আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ১২
Raiha Zubair Ripti
এই যে আমরা মনের বিরুদ্ধে গিয়ে যখন কাউকে ভালোবেসে ফেলি। একটু একটু ফিল করি হ্যাঁ সেই মানুষটির জন্য হৃদয় পু’ড়ে। একাকী বসে তাকে নিয়ে ভাবি,,কখনও তাকে ভাবার মাঝে অধিক শূন্যতায় চোখ দিয়ে অশ্রু অব্দি গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সেটা মানতে নারাজ হয়ে যায় শক্ত পক্ষ মস্তিষ্ক। ভালোবাসা কি কারো শূন্যতায় অনুভব করা যায়? অবশ্যই করা যায়। হুট করে কেউ অভ্যাসে পরিনত হয়ে যাওয়ার পর আচমকাই সেই অভ্যাসে বাঁধা পেলে কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে অনুভব করা হয় প্রতি নিয়ত। এই অনুভব করতে করতেই কখন যে তাকে ভালোবেসে ফেলা হয় সেটা বুঝাই যায় না।
তেমনই এই সন্ধ্যা,, সে ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। আগের মতো ডিপ্রেশনে ভুগছে। নজরুল ইসলাম খেয়াল করছেন মেয়ের আকস্মিক এমন পরিবর্তন তবে সাহস করে জিজ্ঞেস করতে পারছেন না। এই তো খাবার টেবিলে খাবার না খেয়ে খাবার শুধু চামচ দিয়ে নাড়ছে। শ্রেয়া রুমে। তার আজকাল রুমেই দিন কাটে। আজ নাকি ডিভোর্স পেপার সাথে নিয়ে আসবে নিখিল। কেমন যেনো নিজের ভাগ্য নিয়ে উপহাস হচ্ছে। আরে ভাই একটা বাচ্চা জন্ম দিতে পারবে না বলে মানুষ টা তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে? সে যদি সন্ধ্যা কে বিয়ে করতো। আর সন্ধ্যার যদি এই সমস্যা হতো। নিখিল কি সন্ধ্যা কেও ছেড়ে দিত? নিশ্চয়ই না। কারন সন্ধ্যা তো তার ভালোবাসা। আর শ্রেয়া সে তো ঘাড়ে চেপে বসা এক ঝামেলা। এটাকে যত তাড়াতাড়ি উপড়ে ফেলবে তত তাড়াতাড়িই তো সে হালকা বোধ করবে নিজেকে৷
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সন্ধ্যা খাবার টা সম্পূর্ণ খেতে পারলো না। খাবার ভর্তি প্লেটে হাত ধুয়ে উঠতেই কলিং বেল বেজে উঠে। সন্ধ্যা গিয়ে দরজা খুলতেই দেখতে পায় নিখিল এসেছে। সন্ধ্যা সাইডে সরতেই নিখিল ভেতরে ঢুকে। খাবার টেবিলেই ডিভোর্স পেপার টা রেখে নজরুল ইসলামের উদ্দেশ্যে বলে-
-“ চাচা পেপার কমপ্লিট। আমি সাইন করে দিছি। আপনার মেয়েকে বলুন সাইন করে দিতে।
সন্ধ্যা ভ্রু কুঁচকালো। কথা বলার ইচ্ছে না থাকলেও এগিয়ে এসে বলল-
-“ কিসের কাগজ এটা?
নিখিল শান্ত স্বরেই জবাব দিলো-
-“ পড়ে দেখ তাহলেই বুঝতে পারবি।
সন্ধ্যা চোখ বুলালো কাগজ টার ভেতর।
-“ ডিভোর্স পেপার। তা মিস্টার নিখিল আহমেদ আপনি নিজেকে কি ভাবেন বলুন তো?
-“ নাথিং।
-“ তাহলে আপনার সাহস হয় কি করে আপা কে ডিভোর্স দেওয়ার মতো কথা চিন্তা করার জন্য?
-“ কারন মাথাটা আমার তাই চিন্তা টাও আমার সেজন্য।
-“ ন্যূনতম লজ্জা নামক শব্দ টা কি আদৌও আপনার ভেতর আছে? ভালোবেসে বিয়ে করছেন দু’জন দু’জন কে। বিয়ের এতো বছর পর আপা মা হতে পারবে না বলে ডিভোর্স দিতে চাইছেন! পুরুষত্ব কি খুঁয়ে পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছেন? সমস্যা টা আপার না হয়ে আপনার হলে তখন কি হতো? এই তেজ কি তখন থাকতো?
-“ জাস্ট শাট-আপ সন্ধ্যা। যা জানিস না সেটা নিয়ে কথা বলিস না।
-“ ট্রাস্ট মি আমি ইন্টারেস্ট নই আর কিছু জানতে। তবে আপনার কাজ টা মোটেও ঠিক হচ্ছে না।
নিখিল সন্ধ্যার হাত থেকে ডিভোর্স পেপার টা নিয়ে বলল-
-“ সংসার আমার,চিন্তা টাও আমার। তুই প্লিজ নাক গলাস না।
সন্ধ্যা তপ্ত শ্বাস ফেলে চলে আসলো। যা ইচ্ছে করুক গিয়ে। বলার প্রয়োজন ছিলো তাই বলল।
রুমে আসতেই আবার একাকীত্ব লাগা শুরু করলো। ধূর বলে মাথার চুল টেনে ধরলো। কি একটা মনে করে বিছানা থেকে ফোন টা নিয়ে আষাঢ়ের নম্বরে ফোন লাগালো। ফোন ঢুকছে না। মনে পড়লো এটা তো বাংলাদেশী নম্বর। আমেরিকার নম্বর তো জানা নেই। সন্ধ্যা হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকলো অডিও কল দিলো। সেম ঢুকছে না ফোন। সন্ধ্যা ছুঁড়ে ফেলে দিলো ফোনটা। ফ্লোরে পড়ে কয়েক টুকরোতে বিভক্ত হলো। ফোন টা ভাঙার শব্দে হুঁশ আসলো৷ ওহ শিট বলে ফোনের কাছে এগিয়ে গেলো। ভাঙা ফোনটা টা হাতে তুলে নিয়ে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো। কি হচ্ছে তার সাথে এটা? ভাঙা ফোন টেবিলের উপর রেখে ড্রয়ার থেকে ঘুমের ঔষধ বের করে দুটো খেয়ে নিলো।
রাত নিজের রুমে বসে ল্যাপটপে প্রেজেন্টেশন রেডি করছিলো। আমেনা বেগম হাতে ফোন নিয়ে রাতের রুমে ঢুকে বলল-
-“ কি রে রাত আষাঢ়ের ফোনে ফোনকল ঢুকছে না কেনো?
রাত ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে বলল-
-“ ওহ্ মা বলতে ভুলে গেছি..আসলে ভাইয়া নম্বর চেঞ্জ করেছে। আমার কাছে দাও৷ হোয়াটসঅ্যাপে এড করে দিচ্ছি।
রাত নম্বর টা এড করে দিয়ে আষাঢ়ের নাম সেভ করে দিলো। আমেনা বেগম ফোনটা নিয়ে নিজের রুমে এসে ছেলেকে ফোন করলো। আষাঢ় সবেই হসপিটাল থেকে হোটেলে ফিরেছে। ভীষণ ক্লান্ত শরীর নিয়ে বেলকনিতে বসতেই ফোন কল বেজে উঠলো। আচমকা বেজে উঠায় একটু চমকেও উঠলো সাথে। পকেট থেকে ফোনটা বের করে মায়ের নম্বর দেখে সাথে সাথে রিসিভ করলো।
-“ হ্যালো মা।
-“ নম্বর চেঞ্জ করেছিস কেনো? বিকেলে থেকে ট্রাই করছিলাম ঢুকছিলো না। রাত কে বলায় বলল চেঞ্জ করেছিস।
-“ এমনি। খেয়েছো?
-“ হু তুই?
-“ না। কেবল ফিরলাম হসপিটাল থেকে।
-“ আচ্ছা খেয়ে নে তাড়াতাড়ি। তারপর শুয়ে পড়িস। অনেক ধকল তাই না বাবা?
আষাঢ় স্মিত হাসলো।
-“ সয়ে যাবে মা ধকল টা।
-“ শুভ রাত্রি।
আমেনা বেগম ফোন কে’টে বিছানা ঠিক করলো। আষাঢ় পকেটে ফোনটা ঢুকাতেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ আসলো। আষাঢ় দরজা খুলতেই খাবার নিয়ে ঢুকলো ডক্টর আফরোজা নাজনীন। আষাঢ় ভ্রু কুঁচকে বলল-
-“ আপনি?
ডক্টর আফরোজা নাজনীন ভেতরে ঢুকতপ ঢুকতে বলল-
-“ তোমার কাছেই আসছিলাম। আর দেখলাম স্টার্ফ খাবার নিয়ে তোমার রুমের দিকেই আসছিলো। তাই তার থেকে খাবার টা নিয়ে আমিই আসলাম।
-“ আমাকে কি জন্য দরকার?
-“ আপনার সাথে একটু খোলামেলা ভাবে পরিচিত হতে আসলাম।
-“ বাট অ্যাম নট ইন্টারেস্টেড। অ্যাম ফিল ভেরি টায়ার্ড। আই নিড স্পেস। ইউ ক্যান গো।
-“ ওকে। আসছি টেক কেয়ার ইউর সেল্ফ।
আফরোজা নাজনীন চলে গেলো। আষাঢ় লম্বা শ্বাস টেনে দরজা আটকে দিয়ে খাবার টা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
পরের দিন সকালে সন্ধ্যা ঘুম থেকে উঠে শুনতে পেলো নিখিল বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। গতকাল রাতে নাকি সন্ধ্যা রুমে চলে আসার পর হাঙ্গামা হয়েছিল। শ্রেয়া ডিভোর্স পেপার ছিঁড়ে ফেলেছে। সে কিছুতেই ডিভোর্স দিবে না নিখিল কে। নিখিল ও সাফ সাফ বলে দিয়েছে তার পক্ষে সম্ভব না আর থাকা। সেজন্য জামাকাপড় নিয়ে চলে গেছে। সন্ধ্যার কাছে বাসা টা এখন জাস্ট বিরক্তিকর লাগছে। কেনো সে আসতে গেলো ফের ঢাকায়। রাজশাহীতে ই তো ভালো ছিলো। কোনোরকম ব্রেকফাস্ট করে বাসা থেকে বের হলো। ফোন কিনতে হবে। তার আগে এটিএম বুথে যেতে হবে টাকা তুলতে। রিকশায় চড়ে বুথে এসে টাকা তুলে ফোনের দোকানে গেলো। বাজেট অনুযায়ী একটা ফোন কিনে তাতে সিম ঢুকিয়ে নিলো। তারপর বাসার দিকে আসতে নিলে রাতের মায়ের সাথে দেখা হয়। সন্ধ্যা সালাম দেয়। আমেনা বেগম আকস্মিক সন্ধ্যাকে দেখে বলল-
-“ আরে তুমি এখানে কেনো?
-“ ফোন কিনতে এসেছিলাম আর কি। আপনি এখানে যে?
-“ স্বর্ণের দোকানে আসছিলাম গয়না বানাতে।
-“ আপনার জন্য?
-“ না না।
-“ ছেলের বউদের জন্য।
-“ ছেলের বউদের জন্য মানে?
-“ কদিন পর ছেলে বিয়ে করবা না। তো মেয়েকে তো আর খালি হাতে আনতে পারি না।
-“ ডাক্তার সাহেবের বিয়ে?
বিরবির করে বললো সন্ধ্যা। আমেনা বেগম শুনে ফেললো।
-“ হ্যাঁ ঠিক ধরেছো।
সন্ধ্যা চমকালো। তবে তা বুঝতে দিলো না।
-“ আপনার ছেলের খোঁজ পেয়েছেন আন্টি?
আমেনা বেগম ভ্রু কুঁচকে বলল-
-“ ছেলের খোঁজ পেয়েছি মানে? আমার কোনো ছেলে হারিয়েছিলো নাকি?
-“ না না ডাক্তার সাহেবের কথা বলছি।
-“ ও তো আমেরিকা গেছে। জানো না?
-“ হ..হ্যাঁ জানি। কিন্তু রাত যে বললো তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না।
-“ হ্যাঁ নম্বর চেঞ্জ করেছে তো।
-“ নম্বর চেঞ্জ করেছে! এরজন্য ই কি ফোন ঢুকছিলো না? মনে মনে বিরবির করে বলল সন্ধ্যা। আমেনা বেগম সন্ধ্যা কে এখনও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল-
-“ দাঁড়িয়ে আছো কেনো। আসো বাসায় ফিরবে তো?
-“ হু। আ..আন্টি আপনার ফোন টা একটু দেওয়া যাবে? আসলে একটু কল দিতাম। আমার ফোনে টাকা নেই
-“ কেনো নয়। নাও।
ব্যাগ থেকে বের করে ফোন টা সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে দিলো। সন্ধ্যা ফোন টা নিয়ে কল লিস্টে ঢুকলো। আষাঢ়ের নাম দিয়ে সেভ করা একটা নম্বর দেখতে পেয়ে মুখে হাসি ফুটলো। তবে তা ক্ষনস্থায়ী হলো না। এটা সেই পুরোনো নম্বর। নতুন কোনো আমেরিকার নম্বর তো সন্ধ্যা দেখতে পাচ্ছে না। কি একটা মনে করে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকলো। প্রথমেই আষাঢ়ের নাম দেখতে পেলো। তড়িঘড়ি করে নম্বর টা নিজের ফোনে উঠিয়ে নিলো। তারপর আষাঢ় ২ দিয়ে সেভ করলো। আর ফোনটা সাইলেন্ট করলো। তারপর হোয়াটসঅ্যাপ থেকে বেরিয়ে নিজের নম্বরেই ফোন দিলো। একবার দিয়েই ফোনটা আমেনা বেগমের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল-
আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ১১
-“ আন্টি ফোনটা ধরছে না যাকে দিয়েছি।
আমেনা বেগম ফোনটা ব্যাগে ধরে বলল-
-“ চলো তাহলে রিকশা এসে গেছে।
সন্ধ্যা হু বলে নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে বিশ্বজয়ের একটা হাসি দিলো।