উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪১

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪১
দিশা মনি

নেহা আরাভকে সাথে নিয়ে নিরাপদ স্থানে এলো। বিষাক্ত ধোঁয়ার প্রভাবে তাদের দুজনের অবস্থাই কাহিল। নেহাকে আসতে দেখেই নিয়া ছুটে এসে বললো,
“আম্মু, তুমি কোথায় ছিলে? আমি কত ভয় পেয়ে গেছিলাম, জানো?”
নেহা অনেক কষ্টে সামান্য হাসে। আরাভ ততক্ষণে ঢলে পড়ে। নেহার নিঃশ্বাসও ক্ষীণ হয়ে আসে। তাদেরকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। নেহা নিজের জ্ঞান হারানোর আগেও নিয়ার হাত ধরে বলে,

“নিজের খেয়াল রেখো, একজন ভালো মানুষ হও। এছাড়া আমার আর কোন চাওয়া নেই।”
নিয়া নিজের মাকে এই অবস্থায় দেখে চুপ থাকতে পারে না। ছোট মেয়েরার চোখে জল চলে আসে। মাকে হারানোর ভয় চেপে বসে বুকের মাঝে। পাশে থাকা কয়েকজন মানু্ষ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,
“চিন্তা করো না, তোমার মা ঠিক হয়ে যাবে।”
কিন্তু ছোট নিয়ার কানে সেসব কথা যায় না। সে শুধু নিজের মায়ের অসহায়, নিস্তেজ চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নাতাশা আহিরকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। হাসপাতালে এনেই আহিরকে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো ছিল। আহিরের তখনো চেতনা ফেরে নি৷ তবুও তার অবচেতন মন তখনো জাগ্রত ছিল। অবচেতন মনেও আহির নেহাকে বলার চেষ্টা করছিল, আহিরা তার মেয়ে। সে যেন আহিরার দায়িত্ব নেয়। নিজের জীবনের ক্রান্তিলগ্নে এসে তাকে সেই নেহার কাছেই সাহায্য চাইতে হলো যাকে সে একসময় অসহায় অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। নেহা কেন সাহায্য করবে তাকে? আজ থেকে ৫ বছর আগে যখন আহির নেহা ও তার মেয়েকে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল তখন কি একবারো তাদের কথা ভেবেছিল? সেদিন তো নেহা ও তার মেয়ের বড় কোন ক্ষতি হয়ে যেতে পারব। আহির সেসব কিছু ভাবে নি। শুধু নিজের প্রতিশোধের কথাই ভেবেছে। তাই নেহার কাছ থেকে বিন্দুমাত্র সহানুভূতি সে ডিজার্ভ করে না।

আহিরের চিকিৎসা চলল কয়েক ঘন্টা। এরপর তার জ্ঞান ফিরলো। নাতাশা আহিরের কাছে এসে বলল,
“তুই ঠিক আছিস, আহির? জানিস, আমার তোর জন্য কতটা চিন্তা হচ্ছিল। ভাগ্য ভালো আমি তোর ফোনের লোকেশন ট্রাক করে ছুটে গেছিলাম ওখানে। আমার পৌঁছাতে আর একটু দেরি হলে হয়তো আজ তোকে আমি বাঁচাতে পারতাম না।”
আহির চোখ খুলে চারিপাশে তাকায়। নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কৃত করে সে চমকায়। হয়তো ভেবেছিল চোখ খোলার পর নিজেকে জাহান্নামে দেখতে পাবে, জীবনে তো কম পাপ করে নি। আহির নাতাশাকে বলে,
“আহিরা…আহিরা কই…”

নাতাশার মেজাজটা গরম হয়ে যায়। সে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আহিরকে উদ্ধার করল অথচ আহির জ্ঞান ফিরে আহিরার খোঁজ করছে। যে কিনা তার ব্যাপারে একটুও ভাবে না। নাতাশা তবুও বললো,
“ও বাসায় আছে। আমি আঙ্কেলকে তোর ব্যাপারে এখনো কিছু জানাই নি। জানালে শুধুশুধু চিন্তা করবে। ডাক্তার বলেছে, তুই জলদি সুস্থ হয়ে যাবি। আশা করি, ২ দিন পর নির্ধারিত তারিখেই আমাদের এনগেজমেন্ট সম্পন্ন হবে।”
আহির কিছুই বললো না। তার কেন জানি নেহার কথা মনে পড়লো। নেহা তাকে এই চরম বিপদের মুহুর্তে একা ফেলে গেছিল।

একজন মানুষকে কতোটা ঘৃণা করছে এত অসহায় অবস্থায় তাকে একা ফেলা যায় সেটাই ভাবতে থাকে আহির। যদিও তার কাছে এটায় কিছু যায় আসার কথা না। কিন্তু আজ কেন জানি, সে বিষয়টা হজম করতে পারছে না। সে নেহার সন্তানদের বাবা। তাদের মাঝে একটা বন্ধন তো আছেই, ১০ মাস এক ছাদের নিচে ছিল তারা। এসব কিছুর কি কোন মূল্য নেই নেহার কাছে। সেটাই ভাবতে লাগলো আহির। তার মাথা আরো গরম হয়ে গেল যখন মনে পড়লো নেহা তাকে সাহায্য না করলেও ঐ আরাভকে সাহায্য করেছিল। নিজের কাধে করে তাকে নিয়ে যাচ্ছিল। আচমকা আহিরের মুখবিবর শক্ত হয়। আরাভের প্রতি তার এমনিতেই যথেষ্ট রাগ ছিল। এখন সেই রাগ যেন চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছিল।
নাতাশা আহিরের রাগী চেহারা দেখে বলে,

“কি হলো আহির? কি ভাবছিস?”
আহির বলে,
“ঠিক বলেছিস তুই। এনগেজমেন্ট আর বিয়েটা জলদি সেরে ফেলতে হবে।”
অতঃপর সে নিজের মনকে বুঝ দিয়ে বলে,
“ঐ নেহা জাহান্নামে যাক,,,আমার কি? আমাকে নিয়ে ও যাই ভাবুক,,আই ডোন্ট কেয়ার। আমার কাছে ওর কোন গুরুত্ব নেই..কোন না।”
আসলেই কি নেই? প্রশ্নটা মনে আসতে আহির নিজেকে ধমকায়। আজকের ঘটনার পর সে কিছুতেই আগের মতো স্বাভাবিক গা-ছাড়া ভাব দেখাতে পারছিল না। বারংবার নেহার অবজ্ঞার কথা ভেসে আসছিল তার মনে। আহির এটা মানতেই পারছিল না যে, নেহা তাকে অবহেলা করে ঐ আরাভকে সাহায্য করেছে। এই অনুভূতি সামনে তার জীবনে যে এক বড় প্রভাব ফেলবে তা সহজেই অনুমেয়।

আরাভের জ্ঞান ফিরতেই সে নিজেকে আবিষ্কার করল হাসপাতালে। সে দ্রুত উঠে বসে বলল,
“নেহা..!”
একজন ডাক্তার এগিয়ে এসে বললেন,
“কাম ডাউন..আপনার চিকিৎসা চলছে। শুয়ে পড়ুন।”
আরাভ বলে,
“ডক্টর,,আমার নেহা কোথায়?”
“নেহা কে? আপনার ওয়াইফ?”
আরাভ থমকে যায়। নত স্বরে বলে,
“আমার কাজিন…ওর একটা মেয়েও আছে। আমার সাথেই ছিল।”
“ওহ, আপনি ঐ বাচ্চাটার মা কথা বলছেন? উনি পাশের কেবিনেই আছেন। বাচ্চাটা খুব কাঁদছিল। কারো নাম্বারও দিতে পারছিল না। আমাদের এক নার্স ওনাকে সামলাচ্ছে।”
আরাভ বেড থেকে উঠে দাঁড়ায়। ডাক্তার কিছু বলতে গেলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“আমি একদম ঠিক আছি ডক্টর। আমাকে আমার কাজিন ও তার মেয়ের কাছে যেতে হবে। ওদের সামলানোর জন্য আমি ছাড়া আর কেউ নেই।”

ডাক্তার আর আরাভকে থামাতে পারেন না। আরাভ বাইরে এসেই দেখতে পায় একজন নার্স ক্রন্দনরত নিয়াকে সামলাচ্ছে। আরাভকে দেখেই নিয়া ছুটে এসে বলে,
“মামা..ওরা আমাকে আম্মুর সাথে দেখা করতে দিচ্ছে না। আমার আম্মুর জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। তুমি প্লিজ ওদেরকে বলো, আমাকে যেন আম্মুর সাথে দেখা করতে দেয়।”
আরাভ নিয়াকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,
“চিন্তা করো না, আমি যেভাবে সুস্থ হয়ে ফিরলাম, তোমার আম্মুও ঠিক সেভাবেই ফিরবে।”
এমন সময় একজন ডাক্তার আসেন। আরাভ তাকে দেখে এগিয়ে গিয়ে বলে,
“আমার কাজিন নেহা কেমন আছে?”

“ওনার অবস্থা বেশি ভালো না,,,ফুসফুসের অনেক বড় একটা অংশ বিষাক্ত ধোঁয়া দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
“এটা কিভাবে হতে পারে ডক্টর? ওকে তো দেখে স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। এমনকি আমিই অসুস্থ হয়ে পড়ায় ও আমায় নিয়ে এসেছিল নিজের কাধে ভড় করে।”
“শুরুর দিকে ওনাকে স্বাভাবিক মনে হলেও ধোঁয়া ওনার ভেতরে যথেষ্ট প্রবেশ করে ওনার শ্বাসনালীকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। উনি অনেক বেশি সময় ধোঁয়ার মাঝে থাকায় এটা হয়েছে। এরকম রোগীর ক্ষেত্রে বাঁচার সম্ভাবনা কম। তবুও আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।”
আরাভ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। এরমধ্যে ডাক্তার বলেন,

“উনি আপনার আর ওনার মেয়ের সাথে কথা বলতে চাইছেন। আপনারা আসুন।”
আরাভ নিয়াকে কোলে নিয়ে চলে যায় নেহার সাথে কথা বলতে। তাদের দেখেই নেহা নিজের মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্কটা খোলে। নিয়া কাঁদছিল। নেহা আধো আধো স্বরে বলে,
“কেঁদো না..নিয়ামনি…তোমাকে এখন স্ট্রং হতে হবে।”
এরপর সে আরাভের দিকে তাকিয়ে আকুতির সাথে বলে,
“আমার কিছু হয়ে গেলে আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো আরাভ ভাই। তুমি ছাড়া যে ভরসা করার মতো আর কাউকে পাচ্ছি না।”
আরাভ বলে,

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪০

“কিচ্ছু হবে না তোর..তুই একদম ঠিক হয়ে যাবি।”
নেহার শ্বাসের গতি বাড়ে। ডাক্তার বলেন,
“আপনারা এখনই কেবিন থেকে বের হন। ওনার অবস্থার অবনতি হচ্ছে, আল্লাহকে ডাকুন। আল্লাহ ছাড়া ওনাকে বাঁচানোর ক্ষমতা এখন আর আমাদের কারো নেই।”
নেহার এই অবস্থা দেখে নিয়া ফুপিয়ে কাঁদছিল। আরাভ কোনরকমে নিয়াকে নিয়ে বাইরে আসে।

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪২