উত্তল তরঙ্গ পর্ব ১৩

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ১৩
দিশা মনি

নেহা নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে ছিল। তার মেয়ে এখনো অনেক ছোট, একদম তার কাছছাড়া হতে চায় না। এতটুকুনি একটা মেয়েকে ফেলে একা কোথাও কাজে যাওয়ায় সম্ভব না নেহার পক্ষে। তাই আপাতত কোন কাজে যোগ দেয় নি সে। কিছু সময় পর দৃঢ়তা তার ৫ বছর বয়সী ছেলে তাজিবকে কোলে নিয়ে এলো। সে এসেই সহাস্যে বলল,
“কি ব্যাপার নেহা? তোমার মেয়ে তো দেখছি ভীষণ শান্ত। এসেছে থেকে সেভাবে কাঁদতে দেখি নি।”
নেহা বলে,

“হয়তো ও জানে ওর মায়ের পরিস্থিতি কতোটা কঠিন, তাই শুরু থেকে সেই পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে চাচ্ছে।”
“তোমাকেও শক্ত হতে হবে নেহা। নিজের জন্য না হলেও নিজের মেয়ের জন্য। এই সমাজে একা ঠিকে থাকা অনেক কঠিন। তোমাকে নিজের মেয়েকে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে হবে।”
নেহা এবার মাথা একটু নত করে বলে,
“এতটুকু বাচ্চাকে নিয়ে তো এখন আমি কোন কাজ করতে পারব না আপু..কিন্তু এভাবে আর কতদিন আপনার দয়ায় থাকব।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ধুর পাগলি। এসব নিয়ে ভেবো না। তোমার মেয়ে আরেকটু বড় হোক, তারপর তুমি জব করো৷ আমি অনেক ভালো কোন অফিসে তোমার জবের ব্যবস্থা করে দেব। তোমার তো ভার্সিটি লাইফে সিজিপিএ অনেক ভালো ছিল তাই এই নিয়ে বেশি বড় কোন সমস্যা হবে না৷ আর তুমি এখন নিজেকে আমার ছোট বোন ভাবতে পারো তাই নিঃসংকোচে এখানে থাকো।”
নেহা আবেগপ্রবণ হয়ে দৃঢ়তাকে জড়িয়ে ধরে। দৃঢতা নেহাকে আশ্বাস দেয়। এরমধ্যে তাজিব নেহার ছোট্ট মেয়েকে কোলে নিয়ে বলে,
“আম্মু, তোমায় যে আমি বলেছিলাম আমার একটা ছোট বোন লাগবে, ও কি আমার সেই বোন?”
দৃঢ়তা হেসে নিজের ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
“হ্যাঁ, সোনা। ও তোমার বোন। তুমি ওকে পেয়ে খুশি তো?”
তাজিব তো আনন্দে ফেটে পড়ে বলে,

“ভীষণ খুশি আম্মু। ওকে আমি অনেক আদর করব। ওকে অনেক চকলেট, টয় ও ড্রেস কিনে দেব। ওর সাথে খেলব।”
“কিন্তু ও তো এখনো অনেক ছোট।”
“আমি জানি, আমার বোন তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠবে। ওকে আমি অনেক আদরে বড় করব।”
এসব কথা শুনে নেহা আবেগাপ্লুত হয়ে বলে,
“আমার মেয়েটার ভাগ্য অনেক ভালো বাবা, যে ও তোমার মতো এত ভালো একটা বড় ভাই পেল।”
“আপনি কোন চিন্তা করবেন না আন্টি। আমি সবসময় এরকম একটা বোন চেয়েছি। আমি ওকে সবসময় আগলে রাখব।”

নেহার চোখে জল চলে আসে। তবে এ কষ্টের অশ্রু নয়, এ তার আনন্দের অশ্রু। সবসময় তো এরকম একটা সুন্দর জীবনই সে তার মেয়ের জন্য চেয়েছিল। নেহা ভাবে, তার জীবন যেমনই হোক সে তার মেয়েকে একটা সুখের জীবন দেবে। অতীতের কোন কালো ছায়া নিজের মেয়ের উপর পড়তে দেবে না। যখন আপনজনরা পাশে নেই তখন এই অচেনা শহরের মানুষগুলোই যেন তার আপন হয়ে গেল। যাদেরকে নিয়ে সে একটা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখতে পারে।

আরাভ নিজের রুমে এসে মনমরা হয়ে বসে আছে। নেহাকে সে চারিদিকে অনেক খুঁজেছে কিন্তু নেহার কোন খোঁজ পায় নি। ঘরে বসে হালকা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল আরাভ৷ সে জানে, তার লড়াইটা সহজ নয়। নেহা অনেক কষ্ট নিয়ে দূরে চলে গেছে। আপনজনরা যখন কষ্ট দেয় তখন তা মেনে নেয়া কঠিন। আর নেহা তো নিজের সবথেকে খারাপ সময়ে আপনজনদের থেকে কোন সমর্থন পায় নি।
আরাভের ভাবনার মাঝেই বিপাসা চৌধুরী তার রুমে এসে বললেন,
“আরাভ, তুই এসেছিস। আয় বাবা কিছু খেয়ে নে। একেই তোর আব্বুর এই অবস্থা তার উপর তুই এভাবে না খেয়ে থেকে নিজের শরীরটা আর খারাপ করিস না।”
আরাভ বলে ওঠে,

“নাহ, আম্মু। আমার এখন খিদে নেই।”
“এভাবে না খেয়ে থাকলে যে তুই অসুস্থ হয়ে যাবি। দয়া করে খেয়ে নে বাবা। আর তুই তো জানিস, এখন তুই আমার একমাত্র ভরসা। তোর কিছু হয়ে গেলে আমি নিজের অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে কোথায় যাব? এক মুহূর্তেই যে, আমাদের পরিবারটা একদম এলোমেলো হয়ে গেল। না জানি আল্লাহ আমাদের কোন পাপের ফল দিচ্ছেন।”
“নেহার প্রতি করা অন্যায়ের ফল আমরা পাচ্ছি আম্মু!”
“তুই আবার ঐ অপয়টার কথা বলছিস? ওর জন্যই তো আজ এত কিছু।”
“আম্মু, প্লিজ তুমি আর নেহার নামে এরকম কথা বলো না। আমি তা মেনে নিতে পারব না।”
“সত্যিই তো বলছি৷ যাইহোক, তুই খাবার খেয়ে নে। আমি ঘটককে বলে রেখেছি, সামনের মাসেই একটা শুভ দিন দেখে..”

“ঘটক মানে? কি চাইছ তুমি?”
“আমি তোকে এই কষ্টের জীবন থেকে মুক্তি দিতে চাইছি৷ আর কিছু না। ঐ অপয়া মেয়ের স্মৃতি নিয়ে কেন তুই নিজের জীবন কাটাবি? তোর জীবন আবার নতুন করে শুরু কর।”
“না, আম্মু। আমি এই নিয়ে আর কোন কথা শুনব না। নেহাকে অবিশ্বাস না করে আমি যেই ভুল করেছি আবারো সেই একই ভুল কিছুতেই করতে পারব না। প্রয়োজনে নিজের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত নেহার জন্য অপেক্ষা করে যাব ওর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য।”
“আরে ও এখন অন্য কারো বাচ্চার মা.. বুঝছিস না কেন?”
“তাতে আমার কিছু যায় আসে না, আম্মু। আমি শুধু আমার নেহাকে ফেরত চাই।”
বলেই সে নিজের পকেট থেকে বের করে নেহার একটি ছবি দেখে।

নাতাশার দিকে রক্তিম চোখে তাকিয়ে আছে আহির। নাতাশা ভয়ে শিটিয়ে গেছে।
আহির চিৎকার করে বলে,
“তোর সাহস কি করে হলো এই কথা বলার? তোকে আমি নিজের বান্ধবীর থেকে বেশি কিছু ভাবি না। আর তুই এমন কথা বলে আমাদের এই সম্পর্কটাকে নষ্ট করতে চাইছিস?”
“আহির, আমার কথাটা শোন। আমি এত দিন নিজের অনুভূতি লুকিয়ে রেখেছিলাম কিন্তু আর সেটা সম্ভব না। আমি তোকে ভালোবাসি আর..”

নাতাশা নিজের কথা শেষ করতে পারে না তার আগেই আহির ঠাস করে তার গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। নাতাশা অবাক স্বরে বলে,
“তুই আমায় মারলি আহির?”
“হ্যাঁ, মারলাম। এই নিয়ে যদি আবার কথা বাড়াস তাহলে..তুই শুধুই আমার কাছে একজন বন্ধু। এর বেশি কিছু না।”
“নিজের কথা না ভাবিস নিজের মেয়ের কথা ভাব। আমি তোর মেয়ের মা হতে প্রস্তুত।”
“লাগবে না ওর কোন মায়ের। আর তুই যদি এই নিয়ে আর একটা কথা বলিস তাহলে আমাদের মধ্যকার সব সম্পর্ক শেষ।”
নাতাশা দাঁতে দাঁত খিচে বলে,
“বেশ, বলব না আর কিছু। কিন্তু তুই কি সারাজীবন এভাবে একা থাকবি? জীবনে আগাবি না?”
“আমার জীবনের চিন্তা নিশ্চয়ই তোকে করতে হবে না।”
“তুই আবার ঐ নেহাকে জীবনে জড়াতে চাস নাকি। হাজার হোক, তোর সন্তানের মা বলে কথা। একটু মায়া তো থাকবে।”

আহির নাতাশার গলা চেপে ধরে বলে,
“ঐ নেহা আমার কাছে ফেলে দেয়া টিস্যু পেপারের মতো। যাকে তুলে নেয়ার রুচিবোধ আমার নেই। আই উইশ, আমার আর আমার মেয়ের জীবনে ওর ছায়াও কখনো না পড়ুক।”
বলেই সে নাতাশাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। নাতাশা উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“কিন্তু ছায়া তো পড়বেই আহির। তুই ভুলে যাচ্ছিস, তোর আরেক মেয়ে নেহার কাছেই আছে৷ ও যদি কোন দিন ফিরে এসে আহিরাকে তোর কাছ থেকে কেড়ে নিতে চায় তখন কি করবি?”

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ১২

আহির নিজের ঘুমন্ত মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“যদি এমন দিন কখনো আসে তাহলে আমি নেহাকে এই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেব।”
এই উত্তরে যেন এই বঞ্চনার স্বীকার হয়েও নাতাশা বিজয়ীর হাসি হাসে।

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ১৪