উত্তল তরঙ্গ পর্ব ১৭

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ১৭
দিশা মনি

নেহা আজ আবার যথারীতি তার অফিসে পা রাখল। তবে আজ অফিসের পরিস্থিতি বেশ ভিন্ন। সবার মুখে একটা দুঃখী দুঃখী ভাব ও বিষন্নতা। নেহা এটা খেয়াল করে চমকে উঠল। তার এক কলিগকে সে জিজ্ঞেস করল,
“সবাইকে এমন লাগছে কেন?”
“তুমি জানো না? আজ শামিম কায়সার স্যারের ফেয়ারওয়েল হবে। আগামী দিন থেকে এই কোম্পানি সামলাবেন ওনার ছেলে শাহরিয়ার কায়সার।”
নেহাও কথাটা শুনে ভীষণ দুঃখ পেল। শামিম কায়সারকে সে ভীষণ শ্রদ্ধা করল। লোকটাও অনেক ভালো মনের ছিলেন। তার বদলে যিনি আসবেন তিনি কেমন হবেন সেই নিয়ে যারপরনাই সন্দেহ ছিল নেহার মনে। তবুও সে নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত রাখার চেষ্টা করলো।

কিছু সময় পর শামিম কায়সার এগিয়ে আসলেন। সবাই তার দিকে ফুলের তোড়া এগিয়ে দিয়ে ফেয়ারওয়ালের শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলেন। নেহাও একটি ফুলের তোড়া নিয়ে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“ভালো থাকবেন স্যার, আপনার অবসর জীবন সুখের হোক।”
শামিম কায়সার স্নেহের সাথে নেহার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“তুমিও জীবনে এগিয়ে যাও মা। আর সবার উদ্দ্যেশ্যে আমার একটা কথাই বলার, আমার ছেলেটা একটু অন্যরকম। ও বিজনেস নিয়ে অনেক সিরিয়াস। কিছুটা রাগী স্বভাবেরও। তাই হয়তো ওর সাথে মানিয়ে নিতে তোমাদের প্রথম প্রথম অনেক কষ্ট হবে। তবে আমার ছেলেটা এতোটাও খারাপ না। আশা করি, সবটা ঠিকভাবে চলবে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আহির শাহরিয়ার কায়সারের সাথে মিটিংটা ক্যান্সেল করে তড়িঘড়ি করে ফ্লাইটে করে দেশে ফিরছে। কারণ সে খবর পেয়েছে যে তার মেয়ে আহিরা হঠাৎ করে ভীতি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এই খবর শুনে আর স্থির থাকতে পারে নি আহির।
দীর্ঘ কয়েক ঘন্টার জার্নির পর আহির দেশে ফিরে এলো। দেশে এসেই সে কোন কিছু না ভেবে নিজের বাড়ির দিকে রওনা দিলো। এমন সময় বাড়িতে পা রাখতেই নজরে এলো নাতাশাকে। আহির দৌড়ে দিয়ে তীব্র উৎকন্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“আমার মেয়ে..আমার আহিরা এখন কেমন আছে নাতাশা?”
নাতাশা বলে,
“আগের থেকে বেটার আছে। তুই গিয়ে একবার দেখা করে আয়।”
আহির আর সময় নষ্ট না করে নিজের মেয়ের রুমে গেল। আহিরা যখন নিজের বেডে শুয়েছিল। আহির তার পাশে গিয়ে বসে বলে,

“আহিরা, তুমি কেমন আছ প্রিন্সেস?”
আহিরা কোন জবাব দেয় না। আহির বলে,
“কোন কথা বলছ না কেন?”
“আমার জন্য তোমার কানাডা থেকে যেই গিফটগুলো আনার কথা ছিল সেগুলো কোথায়?”
আহির দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আহিরার দিকে সেই গিফট গুলো বাড়িয়ে দেয়। আহিরা সেই গিফট গুলো নিয়ে ভীষণ খুশি হয়ে আনন্দে মেতে ওঠে। এদিকে আহিরের চোখেমুখে দীর্ঘ শ্বাস। আহিরা আহিরকে বলে,
“গিফট গুলো পেয়ে ভীষণ ভালো লাগছে৷ এগুলো আনার জন্য ধন্যবাদ।”
আহির আহিরার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আহিরা গিফটগুলো পেয়ে সেগুলো নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আহিরের সাথে অতিরিক্ত আর কোন কথা বলে না।
আহিরার এমন ব্যবহারে আহির কিছুটা কষ্ট পায়। আহিরাকে সে এতোটা ভালোবাসে অথচ আহিরার কাছে যেন তার এসব ভালোবাসার কোন মূল্যই নেই। সে শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে, নিজের সুবিধার কথা চিন্তা করে সব পরিস্থিতিতে।

নেহা বাসায় ফিরেই দেখতে পায় তার মেয়ে নিয়া বসে বসে তাজিবের সাথে খেয়াল ব্যস্ত ছিল৷ এই দৃশ্য দেখে সে হেসে তাদের পাশে বসে বলে,
“বাহ, দুই ভাইবোন মিলে তো খুব মজা হচ্ছে।”
নিয়াও খুশি হয়ে বলে,
“জানো, আম্মু। ভাইয়া আজ আমাকে একটা নতুন খেলা শিখিয়েছে। আমার তো খেলাটা ভীষণ ভালো লাগছে।”
“বাহ, তাই নাকি।”
এরপর সে নিয়া ও তাজিবকে বলে,
“খেলাধুলা অনেক হয়েছে। এবার তোমরা জলদি খাওয়া দাওয়া করে নাও। তাজিব, তোমার আম্মু আর দাদি কেমন আছে?”

“আম্মু আর দাদি তো অনেক ভালো আছে। কিন্তু তোমার উপর রেগে আছে কারণ তুমি অনেকদিন থেকে আমাদের বাসায় যাও না। তাই আজ তোমায় আমাদের বাসায় যেতে বলেছে।”
“আচ্ছা, তোমার আম্মু আর দাদিকে বলে দিও আজ আমি সময় করে তোমাদের বাসায় যাব।”
নেহার কথা শুনে তাজিব খুশি হয়ে বলে,
“নিয়াকেও নিয়ে যেও আন্টি, আমি অনেক নতুন টয় কিনেছি সেগুলো ওকে দেখাব।”
“আচ্ছা, আমি নিয়াকেও নিয়ে যাব।”
একথা শুনে নিয়া ও তাজিব দুজনেই ভীষণ খুশি হয়।

শাহরিয়ার কায়সার পা রাখল ঢাকায়। আজ থেকে নিজের বাবার কোম্পানির দায়িত্ব সে তুলে নিলো নিজের কাঁধে। এসেই সর্বপ্রথম সিইওর চেয়ারটা দখল করে নিলো সে। তারপর বিচক্ষণ চোখে সবটা পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। তার রাগী রাগী চেহারার জন্য কেউ তার কাছে ঘেঁষতেও ভয় পাচ্ছিল।
শাহরিয়ারের অবশ্য এটা নিয়ে কোন কিছু যায় আসে না। সে তো নিজের কতৃত্ব কিভাবে স্থাপন করা যায় সেই চিন্তায় ব্যস্ত ছিল। শাহরিয়ারের ভাবনার মাঝেই হঠাৎ করে এই অফিসে তার নতুন ম্যানেজার খালেক ইসলাম তার সাথে দেখা করল। খালেক ইসলাম এসেই শাহরিয়ারকে সালাম দিলো। শাহরিয়ার শীতল কণ্ঠে বলল,
“এই অফিসের সবার ফাইল আমার কাছে এনে দাও। আর হ্যাঁ, জানি না এতদিন কি হয়েছে কিন্তু আমি একজন পাংচুয়াল মানুষ, তাই আমি চাই আমার অফিসের সব কর্মচারীও পাংচুয়াল হোক। এই কথা সবাইকে বলে দিও। এখন থেকে কেউ লেইট করে অফিসে আসলে শুরুর দিকে তার স্যালারি থেকে টাকা কাটা হবে আর তাতেও যদি সে না শোধরায় তাহলে চাকরি থেকেই বের করে দেয়া হবে। ”
শাহরিয়ারের চোখে ছিল প্রছন্ন হুমকি। খালেক ইসলাম ভয়ে ভয়ে বলেন,

“আচ্ছা, স্যার।”
বলেই তিনি চলে যান। শাহরিয়ার নিজের ডেস্কে বসে কফি খাচ্ছিল। এমন সময় সে থাই গ্লাসের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করল একজন নারী কেবল মাত্র অফিসে প্রবেশ করল। অথচ অফিস শুরুর ১০ মিনিট হয়ে গেছে। শাহরিয়ারের মেজাজটা এমনিতেই চটে ছিল।
সে দ্রুত বাইরে এলো। নারীটি আর কেউ ছিল না, এটা ছিল নেহা। শাহরিয়ার সরাসরি নেহার কেবিনে গেল। নেহা তখন সবেমাত্র নিজের চেয়ারে বসেছিল এমন সময় শাহরিয়ার এসে বলল,
“এটা অফিস, কোন হাট বাজার নয় যেখানে যখন ইচ্ছা ঢুকবেন আর যখন ইচ্ছা বের হবেন।”
কথাটা শুনেই নেহা চমকে গিয়ে চোখ তুলে তাকায় শাহরিয়ারের দিকে। শাহরিয়ারকে সে আগে কখনো দেখে নি। তাই সে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। শাহরিয়ারের লম্বা-ফর্সা চেহারা, সুঠাম দেহ ও চেহারায় একটা বিদেশী ভাব। নেহা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কে আপনি?”
শাহরিয়ার ভীষণ রেগে বললো,
“আমি কে সেটা খুব শীঘ্রই জানতে পারবেন, আপাতত আমি যেটা বললাম সেটা মেনে চলার চেষ্টা করুন।”
হঠাৎ অচেনা অজানা কারো মুখে এমন কথা শুনে নেহারও মাথা গরম হয়ে গেল। তাই সেও বলল,
“কে আপনি যে আমাকে আপনার কথা শুনে চলতে হবে? আপনি কি আমার বস নাকি? নিজেকে কি মনে করেন?”
শাহরিয়ার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল। এমন সময় খালেক ইসলাম এসে ইশারা করে নেহাকে চুপ করতে বলল কিন্তু নেহা শুনল না। নেহা খালেক ইসলামকে জিজ্ঞেস করল,

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ১৬

“খালেক ভাই, দেখুন তো এই লোকটা কেন৷ চিনি না জানি না আমাকে এসে জ্ঞান দিচ্ছে।”
শাহরিয়ার খালেক ইসলামের দিকে তাকিয়ে বলে,”ওনাকে আমার পরিচয়টা দিয়ে দাও।”
খালেক ইসলাম ঢোক গিলে বলেন,
“নেহা উনি শাহরিয়ার কায়সার, শামিম স্যারের ছেলে। এই কোম্পানির নতুন সিইও।”
কথাটা শুনেই নেহার হুশ উড়ে যায়! তার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায়। না জেনেই এত কিছু বলে ফেলল সে। এবার কি হবে?!

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ১৮