ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৩২

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৩২
Arishan Nur

আই ডোন্ট লাইক কিন্ডস ইটস ট্রু– সারাটা রাত এই একটা কথাই ঘুরপাক খেতে লাগে আয়নার মস্তিষ্কে। ওর রাতে ঘুম হয় না। কেনো জানি চোখ গড়িয়ে ফোঁটায়-ফোঁটায় পানি গড়াতে থাকে খানিক বাদে। তবে সমুদ্র ও’পাশে ফিরে আরামের ঘুম ঘুমাচ্ছিলো। নিস্তব্ধ রজনীতে নিজেকে বড় অসহায় লাগে। জীবনের সমীকরণ মেলাতে গিয়ে কোথায় জানি আটকা পরে৷ কোথা’কার কোন সুতোর টান যেন আলগা! সে হিসাব মেলাতে পারে না, ফলাফল একটা নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দিলো।

সকালের দিকে চোখ বুজে আসলে, সমুদ্রর নড়চড় এর আওয়াজ কানে আসে৷ একটু পর নিজের চুলে কারো হাতের স্পর্শ পায় সে। চোখ বন্ধ করেই রাখে। ও বুঝি মিনিট পাঁচেক চুলে হাত বোলায়। আয়নার আরাম লাগে, বিষাদের তেতো স্বাদ একটু কমে। এরপর উনি উঠে চলে যান। সঙ্গে সঙ্গে আয়নাও উঠে বসলো। চোখ ফোলা তার।
সমুদ্র ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দৃষ্টি নিবন্ধ হলো আয়নার উপর। আয়নাকে দেখে সে বলে, ” আজ এতো দ্রুত উঠে গেলে যে?”
আয়না উত্তর দিলো না, তবে নিজের মনের খারাপ লাগাও বুঝতে দেয় না৷ ও উঠে রান্নাঘরের দিকে যেতে থাকে। সমুদ্র অনেক সকালে ব্রেকফাস্ট করে। ময়নার মা এতো আগে আসে না৷ ওর জন্য প্রোটিন শেক বানিয়ে রুমে ফিরলে সমুদ্র ওর হাত ধরে টেনে নিজের কাছে বসিয়ে নিয়ে বলে, ” কি হয়েছে তোমার? মুখ এমন ফোলা কেন? রাতে ঘুম হয়নি?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আয়না সংক্ষেপে বলে, ” কিছু না।”
ও জানে সমুদ্রকে নিজের মন্দ লাগা বলে লাভ নেই। উলটা নানান যুক্তি দিবে৷ ওর যুক্তি না, যত্ন চাই! মেয়েরা যতোই বিজ্ঞানী কিংবা প্রকৌশলী হোক না কেন! তাও যুক্তির চেয়ে মন ভোলানো আদুরে যত্ন আর কথা পছন্দ করে। ছোট্ট করে বলে, ” মাথাব্যথা ছিলো।”
সমুদ্র শার্ট পরতে পরতে বলে, “নাপা খেতে পারো। শোন, সন্ধ্যায় একটা পার্টি আছে। আমি ছয়টায় এসে তোমাকে নিয়ে যাব।”

–” আমার যাওয়া খুব দরকার?”
–” মিস্টার এন্ড মিসেস ইনভাইটেশন। আমাদের প্রোজেক্টের সাকসেস পার্টি।”
–” আমার ক্লাস আছে, ক্লান্ত হয়ে যাবো।”
–“আজকে তো বৃহস্পতিবার। তোমার ক্লাস তিনটায় শেষ। জলদি বাসায় ফিরবে৷ কুইজ আছে কোনো?”
–” না৷”

সমুদ্র আর কিছু শুনেও না, জিজ্ঞেস ও করেনা, মেডিসিন টেবিলে রেখে, শুধু গেলাম বলে চলে গেলো। আয়নার এমন ছক বাঁধা জীবনটা কেমন অগোছালো লাগে। না পারে কারো সাথে শেয়ার করতে, আর না পারে মন খুলে নিজের খারাপ লাগা গুলো বলতে।
সমুদ্রের সময় হয় না ওর সাথে বসে সারা বিকাল কথা বলার! আয়নার একাকী লাগে ভারী। বাবার বাড়ির কথা মনে পরে অনেক। কিন্তু শায়লা চৌধুরী ও’বসায় শিফট হওয়ার পর সে যায়নি বাবার বাসায় একবারও। আলিয়া ও দাদা-দাদীর সাথে ফোনে, ভিডিওকলে কথা বলে শুধু। ওর কেনো জানি দু’চোখ ভরে উঠে। এতো পাওয়ার মাঝেও কী জানি না পাওয়া তার।
এমন অ-সুখী, বে-রঙিন, অ-গোছালো জীবনের উপর সে ক্লান্ত হয়ে পরছে ভারী।

সমুদ্র কেবিনে বসে ফাইল দেখছিলো এমন সময় নক করার আওয়াজ ভেসে আসে। সে আসার অনুমতি দিতেই নাজিয়া এলো ভেতরে। হাসি-হাসি মুখে, অতিরিক্ত সাজ-সরঞ্জাম করে, যা একান্তই অবান্তর। সমুদ্র চোখ ফিরিয়ে নিলো। সজল ভাই সাতজন ক্যান্ডিডেট এর মধ্যে থেকে নাজিয়া কে সিলেকশন করেছে। মেয়েটা কোয়ালিফাইড কিন্তু স্বভাব কেমন জানো লাগে সমুদ্রের। কেমন একটু গা-পরা কিংবা অতিমাত্রায় বন্ধুত্বপূর্ণ লাগে। ক’টা দিনই গেলো এতেই ওর উপর একটা নেতিবাচক ইমপ্রেশন ক্রিয়েট হচ্ছে যদিও বা সেটা কেবল সমুদ্রের ভ্রান্ত ধারণা বৈকি!
নাজিয়া ফাইল নিয়ে এসে বলে, ” স্যার, আজ দুপুর দু’টোয় মিটিং শিডিউল ফিক্সড করবো?”

–” হ্যাঁ, করো।”
নাজিয়া ফাইল নিয়ে তার সামনে ঝুঁকে দাঁড়াতেই ওর ফিমেল শার্টের তিনটে বোতাম খোলা থাকায় কিছু অস্বস্তিকর, অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পরে সমুদ্র। সে দ্রুত সাইন করে বলে, ” আচ্ছা, এখন যান৷”
–” স্যার, একটা হেল্প লাগতো?”
–” কী?”
–” আমাকে এখনো পিক আপ স্যাটেলের জন্য ব্যবস্থা করে দেয়নি। আজকে একটু ড্রপ করা যাবে? ”
সমুদ্র একবার ভাবলো হেল্প করবে না, না বলে দিবে, পরবর্তীতে বলে উঠে, ” আমি পাঁচটায় বের হবো। আপনি তখন আমার অফিসের গাড়িতে উঠে পড়বেন।”

–” থ্যাংকস, স্যার৷”
নাজিয়া চলে যায়, তবে ওর কড়া পারফিউমের সুঘ্রাণ কেবিনে রয়ে যায়।
দুপুরে খাওয়া সেরেই সে আয়নাকে রিমাইন্ডার দেওয়ার জন্য ফোন দিয়ে মনে করিয়ে দিলো পার্টির কথা। আয়না তখন কেবল ভার্সিটি থেকে ফিরে এসেছে৷ আয়নার ইদানীং কী হয়েছে কে জানে, একদম বাইরে যেতে ইচ্ছা করে না। সে গোসল করেই ভেজা চুলে ঘুমিয়ে পড়লো৷ এদিকে সমুদ্র মিটিং শেষ করে অল্প কিছু খেয়ে বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্য বেরিয়ে পরতেই খেয়াল হলো নাজিয়াকে ড্রপ করার কথা। সে কল দেয় নাজিয়াকে। তারপর গাড়িতে গিয়ে বসে। মেয়েটা পার্কিং লটে এসে দাঁড়ায়, হেঁটে এসে পেছনের দিকে তার পাশে বসে পরে। সমুদ্র চকিতে উঠে। সবসময়ই অফিসের কেউ বসলে সামনের সীটেই বসে। সমুদ্রের পাশে, পেছনে কেউ বসে না। অঘোষিত নিয়ম যেন সেটা। নতুন হওয়ার সুবাদে নাজিয়া বোধহয় এ’নিয়ম জানে না৷ সে বলতেও পারছে না নেমে পড়ার কথা। গাড়ি চলা আরম্ভ করেছে। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে৷
নাজিয়ার বাসার কাছাকাছি আসতেই ও বলে উঠে, ” স্যার, বাসায় আসেন। চা-কফি খেয়ে যান। আমি অবশ্য একা-ই থাকি।”

–” না, না। আজ নয়৷ অন্যসময়।”
ওর বাসার গলির সামনে ঢুকতে রাস্তা একটু খারাপ বিধায় গাড়ি ঝাঁকি খায়। নাজিয়া একদম সমুদ্রের গায়ে ঢলে পরে৷ গায়ের সঙ্গে লেগে যায়। কেমন চাউনিতে নাজিয়া ওর দিকে তাকায়। খুব বিরক্ত লাগে সমুদ্রের। সে দ্রুত সরে এসে বসলো এবং বলে, ” নামুন এখানেই। বাকিটা হেঁটে যান।”
–” স্যার, আসেন না আমার বাসায়।”
–” না, আমার ওয়াইফ অপেক্ষা করছে।”
নাজিয়া একটু চমকালো যেন স্যারের ওয়াইফ বিষয়টা হজম করতে পারছে না। বলেই বসে, ” আপনি বিবাহিত?”
–” বিবাহিত নাহলে ওয়াইফ পাবো কোথা থেকে? সিংগেল থাকলে কী ওয়াইফ থাকে নাকি?”
নাজিয়া নেমে আগ বাড়িয়ে নিজের বাসা দেখিয়ে আরোও কিছু বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই সমুদ্রের আদেশে ড্রাইভার গাড়ি সামনে নিয়ে যায়৷

মামনির ডাকে আয়নার ঘুম ভাঙ্গে। উনি ডেকেই চলেছেন। ঘুমের ঘোরে পরিষ্কার ভাবে কিছু শুনতে পায়না।
আয়না উঠে বসতেই মিসেস রোদেলা বলে, ” সমুদ্র কল দিয়েই যাচ্ছে। তুমি ফোন ধরছো না জন্য আমাকে কল দিয়ে জ্বালিয়ে মারছে। তুমি রেডি হলেই ও শান্তি পাবে। তোমাকে রেডি করানোর দায়িত্ব আমাকে দিয়েছে সমুদ্র।”
আয়নার খেয়াল হলো আজ ওদের পার্টিতে যাওয়ার কথা। তাকে মামনি নিজের দামী আর সুন্দর একটা কালো শাড়ি পরিয়ে দিলো। পিউ আবার ওর ভেজা চুল দেখে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে চুল স্ট্রেইট ও করে দেয়।আবার সুন্দর করে মেক আপ ও করে দিলো। নিজেকে দেখে সে নিজেই অবাক হলো৷ অন্যরকম লাগছে দেখতে। পিউ ভাবীকে দেখে বলেই ফেলে, ” ভাবীমনি, তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। তোমর রুপ দেখে ভাইয়া নিশ্চয়ই আজ পাগল হয়ে যাবে।”

আয়না লজ্জা মিশ্রিত হাসি হাসে। একটু পর, সমুদ্র রুমে আসলে পিউ বেরিয়ে যায়৷
সমুদ্র আয়নাকে সাজুগুজু করে বসে থাকতে দেখে বলে, ” আমি ভেবেছি তুমি আরোও ঘণ্টা খানেক অপেক্ষা করাবে, আমার সৌভাগ্য অপেক্ষায় থাকতে হলো না। ব্লাক পরেছো! তাহলে আমিও ব্লাক পরি। ম্যাচিং হবে৷”
ও ওয়াশরুমে চলে যায়। আয়না চুপচাপ বসে থাকে। সমুদ্রের মধ্যে সবার সামনে, পাবলিক্যালি পার্ফেক্ট কাপল হওয়ার খুব শখ৷ দুনিয়ার মানুষের কাছে তারা বেস্ট কাপল। অথচ আসার পর একবারও বললো অব্দি না, আয়না কেমন আছে! ওর মন খারাপ কেনো? কিন্তু ওনার তো সেদিকে তাকা’বার জো নেই। সুন্দর করে সাজলেই সুন্দর থাকা হয় না, মিষ্টার ওশেন।”

সমুদ্র সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরে বেরিয়ে আসে। আলমারি থেকে ব্লাক স্যুট বের করে বলে, ” লেবুর শরবত দাও।”
এ’বাসায় আসার পর থেকে প্রতিদিন আয়না ওনার জন্য শরবত বানিয়ে রাখে৷ অফিস থেকে এলে ওয়েলকাম ড্রিংক হিসেবে সার্ভ করে। আয়নার বানানো লেবুর শরবত সমুদ্রের খুব পছন্দ। গ্লাসে করে শরবত এনে দিলে ও খেয়ে নিয়ে গ্লাস টেবিলে রেখে, খুব অভিজ্ঞ পুরুষের ন্যায় আয়নার কোমড় জড়িয়ে ধরে। আয়না সরে আসতে চায় কিন্তু সমুদ্র বাঁধা দেয়। দু’জনের মধ্যে হাতাহাতি চলে। একটা পর্যায়ে আয়না বলে, ” আমার সুন্দর করে পরা শাড়ির ভাঁজ নষ্ট করছেন।”

সমুদ্র কথার ফাঁকে ওকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে এবং সুযোগের সঠিক ব্যবহার করে। নিজের বাম হাত আয়নার শাড়ির ভাঁজে কোমড় থেকে আরও সামনে অগ্রসর করে। এরপর কানের সামনে মুখ নিয়ে এসে বলে, ” সমস্যা নাই। শাড়ি খুলে গেলে আমি আবার পরায় দিবো। আফটার অল, শাড়ি পরাতে আমি এক্সপার্ট।”

আয়না নড়েচড়ে উঠে, তবে সমুদ্র পকেট থেকে একটা বক্স বের করে, ডায়মন্ডের একটা চেইন বের করে, পেছনে লেপ্টে থাকা চুল আস্তে আস্তে সরিয়ে দেয়। ওনার শীতল স্পর্শ নিজের ঘাড়ে পড়তেই কিঞ্চিৎ কাঁপে আয়না। চেইন গলায় পরিয়ে দিয়ে অনেক চেষ্টা করেও সমুদ্র আর হুক লাগাতে পারে না৷ বহু কষ্টে হুক লাগিয়ে দুজনেই ড্রেসিং টেবিলে লাগানো মিররের দিকে তাকায়। আয়নার গলায় হীরার সিম্পেল চেইনটা মানিয়েছে বেশ। সমুদ্র নিজেও মোহ আবিষ্ট নজরে তাকিয়ে থেকে আরেকটু আয়নাতে বিভোর হয়ে বলে, ” থাক, আজ আর না যাই। বাসায় থাকি।”

এরপর গলার ওই প্রিয় জায়গায় ঠোঁট ছু’ইয়ে কানের লতিতে কা মড় বসায়। আরোও একটু কাছাকাছি আসবে, তখন বিকট শব্দ তুলে সমুদ্রের ফোন বেজে উঠে। তবে ফোন ধরে মুড আর টাইম ওয়েস্ট করার ইচ্ছা বুঝি ওর ছিলো না। আয়নাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়। আয়নাও একদম চুপটি করে ওর বুকে নেতিয়ে পড়ে। কপালে ছোট্ট একখানা চুমু দেয়। দু’জন দু’জনের দিকে তাকায়, সমুদ্রর দৃষ্টি ওর গোলাপি ঠোঁট দু’টির দিকে। এগিয়ে এসে নিজের হাতের অনামিকা আঙুল আলতো করে ওর ঠোঁটে ছো’য়ায়। ও আবেশে চোখ বুজে ফেলে। সমুদ্র নিজের আঙুলে লিপস্টিকের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। নিজেও আয়নার দিকে ঝুকে, নাকে নাক ঘঁ ষে। হাতে হাত, আঙুলে আঙুল ছন্দ তোলে।

আয়নাকে একদম নিজের সঙ্গে মিশে ফেলে, নিজের পায়ের পাতার উপর দাঁড় করায়। আয়নাও ওর কলার খা মচে ধরে। কেবল দু’জনে দু’জনকে অনুভব করছিলো। একে অপরের ঠোঁটে গরম উষ্ণতার মৌসুম শুরুর পূর্বাভাসের আগেই, আবারও ফোন বাজে। বিকট শব্দে বিরক্ত হয় দু’জনেই। সমুদ্র সরে এসে ফোন হাতে নিয়ে বলে, ” সর‍্যি।”
আয়না বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো, ” আপনি বাসায় থাকলেও মন অন্যকোথাও রাখেন। বাসায় থেকেও লাভ কি? ফোনে কথা বলেই পাড় করেন।”

ফোনে কথা বলা শেষ করেই দু’জন বেরিয়ে পড়ে। আয়না থাকলে সে নিজেই ড্রাইভিং করে। আজও ব্যতিক্রম নয়। বনানীর পাঁচ তারকা হোটেলে এসে পৌঁছে গন্তব্যে চলে যায় তারা। অনুষ্ঠান চলছে। বিশাল আয়োজন। আয়নাকে অনেকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় সমুদ্র।
লাইভ মিউজিক চলছিলো। অনেক কাপল আবার ডান্সও করছে। শুধুমাত্র এডাল্টরা থাকায় ওপেনলি অনেক কিছুই হচ্ছে। তারা দু’জন পাশাপাশি বসে লাইভ মিউজিক উপভোগ করছে। দু’জন ব্ল্যাক পরায় মানাচ্ছিল বেশ। ফটোগ্রাফার এসে ছবিও তুলে ওদের। ওইসময় সমুদ্র হাসি-হাসি মুখ করে ওর কোমড়ে হাত রেখে কী অমায়িক পোস দেয়।
এক ভদ্রমহিলা, সমুদ্রের পরিচিত কেউ হবে হয়তো, উনি এসে বলে, ” এই যে লাভবার্ডস, তোমরা যাও রোমান্টিক ড্যান্স কর। বসে আছো কেন?”

সমুদ্র ওনার কথায় হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে আয়নাকে প্রশ্ন করে, ” মে আই, ম্যাডাম?”
আয়না একটু হতভম্ব হয়, তবে অদ্ভুত এক ভালোলাগা খেলে যায়। সে হাত এগিয়ে দিতেই, উনি ধরে ফেলে, এগিয়ে নিয়ে চলে, লাইভ মিউজিক এর স্টেজের সামনে। ওদের দিকে ফোকাস লাইট জ্বলে। গায়ক গান পরিবর্তন করে, নতুন করে গিটারে সুর তুলে গায়,
“I would never fall in love again until I found her.”
মিষ্টি সুর ভেসে আসে। সমুদ্র ওর কোমড় ধরে, আয়নার একটা হাত নিজের কাঁধে রেখে, আরেকটা হাত নিজের অন্য হাতে হাত রেখে, একটু দুলে। আয়না নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু সমুদ্র ওকেই দেখে যায়।

“I would never fall unless it’s you I fall into”
I was lost within the darkness, but then I found her, I found you.”
লাইন দু’টো শেষ হওয়ার আগে আকষ্মিক সমুদ্র ওকে হেলিয়ে নিয়ে ধরে নিজে একটু হেলে দাঁড়ায়। দু’জন অতি নিকটে চলে যায়। তবে, একজন আরেকজনের হৃদয়ের খবর শুনতে পায় না৷
কে জানে? কবে ঠিক ততোখানি দূরত্বে পৌঁছাবে তারা, যেখানে পৌঁছালে একে অপরের হৃদয়ের খবর বিনা চিঠি লিখেই পড়ে ফেলা যায়৷

হাত তালির আওতাজে ওরা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। স্টেজ থেকে ফিরে, টেবিলে বসে টুকটাক কথা বলছিলো। সারাদিনে মাত্র একটু হাসলো আয়না। টেবিলে খাবার পরিবেশন করার আগ মুহূর্তে, সমুদ্রের ফোনে একটানা কল আসতে থাকে। আয়না বিরক্ত হয়ে যায়। এরপর বলে, ” রিসিভ করে কথা বলুন।”
লাইভ মিউজিক চলছিলো বিধায় সে সরে করিডোরে চলে যায়৷ এদিকে ফুড সার্ভ করা হচ্ছিলো।
সমুদ্র একটু পর বিরস মুখে এসে বলে, ” আয়না, আমাকে একটু অফিস যেতে হবে। খুব দরকার।”
আয়না হতবিহ্বল হয়ে তার পানে তাকালে, উনি চেহারায় অনুতপ্ততা এনে বলে, ” জানতাম না এমন হবে। আসলে ঝামেলা বলে-কয়ে তো আসে না। এম স’র‍্যি।”

আয়নার প্লেটে একগাদা খাবার তুলে দিয়ে বলে, ” তুমি খাও। শায়লা আন্টি আর বাবা রাস্তায়।ওনারা আসছেন। এই টেবিলেই বসবে। আমি তাহলে যাই।”
সমুদ্র হনহনিয়ে বেরিয়ে যায় অনুষ্ঠান থেকে। ও একবারও পিছনে ফিরে আয়নার বিষাদ ভরা চেহারা দেখেনি।
আধ ঘণ্টা বাদে অবশ্য ফাহাদ সাহেব এলেন শায়লাকে নিয়ে। ওরা একই টেবিলে বসে। কিন্তু আয়না একদম চুপচাপ, কেমন উদাসীন থাকে। খাবারও খায় না। পার্টি শেষ করে ফাহাদ সাহেবের গাড়ি করে আয়নাকে বাসায় নামাতে যায়। শায়লা আর আয়না পিছনে বসে। ওর ফোনে বারবার সমুদ্রের কল আসে কিন্তু রিসিভ করেনা। পরবর্তীতে শায়লা চৌধুরীর ফোনে কল আসে সমুদ্র।
ফাহাদ সাহেব জিজ্ঞেস করলো, ” আয়ু মা, কি হয়েছে তোমার? ”

আয়না জবাব দেয় না। ঠায় জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।
শায়লা নিজ থেকে আয়নার কানে নিজের ফোন গুঁজে দেয় এবং বলে, ” যার জন্য উদাস হয়ে মুখ ফুলিয়ে বসে আছো। সে লাইনে আছে৷ কথা বলো।”
সমুদ্র লাইনের ও’প্রান্ত থেকে একটানা অনেককিছুই বলে কিন্তু আয়না প্রত্যত্তর করে না।
সোয়া বারোটায় সমুদ্রের বাসার গেইটে নামিয়ে দিয়ে, ফাহাদ সাহেব লিফট অব্দি আয়নাকে উঠিয়ে দিলেন। উনি অনেক চেষ্টা করে কথা বলার কিন্তু আয়নার বাবার উপর তীব্র রাগের তোপে সে হেরে যায়৷

বাসায় ফিরে আসতেই দেখে সমুদ্রও অফিস থেকে মাত্র এসে ডিভানে বসেছে। আয়নার ভীষণ রাগ-ক্ষোভ জমে ছিলো। সে গটগট করে রুমে ঢুকে পড়ে। সমুদ্র কিছু বলছিল ওকে, যা শোনার প্রয়োজন বোধ করলো না।
রুমে এসেই সর্বপ্রথম আয়না তার হ্যান্ডব্যাগ ছু’ড়ে মারে, তখনই সমুদ্র রুমে আসে। এরপর একটা খুব বাজে ঘটনা ঘটায় আয়না, যেটা সমুদ্রের মনে রিরুপ প্রভাব ফেলে। ও রাগের বশে আজকের গিফট দেওয়া ডায়মণ্ডের চেইনটা ছু্ঁ’ড়ে ফেলে দেয় সমুদ্রের পায়ের তলায়।
সে অদ্ভুত চোখে আয়নার এ’রুপ দেখে। ওরও রাগ উঠলো। সারাদিন এতো প্রেশারে থেকেও গিফট এনেছে।
বলে উঠে, ” কি করলে এটা?”

–” আপনার জিনিস আমার লাগবে না। আপনি প্লিজ অফিসে যান।”
–” ফালতু বকো না।”
আয়না তেজি কর্কশ গলায় বলে, ” সমুদ্র, আপনার আসলে আমার জন্য, আমাদের সম্পর্কের জন্য পার্সোনাল কোনো সময় নেই। অবসর পেলে আসেন, সময় কাটাতে। আমি নিশ্চয়ই আপনার অবসর নই।”
সমুদ্র ভ্রু কুচকে বলে, ” রেগে আছো! স’র‍্যি বলছি তো।”
কিন্তু আয়না দমে থাকে না। চিল্লাতে থাকে। ঝগড়া শুরু হয় তাদের মধ্যে। কথার পীঠে কথা দিয়ে একে-অপরকে দমাতে চাইছিলো।

আয়না বলে, ” এই সম্পর্কের আসলে কোনো নাম নেই।পুরুষ মানুষ এর চেয়ে বেশি র–ক্ষিতাকেও সময় দেয়। আপনার কোথাও আমি নেই। আপনার জীবনে আমার কোনো ইম্পোর্টেন্স নেই। আগাছার মতো আমি।”
সমুদ্রর কপালের রগ ফুলে উঠে রাগে। সে চেচিয়ে উঠে বলে, ” শাট আপ, আয়না।”
ভীষণ জোড়ে চিৎকার দিয়ে কথাটা বলায় ভয়ে কেপে উঠে ডুকরে কেঁদে ফেলে ও। তবে সমুদ্র তোয়াক্কা করে না। শুধু বলে, ” নিজের দোষে অশান্তি বাড়াচ্ছো। সামান্য ম্যাটারে এতো রিয়্যাক্ট কেন করছো? মানুষের কাজ পড়ে যেতেই পারে।”
আয়না কঠোর গলায় বলে, ” অফিস আওয়ারের পর কীসের কাজ আপনার? তাও প্রতিদিন! ”

–” আই ডোন্ট নো, তুমি কী মিনিং করে কি না কি বলছো? তুমি আমাকে অবিশ্বাস করছো?”
–” হ্যাঁ।”
–” দ্যাটস ক্রেজি।”
–” আপনি আসলে আমাকে ভালোবাসেন না তাই না?”
–” এখানে ভালোবাসা কোথা থেকে আসলো?”
–” বিশ্বাসের সঙ্গেই ভালোবাসা জড়িত।”

আয়না উঠে এসে ওর কলার চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ” শুধু শুধু বিয়ে করে আমাকে এতো মানসিক কষ্ট কেন দিচ্ছেন? এরচেয়ে শারীরিক আ ঘাতেও কম কষ্ট। আমার সঙ্গে বনিবনা নাহলে ছেড়ে দিলেই পারেন।”
সমুদ্র অগ্নিচক্ষু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ” তুমি তো বিয়ের সাত দিন পর থেকেই তালাক চাও। সাত দিন না যাইতেই বাবার কাছে তালাক নিয়ে আলোচনা করো। তুমি পারবেও না সংসার করতে। স্বামী-সংসারে পবিত্র থাকার মনোভাবই তোমার নাই। তোমার মধ্যেই দোষ আছে। নিশ্চয়ই ভার্সিটির কোনো ছেলের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক আছে, তাই না? রঙ্গন আহমেদ ওর সাথে রিলেশন ছিলো না? তোমার কি মনে হয় আমি কোনোকিছুরই খোঁজ রাখি না? তুমি নিজে ঠিক নাই, আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাও। তোমরা, সব মেয়ে ছলনাময়ী। নারী স্পর্শ-ই জীবনের যতো অশান্তির মূল।”

আয়না দু’কদম পিছিয়ে গিয়ে বলে, ” আপনি নিজেকে নির্দোষ রাখতে মিথ্যাও বলা শুরু করলেন?”
–” ডিভোর্স তোমার চাই, আয়না। তাও বিয়ের সাত দিনের মাথায়। এ সম্পর্ক কেবল আমার জোড়েই টিকে আছে। তুমি তো কবেই বাঁধন আলগা করে চলে গেছো।”

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৩১

আয়নার চোখের কান্নার বাঁধ ভাঙ্গে। ওর চরিত্র নিয়ে, অন্যকারো সাথে জড়িয়ে অপবাদ দেওয়ায় ও সহ্য করতে পারে না। ফ্লোরে বসে কেঁদে ফেলে। সবকিছু অসহ্য লাগে তার। সমুদ্রের কী ওর প্রতি একবিন্দু মায়া হয় না?

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৩৩