উত্তল তরঙ্গ পর্ব ২৪

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ২৪
দিশা মনি

নেহা নিয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। ইনফিনিক্সে চাকরিটা ছাড়ার পর সে অনেক স্বস্তি অনুভব করছে। কেননা, এত কিছুর পরেও যদি নেহা ওখানে চাকরি করত তাহলে এটা তার আত্মসম্মানে সবথেকে বড় আঘাত হতো। তাই চাকরি ছাড়া নিয়ে নেহার মনে কোন আফসোস নেই। নেহা তো মাথা উঁচু করে নিজের মেয়েকে নিয়ে একটা সুন্দর জীবনের আশাতেই একদিন ঢাকা শহরে পাড়ি জমিয়েছিল।
তবে এখন তার চিন্তা হচ্ছে যে নতুন জব কিভাবে জোগাড় করবে। দৃঢ়তা এমনিতেই তার অনেক সাহায্য করেছে তার কাছে আর সাহায্য চাইবে না নেহা। এবার সে নিজের অতীতের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ইন্টারভিউ দিবে। নিজের যোগ্যতায় নতুন কোন জব নেবে। এমনটাই ভেবে নিলো নেহা। নেহার এই ভাবনার মাঝেই হঠাৎ করে তার ফোন বেজে উঠল। নেহা দ্রুত ফোনটা রিসিভ করে বলল,

“হ্যালো কে?”
বিপরীত দিক থেকে আহির বলল,
“আপনি কি নিয়ার মা বলছেন?”
নেহা আহিরের কন্ঠস্বর শুনে অবাক হয়। কেন জানি এই কন্ঠস্বর তার খুব চেনা লাগে। তবে যেহেতু ফোনে কারো কন্ঠস্বর একদম নিখুঁতভাবে শোনা যায় না তাই নেহাকে বেশ পেরেশানিতে পড়তে হলো। আহিরের কাছেও গলার স্বর চেনা চেনা মনে হলেও সে ঠাহর করতে পারে না যে, এই কন্ঠস্বর সে আগে কোথায় শুনেছে। তার উপর লোকটা তাকে নিয়ার মা বলে ডাকছে। নেহা কিছুটা ভেবে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“হ্যাঁ, আমি নেহার মা বলছি। আপনি কে?”
“আমি আহিরার বাবা বলছি।”
“আহিরার বাবা?”
“মানে আজকে আপনি যেই মেয়েটাকে এক্সিডেন্টের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন তার বাবা। আপনাকে ধন্যবাদ দিতেই কল করা।”
নেহা শান্ত ভাবে বলে,
“নিজের মেয়ের প্রতি যত্নশীল হন। আজ ও যেই অবস্থায় ছিল..আর একটু এদিক ওদিক হলেই..”
“আমি সবটাই শুনেছি। আপনার কাছে আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ৷ বলুন কি করলে আপনার এই ঋণ আমি শোধ করতে পারব।”
“যদি সত্যিই এই ঋণ শোধ করতে চান তাহলে নিজের মেয়ের প্রতি একটু দায়িত্বশীল হোন। আর কিছু করতে হবে না।”

“আপনার গলার স্বরটা আমার ভীষণ চেনা লাগছে৷ আপনারও কি একইরকম লাগছে?”
নেহা অবাক হয়। কি বলবে এবার সে? কিছুটা ভেবে বলে,
“না, লাগছে না। যাইহোক, ভালো থাকবেন আর নিজের মেয়ের যত্ন নেবেন।”
বলেই নেহা ফোনটা রেখে দেয়৷ তার আর কথা বলতেও অস্বস্তি লাগছিল। অন্যদিকে আহির ভাবতে থাকে,
“কে এই মহিলা? কেন ওনার গলার স্বর আমার এত চেনা লাগছিল?”
তবে সে এই ভাবনায় বেশি সময় ব্যয় করলো না। আহিরা ঘুমন্ত চেহারা দেখে হাসিমুখে তার পাশে শুয়ে পড়ল। নাতাশা কিছুটা দূর থেকে আহিরকে পর্যবেক্ষণ করল। সে কিছু সময় আগেই এসেছে। আহির ফোনে কথা বলছিল জন্য এতোক্ষণ সে ভেতরে আসে নি৷ আহির শুয়ে পড়তেই সে বলল,
“অনেক অপেক্ষা করেছি আমি আর না। এবার আহিরকে নিজের করে পাওয়ার জন্য যা করা দরকার আমি তাই করব। আর এজন্য আমার তুরুপের তাস হবে আহিরা।”

শাহরিয়ার কায়সার নিজের বেলকনিতে থাকা রকিং চেয়ারে দুলতে দুলতে নেহার কথাই ভাবছিল। মেয়েটার সাহস তাকে অবাক করেছে। আজ অব্দি কারো এত সাহস হয়নি যে শাহরিয়ারের সাথে এমন ব্যবহার করে। অথচ নেহা একটা সামান্য মেয়ে হয়ে তা করে দেখাল। শাহরিয়ার দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“এই মেয়েটার কথা এত ভাবছি কেন আমি? ও তো আমার জীবনে তেমন মূল্যবান কেউ না। তবুও কেন ওর ভাবনা আমি নিজের মাথা থেকে বের করতে পারছি না।”
শাহরিয়ারের ভাবনার মাঝেই শামিম কে বেলকনিতে এসে বলল,

“আসব?”
শাহরিয়ার নিজের বাবাকে দেখে হতবাক হয়। কারণ সচরাচর তিনি আসেন না। শাহরিয়ার গম্ভীর স্বরে বলে,
“আসুন।”
শামিম কায়সার এসেই বলেন,
“শুনলাম তুমি নাকি কোম্পানিতে এসেই বাড়াবাড়ি শুরু করে দিয়েছ। নেহা চৌধুরীকে নাকি কোম্পানি থেকে বহিষ্কার করেছ। এত বড় অডাসিটি তোমায় কে দিয়েছে? তুমি জানো নেহা আমার কত পুরাতন আর বিশ্বস্ত কর্মচারী।”
শাহরিয়ারের মেজাজটা গরম হয়ে যায়। সে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলে,
“ইনফিনিক্স এখন আমার। তাই এখানে কাকে রাখব বা রাখব না সেই ডিশিসনটাও আমিই নেব। আপনার এখন বিশ্রাম করার সময় আপনি বিশ্রাম নিন।”
“ভুলে যেও না আমার নিজের চেষ্টায় আমি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ইনফিনিক্স গড়ে তুলেছি। তাই তুমি আমায় এভাবে বলতে পারো না।”
“অতীত ঘেটে লাভ নেই। ইন প্রেজেন্ট ইনফিনিক্স আমার তাই আমি যা ডিসাইড করব তাই হবে।”
“তোমাকে যত দেখি ততই অবাক হই। মাঝে মাঝে তো আমার মনে হয়, আমার আম্মাজান যা বলেছিলেন সেটাই ঠিক। তুমি আমার ছেলে নও তুমি ঐ…”

“মিস্টার শামিম কায়সার! আর একটা ওয়ার্ডও সামনে আগাবেন না। আমার মৃত মাকে নিয়ে এত সন্দেহ কেন আপনার? আর যদি এতো সন্দেহ থেকেই থাকে তাহলে কেন আমায় নিজের ছেলে হিসেবে এত বড় করলেন? জন্মের পরই অনাথ আশ্রমে রেখে আসতে পারতেন।”
“করেছি কারণ আমি অমানুষ নই। আর ডিএনএ টেস্টের রিপোর্টও..”
“বাহ, ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট পাবার পরেও আপনার আমার পিতৃপরিচয় নিয়ে এত সন্দেহ। হ্যাঁ, অনেক বড় মনের মানুষ আপনি। কিন্তু সেটা অন্য কারো জন্য। নিজের ছেলেকে যে মাত্র ৫ বছর বয়সে নিজের থেকে বহু দূরে কানাডায় পাঠিয়ে দেয় তারপর দীর্ঘ কাল তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ রাখে সে মানুষ হিসেবে যতোই ভালো হোক একজন পিতা হিসেবে সম্পূর্ণ ব্যর্থ! আর এমন কাউকে কৈফিয়ত দিতে আমি বাধ্য নই।”

শামিম কায়সার দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন। স্বেচ্ছায় তো তিনি শাহরিয়ারকে নিজের থেকে দূরে পাঠান নি। শাহরিয়ারের চেহারা একদম তার মা শারমিনের মতো। এই শারমিন ছিল সেই নারী যাকে শামিম কায়সার একসময় নিজের জীবন দিয়ে ভালোবেসেছেন। নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে নিম্নবিত্ত পরিবারের মিষ্টি স্বভাবের মেয়েটাকে বিয়ে করেছিলেন। তার জন্য গোটা দুনিয়ার বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্যেও প্রস্তুত ছিলেন। অথচ সেই শারমিনই তাকে ঠকালো! তাও আবার তার প্রিয় বন্ধুর সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে। যখন প্রথম তাঁর মা তাকে এই ব্যাপারে বলেছিলেন তখন তিনি বিশ্বাস করেন নি। কিন্তু যখন একদিন নিজের চোখে নিজের স্ত্রী ও বন্ধুকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখেন সেদিন নিজেকে সামলাতে পারেন নি।

রাগে, ক্ষোভে শারমিনকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। শারমিন বারংবার তার কাছে অনুনয় করে বলেছিলেন তিনি নিরপরাধ তাকে ফাসানো হচ্ছে কিন্তু নিজের চোখে দেখার পর তিনি আর সত্যটাকে অস্বীকার করেন নি। এর দীর্ঘ ৯ মাস পর, শারমিন তার সাথে যোগাযোগ করে জানায় তিনি প্রেগন্যান্ট। শামিম কায়সার এই বাচ্চাটাকে অস্বীকার করে। বাচ্চাটা হবার পরই শারমিন মারা যায় কিন্তু মৃত্যুর আগে তাকে ডিএনএ টেস্ট করাতে বলেন। শামিম কায়সার ডিএনএ টেস্ট করান, তাতে পজেটিভ রিপোর্টও পান। কিন্তু স্ত্রীর প্রতি বিতৃষ্ণা বা তার ভালোবাসায় বিশ্বাসঘাতকতা যেকারণেই হোক তিনি কখনো শাহরিয়ারকে আপন করতে পারেন নি।

আর ছোট্ট শাহরিয়ারও একা একা বাবা-মায়ের ভালোবাসা ছাড়া এক কষ্টের শৈশব কাটিয়েছে। এসব ভেবেই শাহরিয়ারের শক্ত আবরণ নরম হয়। তার মনে পড়ে যায় কিভাবে নেহাও আজ তার পিতৃপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলছিল সে আসলেই শামিম কায়সারের মতো এত ভালো মানুষের সন্তান কিভাবে হতে পারে। এটা ভেবেই শাহরিয়ার হুংকার দিয় বলে ওঠে,”নেহা আর কখনো ফিরবে না ইনফিনিক্সে। কখনোই না।”

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ২৩

আরাভ আজ বেরিয়ে পড়েছে ঢাকায়। বিপাসা চৌধুরী অশ্রুসিক্ত নয়নে ছেলেকে বিদায় দিলেন। ঢাকায় যাওয়ার পেছনে আরাভের দুটো উদ্দ্যেশ্য, এক নিজের জন্য ভালো একটা চাকরি খোঁজা আর দুই, নেহার খোঁজ করা। আরাভ এতদিন অনেক যায়গায় নেহাকে খুঁজেছে। কিন্তু তার কোন খোঁজ পায় নি। কিন্তু এবার কেন জানি তার মনে হচ্ছে ঢাকায় গিয়ে নেহা সম্পর্কে কোন তথ্য পাবে।

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ২৫