উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন সিজন ২ পর্ব ৪

উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন সিজন ২ পর্ব ৪
আফিয়া আফরোজ আহি

নিস্তব্ধতার শহরে আমি এক উন্মাদ, যে ব্যাস্ত স্মৃতি চারণে। আশেপাশে সামান্য শব্দের অস্তিত্ব নেই। শুনশান চারপাশ, নেই কোনো কোলাহল। ব্যাস্ত শহর কেমন যেন থমকে গেছে, থেমে গেছে শব্দের আলোড়ন। ব্যালকনি জুড়ে ফুলের মিষ্টি ঘ্রান, মন মাতানো হাওয়া কোনো কিছুই আমায় তাঁদের দিকে টানতে পারছে না। আমি ডুবে আছি এক ঘোরের মাঝে। সন্ধ্যার পর থেকে ঘটনা গুলো কেমন অবাস্তব মনে হচ্ছে। এখনো মাথাই ঢুকছে না কি থেকে কি হয়ে গেল? ইভান ভাই বিয়ে করে নিয়ে এসেছে? এটা কি সত্যি? নাকি স্বপ্ন? নাকি আমার মনের ভ্রম। আচ্ছা এমন কি হতে পারেনা এটা স্বপ্ন? ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখবো সব আগের মতো। এটা কি সম্ভব? নিজেকে কেমন যেন লাগছে। কোনো অনুভূতিই হচ্ছে না। নিজেকে অনুভূতি শুন্য মনে হচ্ছে।

পুরো আকাশ কালো মেঘে ঢেকে আছে। কেমন গুমোট পরিবেশ। চোখ পড়লো ইভান ভাইয়ের ব্যালকনির দিকে। ব্যালকনিটা এখনো ফাঁকা। দরজা ভিতর থেকে লাগানো। ইভান ভাই আর ওই মেয়েটা কি বাড়িতে আছে নাকি চলে গেছে? আচ্ছা আজ তো তাঁদের বাসর? ইভান ভাই কি মেয়েটাকে তার ভালোবাসায় মুড়িয়ে দিবে? দেওয়ারই কথা তার ভালোবাসার মানুষ বলে কথা। নাহলে উনি কিভাবে পাড়লেন আমায় স্বপ্ন দেখিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতে। যদিও ইভান ভাইতো একবারও আমায় বলেন নি আমায় ভালোবাসে। এটা সম্পূর্ণ আমার ধারণা। ওনার কি একটা বারের জন্যও আমার কথা মনে পড়েনি? হাহ, মনে পড়বেই বা কেন? আমি তার কে? সত্যিই কি আমি তার কেউ নোই? উনি যদি ওই মেয়েটাকেই ভালোবেসে থাকে তাহলে কলে আমায় তার বলার কথা গুলোতে এতো উচ্ছাস, অনুভূতি মিশানো মনে হলো কেন? কেন আমায় করা তার শাসন, বারণ?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ভাবানারা মাথার মধ্যে কিলবিল করছে। একটা বেপার লক্ষ্য করলাম এইযে ইভান ভাই মানুষটা অন্য কাউকে বিয়ে করেছেন তবুও আমার কেন যেন কোনো অনুভূতি হচ্ছে না। কান্না পাচ্ছে না। আমি মানুষটা বরাবরই আবেগ প্রবন মেয়ে। কেউ আমায় আঘাত করলে হৃদয় ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেই মতে আমার তো এতক্ষনে কেঁদে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু আমার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি ও পড়ছে না। তবে কি আমি অতি শোকে পাথর হয়ে গেলাম? কে জানে? হয়তো পা*গল হয়ে গেছি।

ভাবানার মাঝে মসজিদের মাইকে আজানের সুর ভেসে এলো। এক প্রান্ত ফ্লোরে লুটোপুটি খাওয়া ওড়না তুলে মাথায় দিলাম। মনের মাঝে দ্বিধা দ্বন্দ্ব চলছে। আমার এখন মানসিক শান্তি প্রয়োজন। রুমে এসে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লাম। ফ্রেশ হয়ে একেবারে ওযু করে বের হলাম। নামাজ আদায় করে ফের ব্যালকনিতে চলে এলাম। ধীরে ধীরে রাতের আঁধার কাটিয়ে আলোয় আলোয় সেজে উঠছে ধরনী। হুট্ করে ইচ্ছে হলো সূর্য ওঠা দেখবো। যেই ভাবা সেই কাজ। গাঁয়ে ভালো ভাবে ওড়না জড়িয়ে বাড়িয়ে পড়লাম ছাদের উদ্দেশ্যে। ছাদের দরজা খোলাই ছিলো। ছাদে পা রাখতেই দমকা হাওয়া পুরো শরীর ছুঁয়ে গেল। হাল্কা ঠান্ডা অনুভুত হচ্ছে। এগিয়ে গেলাম ছাদের রেলিংয়ের দিকে। আঁধারে মোরা শহর ধীরে ধীরে আঁধার কাটিয়ে আলোয় সেজে উঠছে। নতুন ভাবে, নতুন রূপে। প্রকৃতির সৌন্দর্য অপরূপ, যতই দেখি চোখে ফেরানো দায়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাই। গভীর বন জঙ্গল পেরিয়ে পাহাড়ের মাঝে যেখানে থাকবে না কোনো যান্ত্রিক কোলাহল, থাকবে পাখির কিচির মিচির শব্দ। শুধু আমি আর প্রকৃতি। বিষয়টা অনেক ইন্টারেস্টিং।

আমি এক মনে আশপাশটা দেখছি। আবার সেই কোলাহল, সড়কে জমে উঠছে গাড়ি আর জনমানবের ভীড়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে সেই পুরোনো ব্যাস্ততা। চোখ বুজে অনুভব করছি সময়টা। হুট্ করে মনে হলো কেউ সিঁড়ি বেয়ে আসছে। ধূপধাপ পা ফেলে। তবে আমি চোখ খোলার প্রয়োজন বোধ করলাম না। আগের ন্যায় চোখ বুজে রইলাম। অনুভব করতে লাগলাম পরিবেশটা। মানুষটা আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। এবার চোখ মেলে চাইলাম। সামনে আদ্র ভাই দাঁড়িয়ে আছে। ঘেমে গেছে মানুষটা। শ্বাস নিচ্ছে অস্বাভাবিক ভাবে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। হাঁটুতে হাত রেখে হাঁপাচ্ছেন। দেখে মনে হচ্ছে দৌড়ে এসেছেন। হুট্ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চট করে আমার মাথাটা তার বুকে চেপে ধরলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

“তু্ই এখানে দাঁড়িয়ে চোখ বুঝে আছিস? আর পুরো বাড়ি তোলপাড় হয়ে গেছে তোর জন্য”
আমি মিশে আছি আদ্র ভাইয়ের বুকের সাথে। আদ্র ভাইয়ের হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি হার্ট বাবাজি বেরিয়ে আসবে। ওনার হাত, পা ও মাত্রাতিরিক্ত কাঁপছে। আদ্র ভাইয়ের কথার মানে বুঝতে না পেরে বললাম,
“কেন? আমাকে নিয়ে বাড়ি তোলপাড় হওয়ার কি আছে?”
আদ্র ভাই বলা শুরু করলেন,
“মেঝ আম্মু ঘুম ভেঙ্গে তোকে রুমের কোথাও না দেখে খোজা শুরু করলো। কিন্তু এক পর্যায়ে তোকে না পেয়ে মেঝ আম্মু কান্না করা শুরু করলো। মেঝ আম্মুকে ডাকতে এসে বড় আম্মু, মেঝ আম্মু কান্না করতে দেখে ঘাবড়ে গেলেন। সবাইকে ডাকা শুরু করলেন। বড় আম্মুর ডাকাডাকিতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। বড় আম্মুর গলার স্বর তোর রুম থেকে পেয়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাড়াহুড়ো করে ছুটলাম তোর রুমে। হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

“কি হয়েছে মেঝ আম্মু? তুমি কান্না করছো কেন?”
মেঝ আম্মু কান্না করতে করতে বললেন,
“রোদ রুমে নেই। আমার অসুস্থ মেয়েটা কোথায় গেল?”
ফের মেঝ মামুকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমার মেয়েকে এনে দেও। তোমাদের জন্য কাল আমার মেয়ে এতো বড় একটা ধাক্কা খেয়েছে। মেয়ে আমার কিছু করে বসলে তোমার খবর আছে। আমার রোদকে এনে দেও”
ততক্ষনে পুরো বাড়ির সবাই লেগে গেছে তোকে খুঁজছে। পুরো বাড়ি খুঁজেও যখন তোকে পাওয়া গেল না তখন মামুরা বেরিয়ে গেল বাড়ির বাহিরে খুঁজতে। হুট্ করে আমার মনে হলো তু্ই ছাদে আসতে পারিস। তাই সেকেন্ড ব্যায় না করে চলে এলাম”

আদ্র ভাই থামলেন। হাপাচ্ছেন উনি। একে তো সদ্য ঘুম থেকে উঠেছেন। তার ওপর এভাবে দৌড়া দৌড়ি করেছেন।
“আমাকে খোঁজার কি আছে? আমি তো ছোটো বাচ্চা নোই যে হারিয়ে যাবো”
আদ্র ভাই মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
“সেটা তু্ই বুঝবি না গ*বেট। এটা যদি বুঝতি তাহলে তো হতোই। এখন বল এখানে কি করছিলি?”
“ইচ্ছে করছিলো সূর্য ওঠা দেখব তাই চলে এলাম”
“এখন নিচে চল। সবাই তোকে খুঁজছে”
“চলো”

আমি আর আদ্র ভাই নিচে নেমে এলাম। আমায় দেখে আম্মু এক ঝটকায় জড়িয়ে ধরলো। আম্মুকে দেখে মনে হচ্ছে পারলে আমাকে কলিজায় ঢুকিয়ে নিবে। আমায় এক মুহূর্তের জন্য ছাড়ছেন না। কপালে চুমু দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তু্ই ঠিক আছিস সোনা? কোথায় গিয়েছিলি?”
“আমি ঠিক আছি আম্মু। ছাদে গেছিলাম, রুমে ভালো লাগছিলো না তাই”
আব্বুদের ফোন করে জানানো হলে তারা চলে এলো। একে একে সবাই এসে জিজ্ঞেস করছে, ” “কোথায় গিয়েছিলাম? কাউকে বলে যাইনি কেন?”

আরো কতো কতো প্রশ্ন! সবার এতো আকুলতা দেখে মনে শান্তি লাগছে। ইভান ভাই আমায় ভালো না বাসলেও আমার পুরো পরিবার আমায় ভালোবাসে। আর কি চাই আমার? আম্মু আমায় বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল,
“তু্ই বস, আমি তোর জন্য খাবার নিয়ে আসছি। কাল রাত থেকে তো কিছুই খাসনি”
সবার মাঝে এক কোণে ইভান ভাইকে খেয়াল করলাম। এক সেকেন্ডের মাঝে আবার উধাও হয়ে গেল। একে একে সবাই রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আমি ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। চোখ বুজে আসছে। ঘুম জেঁকে বসেছে চোখের পাতায়। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার ফল এটা। চাদর গাঁয়ে টেনে শুয়ে পড়লাম। খানিক ক্ষণের ব্যাবধানে পাড়ি জমালাম ঘুমের দেশে।

ঘুম ভাঙলো প্রায় দশটা নাগাদ। চোখ কচলে উঠে বসলাম। ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতেই চোখ পড়লো ইভান ভাইয়ের দিকে। বজ্জাত বেটা বসে আছে। পায়ের ওপর পা তুলে নবাব জাদার মতো। হাতে ফোন, ব্যাস্ত হাতে স্ক্রিনের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছেন। কাল যে উনি এতো বড় একটা ঘটনা ঘটিয়েছেন সেটা ওনাকে দেখে মনেই হচ্ছে না। মুখের ভাব ভঙ্গি স্বাভাবিক। ওনার থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। বিবাহিত বেডার দিকে তাকানোর সময় আমার নাই, হুহ। তাকাবো না তার দিকে। টেবিলে যেয়ে বসতেই আম্মু খাবার নিয়ে এলো। নিজে হাতে খাইয়ে দিতে নিলেন। আমি নিজ হাতে খেতে চাইলেও দিলেন না।

এমনি সময় আমি খাইয়ে দিতে বললে দুইটা ধমক দিয়ে বসিয়ে দেয়। বলে নিজের হাতে খাঁ। আজকে যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছেন। ব্যাপারটা বুঝতে আমার দেরি হলো না। আম্মু আমাকে না পেয়ে ভয় পেয়েছেন তাই এখন আমায় কাছ ছাড়া করতে চাইছেন না। খাচ্ছি এমন সময় ইভান ভাইয়ের বউ সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। পরনে শাড়ি, মাথায় কাপড় দেওয়া। ঘোমটার আড়ালে উঁকি দিচ্ছে ভিজা চুল। দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটা ইচ্ছে করেই দেখাতে চাইছে। ওর ভেজা চুল দেখে ঘটনা বুঝতে আর বাকি রইলো না। চোখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকাতে যাবো এমন সময় চোখ আটকালো ইভান ভাইয়ের দিকে। উনি রক্তিম চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবেন। এদের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। খাচ্ছি এমন সময় পাশের চেয়ারে ধপাস করে কেউ বসলো। চোখ ঘুরিয়ে দেখলাম আদ্র ভাই। আদ্র ভাই আম্মুকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“মেঝ আম্মু তোমার মেয়েকে না খাইয়ে আমাকে খাইয়ে দেও। ওর চিন্তায় চিন্তায় দেখো আমি কতটা শুকিয়ে গেছি। আর ওকে খাইয়ে তো লাভ হচ্ছে না, আগেও শুটকি ছিলো এখনো সেটাই রয়ে গেছে। কোনো উন্নতি নেই”
আদ্র ভাইয়ের কথায় নাকের পাটা ফুলে উঠলো। রাগে ফোঁস ফোঁস করছি। বজ্জায় লোক আমায় ইনডাইরেক্টলি শুটকি বলল? ওনার সাহস তো কম না! আম্মু আমার সাথে আদ্র ভাইকেও খাইয়ে দিচ্ছেন।
“তুমি নিজের হাতে খেতে পারো না? এতো বড় হয়ে আমার খাবারে ভাগ বসাতে এসেছো?”
“তোর খাবার অনেক টেস্টি তাই ভাগ নিচ্ছি”
খাওয়া শেষে উঠে চলে আসতে নিলাম। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে আসতে নিলে ইভান ভাইয়ের রুম থেকে উচ্চ শব্দে কথা ভেসে এলো। আমার রুমে যেতে প্রথমে ইভান ভাইয়ের রুমে পড়ে, আমার রুমের পড়ে ইভার রুম। অস্পষ্ট কিছু কথা কানে ভেসে এলো,

“বউ হতে চাইছিস? ইফরান খান ইভানের বউ? নাটক কম কর। তোর মতো মেয়েদের আমার জানা আছে। শাড়ি পড়ে, মাথায় ঘোমটা দিয়ে, ঘোমটার নিচে ভিজা চুল দেখিয়ে কি প্রমাণ করতে চাইছিস? আমার জানামতে চুল ভিজানোর কোনো কারণ নেই। তোকে যদি আমার আশেপাশে দেখি একদম খু*ন করে ফেলবো”
“আমি তো তোমার আশেপাশেই ঘুরবো আমার না হওয়া জামাই সাহেব। তোমার জীবন যদি ধ্বংস না করেছি তো আমার নাম পাল্টে অন্য কিছু রাখবো। সবে তো খেলা শুরু মিস্টার ইফরান খান ইভান। এখনো অনেক কিছু বাকি”
“যা করার আমার সাথে করবি। রোদ পাখি আর আমার পরিবারের কারো কিছু হলে তোকে আমি জীবিত কবর দিবো”

উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন সিজন ২ পর্ব ৩

“তুমি আমার কিচ্ছু করতে পারবে না”
কথাটা বলে মেয়েটা উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। কথা গুলো অস্পষ্ট হওয়ায় ওদের কথার মানে কিছুই বুঝতে পারলাম না। ওদের নিয়ে ভাবার আমার সময় নেই। ইভান ভাইয়ের রুমে ক্রস করে নিজের রুমে প্রবেশ করলাম।

উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন সিজন ২ পর্ব ৫