিল খাচ্ছে,,আর শ্রেয়া খাবার বেড়ে দিচ্ছে। না চাইতেও দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসলো। এরা দুজন কত ভালোই না আছে সন্ধ্যার ভালো থাকাকে কেঁড়ে নিয়ে।
সন্ধ্যা নিজের রুমে আসলো। সেই আগের মতই আছে রুমটা। বেশ পরিপাটি। সন্ধ্যা ফ্রেশ হয়ে নিলো। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দরজার দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো শ্রেয়া এসেছে খাবার নিয়ে। রুমে ঢুকে খাবার টা বিছানায় রেখে বলল-

-“ জানতাম না তো তুই আসবি। জানলে তোর পছন্দের খাবার রাধতাম।
সন্ধ্যা টাওয়াল টা সোফায় রেখে বলল-
-“ নো নিড।
শ্রেয়া সন্ধ্যার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিলো। সন্ধ্যা আগের থেকেও সুন্দরী হয়ে গেছে। চুল ছেড়ে দেওয়ায় লম্বা কেশ গুলো হাঁটুতে এসে ঠেকেছে। আগে চুল গুলো বেশ ছোট ছিলো শ্রেয়ার থেকে। আর এখন কোমড় ছেড়ে হাঁটুতে এসে পৌঁছেছে। চার বছরে বেশ পরিবর্তন হয়েছে।
সন্ধ্যা শ্রেয়াকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল-

-” এভাবে তাকিয়ে না থেকে রুম থেকে বের হও। ঘুমাবো আমি।
-“ খাবি না?
-“ না বের হও প্লিজ।
শ্রেয়া অপমানিত বোধ করলো। কথা বলার ইচ্ছে নিয়ে আসলেও কথা না বলে খাবার নিয়ে চলে গেলো। শ্রেয়া বাহিরে আসতেই শ্রেয়ার বাবা নজরুল ইসলাম বলেন –
-“ খায় নি?
শ্রেয়া ছোট্ট করে জবাব দিলো-
-“ না।

-“ এখনও রেগে আছে আমার মেয়েটা। শুধু মাত্র তোর ইচ্ছে কে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য আমার ছোট মেয়েটার সাথে আমার এতো টা দূরত্ব বেড়ে গেলো।
নজরুল ইসলাম বুক ভরা কষ্ট আর অনুশোচনা নিয়ে চলে গেলেন।
নিখিল তাকিয়ে আছে সন্ধ্যার দরজার দিকে।
সন্ধ্যা নিখিলের মুখের উপর রুমের দরজা আটকিয়ে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিলো। নিখিল পলক ফেলতে ভুলে গেলো। মেয়েটার এতো জেদ? চার বছরের একটা বারের জন্য ও কথা বলে নি সন্ধ্যা নিখিলের সাথে। কোনো যোগাযোগ রাখে নি পরিবারের কারো সাথে। শুধু সন্ধ্যার মা সায়েমা বেগম বাদে। নিখিল দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চলে গেলো।
সন্ধ্যা বিছানায় শুতেই সন্ধ্যার ফোন বেজে উঠে। সন্ধ্যা ফোনের স্কিনে তাকিয়ে দেখে সন্ধ্যার খালা ফোন করেছে। সন্ধ্যা ফোন টা রিসিভ করে কানে নিয়ে বেলকনিতে চলে আসলো।

-“ হ্যালো খালা।
সন্ধ্যার খালা সালমা বেগম ফোনের ওপাশ থেকে বললেন –
-“ পৌঁছেছিস ঠিক মতো?
-“ হ্যাঁ।
-“ আপার অবস্থা কেমন?
-“ বেশি ভালো না খালা। আমাকে স্পষ্ট দেখতে পায় নি মা জানো। ওরা আমার মায়ের চিকিৎসা করে নি হয়তো।
-“ আমি ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রেখেছি। কাল আপা কে নিয়ে যাস।
-“ আচ্ছা, রাখি তাহলে।
সন্ধ্যা ফোনটা কেটে রুমে আসার জন্য উদ্দ্যত হলে হঠাৎ গিটারের আওয়াজ শুনতে পেয়ে থেমে যায় । এতো রাতে গিটার কে বাজাচ্ছে? কিছুক্ষণের মধ্যে বুঝতে পারলো গিটার টা উপর তালায় বাজানো হচ্ছে। বাহিরে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে এখনও। গিটারের সুর টা দারুন, ভালো লাগলো সন্ধ্যার তাই বেলকনির চেয়ারে বসে পড়লো। কেমন যেনো ঘোর লাগা সুর। এমন সুর আগে কখনও শুনে নি সন্ধ্যা। মিনিট পাঁচেক পর সন্ধ্যা শুনতে পেলো কোনো পুরুষালি কন্ঠে কেউ গাইছে…

আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল,
গেলরে দিন বয়ে।
বাঁধন-হারা বৃষ্টি ধারা
ঝরছে রয়ে রয়ে।
একলা বসে ঘরের কোণে
কি ভাবি যে আপন মনে,
সজল হাওয়া যূথীর বনে
কি কথা যায় কয়ে!
বাঁধন-হারা বৃষ্টিধারা
ঝরছে রয়ে রয়ে।
হৃদয়ে আজ ঢেউ দিয়েছে
খুঁজে না পাই কুল;
সৌরভে প্রাণ কাঁদিয়ে তুলে
ভিজে বনের ফুল।
আঁধার রাতে প্রহরগুলি
কোন্‌ সুরে আজ ভরিয়ে তুলি,
কোন্‌ ভুলে আজ সকল ভুলি
আছি আকুল হয়ে!
বাঁধন-হারা বৃষ্টি ধারা
ঝরছে রয়ে রয়ে!

সন্ধ্যা মুগ্ধ হয়ে শুনলো অচেনা পুরুষের গলায় গাওয়া এই গানটা। এই গান টা গেয়ে লোকটা আরেক টা সুর তুললো গিটারে। সন্ধ্যা বেলকনিতে বসে অপেক্ষা করলো গিটার বাজানো বন্ধ হবার। সাড়ে ১ টার দিকে গিটার বাজানো বন্ধ হলে সন্ধ্যা রুমে চলে আসে। মানতে হবে গুটারের সুরের সাথে সাথে লোকটার গানের গলাও মারাত্মক।
সকালে সন্ধ্যার ঘুম ভাঙে কলিং বেলের আওয়াজে। সন্ধ্যা উঠলো না। তবে আওয়াজ টা বেড়েই চলছে। কেউ কি দরজা খুলছে না নাকি? সন্ধ্যা ফোনে সময় দেখে নিলো। এখন ৬ টা ৫ বাজে। এতো সকালে কে এসেছে? সন্ধ্যা খোলা চুল গুলো হাত খোপা করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে এসে দরজা খুলে কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই দেখতে পায় দরজার সামনে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। শরীরে ব্লু কালারের টি-শার্ট। হাতে একটা বাটি। সন্ধ্যা ভ্রু কুঁচকে বলল-

-“ কে আপনি? সাতসকালে কেউ এভাবে দরজায় কলিং বেল বাজায়?
রাত পরিচিত বাড়িতে অচেনা এক মেয়েকে দেখে রীতিমতো চমকে গেলো। ভদ্রতার সহিতে বলল-
-“ কলিং বেল এভাবে বাজানোর জন্য দুঃখিত। কিন্তু আপনি কে? আপনাকে ঠিক চিনলাম না।
সন্ধ্যা কিছু বলার জন্য হা করতেই পেছন থেকে সন্ধ্যার চাচি বলে উঠল-
-“ কে এসেছে?
সন্ধ্যা দরজা থেকে সরে রুমে যেতে যেতে বলল-
-“ চিনি না। হয়তো কোনো সাহায্য চাইতে এসেছে।
রাত হতভম্ব হলো। সাহায্য মানে কি মিন করলো হাতে বাটি দেখে? চিন্তায় পড়ে গেলো রাত। রাতকে দেখে সন্ধ্যার চাচি নয়না বেগম হাসি মুখে বলল-

-“ আরে রাত যে। ভেতরে এসো।
রাত বাটি টা এগিয়ে দিয়ে বলল-
-“ আন্টি মা চিনি দিতে বলছে। আসলে চিনি শেষ হয়ে গেছে। আর এতো সকালে তো দোকান খোলাও থাকে না।
-“ আরে ব্যাপার না। আমি এখুনি এনে দিচ্ছি। তুমি ভেতরে এসে বসো।
রাত বাহিরেই অপেক্ষা করলো। নয়না বেগম চিনি এনে বাটি দিতেই রাত জিজ্ঞেস করলো –
-“ ঐ মেয়েটা কে ছিলো আন্টি?
-“ আরে ওটা তো সন্ধ্যা। চিনতে পারো নি?
রাত অবাক হলো। এই মেয়েটা সন্ধ্যা! অনেক পরিবর্তন এসেছে সন্ধ্যার মাঝে। এক ঝলক দেখেছিল রাত চার বছর আগে। আর কোনো কথা না বলেই রাত চলে গেলো।
সন্ধ্যা রুমে এসে ওয়াশরুমে ঢুকে হাত মুখ ধুয়ে নেয়। মাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যেতে হবে তো। সন্ধ্যা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখে তার রুমের দরজা খুলে কেউ হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকছে। সন্ধ্যা তাকালো। দেখলো একটা অচেনা মহিলা হন্তদন্ত হয়ে আসলো। সাথে সন্ধ্যার চাচি। মহিলাটার মুখে হাসি ঝুলছে। সন্ধ্যার চাচির দিকে তাকিয়ে বলল-

-“ এটাই সন্ধ্যা?
সন্ধ্যাট চাচি মাথা ঝাকালো।
মহিলা টা সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে আসলো। থুতনিতে হাত দিয়ে চুমু খেয়ে বলল-
-“ মাশা-আল্লাহ মাশা-আল্লাহ সন্ধ্যা তো দেখছি রাতের বলার থেকেও আরো বেশী মিষ্টি আপা।
সন্ধ্যা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো-
-“ রাত কে?
মহিলাটি হেসে বলল-

-“ আমার ছোট ছেলে রাত। একটু আগেই নাকি তোমাকে দেখে গেছে। আমাকে বলা মাত্রই তো ছুটে আসলাম তোমায় দেখতে।
সন্ধ্যা চাচির দিকে তাকালো। কিছুই বুঝলো না। এই মহিলা টা কে? আর তাকে দেখার জন্য ছুটে আসতে হবে কেনো তার? আর রাত ছেলেটাই কেনো গিয়ে তার মাকে বলবে তার কথা? হু ইজ রাত? সে কখন সন্ধ্যা কে দেখলো?

আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ২