ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২৫

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২৫
Arishan Nur

রাস্তার ধারে সোডিয়াম লাইটের হলদে আলোয় আবৃত রাস্তা-ঘাট। ঢাকার ব্যস্ত রাস্তা ৷ সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশ। সমুদ্র কোনো কিছু ঠাণ্ডায় মাথা ভাবতে পারছে না। একধ্যানে গাড়ি চালাচ্ছে আর নিরবিচ্ছিন্ন ভাবনা-চেতনায় ব্যস্ত। আয়নার এহেন আচরণ ওকে বড্ড ভাবাচ্ছে। সে বুঝে উঠতে পারছে না, স্বাভাবিক রীতিমত এরেঞ্জ ম্যারেজ করার পরও এতো জটিলতা কেন? আর দশ-বারোটা বৈবাহিক সম্পর্কের মতো তাদের সম্পর্ক আগাচ্ছে কেন? কেন? আয়নার ব্যবহারে সে স্পষ্টভাবে অবহেলা দেখতে পাচ্ছে। এক জীবনে বহু পরিমাণ অবহেলার স্বাদ গ্রহণ করেছে। ইউশার বিষয়টাও এতো প্যাথেটিক নয়। কিন্তু আয়নার ক্ষেত্রে বিষয়গুলো– সবটা ভিন্ন। তাদের মধ্যে কোনো থার্ড পার্সন নেই, স্টীল সবটা কেন এতো খাপছাড়া? কেন ও এতো উদাসীন? মুখে কিছু বলে না। সমস্যা কী তাও জানায় না। ওর উদাসীনতা বড্ড ভাবায় সমুদ্রকে।

কমিউনিটি সেন্টারের সামনে এসে গাড়ি থামালো সে। সব ফ্রেন্ডদেরকে ইতিমধ্যে জানিয়েছে ওয়াইভ সহ আসছে। এখন আয়নাকে দেখতে না পেলে সবাই হরেকরকম প্রশ্ন তুলবে। নতুন বউ দেখার জন্য সবাই মুখিয়ে আছে যেন। নীলাও আসছে। ও নিশ্চয়ই মাথা খাবে। সে পার্কিং লটেই বসে থাকে। ইচ্ছা করে দেরিতে যাবে। এখন একদম যেতে মন চাচ্ছে না। গাড়িতে বসেই সিগারেট ধরায় সে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আয়না নিজের রুমে মন খারাপ করে বসে আছে। তার সত্যি খুব খারাপ লাগছে। গিল্ট ফিল হচ্ছে এখন। এক্সপ্লেনেশন দেওয়ারও সময় দিলো না। এখন কী করবে সে? মাথা কাজ করছে নাহ। অসহায় লাগছে। একটু পর আলিয়া ভেতরে এসে জিজ্ঞেস করে, ” ভাইয়া কী রেগে বের হয়ে গেলো আপা?”
আয়না অসহায় মুখ করে ছোট বোনের দিকে তাকায়। আলিয়ার যা বোঝার বুঝে যায়৷ নিশ্চয়ই দু’জনের মধ্যে কোনো গণ্ডগোল হয়েছে। যদিও মুখে কেউ কিছু বলে নি।
আয়না নিজ থেকে মুখ কালো করে বলে, ” ওনাকে আমি রাগিয়ে দিয়েছি। ইচ্ছা করে না আবার অনিচ্ছাতেও না।”
–” ওহো কি যে বলো বুঝিই না।”
–” কী করবো এখন?”

আলিয়া বোনকে বলে উঠে, ” ভাইয়া তো চলে গেছে কি আর করবে? তোমার আর বিয়ের প্রোগ্রামে যাওয়া হচ্ছে না। পারলে ভাইকে কিছু গিফট দিয়ে দিও। রাগ ভ্যানিশ হয়ে যাবে।”
–” সে’বার আমি যখন রাগ করলাম, উনি আমার প্রিয় চকলেট দিলো। কিন্তু আমি কী দিবো!”
–” চকলেট দেও।”
–” ধ্যাত, উনি চকলেট খায় না।”
আলিয়াই মুখ ফসকে বলে, ” তাইলে সিগারেট দেও গিফট। ওটাতেই খুশি হবে।”
কথাটা বলার সাথে সাথে আলিয়া মাথা চুলকে বের হয়ে যায় রুম ছেড়ে। আয়না ভাবতেই থাকে। যে করে হোক ওনার রাগ ভাঙ্গানো লাগবে। তার দোষে সবটা হয়েছে। এখন তাকেই সব ঠিক করা লাগবে৷ জনাব ডাক্তার উরফ বিজনেসম্যান সাহেব যতোক্ষন না রাগ ফেলে দিচ্ছে, সে তাকে তার মতো করেই জ্বালিয়ে যাবে।

ঠিক রাত আটটার পর বিয়ের প্রোগ্রামে ঢুকে সমুদ্র। সাদা শার্ট আর কালো স্যুট পরেছে আজ। প্রোগ্রাম ইতিমধ্যে জমে গেছে। গেস্টরা এসে গেছে। সে ঢুকে ফ্রেন্ডদের খুঁজতে লাগে। এরমধ্যেই তন্ময় যার বিয়ে ওর মায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। আন্টি কেমন আছো জিজ্ঞেস করেই দ্বিতীয় প্রশ্ন ছু’ড়লেন,নতুন বউ কোথায়? সমুদ্র ওর ফ্রেন্ডদের সবাইকে জানিয়েছে বিয়ের কথা। সে সুবাদে ওদের অভিভাবকরাও জানেন।

সমুদ্র জবাব দিতে পারেনা। হাল্কা হাসে শুধু। এজন্য দেরিতে এসেছে। একঘন্টাও থাকবে না সে। পেছনে থেকে ওর ফ্রেন্ডদের গ্রুপের কেউ একজন ডাক দিলো। সে পেছনে ঘুরতেই দেখলো, স্টেজের সামনে থেকে দ্বিতীয় রো’তে ওর পুরা ফ্রেন্ড সার্কেল গ্রুপিং হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে গল্প করছে। সে ইশারা করে জানায় আসছে ও’দিকটায়। আন্টিও ব্যস্ত আজ। কাজেই প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেও কিছু বলার সময় পান না। সমুদ্র ফ্রেন্ডের কাছে গিয়ে কথা বলে।
ওরাও সৌজন্যমূলক কথার ফাঁকে বারবার জিজ্ঞেস করে ভাবী কই? ভাবীকে আন। ভাবীকে রেখেই এদিকে আসলি কেন? ভাবী কী খেতে বসে গেছে?

সমুদ্র কোনোকিছুরই জবাব দেয় না। ওদের কীভাবে বলবে ওদের ভাবী তো এলোই না। বলতেও দ্বীদ্ধা কাজ করছে। সমুদ্র বিড়বিড় করে বলে, ” আসেনি।”
কিন্তু আস্তে বলায় ওরা শুনে না। ভুল শুনে। একজন বলেই দেয়,” কিরে ভাবী পিছে নাকী!”
সমুদ্র বলে, ” ধুর না। ও আস……. ”
এমন সময় পেছনে থেকে নারীকণ্ঠ ভেসে আসে। ” হ্যাঁ ওনার পেছন পেছন আসছি।”

সমুদ্র পিলে চমকে উঠে। নারীকণ্ঠটি তার পরিচিত। এটা তো আয়নার ভয়েজ। ওর ভয়েজ এখানে কেন শুনলো সে? পেছনে তাকায় না একবারও। মেয়েটা অন্য কেউ, অন্যকারো সাথে এসেছে। আয়না আসেনি। কিন্তু তার সমস্ত যুক্তি,চিন্তাভাবনা কে ভেস্তে দিয়ে আয়না তার পাশে এসে দাঁড়ালো। ওর আঙ্গুলে আঙ্গুলে ছু’য়ে দেয় খানিক। সবার সঙ্গে বেশ মিষ্টিসুরে কথা বলতে আরম্ভ করে। ছবিতে সবাই আয়নাকে দেখেছে। তাই চিনতে ওদের সমস্যা হয়নি। সমুদ্র একবারও তাকায় না ওর পানে৷ তবে ওর হাতের ছো’য়ায় হঠাৎ কোথায় জানি কম্পন ধরে। হয়তো হৃদয়ে। ওই অকেজো হৃদয়ে আজ হঠাৎ অনুভূতি ফুটছে যেন! মনের কোনো কোণে যেন ভালো লাগারা হাতছানি দিয়ে ডাকে। সে আড়চোখে একটা বার শুধু তার দিকে তাকিয়ে দেখে আসলেই মেয়েটা আয়না তো? নাকি তার ভ্রম। ও কীভাবে এলো, কেন এলো, এতো পারফেক্ট টাইমে কীভাবে এলো কিছু ই জিজ্ঞেস করা হলো না।
বেগুনি জামদানীতে ওকে সুন্দর লাগছে সেটা জীবনেও বলবে না। হুহ!

কথাত ফাঁকে সকলেই গোল হয়ে বসে। আয়নাকে সবাই গুরুত্ব বেশি দিচ্ছে। আয়নাও সবার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে যেন ওদের সঙ্গে কতোদিনের পরিচয় ওর। দেখে মনে হচ্ছে, ওর কোনো দুঃখ নেই। কিন্তু সমুদ্র পারেনা আনন্দ করতে । সে একপাশে চুপচাপ বসে থাকে আর একটু পরপর ওকে দেখে৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আজ আয়নার বুদ্ধি খুলেছে যেন। সমুদ্র যতোবারই লুকিয়ে বা আড়ালে থেকে ওকে দেখার চেষ্টা করেছে ততোবারই আয়নার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেলো। চোরও ধরা খেতে পছন্দ করে না, সেখানে সে লেজকাটা শেয়াল হয়ে বারংবার ধরা খাচ্ছে। ওর সব ফ্রেন্ডরা মিলে একটা ট্যুরের আয়োজন করতে চাচ্ছে। শ্রীমঙ্গল এ একটা রিসোর্টে। সমুদ্র সরে এসে রেস্ট রুমের দিকে পা বাড়ায়। রেস্টরুম বলতে হৈচৈ মুক্ত ছোট একটা রুম। ব্যাকস্টেজে। তবে নন-এসি।গুমোট রুম। একটু পরই প্রথম ব্যাচের আহার পর্ব। এদিকটায় ভীড় নেই বললেই চলে। রেস্টরুমটাও জনমানবহীন ছিলো। সে এসে প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে বসতেই দু’মিনিটের ব্যবধানে আয়না তাকে অনুসরণ করে চলে আসে৷ সমুদ্র তা দেখামাত্র বিরক্ত হয়।

আয়না তার সামনে এসে দাঁড়ালো। ওর জামদানী শাড়িটা একটু নিচে নেমে গেছে বোধহয়। নিশ্চয়ই ঠিকমতো শাড়ির ভাঁজ তৈরি করতে পারেনি। ফর্সা অনাবৃত পে–টের খানিক অংশ দেখা যাচ্ছে৷ সমুদ্রের বিরক্তির মাত্রা আরোও বৃদ্ধি পেলো।
সে চোখ গরম করে আয়নার পানে তাকিয়ে বলে উঠে, ” এখানে কেন আসছো? যাও স্টেজের সামনে গিয়ে দাঁড়াও। আমার কাছে কী?”

–” আপনার কাছেই তো সব।”
–” লেইম কথা বাদ দেও। ওকে?”
–” সবাই মিলে শ্রীমঙ্গল যাচ্ছি। রিসোর্ট বুক করা হয়েছে।”
–“আমরা যাবো না।”
–” না, যাবো৷ আমি আমাদের নাম দিয়ে দিয়েছি। রুমও বুকিং হয়ে গেছে। কাপল রুম আমাদের জন্য।”
–” আমার কাজ আছে। অফিস আছে। আমি যাবো না। ইচ্ছা হলে তুমি একাই যাও।”
–” শুক্র-শনি বার আবার কিসর অফিস?”

সমুদ্র কথা বাড়ায় না। মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে আয়না পার্স খুলে একটা গিফট বের করে। র‍্যাপিং করা।”
আয়না ওর হাতে গুঁজে দেয় এরপরে বলে, ” খুলে দেখুন।”
সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে টান মেরে র‍্যাপিং পেপার ছিঁড়ে ফেলে।যেন পেপার ছেঁড়ার মাধ্যমে নিজের রাগের মাত্রা বোঝাতে চাচ্ছে ও। প্যাকেট খুলতেই দেখলো দু’টো বিদেশি দামী ব্রান্ডের সিগারেটের প্যাকেট। সে চোখ বড় বড় করে তাকায়। এই প্রথম সে উপহার হিসেবে সিগারেট পেলো।
আয়নাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” তুমি সিগারেট কেন এনেছো?”
–” আমি রাগ করেছিলাম বলে আমার প্রিয় কিটক্যাট দিলেন, তাই ভাবলাম আপনি রাগ করেছেন জন্য আপনার প্রিয় সিগারেট দিই।”

সমুদ্র সব রাগ কপূর্রের ন্যায় উবে যায়। এতো কিউট চিন্তা করে জোশ একটা গিফট দিয়েছে ও! তবে মোটেও তা আয়নাকে বুঝতে দেয় না। এতো জলদি রাগ পড়ে যাওয়ার কথা আয়নাকে বলে দিলে ওর রাগের দাম কমে যায়।
রাগ আর শেয়ার বাজারের মূল্য কমতে থাকলে, দাম থাকে না।
সে সিগারেট প্যাকেটে ঢুকিয়ে বলে, ” এমন মেকাপ করে সিগারেট কিনতে গেছো পুরা এলাকাবাসী জেনে যায়নি?”
–” দারোয়ান কে নিয়ে আনিয়েছি।”

সমুদ্র সোজাসুজি গেইটের দিকে যেতে ধরলে আয়নার বাহু ধরে বলে, ” সর‍্যি তো! আচ্ছা আপনার রাগ এখনো কমেনি? তাহলে কান ধরি? আপনি বললে উঠা-বসা ও করবো। তাও প্লিজ নর্মাল হন।”
সমুদ্র ভ্রু কুচকে রেখেই জবাব দেয়, ” তোমার মধ্যে এতো ছেলেমানুষী ভাব কেন? আজব!”
আয়না ওনার কথা শোনার অপেক্ষায় না থেকে কানে হাত দিতেই সমুদ্র বলে উঠে, ” এই এই কি করছো? কেউ দেখলে আমাকে নারী নির্যাতন মামলায় জেলে ঢুকায় দিবে। কান থেকে হাত নামাও।”

আয়না কান থেকে হাত নামিয়ে সমুদ্রের দিকে ছু’টে আসতে গেলে, শাড়ির কুচির সঙ্গে স্যান্ডেলের হিলের অংশ লেগে হুমড়ি খেয়ে সামনের দিকে পড়ে যেতে নেয়। ভাগ্য সহায় ছিলো। সমুদ্র সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় ওর বুকের উপর হুমড়ি খায়। সমুদ্রের টাল সামলাতে ভারী কষ্ট হয়। পাশের দেয়ালের সঙ্গে পিঠ গিয়ে ধাক্কা খায়৷ লাগেও খুব। তবে প্রকাশ করে না। বেশ শক্ত করেই আয়নাকে ধরে থাকে। ও আস্তে করে ধরে থাকলে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে চিটপাটাং হবে ও।

সমুদ্র ওর কোমড় চেপে ধরেই ঝারি মারা কণ্ঠে বলে, ” এভাবে এতো লাফালাফি করো যে পরে গেলে কী হত? মাজা ভে–ঙে হসপিটালাইজড হওয়া লাগত।”
আয়না ওর কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বলে না। বুকে লেপ্টে থাকে যেমন করে কোনো বড় গাছকে আটকে মরা লতা-পাতা লেপ্টে থাকে৷ সমুদ্রের কোনো জানি লাগে। সবটা অন্যরকম লাগে৷ কেমন লাগছে এর উত্তর তার চাই। সে আবেশে চোখ বুজে ফেলে। কে জানি উত্তর দেয় শান্তি লাগছে বড়। কে দিলো উত্তরটা? কারো কথা শোনা যাচ্ছে৷ কিন্তু ও কারো কথা শুনছে চায় না এই মুহূর্তে ৷ শুধু অনুভব করতে চায়।

আয়নার অনাবৃত আচলের ফাঁক গলে ওই হলদে দুধে আলতা পেটে হাত চালায়। এক প্রকার খা–মচে ধরে। অবিন্যস্ত হাত চঞ্চলতা বাড়ায়। দুজন এতো কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে যে ওর কম্পিত হওয়াও সে অনুভব করে৷ ওর উষ্ণ নিশ্বাস সবটা তার মধ্যে অন্তঃরাল থেকে শিহরণী সংকেত দিচ্ছে। অসহ্যরকম আরাম লাগে। সে সমস্ত বলপ্রয়োগ করে আয়নাকে নিজের বুকের সঙ্গে আরোও জোরে আগলে নেয়। নিজের ভার ছেড়ে দেয় দেয়ালে। সমুদ্রের মনে হলো আয়না তার হৃদপিণ্ডটা ঠাণ্ডা করে দিলো। পারলে ওকে বুকের সঙ্গে পি–&ষে নিত। একদম ব্লে–ন্ড করে বুকে ঢুকিয়ে নিবে।

–” শুনছেন কী বলছি?”
–” না।”
সমুদ্র বেশ খানিকটা বিরক্ত হয়। তার কিছু শুনতে মন চাচ্ছে না৷ এভাবেই যুগ যুগ কাটিয়ে দিতে চায়৷ কিন্তু আয়নার এখনই কথা বলতে হবে৷ কথা না বললে যেন ভারতবর্ষ ধ্বং–স হবে।
সে একটু মাথা উঁচু করে বলে, ” আমার কুঁচি খুলে গেছে।”
–” কি খুলে গেছে?”
–” শাড়ির কুঁচি। শাড়ি যেকোনো সময় খুলে যাবে।প্লিজ কোনো ব্যবস্থা করেন।”
সমুদ্রের সঙ্গে সঙ্গে টনক নড়ে। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, ” এ’সব কী বলো?”

আয়না তখন ব্যস্ত হয়ে আঁচল ধরে নিচু হয়ে কুঁচি দেখছিলো। সমুদ্র দ্রুত ছু’টে গেইট লক করে দেয়। মেয়েটার যদি কোনোদিকে খেয়াল থাকে। এই মুহূর্তে যদি কেউ ভেতরে ঢুকে পরে! গেইট লক করে ঘুরে দাঁড়াতেই সমুদ্রের যেন হতবুদ্ধি হওয়ার উপক্রম। ছোট্ট করে দু’বার ঢোক গিললো। যা সামনে দেখছে এ’সব দৃশ্য দেখলে যেকারো মাথা খারাপ হয়ে যাবে। ও সমস্ত কুঁচি খুলে ওগুলো পুনরায় ভাঁজ করছে। আঁচলের বালাই নাই। নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ব্লাউজের হাতা উলটে আছে। সমুদ্র একবার মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে ব্রাশ করে নিল এতে রক্ত সঞ্চারিত ঠিকঠাক মতো হয়। প্রেশার বাড়লে এমন করা লাগে। তাহলে আরাম লাগে। প্রোফেসর এডরিন এটা বলেছিলো।
সে এক পা, দু’পা এগিয়ে আসতেই আয়না ওর আঁচলখানা সমুদ্রের হাতে তুলে দিয়ে বলে, ” শাড়িটা এতো ভারী, কোনোভাবেই কুঁচি হচ্ছে না৷ একটু নিচু হয়ে কুঁচি গুলো ঠিক করে দিতে পারবেন?”

–” আমি জীবনেও শাড়ি পড়া দেখিনি।”
–” তাই বলে কুঁচি ঠিক করে দিতে পারবেন না? একদম ডাস্টবিনের মতো কথা বললেন।”
–” ঠিক করে শাড়ি পড়িয়ে দিলে বলবে কাকে আগে পড়াতাম শাড়ি। এসব ঝামেলায় আমি নাই।”
আয়না মুখ ফুলিয়ে বলে, ” না এসব কিছু বলবো না।প্লিজ হেল্প।”
সমুদ্র আবার কেউ সাহায্য চাইলে না করে না। জোর গলায় বলে, ” আঁচল ধরো।আর হ্যাঁ একদম কই মাছের মতো লাফালাফি করবা না।”

ওর শাড়ির কুঁচি কোনোরকমে ভাঁজ দিয়ে সেভটিপিন মেরে দেয়। যদিও বা সুন্দর হয়নি কিন্তু চলনসই। খুলে পড়ার অন্তত সম্ভাবনা নেই। সমুদ্র নিজেও অবাক হলো কেমনে পারলো সে কুচি ভাঁজ করতে?
শাড়ি পড়ানো হতেই আয়নার ওর দু’হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ” শুনেন।”
সমুদ্রের হাত ছিলো ওর কুচিদ্বয়ের ভাঁজে। এরপর গভীর মনোযোগ দিয়ে অনাবৃত অংশগুলো ঢেকে দেয়। তারপর সুধায়,” বলো।”

–” তাকান আমার দিকে।”
সমুদ্র মাথা উঁচু করতেই আয়না ওর বাম গালে একটা চু-মু বসায়। এরপর ছেড়ে দিয়ে বলে, ” থ্যাংকস। শাড়ি ঠিক করে দেওয়ার জন্য।”
এরপর ডান গালে আবারোও আলতো করে ঠোঁট ছু’য়ে দেয়। ছেড়ে দিয়ে বলে, ” এন্ড সর‍্যি।”
সমুদ্র হতভম্ব হয়ে হ্যাবলার মতো চেয়ে থাকে, চোখ গোল গোল করে৷ সে একদম বরফের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। গালে এখনো লাল লাল লিপস্টিকের দা?&গ দেখা যাচ্ছে। সমুদ্র ডান গালটায় যেখানে চু–মু বসিয়েছে সেখানে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে যে ওর পথ আটকে থামাবে সে উপায় নেই। আয়না একপ্রকার দৌঁড়ে রেস্টরুম ছেড়ে বেরিয়ে গেছে৷

স্টেজের সামনেই নীলার সঙ্গে দেখা। নীলা আয়নাকে দেখামাত্র জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু খায়। অবিরাম বকবক করতেই থাকে ওর সাথে।
সমুদ্রের সম্পূর্ণ ফ্রেন্ড গ্রুপ মিলে বর-বউয়ের সঙ্গে ফটোসেশান করে। তারপর খেতে যায়৷ খাওয়ার সময় ওয়েটারকে আয়না বলে উঠে, ” ডাক্তার সাহেব কে লেগপিজ দিবেন।”
সমুদ্রের এতো মেজাজ খারাপ হয়। ওর সব ফ্রেন্ডরা হেসে দেয়। এতো বুড়া হওয়ার পর মানুষ-জন এ বয়সে আর লেগপিজ চায় না। এখন বাচ্চাদের লেগপিজ খাওয়ানোর বয়স যাচ্ছে। ওদের হাসতে দেখে ওয়েটারও হেসে দেয়। তারপর বলে, ” দিচ্ছি স্যার।”

সমুদ্র মুখ-চোখ শক্ত করে খেতেই থাকে৷ এমন সময় হুট করে ওর বাম পায়ে সুর–সুরি অনুভূতি হয়। বাম পাশে আয়না বসেছে৷ সে চোখ নিচু করে দেখলো, আয়না স্যান্ডেল খুলে ওর পায়ের আ–ঙ্গুল দিয়ে ওকে কাতু–কুতু দিয়ে ইচ্ছা করে জ্বালাচ্ছে৷ সমুদ্র চোখ গরম করে আয়নার দিকে তাকায়। আয়না ওইসময় গভীর মনোযোগ দিয়ে খাওয়ার অভিনয় করে। দ্বিতীয়বার এমন করলে সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়৷ এক ফ্রেন্ড প্রশ্ন করে, ” কি হলো?”
সমুদ্র পড়ে বিপাকে। বউয়ের দুষ্টামির কথা তো পাবলিকভাবে বলা যায় না। সে ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে,
–” পানি নিবো।”

টেবিলের মাঝখান থেকে পানি নিয়ে গ্লাসে ঢেলে নেয়। ওদের দু’জনের চোখাচোখি হতেই সমুদ্র ইশারায় বুঝায় কাজটা ভালো হচ্ছে না। আয়না ভ্রুক্ষেপহীন। সে ভ্রু নাচিয়ে দুষ্টু হাসি হাসে। সমুদ্র ওর কাতুকুতু দেওয়া সহ্য করতে থাকে। এগুলো একদা সেও করেছে। তার সূত্র তার উপরই প্রয়োগ করছে।বেয়াদব মেয়ে!
খাওয়া শেষে চেয়ারে বসতেই নীলা ওর ছোটো মেয়েটাকে আয়নার কোলে তুলে দিয়ে বলে, ” নুহা মামনি কিছুক্ষণ নতুন মামীর সঙ্গে থাকো। আম্মু-আব্বু খেয়ে নিক ততোক্ষণে।”
আয়না বাচ্চা খুব সুন্দর মতো রাখতে পারে৷ ও একদম দক্ষদের মতো এতো ছোট বাচ্চাটাকে কোলে নেয়। সমুদ্র অবাক হয়। সে ডাক্তার হয়েও এতো ছোট বাচ্চা নিতে পারেনা। ইন ফ্যাক্ট বাচ্চাই কোলে নেয় না। সে বলে উঠে, ” তোরা বাচ্চা অন্যের কাছে ফেলে রেখে খাওয়া-দাওয়া করবি? কেমন নির্দয় মা তুই!”
নীলা সমুদ্রের দিকে তাকায় এবং বললো, ” তোরও এমন মিনি সাইজ আসবে৷ তখন বুঝবি মজা। দেখবো বাচ্চা কোলে রাখে কেমনে খাস তুই। বাচ্চার কান্না থামাতে গিয়ে আর খাইতেই পারবি না। এরচেয়ে এখন থেকেই দ্রুত ট্রেনিং নে।”

আয়না বাবু কোলে নিয়েই বলে, ” ওনার আসলেই ট্রেনিংয়ের দরকার আছে। নাহলে দেখা যাবে বাবুর সেরিলাক নিজেই খেয়ে বসে আছে। ওদিকে বাচ্চা ক্ষুধায় কাঁদছে।”
নীলা আর আয়না দুজনে সমুদ্রকে পচাতে পেরে খুব হাসলো। মাকে হাসতে দেখে ছোটো নুহাও ফোকলা দাঁতে হাসি দিলো। সমুদ্র মুখ ভোতা করে দাঁড়িয়ে থাকে।
আয়না প্রশ্ন করে, ” আপনি বাচ্চা কোলে নিতে জানেন তো? নিয়েছেন কোনোদিন? ”
–” হসপিটালে নিয়েছিলাম। অনেক আগে।”

আয়না অবাক নয়নে বলে উঠে, ” তাহলে আসলেই আপনার ট্রেনিং দরকার। আপু ঠিকই বলছে। আচ্ছা চেয়ারে বসুন। আমি দেখাচ্ছি কীভাবে বাচ্চা কোলে নিতে হয়। তারপর নুহাকে কোলে নেন।”
সমুদ্র সরে এসে বলে, ” একদম নিজের বাচ্চা হলেই কোলে নিবো ওকে।এর আগে না।”
আয়না অবাক চোখে তাকালে সমুদ্র বলে উঠে, ” তুমি দেখি ভালোই বাচ্চা সামলাতে জানো। আমার তো সুবিধাই তাহলে।”
সবার সঙ্গে বিদায়ের বেলা নীলা একফাঁকে সমুদ্রকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলে, ” ইউশা দেশে এসেছে, জানিস?”
সমুদ্র ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে বলে, ” না।”

–” এভাবে হুট করে কেন আসলো? কি চায়?”
–” ওর ব্যাপারে কিছু শুনতে চাই না। আসি।”
আয়নাকে নিয়ে গাড়িতে উঠতেই আয়নার মোবাইলে ওর বাবার ফোন আসে। আয়না ফোন কেটে দেয়। দাদা অসুস্থ থাকার সময় বাবা বাসাতেই ছিলো। কিন্তু গত দু’দিন রাতে বাসায় আসেনি। নিশ্চয়ই ওই মহিলার বাড়ি ছিলো। আয়না অবশ্য বাবার সঙ্গে কথা বলে না। চেহারাও দেখায় না। মুহুর্তের মধ্যে সমুদ্রের ফোন বেজে উঠে। ফাহাদ সাহেব কল দিয়েছেন। সমুদ্র রিসিভ করে কথা বলে নেয়৷

এরপর গাড়ি চালাতে চালাতে বললো, ” আজকে তুমি আমাকে অনেক জ্বালিয়েছো। বিয়ে বাড়িতে এমন করে? রীতিমতো সিডি– উস করছিলে। আমি ভদ্র জন্য সহ্য করতে পেরেছি।”
আয়না চোখ গোল গোল করে তাকায় ওনার পানে। নীল আর বাদামী চোখের মণির মিলন ঘটে। সমুদ্র গাড়ির মোড় ঘুরিয়ে একটা অন্ধকার গলির ভেতর গাড়ি থামায়। আয়না ভয় পায়। যদিও উনি সঙ্গে আছেন। নিরাপদ ই থাকবে। তবুও এমন কোলাহল বিহীন, যানবাহন বিহীন অন্ধকার গলিতে গাড়ি থামানো রিস্কি লাগলো তার। একটা ল্যাম্পপোস্ট ও নেই আশেপাশে।

সমুদ্র আচানক ওর বাহুতে টান মারে। আয়না হেলে ওর দিকে ঠলে পড়ে৷ সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, ” এখন জ্বালানোর পালা আমার।”
আয়না কিছু বলবে সে’সময় টুকুও পায় না ও৷ তার আগেই সমুদ্র ওর অ–ধর–জোড়া মিলিয়ে ফেলে ওর অ//ধর জোড়ার সঙ্গে। আপনা-আপনি কথা বলা বন্ধ হয়ে যায় ওর। ওর চোখ রসগোল্লার মতো বড় আর গোল হয়ে যায় ক্ষণেই। আবেশে, আবেগে, লজ্জায় সব ধরনের অনুভূতির নতুন এক ফিউশানে উৎপন্ন অনুভূতির সাগরে ডুবতে ডুবতে আয়না উনার শার্ট খা–মচে ধরে। কতোক্ষণ পার হয় কে জানে৷ পেছনে থেকে গাড়ির গ্লাসে কিল দেওয়ার আওয়াজে হুশ আসে ওদের৷

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২৪

সমুদ্র সরে এসে ঠোঁ–ট মুছে লুকিং গ্লাস দিয়ে ব্যাকভিউ দেখে। গলির মোড়ে আরেকটা গাড়ি এসেছে৷ কিন্তু সমুদ্রের পার্ক করা গাড়ির জন্য আগাতে পারছে না জন্য গাড়ির ড্রাইভার নেমে এসেছে। হয়তো কয়েকবার হর্ন দিয়েছে৷ গা–লি-গালাজও করছে।
ওই সময় এই জগতে থাকলে তো গাড়ি সাইড করবে সে?
আয়না বলে উঠে, ” বেশি রোমিও গিরি করলে এমনই হবে।”

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২৬