আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ২৭
Raiha Zubair Ripti
-“ আপনি এখানে?
কথাটা বলতেই রাহুল এগিয়ে আসলো। কনার বাহু ধরে বলল-
-“ তুমি এখানে কেনো কনা?
কনা ঘাবড়ে গেলো। যাক রাহুল তাহলে হয়তো কিছু শুনে নি। কনা বাহু থেকে রাহুলের হাত সরিয়ে বলল-
-“ উপরে চলুন। সবাই হয়তো আমাদের খুঁজছে।
রাহুল সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল,
-“ তুমি যাও আমি আসছি।
কথাটা বলে রাহুল সামনের দিকে হাঁটা ধরলো। কনা পেছন থেকে ডাকলো-
-“ কোথায় যাচ্ছেন?
-“ ফিরছি আমি তুমি যাও।
কনা নিঃশব্দে উপরে উঠে গেল। সিঁড়ি তে আসতেই দেখলো আষাঢ় তড়িঘড়ি করে নিচে নামছে। কনা ভ্রু কুঁচকে বলল-
-“ কোথায় যাচ্ছেন আষাঢ় ভাই?
আষাঢ় ব্যস্ততার সহিত জবাব দিলো-
-“ গিফট আনতে যাচ্ছি।
কনা বুঝলো না আষাঢ়ের কথার মানে। হয়তো সন্ধ্যার জন্য কোনো গিফট। কনার মনের ভেতর খচখচ করতে লাগল।
কনা ছাঁদে আসলো। ছাঁদে পা রাখতেই সন্ধ্যা কনাকে টেনে গম্ভীর কন্ঠে বলল-
-“ আর আসতে হবে না। অনুষ্ঠান শেষ। রুমে গিয়ে ঘুমাবি চল।
কনা অবাক হয়ে বলল-
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
-“ অনুষ্ঠান শেষ!
-“ হু। চল।
সন্ধ্যা কনাকে ধরে রুমে নিয়ে আসলো।
-“ যা ফ্রেশ হয়ে হলুদ ধুয়ে আয়।
কনা সন্ধ্যার কথা মতো শাড়ি পাল্টে হলুদ শরীর ধুয়ে পরিষ্কার কাপড় পড়ে নিলো। বিছানায় এসে শুতেই সন্ধ্যা কনা কে আচমকা জড়িয়ে ধরে বলল-
-“ খুব বড় গেছিস তাই না কনা?
-“ হঠাৎ এমন কথা কেনো বলছিস?
-“ না এমনি মনে হলো। ঘুমা নতুন সকাল তোর জন্য নতুন কিছু অপেক্ষা করছে।
-“ নতুন কিছু মানে?
-“ নতুন জীবন শুরু করবি সেটার কথাই বলছি।
কনার মুখে বিদ্রুপের হাসি ফুটলো। নতুন জীবন! কাশ নতুন জীবন হতো।
-“ আমার সাথে ঘুমাবি আজ? ভাইয়া কোথায়?
-“ ও একটা কাজে গেছে। ফিরবে কি ফিরবে না জানি না। আসলে আঙ্কেলের সাথে ঘুমাবে নি। আমি আজ তোর সাথেই ঘুমাবো।
-“ ঠিক আছে।
রাতের আঁধার যখন ক্রমশ ফিকে হয়ে যায়, তখন পূর্ব আকাশে সূর্যের প্রথম কিরণ জানান দেয় একটি নতুন দিনের শুরু।
নতুন সকাল মানেই এক অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রকাশ। পূর্ব দিগন্তে সূর্যের আগমন যখন আকাশকে লালচে-কমলা রঙে রাঙিয়ে তোলে, তখন মনে হয় যেন প্রকৃতি এক নতুন চাদরে সেজেছে। ঠাণ্ডা বাতাসের স্পর্শে মনের মাঝে জাগে এক অনাবিল প্রশান্তি।
এই নতুন সকাল নিয়ে আসতে পারে অগণিত সম্ভাবনা, শিশিরভেজা ঘাস, পাখির কাকলি, এবং আকাশে ভাসমান সোনালি রঙের মেঘের ছায়া মনে করিয়ে দেয় যে জীবনে কখনোই শেষ কথা বলে কিছু নেই।
কনাকে নিজ হাতে তৈরি করে দিচ্ছে সন্ধ্যা। মেরুন কালারের বেনারসিতে অপূর্ব লাগছে কনা কে। সাজানো শেষ হতেই সন্ধ্যা কনার দিকে দু হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল-
-“ নজর না লাগুক কারো। খুব সুন্দর লাগছে তোকে। বেস্ট একটা দিন তোর।
কনা আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে রইল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে যেন চিনতেই পারছে না। আয়নার ভেতরের মেয়েটি কি সত্যিই সে? মেরুন বেনারসির জমকালো সাজ, চোখে মোহময় কাজল, ঠোঁটে হালকা লাল রঙ। যেন কোনো রূপকথার রাজকন্যা। অথচ এই মেয়েটার ভেতরটা যেন ঠিক তার বিপরীত—চোখের পেছনে চাপা এক অসন্তোষ, মুখের হাসির আড়ালে এক অপূর্ণতা। সাজানো চেহারার পেছনে থাকা মন যেন বোবা চিৎকার করছে।
সন্ধ্যা একপাশ থেকে কনার চুল ঠিক করে দিল। মৃদু হেসে বলল,
– “আজকে তুই সবার থেকে আলাদা । বউ বলে কথা।
কনা মুখ তুলে সন্ধ্যার দিকে তাকাল। গলার কাছে আটকে থাকা কথাগুলো বলার জন্য যেন কিছুটা সাহস খুঁজল। তবে তার আগে সন্ধ্যা আবার বলল,
– “এখন সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে। নতুন জীবনের জন্য তৈরি হয়ে যা। বেস্ট অফ লাক ডিয়ার।
কনার ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপের ছায়া ফুটে উঠল। ‘নতুন জীবন’ কথাটা বারবার কানের ভেতর প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। নতুন জীবনের স্বপ্ন হয়তো ছিল একসময়, কিন্তু এখন তার কাছে সবকিছুই যেন ভীষণ অনিশ্চিত আর ধোঁয়াশা।
সন্ধ্যা কনার কাঁধে হাত রেখে বলল
– “চল, নিচে সবাই অপেক্ষা করছে। সময় হয়ে এসেছে।”
কনা কিছু না বলে মাথা নত করল। চোখেমুখে একটা চাপা বিষণ্ণতা স্পষ্ট।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কনা মনে মনে ভাবল, ‘আজকের দিনটা সত্যিই বেস্ট? নাকি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় বিষাদময় দিন’
বসার রুমে আসতেই সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত। জামাই এখনও আসে নি। আসতেছে। চারপাশে মৃদু আলোর ঝলকানি, মিষ্টি গান আর মানুষের কোলাহল। অথচ কনার মনে একটাই প্রশ্ন—’এই কোলাহল কি আমার জীবনের নীরবতাকে আড়াল করতে পারবে?’
আষাঢ় একপাশে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিল। কিন্তু তার মুখে যেন কোনো এক অদ্ভুত গাম্ভীর্যের ছাপ। ভোরের দিকে ফিরেছে সে। আর ফিরতেই কামরুল হাসান আষাঢ় কে বিয়ের দিকটা দেখতে বলেন। বেচারা ঘুমে তখন ছুপছুপ ছিলো। কিন্তু মুখের উপর বলতে পারলো না তার ঘুমের দরকার। অগ্যতা খাবারের দিকটা দেখলো। সন্ধ্যা আষাঢ় কে দেখামাত্রই এগিয়ে এসে বলল-
-“ এভরিথিং ইজ ওকে?
-“ হু।
-“ ফিরেছেন কখন?
-“ ভোরে।
-“ চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে ঘুমান নি রাতে।
-“ হু।
-“ তো এসেও কি ঘুমান নি?
-“ ঘুমানোর আর সময় ই বা পেলাম কোথায় বলো। আই নিড ঘুম সন্ধ্যা। আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।
-“ আচ্ছা আপনি রুমে গিয়ে ঘুমান। আমি বাকিটা সামলে নিব।
-“ কিছু সামলানোর লাগবে না। কারন ও আসবে না।
সন্ধ্যা চমকে উঠলো।
-“ আসবে না মানে?
-“ রাজি হয় নি। আর আমি চেষ্টা করেছি সারা রাত বুঝানোর জন্য কিন্তু ও বুঝে নি। জোর করো কারো হৃদয়ে কারো জন্য অনুভূতি সৃষ্টি করা যায় না সন্ধ্যা।
-“ আমার মন বলছে ও আসবে। আমি কথা বলেছি তো ওর সাথে। আমি বুঝিয়েছি। মনে হচ্ছে ও আসবে।
-“ বৃথা ভাবছো। আমি গেলাম।
ঠিক ১ টার দিকে শোনা গেলো জামাই এসেছে। কথাটা কানে আসতেই সন্ধ্যার মুখে হাসি ফুটলো। সে জানতো বর আসবে। সন্ধ্যা কনার সাথে থাকায় আর বরের কাছে যেতে পারলো না। বরকে স্টেজে বসানো হয়েছে। কনার, বর আসার কথা শুনেই বুকের ভেতর যন্ত্রণা শুরু হতে লাগলো। বাহিরে কেমন যেনো চেচামেচির আওয়াজ ও শোনা যাচ্ছে। একটু পর কামরুল হাসান আসলেন সন্ধ্যার কাছে। সন্ধ্যাকে সাইডে ডেকে কিছু বললেন। সন্ধ্যা কামরুল হাসান কে কি বললো তা কনা শুনতে পেলো না। কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা আষাঢ়ের রুমে গেলো। আষাঢ় কে জাগিয়ে তুলে বলল-
-“ আরে উঠুন।
আষাঢ় ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে বলল-
-“ হোয়াই?
-“ বিয়ের ব্যান্ড বাশি ঢোল বাজাবেন সেজন্য উঠুন তো।
আষাঢ় উঠে বসলো।
-“ যান ফ্রেশ হয়ে আসুন। বর পক্ষ চলে এসেছে কাজিও চলে এসেছে। বিয়ে পড়াবে। আমি যাচ্ছি আপনি রুম থেকে বের হয়ে আঙ্কেলের কাছে যাইয়েন তো। সে কিছু বলবে।
-“ বর এসেছে!
সন্ধ্যা বিশ্ব জয়ের হাসি দিয়ে বলল-
-“ তা আসবে না? যান এখন কনার বাবা কে বুঝিয়ে আসুন। আমি চললাম।
সন্ধ্যা বেরিয়ে আসলো। কনার কাছে এসে বসতেই কনা জিজ্ঞেস করলো-
-“ কি হয়েছে?
-“ নাথিং তেমন কিছু না।
কথাটা বলতেই হঠাৎ বাহির থেকে একটা মেয়ে এসে কনা কে জড়িয়ে ধরলো। কনা হকচকিয়ে গেলো। মেয়েটির মুখের দিকে তাকাতেই দেখলো শরিফা এসেছে। চমকালো কনা।
-“ তুমি এখানে!
শরিফা সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে বললে সন্ধ্যা ইশারায় চোখ গরম করে তাকায়। শরিফা মৃদু হেঁসে বলল-
-“ তোমার বিয়ে আর আমি আসবো না? দাওয়াত দাও নি তো কি হয়েছে? আমি যেচেই চলে এসেছি।
কনার মাথাতেই ছিলো না শরিফা কে জানানোর। শরিফা বসলো। সন্ধ্যা জিজ্ঞেস করলো-
-“ ছেলের বিয়ে পড়ানো শেষ?
-“ হ্যাঁ। এখন এখানে আসবে।
কথাটা বলতেই কাজি এসে হাজির। কনার সামনে চেয়ার টেনে বসে বলল-
-“ পাত্র রাত আহমেদ, তার পিতা আশরাফুল ইসলাম এবং মাতা আমেনা বেগম, এবং কনে কনা, তার পিতা কামরুল হাসান এবং মাতা সানজিদা বেগম, সকলের সম্মতিতে এই বিয়েটি সম্পন্ন হচ্ছে।
এখন, পাত্রীর কাছে জানতে চাই,কনা, তুমি কি রাত আহমেদকে তোমার স্বামী হিসেবে কবুল করো?”
রাতের নাম শুনতেই কনা চমকে উঠলো। মন হয়ে গেল অবশ। এক মুহূর্তের জন্য সবকিছু থমকে দাঁড়াল। রাতের নাম টা শুনে তার বুকের গভীর থেকে যেন একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। চারপাশের শব্দ, মানুষের কোলাহল, সবার হাসি—সব যেন এক মুহূর্তে নিস্তব্ধ হয়ে গেল তার জন্য।
রাতের নাম কেনো বলছে কাজি? পাত্র তো রাহুল।
-“ আঙ্কেল আপনার ভুল হচ্ছে পাত্রের নাম রাহুল হবে।
কনার কথায় কাজি আশেপাশে তাকালো।
-“ ভুল কেনো হবে? পাত্র নিজেই তো বললো তার নাম আর তার বাবা মায়ের নাম।
কনা কিছু বলতে নিলে সন্ধ্যা থামিয়ে দেয়।
-“ কাজি সাহেবের কোনো ভুল হয় নি। তুই রাত কে বিয়ে করতে চাস না? রাত এসেছে এখন তুই কবুল বলে দে।
মাথা ঘুড়িয়ে গেলো কনার। রাত এসেছে! কিভাবে সম্ভব? রাতের তো আজ রাতে ফ্লাইট ছিলো তাহলে? কাজি তাড়া দিলো। কনা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল-
-“ হ্যাঁ, আমি রাত আহমেদকে আমার স্বামী হিসেবে কবুল করছি।”
সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো। কনার দেহ জুড়ে বইছে ঝড়। একটু পর কনার পাশে বসানো হলো রাতকে। সাদা পাঞ্জাবি পরা রাতের মুখে কোনো আবেগ নেই। তার চোখে সেই চিরচেনা গাম্ভীর্য। পাশেই আরাফাত। মাথায় কিছুই ঢুকছে না কিভাবে কি হলো?
কনা একটু দূরে তাকাতেই দেখতে পেলো রাহুল দাঁড়িয়ে আছে। কনা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। রাহুল মৃদু হেসে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা হাঁটা ধরলো। খুব কষ্ট হচ্ছিল নিজের বিয়ের আসরে নিজরই হবু বউয়ের বিয়ে তার ভালোবাসার মানুষটার সাথে করাতে গিয়ে। কিন্তু কি করার? যখন প্রিয়তমার সুখটাই সবার উর্ধ্বে থাকে তখন এমন কঠিন অনেক কাজই করতে হয় বুকে পাথর চেপে। মৃদু শীতল বাতাস তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেই স্পর্শে কোনো প্রশান্তি নেই। বুকের ভেতর যেন এক অদৃশ্য ভার চাপা পড়ে আছে। নিজের মনের ভেতর সান্ত্বনার কথা বলে সে নিজেই নিজেকে বোঝাতে চাইছে। বিরবির করে বলল,
-“ খুব কাঠখড় পুড়িয়েছি তোমার জন্য। আমার কাছে তোমার সুখটাই আগে। আর আমি বুঝে গিয়েছি তুমি কোথায় সুখী হবে। তাই তোমাকে তোমার সুখের সন্ধান পাইয়ে দিলাম। ভালো থাকো প্রিয়।”
কথাটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই তার ঠোঁটে ফুটে উঠল এক ম্লান হাসি। কিন্তু সেই হাসির ভেতর যেন ছলকে উঠল অজস্র অশ্রু। মুখে হাসি থাকলেও চোখের গভীরে সেই কষ্টের ঝড় যেন ধরা পড়ল।
পায়ের তলায় মাটি সরে যাওয়ার অনুভূতি সত্ত্বেও সে নিজেকে ধরে রেখেছে। তবে বুকের ভেতরের কান্নার তীব্রতা যেন তাকে ধীরে ধীরে ভেঙে দিচ্ছে। চোখের কোণে জল জমলেও সে তা ঝরে পড়তে দিচ্ছে না, কারণ তার জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে—প্রেম আর দায়িত্বের দ্বন্দ্বে। আর সে বেছে নিয়েছে প্রিয়জনের সুখ।
আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ২৬
হাঁটতে হাঁটতে একসময় থেমে গেল রাহুল। আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনের ভেতর থেকে একটাই প্রশ্ন উঠে আসছে, “তোমার জন্য এতটা করতে পেরে কি আমি খুশি? নাকি নিজেকেই সান্ত্বনা দিচ্ছি যে, যা করেছি ঠিক করেছি?”
তার চোখে-মুখে বেদনার ছাপ স্পষ্ট, অথচ সেই বেদনা মিশে আছে এক গভীর ভালোবাসায়। যে ভালোবাসায় মানুষটাকে পাওয়ার দাবি করে না