উত্তল তরঙ্গ পর্ব ২৯
দিশা মনি
নেহা তার বড় আব্বুর পাশে বসে পড়লো। আজমাইন চৌধুরী যেন নড়ে উঠলেন। ফ্যালফ্যাল চোখে নেহার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না। নেহা আজমাইন চৌধুরীর হাতটা আলতো করে স্বর্শ করে বলল,
“তোমার এই অবস্থা কিভাবে হলো বড় আব্বু? তুমি কি এখনো আমার উপর রাগ করে আছ? আমার সাথে কথা বলবে না?”
আজমাইন চৌধুরী কিছু বলার জন্য ঠোঁট নাড়াতে লাগলেন। কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হলো না। নেহা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। বিপাসা চৌধুরী নেহার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“তুই চলে যাবার কিছু দিন পর হঠাৎ করে একদিন তোর বড় আব্বু অসুস্থ হয়ে পড়ে। জ্ঞান হারানোর আগে আরাভকে শুধু এটুকুই বলে যে, নেহা কোন দোষ করে নি। ওকে ফিরিয়ে আন। এটা বলেই তোর বড় আব্বু জ্ঞান হারান। তারপর থেকে আজ অব্দি ওনার এই অবস্থা।”
“তার মানে বড় আব্বু আমাকে অপরাধী মনে করে না? উনি আমার নির্দোষতা বুঝেছেন?”
বিপাসা চৌধুরী মাথা নাড়ান
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“শুরুতে আমিও এটা মানতে পারি নি। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে উপলব্ধি করলাম, তোর বড় আব্বু এইরকম পরিস্থিতিতে নিশ্চিহ্ন মিথ্যা বলবে না। তাছাড়া…”
“তাছাড়া কি?”
“তোর বড় আব্বু অসুস্থ হবার আগে তার ফোনে একটা কল এসেছিল। সেই ফোনকলের পরই তোর বড় আব্বুর এই অবস্থা। আমি জানি না, এর পেছনে কে বা কারা আছে। আরাভ পুলিশকে ফোন নম্বরটা দিয়েছিল কিন্তু তারাও ট্রেস করতে পারে নি। মনে হয়, সিমটা জাল ছিল।”
নেহার অবাক হবার মাত্রা বাড়ে। সে নিজের চোখের জল মুছে বলে,
“আমি ঠিকই উপলব্ধি করতে পারছি এসবের পেছনে কে আছে। আর তাকে আমি ছাড়বো না।”
আর মনে মনে বলে,
“ঐ আহির পাটোয়ারী শুধু আমার আর আমার মেয়েকে অসহায় অবস্থায় ফেলেই ক্ষান্ত হন নি, শুধুমাত্র ওনার জন্য আজ আমার বড় আব্বুর এই অবস্থা। ওনাকে আমি কখনোই ক্ষমা করব না। অনেক হয়েছে লুকোচুরি, এই ৫ বছর আমি অনেক পালিয়ে বেড়িয়েছি। কিন্তু এবার আর না। এবার আমি ঐ আহির পাটোয়ারীকে ওনার সমস্ত কাজের উচিৎ শিক্ষা দেব। আমার প্রতি, আমার মেয়ের প্রতি এবং আমার বড় আব্বুর প্রতি করা সব অন্যায়ের শাস্তি উনি পাবেনই।”
বিপাসা চৌধুরী বলে ওঠেন,
“তুই কি জানিস নেহা এসবের পেছনে কে আছে? তাছাড়া..যদিও আরাভ আমাকে এসব নিয়ে প্রশ্ন করতে মানা করেছে কিন্তু তবুও..মানে তোর বাচ্চার বাবা কে? এটা আজও আমাদের সবার কাছে একটা বড় রহস্য। আমি হয়তো এক সময় তোকে দুই চোখে দেখতে পেতাম না, তবুও আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, তুই আর যাই করিস কারো সাথে প্রেম করা বা পালিয়ে যাবার মতো মেয়ে নস। খটকা আমার মনেও হয়েছিল। কারণ তোর উপর তোর বড় আব্বু, আরাভ ওরা যেভাবে নজর রাখত তাতে করে তোর কারো সাথে প্রেম করা বা পালিয়ে যাওয়া এতটা সোজা নয়। নিশ্চয়ই এর পেছনে কোন রহস্য আছে। আমি সেইসময় তোর প্রতি ক্ষোভ থেকেই এটা ভেবে নিয়েছিলাম যে তুই পালিয়ে গেছিস। আসল সত্যটা জানারও চেষ্টা করিনি৷ আজ জানতে চাইছি, বলবি আমায়?”
নেহা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“তোমাদের সবাইকে আমি সব সত্য বলব বড় আম্মু। শুধু আমাকে একটু সময় দাও, আর আমাকে এটুকু কথা দাও যে সব সত্য জানার পরে তোমরা কেউ আমার মেয়ের প্রতি বিরূপ মনোভাব ধারণ করবে না। আমি জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করেছি কিন্তু নিজের মেয়েকে আমি কোন কষ্ট পেতে দিতে চাই না।”
বিপাসা চৌধুরী অনুতপ্ত স্বরে বলেন,
“এক ভুল মানুষ বারবার করে না রে নেহা। একবার তোকে অবিশ্বাস করে আমরা যেই ভুল করেছি তার শাস্তি আজও পেয়ে যাচ্ছি। এর পুনরাবৃত্তি করার সাহস আমাদের নেই।”
এমন সময় নিয়া আরাভের কোলে চড়ে আসে সেখানে। আরাভ নিয়াকে সামনে নিয়ে এসে আজমাইন চৌধুরীকে দেখিয়ে বলে,
“এই হলো তোমার বড় নানা।”
নিয়া আজমাইন চৌধুরীর দিকে মায়াভরা চোখে তাকিয়ে বলে,
“বড় নানা এভাবে শুয়ে আছে কেন? কি হয়েছে ওনার?”
“তোমার বড় নানার একটা বড় অসুখ হয়েছে। তাই সে এভাবে শুয়ে থাকে সবসময়।”
“উনি কি আর কখনো আগের মতো হবে না মামা?”
আরাভ নিয়ার গালে একটা চুমু খেয়ে বলে,
“অবশ্যই হবে। তোমরা এসে গেছ না এবার উনি আবার আগের মতো সুস্থ হয়ে যাবেন। তারপর আমরা সবাই মিলে একসাথে নতুন ভাবে জীবন শুরু করব।”
নেহা আচমকা বলে ওঠে,
“সেটা সম্ভব নয় আরাভ ভাই।”
আরাভ হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায়। বিপাসা চৌধুরী বলেন,
“কেন এমন বলছিস নেহা? আমরা সবাই তো নিজেদের ভুলটা শুধরে নিতে চাইছি৷ তুই কি আমাদের আর একটা সুযোগ দিবি না?”
নেহা বলে,
“আমার লড়াইটা একার বড় আম্মু। আমার মেয়ে বা আমার দায়িত্বের বোঝা আমি তোমাদের উপর চাপাতে চাই না। তোমাদের উপর আমার কোন রাগ নেই বিশ্বাস করো কিন্তু..আমি নিজের আর নিজের মেয়ের যে আলাদা দুনিয়া তৈরি করে নিয়েছি সেই দুনিয়াতেই থাকতে চাই।”
আরাভ আহত স্বরে বলে,
“এর মানে তো এটাই বোঝায় যে, তুই আমাদের সাথে থাকতে চাস না।”
“বিষয়টা এমন নয়..তোমাদের সাথে আমার যোগাযোগ সবসময় থাকবে। আর হ্যাঁ, নিয়ার স্কুলে একটা প্রোগ্রাম আছে তাই আমাদের পরশু আবার ঢাকায় ফিরতে হবে আবার আমার নতুন চাকরিও খুঁজতে হবে। তবে তোমাদের সাথে আমার যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ থাকবে।”
বিপাসা চৌধুরী ও আরাভ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। তার বুঝে যায়, নেহাকে আর বেঁধে রাখা যাবে না। কারণ সে আত্মসম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখে গেছে।
আহির নিজের রুমে মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিল। তার মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছিল। আচমকা মাথায় কারো স্পর্শ টের পেয়ে আরাভ চোখ তুলে তাকায়। নাতাশাকে দেখতে পেয়ে সে তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়িয়ে রাগী কন্ঠে বলে,
“নাতাশা তুই…তুই এখানে কেন? আমার পারমিশন ছাড়া এভাবে আমার রুমে এসেছিস কেন?”
“তোর রুমে আসতে আমার পারমিশন লাগবে? হাসালি রে!”
“এখানে হাসির কিছু নেই। আমি সিরিয়াস।”
“শোন, আর কিছুদিন পরই আমরা এক হয়ে যাব। তখন এত দূরত্ব থাকবে না।”
“আমরা কখনোই এক হবো না নাতাশা। তোকে আমি বন্ধুর থেকে বেশি কিছু ভাবি না।”
“কিন্তু তুই আঙ্কেলকে কথা দিয়েছিস যে..”
“আমি জাস্ট এটাই বলেছি যে, আমি ভেবে দেখব। এখনো নিজের রায় আমি জানাই নি। আর তাছাড়া, যদি আমি বিয়ে করিও তবুও আমার কাছে তুই ছাড়া আরো অনেক অপশন আছে। তাই বলছি, আমার পেছনে না লেগে থেকে অন্য কাউকে খুঁজে নে।”
বলেই আহির বেরিয়ে যায়। নাতাশা আহিরার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোকে আমি ছাড়া আর কেউ পাবে না। তোকে পাবার জন্য তো কম কিছু করি নি আমি। কত পথের কাটাকে সরিয়েছি। এবার তোকে পাওয়ার জন্য যত নিচে নামতে হয় আমি নামব।”
হঠাৎ নাতাশার ফোনে একটা কল আসে। নাতাশা ফোনে তার একজন সহকর্মীর সাথে বলে। ফোনটা রেখেই সে বলে,
“নেহা….এই নেহা কোথায়? ৫ বছরে ওর কোন খোঁজই পেলাম না। যদি নেহা আবার ফিরে আসত তাহলে খুব ভালো হতো। আহিরের দূর্বলতা হলো আহিরা, নেহা ফিরে আসলে সেই দূর্বলতা আরো বেশি করে চেপে বসত আর সেই সুযোগে..”
উত্তল তরঙ্গ পর্ব ২৮
নাতাশা একটা শয়তানী হাসি দেয়। আর দুহাত জোড় করে বলে,
“সৃষ্টিকর্তা তুমি ঐ নেহার সাথে একটা বার আমার দেখা করিয়ে দাও। তারপর আহিরকে কিভাবে নিজের করে নিতে হয় সেটা আমি দেখে নেবো।”