ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ১২

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ১২
Arishan Nur

রাত তখন দশটা বাজছিলো। সন্ধ্যার পর থেকে আবহাওয়া বেশ খানিকটা খারাপ হতে থাকে৷ ঝড়ো বাতাস বইছিলো। শীতল, মিহি, হিমেল হাওয়ায় মন খারাপের সুবাস ছিলো বুঝি। থেকে থেকে মেঘ চমকাচ্ছিল। বিজলি পড়ার শব্দ কানেও এসেছে বার কয়েক। সমুদ্রকে বাসরঘরে বসতে দেওয়া হলো। আজকে আকদ ছিলো জন্য বউ নিয়ে শ্বশুড়বাড়ি যাওয়া হবে না। ফলাফল সমুদ্রই আজকে তার শ্বশুড়বাড়ি রাত্রি যাপন করবে। সে অনুযায়ী পরিকল্পনা মাফিক আয়নার রুমেই সুন্দর করে ফুল দিয়ে একদম সিম্পেলভাবে সাজানো হয়েছে। অতিরঞ্জিত কিছুই নেই। তবুও কেমন বিশেষ কিছুর শোভা পাওয়া যাচ্ছে। শোভাবর্ধক ট্রেতে একপাশে বাদাম আর একটা কাঁচের গ্লাসে গরম গরম দুধ সঙ্গে হলুদ-কেশর মিশিয়ে দিয়েছে, সেটা রাখা হয়েছে। ট্রে’তে গোলাপের লাল পাপড়ি ছড়িয়ে রাখা। এমনকি বেডের কভারের উপরেও ফুলের পাপড়ি দিয়ে সাজানো। এবং বাড়তি বলতে সেন্টার টেবিলে একটা ফুলের ব্যু’কে রাখা।

ওমনি সময় আয়নাকে এ’ঘরে আনা হলো। সঙ্গে ওর দাদী আর ফুপু ছিলো। ওর শাড়ি বদলিয়ে দেওয়া হয়েছে। শাড়ির কথা মনে পড়তেই সমুদ্রের চাপা হাসি চলে আসলো। ঘড়ির চিপায় আটকে যাওয়ায় আর কোনোভাবেই ঘোমটার আঁচল চেইন থেকে মুক্ত করা যাচ্ছিলো না। সবার চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র ঘড়ি খুলে ফেলেছিলো। পরে আঁচলের সাইড কেটে ফেলা লেগেছে৷ আপাতত সে দরজার দিকে তাকায়। আয়নাকে সুতির একটা গোলাপি রঙের শাড়ি পড়ানো হয়েছে। চুল খোপা করেছে ও। সমুদ্রের মনে হলো অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ ওকে বেশ বড় লাগছে। মাত্র ইঞ্জিনিয়ারিং সেকেন্ড ইয়ায়ের স্টুডেন্ট ও। তবে এই মুহূর্তে বয়সে বেশ বড় লাগছে৷ দাদী আবার রুমে ঢুকার আগে ওর মাথায় আঁচল তুলে দিলো। এরপর রুমে আসতেই সমুদ্র নড়েচড়ে উঠলো। সে বুঝে পায় না এমন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত? জীবনে প্রথমবার এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে তাই সম্পূর্ণ ক্লুলেস।
দাদী আয়নাকে টেনে সমুদ্রের সামনে দাঁড় করিয়ে বললো, ” জামাই বাবা, এইযে তোমার বউকে তোমার কাছে দিয়ে গেলাম। তুমি তোমার বউকে বুঝায় নাও।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এমন কথার বিপরীতে কি বলা দরকার সমুদ্র বুঝে পায় না। সে মাথা চুলকানো শুরু করে। আয়নাও মাথা নিচু করে গুটিসুটি পায়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। ফুপি পরিবেশ হাল্কা করার জন্য আয়নাকে সমুদ্রের পাশে বসিয়ে দিয়ে দুইজনের হাত একসঙ্গে করে বলে, ” তোমরা সবসময় হাসি-খুশি থাকো।”
সমুদ্র সৌজন্যতার হাসি হাসে। আয়নার তখন লজ্জায় ঠোঁট তিরতির করে কেঁপে উঠে। ওনারা যাওয়ার সময়ে দরজা লাগিয়ে দিয়ে যায়। চোখের সামনে ঘরে কেবল দুজন প্রানী উপস্থিত থেকে গেলো। সমুদ্র হাত ছাড়ছে না দেখে ওর বেশ অস্বস্তি হতে লাগে৷ সে আলতো করে সরাতে চাইলে, সমুদ্র আরেকটু চেপে এসে বসে বললো, ” সেদিন সরল মনে আঘাতপ্রাপ্ত কপালে হাত বুলাতে চেয়েছিলাম কেমন চুরা–ইলের মতো বিহেইভ করলে, দ্যাখো আজ তোমার বাড়ির মানুষ-জন তোমাকে আমার কাছে রেখে দিয়ে চলে গেলো।”

আয়না তার চোখের দিকে তাকায়।
সমুদ্র বলে উঠে, ” দিস ইজ দ্যা পাওয়ার অফ ম্যারিজ।”
আয়না মনে মনে ভাবে আসলেই তো তাই, এতোদিন বাবা কঠোরভাবে বলে আসলো কলেজ-ভার্সিটিতে কোনো প্রেম-ট্রেম না করতে, ছেলেদের সঙ্গে মেশা একেবারেই যাবে না, আর আজ আয়োজন করে তাকে একটা ছেলের সঙ্গে পাঠায় দিচ্ছে!
তবে আয়না বলে উঠে,” আপনি আমাকে চুরাইল বললেন?”
–” ঠিক তা বলিনি।”
–” তাহলে কী বলতে চাইছিলেন?”

সমুদ্রের কাছে বুঝি কোনো যুক্তি নেই বিধায় সে টপিক চেঞ্জ করে বলে উঠে, ” যাও ট্রে’টা এখানে নিয়ে আসো।”
আয়নার ট্রের দিকে তাকায়। ওনার এখন খেতে হবে কেন? একটু আগেই কতোগুলো খাবার খেল!
সে হাত বাড়িয়ে ট্রে আনে সমুদ্রের সামনে। আয়না ট্রে হাতে বসে থাকে। সমুদ্র আয়েসী ভঙ্গিমায় একটা বাদাম তুলে নিয়ে মুখে পুড়ে৷ তারপর বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখে বেশ জোরে বাতাস বইছে। আজ বোধহয় জোরে করে বৃষ্টি হবে। কে জানে?
তারপর দুধের গ্লাস হাতে তুলে নিয়ে বললো, ” শোয়ার আগে গরম দুধ খেলে ঘুম ভালো হয়। তোমার ঘুমের সমস্যা আছে?”

আয়না ট্রে হাতে মাথা নাড়িয়ে জানান দিলো তার ঘুমের সমস্যা হয় না। সমুদ্র ঢক ঢক করে সম্পূর্ণ দুধ খেয়ে ট্রেতে রেখে দেয় গ্লাস। আয়না যখন ট্রে টেবিলে রাখতে পা বাড়ায় উনি বলে উঠে, ” গরম দুধের আরোও একটা বিশেষ উপকারিতা আছে যেটা রাতে বেশ কাজে আসে।”
আয়না বুঝলো না সমুদ্র কি বলছে। বারান্দার দরজা খোলা ছিলো। হুরহুর করে বাতাস আসছিল। সেই সময় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামার আওয়াজ পাওয়া যায়৷
সে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় এবং বললো, ” আপনি ফ্রেশ হবেন না?”

–” না।”
–” সেকি কেন?”
–” এক্সট্রা কোনো কাপড় আনা হয়নি।”
আয়না চটজলদি আলমারি থেকে একটা সাদা রঙের সুতির পাঞ্জাবি বের করে ওনার সামনে ধরলো। সমুদ্র মনে হয় খুশিই হলো। সে হাত বাড়িয়ে কাপড় নিয়ে সোজা হাঁটা ধরে ওয়াশরুমের দিকে। সমুদ্র যখন বাথরুম থেকে বের হয় তখন বৃষ্টির বেগ এতো বেড়ে গেছে যে রুমের ভেতর বৃষ্টির পানি এসে ফ্লোর ভিজে যাচ্ছিলো। সে বাধ্য হয়ে আয়নাকে বলে, ” বারান্দার দরজা লাগিয়ে দিলে ভালো হয়।”
আয়না যেন ওনার এইকথায় সামান্য বিচলিত বোধ করলো। বোধহয় একটু ভয়ও পেল। তবুও বারান্দার দরজা লাগিয়ে ভেতরে আসে। এতো অল্প মুহূর্তেই ওর শাড়ীর আঁচলে পানি লেগে ভিজে ওঠে। সমুদ্রের চোখ এড়ালো না বিষয়টি।

সে বললো, ” ফ্যানের সামনে বসো। বাতাসে ভেজা অংশ শুকিয়ে যাবে।”
আয়না বাধ্য মেয়ের ন্যায় সমুদ্রর পাশে এসে বসে পড়লো। হাল্কা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগলো। বাতাসে চুল গুলো কিঞ্চিৎ উড়াউড়ি শুরু করে। সে চুল সামলাতে ব্যস্ত হলে, আঁচল ওড়ে, আবার আঁচল সামলাতে গেলে চুল বাতাসে নাচানাচি শুরু করে৷ কি এক মসিবত! ওনার উপস্থিতি যেন আয়নাকে ভেতর থেকে গুড়িয়ে দিচ্ছে। সবকিছুতই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। যা করতে যাচ্ছে সেটা করতে পারছে না৷ আয়নার ধারণা হলো সমুদ্র নিশ্চয়ই তাকে দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি দিচ্ছে। মনে মনে ভাবছে মেয়েটা গুড ফর নাথিং!

সমুদ্র নিজের হাত বাড়িয়ে ওর শাড়ির নরম আঁচলখানা মেলে ধরলো। ফ্যানের বাতাসে আঁচল তিরতির করে নড়তে থাকে। নাকি আয়না কেঁপে উঠছে বোঝার উপায় নেই। সমুদ্র তখনো ওর আঁচল সমেত ধরে বসে আছে। আয়না ভুলেও ওনার দিকে তাকাচ্ছে না।
সমুদ্র তাকে উদ্দেশ্য করে বললো, ” তোমার দাদীর কথা শোনা যাবে না।”
আয়না তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো।
সমুদ্র দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে, ” তোমার কোলে এখনি পুত আনা যাবে না। নাহলে দেখা যাবে বাচ্চাকে ফিডার খাওয়াতে গিয়ে বাবু নিয়ে উলটে পড়ে আছো!”
ওনার রসিকতা পূর্ণ বাক্যগুলো শ্রবণ মাত্র আয়নার তখন অবস্থা নাজেহাল। শরম-রাগের সংমিশ্রণে সে মুচড়ে উঠে ভেতর ভেতর। মন চাইলো এই রুম থেকে, ওই বদমাশ লোকটা থেকে পালিয়ে যেতে!
সমুদ্র সামান্য ঝুঁকে আসে তার দিকে। আয়নার ওইক্ষণে ভীষণ ভয় লাগা কাজ করে। তবে কি এখনই?ওনার মতো লোককে না বলার সাহস নেই আয়নার মধ্যে। তার উপর উনি যতোটা রাগী! যদি আয়নাকে দুমড়েমুচড়ে শেষ করে দেয়?

–” তুমি কি নার্ভাস হয়ে গেলে নাকি?”
আয়না উত্তর দিতে পারে না৷ উনি ফের প্রশ্ন করে, ” কোনো কারণে ভয় পাচ্ছো?”
আয়না মাথা নাড়িয়ে একবার না বলে, পরক্ষণে হ্যাঁ বলে, ফের না সূচক অর্থ প্রকাশ করে৷ আবার হ্যাঁ বোধক ইঙ্গিত দেয়।
সমুদ্র মুখ উচ্চারণ করে বলে, ” বুঝেছি।”

কাছাকাছি আসার ফলে সমুদ্র খেয়াল করে ওর মেহেদীর রং বেশ গাঢ় হয়েছে৷ একদম গাঢ় খয়েরী। সে ভারী অবাক হলো। কালকেই না কেমন হাল্কা কমলা ছিলো। আজ হুট করে কিভাবে এতো গাঢ় রঙ আসলো? সে হাত বাড়িয়ে আয়নার দু’হাত ধরে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে আয়না যেভাবে কেঁপে উঠলো — সমুদ্রের মনে হতে থাকে খিচুনির রুগী দেখলো সে। নিজের হাতে ওর হাত গুলো ধরে রেখে প্রশ্ন করলো, ” মেহেদীর রঙ অনেক গাঢ় হয়েছে!” এরপর আয়নার দু’হাতের মেহেদীর ঘ্রাণ নিলো নাক দিয়ে। ফলে ওনার ঠোঁটের অল্প পরিসরের ছোঁয়া এসে আছড়ে পড়ে আয়নার তুলতুলে টুকটুকে মেহেদী পড়া হাতে। আয়নার কম্পিত শরীরের কার্যক্রম স্পর্শ না করেও টের পায় সমুদ্র।
আয়নার ডান হাতের তালুতে একদম মাঝে সমুদ্রের নাম লিখা হয়েছে। সমুদ্র ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ” আসো, শুয়ে পড়ো। তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে খুব। ”
আয়না উঠে আসতে ধরলে, সমুদ্র প্রশ্ন করে, ” বেডের কোন সাইডে শোয় তুমি? কিনারে নাকি দেয়লারে দিকে?”
আয়না উত্তর দেয়, ” মাঝখানে। ”

–” মাঝখানে কেন?”
–” মনে হয় কিনারে শুলে বেড থেকে পরে যাবো।”
–” তুমি দেয়ালের দিকে শোয় তাহলে।”
আয়না উঠে গিয়ে লাইট অফ করে দিয়ে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিলো।
সমুদ্র প্রশ্ন করে, ” ড্রিম লাইট কেন আবার ?”
আয়না বেডে এসে বসে জবাব দিলো, ” আমি অন্ধকারে শুই না তো এজন্য। ”

সমুদ্র পড়লো বিরাট বিপাকে। এমনিতেই ব্রেক আপের পর থেকে তার তন্দ্রার সমস্যা। ঔষধ নিয়েও কখনও ঘুম পূরুণ হয় না। তার উপর নতুন বিছানা, নতুন গন্ধ। ড্রিম লাইট জ্বলতে থাকলে চোখের পাতাই বন্ধ হবে কীনা সন্দেহ। তবে ড্রিম লাইট অফ করে দিতে বললো না সে। মেয়েটা এমনিতেই তাকে বাঘ-সিংহ ভেবে ভীষণ ভয়ে আছে, চাপে আছে। আবার রুম অন্ধকার করতে বললে ভয়ে কেঁদে ফেলতেই পারে! আয়নার জন্য এটা অস্বাভাবিক কিছু হবে নাহ।

আয়না তাকে টপকে বেডের ওদিকে বসে পড়ে৷ সমুদ্র তার দিকে একবার তাকিয়ে, অন্য দিকে ঘুরে শুয়ে পড়ে, এরপর আয়নার দিকে ঘুরে বলে উঠে, ” রিল্যাক্স, আমি চাই না কালকে সকালে তোমার জ্বর আসুক। সো কুল ডাউন! আরাম করে ঘুম দাও।”
আয়নার মুহুর্তেই সেই অপমান করার দিনটার কথা স্মরণ হলো। এই মানুষটা এতো লজ্জাজনক কথা কীভাবে বিনা দ্বিধায় বলে ফেলে? মুখে কোনো লাগাম নেই৷ কিচ্ছুটি আটকায় না মুখে!
আয়না সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে ওদিকে মুখ করে শু’য়ে পড়ে৷ ওনার দিকে ভুলেও আর তাকাবে না। ইচ্ছা করে তাকে অপদস্থ করে সবসময়।
সমুদ্র সামান্য হাসলো। এরপর চোখ খোলা রেখেই শুয়ে থাকে। রাত কয়টা বাজে খেয়াল নেই। তবে আয়নার ভারী নিশ্বাসের শব্দ কানে আসে। একটু পর সে উঠে বসে । আয়না তখন ঘুমের ঘোরে এদিকে ঘুরে আসে৷
সমুদ্র উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। বৃষ্টি থেমে গেছে কিন্তু বারান্দার মেঝেতে বৃষ্টির পানি পড়ে আসে। সে পা মাড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। সঙ্গে সিগারেট নেই জন্য আফসোস হলো। সিগারেট খেতে পারলে একটু আরাম পাওয়া যেত।

অনুভূতি কিছুটা বৃষ্টির মতো। বৃষ্টি থেমে গেলেও যেমনটা করে বৃষ্টির ফোঁটা রয়ে, তেমনি অনুভূতি মরে ফেললেও অবশিষ্ট কিছু স্মৃতি আজীবন রয়ে যায়।
এমনই এক বৃষ্টিমুখর রাতে সে আর ইউশা নিউক্যাসেল সিটিতে ঘুরতে গিয়েছিলো। থোরাক্স কার্ড শেষ হওয়ার পর ঘুরতে বেরিয়েছে দুইজনে। তখন কেবল রিলেশনের একদম প্রথম প্রথম। মাখো মাখো প্রেম। সি-বীজ ঘুরে ফিরে আসার পথে হঠাৎ বৃষ্টি পড়া আমম্ভ করলো। ইউশার শখ জাগলো ও বৃষ্টিতে ভিজবে৷ সমুদ্র আবার ইউশার সবধরনের শখ খুব শখ নিয়ে পূরণ করত। তারা যাওয়ার পথের বাস থেকে নেমে বৃষ্টিতে ভেজে। একদম কোনো চিন্তা ছাড়া, লোকে কি বলবে এসব কিছু না ভেবেই দুইজনে একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজলো। লাফালাফি, হাসাহাসি করলো। এরপর সমুদ্র হাঁটু গেড়ে বসে ওকে প্রোপোজও করলো। তখন অবশ্য বয়সে ছোট ছিলো। কেবল ফার্স্ট ইয়ারে ছিলো তাও প্রথম প্রেম, পাগলামির মাত্রা বেশি ছিলো। সে চোখ বন্ধ করে নিজেকে ধাতস্থ করলো।

ভেজা পা নিয়েই রুমে ফিরে আসে, এবং বেডে বসতেই দেখে আয়না ঘুমের ঘোরে একদম বেডের মাঝে এসে ঘুমাচ্ছে। সমুদ্র একটু চেপে এসে আয়নার একদম কাছাকাছি শুয়ে খুব অধিকারবোধ থেকে আয়নার শাড়ির ভাঁজ কিঞ্চিৎ সরিয়ে দিয়ে ওর পেটে হাত গুঁজে দেয়। আয়না গভীর ঘুমেও নড়ে উঠে। ওর শাড়ি একদম এলোমেলো হয়ে আছে৷ সমুদ্র একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। সেন্টার টেবিলে ওর বন্ধ ফোন পড়ে থাকে।
ড্রিম লাইটের আলোয় খেয়াল হলো আয়নার চোখের কাছটায় একটা চোখের পাপড়ি অযত্নে পরে আছে৷ সে আস্তে করে পাপড়িটা সরিয়ে দিলো। ফুলেল বিছানায় একদমই ঘুম আসছিলো না৷ তবে আয়নার ঘুম দেখে সেও চোখ বন্ধ করে।

সমুদ্রের ঘুম ভাঙ্গে আয়নার ডাকাডাকির শব্দে।
–” আর কতো ঘুমাবেন?”
সমুদ্র ঘুমু চোখে বলে, ” বাসর রাত পুরাটা ঘুমায় কাটিয়ে সকালবেলা চেচামেচি করছো কেন?”
ঘুম থেকে উঠেই এমন কথার তোপে পরে আয়না ফের লজ্জা পায়৷ এমনিতেই নিজের গায়ে কারো উপস্থিতি লক্ষ্য করে আজ দ্রুত ঘুম ভাঙ্গে। চোখ খুলতেই নিজের শরীরে ওনার পুরুষালি হাতের ছোঁয়া পেতেই আয়না চমকে উঠে বসে। আবার পরমুহূর্তে বেশ শরমবোধও করলো। সে নিজেই মাঝখানে একদম সমুদ্রের গায়ের কাছে ঘুমের ঘোরে চলে এসেছে সে খেয়াল ছিলো না৷
সমুদ্র উঠে বসে বললো, “জ্বর-টর আসেনি তো রাইট?”
আয়না উঠে দাঁড়িয়ে রুম ত্যাগ করে৷ সমুদ্র মনে মনে নিজের বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নেয়। নাস্তা সেড়েই বের হয়ে পড়বে৷

সে যখন নাস্তার টেবিলে আসে, তখন সবাই যেন তার জন্য অপেক্ষা করছিলো। দাদী তাকে খেতে দিলো। আয়নাও নাস্তা করছিলো।
দাদী জিজ্ঞেস করে, ” বাবা তুমি কি কি খেতে পছন্দ করো?”
আয়নাও কান খাড়া করে শুনার চেষ্টা চালায়। সে ধরে নেয় সমুদ্রের অনেক নামী-দামী খাবার পছন্দ। একে তো অস্ট্রেলিয়ায় থাকত তার উপর বড়লোকের একমাত্র ছেলে।
সমুদ্র বলে উঠে, ” দেশী খাবার ভালো লাগে। যেমন: কচুর লতি দিয়ে চিংড়ি, শুটকি ভর্তা, আলু ভর্তা,লাল শাক, করলা ভাজী সহ সব ধরনের দেশি খাবার পছন্দ। ”
আয়নার চোখ কপালে উঠে যায়। দাদী তার উত্তর শুনে খুব খুশি হলেন৷ প্রশ্ন করলেন, ” বাবা সবুজ কচুর ডাল খাও তো?”

–” জ্বি, আলুভর্তার সঙ্গে দারুণ লাগে।”
সকালে নাস্তা সেড়ে রুমে এসেই সমুদ্র মানিব্যাগ পকেট নেয়, তখন আয়না প্রশ্ন করে, ” কোথাও যাচ্ছেন?”
সমদ্র সুধালো, ” বাসায় যাচ্ছি আয়না।”
–” এখনই?”
–” হুম। যেতে হবে। শুনো ফোন দিলে ফোন ধরবা আর অফিস আসবে তাও রেগুলার। আসি।”
আয়নার একদম-ই ওনার দেওয়া বিদায় পছন্দ হলো না৷ ভীষণ মন ভার হলো। কী দরকার এতো জলদি যাওয়ার? কালকেই বিয়ে হলো? আজকেই কেন দূরত্ব? তবে মুখে কিছু বললো না।

একটু পরই সমুদ্র কে তার রুমে ফিরে আসতে দেখা গেল। ওনাকে দেখামাত্র আয়নার মন ভালো হয়ে যায়৷
সমুদ্র বলে উঠে, ” যেতে দিলো না। তোমার বাড়ির লোকজন আমাকে আটকায় রাখছে৷”
আয়নার ওনার কথা শুনে খুব আনন্দ লাগলো। ভালো হয়েছে! নতুন বিয়ে করে আপনাকে কেন এতো জলদি বাড়ি যেতে হবে? বউ রেখে বাসায় যাওয়ার তাড়া কেন?
সমুদ্র দু’বার সারারুম পায়চারি করলো। এরপর আয়নার কাছে ফিরে এসে বললো, ” আমার বাসার সবাই সন্ধায় আসবে। ডিনার করে তারপর যাব৷ আচ্ছা এতোক্ষণ সময় কিভাবে পাড় করব?”

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ১১

–” জানি না তো!”
–” এক কাজ কর, গুগুলে সার্চ দিয়ে দেখো নবদম্পতিরা কীভাবে সময় কাটায়? হারি আপ!”
আয়নাও সরল মনে গুগলে সার্চ দিলো এবং সঙ্গে সঙ্গে যেসব আর্টিকেল আসলো তাও ছবি সহ, ওগুলো চোখের সামনে আসামাত্র আয়নার লজ্জায় চোখ-মুখের অবস্থা করুণ! ওনার মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করলো।
সমুদ্র ওর অবস্থা দেখে শব্দ করে এই প্রথমবার হাসলো। আয়না এই প্রথম ওনাকে হাসতে দেখলো!

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ১৩