আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ৯
Raiha Zubair Ripti
সন্ধ্যা আজ মেরুন রঙের একটা শাড়ি পড়েছে। হাঁটু অব্দি আসা চুল গুলো খুলে বাঁধতে গিয়েও কিছু একটা মনে হতেই চুল গুলো আর বাঁধলো না। আয়নায় একবার নিজেকে দেখে নিয়ে দেখলো কপালে টিপ নেই। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে টিপের প্যাকেট থেকে একটা টিপ বের করে টিপটা কপালে লাগিয়ে বিছানা থেকে ফোন টা নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। সোফায় বসে ছিলো নিখিল। সন্ধ্যাকে দেখা মাত্রই চোখ জুড়িয়ে গেলো। কি মারাত্মক পরিবর্তন এসেছে মেয়েটার মধ্যে। না চাইতেও বেহায়া চোখ চেয়ে রইলো। সন্ধ্যা জুতা টা পড়ে দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে নিলে নিখিল পেছন থেকে বলে উঠে –
-“ সন্ধ্যা শোন।
সন্ধ্যা পিছু ফিরে তাকালো। নিখিল এগিয়ে এসে বলল-
-“ আষাঢ়ের সাথে কি তোর কিছু চলছে?
সন্ধ্যা ভ্রু কুঁচকালো।
-“ কিছু চলছে মানে? হোয়াট ডু ইউ মিন?
-“ না কাল দেখলাম আষাঢ় সারাক্ষণ তোর পাশে ছিলো সেজন্য আর কি।
-“ সেটা তাকেই গিয়ে জিজ্ঞেস করুন আমাকে না করে।
-“ তার মানে কিছু নেই তাই তো?
-“ যদি বলি কিছু আছে। কেমন লাগবে তখন?
নিখিল থমকে গেলেও সন্ধ্যাকে বুঝতে না দিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলল-
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-“ ভ….ভালোই লাগবে।
-“ তাহলে ধরে নিন আমাদের মাঝে কিছু আছে।
-“ কি আছে?
-“ ফিটার খাওয়া বাচ্চা নন আপনি। আপনি এতক্ষণ যা মিন করছিলেন সেটাই বললাম। সেটাই আছে। তারপর ও আবার প্রশ্ন করছেন!
-“ বেশ বদলে গিয়েছিস আগের থেকে।
-“ সময় যাবে মানুষ বদলাবে এটাই তো পৃথিবীর নিয়ম।
-“ তাই বলে এতোটা!
-“ ধাক্কা খেতে খেতে এতো টা বদল হয়েছে। শুকরিয়া আদায় করছি এই ধাক্কাটা যারা দিয়েছে তাদের জন্য।
-“ তা এখন দিনকাল কেমন চলে?
-“ এসব জানার জন্য দাঁড় করিয়েছেন? তাহলে সরি আমার এতো অযথা সময় নেই এসব বলার।
-“ বিয়ে করবি না? বয়স তো হচ্ছে।
সন্ধ্যা যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়লো।
-“ যখন উপর ওয়ালা চাইবে তখনই বিয়ে হবে। আর বিয়ে হলে তো দেখতেই পারবেন। অযথা আমাকে নিয়ে কেনো ভাবছেন আমার মাথায় আসছে না।
-“ এখনও রেগে থাকবি আমার উপর?
-“ রাগ! তাও আবার আপনার উপর? হাস্যকর শোনায় না! আপনার উপর রাগ আমার নেই। তবে কি আছে জানেন?
-“ কি?
-“ এক আকাশ সম ঘৃণা। যেটা আপনি ডিজার্ভ করেন।
নিখিল তপ্ত শ্বাস ফেললো। সন্ধ্যা চলে গেলো। দূর থেকে শ্রেয়া দেখছি শুনছিলো তাদের কথোপকথন। নিখিল পিছু ফিরতেই শ্রেয়া এগিয়ে এসে বলল-
-“ সন্ধ্যা তোমাকে ঘৃনা করে বুঝতে পেরেছো? তাও কেনো সন্ধ্যা সন্ধ্যা করছো? ওকে বিয়ে করতে চাইছো না তো আমাকে ছেড়ে? দেখো আমি কিন্তু তোমাকে ডিভোর্স দিবো না বলে রাখলাম।
নিখিলের শরীর কিড়মিড় করে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল-
-“ ভুলে যেও না সন্ধ্যার চোখে নিজের জন্য এই ঘৃনা টা দেখতে হচ্ছে শুধুমাত্র তোমার জন্য। তোমার বাবা হাতে পায়ে ধরেছিলো তোমাকে বিয়েটা করার জন্য। কারন তুমি সবার ইমোশন নিয়ে খেলা করেছো৷ আর তোমাকে এসব কেনো বলছি। তুমি তো একটা স্বার্থপর মেয়ে। নিজের দিকটা সবার আগে ভাবো। কখনও কাউকে সত্যি কার অর্থে ভালোবাসলে কখনোই এমন ঘৃন্য কাজ টা করতে পারতে না। ব্ল্যাকমেইল করে আমাকে বিয়ে করেছো তুমি। নিজের ভালোবাসার মানুষটার চোখে নিজের জন্য এক আকাশ সম ঘৃণা দেখতে কেমন লাগে সেটা তুমি কি আদৌও বুঝবে? কাউকে ভালোবাসলে তাকে পেতেই হবে বিষয়টা এমন না। সন্ধ্যা কে আমি ভালোবাসি। তবে যেদিন তোমার মতো মেয়েকে বিয়ে করার কথা জানিয়েছি সেদিন থেকেই সন্ধ্যাকে পাওয়ার ইচ্ছে আমি কবর দিয়েছি। কজ সি ডিজার্ভ বেটার দ্যান মি।
-“ তাহলে আমাকে কেনো ছাড়তে চাইছো?
-“ কারন টা তো জানোই। আর রিপোর্টের কথা কিন্তু আমি জেনে গেছি।
শ্রেয়া চমকালো।
-“ ক…কি জেনেছো?
-“ এই যে সমস্যা টা আমার বা। সমস্যা টা তোমার। তুমি মা হতে পারবে না। এখন আমিও আমার সিদ্ধান্ত বাসার সবাই কে জানিয়ে দিব। আই হোপ তারা আমার দিকটা বুঝবে।
নিখিল চলে গেলো। শ্রেয়ার পা অসার হয়ে আসলো। নিখিল কে পাওয়ার জন্য এতো কিছু করলো। এখন নিখিলই তাকে ছেড়ে দিবে বাচ্চা না হবার জন্য? এটা কি শ্রেয়ার দোষ?
হ্যাঁ কর্মের দোষ। খুব প্ল্যান মাফিক যখন ছোট বোনের ভালোবাসা কে পাওয়ার জন্য ছোট বোনের পবিত্র হৃদয়কে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে তার রুহের হায় তো লাগবেই। অথচ বেচারা শ্রেয়া মানতেই চাচ্ছে না এটা তারই কৃতকর্মের ফল।
সন্ধ্যা ছাঁদে আসতেই দেখলো খাওয়ার জন্য সবাই বসে গেছে। রাত ছেলেটা খাবার বেড়ে দিচ্ছে। রাত কে সন্ধ্যার কাছে কেবল একটা নিষ্পাপ বাচ্চাসুলভ মানুষ মনে হয়। কিছুটা মেয়েলি টাইপের, চঞ্চল । মাঝেমাঝে তো মনে হয় ছেলেটা সন্ধ্যার ছোট হলেও পারতো। রাত সন্ধ্যা কে দেখামাত্রই খাবারের বাটি রেখে এগিয়ে এসে মুচকি হেসে বলল-
-“ আসুন বসবেন। অনেক দেরি করে আসছেন। শ্রেয়া নিখিল ভাইয়া তো কখন খেয়ে গেছে।
সন্ধ্যা গিয়ে বসলো। রাত খাবার বেড়ে দিলো। সন্ধ্যা খেতে খেতে বলল-
-“ বাবুর্চি হয়েছেন নাকি?
-“ হ্যাঁ হলাম।
সন্ধ্যা খাবার মুখে দিতে দিতে এদিক ওদিক তাকালো। রাত সেটা দেখে বলল-
-“ কিছু খুঁজছেন?
-“ হুমম।
-“ কি খুঁজছেন?
-“ কাউকে কিন্তু পাচ্ছি না।
-“ কাকে?
-“ শরিফা কে।
-“ শরিফা ও তো অনেক আগেই খেয়ে চলে গেছে।
-“ বাসায়?
-“ না। আরাফাত ভাইয়া কোথাও একটা নিয়ে গেলো।
-“ ডক্টর আরাফাত?
-“ হুমম।
-“ কোথায় নিয়ে গেলো?
-“ সেটা তো বলতে পারলাম না। আসলে ওরা তো একে ওপর কে পছন্দ করে। হয়তো একাকী সময় কাটাতে কোথাও গেছে।
-“ রিলেশনে তারা!
অবাক হয়ে বলল সন্ধ্যা।
-“ হুমম। কেনো জানেন না? দেখে মনে হয় না তাই তো?
-“ হুম।
-“ আমি প্রেম করলে জানেন কি করবো?
-“ কি?
-“ পুরো পৃথিবী কে জানিয়ে করবো।
-“ নজর লাগে এতে জানেন?
-“ লাগবে না.. নজর টিকা লাগিয়ে রাখবো।
-“ ভালোবাসা গোপনে সুন্দর। এটা পুরো বিশ্ব কে জানানোর বিষয় না। শুধু মাত্র জানবে দুটি হৃদয় ব্যাস।
-“ আপনি কখনও কাউকে ভালোবাসছেন?
সন্ধ্যা পানি খেতে গিয়েও থমকে গেলো। চোখের পলক ফেলে বলল-
-“ হয়তো বেসেছিলাম ভালো কাউকে।
এঁটো হাত ধুয়ে চলে গেলো। রাত তাকিয়ে দেখলো।
আকাশে সূর্য ঢোলে যেতেই আষাঢ় বাসায় ফিরে। নিজের রুমে এসে ফ্রেশ হয়েই সন্ধ্যা কে কল লাগালো। সন্ধ্যা বেলকনিতে বসেছিল। আষাঢ় কে আসতে দেখেছে সে। ফোনটা রিসিভ করে কানে নিতেই আষাঢ় ফিসফিস করে বলল-
-“ চুল ছেড়ে দিয়ে এভাবে বেলকনিতে বসে আছো কেনো? মন খারাপ?
সন্ধ্যা আঁধারে ঢেকে আসা আকাশটার দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ না। মন টা ভালোই।
-“ তাহলে?
-“ এমনি বসে আছি। ভালো লাগছে বসে থাকতে।
-“ রাজশাহী যাবে কবে আবার?
-“ পরশু।
-“ আমি দিয়ে আসবো।
-“ আপনি কেনো দিয়ে আসবেন? আমি একা যেতে পারি।
-“ একা যেতে পারো জানি। তবুও আমি দিয়ে আসবো। না একদম করবে না। করলেও শুনবো না।
-“ আপনি কিন্তু বেশি বেশি করছেন।
-“ উঁহু এখনও সীমার মাঝেই আছি।
-“ আপনি কি চান আমার কাছে বলেন?
-“ যদি বলি তোমাকে? তাহলে কি এই তুমি টাকে সযত্নে পার্সেলে মুড়িয়ে আমার ঠিকানায় পাঠাবে?
-“ ডাক্তার কি এমন হয়?
-“ কেমন হয়?
-“ ওরা থাকে নিরামিষ।
-“ আমি না হয় আমিষ।
সন্ধ্যা চুপ হয়ে রইলো। কিছুক্ষণ নীরবতা চললো দু’পাশে। আষাঢ় এই গুমোট নীরবতা কে ভেঙে ভারী কন্ঠে বলল-
-“ সন্ধ্যা!
-“ হু বলুন।
-“ ভালোবাসি।
সন্ধ্যা শব্দ টা শোনামাত্র ই বরফের মতো জমে গেলো। ভালোবাসি! শব্দ টা দ্বিতীয় বার কোনো পুরুষের মুখে শুনলো সন্ধ্যা। চার বছর আগে একবার শুনেছিল সন্ধ্যা নিখিলের মুখে। বলেছি সে শ্রেয়াকে ভালোবাসে। সেদিন এই শব্দ টা শুনে বুক ভার হয়ে আসছিলো। আর আজ বুক কাঁপছে, শরীর কাপছে। এতো নিদারুণ একটা শব্দ অথচ সন্ধ্যার অনুভূতি গুলো কেমন বেখাপ্পা। সন্ধ্যা আষাঢ় কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন টা কে’টে রুমে চলে আসলো। বিছানায় শুয়ে চোখ বুঝে রইলো।
আষাঢ় কেটে দেওয়া ফোনের দিকে নির্নিমেষ চোখে চেয়ে রইলো।
এর ঠিক একদিন পর,,
গোটা একদিন সন্ধ্যা আষাঢ়ের ফোন কল সব ইগনোর করেছে। এমন কি ঘর থেকেও বের হয় নি। আষাঢ় অসংখ্য মেসেজ ও দিয়েছে কিন্তু সন্ধ্যা সিন করে নি। আজ রাজশাহী যাবে। সেজন্য বাসা থেকে বের হতেই গেটে এসে আষাঢ়ের সাথে দেখা হয়। আষাঢ় সেই সকাল থেকে অপেক্ষা করছিলো সন্ধ্যার। টানা আড়াই ঘন্টার অপেক্ষার পর আসলো সন্ধ্যা। সন্ধ্যা আষাঢ় কে উপেক্ষা করে চলে যেতে নিলে আষাঢ় সন্ধ্যার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সন্ধ্যা পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে আষাঢ় সন্ধ্যার হাত টেনে ধরে বলে-
-“ কি হয়েছে এমন ইগনোর কেনো করছো?
সন্ধ্যা হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বলল-
-“ হাত টা ছাড়ুন। লোকজন দেখে ফেলবে।
আষাঢ় হাত টা না ছেড়ে শক্ত করে ধরে বলল-
-“ আগে সমস্যা কি সেটা বলো। তারপর ছাড়ছি।
-“ কোনো সমস্যা নেই। হাত ছাড়ুন।
-“ তাহলে ইগনোর কেনো করছো?
-“ আপনার থেকে জাস্ট দূরে থাকার চেষ্টা করছি।
-“ হোয়াই?
-“ কারন টা আপনি জানেন ডাক্তার।
-“ গাড়িতে বসো।
-“ না আমার হাত ছাড়ুন আমার বাস মিস হয়ে যাবে।
-“ গাড়িতে উঠতে বলছি তো। আমি দিয়ে আসবো।
-“ না বলছি শুনুন সেটা।
-“ দেখছো তো শুনছি না। একটু করুনা করে বসো।
-“ আচ্ছা হাত ছাড়ুন।
আষাঢ় হাত ছাড়লো। সন্ধ্যা গিয়ে বসলো গাড়িতে। দূর বেলকনি থেকে রাত সবটা দেখলো। গতকাল থেকেই তার ভাইকে বেশ অস্থির লাগছিলো। আজ আবার সন্ধ্যার সাথে এভাবে দেখে কেমন একটা লাগলো।
আষাঢ় গাড়িতে বসেই গাড়ি স্টার্ট দিলো। সন্ধ্যা বাহিরের দিকে মুখ করে আছে। আষাঢ় গাড়ি চালাতে চালাতে বলল-
-“ সন্ধ্যা স্বীকার করবে আমায়?
-“ কিসের জন্য?
-“ আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।
-“ মাথা ঠিক আছে আপনার?
-“ হ্যাঁ ঠিক আছে।
-“ আমার তো সেটা মনে হচ্ছে না।
-“ সেটা তোমার সমস্যা। তবে অ্যা’ম টোটালি ফাইন।
-“ কতটুকু চিনেন আমায়? কতটুকু জানেন আমায়?
-“ যতটুকু জানার দরকার জেনে নিয়েছি। যতটুকু চেনার চিনে নিয়েছি।
-“ আমি আপনাকে কখনই স্বীকার করবো না।
-“ আমি আমেরিকা চলে যাচ্ছি সন্ধ্যা।
সন্ধ্যা ত্বরিত গতিতে তাকালো আষাঢ়ের দিকে।
-“ চার বছরের আগে ফিরবো না।
-“ কংগ্রেস।
-“ ব্যাস এটাই বললে!
-“ এরচেয়ে আর কিছু বলার জন্য শব্দ ভাণ্ডার আমার কাছে নেই।
আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ৮
-“ একটু ভাবো। সময় নাও৷
-“ আচ্ছা নিলাম।
আষাঢ়ের মুখে হাসি ফুটলো।
-“ সত্যি?
-“ হুমম৷
আষাঢ়ের খুশি খুশি লাগলো। সারা রাস্তা এই ভাবতে লাগলো যে সন্ধ্যা তার ভালোবাসা কে স্বীকার করবে। সত্যি কি স্বীকার করবে ঠকে যাওয়া এই পাথরের হৃদয়ে পরিনত হওয়া নারী?