ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৫
Arishan Nur
— ” ঠকাচ্ছো নাতো ওকে?”
সমুদ্র পরখ করে দেখলো একবার মিসেস ইভানাকে। নিজেকে যথেষ্ট বিবেচক ভাবে সে। তবুও এ প্রশ্নের উত্তর দিতে যেন সময় নেয় সে। আসলে, প্রকৃতপক্ষে, প্রতারণার সংজ্ঞা কি?
সে থেমে থেমে বলে উঠে, ” সত্য গোপন করা প্রতারণার মধ্যে পরে না। ওর অধিকার তো ক্ষুন্ন করছি না।”
–” ও কিছুই জানবে না।”
–” না। আমি একবিন্দু পরিমাণও কিচ্ছুটি বলব না।”
মিসেস ইভানা আরোও কিছু বলতেন বুঝি কিন্তু তার আগেই সমুদ্র ফোন অন করে শুধু ঘড়ি দেখে নিয়ে ভ্রু কুচকালো তবে কিছু বললো না।
–” কি হলো আব্বু?”
–” সাত মিনিট হয়ে গেলো৷ এখনো আসছে না।”
–” আসবে। ওয়াশরুমে গেছে৷”
সমুদ্র ঠাণ্ডা পানিতে চুমুক দিয়ে বলে, “ব্যবসা-বাণিজ্যিক কাজ খুবই প্যারাদায়ক। আর ভালো লাগছে না। সবদিক থেকে চাপে থাকি। ”
মিসেস ইভানা হাল্কা হেসে বলে, ” আমরা আছি তো তোমার সাথে। সবধরনের সহযোগিতা যেকোনো সময় তুমি পাবে৷ রিল্যাক্স।”
সমুদ্র উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ” একটু আসছি।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মিসেস ইভানা প্রথমে ঠাওর করতে পারলেন না, পরবর্তীতে সমুদ্রকে রেস্তোরাঁর শেষ কোণায় যেতে দেখে মুচকি হেসে বলে, ” আটটা মিনিট মাত্র ওকে না দেখতেই অস্থির হচ্ছো! তুই ব্যাটা বউ পাগল ছেলে হবি।”
সমুদ্র আউটডোর সাইড চেক করে এসে লেডিস ওয়াশরুমের সামনে দাঁড়িয়ে উসখুস করছে৷ কি করবে সে? আয়না রেস্তোরাঁর অন্যকোথাও নেই৷ এক্সিট ডোর সমুদ্রের চক্ষুর সম্মুখে ছিল। ও যে রেস্তোরাঁ ত্যাগ করে অন্যকোথাও যায়নি এটা সিউর সে। মেয়েটা বাকি স্পটেও নেই। ফোনও টেবিলে রেখে গেছে। তাহলে ওয়াশরুম ছাড়া অন্যকোথাও তো হওয়া লজিক্যাল না। এতোক্ষণেও বের হচ্ছে না কেন? সে লেডিস ওয়াশরুমের সামনে থেকে এক কদম পেছাতেই আচানক মনে হলো, ওয়াশরুমের ভেতর থেকে কারোও দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ কানে আসছে৷ সেকেন্ডের মধ্যে মস্তিষ্ক খুব দ্রুত কিছুর আভাস পায়। সে দিক-বেদিক না ভেবে লেডিস ওয়াশরুমের ভেতর ঢুকে পড়ে৷ ওয়াশরুম সম্পূর্ণ ফাঁকা পড়ে আছে। তবে প্রথম সাড়ির দ্বিতীয় ওয়াশরুমের দরজা নড়ছে। ধাক্কানোর আওয়াজ আসছে। সে দ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠে, ” আয়না তুমি ভেতরে?”
এক সেকেন্ডের মধ্যে আয়নার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। সে ভেতর থেকে বললো, ” স্যার, আমি ভেতর থেকে লক হয়ে গেছি। ছিটকিনিতে মনে হয় সমস্যা। কোনোভাবেই ছিটকিনি খুলা যাচ্ছে না।”
সমুদ্র যেন কিছুটা শান্ত হলো। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ও বারবার ওয়াশরুমে দেরি হওয়া নিয়ে এমন কিছুই সংকেত পাঠাচ্ছিলো। সে কিছু বলবে তার আগেই একজন রেস্টুরেন্টের ফিমেল স্টাফ ভেতরে এসে সমুদ্রকে দেখে এক প্রকার চিৎকার দিয়ে বলে, ” এক্সকিউজ মি, স্যার এটা লেডিস ওয়াশরুম। আপনি এখানে কী করছেন? প্লিজ বাইরে যান। আমাদের রেস্তোরাঁর সিস্টেম অনুযায়ী কোনো পুরুষ লেডিস ওয়াশরুমে থাকতে পারবে না। কোনোধরনের অবৈধ কাজ করা এলাউ না।বের হন। ”
সমুদ্রের যেন রাগে মেজাজ খারাপ হয়ে আসে। সে ভীষণ জোড়ে ধমক দিয়ে বলে উঠে, ” আমি ফা—– ক ইউর সিস্টেম। আমার বউ ওয়াশরুমের ভেতরে আটকা পড়েছে। আর আপনি আমাকে সিস্টেম শেখাচ্ছেন?”
কথাগুলো বলে দরজার গায়ে জোড়ে পা দিয়ে লা–থি মারে সে।
সমুদ্র এতো জোরে চিৎকার করে কথা গুলো বলছিল যে ভেতর থেকে কেবল আয়নাই নয় বরং বাইরে থেকে মানুষ সব শুনে ফেলেছে। আয়নার ভারী অদ্ভুত অনুভূতি হয়। উনি তাকে নিয়ে এতোটা কনসার্ন? এতোটা ভাবেন উনি?
মহিলাটাও বেশ ভড়কে যায়, এতো জোড়ে চিৎকারে সে ভয়ও পায় বোধহয়। চেচামেচির আওয়াজে সব স্টাফরা ভেতরে আসে।
সমুদ্র বলে, ” দ্রুত আপনাদের টেকনিক্যাল স্টাফদের ডেকে দরজা খোলার ব্যবস্থা করেন এক মিনিটের মধ্যে । নাহলে আমি পুরা রেস্টুরেন্ট ভেঙে ফেলবো।”
ইতিমধ্যেই জানাজানি হয়ে গেছে সারা রেস্তোরাঁয় যে লেডিস ওয়াশরুমের ভেতর একটা মেয়ে আটকা পড়েছে। ওনার হ্যাসবেন্ড ভীষণ প্যানিকড করছেন। দ্রুত দরজা ভেঙে খুলে দেওয়া হলো। ম্যানেজার এসে ক্ষমা ও দুঃখ প্রকাশ করলো। ওদের নাকি দরজায় ক্রুটি ছিল কিন্তু বুঝতে পারেনি জন্য এমন অসুবিধে হলো।
আয়না সমুদ্রের রাগ দেখে বেশ অবাক হয়। তাকে উদ্ধার করে বের করার পর শুধু জিজ্ঞেস করলো, ” ঠিক আছো?”
আয়না মাথা নাড়ালো। সমুদ্র এক বোতল পানি এগিয়ে দেয় তাকে। আয়না বোতলে চুমুক দিয়ে রেস্টুরেন্টের বাইরে বের হলো। তাকে ঘিরে এতো জটলা পছন্দ হচ্ছিলো না। সমুদ্র বিল মিটিয়ে ইভানার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালো।
আয়না রেস্টুরেন্টের বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। তখন কেবল বেলা ডুবছে। রাস্তায় কমলা রঙের রোদ এসে আঁছড়ে পড়ছিলো। মিহি স্নিগ্ধ বাতাস বইছে।কালো পিচঢাকা রাস্তায় সাইসাই করে প্রাইভেট কার ছুটে যাচ্ছে। সে অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
সমুদ্র তার কাছে গিয়ে সুধালো, ” বাসায় যাবে এখন?”
আয়না অন্যমনস্কতা দূরীকরণ করে বললো, ” হ্যাঁ, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
–” চল, তোমাকে নামিয়ে দেই।”
–” না, না আমি একা যেতে পারবো।”
সমুদ্র ওর ফোন, ওর হাতে দিয়ে, তার কথাটাকে বিন্দুমাত্র দাম না দিয়ে বললো, ” গাড়ি নিয়ে আসছি লট থেকে। দাঁড়াও এখানে।”
সমুদ্র যেতেই ইভানাও বের হয়। আয়নাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ” তোমাকে নিয়ে সমুদ্র চিন্তা করছিল। এই দুর্ঘটনা কিভাবে ঘটলো? সাবধানে থাকবে কেমন? বিয়ের আগে মেয়েদের বেশি বের না হওয়াই ভালো। খারাপ শক্তির নজর বেশি লাগে৷”
ওনার মতো স্মার্ট শিক্ষিত মহিলার মুখে এমন কুসংস্কারমূলক কথা শুনে আয়না খানিক চমকায়। পরে মনে পড়লো, বাঙ্গালী নারী স্পেসস্যুট পড়ে চাঁদে গেলেও সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরতে চাইবে! কারণ ওদের মতে, সন্ধ্যার সময় মেয়েদের অশনি শক্তি নজর দেয়।
আয়না বলে উঠে, ” আপনি বিয়েতে আসবেন কিন্তু! ”
–” তোমাদের বিয়ে নিয়ে আমি খুব এক্সাইটেড। সমুদ্রের জন্য খুব খুশি আমি। তোমার মতো একটা সুইট মেয়ে স্ত্রী হিসেবে পাওয়া পরম সৌভাগ্য। অবশ্যই আসব, মা।”
সমুদ্র গাড়ি নিয়ে আসলে আয়না ফ্রন্ট সীটে বসলো। সে তাদের মধ্যকার সম্পর্কের কোনোরুপ বিরুপ ধারণা দিতে চায় না মিসেস ইভানাকে। আয়না বসতেই সমুদ্র গাড়ি টান মারলো।
–” আপনি রেগে আছেন?”
–” না।”
–” রাগার মতো কিছু হয়নি। তাছাড়া ওয়াশরুমেই আটকা পড়েছিলাম। ক্ষতি হওয়ার মতোন কিছু ঘটেনি৷ মরতে তো আর ধরিনি।”
সমুদ্র তৎক্ষনাত গাড়ি জোরে ব্রেক কষে। আয়নার মনে হচ্ছিলো নিশ্চয়ই এক্সিডেন্ট করবে এই লোক। ওনার গাড়িতে উঠতে এইজন্য ভয় লাগে। কখন দুর্ঘটনা ঘটায়!
–” কি হলো?”
–” সীটবেল্ট পড়োনি।”
আয়নার খেয়াল হয় সে সীটবেল লাগায়নি, এজন্য এতো জোরে কেউ হার্ড ব্রেক কষে? ওনাকে কে যে লাইসেন্স দিয়েছে গাড়ি চালানোর?
আয়না সীটবেল্ট টেনে আনতে ধরলে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হলো। সমুদ্র একটু তার দিকে এগিয়ে এসে বেল্ট টেনে, লাগিয়ে দিয়ে বললো, ” মৃত্যুর কথা মুখে আনবে না আর কোনদিন।”
আয়না এবারে ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। ওই যে কেমন অদ্ভুত পারফিউমটার গন্ধ নাকে এসে লাগলো। নীলচে চোখের দিকে তাকাতেই কেমন মন ব্যাকুল করা নাম না জানা অনুভুতি হতে লাগলো তার। মানসপটে ওনার রেগে চিৎকার দিয়ে ‘আমার বউ’ শব্দটা ভেসে উঠতেই ফোলা গাল দুটো টমেটোর মতো লাল হয়ে উঠে। হুট করে সবকিছুই খুব ভালো লাগতে লাগলো। এইযে সূর্য ডুবতে থাকা, আকাশের কমলা বর্ণ ধারন করা, পাখিদের আকাশে তাড়াহুড়ো করে নীড়ে ফেরার ব্যস্ততা! সবকিছুই আজ ভিন্ন লাগছে তার? তবে কি আজ বিশেষ কিছু হয়েছে? কি হয়েছে? উম্ম…. নাম না জানা, একদম অজানা, কেবল সাহিত্যে পড়া এক অন্যরকম ভাসমান অনুভূতির সঙ্গে সবে পরিচয় হলো তার! কি সেই ভাসমান অনুভূতি? নাম কি তার? আয়না এর উত্তর জানে কিন্তু মানতে চায় নাহ। কোনোভাবেই চায় না। ওমন দুঃসাহসিক অনুভূতির সম্মুখীন হওয়ার শক্তি নেই তার।
সমুদ্র আজ একদম বাসার সামনে এসে গাড়ি থামায়। আয়না নামতে চাইলে নিজে থেকে সে বলে উঠে, ” শুনো, আমাকে স্যার বলে ডাকার প্রয়োজন নেই। আজকে থেকে আরোও প্রয়োজন নেই।”
আয়না নেমে দরজা লাগাতে লাগাতে বললো, ” স্যার, আমাদের বাসায় আসেন, আপনি আসলে বাবা খুশি হবে৷ ”
সমুদ্র একটা কড়া নজর ছুঁড়লো তার দিকে। তবুও আয়না ফের বললো, ” আসি স্যার। আসসালামু আলাইকুম, স্যার।”
–” ওয়ালাইকুম আসসালাম। ”
সমুদ্র গাড়ি ঘুরাতে ঘুরাতে ভাবে, আম্মু বলে, সে নাকি ভীষণ ঘাড়ত্যাড়া। কিন্তু আয়না যে তার চেয়েও দুই ধাপ এগিয়ে ঘাড়ত্যাড়ামিতে এটা আম্মু জানে না। জানলে নিশ্চয়ই দুই ঘাড়ত্যাড়াকে একছাদের নিচে রাখার বুদ্ধি করতেন না একদম!
আয়না বাসায় আসলো। আজ ওর দাদা-দাদী এসেছে বড়চাচার বাসা থেকে। দাদা-দাদী তাদের সঙ্গেই থাকেন৷ কিন্তু কয়েকমাস ধরে কি যেন হলো? বড়চাচা দাদা-দাদীকে নিজের সঙ্গে রাখছেন। এতোবছর তাদের খোঁজও নিত না, এখন হুট করে এতো দরদ যে তাদের সঙ্গে থাকতে ই দিচ্ছে না। আয়নার খটকা লাগে। হচ্ছেটা কি?
সে আসতেই বারান্দা থেকে মিউমিউ শব্দ তুলে তার আদরের বিড়াল মিলি দৌঁড়ে এসে তার পায়ে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল। মিউমিউ শব্দ তুলে আদর চাইছে সে। আয়না তাকে কোলে তুলে নিল। তার বিড়াল খুব পছন্দ। একবার কোন কে-ড্রামা দেখে এমন বিড়ালের আবদার বাবার কাছে করেছিল, বাবাও বিষয়টা সিরিয়াসি নিয়ে নেন। এইজন্য বাবা বিদেশ থেকে, স্পেশালি ফোস্টার হোম থেকে, তাকে এই পার্সিয়ান ক্যাটটা পেট হিসেবে পালার জন্য দিয়েছে। আয়না তাদের বাসার সাহায্যকর্মী হালিমাকে ডাকে। হালিমা বুয়া অনেকদিন ধরেই তাদের বাসায় আছে৷
আয়না বলে উঠে, ” খালা, আপনি মিলির জন্য মাছ সেদ্ধ করেছেন?”
–” হ্যাঁ, আপামনি।”
–” ওকে ঠিকমতো খাইয়েছেন আজ?”
–” তিন বেলা এই ভোটকা বিড়ালটারে খাওয়াইছি আপামনি৷ দুইবার পটিও করছে। সব ধুয়ে সাফ করে রাখছি।”
–” ওর মাছটা আনেন। আমি এখন খাইয়ে দেই। আর হ্যাঁ, মিলিকে একদম ভোটকা বলবেন না। ওর নাম ধরে ডাকবেন।”
হালিমা খালা যেতে যেতে বকতে লাগলেন, ” গরীব মানুষ মাছ খাইতে পারে না, আবার বড়লোকরা বিলাইকেই তিনবেলা মাছখাওয়ায় ভোটকা বানায়!”
আয়না যখন মিলিকে মাছ খেতে দিচ্ছিলো, ওইসময় ফাহাদ সাহেব এসে মেয়ের পাশে বসলেন। এরপর বলে উঠে, ” শুধু বিড়ালকে মাছ খাওয়ালে হবে? নিজেকে ও মাছ খেতে হবে৷”
আয়না অসহায় মুখ করে বলে, ” মাছ খেতে একদম ভালো লাগে না, বাবা৷”
উনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ” দাদাভাই আসার সময় বড় ইলিশ এনেছে। পদ্মার ইলিশ। সরিষা দিয়ে রান্না করা হয়েছে। ইলিশের ঘ্রাণে বাসা মো মো করছে। খুব টেস্ট হবে কিন্তু। আমি খাইয়ে দিচ্ছি?”
আয়না বুঝলো বাসায় যে আশটে গন্ধ হচ্ছে ওটা ইলিশ মাছের। সে বলে উঠে, ” বাবা প্লিজ না। তুমি খাও।”
–” আমার মেয়েরা না খেলে আমার ও খেতে ইচ্ছা হয় না।”
বাবার জন্য হলেও আয়নার ইলিশ অপছন্দ হওয়া সত্তেও খেতে বসে। সবাই মিলে খেতে বসেছে৷ অনেকদিন পর বাসায় এই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। দাদা-দাদি এসে বসলেন। আলিয়াও এসে বসেছে৷ ফাহাদ সাহেব মাছের কাঁটা বেছে আয়নার প্লেটে তুলে দিচ্ছেন। আয়না বাধ্য মেয়ের মতো খেয়ে নেয়।
আয়না-আলিয়া খাওয়া শেষ করে ভিডিও কল নিয়ে ব্যস্ত হয়৷ পিউ– সমুদ্রের বোনের সঙ্গে অনলাইন শপিং নিয়ে আলোচনা করবে। ফাহাদ সাহেবের এসবে আগ্রহ নেই। সে তার বাবা-মায়ের সাথে ড্রয়িং রুমে বসলেন। তার বাবা-মায়ের বার্ধক্য বয়স চলছে। অসুস্থতা লেগেই আছে। তবে তারা আয়নার বিয়েতে খুব খুশি।
তার বাবা বলে উঠে, ” তোমার ভাই মনে হয় বিয়েতে আসবে না।”
–” শুনেছি, আব্বা।”
আয়নার দাদা বলে উঠে, ” ওরা চাচ্ছিলো পিয়াশের সঙ্গে আয়নার বিয়ে হোক। কিন্তু বাবা তুমি তো অন্যকোথাও বিয়ে ঠিক করলে।”
ফাহাদ সাহেব বলেন, ” আমার মেয়ের জন্য সমুদ্রের মতো ছেলেই খুঁজছিলাম। বিয়ে তো সৃষ্টিকর্তার আদেশে হয়। আমাদের কারো কোনো হাত নেই এতে৷ আমরা উসিলা মাত্র। আমার মেয়ের সমুদ্রের সঙ্গে জোড়া লিখা ছিল। এইজন্য বিয়েটা হচ্ছে। পিয়াশের সঙ্গে ওর জোড়া লেখে নি জন্য পিয়াশের সঙ্গে হচ্ছে না।”
সমুদ্র আজ সাতটার মধ্যে বাসায় ফিরেছে। ইদানীং দেরি করছে না। মা কড়া আদেশ জারি করেছে, বিয়ের আগ অব্দি সাতটার আগেই বাসায় ঢুকতে হবে। যথা আজ্ঞা তার মায়ের আদেশ পালন করছে। ফ্রেশ হয়ে, গোসল সেড়ে নিজের রুম থেকে বের হলো। ডাইনিং এ আসতেই মা আর ছোটবোন পিউয়ের হাসির আওয়াজে সে ড্রয়িংরুমে পা রাখে। ওদের দুইজনকে একসঙ্গে হাসতে দেখে সে শান্তি অনুভব করে। বাসার সদস্যরা হাসি-খুশি থাকলে, বোঝা কাঁধ থেকে নামে। অনুতপ্ততা কমে।
সে এগিয়ে গিয়ে বললো, আম্মু, নতুন প্রোজেক্টটা নিয়ে একটু ডিসকাশন করার ছিল। আমাকে একটু সাহায্য করো।”
মিসেস রোদেলা বকা দেওয়ার ভঙ্গিমায় তার দিকে তাকিয়ে বলে, ” ওরে আমার ব্যবসায়ী পুত্র রে! কাজ-টাজ অনেক করেছিস। আজ থেকে সব বাদ। অনেক ব্যবসা দেখেছিস। কালকে থেকে আর অফিস যাবি না।”
–” শুক্রবার আসতে অনেক দেরি। কাল তো ফরেন ক্লাইন্টদের সঙ্গে স্পেশাল মিটিং আছে।”
রোদেলা বলে, ” বস তুই বাপ। এতো কাজ করার দরকার নেই।”
সমুদ্র বসলো। তার মা বলে উঠে, ” তোর জন্য শেরওয়ানি দেখছি। দেখ কোনটা পছন্দ হয়।”
–” তুমি-ই চুজ করো। তোমার পছন্দ বেশি ভালো।”
মিসেস রোদেলা একগাল হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলেন। আজ সে অনেক খুশি। ছয়মাস পর আজকে তার স্বামী আবেগের হেলথ রিপোর্ট ভালো এসেছে। নেগেটিভ কিছু নেই রিপোর্টে।
পিউ বলে উঠে, ” ভাইয়া, ভাবীর জন্য কি দেখবো? ভাবীকে কিন্তু তুমিই বিয়ের ব্রাইডাল আউটফিট দিবে। তোমার কোনো সাজেশন আছে? এনি রিকোয়েরমেন্ট ওর ডিমান্ড ?”
সমুদ্র জীবনের কোনো এক খণ্ডাংশে কল্পনা করেছিল তার নববধূবেশে লাল শাড়ি পরিহিতা কেউ একজন থাকবে। একবার ভাবলো এই শখের কথা বলবে না। দরকার কী শখ পূরণের? এতো শখ পুষে হয়টা কি? যদি শখের মানুষই না রয়?
তবুও বলে ফেলে, ” ওর জন্য লাল ব্রাইডাল কাতান শাড়ি দেখ পারলে । ”
পিউ ভাইয়ের মুখ এমন কথা শুনে সাথে সাথে ফোন ঘুরিয়ে সমুদ্রের সামনে আনে। সমুদ্র কোনোদিন ভাবেও নি পিউ ভিডিও কলে আয়নার সঙ্গে কানেক্টেড ছিলো। কেমন অস্বস্তি লাগলো তার। আয়না ভিডিও কলে আছে জানলে সে কোনোদিন নিজের শখখানার কথা বলত না।
পিউ মায়ের সামনেই বলতে লাগে, ” ওর জন্য কাতান লাল শাড়িইই।”
যতোই মডার্ণ কালচারে লাইফ লিড করুক না কেন, বাঙ্গালী ছেলেরা মায়ের সামনে এমন পরিস্থিতিতে পড়লে লজ্জা পায়৷ নাজুক অবস্থা হয়৷ সমুদ্র সামান্য ভ্যাবাচেকা খেয়ে এদিক-ওদিক করে চোখ নিচু করে।
পিউ বলতে থাকে, ” এই ভাইয়ায়া, আর ইউ ব্লাসিং? হু? হু?”
সমুদ্র থেমে থেমে বলে, ” ব্লাসিং? ফর হোয়াট? এন্ড হুয়াই? আয়া নট এট অল।”
পিউ তার গালের দিকে ইঙ্গিত করে বলে, ” দেখো, দেখো তোমার গাল লাল হয়ে গেছে।” এরপর আয়নাকে ইশারা করে বলে, ” তাই না ভাবী?”
ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৪
মিসেস রোদেলা হাসছিলেন ওদের এসব কান্ড দেখে।
সমুদ্রের দশা নাজুক হলেও প্রকাশ না করে, তেজি গলায় বলে, ” গাল লাল হয় এলার্জি হলে। আমার মনে হয় এলার্জির সমস্যা দেখা দিচ্ছে।”
ফোনের স্ক্রিন থেকে আয়নার অট্টহাসির আওয়াজ পাওয়া গেল। সমুদ্র সব লজ্জা ভুলে সরাসরি ভিডিও কলের স্ক্রিনের দিকে তাকায়।