উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন পর্ব ৩৭
আফিয়া আফরোজ আহি
নিস্তব্ধতায় ঘেরা পুরো ড্রয়িং রুম। কোথাও নেই কোনো শব্দ। মনে হচ্ছে নীরবতা পালন করা হচ্ছে। মাথা নিচু করে ড্রয়িং রুমে সবার সামনে বসে আছি। মেজাজ পুরো খারাপ। ইচ্ছে করছে আদ্র কে হাতের কাছে পেলে ইচ্ছে মতো ধোলাই দিতাম। সেই সময়ের ঘটনা, রোশনি কথা গুলো বলে চলে গেল। আমি হতবাক, হতোভম্ব হয়ে বসে আছি। কি হচ্ছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না। আমাকে দেখে মনে হবে ঘোরের মাঝে ডুবে গিয়েছি। ইভা পাশ থেকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“কিরে কিছু বলছিস না কেন? রোবট হয়ে গিয়েছিস? নাকি অনুভূতিহীন হয়ে গেছিস?”
আমি ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। কি বলবো বুঝতে পারছি না। ইভা আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,
“রোদ শুনতে পাচ্ছিস ওই হাদারাম গাধা তোকে দেখতে এসেছে। কিছু কর আদ্র ভাইকে কল দে। তাকে জানা বিষয়টা”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এবার আমার ধ্যান ভাঙলো। হন্তদন্ত হয়ে ফোন খুঁজছি। অতঃপর পেয়েও গেলাম। হাত পা কেমন কাঁপছে। হটাৎ করে বুকের মাঝে আদ্র কে হারিয়ে ফেলার ভয় হচ্ছে। কাঁপা কাঁপা হাতে আদ্রর নাম্বার ডায়াল করলাম। প্রথমবার রিসিভ হলো না। ফের ফোন লাগলাম। রিসিভ করতেই উনাকে বলতে না দিয়ে তড়িৎ গতিতে বলে উঠলাম,
“আদ্র ভাই কোথায় তুমি? বাড়ি এসো জলদি”
ওপর পাশ থেকে শান্ত কণ্ঠে ভেসে এলো,
“আগে ভাই বলা বন্ধ কর। আমি তোর জামাই লাগি ভাই না”
“জামাইয়ের গুষ্টি কিলাই। তুমি ফাও পেচাল বাদ দেও। এখন আগে আমার কথা শোনো ঈশিতা আপুরা এসেছে বাসায়”
“ভালো তো, এখানে এতো হাইপার হওয়ার কি আছে। ওর বাবার বাড়ি ও বেড়াতে এসেছে”
এবার কিছুটা ঝাড়ি দিয়ে বলে উঠলাম,
“তুমি চুপচাপ আমার কথা শুনবে? নাকি কল কেটে দিবো”
“ঠিক আছে বল শুনছি”
“ঈশিতা আপুর শশুর-শাশুড়ি, তার দেবর চাচা শশুর-শাশুড়ি এসেছে আমাকে তাঁদের বাড়ির বউ করে নিয়ে যেতে”
ওপর পাশের মানুষটা নিশ্চুপ। তার কোনো কথা নেই। ওনার কোনো আওয়াজ না পেয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“শুনছো?”
“হ্যাঁ শুনেছি। তুই এতো হাইপার না হয়ে আগে এক গ্লাস পানি না। এই বেহুদা টেনশন করে যদি অসুস্থ হয়েছিস তাহলে তোর খবর আছ বলে দিলাম”
তার এই শান্ত রূপ এই মুহূর্তে আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করলো। মেজাজ এমনি খারাপ তার ওপর ওনার শান্ত রূপ মেজাজটাকে আরো খারাপ বানিয়ে দিচ্ছে।
“আমি তোমাকে কি বলছি আর তুমি কি বলছো?”
“তোকে আগে যেটা বলেছি সেটা কর। পানি খা”
আমি উঠে টেবিলে থেকে একগ্লাস পানি ঢেলে ঢক ঢক করে খেয়ে নিলাম।
“খেয়েছি, এখন বলো”
“এখন কল কেটে গোসল করে খেয়ে দেয়ে সুন্দর করে শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে ওদের সামনে যা, বাকিটা আমি দেখছি”
“তোমার মাথা ঠিক আছে? তুমি আবার ওতি শোকে পা*গল হওনি তো? আমি ওদের সামনে শাড়ি পড়ে যাই আর ওরা আমায় ওদের ছেলের বউ করে নিয়ে যাক আর তুমি বসে বসে দেখতে থাকো”
আদ্র ধমক দিয়ে বলে উঠলো,
“তোকে যেটা বলেছি সেটা কর। আমি আছিতো নাকি? আমি থাকতে তোর কিসের এতো টেনশন? পিচ্চি মাথায় এতো টেনশন না নিয়ে রিলেক্স থাক আমি আছি তো”
কিছু বললাম না।ওনার মনে হয় মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ওনাকে আমি বলছি এক উনি বুঝছেন আরেক। ফের বলল,
“মাথা থেকে এসব আউল ফাউল টেনশন ঝেরে গোসল করে খাওয়া দাওয়া করে শাড়ি পড়ে বউ সেজে রেডি হ। আমি আসছি”
রাগ করে কল কেটে দিতে যাবো এমন সময় তার বিরবির কণ্ঠে শুনতে পেলাম,
“বেটা বেশি বেড়েছে তাই না? আদ্রর রৌদ্রময়ীর দিকে হাত বাড়ানো জাস্ট ওয়েট। আমার বউকে বিয়ে করতে চাওয়ার শখ মিটিয়ে দিবো জনমের মতো”
আরো কিছু শুনবো তার আগেই কলটা কেটে গেল। আমি কি করব বুঝতে পারছি না। ইভা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি বলল আদ্র ভাই?”
“তোর আদ্র ভাই অতি শোকে পা*গল হয়েছে। আমাকে বলেছে সেজেগুঁজে ওদের সামনে যেতে”
ইভা ভাবুক হয়ে বলল,
“আদ্র ভাই যেহেতু বলেছে তারমানে সে নিশ্চই কোনো কিছু করবে। তুই চিন্তা করিস না”
ইভা নিজের রুমে চলে গেল। আমিও সকল চিন্তা বাদ দিয়ে গোসল করতে চলে গেলাম। বের হয়ে চুল মুছচ্ছি এমন সময় রুমে আম্মুর আগমন। হাতে কয়েকটা শাড়ি নিয়ে এসেছে। শাড়ি গুলো বিছানার ওপর রেখে বলল,
“এখান থেকে যে কোন একটা পড়ে রেডি হয়ে নে”
আম্মুর কথার বিপরীতে কিছু বললাম না। মাথা নাড়িয়ে সায় জানালাম। আম্মু অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো বুঝতে পারছে না তার মেয়ে এতো ভালো হলো কবে থেকে। কারণ কোনো প্রশ্ন ছাড়া এক কথায় রাজি হয়ে যাওয়ার মেয়ে আমি না। আম্মু কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে চলে গেল।
বিছানায় বসে শাড়ি গুলো উল্টে পাল্টে দেখছি এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপর পাশ থেকে আদ্র মহাশয়ের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
“শাড়িগুলোর মধ্যে যে নীল শাড়ি আছে ওটা পড়ে আসবি”
বলেই ফট করে কল কেটে দিলো। আমি বেক্কেলের মতো ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে রইলাম। এই লোক কি সত্যি সত্যি পা*গল হলো? নিজের বিয়ে করা বউকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে উনি তাঁদের বাধা না দিয়ে উল্টো তাঁদের সামনে পড়ে যাওয়ার জন্য আমায় শাড়ি সিলেক্ট করে দিচ্ছে? আমি শিওর এই লোক পা*গল হয়ে গেছে। রাগে বিরবির করতে করতে শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে নিলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাজল পড়ছি এমন সময় ইভা আর রোশনি রুমে ঢুকলো। দুজনের মুখে লেগে আছে হাসি। ওদের হাসি দেখে কপাল কুঁচকে গেল। একটু আগেই না ইভা মেজাজ খারাপ নিয়ে গেল। এতটুকু সময়ের মাঝে কি এমন হলো যে এদের মুখে বিশ্ব জয় করা হাসি লেগেছে আছে? কারণ কি? ওদের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
“কিরে হাসছিস যে? এতো হাসি আসছে কথা থেকে?”
“সেটা বলা যাবে না”
“কেন?”
রোশনি বলল,
“বড় আব্বু তোমায় নিয়ে যেতে বলেছে। সেখানে গেলেই বুঝতে পারবে”
বুঝতে পারলাম এদের জিজ্ঞেস করে কোনো লাভ নেই। তাই নিজেকে শেষ বারের মতো আয়নার দেখে নিয়ে বললাম,
“চল”
বলে সামনে আগাতে নিলে ইভা আটকে দিলো। কপাল কুঁচকে ওর দিকে তাকালাম।
“মাথায় কাপড় না দিয়ে কোথায় যাচ্ছিস? আগে মাথায় কাপড় দে”
“এমনি মেজাজ খারাপ, তুই আর খারাপ করিস না”
ইভা কিছু না বলে নিজ দায়িত্বে মাথায় কাপড় দিয়ে দিলো। দুজন দুপাশ থেকেই ধরে নিয়ে যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে আমি হাঁটতে পারিনা। তাও কিছু বললাম না। চুপচাপ ওদের সাথে যেতে লাগলাম। আমায় নিয়ে ইভা সিঙ্গেল সোফায় বসিয়ে দিলো। ইচ্ছে নেই মুখ তুlলে সামনের মানুষ গুলোকে দেখার। মাথ নিচু করে বসে আছি। তবে আশেপাশে সবাইক যে আমার দিকে তাকিয়ে আছে সেটা বুঝতে পারছি। নিজেকে কেমন ভিন্ন গ্রহের প্রাণী মনে হচ্ছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। হটাৎ কেউ বলে উঠলো,
“মা মুখটা একটু তোলো তো, তোমার চাঁদ বরণ মুখটা একটু দেখি”
কণ্ঠস্বরটা আমার বড্ড চেনা। তড়িৎ গতিতে মুখ তুলে তাকালাম। সামনের মানুষ গুলো যে আমার বড্ড কাছের। আমার সামনে ফুপ্পি, ফুফা, আরু,আদ্র আর আদ্রর দাদুমনি বসে আছে। আমি অবাক চোখে তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছি। ওরা কখন এলো? আর এখানেই বা কি করছে? এখানে তো এই হাদারাম গাধা আর তার ফ্যামিলির থাকার কথা ছিলো। আর আমার সাথে হচ্ছে টাই বা কি? আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি বাস্তব। আমার অবস্থা দেখে সবাই একসাথে উচ্চস্বরে হেসে দিলো। ওদের হাসতে দেখে কিছুই বুঝতে পারলাম না।
নিজেকে কেমন ভিন্ন গ্রহের প্রাণী মনে হচ্ছে। এখানে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। সব কেমন মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। আড়চোখে তাকালাম আদ্রর দিকে। মহাশয় আয়েস করে সোফায় গাঁ এলিয়ে বসে আছে। আদ্রর পরনে কালো শার্ট কালো প্যান্ট, কোর্ট খুলে পাশে রাখা, একদম ফর্মাল লুক যাকে বলে। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো, হাতে কালো ঘড়ি, চুলগুলো গুছিয়ে রাখা পুরো হিরোর মতো লাগছে। ওনার বসার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে শশুরবাড়ি এসেছে এমন ভাব তার। ভেবে দেখলাম এটা তো তার শশুর বাড়িই। আদ্র সবার চোখের আড়ালে চোখ টিপে দিলেন। আমি রক্তিম চোখে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। ফুপ্পি গম্ভীর মুখ করে বলে উঠলো,
“বড়দের সামনে এসে সালাম দিতে হয় এটা জানো না? ভদ্রতা শেখোনি?”
ফুপ্পির কথা শুনে জিভে কামড় দিলাম। এদের একেক জনের একেক রূপ দেখে ক্ষনে ক্ষনে অবাক হচ্ছি। আজ মনে হয় আমার অবাক হওয়ার দিন। মিনমিনে স্বরে সালাম দিলাম। সালামের উত্তর দিয়ে দাদুমনি বলে উঠলো,
“তা মেয়ে ঘরের সব কাজ জানো তো? রান্না বান্না, ঘর সামলানো”
“জি পারি”
ফুপ্পি ফের জিজ্ঞেস করলো,
“মেয়ে একটু হেটে দেখাও তো? আর চুলগুলো দেখি তো কতোটুকু। এখনকার মেয়েদের মতো কেটে ছোটো করে ফেলোনি তো? আমার ছেলের আবার লম্বা চুলের মেয়ে পছন্দ”
ফুপ্পি কথাগুলো বলে মিটিমিটি হাসছে। ইভা মাথা থেকে কাপড় সরিয়ে চুলের ক্লিপ খুলে দিলো। সাথে সাথে চুলগুলো ঝরঝর করে পিঠে ছড়িয়ে গেল। উঠে সুন্দর করে হেটে দেখালাম।
“হয়েছে বসো বসো। না চুল মাশাআল্লাহ লম্বাই আছে”
ভদ্র মেয়ের মতো যেয়ে বসে পড়লাম। এরা একেক জন একেক কথা জিজ্ঞেস করছে আর আমি বসে বসে সেগুলোর উত্তর দিচ্ছি। আদ্রর দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। আমার অবস্থা দেখে হাসা হচ্ছে তাই না? সব হাসি আমি বের করবো, অ*সভ্য লোক কোথাকার! হুট্ করে ফ্লায়িং কিস ছুড়ে দিলেন। চোখ গরম করে ওনার দিকে তাকালাম। উনি সেটাকে পাত্তা না দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসলেন। আমি পারছি না ওনার চুল গুলো টেনে দিতে। বজ্জাত লোক একটা। এগুলো যে ওনার বুদ্ধি সেটা বুঝতে দেরি হলো না। সব আমায় হেনস্থা করার পয়তারা। ওয়েট সব সুধে আসলে তুলবো। বাকি সবার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওরাও মুচকি মুচকি হাসছে। আমি তাকাতেই সবাই চুপ করে গেল। সব প্রশ্ন শেষে ফুফা বলল,
“ভাই সাহেব আপনাদের মেয়ে আপনাদের পছন্দ হয়েছে। এখন দুজন কে আলাদা করে কথা বলতে দিলে ভালো হয়। ওদের টা ওরা বুঝে নেক”
বড় আব্বু ফুফার কথায় সম্মতি জানিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“রোদ মা আদ্র বাবা কে নিয়ে তোমার রুমে যাও তো”
উঠে গট গট পায়ে হাঁটা দিলাম। পিছু পিছু ইভা রোশনি আর আদ্র এলো। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। দরজার সামনে থেকে ফিসফিস কণ্ঠে শুনতে পেলাম ইভা বলছে,
উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন পর্ব ৩৬
“গুড লাক ভাইয়া। ভিতরে তোমার জন্য বারুদ অপেক্ষা করছে। বেঁচে ফিরলে দেখা হবে”
“এভাবে ভয় দেখাচ্ছিস কেন? দোয়া কর যেন বেঁচে ফিরতে পারি। আর না ফিরলে দুয়া মে ইয়াদ রাখনা”
আদ্র দুঃখি দুঃখি মুখ করে কথা গুলো বলল। অতঃপর ওদের বিদায় দিয়ে বুকে ফুঁ দিয়ে রুমে ঢুকলো।