উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন সিজন ২ পর্ব ৩২
আফিয়া আফরোজ আহি
সকালের মিষ্টি রোদের আলোয় ঝলমল করছে পরিবেশ। আশেপাশে মানুষের আনাগোনা। নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ, প্রায় সব কিছুই নতুন। এই নতুনের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছি আমি। মেডিকেলে ক্লাসে শুরু হয়ে গেছে সপ্তাহ খানেক হবে। ক্যাম্পাস, নতুন বন্ধু বান্ধবী সব মিলিয়ে কেটে গেছে প্রথম তিনটে দিন। এরপর শুরু হয়েছে পড়াশোনার প্রেসার। শুভ ভাই প্রথমেই বলে দিয়েছে পড়ায় বেশি গ্যাপ পড়লে পিছয়ে পড়তে পারি। যেদিনের টা সেদিনই শেষ করতে। নতুন সব কিছু, এতো কিছুর মাঝে কারো সাথে সেভাবে কথা হচ্ছে না। ক্লাস শেষে বাড়ি আসতে আসতে দুপুরে পেরিয়ে বিকেল হয়ে যায়। তখন এসে শরীর নেতিয়ে পড়ে।
ইচ্ছে করেনা কিছু করতে। ক্লান্ত শরীরে কোনো মতে খেয়ে দেয়ে ঘুম। ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসা। মাঝে টুকটাক আড্ডা এই মিলেই দিন কেটে যাচ্ছে।
কয়েকদিন যাবত সবার আচরণ কেমন যেন লাগছে। ঈশিতা আপুর বিয়ের পর থেকেই মনে হচ্ছে বাড়িতে কিছু একটা হচ্ছে যেটা আমি জানি না। জানি না বললে ভুল হবে। আমায় জানতে দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু কি হতে পারে বিষয়টা? সবাই মিলে দিব্বি কথা বলছে আমি গেলেই তাদের আড্ডা শেষ। সবাই হুট্ করে চুপ মেরে যায়। অতঃপর শুরু করে অন্য টপিকে কথা বলা। এমন ভাব যেন আমি শুনে ফেললে মহা ভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে। আজব! কি সব ঘটছে আমাত্র আশেপাশে। শুধু আপুরা না আম্মুরাও শুরু করেছে। আমি না থাকলে সবাই একসাথে কি যেন গুজুর গুজুর করে। আমি গেলেই চুপ। কুচ তো খিচড়ি পাক রাহি হে। কিন্তু কি? কি হতে পারে! ওদের কথা জানার জন্য প্রথম প্রথম আগ্রহ জাগলেও এখন আর ইচ্ছে হচ্ছে না। ওরা যেহেতু আমায় জানাতেই চাচ্ছে না তাহলে আমার কি এমন ঠ্যাকা পড়েছে ওদের কথা শোনার? শুনবো না ওদের কথা, না শুনলে আমার কি হবে? কিছুই হবে না। নিজেই নিজেকে এই বলে সান্তনা দিচ্ছি।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
ইদানিং আরো একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম। এই বজ্জাত আদ্র ভাইও কল দেওয়া ভুলে গেছে। আগে দিনে পাঁচ থেকে দশবার কল দিতো। কি করছি, খেয়েছি কিনা? বাসায় পৌঁছেছি কিনা সব বিতন্ত জিজ্ঞেস করতো। আর এখন দিনে একবার কি বেশি হলে দুবার। তাও আবার আগের মতো কথাও বলে না। আগে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত কলে থাকতে থাকতে। আর এখন সর্বোচ্চ দশ মিনিট। অর বেশি কথা বিগত সপ্তাহে হয়নি। মন মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। আচ্ছা আদ্র ভাই কি আমায় ইগনোর করছে? নাকি উনি অন্য কাউকে…? ছিঃ! ছিঃ! আমি এসব কি ভাবছি! আদ্র ভাই এটা করতেই পারে না। হঠাৎ চোখের কোণে পানি জমলো। অভিমান হলো বড্ড। তবে কি আমি ওনার কাছে পুরোনো হয়ে গেছি? মানুষ বলে সম্পর্ক পুরোনো হবে অবহেলা শুরু হয়। আদ্র ভাই কি তবে আমায় অবহেলা করছে?
উনি কি জানে না আমি ওনার অবহেলা সহ্য করতে পারিনা? শুধু ওনার কেন কেউ আমায় সামান্য তম অবহেলা করলেও সেটা আমার সহ্য হয় না। বার বার মনে হয় আচ্ছা আমি কি কোনো ভুল করেছি? মানুষটা আমায় কেন অবহেলা করছে? কারণ কি হতে পারে? এই টেনশনে দিন কেটে যায়, ডিপ্রেশনে চলে যাই। সেখানে আদ্র ভাইয়ের সামান্য অবহেলাও মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সহজ না। ভাবানার মাঝে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো। বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। এমন সময় পাশে রাখা ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে জ্বল জ্বল করছে প্ৰিয় নাম“আদীব চৌধুরী আদ্র”। একটু আগেও মানুষটার কথা ভাবে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠছিলো আর এখন কান্না পাচ্ছে। তুলবো না ওনার ফোন। কথা বলবো না। আমায় ইগনোর করেছো এখন আমিও ইগনোর করবো। ফোন ধরবো না। কথাও বলবো না। কিছু করবো না। পর পর দশ বারের মতো ফোন করেছে, এরপর শুরু হলো ম্যাসেজের বর্ষণ। একের পর এক ম্যাসেজ এসেই চলেছে। লাস্ট ম্যাসেজ টা এমন,
“রোদ জান ফোন তুলছিস না কেন? কি করেছি আমি? ফোন তোল প্লিজ। আই রিকোয়েস্ট ইউ, প্লিজ ফোনটা তোল। তুই কি ফোন তুলবি নাকি আমি আসবো সেটা বল? আমি আসলে কিন্তু তোর খবর আছে বলে দিলাম”
আদ্র ভাইয়ের আবেগ ঘন ম্যাসেজ। শেষ লাইন পড়ে ঢোক গিললাম। এতো পুরো হু*ম*কি। এখন ফোন না তুললে নিঃঘাত আমায় মাথায় তুলে এছাড়া দিবে। ফোন বেজে উঠতেই কোনো কথা না বাড়িয়ে রিসিভ করে নিলাম। ওপাশ থেকে ঝাজালো কণ্ঠ,
“কি সমস্যা? ফোন তুলছিস না কেন? আমাকে কি মনে হয় তোর? পা*গল আমি? টেনশন হয়না আমার? নাকি আমায় এভাবে টেনশনে রেখে তুই শান্তি পাস? কোনটা বল? একের পর এক ফোন দিচ্ছি তুলছিস না কেন? কি হলো কিছু বলছিস না কেন?”
ধমকের সাথে কথা গুলো বলল উনি। আদ্র ভাইয়ের কথার পৃষ্ঠে কোনো জবাব দিলাম না। এতক্ষনের জমে থাকা অভিমানের পারদ আরো বাড়লো। আদ্র ভাই উত্তর না পেয়ে অবাক হলো বোধ হয়। সাধারণত একটা ঝাড়ি মারলে আমি উল্টো দশটা ঝাড়ি মেরে বসিয়ে দেই। আর আজ চুপ তাই চমকানরই কথা। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো। অতঃপর নরম সুরে বলল,
“সরি জান। আমার ভুল হয়ে গেছে। কি করবো বল? এতো বার ফোন দিয়েছি কিন্তু তুই ফোন তুলছিলিস না তাই মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। সারাদিনে তোর কণ্ঠস্বর না শুনে নিজেকে উন্মাদ উন্মাদ লাগছিলো। সরি, কি হয়েছে বল?”
তাও কোনো জবাব দিলাম না। এতক্ষন ঝাড়ি দিয়ে এখন এসেছে ভালোবাসা দেখাতে! লাগবে না আমার ভালোবাসা!
“রাগ করেছিস? সরি বললাম তো ইয়ার, এবার অন্তত রাগ করে থাকিস না প্লিজ”
“আমি রাগ করলেই বা কি আর না রাগ করলেই বা কি? আপনার কিছু যায় আসে? আপনি তো ব্যাস্ত মানুষ! আপনার দেখাই পাওয়া যায় না। এখন পুরোনো হয়ে গেছি তো এখন আর ভালো লাগবে না এটাই স্বাভাবিক! যাকে নিয়ে ব্যাস্ত আছেন তাকেই সময় দেন। আমায় কল দেওয়ার প্রয়োজন নেই। রাখছি”
ওনাকে কিছু বলতে না দিয়ে মুখের ওপর কল কেটে দিলাম। ফোন কেটে সুইচ অফ করে রাখলাম। এবার কিছুটা শান্তি লাগছে। আমায় ইগনোর করা তাই না? এবার বোঝো ইগনোর কাকে বলে। ফুরফুরে মেজাজে ব্যালকনিতে দোলনায় বসে পা দোলাচ্ছি। রুমে ইভা প্রবেশ করলো। আমার কাছে এসে ফোন বাড়িয়ে দিলো। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
“তোর ফোন আমায় দিচ্ছিস কেন? তোর ফোন দিয়ে আমি কি করবো?”
“ফোন অফ করেছিস কেন? ভাইয়া কল দিচ্ছে রিসিভ ও করছিস না। কি হয়েছে?”
“তোর এতো কিছু জানতে হবে না। তুই যা”
“আদ্র ভাই লাইনে আছে কথা বল”
“আমি ওনার সাথে কথা বলবো না। ওনাকে বলে দে যাকে নিয়ে ব্যাস্ত আছে তাকে নিয়েই থাকতে। আমাকে দিয়ে কি কাজ?”
ইভা কিছু বলবে তার আগে ওপাশ থেকে কল কেটে দেওয়া হয়েছে। ইভা আমার দিকে তাকিয়ে হতাশার শ্বাস ফেলে বলল,
“কি শুরু করেছিস ইয়ার? বেচারা কে প্যারা কেন দিচ্ছিস?”
“উনি আমার ইগনোর করেছে আমিও করছি। ব্যাস, সমান সমান”
“ভাইয়া হয়তো ব্যাস্ত আছে”
“ওনার ব্যাস্ততার নিকুচি করেছি। আবার বুঝুক ইগনোর করলে কেমন লাগে”
“তোকে বুঝিয়ে লাভ নেই”
ইভা চলে গেল। অদ্ভুত কাণ্ড! আমায় বুঝিয়ে লাভ নেই মানে কি? আমি কি বাচ্চা যে বুঝালেও বুঝবো না? ওরা বুঝাতে চায় কি?
রাতে খাওয়া শেষে আয়নার সামনে বসে চুল আচড়াচ্ছি। সমস্ত মনোযোগ চুল আঁচড়ানো তে। ধরাম করে শব্দ হলো। পিছনে ফিরে দেখলাম আদ্র ভাই দরজার লাগাচ্ছেন। তাড়াহুড়ো করে দরজা আটকে দ্রুত গতিতে কাছে এসে আমায় বসা থেকে এক টানে দাঁড় করিয়ে অধরে অধর মিলিয়ে দিলেন। ঘটনা গুলো এতো তাড়াতাড়ি ঘটে যাওয়ায় কিছু বুঝতে পারলাম না। যতক্ষণে খেয়াল হলো ততক্ষনে আমি পুরো পুরি আদ্র ভাইয়ের আয়ত্তে। ওনার বুকে ধাক্কা দিয়ে চলেছি। কিন্তু লাভ কিছুই হচ্ছে না। উনি শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরেছে। ওনাকে নিজের থেকে এক ইঞ্চি ও সরাতে পারিনি। মিনিট দুই বাদে ছেড়ে দিয়ে কপালে কপাল ঠেকালেন। মৃদু কণ্ঠে বললেন,
“কি সমস্যা? এখন বল”
কোনো কথা না বলে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। আদ্র ভাই গাল চেপে ধরে ওনার দিকে ফেরালেন।
“তোর সমস্যা টা কি? আমায় বলবি?”
“আপনার সময় হবে না আমার কথা শোনার। ছাড়ুন আমায়”
উনি উপহাস করে বলল,
“বাহ্! বেশ উন্নতি হয়েছে তো! তুমি থেকে আপনি? উন্নতির কারণ জানতে পারি?”
“আমি আপনাকে বলতে বাধ্য নোই। আমাকে ছাড়ুন আর সারাদিন যাকে নিয়ে ব্যাস্ত ছিলেন তার কাছে যান”
আদ্র ভাই মাথায় চাপর দিলো। বললেন,
“এই ভুত মাথায় ঢুকলো কিভাবে? কে ঢুকিয়েছে?”
“কেউ না, আপনি সরুন”
উনি সরা তো দূর আরো এক ধাপ এগিয়ে এলেন। আমি যতো ছাড়তে বলছি ততো বেশি আঁকড়ে ধরছে।
“তুই যতক্ষণ না বলবি ততক্ষন ছাড়ছি না”
একটু থেকে আদুরে কণ্ঠে বলল,
“কি হয়েছে আমায় বলবি না রৌদ্রময়ী? তোর আদ্র কে বলবি না? আমি কি করেছি বলবি তো? হঠাৎ এমন রাগ করে আছিস কেন? আমি কি কোনো ভুল করেছি? আমার কোনো কাজের তোর খারাপ লেগেছে? বল আমায়?”
আদ্র ভাইয়ের আদুরে কথায় মন কিছুটা গলে গেল। অভিমান মিশ্রিত কণ্ঠে বলে উঠলাম,
“আপনি আমায় ইগনোর করছেন কেন?”
আদ্র ভাই কৌতূহলী গলায় সুধালো,
“আমি তোকে ইগনোর করলাম কখন?”
“এইযে ইদানিং আগের মতো কল দিচ্ছেন না। আমার খোঁজ খবর নিচ্ছেন না। আর কল দিলেও কয়েক মিনিট কথা বলার পরই কল কেটে দেন। সারাদিন এতো কিসের ব্যাস্ততা আপনার? আমার জানামতে অফিসে এখন এতো কাজের প্রেসার নেই। নিশ্চই নতুন কাউকে পেয়েছেন এই জন্য আমায় ইগনোর করছেন। ইগনোর তো করবেনই। আমি এখন পুরোনো হয়ে গেছি না, এখন তো আর আমায় ভালো লাগবে না। এখন সুন্দরী সুন্দরী মেয়ে ভালো লাগবে। সরুন আপনি আমার কাছ থেকে, দূরে যান”
আমার কথা শুনে উনি উচ্চ স্বরে হেসে দিলো। হাসতে হাসতে আমায় ছেড়ে বিছানায় বসলো। হাসি থামিয়ে ইশারা করলো পাশে বসার জন্য। আমি তাও দাঁড়িয়ে আছি। উনি আচমকা এক টানে কোলে বসিয়ে দিলো। পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে থুতনি ঠেকালেন। অতঃপর বলল,
“আমার বোকা রানী তুই কি করে ভাবলি আমি তোকে রেখে অন্য কারো কাছে যাবো? যেখানে দীর্ঘ দশটা বছর এক পাক্ষিক তোকে ভালোবেসে গেছি, তাও তোর মনে আমায় নিয়ে সামান্য অনুভূতি নেই জেনেও। তার পরও কিভাবে ভাবলি?”
“ভাববো নাতো কি করবো? তুমিই তো আগের মতো কল বা ম্যাসেজ দিচ্ছিলে না!”
আদ্র ভাই উল্টে বললেন,
“আমি দেই নি মানলাম আমি ইগনোর করছি। কিন্তু তুই দেস নি কেন?”
ওনার এক প্রশ্নে চুপ মেরে গেলাম। উনি খোঁচা মেরে বলল,
“কি হলো বল? উত্তর দে এখন চুপ কেন?”
তোতালানো কণ্ঠে বললাম,
“আমি দেই নি কারণ আমি! আমি তোমার কলের অপেক্ষায় ছিলাম”
আদ্র ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“জানিস রৌদ্রময়ী আমরা নিজেদের ভুল না দেখলেও অন্যের ভুল ধরতে মুখিয়ে থাকি, এটাই বাস্তবতা”
উনি যে আমায় খোঁচা মেরে বলল এটা বুঝতে সময় লাগলো না। সত্যিই তো ভুল টা আমারই ছিলো। উনি ফোন দেয় নি তো কি হয়েছে? আমি তো দিতে পারতাম। তা না দিয়ে উল্টো ওনাকে বাজে কথা শোনালাম। গিল্টি ফিল হচ্ছে। মিন মিনে কণ্ঠে বললাম,
উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন সিজন ২ পর্ব ৩১
“সরি”
“সরি বলছিস কেন?”
“আমি খামোখাই তোমার ওপর রাগ ঝাড়লাম”
“বাদ দে”
একটু থেমে বলল,
“একটা কথা কি জানিস?”
উৎসুক হয়ে তাকালাম। আমার তাকানো দেখে উনি মুখ কিছুটা এগিয়ে আনলো। অতঃপর ফিসফিসিয়ে বলল,
“রাগলে তোকে হেব্বি লাগে। একদম পাক্কা টস টসে টমেটোর ন্যায়। ইচ্ছে করে কামড়ে কুমরে খেয়ে ফেলি। কি বলিস খেয়ে ফেলবো নাকি?”
নাক সিটকে বললাম,
“ছিঃ! যতো সব অশ্লীল কথা”
আমার কথার ধরণের উনি শব্দ করে হেসে দিলো। ওনার হাসি দেখে নিজেও হেসে দিলাম।