উত্তল তরঙ্গ পর্ব ১৪
দিশা মনি
নেহা একদম ফর্মাল ড্রেসআপ করে তৈরি হয়ে নিয়েছে। আজ থেকে নিজের জীবনের নতুন একটা অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছে সে। একদিন খালি হাতে সে এই ঢাকা শহরে এসেছিল। তবে সেই অসহায় নেহার মাঝে অনেক পরিবর্তন এসেছে। মাঝখানে কেটে গেছে ৭ মাস। নেহার মেয়েটা এখন বড় হয়েছে। হাটতে না পাড়লেও হামাগুড়ি দিয়ে চলাফেরা করে। যার ফলে নেহা সিদ্ধান্ত নিয়েছে এটাই সঠিক সময় নিজের ক্যারিয়ারে মন দেয়ার। এভাবে আর কতদিন অন্যের দয়ায় বাঁচবে তারা? এবার তাই নিজে কোন কিছু করার চেষ্টা করলো সে। নেহার একাডেমিক রেজাল্ট অনেক ভালো ছিল,ইংরেজি বলার দক্ষতাসহ তার প্রোগামিং স্কিলও অনেক ভালো ছিল। কেননা, ভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ে সে এসব কিছু শিখে নিয়েছিল। তার উপর দৃঢ়তার সুপারিশ তো ছিলই। এজন্য জবটা পেতে বেশি অসুবিধা হয় নি। জবটাও বেশ ভালো, একটা কর্পোরেট অফিসে জব পেয়েছে সে। মাসিক বেতন ৪০ হাজার টাকা, যা ক্রমান্বয়ে হয়তো বাড়বে। এসব কিছু মিলিয়ে নেহা অতীতের যন্ত্রণা ভুলে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
নেহা যখন তৈরি হচ্ছিল তখনই আনিকা চৌধুরী নেহার মেয়েকে কোলে নিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। নেহার মেয়েটা আধো আধো স্বরে বলে ওঠে,
“আমু..”
নেহা একপলক নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসে। তার মেয়েটা আর আগের মতো কঙ্কালসার নেই। এই কয়দিনে বেশ ভালোই স্বাস্থ্য হয়েছে, দেখতেও অনেক কিউট হয়ে গেছে। আনিকা চৌধুরী নেহার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“দেখো, তোমার মেয়ে নিজের আম্মুর কাছে আসার জন্য কাঁদছিল। তাই ওকে নিয়ে এলাম।”
নেহা আনিকা চৌধুরীর কোল থেকে নিজের মেয়েকে নিজের কোলে নেয়। তার মেয়ের নাম সে রেখেছে “নিয়া”। নিয়াকে কোলে নিয়ে নেহা বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আমার ভালো মেয়ে। তুমি কিন্তু একদম শান্ত বাচ্চা হয়ে থাকবে। কোন দুষ্টামি করবে না। আর নানিকে একদম বেশি জ্বালাবে না।”
ছোট্ট নিয়া কথাগুলো বুঝতে পারে কি না সেটা বোঝা যায় না। সে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। এমনিতে বাচ্চা হিসেবে সে ভীষণ শান্ত, বেশিরভাগ সময় চুপচাপ থাকে। তবে মাঝেমধ্যে হঠাৎ করে কোন কারণে বিরক্ত হলো এতো জোরে কান্না করে যে আশেপাশের সবাই বিরক্ত হয়ে যায়।
এমন সময় তাজিব ছুটে এসে বলে,
“তুমি একদম চিন্তা করো আন্টি। ওর ভাইয়া আছি তো, আমি ওকে সামলে নেব।”
নেহা হেসে বলে,
“তুমি তো নিজেই একটা বাচ্চা, আরেকটা বাচ্চাকে কিভাবে সামলাবে।”
তাজিব ভাব নিয়ে বলে,
“আমাকে আন্ডারএস্টিমেট করো না আন্টি, আমি যেমন তেমন বাচ্চা নই, আমি হলাম সুপার বাচ্চা। আমি সব করতে পারি।”
তাজিবের কথা শুনে আনিকা চৌধুরী ও নেহা দুজনেই হেসে ফেলে। এমন সময় দৃঢ়তা এসে বলে,
“নেহা, তুমি প্রস্তুত তো। জলদি বেরিয়ে পড়ো। আজ অফিসে তোমার প্রথম দিন। আজ লেইট করা ঠিক হবে না।”
নেহা মাথা নাড়িয়ে বলে,
“জ্বি, আপু।”
অতঃপর সে নিয়ার গালে ও কপালে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে নিয়াকে আনিকা চৌধুরীর কোলে তুলে দিয়ে বলে,
“ওকে দেখে রাখবেন আন্টি, আর নিয়া মা..তুমিও কিন্তু একদম ভালো বেবি হয়ে থাকবে।”
বলেই দৃঢ়তার সাথে বেরিয়ে পড়ে নেহা। তারা বেরিয়ে যেতেই আনিকা চৌধুরী ও তাজিব। মেতে ওঠে নিয়াকে নিয়ে। তাজিবের বাবা ইউভান চৌধুরী একজন নেভি হওয়ায় বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকে। ৫/৬ মাস পর পর দেশে আছে। কিছুদিন আগেই তিনি এসে গেছেন। নেহার কথা শুনে অনেক আফসোস করেছেন। এমনকি নেহা ও তার মেয়েকে সবরকম সমর্থনও করতে বলে গেছেন নিজের পুরো পরিবারকে।
বড় একটা কুশনে বসে আছে নাতাশা। তার কোলে আহিরের মেয়ে আহিরা। আহির বর্তমানে কিছু কাজে ব্যস্ত থাকায় নাতাশাই তাকে সামলাচ্ছে। আহিরাকে এভাবে সামলাতে বিরক্ত হলেও তার কিছু করার নেই। কারণ আহিরের মন পাওয়ার জন্য তার একমাত্র উপায় এটাই। মাঝখানে একবার আহিরা নাতাশার চুল ধরে টানলো। এতে তার ইচ্ছা করছিল বাচ্চাটাকে আছাড় মা*রতে কিন্তু সেই সাহসও তার নেই। নাতাশা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। আহিরা এখন ৭ মাস বয়সী, আধো আধো কথা বলতে পারে। আহিরকে “পাপা” বলে ডাকে। আহিরাকে একা পেয়ে নাতাশার মাথায় হঠাৎ করে একটা দুষ্টুবুদ্ধি এলো। সে আহিরাকে আদর করতে বলে,
“সোনা মেয়ে..আমি তোমার কি হই জানো? বলো তো মাম্মা..”
আহিরা চুপচাপ তাকিয়ে থাকে নাতাশার দিকে। শুরুতে কিছুই বলে না। নাতাশা এতে বিরক্ত হলেও বারকয়েক চেষ্টা করে আহিরার মুখ থেকে মাম্মা ডাক শোনার। কিছু সময় পরেও যখন আহিরা বলছিল না তখন অধৈর্য হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে বলে,
“এটা বাচ্চা নাকি আপদ..ইচ্ছা করছে গলা টিপে মেরে ফেলি। আহিরকে দেখে তো খুব পাপা, পাপা করে তাহলে আমাকে মাম্মা বলতে কি সমস্যা?”
এমন সময় হঠাৎ করে নাতাশা খেয়াল করে তার পড়নের দামী শাড়িটা ভিজে গেছে। দ্রুত চেক করতেই সে বুঝতে পারে আহিরা তার শরীরে মূত্র বিসর্জন করেছে। এতে সে রেগে গিয়ে আহিরাকে সোফায় বসিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“এটা কি হলো? আমার এত দামি শাড়ি..এটা বাচ্চা না আপদ..”
“নাতাশা…”
হঠাৎ একটি গর্জন কানে আসতেই নাতাশা সতর্ক হয়ে গেল। আহির দ্রুত বেগে এসে নাতাশার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
“তোর সাহস কি করে হলো আমার মেয়েকে নিয়ে এমন কথা বলার?”
নাতাশা ঢোক গিলে বলল,
“আসলে আহির..আমার নতুন দামী শাড়ি এটা..অনেক প্রিয়..”
“তোর কয়টা দামী শাড়ি লাগবে বল আমায়, আমি তোকে কিনে দেব। কিন্তু আমার মেয়েকে নিয়ে এমন শব্দ আমি বরদাস্ত করব না। আর কোনদিন যদি এমন কিছু শুনি তাহলে তোর জিভ আমি টেনে ছিড়ে ফেলব।”
“তুই এতো সিরিয়াস কেন হচ্ছিস আহির? আমি তো জাস্ট..”
“গেস্ট লস্ট..”
“আহির..আমার কথাটা..”
“গো টু দা হেল। আমার মেয়ের পাশে তোকে আর থাকতে হবে না। আমি তো তোকে থাকতে বলিনি। ওর প্রতি এমন বিভেবিয়ার আমি একদম টলারেট করব না।”
নাতাশা বুঝতে পারে আহিরের মন পেতে তাকে আহিরার প্রতি নরম হতে হবে। তাই সে নতস্বরে বলে,
“সরি, আর কখনো এই ভুল হবে না। আমাকে একটা সুযোগ দে।”
“দিলাম সুযোগ। এখন যা আমার সামনে থেকে।”
নাতাশা যাওয়ার সময় একবার আহিরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“একদিন এই বাচ্চাই আমার তুরুপের তাস হবে!”
আরাভের দাঁড়ি যেন একটু বেশি লম্বা হয়েছে,চুল গুলো উস্কোখুশকো। দীর্ঘ ৭ মাস ধরে সে নেহাকে নানা যায়গা খুঁজেছে কিন্তু কোন খোঁজ পায়নি। এর ফলে নিজের যত্ন নিতেও ভুলে গেছে সে। নেহার একটা পুরানো ছবি দেখে বলে,
“কোথায় তুই নেহা? আর কখনো কি ফিরবি না? এত অভিমান তোর?”
এমন সময় বিপাসা চৌধুরী ছেলের রুমে এসে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,
“চুল-দাড়ি গুলো ছেটে আয় বাবা। এভাবে নিজের অযত্ন করিস না। একেই তোর আব্বুর এই অবস্থা আর..”
“আমি যে আর পারছি না আম্মু। একদম শেষ হয়ে যাচ্ছি।”
বিপাসা চৌধুরী জানেন না তিনি কি করবেন। এই ৭ মাসে বাস্তবতা তাকেও বদলে দিয়েছে। আজমাইন চৌধুরীর অসুস্থতার জন্য ইতিমধ্যেই তাদের ব্যবসা দেউলিয়া হবার পথে। তারমাঝে আরাভেরও এই অবস্থা। বিপাসা চৌধুরীর সব অহংকার যেন ধুলোয় মিশে গেছে এসবে!
উত্তল তরঙ্গ পর্ব ১৩
নেহা তার অফিসে পা রাখলো। এত বড় অফিস দেখে তার বড্ড ভয় হলো। তার নতুন কর্মস্থল এটা। চোখ বন্ধ করে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিয়ে সে বলে,
“ধন্যবাদ আল্লাহ, আমাকে এত সুন্দর একটা জীবন দেয়ার জন্য। আমি কখনোই ভাবি নি অতীতের অন্ধকার ঠেলে আবার এত আলো আসবে আমার জীবনে। এখন তোমার কাছে একটাই চাওয়া, এই আলো যেন বজায় থাকে আজীবন। কখনো নিভে না যায়।”