ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২০

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২০
Arishan Nur

গত দু’দিন ধরে আয়নাদের বাসার পরিবেশ খুব একটা অনুকূল অবস্থায় নেই৷ সময় মাফিক সব হচ্ছে কিন্তু তবুও ঝড়ে ভেঙে পড়া গাছের মতো করুণ দশা সবার। ফাহাদ সাহেবের দ্বিতীয় বিয়ের খবর বয়োজ্যেষ্ঠদের গুটিকয়েক’ জন জানতেন। তবে এখন খোলাসা হওয়ার পর ফ্যামিলির সকলে জেনে যায়। আয়নার সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে বেশিরভাগ মানুষজনই ফাহাদ সাহেবের পক্ষ নিয়ে কথা বলে সড়ে পড়ছে। গ্রামের বাড়ি থেকে এক ফুপু কল দিয়েছিলো। ইনিয়েবিনিয়ে কিছু সৌজন্যমূলক কথা বললো। এরপর সরাসরি জিজ্ঞেসই করে ফেলে, ” শুনলাম ফাহাদ ভাইসাব আরেকটা বিয়ে করছে? মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার বয়সে নিজেই বিয়ে করলো? ”

আয়নার ওইসময় ভীষণ রাগ-কষ্ট-ক্ষোভ-বেদনায় মন বিষিয়ে উঠে। উনি অবশ্য পরে বলছিলো, বিয়ে করে নাকি ভালো করেছে। একা কতোদিন থাকা যায়? এসব কিছু ভালো সুশীল কথা বলে দ্বিতীয়দফায় খোটা মেরে জিজ্ঞেস করলো, ” তা নতুন জামাই আর নতুন বউ নিয়ে গ্রামে আসিও।নতুন মানুষদের গ্রাম ঘুরাই নিয়ে যাইও।”
আয়না হতভম্ব হয়ে পরে। মানুষ-জন এভাবে কেন তাকে খোঁচা মেরে কথা বলছে? বলবেই বা না কেন? তবে কেউ কী একবারও তাদের দু’বোনের দুঃখ বোঝার চেষ্টা করে না? আয়নার মন খুব খারাপ হয়। কেমন বিষাদে ছেয়ে যায় মন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এতোটাও মর্ডান না যে মায়ের রিপ্লেসমেন্ট কেও সয়ে নিবে।
সকালের নাস্তার জন্য ফাহাদ সাহেব আয়নাকে ডাকতে আসলেন। গত দু’দিন ধরে দুই বোনের কেউ ঠিকঠাক মতো তার সঙ্গে কথাও বলছে না, খাওয়া-দাওয়াও করছে না।
ফাহাদ সাহেব নম্র গলায় আয়নার রুমের দরজা ধাক্কালেন। তারপর বলে উঠে, ” আয়ু, নাস্তা করতে আসো। ক্লাস আছে না আজকে?”

আয়না জবাব দেয় না ভেতর থেকে। ফাহাদ সাহেব দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দেন। ওইসময় আয়নার একটু আগের বলা কথা গুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। আর এখন বাবাকে দেখামাত্র রাগের মাত্রা যেন ফুটন্ত তেলে পানির ছিঁটা দেওয়ার মতো। বাবার জন্য তাকে সবাই যা ইচ্ছে তাই বলছে। অপমানিত হওয়ার সুযোগ করে দিলো!
সে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠে, ” আব্বু তুমি এক্ষুনি আমার রুম থেকে যাও। তোমার চেহারা দেখতে ইচ্ছা করছে না।”
ফাহাদ সাহেব বেশ খানিকটা আহত হলেন সেই সঙ্গে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। আয়না স্বভাব-ত খুব শান্ত-শিষ্ট ধরনের। ঝগড়াঝাটির মধ্যে ও নেই। বরং মিষ্টি ভাষী আর হাসি-খুশি ধরনের। আয়নাকে এভাবে চিল্লাতে দেখেনি এর আগে। বরং তাদের বাসায় এমন চিল্লা-পাল্লা, অশান্তি এর আগে কখনোই হয়নি। কাজেই আয়নার চিৎকারের আওয়াজে ফাহাদ সাহেবের মা সালেহা বানুও এগিয়ে আসেন দেখার জন্য।

আয়নার চোখে তখন জল ছিলো। সে আবারো চিৎকার করে বলে, ” তুমি এখনো আমাদের বাসায় আছো কেন? যাও তোমার দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে যাও। এক্ষুনি যাও বাবা। আর কোনোদিন আমাদের কাছে আসবে না।”
ফাহাদ সাহেব বুঝলেন আয়না এখনো রেগে আছে। রেগে থাকাটা অস্বাভাবিক না। শায়লাও অগ্রীম জানিয়ে দিয়েছে, যেহেতু সংবাদ পাওয়া মাত্র ও সঙ্গে সঙ্গে রিয়্যাক্ট করেনি। নীরব ছিলো। কাজেই বাসায় গিয়ে পরবর্তীতে ফাহাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে পারে। জানার পরপর বুঝে পাচ্ছিলো না কি করা উচিত। আবার অন্য কারো বাসায় ছিলো, সঙ্গে নতুন জামাই। সবটা চেপে গেছে। বাসায় যাওয়ার পর তোলপাড় শুরু হবে। শায়লার কথাই ঠিক হলো। তিনদিন ধরে বাসার পরিবেশ অস্বাভাবিক।

আয়না বাবার সামনেই দরজা লাগিয়ে দেয়৷ ফাহাদ সাহেবকে সালেহা বানু সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ” আয়ু বুবুর মনটা খুব নরম। এজন্য কষ্ট পাচ্ছে বেশি। ওর ব্যবহারে মনে কিছু নিস না।”
–” না! মনে কিছু নেইনি। বুঝতে পারছি ওর খারাপ লাগবে।”
ফাহাদ সাহেব আলিয়াকে ডাকলেন। কিন্তু আলিয়াও ঘুমে আছে। উনি একাই নাস্তার টেবিলে বসে পড়লেন। দুই মেয়েকে নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন সে।
খাওয়ার মাঝে বলে উঠে, ” আম্মা অফিসের কাজে চিটাগং যেতে হবে। তিনদিনের জন্য। লকারে টাকা আছে। প্রয়োজন হলে খরচ করবে৷”

এরপর হামিলা বুয়াকে ডাক দিলেন। হালিমা বুয়া রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসেন দ্রুত৷
ফাহাদ সাহেব বলেন, ” হালিমা আপা, এই তিনদিন বাসায় মাছ রান্না করবেন না। ওদের দুই বোনের মাছ পছন্দ না। ওরা যা খেতে চায় ড্রাইভার কে দিয়ে বাজার করায় রান্না করে দিবেন।”
–” আচ্ছা ভাইসাব।”
ফাহাদ সাহেব ফের আয়নার রুমের সামনে গিয়ে বললো, ” আয়ু আমি যাচ্ছি। অফিসের কাজে তিনদিনের জন্য চিটাগং। দাদা-দাদীর যত্ন নিবে।”
বন্ধ দরজার ও’পাশ থেকে কোনো সাড়া এলো না।
আলিয়ার যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন বেলা এগারোটা। ঘুম থেকে উঠেই দেখে রুমের মধ্যে হালিমা বুয়া কাপড় ভাঁজ করছে। ওনার ইতিমধ্যে দুপুরের রান্নাবান্না শেষ বোধহয়। বারোটার পর থেকে হালিমা বুয়া টিভি দেখা শুরু করে সব কাজ শেষ করে৷
আলিয়া উঠে বসে বলে, ” আজকে নাস্তা কী? ”

হালিমা বুয়া বলে, ” ছোট আপামনি এই বেলায় কেউ নাস্তা খায়? আপনে এক্কেবারে দুপুরের ভাত খান?”
আলিয়া চোখ কচলে ফোন হাতে নিতেই সামান্য অবাক হয়। শ্রাবণ ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। শ্রাবণের ম্যাসেজ দেখতে ই একটু ভালো লাগে। পরক্ষণেই ফোন রেখে দেয়। সীন করে না। শ্রাবণ হলো আপার শ্বশুড়বাড়ি থেকে আসা গেস্টের কার যেন ছেলে। মেহেদীর দিনে একসঙ্গে অনেকক্ষণ ছিলো তারা। সেই সুবাদে পরিচয়। এরপর হুট করে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠালো। দেন প্রায় প্রতিদিনই ম্যাসেজ দেয়৷ আলিয়ারও অবশ্য ভালোই লাগে ওর সাথে কথা বলতে। এর আগে কোনোদিন এভাবে কোনো ছেলের সঙ্গে চ্যাট করেনি।

কারণ বাবার স্ট্রিক্ট বারণ আছে। কোনো ছেলের সঙ্গে প্রেম করা যাবে না। তবে বাবা নিজেই যে কাজটা করলো এরপর আলিয়ার বাবার উপর ভীষণ ক্ষোভ। সেই ক্ষোভ থেকে বাবার বানানো সব রুলস ব্রেক করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে সে। এতোদিন শ্রাবণকে খুব একটা পাত্তা দেয় নি। কিন্তু গত দু’দিন ধরে ওর সাথে ভাব জমাচ্ছে। আলিয়া ঠিক করেছে, সে হয় পালিয়ে বিয়ে করে বাবাকে শিক্ষা দিবে আর তা না পারলে বাবার পছন্দ করা ছেলেকে ডিটচ্ মেরে বিয়ের দিন সব সোনাদানা নিয়ে ভেগে যাবে। এতেও বাবার অনেক বেইজ্জতি হবে।

এভাবে প্রতিশোধ নিতে চায় সে। কিন্তু পালাবে যে, কার সাথে পালাবে? লাগেজের সঙ্গে তো আর পালাবে না৷ একটা বয়ফ্রেন্ড তো লাগবেই। কই থেকে পাবে বয়ফ্রেন্ড? তখনই খেয়াল হলো শ্রাবণ তাকে কেন যেন খুব পটানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। এর আগেও একজন এমন করেছে৷ কিন্তু ওকে আলিয়া বিন্দুমাত্র পাত্তা দেয় না। একবারে ছাপড়ি টাইপ ছেলে ছিলো৷ কিন্তু শ্রাবণ এমন না। ও ইংলিশ মিডিয়ামের স্টুডেন্ট ছিলো। এখন ইকোনমিকস্ এ পড়ছে থার্ড ইয়ার তাও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে। ওকে পাত্তা দেওয়া যায়। সবদিক থেকে-ই চলনসই সে। আলিয়া যখন নাস্তা করতে রুমের বাইরে যায় ততোক্ষণে আয়না বেরিয়ে গেছে ভার্সিটির উদ্দেশ্য।

আয়নার মন-মেজাজ খুব খারাপ। এতো বিরক্ত আর ইরেটেট এর আগে কোনোদিন লাগে নি। সকাল নয়’টা দশে একটা ক্লাস ছিলো। আরেকটা হওয়ার কথা ছিল দুপুরে৷ কিন্তু হুট করে দুপুরের ক্লাস ক্যান্সেল হয়ে যায়। তার সেকশনের বাকি ফ্রেন্ডরা ক্লাস ক্যান্সেল হওয়ায় বেশ ফূর্তিতে আছে। ক্লাস ক্যান্সেল হওয়ার আনন্দ একদিকে আর সারা পৃথিবীর যতো আনন্দ তা দড়িপাল্লার আরেকদিকে। আয়নার ধারণা পোলাপান সবচেয়ে খুশি হয় ক্লাস ক্যান্সেল হলে। সে সহ আরো চার-পাঁচ জন ফ্রেন্ড টিএসসির দিকে এগিয়ে গেলো। আজ রোদ একদম মাথা বরাবর। সূর্যের তেজ আজ বেজায়। ধুধু রোদে টিএসসির সামনে একপ্রকার বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা লেবুর শরবতের গ্লাস। এমন সময় সমুদ্রের কল আসে তার নাম্বারে। রোদে চোখ-মুখ কুচকেই সে ফোন রিসিভ করে৷

–” হ্যাঁ আয়না। কোথায় তুমি? ”
আয়না একবার ভাবলো বলবে বাসায় আছে, দুপুর টাইম যদি বাসায় চলে আসে। এই ভেবে সত্যটাই বলে দেয়।
–” ভার্সিটির সামনে। টিএসসিতে।”
–” ফ্রেন্ডরা সঙ্গে আছে?”
–” হ্যাঁ তো।”
–” আমি শাহবাগের দিকে একটা কাজে এসেছি। তিন’ টা মিনিট দাও। আসছি।”

আয়না কানে ফোন নিয়ে চোখ বড় বড় করে। উনি এদিকে আবার কী করতে এলো? শাহবাগে কাজে আসলেই কী টিএসসি এসে দেখে যেতে হবে নাকি! আয়না লেবুর শরবত হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। পাশে তার পাঁচজন ক্লাসমেটের কেউ বসে বা দাঁড়িয়ে আছে। বাবরি চুলের সুব্রত। ও কাঁধে গিটার নিয়ে বসে আছে রোদের মধ্যে। কোনো হেলদোল নেই। আয়না ভাবে ওর আসলে সিএসই নেওয়া উচিত হয়নি। চারুকলা তে যেত। সারাদিন ভাবুক হয়ে ভাবত আর ক্যানভাসে রংতুলি নিয়ে খেলতো। ওইদিকে অর্পা ও দাঁড়িয়ে ফোনে ব্যস্ত। আসলে ভার্সিটি লাইফে সবারই নিজের একটা বাউন্ডারি থাকে। যে যার মতো যাকে নিয়ে ব্যস্ত শুধু ফ্রি টাইমে বন্ধু নিয়ে আড্ডা। প্রতিবার সুব্রত, কাজল ওরা সিলেট যাওয়ার প্লান করে। ওদের ক্লাসে একজন চাকমা ফ্রেন্ড আছে। ওদের বাড়িতে ঘুরতে যাবে অথবা সুব্রতের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা যাওয়ার পরিকল্পনা করে কিন্তু দ্বিতীয় বর্ষে এসেও তা কার্যকর হয় না।
আয়নার ঘোর কাটে যখন কেউ তাকে পিছন থেকে ডেকে উঠে, ” আয়না!”

আয়না সহ ওর বাকি ক্লাসমেটরাও ফিরে তাকালো। সে দেখলো সমুদ্র এসেছে। তার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আজকে ও হাল্কা নীল রংয়ের একটা ফর্মাল শার্ট পড়েছে কিন্তু ইন করে নেই। নীলচে চোখের মনির সঙ্গে ওর শার্ট দারুণ ম্যাচিং হয়েছে। দূর থেকে আয়নাকে তাকাতে দেখে ও হেসে দেয়। আয়নার ওইসময় খুব ব্যাকুলতা অনুভব হয়। কেন যেনো মায়া আসে ওর প্রতি। নিজের জন্যও মায়া লাগে। কেমন অদ্ভুত অজানা একটা অনুভূতি মনের কোন খানে জানি পাখা ঝাপটায়। টের পায় কিন্তু বুঝে উঠতে পারেনা । নারী হওয়ার দুর্ভোগের মধ্যে অন্যতম হলো নিজের অনুভূতি নিজেই বিশ্লেষণ করতে না পারা। এইযে এই মুহূর্তে তার কেমন খামখেয়ালি অনুভূতি অনুভূত হচ্ছে। মনে হচ্ছে দু’হাত মেলে কোনো ভীনদেশে উড়াল দিতে৷ ওনার হাসিমুখের দিকে তাকাতেই কান্না পাচ্ছে৷

মনে হচ্ছে সামনে গিয়ে হাতটা ধরে শাসিয়ে বলতে, ” শুনুন মিষ্টার ওশেন, আজ থেকে আপনার ওই সুন্দর দু’টো চোখ অন্য মেয়েদের দেখাবেন না ভুলেও। রাস্তায় বের হওয়ার সময় চোখ বেঁধে বের হবেন। এখন উনি যদি প্রশ্ন করেন চোখ বেঁধে বের হলে তো দুর্ঘটনা ঘটবে তখন আয়নার কাছে উত্তর থাকবে না, ব্যাখা থাকবে না। কিন্তু এতো সুন্দর মিষ্টি অনুভূতির মধ্যেও বিশ্রী একটা স্মৃতি ভেসে আসে। তবুও একটা ‘কিন্তু’ রয়ে যায় কোনো এক পঠিত পাতায়।
সমুদ্র রাস্তা ক্রস করে তার সামনে এসে দাঁড়ায় এবং বললো, ” এই রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে কেন? ছায়ার নিচে যাও।”

আয়নাকে এই প্রথমবার ফ্রেন্ড ব্যতিত কোনো অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে কথা বলতে দেখে অর্পা অবাক ই হয়। ওর খেয়াল ই ছিলো না বান্ধাবীর বিয়ে হয়েছে। অবশ্য সুব্রত আর কাজলের মনে হলো এটা নিশ্চয়ই দুলাভাই। কারণ বিয়ের ছবি দেখেনি। আন্দাজে কিছু বলাও যায় না জন্য চুপ থাকে৷
অর্পা একটু ঠোঁট কাটা স্বভাবের, বলে ফেলে, ” এই লম্বুটা কে রে দোস্ত? তোর সঙ্গে কেন কথা বলে এই লম্বু ব্যাটা?”
আয়না এতোবেশি অস্বস্তিতে পড়লো। সে সমুদ্রর পানে তাকায়। ও মিটমিটিয়ে হাসছে যেন৷
আয়না আস্তে করে বলে, ” ওনার নাম সমুদ্র। আমার হাসবেন্ড। তোদের দুলাভাই।”
কথাগুলো বলার সময় ওর নিজের গলার স্বর কেঁপে উঠে৷ লাজে কিঞ্চিৎ পরিমাণ গালের ফোলা অংশে লাল রক্তিম আভা ফুটে উঠে।

সবাই নড়েচড়ে উঠলো। এরপর সমুদ্রের সঙ্গে কথা বলা শুরু করে। অর্পা ক্ষমা প্রকাশ করলো।
ভাবুক সুব্রত গিটার বের করে এনে বলে উঠে, ” আয়না আর দুলাভাইয়ের জন্য দু’লাইন গাই! গরীবের তরফ থেকে ছোট উপহার!”
ও গিটারে টুংটাং আওয়াজ তুলে। টিএসসির মোড়ে এমন গীটারিস্ট গোয়ানীস ডিসুজা অহরহ খুজঁলে পাওয়া যায়। যে হাতে জাভা, পাইথনের কোডিং তোলার কথা, সে হাতে কি অবলীলায় গিটারে সুরে তুলে। গেয়ে উঠে,
“আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা
আর কত কাল আমি রব দিশাহারা
রব দিশাহারা।
কারা যেন ভালোবেসে আলো জ্বেলেছিল
সূর্যের আলো তাই নিভে গিয়েছিল!”

আয়নার গান শোনা মাত্র আরো একবার কী ভীষণ প্রখর এক অনুভূতি হন্ন হয়ে বুকের মাঝ বরাবর তীব্র স্রোতের ন্যায় আছড়ে পরে। আসলেই হুট করে মনে হচ্ছে আশেপাশে কোথাও ভ্যাপসা গরমভাব নাই। সূর্যের তেজ উনি আসার সঙ্গে সঙ্গে নিভে গেছে কী?
অতিরিক্ত কোলাহল, রিকশার হর্ণ, কাকের কাকা, গাড়ির বিকট শব্দ, মানুষজনের হৈচৈ উপেক্ষা করে সুব্রতের গাওয়া দু’লাইন কি দারুণ জমে যায়৷ আয়না একধ্যানে সমুদ্রের পানে তাকিয়ে থাকে। সাহিত্য এতো সুন্দর কেন? আরোও সুন্দর বোধহয় শিল্পীরা, যারা সাহিত্যকে প্রাণ দেয়। তারচেয়েও সুন্দর বোধহয় সদ্য প্রেমে পড়া কোনো তরুণীর চোখে তার সেই প্রেমিক!

দু’লাইন গাওয়ার পর সুব্রত থেমে যায়। এরপর আয়নার সব ফ্রেন্ড তাদের একমাত্র দুলাভাইকে বললো ট্রিট দিতে। সমুদ্র ও রাজী। ওরা অবশ্য বেশি কিছু চায় না। টিএসসির মোমো আর ফুচকা খায়৷ ওতেই আনন্দ যেন!
সুব্রত বলে, ” দুলাভাইকে ডিপার্টমেন্ট ঘুরিয়ে নিয়ে যা।”
আয়নার ইচ্ছা ছিলো না। তবে সমুদ্রের ইচ্ছা হলো ওর ডিপার্টমেন্ট দেখবে৷ অগত্যা বাধ্য হয়ে নিয়ে গেলো এ ইউনিটের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট এর সিএসই শাখায়।

ওদের ক্লাসরুম আজ ফাঁকা ছিলো। ডিপার্টমেন্টর সামনে, ওখানেটায় কয়েক মিনিট পার করে ফিরে আসবার পথে আয়নার মেজর কোর্সের ফ্যাকাল্টির সাথে সাক্ষাৎ ঘটে। স্যার আয়নাকে সি আর হওয়ার সুবাদে চেনেন। স্যার অনেক রসিক লোক। মজা নিয়ে পড়ায়। ওনার ক্লাসে হাসি মাস্ট। এ জন্য আয়নার প্রিয় শিক্ষক। ওনি করিডোর বা ভার্সিটির যেকোনো জায়গায় দেখা হলে শিক্ষার্থীদের দু’টি প্রশ্ন করে। কেমন আছো আর কই যাচ্ছো।
আজও ব্যতক্রম হলো না। উনি সালামের জবাব দিয়ে প্রশ্ন করলেন আয়নাকে উদ্দেশ্য করে। এরপর সমুদ্রকে খেয়াল হলো। সমুদ্র পোশাক-আশাক দেখেই বোধকরি বুঝলেন ছাত্র না। পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, “কে তুমি বাবা?”
সমুদ্র একবার আয়নার দিকে তাকায়। এরপর নিজ থেকে ই সুন্দর করে সালাম দিয়ে যথেষ্ট ভদ্রভাবে বলে, ” স্যার আমি আয়নার স্পাউজ।”

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ১৯

স্যার শুনে বেশ খুশি হলেন৷ ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি নিজের সন্তান সমতুল্য ভাবেন। ওদের সুখী পরিবার দেখে ভালোই লাগে৷ তাদের দাম্পত্য জীবন যেন সুখময় হয় সে দুয়া দিলেন।
এরপর জিজ্ঞেস করলো, ” বাবা তুমি কিসে পড়ছো? তুমিও ইঞ্জিনিয়ার নাকি?”
–” না স্যার, আমি ম্যাককুয়ারি ইউনিভার্সিটি (Macquarie University) , সিডনি, অস্ট্রেলিয়া থেকে মেডিকেল সাইন্স নিয়ে পড়েছি।”
–” মাশাল্লাহ। তুমি তো তাহলে আমাদের সিএসই ডিপার্টমেন্টের জামাই। আবার এসো কেমন? জামাই বলে কথা।”
স্যার যেতেই সমুদ্র শব্দ করে হেসে প্রায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এরপর বলে, ” ইন্টারেস্টিং তো! ”

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২১