আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ২৩

আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ২৩
Raiha Zubair Ripti

সকাল হতেই কনা ব্রেকফাস্ট করে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। আসার পথে চেয়েছিল আকস্মিক ভাবে হলেও রাতের সাথে যেনো একবার দেখা হোক। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। রাতের সাথে দেখা তো দূর তার ছায়ার দেখাও মিললো না। ভারাক্রান্ত মন নিয়েই চলে আসলো।
কয়েক ঘন্টার জার্নি শেষ করে নিজের বাসায় পৌছালো। বাসায় আসতেই দারোয়ান জানালো তার বাবা অফিসে আছে। কনা দারোয়ানের থেকে চাবি নিয়ে সদর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। ডাইনিং টেবিল পাশ কাটিয়ে যেতেই দেখলো টেবিলের উপর সাদা এক টুকরো কাগজ ভাজ করা। কনা ল্যাগেজ টা পাশে রেখে কাগজ টা খুললো। কনার বাবা লিখেছে—

“ খাবার রান্না করা আছে মা। খেয়ে নিও। আমি বিকেলেই চলে আসবো।
কনা মৃদু হাসলো। কি নিদারুণ একটা বাবা পেয়েছে সে। এমন বাবা প্রতিটি মেয়ে ডিজার্ভ করে।
কনা নিজের রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে খাবার খায়। বিকেলের দিকে কামরুল হাসান বাসায় আসে। কনা দেখামাত্রই বাবা কে সালাম দেয়। কামরুল হাসান সালামের জবাব দিলো। নিজের রুমে গিয়ে পোশাক চেঞ্জ করে বসার ঘরে এসে চুপচাপ কনাকে বসিয়ে তার চোখে চোখ রেখে জানতে চাইল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“ খেয়েছিস?
-“ হুম।
-“ রাহুল ছেলেটা কে?
-“ আমি যেই কোচিং এ পড়তাম। রাহুল ও সেখানে পড়ে।
“ ওহ্ আচ্ছা তা রাহুল আর তোর বিয়ে নিয়ে কিছু ভেবেছিস?
কনা চুপ, অস্বস্তিতে পড়ে যায়। তার ঠোঁটে কথা আটকে যায়। অনেক কিছু বলা ছিল, কিন্তু ঠিক কীভাবে, কিভাবে শুরু করবে, কিছুই ঠিক ঠাক বোঝে না। এ মুহূর্তে মনে হয় যেন সে অনেক সময় চেয়ে নেয়, কিন্তু সময় কি আসলেই পাওয়া যায়?
“বাবা, আমি ঠিক জানি না। এখনোও আমার নিজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো অবস্থায় হয় নি। তুমি যা ঠিক মনে করবে আমি তাই করবো।
কামরুল হাসান মাথা নেড়ে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন, “তোমার আর রাহুলের সম্পর্ক নিয়ে কেমন তা আমি জানি না। কিন্তু সিদ্ধান্ত তোমার। তোমার সুখটাই তো সবচেয়ে জরুরি, কনা। তুমি ভালোভাবে ভাবো। সময় লাগলে সময় নাও। নো তাড়াহুড়ো।
কনা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
ঠিক সেই মুহূর্তে তার ফোন বেজে উঠল। রাহুলের ফোন। কামরুল হাসান রাহুলের নম্বর দেখে বসা থেকে উঠে বলল-

-“ কথা বলো আসছি।
কিছুটা সময় নিয়েই ফোনটা রিসিভ করল।
“হ্যালো কনা। কেমন আছো?”
রাহুলের কণ্ঠে কিছুটা অস্বস্তি, কিছুটা অভিব্যক্তি ছিল, মনে হচ্ছিল লোকটা তার ফোন রিসিভের অপেক্ষাতেই ছিলো। কনা কিছুটা ভাবল, তারপর বলল,
-“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন?”
রাহুল একটু থেমে, তারপর বলল,

-„ আলহামদুলিল্লাহ আমিও ভালো আছি। কনা আমি কিছু বলতে চাই। আমি জানি তুমি একটু দ্বিধায় আছো হুট করে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো নিয়ে। আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি। প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়ে যায়। আমার দৃষ্টি যেনো আর কোনো রমণী তে গিয়ে না আটকায় সেজন্য প্রস্তাব টা পাঠানো। তুমি যত পারো সময় নাও আমাদের সম্পর্ক টাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আমি অপেক্ষা করবো। তুমি রাজি হলেই আগাবো। জাস্ট আমাকে করুনা করে হলেও তোমার জীবনের সাথে জড়িয়ে দিও।

কনা কিছুটা নীরব হয়ে গেল। তার ভেতর কিছু একটা হালকা অনুভূতি উঠছিল, এক মুহূর্তের জন্য রাহুলের কথা ভাবতে শুরু করলেন, রাহুলের জায়গায় নিজেকে বসালো। কনা নিজেও রাতকে ঠিক এভাবেই বলেছিল। প্রতিত্তোরে রাত তাকে উপেক্ষা করে চলে গেলে। ইশ তখন যা কষ্ট হয়েছিল। আচ্ছা রাহুল কে রিজেক্ট করলে কি রাহুলের ও সেম কষ্ট হবে? হয়তো। কিন্তু কনার কষ্ট হচ্ছে কেনো। কিসের জন্য হচ্ছে কষ্ট৷ কাকে নিয়ে হচ্ছে?
“আমি সময় নিয়ে আবার আপনার সাথে কথা বলে জানাবো।

কথাটা বলার সময় কনার মনের ভেতর যে অস্থিরতা তা খুব স্পষ্টভাবে অনুভব করছিল কনা।
” ঠিক আছে, আমি অপেক্ষা করবো। তবে তুমি জেনে রেখো, আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি।”
কনা ফোনটা রেখে দিলো, তার মনের মধ্যে একাধিক প্রশ্ন। এ সিদ্ধান্ত এত সহজ হবে না। তবে সময় যেহেতু চাওয়া হয়েছে তারমানে নির্দিষ্ট একটা সিদ্ধান্তে তার যেতে হবে।
একদিকে রাত তার মায়ের মুখে শুনলো কনা নাকি তার বাড়ি চলে গেছে। রাত খুশি হলো কিছুটা। কিন্তু কনার কথা বারবার মাথায় ঘুরছে।

নিজের রুমে গিয়ে রাত আয়নার সামনে দাঁড়াল। নিজের চোখে অদ্ভুত এক শূন্যতা দেখতে পেল। শূন্যতা টা ছিলো সন্ধ্যা কে এই জীবনে না পাওয়ার
রাতের চোখে পানির ছাপ দেখা গেল। সে জানে, তার জীবনের গল্পে একটা অধ্যায় চিরকাল অসমাপ্ত থেকে গেছে। কিন্তু এই অসমাপ্তির মধ্যে দিয়েই হয়তো তাকে চলতে হবে।
রাত জানালার বাইরে তাকিয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল,
“আমাকে নিজের জীবনে একটা পরিণতি আনতে হবে। আর কনাকে তোমাকে তোমার সঠিক পথ দেখতে হবে। তোমাকে তোমার নতুন জীবনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে, যেখানে তোমার জন্য সত্যিকারের সুখ অপেক্ষা করছে।”

ঘরভর্তি মোমের নরম আলো। হালকা মশলার সুগন্ধে মিশে থাকা এক অদ্ভুত মায়াময় পরিবেশ। জানালার বাইরে আকাশ ভরা কালো মেঘ, যেন প্রকৃতিও আজ কোনো রহস্যময় রাতের সাক্ষী হতে চাইছে।
রিসোর্টের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ধীরে ধীরে গাঢ় নীরবতায় ঢেকে যাচ্ছে। রাত নামতেই চারপাশে ঝিঁঝি পোকার ডাক, ঝরনার মৃদু শব্দ আর দূর থেকে ভেসে আসা মেঘের গর্জন মিলে পরিবেশটা যেন আরও বেশি রোমান্টিক করে তুলেছে।
সন্ধ্যা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রাতের মিষ্টি ঠাণ্ডা হাওয়া তার চুল উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আষাঢ় তার পিছনে এসে দাঁড়াল। দেখলো সন্ধ্যার হাতে একটা বই। বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সে আষাঢ় কে আড়চোখে দেখছে।
“তুমি বই পড়ার ভান করছো, আমি জানি।”
সন্ধ্যা হেসে বলল,

“আপনার মতো মানুষ পাশে এসে দাঁড়ালে কি আর বইয়ে মন বসে?”
“তাহলে আমাকেই পড়ো। আমি পুরো একটা এনসাইক্লোপিডিয়া। আমার ভেতর গল্প, কবিতা, নাটক, আর রহস্য সবই আছে।”
সন্ধ্যা মুখ কুচকে বলল,
“আপনার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে আপনি একের ভেতর সব। পুরাই মিস্ট্রি বক্স।
আষাঢ় হাসল,

“চিরকাল তো তোমার সঙ্গেই কাটবে। তাই নিজেকে একের ভেতর সব ফাংশনে ডাউনলোড করে নিলাম।
সময়টা যেন থেমে গেছে, একে অপরের চোখে চোখ রেখে তারা বুঝতে পারছিল, জীবনের পথে কোনো বিশাল বাণী নেই। কিন্তু তাদের মধ্যকার ছোট ছোট অনুভূতিগুলোই যেন এত বড় হয়ে উঠছে।
“তুমি জানো, সন্ধ্যা, আমাদের সম্পর্কটা অনেকটা এই পাহাড়ের মতো। কেউই জানে না কখন মেঘ চলে যাবে, আবার কখন ঝরনা বইতে শুরু করবে। শুধু বিশ্বাস রাখতে হবে একে অপরের ওপর।”
দুজনের হাসি-ঠাট্টার মাঝেই সন্ধ্যা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল।
“তোমার চোখে কিসের এত ভাবনা?” আষাঢ় হালকা গলায় জিজ্ঞাসা করল।
সন্ধ্যা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“ভাবছি, আমার প্রতি আপনার এই ভালোবাসাটা এভাবেই থেকে যাবে তো?”
আষাঢ় তার কাঁধে হাত রাখল।

“ভালোবাসা কখনো হারায় না, সন্ধ্যা। সময়, পরিস্থিতি—সব বদলালেও ভালোবাসার এই অনুভূতিটা চিরন্তন।”
সন্ধ্যা হেসে বলল, “আপনি সবসময় এত মিষ্টি কথা বলেন কীভাবে?”
আষাঢ় মুচকি হাসলো। হাত বাড়িয়ে সন্ধ্যাকে কাছে টেনে নিল। তার গভীর চোখে তাকিয়ে বলল,
“❝” তোমার মায়াভরা চোখে
আষাঢ়ের চাঁদ কে দেখতে পাই,
তোমার স্পর্শে যেন
নিজের অস্তিত্বে কে খুঁজে পাই❞
সন্ধ্যা কিছু বলতে পারল না। তার চোখের কোণায় লজ্জার রেখা ফুটে উঠল।
আষাঢ় একটুও সময় নিল না। তার দু’হাতের শক্ত অথচ কোমল ছোঁয়ায় সন্ধ্যাকে কোলে তুলে নিল।
“আষাঢ়! আপনি—”

তার বাক্য অসমাপ্তই রয়ে গেল। আষাঢ় গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে আজ কথা বলতে হবে না। আজ শুধু আমি বলব, তুমি শুনবে। আমি ছুঁয়ে দেখব, তুমি অনুভব করবে রাজি মিসেস আহমেদ? ”
সন্ধ্যা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। তার শ্বাস যেন দ্রুত হয়ে উঠল।
আষাঢ় তাকে ধীরে ধীরে বিছানায় শুইয়ে দিল। তার চুলের খোঁপা খুলে দিয়ে বলল,
“তোমার এই চুলের ঘ্রাণ আমাকে পাগল করে দেয়, সন্ধ্যা।
সন্ধ্যার ঠোঁট কাঁপছিল কিছু বলার জন্য, কিন্তু শব্দ বের হলো না। আষাঢ় তার উপরে ঝুঁকে তার মুখটা দু’হাতে ধরে বলল,

“তোমার চোখে এমন এক জাদু আছে, যা আমাকে তলিয়ে দেয়। তুমি জানো না, আমি কতবার এই চোখের ভেতর হারিয়ে গেছি।”
সে ধীরে ধীরে সন্ধ্যার কপালে চুমু খেল। কপালের নরম স্পর্শে সন্ধ্যা চোখ বন্ধ করে ফেলল।
“আজ, এই রাত, তোমার প্রতিটা মুহূর্ত আমার। তুমি আমার পৃথিবী, সন্ধ্যা।”
তার ঠোঁট সন্ধ্যার ললাট থেকে নামতে নামতে তার গালের পাশ ঘেঁষে নামল। সন্ধ্যার গলা শুকিয়ে গেল।
“আষাঢ়…” তার গলার স্বরে কম্পন।
“শান্ত হও, সন্ধ্যা,” আষাঢ় মৃদু হেসে বলল।

-“ আমি শান্তই ছিলাম। কিন্তু আপনি আমাকে অশান্ত করে ফেলছেন ডাক্তার সাহেব। এটা তো ঠিক না।
তারপর সে সন্ধ্যার হাত নিজের হাতে নিয়ে তার আঙুলে একটার পর একটা চুমু দিল।
-“ আর তুমি যখন আমাকে অশান্ত করে ফেলো তার বেলায়?
সন্ধ্যা ভ্রু কুঁচকে বলল-
-“ কখন করলাম?

-“ অলওয়েজ করো। তোমাকে দেখলেই তো আমি অশান্ত হয়ে পড়ি। ডেস্পারেট হই একটু ছুঁইয়ে দেওয়ার জন্য। তা মিসেস আজ কি একটু অনুমতি মিলবে ছুঁইয়ে দেওয়ার? দেখো বাহিরের পরিবেশ টা। একদম রোমান্টিক ভাইব দিচ্ছে। বিবাহিত হয়েও যদি অবিবাহিত দের মতো থাকি তাহলে তো খুব অন্যায় হয়ে যায় নিজের সাথে।
সন্ধ্যা আষাঢ়ের শার্টের কলার চেপে ধরলো। চোখ মুখে ছিলো ভয় লজ্জা। আষাঢ় বুঝলো সম্মতি আছে। কারন সন্ধ্যার কোনো কিছুতে আপত্তি থাকলে সেটা মুখের উপর বলে দেয়।
বাইরে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। বৃষ্টির শব্দ যেন এক মোহময় সুর তুলে ধরল। ঘরের ভেতরে আষাঢ়ের স্পর্শ আর সন্ধ্যার লজ্জা এক হয়ে রাতটাকে অদ্ভুত এক আবেগময় রূপ দিল।
সেই রাতের প্রতিটা মুহূর্তে যেন আষাঢ় আর সন্ধ্যা হারিয়ে গেল নিজেদের ভালোবাসার গভীরতায়, যেখানে সময় থেমে গিয়েছিল।

আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ২২

বাইরে আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। মৃদু হাওয়ার সাথে বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা স্পষ্ট। ঘরের ভেতরে মোমের নরম আলো যেন চারপাশে এক মায়াবি পরিবেশ তৈরি করেছে। বৃষ্টির শব্দ আর ঘরের ভেতরের মৃদু আলোতে রাতটা যেন ভালোবাসার এক অসীম অধ্যায়ে পরিণত হলো।

আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ২৪