উত্তল তরঙ্গ পর্ব ১৬
দিশা মনি
নেহা আজ অফিসে এসে সব কাজ সঠিক ভাবে সম্পন্ন করে বের হতে হবে। এমন সময় সে তার চারপাশে কিছু কলিগদের মধ্যে কানাঘুষা শুনল। তার এক কলিগ বলছিল,
“আরে শুনেছ, শামিম স্যার নাকি খুব শীঘ্রই অবসর নিতে চলেছেন। তার যায়গায় আসতে চলেছে নতুন কেউ।”
“আমিও তো তাই শুনলাম। শামিম স্যার তো অনেক ভালো লোক ছিলেন। ওনার বদলে যে আসবে তিনি যে কেমন হয় সেটাই ভাবছি।”
“আমি যতদূর শুনলাম, ওনার কোন আত্মীয়ই এই কোম্পানির নতুন সিইও হবেন।”
“আমিও তো তাই শুনলাম।”
কথাগুলো শুনে নেহা অবাক হলো। এমন কিছুর গুঞ্জন সে আগে শোনে নি। শামিম কায়সার তো নেহার কাছে একদম বটবৃক্ষের মতো ছিল এতদিন। বিগত ৫ টা বছর ধরে লোকটা নেহাকে অনেক স্নেহ দিয়েছেন। তাই তার বিদায়ের কথা শুনে নেহার মনটা যারপরনাই খারাপ হয়ে গেল। সে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। তার মনেও বাসা বাধল নতুন আশঙ্কা। তার নতুন বস কেমন হবে? তিনিও কি শামিম কায়সারের মতো মহৎ হৃদয়ের ব্যক্তি হবেন? আর যদি তেমনটা না হয় তখন?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আমার জীবনে এসব মহানুভবতার কোন স্থান নেই স্যান্ডি। তোমাকে আমি অনেক সুযোগ দিয়েছি বাট তুমি সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারো নি৷ আর তাই আজ আমি তোমায় ফায়ার করে দিচ্ছি।”
স্যান্ডি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তার বসের দিকে তাকাল। কিন্তু লোকটার চোখে বিন্দুমাত্র কোন করুণা ছিল না৷ ছিল শুধু একরাশ দম্ভ। পায়ের উপর পা তুলে বসে তিনি বললেন,
“শাহরিয়ার কায়সারের কাছে ভুলের কোন ক্ষমা নেই। ভুলের সমানুপাত হলো শাস্তি৷ ভুল যেহেতু তুমি করেই ফেলেছ তাই শাস্তি পেতেই হবে।”
স্যান্ডি এবার শাহরিয়ার কায়সারের একদম পায়ের কাছে বসে পড়ে বলে,
“দয়া করে আমায় আর একটা সুযোগ দিন স্যার।”
শাহরিয়ার কায়সার তাকে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে বলল,
“নো চান্স।”
বলেই উঠে দাঁড়ালো। অতঃপর সিকিউরিটি গার্ড দেখে বের করে দেয়া হলো স্যান্ডিকে। অতঃপর সে গলা খাকারি দিয়ে নিজের ম্যানেজারকে ডেকে পাঠালো। ম্যানেজার এসেই তাকে স্যালুট দিলো৷ শাহরিয়ার বলল,
“আমার কানাডা থেকে দেশে ফেরার সব বন্দবস্ত হয়েছে তো?”
“জ্বি, স্যার।”
“গুড। ড্যাড সবকিছু ঠিকভাবে সামলাতে পারছে না। ওনার মহানুভবতাই আমাদের কোম্পানির অনেক ক্ষতি করছে। এভাবে আমাদের কোম্পানি কখনোই ইন্টারন্যাশনালি ফেমাস হতে পারবে না। সেজন্য এবার আমাকে কোম্পানির হাল ধরতেই হবে।”
শাহরিয়ার কায়সারের চোখে একটা বুনো জেদ। অতঃপর সে একটু শান্ত হয়ে বলল,
“আমার আজকের সিডিউলটা বলো।”
“জ্বি, আজ দুপুরে আপনার পাটোয়ারী এন্টারপ্রাইজের সিইও আহির পাটোয়ারীর সাথে একটা মিটিং আছে।”
আহির পাটোয়ারীর নাম শুনেই শাহরিয়ারের চোখে একটা অদ্ভুত আলো জ্বলে ওঠে। সে নিজের ডেস্ক থেকে একটি বল হাতে তুলে নিয়ে বলে,
“আহির পাটোয়ারী, বিজনেস ওয়াল্ডে ওনার অনেক নাম শুনেছি। বেশ, মিটিং এর টাইমটা বলে রাখুন।”
নেহা অফিস থেকে বাসায় ফিরেই দেখল নিয়া একদম বাধ্য মেয়ের মতো তার সব কথা শুনেছে। এখনো সে পড়ার টেবিলে বসে আছে। খাবার খেয়ে প্লেট খুব সুন্দর ভাবে ঢাকনা দিয়ে রেখেছে। একটা খাবারও মাটিতে ফেলে নি। এসব দেখে সে তৃপ্তি পেল। অতঃপর নিয়ার পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নিয়ে গালে একটা হামি দিয়ে বলল,
“আমার মেয়েটা তো একদম গুডগার্ল হয়ে গেছে। কত সুন্দর আমার সব কথা মেনে চলছে।”
কিন্তু নেহা খেয়াল করল নিয়ার মনটা বিষন্ন। এটা দেখে সে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,
“কি হয়েছে নিয়ামনি? তোমাকে এমন লাগছে কেন?”
নিয়া হঠাৎ করে কেঁদে ওঠে। নেহার বুকটা ছ্যাত করে ওঠে।
“কাঁদছ কেন নিয়ামনি? তুমি কি পড়ে গিয়ে কোথাও ব্যথা পেয়েছ?”
“আম্মু জানো..আজ আমি যখন তাজিব ভাইয়ার সাথে পার্কে খেলতে গেছিলাম তখন এক আঙ্কেল আমাকে আমার বাবার নাম জিজ্ঞেস করেছিল..আমি তখন বলতে পারি নি৷ এজন্য ঐ আঙ্কেলটা আমার দিকে কিভাবে যেন তাকিয়ে ছিল৷ তারপর আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললো, আমার কি কোন বাবা নেই, তাহলে আমি কিভাবে জন্ম নিয়েছি। ওনার কথা আমি কিছু বুঝতে পারি নি। উনি বললেন, সবারই তো বাবা থাকে, আমার বাবা কেন নেই। আমি ওনার কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি নি আম্মু।”
নিয়ার কথা শুনে নেহা তার মেয়েকে একদম বুকে জড়িয়ে নেয়। নেহার চোখেও জল। সে মনে মনে বলে,
“এই ভয়টাই যে আমাকে সবসময় গ্রাস করে। কিন্তু তোমাকে আমি কিভাবে তোমার বাবার পরিচয় দেব..সে যে একটা অমানুষ। আজো আমার তার করা অমানবিক অত্যাচারের কথা মনে পড়ে। শুধুমাত্র তার জন্য আমার সাজানো গোছানো জীবনটা একদম এলোমেলো হয়ে গেছে।”
নেহা নিজের চোখের জল মুছল। নাহ, তার এমন ভেঙে পড়লে চলবে না৷ সে যদি ভেঙে পড়ে তাহলে তার মেয়েকে কে সামলাবে? এজন্য নেহা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“নিয়ামনি, চলো আজ আমরা একটা নতুন গেইম খেলব।”
নিয়াও এবার কান্না থামিয়ে বলল,
“কি গেইম মামনি?”
নেহা এবার নিয়াকে নিয়ে বিছানায় বসল। তারপর তার সাথে রক, পেপার, সিজার খেলতে শুরু করল। খেলায় দুজনে এত মজা করতে লাগল যে নিয়া তার সব দুঃখের কথা ভুলেই গেল।
নিজের রুমে বসে আছে আরাভ। তার অবস্থা এখন আগের থেকে শোচনীয়। আজমাইন চৌধুরীর অসুস্থতার জন্য তাদের স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তিই বিক্রি করে দিতে হয়েছে। এখন সে বিপাসা চৌধুরী ও আজমাইন চৌধুরীকে নিয়ে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকে। আজমাইন চৌধুরী এখনো কোমায়।
আরাভ বসে বসে মাসের সব বাজারের হিসাব করছিল৷ এমন সময় একটা পুরাতন ফাইল ঘাটতে গিয়ে সে নিজের আর নেহার একসঙ্গে একটা ছবি দেখে। ছবিটা দেখে সে এতোটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে যে তার চোখে জল চলে আসে। বিপাসা চৌধুরী তাদের প্রতিবেশী রিনা নামের একটি মেয়েকে নিয়ে আরাভের রুমে আসেন। রিনা এসেই আরাভের দিকে তাকায় ব্যকুল দৃষ্টিতে। আরাভের প্রতি রিনার রয়েছে এক অন্যরকম অনুভূতি। যা সে কখনোই ব্যক্ত করতে পারে না৷ তবে বিপাসা চৌধুরী জানেন রিনার মনের কথা। তিনি এটাও বিশ্বাস করেন যে, এই রিনা নামের মেয়েটা তার ছেলেকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে। কিন্তু আরাভের মনে যে আজো নেহার বাস। সে কি নেহাকে ভুলে নতুন জীবন শুরু করতে পারবে?
আহিরা নিজের হাতে থাকা স্মার্টওয়াচে বারবার সময় দেখছে। ইতিমধ্যেই তার স্মার্টওয়াচে ২০ টারও বেশি কল এসেছে আহিরের নাম্বার থেকে। কিন্তু সে ফোনটা একদম রিসিভ করে নি। সে মনের সুখে টিভিতে কার্টুন দেখছে ও পপকর্ন খাচ্ছে। এমন সময় নাতাশা তার রুমে এসে বলে,
“আহিরা, এই যে তোমার জন্য স্যান্ডউইচ নিয়ে এসেছি।”
আহিরা রাগান্বিত স্বরে বলে,
“এত টাইম লাগল কেন? তোমার স্যান্ডউইচ তুমি খাও। আমার স্কুলের জন্য লেইট হয়ে যাচ্ছে। আমাকে জলদি স্কুলে পৌঁছে দাও।”
“আমি এত কষ্ট করে স্যান্ডউইচ বানালাম, তুমি সেটা খাবে না?”
“তুমি কি বয়রা নাকি? কানতে শুনতে পাও না?”
“শুনেছি কিন্তু এত কষ্ট..”
“এসব সিল্লি কথা আমার সামনে বলবে না। তাড়াতাড়ি স্কুলে রেখে এসো নাহয় আমি ড্রাইভারকে নিয়ে একাই বেরিয়ে পড়ছি।”
নাতাশা বলে,
“ঠিক আছে, আমি তাহলে স্যান্ডউইচটা তোমার টিফিনের জন্য দিচ্ছি।”
“ওকে।”
এমন সময় মুমিনুল পাটোয়ারী এসে বলেন,
উত্তল তরঙ্গ পর্ব ১৫
“দিদিভাই, তোমার পাপা নাকি তোমায় ফোন করছে। তুমি রিসিভ করছ না কেন?”
“আমার ইচ্ছা হয়নি আমি রিসিভ করি নি৷ তুমি নিজের ছেলেকে বলে দাও, আমায় যেন আর কল করে ডিস্টার্ব না করে। আমি এখন স্কুলে যাচ্ছি। আর এটাও বলে দিও যে ভ্যাংকুবার থেকে আমি যা যা আনতে বলেছি তার সবকিছু যেন নিয়ে আসা হয়। আদারওয়াইজ, যেন সে বাংলাদেশের মাটিতে পা না রাখে।”