উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৩১

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৩১
দিশা মনি

নেহা নিয়াকে নিয়ে অপেক্ষা করছিল দর্শক মঞ্চে বসে। তার মাথায় এখন রাগ চেপে বসেছে। নিয়াকে স্নো হোয়াইট থেকে বাদ দেয়া নিয়ে তার খুব একটা আপত্তি নেই কিন্তু সামান্য কারণে একজন শিক্ষিকাকে চাকরিচ্যুত করার কথাটা সে মেনে নিতে পারছে না। এজন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবার ঐ বাচ্চার অভিভাবকদের দুটো কথা শুনিয়েই যাবে। এমনকি সে নিজের মেয়েকেও আর এমন স্কুলে পড়াতে চায় না যেখানে এমন ভাবে প্রভাব খাটিয়ে অন্যায় করা যায়।
কিছু সময় পর আহির, আহিরাকে নিয়ে উপস্থিত হলো স্কুলে। আহিরা তো ভীষণ খুশি এটা ভেবে যে আজ সে স্নো হোয়াইট হিসেবে অভিনয় করবে। নাতাশা আহিরাকে বললো,

“চলো আমি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।”
এমন সময় আহির বললো,
“নাহ, তুই এখানেই থাক নাতাশা। আমার মেয়েকে আমি পৌঁছে দিয়ে আসছি।”
নাতাশা আর কিছু বলে না৷ আহির আহিরাকে গিয়ে মঞ্চের পেছনে দাঁড়ায়। সে বলে ওঠে,
“যাও প্রিন্সেস, নিজের সেরাটা দিয়ে অভিনয় করো। আমি এখানেই আছি।”
আহিরাদের স্কুলের ড্রামা টিচার এগিয়ে এসে আহিরাকে নিয়ে গেলো মঞ্চের দিকে। আহিরা নিজের স্বভাবসুলভ অহং ভাব নিয়ে মঞ্চে উঠল। আহিরাকে মঞ্চে দেখামাত্রই নেহা অবাক হলো। নিয়া নেহার উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“আম্মু, এটা সেই মেয়েটা না যাকে ঐদিন তুমি এক্সিডেন্টের হাত থেকে বাচিয়েছিলে? জানো, ও সেদিন রিহার্সালের সময় আমায় ধাক্কা মে*রে ফেলে দিয়েছিল। শায়লা ম্যামকেও অনেক বকেছিল।”
নেহা রাগী কন্ঠে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তুমি আমায় এসব আগে বলো নি কেন?”
“আমি ভেবেছিলাম তুমি শুধু শুধু চিন্তা করবে তাই কিছু বলি নি।”
নেহা বলে,
“মেয়েটারই বা কি দোষ। পরিবার থেকে যেমন শিক্ষা পেয়েছে তেমনই তো হবে। যেদিন ওর বাবা ফোন করে আমায় উপকারের জন্য ঋণশোধ করতে চেয়েছিল সেদিনই আমি বুঝে গেছিলাম ওনার মনোভাব কেমন। নিজের মেয়েকে একদম উচিৎ শিক্ষা দিতে পারেন নি উনি। দেখি, অনুষ্ঠানটা শেষ হোক। তারপর আমি গিয়ে ওনার সাথে কথা বলে আসব।”

আহিরা মঞ্চে উঠে হাসিমুখে তাকালো সামনের দিকে। তার আশেপাশে আরো কিছু বাচ্চারা গোল হয়ে দাঁড়াল। আহিরা স্নো হোয়াইটের অভিনয় করা শুরু করল। সে বললো,
“আমি হলাম স্নো হোয়াইট। এই দুনিয়ার সবথেকে সুন্দরী রাজকন্যা…”
নিয়ার কথা শুনে নেহার রাগ আরও বেড়ে গেল। তার মনে হচ্ছিল, এই আহিরা নামের মেয়েটার অহংকার আর ওর বাবার উদ্ধত মনোভাবের জন্যই শায়লা ম্যামকে চাকরি হারাতে হয়েছে। নেহা মনে মনে ঠিক করে নিল, অনুষ্ঠান শেষ হলেই সে আহিরার বাবার সঙ্গে কথা বলবে এবং এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে।
এদিকে আহিরা মঞ্চে নিজের অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে। সে যখন নিজেকে ‘সবচেয়ে সুন্দরী রাজকন্যা’ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছিল, তখন তার মুখে একটা গর্বিত হাসি লেগে ছিল। কিন্তু নেহার চোখে সেই হাসিটা অহংকারের হাসি ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছিল না।

অনুষ্ঠান চলতে লাগল। বাচ্চারা নিজেদের মতো করে অভিনয় করে যাচ্ছে। নেহা শুধু আহিরাকে লক্ষ্য করছে। তার মনে হচ্ছিল, এই ছোট্ট মেয়েটার মধ্যে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস আর উদ্ধত মনোভাবের অভাব নেই। সে বুঝতে পারছিল না, একটা ছোট বাচ্চার মধ্যে এই ধরনের আচরণ কিভাবে আসতে পারে। নিশ্চয়ই এর পেছনে ওর বাবা-মায়ের শিক্ষা বা প্রভাব রয়েছে।
কিছুক্ষণ পর নাটকের বিরতি হলো। দর্শকরা সামান্য বিরতি নিতে ব্যস্ত। এই সুযোগে নেহা উঠে দাঁড়াল। নিয়া তাকে জিজ্ঞাসা করল, “কোথায় যাচ্ছো আম্মু?”
নেহা দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিল,

“আমি আহিরার বাবার সাথে কথা বলতে যাচ্ছি। এটা অন্যায়, নিয়া। একজন ভালো শিক্ষিকাকে এভাবে চাকরিচ্যুত করাটা আমি মেনে নিতে পারছি না।”
নিয়া নেহার হাত ধরে বলল,
“কিন্তু আম্মু, তুমি কেন ঝামেলায় জড়াতে যাচ্ছো? আর যদি উনি তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন?”
নেহা নিয়ার হাত ছাড়িয়ে বলল,
“ভয় পেও না। আমি শুধু সত্যি কথাটাই বলব। আর কোনো অন্যায়কে চুপ করে থাকতে দেব না।”
নেহা ভিড়ের মধ্যে আহিরার বাবার খোঁজ করতে লাগল। কিন্তু বুঝতে পারল না তিনি কোথায় আছেন। এই ভিড়ের মধ্যেই হঠাৎ করে সে কারো সাথে একটা ধাক্কা খেলো। যার ফলে তার সামনে থাকা মহিলার হাত থেকে ফোন পড়ে গেল। মহিলাটি নিজের ফোন ফ্লোর থেকে তুলতে তুলতে রাগী স্বরে অস্পষ্ট কিছু বলল৷ নেহা সেদিকে বিশেষ খেয়াল না করে বলল,

“সরি আমি ইচ্ছা করে..”
মহিলাটি মাথা তুলে তাকাতেই নেহার সাথে তার মুখোমুখি সাক্ষাৎ হলো। নাতাশা অবাক চোখে নেহাকে দেখতে লাগল। নেহার অবস্থাও একইরকম। নাতাশা মনে মনে বলল,
“আমি কি ঠিক দেখছি? এটাই তো সেই মেয়ে..আহিরার মা নেহা। এতগুলো বছর পর ও আমার সামনে..আমার চাওয়া তাহলে আল্লাহ পূরণ করল।”
নেহা নাতাশাকে দেখেই ভাবলো,

“এই তো সেই মহিলা..ডাক্তার নাতাশা..ঐ জানোয়ার আহিরের বন্ধু। ইনি এখানে কি করছেন?”
নাতাশা নেহাকে কিছু বলতে উদ্যত হয় এমন সময় নেহা তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। নাতাশা কিছুটা ঘাবড়ে যায়। সে বলে,
“যদি কোনভাবে আহির আর নেহা মুখোমুখি হয়ে যায় তাহলে কি হবে?”
একটু পরই সে ভাবে,
“হলে ক্ষতি কি? বরং ভালোই হবে। নেহাকে দেখে আহিরের মনে আহিরাকে হারানোয় ভয় আবার জেগে উঠবে। আর সেই সুযোগটাই ব্যবহার করব আমি।”

নেহা কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর দেখতে পেল আহিরা চুপচাপ মঞ্চের পেছনে একটি সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে মনের সুখে চিকেন কাটলেট খাচ্ছে। নেহা ভাবলো,
“মেয়েটা এখন খাচ্ছে..এখন কি ওকে বিরক্ত করা ঠিক হবে?”
নেহার ভাবনার মাঝেই হঠাৎ করে মঞ্চে পুনরায় এনাউজ করা হলো নাটকের বাকি অংশ এখন মঞ্চায়ন করা হবে। আহিরাও উঠে চলে গেল। নেহা আশেপাশে তাকিয়ে কোথাও কাউকে দেখতে পেল না। সে ভাবলো,
“তাহলে কি আহিরার বাবা-মা কেউ আসে নি এখানে?”
সে আবার দর্শক সিটে ফিরে গিয়ে নিয়ার পাশে বসলো। নিয়া নেহাকে দেখে বললো,
“ঐ মেয়েটার বাবা-মায়ের দেখা করলে আম্মু?”

নেহা মাথা নাড়িয়ে না-বোধক ইশারা করে। তখনো তার মনে নাতাশার সাথে দেখা হবার দৃশ্যটা ভেসে ওঠে। নেহা ভাবতে থাকে, ঐ নাতাশা এখানে তাহলে কি কোনভাবে আহিরও এখানে আছে?
তবে নেহার মনে আজ আগের মতো ভয় নেই। বরং সে নিয়াকে কোলে আগলে নিয়ে বলে,
“যদি থেকেও থাকে তাহলে আমি তার পরোয়া করি না। এবার যদি ওনার মুখোমুখি হই তাহলে ওনার চোখে চোখ রেখে উচিৎ জবাব দেব।”
নাতাশা আশেপাশে আহিরকে খুঁজছিল। আহির বাইরে থেকে ফোনে কারো সাথে কথা বলতে বলতে ভেতরের দিকে আসছিল। নাতাশা এগিয়ে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে,

“কিরে কোথায় গেছিলি?”
” বাইরে গেছিলাম একটা ইমপরট্যান্ট কল ছিল। নাটক আবার শুরু হয়েছে?”
“হুম। তোকে একটা কথা বলার ছিল।”
“এখন আমি কিছু শুনতে চাই না। আমাকে আমার মেয়ের পাশে থাকতে হবে।”
বলেই সে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এদিকে নাতাশা বলে,
“এখন আমাকে যতো এড়িয়ে যাবি যা, তবে তোকে লাইনে আনার ওষুধ আমি পেয়ে গেছি। নেহাই হবে আমার তুরুপের তাস।”

আহিরা মঞ্চে অভিনয় করছিল। এমন সময় নেহা খেয়াল করে মঞ্চের পাশে থাকা একটি ক্রেন ভীষণ নড়ছে যেকোন সময় তা ভেঙে পড়তে পারে আহিরার উপর। এটা দেখামাত্রই নেহা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। চিৎকার করে মঞ্চে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে সরিয়ে দিলো আহিরাকে। ক্রেনটা পাশেই ভেঙে পড়ল। উপস্থিত দর্শকরা হতবাক। আহিরও দিকবিদিকশুন্য হয়ে মঞ্চের সামনে ছুটে এসে বলল,

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৩০

“প্রিন্সেস..তোমার কিছু হয় নি তো?”
চেনাজানা কন্ঠস্বরটা শুনেই হতবাক চোখে সামনের দিকে তাকালো নেহা। আহির তখন আহিরাকে নিয়ে চিন্তিত ছিল জন্য শুরুর দিকে নেহাকে খেয়াল করে নি। কিন্তু চোখ পড়তেই বিস্ময়ে থ হয়ে গেল তার চোখ। দীর্ঘ ৫ বছর পর মুখোমুখি তারা!

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৩২