একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ১১
রনীতা তুশ্মি
চারপাশে যখন ঘুটঘুটে অন্ধকার তখন সেই রহস্যময় মানবের উদ্ভট এক কথা শুনে আনায়া পুরো থ!
কেনীথের কথাটা আনায়ার কাছে উদ্ভটই লেগেছে। সামান্য একটা বিষয়ে এই ধরনের ভাষা ব্যবহার করা কি খুব দরকার। এমনটা মনে হওয়ারও অবশ্য কারণ আছে, আনায়ার ছোট খাটো বিষয়ে স্ল্যাং ইউজ করাটা মোটেও পছন্দ নয়। কিন্তু বর্তমানে এসব নিয়ে ভাবার পরিস্থিতি গড়ে ওঠেনি।
আনায়া গাড়ি থেকে নেমেই বুঝতে পারলো সে কোনো বড় পাহাড়ের সড়কের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার জানা মতে কনসার্ট শহরে হওয়ার কথা তবে এইখানে আসার কারণটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।
এরপর যখন কেনীথের আওয়াজ অনুসরণ করে তার দিকে তাকালো, তখন আরেকটু আঁ*তকে উঠলো। এই লোকটাকে তার মন প্রাণ থেকে পাগল মনে হয়। রাস্তার এক শেষ প্রান্তের একদম কিনারায় সটানভাবে প্যান্টের পকেটে হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো কেনীথ। আনায়া গাড়ি থেকে বের হয়েছে তা বুঝতেই ঘাড় বেঁকিয়ে উল্টো ঘুরেছে। আশেপাশে বাতাসের যে তীব্র খেলা শুরু হয়েছে তাতে যদি ভুলেও নিজের ব্যালেন্স হারায় তো সোজা নিচে।
কতফুট উঁচুতে এই রাস্তা তা আনায়ার ধারনা না থাকলেও এতোটুকু আন্দাজ করা যায় যে এখান থেকে একবার কেউ নিচে পড়ে গেলে তার নাম নিশানও হয়তো কেউ খুঁজে পাবে না। একদিকে কেনীথকে ওতো কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এসব উল্টোপাল্টা চিন্তা করতেই আনায়ার গলা শুকিয়ে গেলো। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিশ্বাস নেওয়াও কিছুক্ষণ বন্ধ করে দিলো।
এরই মাঝে কেনীথ বড় বড় পা ফেলে আনায়ার ঠিক মুখ বরাবর এসে দাঁড়ালো। আনায়ার ফোনটা এমন ভাবে ধরা যে নিচ থেকে ফোনের ফ্ল্যাশ লাইটের আলোর প্রতিফলনে কেনীথের শান্তশিষ্ট গম্ভীর চেহারাটাও ভয়ং/কর সুদর্শন কোনো দা*নব মনে হচ্ছে। বেচারী আনায়া এখনো নিজের নিশ্বাস আঁটকে কেনীথের মুখের দিকে ভীতু চোখে তাকিয়ে রয়েছে।
এদিকে কেনীথ কিছুক্ষণ আনায়ার দিকে একনজরে তাকিয়ে থাকার পর নির্বিকার বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—“নিশ্বাস নে গাধী! ”
কথাটা বলেই কেনীথ এক হাত প্যান্টের পকেট থেকে বের করে কালো চশমাটা পড়তে পড়তেই, বড়বড় পা ফেলে গাড়িতে গিয়ে বসলো।
এদিকে আনায়ার মস্তিষ্কে কেনীথের কথাটুকু বোধগম্য হতেই আনায়া ত্বরিত আঁটকে রাখা দম ছেড়ে স্বাভাবিক ভাবে নিশ্বাস নিতে লাগলো। এরপর কয়েকবার চোখের পাপড়ি ঝাপটিয়ে আশেপাশে তাকাতেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে আর বেশিক্ষণ একা থাকার সাহস জুটলো না।দ্রুত গতিতে গিয়ে গাড়িতে বসলো।
অন্যদিকে কেনীথ আনায়ার গাড়িতে বসার সাথে সাথেই একমুহূর্তও দেরী না করে ত্বরিত গাড়ি স্টার্ট দিলো। প্রথমদিকে সেই প্রথম বারের মতোই স্পিডে গাড়ি চালাতে লাগলো। এদিকে আনায়া মনে মনে নানান বিষয়ে ভাবছে। একদিকে তো এখানে কেনো এসেছে,এটা কোন রাস্তা, এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার কেনো, কোনো জনবসতি কিংবা অন্যান্য গাড়ির চলাচল আবার লাইটের ব্যবস্থা নেই কেনো আর কনসার্ট স্পটে পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগবে ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে জানার ইচ্ছে থাকলেও এতোকিছুর উত্তর আদোও কেনীথ দেবে কিনা সেই বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে অন্যদিকে তার এতো প্রশ্ন শুনে তাকে এখানেই ফেলে যাবে না তারও বা গ্যারান্টি কি!
কিন্তু এসব ছাড়াও আনায়া যে বিষয়টি নিয়ে ভাবছে তা হলো কেনীথ তাকে গাধী বলে সম্মোধন করেছে । আনায়া বুঝে উঠতে পারছে না একটা মানুষ সবাইকে তুই করে বলে তাই তাকেও বলেছে, এটা মানা যায় কিন্তু সরাসরি গাধী! কেমন অদ্ভুত না!
এই বিষয়টি নিয়ে আনায়া কিছুক্ষণ ভাবার পর মুচকি হাসলো। বিষয়টিকে সে নেগেটিভ ভাবে না নিয়ে পজিটিভ ভাবে চিন্তা ভাবনা শুরু করলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো কেনীথ হয়তো তাকে বর্তমানে ছোট বোন হিসেবেই ট্রিট করছে।আবার মনে হচ্ছে তার হুস ফেরার পর এসির পাওয়ার যতটা বেশি ছিলো এখন ততটা নেই। হয়তো কেনীথ ভুলেই তখন বেশি পাওয়ার দিয়ে দিয়েছিলো।
কেনীথকে বড় ভাই হিসেবে ধরলে এসব নিয়ে এতো মাথা ঘামানোর কিছু নেই। ইমন আর কেনীথ দু’জনেই তো আনায়ার কাছে সমান, তবে এতো ভাবনারই বা কি আছে! লোকটা এমনিতে অদ্ভুত হলেও বড় ভাই হিসেবে মন্দ নয়।
যদি এমনটা হয়, তবে আনায়া আর রেহানের বিয়েতে যদি তাকে ইনভাইট করা হয় তবে হয়তো কেনীথ না করবে না। ছোট বোনের বিয়ে ভেবে, আসলে আসতেও পারে। আনায়া ভাবতে ভাবতে যে তার চিন্তা ভাবনা কতদূর চলে গিয়েছে, তা নিয়ে হয়তো তার নিজেরেও কোনো হুস নেই। কিন্তু তার এই চিন্তার ভাবনা কেটে গেলো কেনীথের পরবর্তী কার্যক্রমে।
এবার কেনীথ এতো দ্রুত স্পিডে গাড়ি চালাতে লাগলো যে আনায়া আর নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারলো না। হঠাৎ এমন পরিবর্তনের মানে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো। মনে মনে ভাবলো কেনীথ আবার তার মনের কথা শুনে ফেলেছে নাকি। শুনতে পেলেও তাতে দোষ করার মতো কি আছে! আবার নিজের চিন্তা ভাবনা দেখে নিজেকেই গালাগালি করলো। সে মনে মনে কথা বললে সে কথা কেনীথ কি করে শুনতে পাবে!
আনায়া চোখ মুখ যতটা পারলো স্বাভাবিক রেখে ঠোঁট চেপে, দাঁত খিঁচে তার নিজের জামার একটা অংশ খাঁম/চে ধরলো। এবার মনে হচ্ছে কেনীথ গাড়ি চালাচ্ছে না বরং সত্যি সত্যি উড়াতে চলেছে। হঠাৎ এতো স্পিড বাড়িয়ে দেওয়ার কারণ আনায়া ঠিক বুঝতে পারলো না। কিছু বলে যে থামাবে সে পরিস্থিতি কিংবা সাহসও নেই।
স্টেজের সামনে দর্শকের উপচে পড়া ভিড় । সবার মাঝেই টানটান উত্তেজনার ঝলক। অন্ধকারে স্টেজের লাল-কালো স্পট, মুভিং হেড, স্ট্রোব, লেজার, পার লাইট সহ নানা ধরনের লাইট গুলো সমানতালে জ্বলে নিভে উঠছে। একদিকে গিটার, পিয়ানো, ড্রামের শূন্য অবস্থা অন্যদিকে কেনীথের তীব্র অপেক্ষায় হুইস্কার আর আনন্দ উল্লাসের আদান-প্রদানে উত্তে*জিত দর্শকগণ। সবমিলিয়ে সার্বজনীন উন্মাদনায় একটি তীব্র আকাঙ্ক্ষায় জেগে ওঠা কনসার্ট শুরুর প্রাক-আবহ তৈরি হয়েছে।
কনসার্ট স্টেজ থেকে কিছুটা কাছেই রাইজিং লাউঞ্জ/ লজে অর্থাৎ আর্টিস্ট রুমে বসে আরাম আয়েশ করতে ব্যস্থ কেনীথ। রুমের সোফায় একদম স্টেজ পপারেল স্টাইলে সেজেগুজে তৈরি। সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে একহাত দিয়ে রুবিক্স কিউবের সেম কালারের স্লট মেলাতে ব্যস্থ।
আনায়া জানে না, কেনীথ এই রুবিক্স কিউবটা কোথায় পেলো কিন্তু অন্যান্য দিনের মতো যে ফোনের মাঝো ডুবে নেই তাই অনেক। কিন্তু সে শুরু রুমের মধ্যে ঘুরাঘুরি করছে আর একটু পর পর বাহিরে কনসার্ট স্টেজ আর লোকজনের দিকে উঁকি দিচ্ছে। কনসার্ট এর সময় সেই কখন হয়ে গিয়েছে অথচ এই কেনীথের মাঝো কোনো হেলদোলও। নির্বিকারে নিজের কাজে ব্যস্থ।
পরনে শুধু কালো আর লালের কম্বিনেশনের জ্যাকেট যার চেইন অর্ধেকটা খোলা রাখায় বলিষ্ঠ উদম বুকের অনেকটাই দৃশ্যমান। সাথে কালো রংএর স্কিনি ডেনিম আর জুতা। আর আনায়ার কথা অনুযায়ী তার চুলগুলো তেমনই যেমনটা সচারাচর দেখা যায়। সঙ্গে শুধু কালো রংএর সেই চিরচেনা একটা ব্রেসলেট।
তবে আনায়ার ড্রেসআপে কোনো পরিবর্তন নেই। সে যেভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলো ঠিক সেভাবেই আছে। আনায়া আর কেনীথ কনসার্টএর নিদিষ্ট সময়সীমার অনেক আগেই চলে এসেছে। এখানে পৌঁছানোর পর অনেকেই আনায়াকে জিজ্ঞেস করেছে তারা এতো তাড়াতাড়ি পৌঁছালো কি করে। আনায়া সেভাবে কোনো উত্তর দিতে না পারলেও এতোটুকু বুঝেছে যে কেনীথ তাড়াতাড়ি পৌঁছানোট জন্য সেই পাহাড়ি রাস্তাটাই হয়তো বেছে নিয়েছে। এছাড়া তো আর কোনো কারণ থাকার কথা নয়।
কিন্তু বাহিরে মানুষের এতো আয়োজন উত্তেজনা আর কেনীথের প্রতি এতো তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকার পরও এই লোক কিভাবে এতো নিরদ্বিধায় বসে রইছে কে জানে। বিষয়টি আনায়ার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। এর আগের বার যংন কনসার্টে এসেছিলো, সেইবারের মতো কি এবারও ওতো দেরী করবে। এমনিতেই মাঝ রাত, কেনীথ যত দেরী করবে কনসার্ট শেষ হতেও তো তত দেরী হবে । তার এতো হাসফাস করতে আর ভালো লাগছে না, আবার কেনীথকে যে কিছু বলবে সেই সাহসও হচ্ছে না। মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন খুব বিরক্ত করছে। সেটাই চিন্তায় ব্যস্থ যে এই লোকটার সাথে ইমন ভাই এতোদিন কাজ করার পরও এতো হাসিখুশি কি করে থাকতো। এ তো পুরো টেনশনের আস্তানা।
রুমের মধ্যে কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর একবার বাহিরে উঁকি দিয়ে ধীরে ধীর কেনীথের কাছে গেলো এরপর স্বাভাবিক গলায় বলতে লাগলো,
—“ভাইয়া বলছিলাম….
আনায়া কথা শুরু করতে না করতেই কেনীথ ত্বরিত রুবিক্স কিউব ঘোরানো বন্ধ করে আনায়া দিয়ে আকস্মিক ভাবে তাকালো। হঠাৎ কেনীথের ওভাবে তাকানো দেখে আনায়া আকস্মিক চমকে উঠতেই মনে পড়লো এই মূহুর্তে সে কেনীথকে কি বলতে চেয়ে কি বলে ফেলেছে! ত্বরিত ঢোক গিলে ঠোঁট ভিজিয়ে বলতে লাগলো,
—“সরি! সরি স্যার!…. স্যার বলছিলাম যে কনসার্ট এর সময় তো হয়ে গিয়েছে। সবাই আপনার জন্য ওয়েট করছে, আপনি যাবেন না! ”
কেনীথ একই ভাবে আনায়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার মুখের ভঙ্গিমা দেখে কিছুই আন্দাজ করা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ একই ভাবে তাকিয়ে থাকার পর সে আবারও নিচের দিকে তাকিয়ে রুবিক্স কিউব ঘোরাতে লাগলো আর নির্বিকারে বললো,
—“যখন আমার মুড হবে তখন যাবো! ”
এটা শুনে আনায়া আবারও থ! এই লোকটাকে তার মাঝমাঝে…..না!না! বেশির ভাগ সময়ই তার সহ্য হয় না। যতসব উদ্ভট মন মর্জি।
আনায়া কেনীথের দিকে কিছুক্ষণ একনজরে তাকিয়ে ওর কার্যকলাপ দেখলো আর নিজের রাগগুলোর বহিঃপ্রকাশ ঘটার আগেই চাপা দিলো। যে রাগের যথার্থ কোনো ফল নেই সেই রাগের বহিঃপ্রকাশেরও কোনো মানে নেই। একটা সময় আনায়া সেখান থেকে সরে এসে দরজায় একবাহু হেলান দিয়ে বুকে হাত দুহাত গুজে বাহিরের মানুষের কার্যকলাপ দেখতে লাগলো।
এতো এতো মানুষের এতো সোরগোল আনায়ার ঠিক ভালো লাগছে না। তার মন পড়ে আছে রেহানের ভাবনায়। রেহানের সাথে সেই কখন থেকে কথাই হয়নি। এখন ফোন দিলে পাবে কি না কে জানে। আবার আশেপাশের যে পরিস্থিতি তাতে ঠিকভাবে কথাও বলা যাবে না।
এরই মাঝে হঠাৎ কেনীথ তার পাশ কাটিয়ে বাহিরে যাওয়ার সময় আনায়া হালকা চমকে গিয়ে পড়ে যেতে লাগলে ত্বরিত নিজেকে সামলে নেয়। অন্যদিকে কেনীথ কয়েক কদম এগিয়ে পিছন ফিরে আনায়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
—“স্টেজের ওদিকে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। লজের আশেপাশেই থাকবি, আর ভেতরে হয়তো ফ্রুটস রাখা আছে। বসে বসে খেয়ে নিস সব, নাহলে অপুষ্টিকর রোগীর মতো উঠতে বসতে এভাবে উল্টে পড়বি! ”
কেনীথ কথাগুলো বলে চলে যেতে একমুহূর্তও দেরী না করলেও আনায়া ওর কথা শুনে পুরো তব্দা খেয়ে গেলো। একে তো সে নাকি ভিকের পিএ আবার বলছে সে নাকি স্টেজের আশেপাশেও না যায়। অন্যদিকে ওসব কি বললো। হালকা ব্যালেন্স হারিয়েছে দেখে এতো বড় অপমান।
বেচারী আনায়ার কষ্টে পুরো কান্না পাচ্ছে। সে যথেষ্ট খাওয়াদাওয়া করে। বড় ভাই বানিয়েছে দেখে এভাবে ঠেস মেরে কথা বলার কি ছিলো। কিন্তু সে করবেও বা কি! খালি মনে মনে ভাই মানলেই তো হবে না, কেনীথ যে তার বস এটাও তো মাথায় রাখতে হবে। এছাড়া তার মনের আক্ষেপ-দুঃখের মাঝে কেনীথ অলরেডি স্টেজে পৌঁছে গিয়েছে আর ওদিকে দর্শক যেন গলা কাঁ*টা মুরগীর মতো লাফাচ্ছে। আনায়া এই কথাটা অবশ্য নিজের রাগ ঝাড়তেই বলে ফেললো। আনায়া দর্শকদের উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করে বললো,
—“আরে ছাগলের দল! ওটা মানুষ, কোনো মৎস্যপুরুষ না! এমন গলা কাঁ*টা মুরগীর মতো লাফানোর কি আছে? ”
সুরের ঝংকার বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। স্টেজের রংবেরঙের এর আলো ছরিয়ে চারপাশ মুখরিত। দর্শকের উত্তেজনা যেন ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে, কেনীথের প্রতি প্রত্যেকের প্রগাঢ় ভক্তি ভালোবাসার অনুভূতির রেশ ছড়িয়ে দিচ্ছে। গানের তালেতে সবাই একসাথে নাচছে, হাত তুলছে, শিশ বাজাচ্ছে আর প্রত্যেকে কেনীথের গিটারের সুর আর গানের মাদকতার এক অদ্ভুত অবস্থায় ডুবে যাচ্ছে। পুরো পরিবেশটাই এক বড়সড় অনুভূতির উৎসব, যেখানে সঙ্গীত, আলো আর মানুষের মিলনে সৃষ্টি হচ্ছে সঙ্গীতের এক নতুন জাদুর মেলা।
নিভা ছিল মনের আগুন……
কে দিলাই জ্বালাইয়ারে…..
ভ্রমর কইও গিয়া…
বরাবরের মতোই এবারও কেনীথ নিজের পছন্দের গান দিয়েই কনসার্ট শুরু করলো। এই গানটা আনায়ারও বেশ পছন্দ হওয়ায় সে দূর থেকেই গানটা মনের আনন্দে উপভোগ করলো। এরপর কেনীথ একে একে আরো কিছু গান গাইলো। দর্শনজনতাও প্রচন্ড উত্তেজনা আর আনন্দ সেসব গান উপভোগ করলো। কিন্তু সবার মাঝে একটা প্রশ্ন থেকেই গেলো এই কেনীথ আজ কোনো গন্ডগোল কিংবা এখনো মা*রামা*রি করেনি! এসবের সাথে তো প্রত্যেকই অভস্ত আর আজ এমনটা না হওয়ার প্রত্যকেই অবাক। সবাই ভাবছে আজ এমন কি হলো যার কারণে কেনীথের আজ এমন পরিবর্তন। তবে এতে কেউ আফসোস নয় বরং খুশিই হয়েছে। নাহলে এতো প্রতীক্ষার মতো কেনীথ স্টেজে এসেই কিছুক্ষণ না যেতেই এসব গন্ডগোল শুরু করে দেয়। এরপরের কাহিনি তো সবারই জানা। কিছুক্ষণ হাঙ্গামা হওয়ার পর কনসার্ট শেষ আর কেনীথের কনসার্ট অসম্পূর্ণই থেকে যায়। তবে এতো সুন্দর পরিবেশটা হয়তো বেশিক্ষণ স্থায়ী হওয়ার নয়।
কিছুক্ষণ আগে রেহান আনায়াকে ফোন করায় দুজনের বেশ প্রফুল্ল চিত্তেই একে অপরের সাথে ফোনে কথা বলে চলেছে। এর মাঝে রেহান আনায়াকে গান শুনতে স্টেজের কাছে যেতে বললে আনায়াও ধান্দাতেই স্টেজের অনেকটা কাছে চলে যায়। কিন্তু তার এদিকে ধ্যানও নেই যেই এই ভরা কনসার্টের মাঝে কয়েক জোড়া চোখ তার দিকে কু নজরে তাকিয়ে রইছে।
এই কয়েক জোড়া চোখ তো কেবল তাকিয়েছে তার দিকে কিন্তু এক জোড়া চোখ যে সেই কখন থেকে তাকে লক্ষ করে যাচ্ছে তা হয়তো আনায়ার ধারণারও বাহিরে।
আনায়া দেখতে শুনতে প্রচন্ড মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে। কথা কথায় মৃদু হাসিতে তার গালে ফুটে ওঠা ছোট বড় টোলের প্রেমে পড়বে না এমন লোক কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। ফিটফাট করে বাঁধা উঁচু খোঁপাটাও এলোমেলো হয়ে গিয়ে যেন তার মাধুর্যকে আরো বৃদ্ধি করেছে।
স্বাভাবিক ভাবেই এই পরিপূর্ণ মাধুর্যকে কোনো কু*চরিত্রবান লোকেরা সুদৃষ্টির সঙ্গে দেখবে না। তাদের কাছে এসব মানেই হলো এক তীব্র লালসার আস্তানা।
এমনিতেই পুরো এরিয়ার লাইটিং সিস্টেমটা গাঢ় লালের মধ্যে রাখা হয়েছে আর আনায়া যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে আলোও তেমনটা নাই বললে চলে।
অন্যদিকে কয়েকটা আনায়ার থেকে কিছুটা বয়সের বড় হবে এমন কয়েকজন ছেলে অনেকক্ষণ থেকে তাকে নিয়ে কু*রুচিপূর্ণ মন্তব্য করে যাচ্ছে। যেটা আনায়ার চোখে না পড়লেও কেনীথের নজর এড়িয়ে যায়নি। গান গাইতে গাইতে কিছুক্ষণ সেসব স্বাভাবিক ভাবে সহ্য করলেও যখন লোকগুলো আনায়ার দিকে এগোতে লাগলো তখনই কেনীথ আর স্বাভাবিক থাকতে পারলো না।
Cross my heart and hope to die
Welcome to my darkside
Ooh, to my da-da-darkside
Ooh, to my da-da-dark…side…….
কেনীথ ডার্ক সাইড গানটা গাইছিলো। আশেপাশে তার সুরের প্রতিধ্বনি সবাইকে বিমোহিত করছিলো আর এক ভীতিকর পরিবেশ বিরাজ করছিলো।
কিন্তু একটা সময় পর তার সহ্যের ক্ষমতা ভেঙ্গে গেলে তার সামনে থাকা স্টান্ড মাইক্রোফোনটা শক্ত করে ধরলো পাশাপাশি গায়ে ঝুলিয়ে রাখা গিটারের মাথার কাছে শক্ত করে চেপে ধরলো। ধীরে ধীরে তার কন্ঠস্বরও কঠোর হতে লাগলো। এদিকে দর্শক জনতা কেনীথের হঠাৎ এই পরিবর্তনের কারণ ঠিকভাবে বুঝে ওঠার আগেই কেনীথের গান থেমে গেলো আর সে আকস্মিক গিটারটা খুলে ফেলে ফ্লোরে আঁচ*ড়ে ফেললো।
হঠাৎ সব কিছু থমকে যাওয়ায় প্রত্যেকের মতোই আনায়াও বিস্মিত হয়ে নিজের ফোনে কথা বলা স্টপ করে দিলো। এদিকে সবার মধ্যেই পিনপতন নিরবতা। হঠাৎ এমন আবার কি হলো আর এই মূহুর্তে কেনীথই বা কার সাথে কি করতে চাইছে।
সবার মতই সেই ছেলেগুলোও হয়তো বুঝতে পারলো না তাদের সাথে কি হতে চলেছে। কেনীথ এক লাফে স্টেজ থেকে নেমের সোজা তাদের কাছে এলো আর তারা কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই কেনীথ নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ছেলেগুলোকে মা*রতে লাগলো।যদিও একটা মানুষের পক্ষে ৪-৫ টা ছেলেকে একসাথে মা/রা অসম্ভব প্রায় হলেও কেনীথের জন্য এটি তেমন অস্বাভাবিক কিছু নয়।
একটা ছেলেকে মে*রে নাক মুখ ফাটিয়ে দেওয়ায় সে এখন মাটিতে শুয়ে কাটাচ্ছে। আরেকজন আবার উল্টো করে শুইয়ে মাটিতে আর তার ঘারের কাছে পায়ের সর্বোচ্চ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে কেনীথ। শক্ত বুট জুতোই ছেলেটার জান যায় অবস্থা।
তাকে আধমরা বানিয়ে ছেড়ে দিয়েই অন্যদিকে আরেকটা ছেলেকে শুইয়ে দিয়ে তার পা দিয়ে ছেলটার উরুতে চেপে ধরে আছে। আপাতত তার হাত দিয়ে যে ছেলেটার কলার চেপে রেখছে তাকে যথাযথ উত্তম-মধ্যমও দেওয়ার পর বাকি দুটোকে দিবে।
শুধু মাত্র একটা ছেলেই পেছনে থাকায় সে ভীরের মধ্যে লুকিয়ে গিয়েছে কিন্তু বাকি চারজন এখন মা*রের উত্তম-মধ্যম জ্ঞান লাভ করছে বিখ্যাত রকস্টার নামক ম*নস্টার কেনীথের থেকে।
আনায়া গলা শুকিয়ে আসছে। চারপাশে এতো র*ক্তের ছড়াছড়ি তার সহ্য হচ্ছে না। সে বারবার বিস্মিত হচ্ছে আশেপাশের এতো এতো দর্শককে দেখে। কেউই কেনীথকে আটকাচ্ছে না, যে যার মতো বিষয়টিকে নিজেদের ক্যামেরা বন্দী করছে নয়তো দেখে মনে হচ্ছে উপভোগ করছে।আর এই কেনীথকে তো মনে হচ্ছে লোকগুলোকে একদম জানে মে*রে সে শান্ত হবে। চোখ মুখ লাল,পূর্ণ লাল চোখের মণি সহ পুরো চোখ দুটোও এখন পূর্ণাঙ্গ লাল হয়ে গিয়েছে। হাতের মাসেলস্ গুলো অতি*রিক্ত রাগের দরূন প্রচন্ড রকম ফুলে উঠছে।
আনায়ার আর সহ্য হলো না এসব আর সবার মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখার। কিন্তু কি করবে তাও তো বুঝে উঠতে পারছে না।এর আগের বার বেহুশের মতো যা করেছিলো এবার তো তা মোটেও করা যাবে না।কি এতো র*ক্তের ছ*ড়াছড়ি দেখে আনায়া না চাইতেও দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই মূহুর্তে নিজের দূর্বলতা প্রকাশেরও কোনো মানে নেই। কষ্ট করে হলেও নিজের দূর্বলতার বিষয়টি তাকে সহ্য করতে হবে।
আনায়া কেনীথের থেকে কিছুটা পিছনে অন্ধকারের দিকে ছিলো, যে কারনে তার দিকে নজর পড়ার আর কারো সময় হয় নি। এদিকে কেনীথ তো সেই কখন থেকে একটা ছেলেকে ধরে মুখের মধ্যে ঘু*ষি মে*রে যাচ্ছে।বেচারার চোখ মুখ,নাক ফেটে গলগল করে র*ক্ত ঝড়ছে।
আনায়া তাড়াতাড়ি করে কেনীথের কাছে গেলো সেই লোকটাকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে। প্রথমেই গিয়ে কেনীথের একবাহু ধরে আটকাতে গেলেই কেনীথ ওকে দেখে লোকটাকে ঘু*ষি মা*রতে গিয়েও থেমে যায়।
আশপাশের কয়েকজনই হঠাৎ একটা মেয়েকে কেনীথকে আটকাচ্ছে দেখে অবাক হয় আর তার চেয়ে বেশি অবাক হয় যখন দেখলো কেনীথ নিজেও এর কোনো প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে থেমে গিয়েছে। সবার মতো আনায়াও ভেবেছিলো সব হয়তো এবার স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। কেনীথ হয়তো আর কিছু করবে না।কিন্তু সবার চিন্তা ভাবনাকেই কেনীথ ভুল প্রমান করে পরবর্তীতে যা করলো তা সবার মতো আনায়াও প্রস্তুত ছিলো না।
কেনীথ ছেলেগুলোকে ছেড়ে দিয়ে আনায়ার দিকে ঘুরলো। এরপর মুহুর্তেই তার বলিষ্ঠ দেহ দিয়ে ঢেকে আনায়াকো সবার দৃষ্টি থেকে আড়াল করে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আনায়ার গাল চেপে ধরলো। এরপর শক্ত করে ওর বাহু ধরে ধীরে ধীরে পেছনে থাকা কেনীথের ছবি টাঙ্গানো বড় বোর্ডটার সাথে জোরে চেপে ধরলো।
এদিকে আনায়ার গালের হাড়গুলো মনে হয় ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম। কেনীথের সর্বোচ্চ শক্তির সাথে তার মতো মেয়ের পেরে ওঠা কখনোই সম্ভব নয়। কেনীথ যেন তাকে নিজের বলিষ্ঠ দেহ দিয়ে সম্পূর্ণ আবদ্ধ করে ফেলেছে। কিঞ্চিৎ নড়াচড়া করারও উপায় রাখেনি।
একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ১০
কেনীথ আর তার মাঝে পার্থক্যের পরিমানটা নেই বললেই চলে। কেনীথ আর তার চোখ একে অন্যের দিকে তীব্র চাহনি নিয়ে দেখছে। একজনের চোখে তীব্র ক্ষো*ভ তো একজনের চোখ স্রোতহীন শান্ত নদীর জলের মতো। একটা সময় গালের অসহনীয় ব্যথায় বেচারী আর সহ্য করতে না পারে আনায়ার চোখ বেয়ে আপনা-আপনি কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। এটা দেখে কেনীথের মন গললো কিনা জানা যেই তবে তীব্র আ*ক্রোশের সঙ্গে হিঁসহিঁসিয়ে বলতে লাগলো,
—“বলেছিলাম না আমি! লজের কাছেই থাকবি, স্টেজের আশেপাশেও আসবি না! তবে কেনো এসেছিস এখানে?