একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ১৩

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ১৩
রনীতা তুশ্মি

–“পৃথিবীতে একই রকম মানুষ যেখানে সাত জন রয়েছে সেখানে আমার মতো জামা কি আর কারো হতে পারে না! এমন তো নয় ওই জামা গুলো শুধু আমার জন্যই স্পেশাল ভাবে বানানো হয়েছে যা পৃথিবীর এক পিসই করেই রয়েছে। ”
ইনায়া বোনের গম্ভীর কথাগুলো শুনেও হাসলো,
—“আমি জানি তুমি সহজে স্বীকার করবে না কিন্তু ওই মেয়েটা যে তুমিই তাতে আমি 99.99999% সিওর। একে তো তোমার ঐ জামা গুলো কয়েক মাস আগে আমিই পছন্দ করে কিনে দিয়েছিলাম যা তুমি ভুলে গেলেও আমি কিন্তু ভুলিনি।
আর দ্বিতীয় আমার বোন যদি বোরকা পড়েও থাকে তবুও আমি শত মাইল দূর থেকেও চিনতে পারবো। ”
ইনায়ার ভাব নিয়ে বলা কথাগুলোকে কিছুটা উড়িয়ে দিয়ে আনায়া বললো,

—“তুই সিনেমার মতো অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ছিস। যদি এমনটাই হতো তবে প্রথমবারেই মেয়েটাকে দেখে চেনার কথা ছিলো তোর। তখন না এসে এখন কেনো এসেছিস। ”
—“তুমি আর এই জীবনে শুধরাইলে না! বড় বোন হয়েও এমন মিথ্যা কেউ বলে? ”
আনায়া চোখ ছোট ছোট করে তাকালো অন্যদিকে ইনায়া আবারও বললো,
—“আমি তো তখন বিষয়টিকে পাত্তা দেই নি। কিন্তু এবার পুরোপুরি সিওর। তুমি কি ভুলে গিয়েছো সেদিন রাতে তুমি বাড়ি থেকে ঐ জামাটাই পড়ে গিয়েছিলে। আর সেই কনসার্টেও তুমি ইমন ভাইয়ার সাথে সেই হলুদ জামাটাই পড়ে গিয়েছিলে। এরপরও মিথ্যা বলবে! আর আমি না হয় ছোট মানুষ কম বুঝি! তা তোমার বন্ধু রনক ভাইয়াও তো দেখি সন্দেহ করেছে। এখনও বলবে…..
ইনায়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই আনায়া বিরক্তি নিয়ে বললো,
—“আসছে আমার ছোট মানুষ! পুরো দুনিয়াটা ভেজে খেয়ে বেড়াচ্ছেন। ”
ইনায়া হেসে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—“তার মানে আমি যা বলছি তা সব সত্যি, তাই না!
—“সবই তো বুঝে গিয়েছিস এটাও আবার মুখে বলতে হবে। এখন দয়া করে আমার রুম থেকে যা, আর এতো পাকনামি না করে ঘুমা। আর শুন! ভুলেও এসব কথা যেন কেউ জানতে না পারে। যদি চাস, তোর বোনটা বাকি জীবনটা একটু স্বস্তিতে পার করুক। ”
এবার ইনায়া বোনের বিরক্তর সুরে বলা কথা শুনে কিছুটা আহ্লাদী সুরে বললো,
—“তুমি এমন বলো কেনো! আমি কি কখনো তোমার খারাপ চাইতে পারি। আমি কাউকে কিছু বলবো না যদি………
আনায়া ইনায়ার কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকালো অন্যদিকে ইনায়া মুচকি মুচকি হাসছে। আনায়া তখন ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
—“যদি…..? ”
—“যদি তুমি বলো তোমার আর ভিকের মধ্যে কানেকশনটা কি? ”
আনায়া বোনের মুচকি হেসে বলা কথাটা শুনে কপালে ভাজ ফেলিয়ে বললো,
—“এটা না জানলেও চলবে। এখন তুই ঘুমা। ”
—“ও আপু বলো না প্লিজ। আমি প্রমিজ করছি এই বিষয়ে আমি কাউকে বলবো না।”
—“তুমি যেটাই করো না কেনো, আমি তোমাকে কিছুই বলছি না। ”
—“তাহলে আমিও আমার কথা রাখবো না। সবাইকে বলে দেবো ওই মেয়েটা তুমি! ”
আনায়া চোখ ছোট ছোট করে বললো,

—“মীরজাফর! ”
ইনায়া হেসে বললো,
—“ফিমেল ভার্সন! ”
আনায়া এবার হাত ধুয়ে এসে বিছানায় বসে বসে খাবার খেতে লাগলো। এরপর ইনায়াকে জিজ্ঞেস করলো ও খেয়েছে কিনা। ইনায়া খেয়েছে বলার পরও আনায়া আবারও ওকে কয়েক লোকমা খাইয়ে দিতে দিতে বললো,
—“হুম! ওই মেয়েটা আমিই। ”
ইনায়া মুখের খাবার থাকা অবস্থাতেই বললো,
—“সে তো জানি কিন্তু তুমি আমার জামাইকে চ*ড় মেয়েছিলে কেনো। ওর ব্যাথা লাগেনি বুঝি! ”
আনায়ার খাবার চিবুচ্ছে আর এদিকে বোনের এহেন কথা শুনে পুরো মুডের তেরোটা বেজে গিয়েছে। বিরক্তিতে দাঁত কটমট করে বললো,

—“কিসের জামাই! ইচ্ছে তো করছে তোকে চৌদ্দ তলা উপর থেকে নিচে ফেলে দেই। ওকে মে*য়েছি ও কষ্ট পেয়েছে আর সেই রাতে আমার গালে যেভাবে চেপে ধরেছিলো আমি তাতে কষ্ট পাইনি? আরেকটু হলে তো আমার গালের হাড্ডি গুলো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যেত। ”
বোনের কথা শুনে ইনায়া ইনোসেন্ট মুখ করে বললো,
—-“আচ্ছা সরি, তুমি বলো। তুমি ভিকের কাছে কিভাবে পৌঁছালে। আর সেই রাতের ঘটনার পর অনেকে অনেক কিছুই বলছে। সবকিছু মিথ্যা হলেও এটা তো সত্য যে তোমরা দুজন পরিচিত,কিভাবে? ”
আনায়া খেতে খেতে বললো,
—“আমি তোর ভিকে নামক জামাইয়ের পি.এ. এইজন্য। ”
ইনায়া বোনের কথা যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।চোখেমুখ দারুণ ভাবে বিস্মিত হলো। ইনায়া কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকার পর বললো,

—“তুমি কি মজা করছো? ”
—“নাহ! ”
—“কি!!!”
আনায়া বিরক্ত হয়ে বললো,
—“ইরা আস্তে! রাম ছাগলের মতো চেচাচ্ছিস কেনো।”
—-“তারমানে তুমি ওখানেই জব করো। ”
—“হু!”
—“আমাকে আগে বলোনি কেনো! ”
আনায়া নির্বিকারে বললো,
—“এমন ছাগলামি করবি এজন্য! ”
ইনায়া আর এবার বিছানায় স্থির হয়ে বসে থাকতে পারলো না।জোড়ে লাফিয়ে উঠে বিনা আওয়াজে লাফালাফি করতে লাগলো। এদিকে আনায়া বোনের কাজকর্ম দেখে বিরক্তি নিয়েই খাবার খেয়ে যাচ্ছে। ইনায়া কিছুক্ষণ থেমে আনায়ার কাছ থেকে পুরো বিষয়টি জানতে চাইলে আনায়া শুরু থেকে মোটামুটি সব কিছুই ইনায়ার প্রশ্ন অনুযায়ী উত্তর দিলো। সবকিছু শুনে ইনায়া প্রচন্ড বিস্মিত হয়ে বললো,

—“ছিহ!তোমরা কত বড় মিথ্যাবাদী। ইমন ভাইও এতোদিন ভিকের পিএ ছিলো আর তুমিও……তুমি তো আমার বোন। আমাকে মিথ্যা বলার কি দরকার ছিলো। আমিই এতোই খারাপ।”
—“নাহ! তুমি ধোঁয়া তুলসি পাতা। আর আমি তোকে মিথ্যা কখন বললাম। তুই তো আমার জব নিয়ে এর আগে কখনো কিছু জিজ্ঞেসই করিসনি।”
ইনায়া নিজের ভুল বুঝতে পেরে জিহ্বায় হালকা কা*মড় দিয়ে হঠাৎ কি যেন ভেবে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। তা দেখে আনায়া কপাল কুঁচকে ওর দিকে তাকাতেই ইনায়া পেছন থেকে এসে ওর গলা জরিয়ে ধরে আহ্লাদী সুরে বললো,

—“আপু! ও আপু……..
—“এখন আবার কি চাস! এসব কি শুরু করলি। ”
—“শোনো না! ”
—“আগে সামনে এসে চুপচাপ বসে বলতে থাক, তারপর তোর কথা শুনছি।
আনায়ার কথামতো ইনায়া তাই করে। এরপর বোনের কাছে একটু এগিয়ে গিয়ে মাথাটা নিচু করে ধীরে সুস্থে বললো,
—“তুমি না আমার বড় বোন আর তুমি তো জানই আমি ভিকের কত্ত বড় ফ্যান। প্লিজ,প্লিজ যাস্ট একবার ভিকের সাথে দেখা করিয়ে দেও। প্রমিজ করছি ইহজন্মে আর তোমার কাছে কিছু চাইবো না। তোমার দাসী হয়ে থাকবো, যা বলবে তাই শুনবো।প্রমিজ করছি, একদম পাক্কা প্রমিজ। ”
অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরও যখন আনায়ার কাছ থেকে কোনো উত্তর এলো না তখন ইনায়া মাথা উঁচু করতেই আনায়ার চেহারা দেখে ভরকে গেলো। তার বোনের চোখমুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না ও কি বলবে বা করতে চাইছে। কিন্তু মস্তিষ্কে কোনো কিছুর একটা সংকেত পেতেই দুই হাত দিয়ে নিজের গালদুটো চেপে ধরে ঢোক গিললো।

রাতের আধারে রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর সেন্ট পিটার্সবুগের রাস্তায় ব্লাক কালারের রোলস রয়েস ফ্যান্টম কারটা সাই-সাই করে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। তার পেছনে আরো ৪-৫টা বিলাসবহুল গাড়ি সমান তালে সামনের প্রথম গাড়িটাকে অনুসরণ করে চলেছে।
রোলস রয়েসের ভেতরে পেছনের সিটে কালো লেদার জ্যাকেট, প্যান্ট আর জুতা পড়ে পায়ের উপর পা তুলে নির্বিকারে বসে রইছে কেনীথ। চুলগুলো হালকা কার্ল ব্রাশ করে হাফ মেসি বান করা সঙ্গে চোখে কালো গ্লাসেস। এয়ারপোর্ট থেকে সম্পূর্ণ যাত্রা পথের এই বিলাসবহুল আয়োজন মূলত তার জন্যই করা হয়েছে।। হঠাৎ এতোগুলো বছর পর এই দেশে আসাটা কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় নয় বরং তার পরবর্তী পরিকল্পনা পূরনের উদ্দেশ্যই কেনীথ এই বিদেশের মাটিতে পা রেখেছে।
বাংলাদেশ থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গ-এর সময়ের ব্যবধান ৩ ঘন্টা পিছিয়ে। বর্তমানে এই শহরে আটটা বাজে যা বাংলাদেশী সময়ে রাত দশটা।
কেনীথ এয়ারপোর্টে পা রাখার আগেই তার শুভাকাঙ্ক্ষী তার জন্য এত্তসবের আয়ােজন করে রেখেছে। নিসন্দেহে বলা যায় এই শুভাকাঙ্ক্ষী একাকিত্বের প্রেমিক কেনীথের বড়ই আপন কেউই। শুধু সে নয় বরং আরো একজন হয়েছে যে এতোবছর পর কেনীথের রাশিয়ায় আসার খবর পেয়েই প্রাসাদ সমতুল্য বাড়িটাতে মনের আনন্দে সেজেগুজে লাফিয়ে, গান গেয়ে বেড়াচ্ছে।

He is a bad boy with a tainted heart
And even I know this ain’t smart
But mama I’m in love with a criminal
And this type of love isn’t rational, it’s physical
Mama please don’t cry, I will be alright
All reason aside I just can’t deny, I love the guy
বিশাল বড় এরিয়া জুড়ে এক রাজকীয় প্রাসাদ সমতুল্য বিলাসবহুল বাড়ি। আশেপাশে রাতের আধারকে আলোকিত করতে নানা রংএর লাইট জ্বালিয়ে রাখা। চারপাশে কয়েকশত প্রজাতির নানা মাধুর্যপূর্ণ ফুলের গাছ। তবে গোলাপ ফুলের পরিসংখ্যানটা যেন একটু বেশি। নিশ্চিত এই বাড়ির বিশেষ এক অতন্ত্য সৌখিন ব্যক্তির সান্নিধ্যেই এই ফুল- প্রকৃতির অপরুপ সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে।
বিশাল বড় এরিয়া ঘুরে বাড়ির সদর দরজার দিকে এগোতে এগোতেই কেনীথের কানে হঠাৎ দূর থেকে আসা মনোমুগ্ধকর কন্ঠে গাইতে থাকা গানের স্বর ভেসে আসতে লাগলো। কেনীথের বুঝতে বাকি রইলো না গানটা কে গাইছে। কিন্তু সে একবারও জানালার গ্লাস নামিয়ে বাহিরে তাকিয়ে সেই গানের কন্ঠস্বরের মালিককে খোঁজার বিন্দু পরিমাণও আগ্রহ দেখালো না বরং সেভাবেই নির্বিকারে চুপচাপ বসে রইলো। অথচ যত বাড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে ততই তার কানে গানের প্রতিটা শব্দ প্রতিনিয়ত কর্ণে প্রবেশ করছে।

He is a villain by the devil’s law
He is a killer just for fun, fun, fun, fun
That man’s a snitch and unpredictable
He’s got no conscience, he got none, none, none, none
All I know, should’ve let go, but no
‘Cause he’s a bad boy with a tainted heart
And even I know this ain’t smart
But mama I’m in love with a criminal……..

And he’s got my name
Tattooed on his arm his lucky charm
So I guess it’s okay he’s with me
And I hear people talk
Trying to make remarks keep us apart
But I don’t even hear
I don’t care
‘Cause mama I’m in love with a criminal
And this type of love isn’t rational, it’s ….

ঠিক বিশাল বড় সোনালী রংএর সদর দরজার সামনে কেনীথের গাড়িটা সহ বাকি গাড়ি গুলোও থেমে গেলো। আর মূহুর্তেই কিছু কালো রংএর ফর্মাল ড্রেসআপে ভূষিত একজন লোক এসে গাড়ির দরজা খুলে দিলো অন্যদিকে বাকি লোকগুলো গিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে সদর দরজা পর্যন্ত লাইন ধরে কেনীথের জন্য পথ তৈরি করে দিলো।
কেনীথ গাড়ি থেকে নেমে নিচে পা রাখতেই খেয়াল করলো তার পায়ের নিচে লাল গালিচা বিছিয়ে রাখা একদম সদর দরজার ভেতর পর্যন্ত। এটা দেখে কেনীথের মাঝে কোনো হেলদোল হলো না।বরং ছোট করে এক দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। তবে এর মাঝে সে এটাও খেয়াল করেছে। তার গাড়িটা বাড়ির সামনে আসতেই সেই সুমধুর কন্ঠস্বরে গাওয়া গান সম্পূর্ণ না হয়েই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কেনীথ নিজের কালো গ্লাসেস্ টা না খুলেই মাথাটা হালকা উপরে তুলে ছাঁদের দিকে তাকাতেই ছাঁদের মৃদু আলোয় থাকা এক ঝাপসা ছায়া মূহুর্তেই সরে গিয়ে কেনীথের চোখের আড়াল হলো।

কেনীথ সেদিকে বেশিক্ষণ না তাকিয়ে থেকে সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। বাড়ির দিকে কিছুরা এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো ষাটোর্ধ এক ফর্সা নারী। যার পড়নে বড় এক সাদা রংএর গাউন। গলায় মূল্যবান প্লাটিনাম আর ডায়মন্ডের কারুকার্য শোভিত লকেট স্ট্রিং সাথে হালকা একটা স্কার্ফ জড়ানো। চুলগুলো হালকা বাদামী বর্ণের যা এমনিতেই কার্ল ব্রাশ করে খুলে রাখা।
কেনীথ সেই নারীটির কাছে যেতেই তিনি কেনীথকে উচ্ছ্বাসের সহিত জড়িয়ে ধরলেন। তার মতো এক শক্তপোক্ত কঠিন হৃদয়ের নারীর চোখেও আজ জল টলমল করছে তা শুধু এতোবছর পর কেনীথের একবার মুখদর্শন করে। সেই শুধু জানে এটা তার কত প্রতীক্ষা আর প্রত্যাশার ফল।
নারীটি কিছুটা কান্নারত সুরে কেনীথকে রাশিয়ান ভাষায় বলতে লাগলো,

“Ty vspomnil(a) spustya stol’ko vremeni? Ne pomnite nashi slova ni razu? /”টি ভস্পোমনিল(আ)/ভস্পোমনিলা স্পুস্ত্যা স্তোল’কো ভ্রেমেনি? নে পম্নিতি নাশি স্লোভা নিই রাজু?”
(কতগুলো বছর পর তোমাকে দেখার সৌভাগ্য হলো। আমাদের কথা কি তোমার একবারও মনে পড়ে না!)
উত্তরে কেনীথ শুধু নির্বিকারে বললো,
“Ty pozval, i ya prishol” / “টি পজভাল, ইয়া প্রিশোল। ”
(তুমি ডেকেছিলে, তাই এসেছি।)
কেনীথের কথা শুনে তিনি আর কিছুই বললেন না। বরং নিজেকে শক্ত করে রাশিয়ান ভাষাতেই বললো,
—“ভেতরে এসো! ”
এই নারীটির নাম কাতেরিনা লুসিয়া। সম্পর্কে তিনি কেনীথের নানী। কেনীথ বাংলা, ইংরেজি, রাশিয়ান ভাষা সহ আরো কয়েক ধরনের ভাষা জানলেও লুসিয়া দুই একটা শব্দের অর্থ ব্যতীত বাংলা জানে না। যেকারণে পুরো সময়টাই কেনীথ আর লুসিয়াস সংলাপ রাশিয়ান ভাষাতেই হয়ে থাকে।
লুসিয়ার কথা মতো কেনীথ ভেতরে প্রবেশ করতেই সে আশেপাশে না তাকিয়ে সোজা জিজ্ঞেস করলো,

—“আগে ফ্রেস হয়ে আসি! তারপর কথা হচ্ছে। ”
লুসিয়াও মুচকি হেসে বললো,
—“ঠিক আছে! ”
প্রশস্ত সম্পূর্ণ ফ্লোর চকচকে মার্বেল পাথরে মোড়া, যা গাঢ় স্বর্ণালী এবং র/ক্ত লাল রঙের মিশ্রণে তৈরি। চারপাশের দেওয়াল গুলোতে নান্দনিক শিল্পকর্ম এবং আধুনিক বিমূর্ত পেইন্টিং সুন্দর ভাবে সাজিয়ে রাখা। প্রধান লিভিং রুমে বিভিন্ন ধরনের মডার্ন অ্যাকসেন্ট ফার্নিচার, সুদূরপ্রসারী লাইটিং সিস্টেম এবং ডিজাইন বস্তু এই বাড়ির অভ্যন্তরীণ স্টাইলকে একটি আধুনিক ও সুকণ্ঠ অভিজ্ঞতায় পরিণত করেছে। এছাড়া বাড়ির ঠিক মাঝখানে লাল-সোনালী আর সাদা- গাঢ়া লাল রংএর আবরণের আচ্ছাদিত বিশাল এক সিঁড়ি।
এতো কিছুর পরও কেনীথের এই পরিবেশটা মোটেও পছন্দ হলো না। যে মানুষটা সবসময় কালো আঁধারে থাকতেই বেশি ভালোবাসে সে কিভাবে এইসব রংচঙে আলোকে ভালোবাসবে। তবে একটা সময় এই বাড়িটাও তার পছন্দ মতই সাজানো ছিলো যা এখন আর আগের মতো কোনো অংশেই নেই। আর এসব কার কল্যানে করা হয়েছে তা কেনীথের ভালো করেই জানা।
কেনীথ সিঁড়ির কাছ গিয়ে উপরে উঠতে গিয়েও আবার থেমে যায়। এবং পিছনে ফিরে লুসিয়াকে বলতে লাগে,

—“বাবুশকা! আমার রুমের চাবি……!”
(রাশিয়ান ভাষায় বাবুশকা অর্থ নানী অথবা দাদী)
কেনীথের কথা শেষ হওয়ার আগেই পেছন থেকে কেউ সুমধুর কন্ঠে বললো,
—“চাবির কি প্রয়োজন। আমি তো তোমার রুম নিজ হাতে গুছিয়ে রেখেছি!”
কথা শোনা মাত্রই কেনীথ পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো অল্প বয়সী এক যুবতী মেয়ে সিঁড়ির উপর প্রান্তে মুখে এক প্রানবন্ত বিস্তৃত হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইছে। পরনে বড়সর গাঢ় লাল রং-এর প্লেইন গাউন। তবে কোনো আলাদা স্কার্ফ পড়া নেই। মাথার গাঢ় লাল টুকটুকে প্রাকৃতিক হালকা কার্লি চুলগুলো সুন্দর ভাবে চিরুনি করে খুলে রাখা। গায়ের রং ধবধবে ফর্সা। মিথলজির সেই সবচেয়ে সুন্দরী রাজকুমারীর চেয়ে কোনো অংশে কম নয় বরং তার চেয়ে আরো বেশি।
কেনীথ ভালো করে খেয়াল করলো মেয়েটির হাতে একগুচ্ছ র/ক্ত লাল রাঙ্গা গোলাপ। দেখে মনে হচ্ছে এগুলো এই বাড়ির বাগানেরই।
কেনীথ মেয়েটির কথায় পাত্তা না দিয়ে আবারও সামনে ঘুরে লুসিয়াকে বললো,

—“আমি বলেছিলাম আমার রুমে যেন কেউ কখনো না যায়। তবে…….
কেনীথের এই কথাটাই যেন সেই প্রানবন্ত হাসিটাকে মূহুর্তেই নিভিয়ে দিলো। এদিকে লুসিয়া একবার পেছনে থাকা মেয়েটাকে দেখে অপ্রস্তুত সুরে কেনীথকে বলতে লাগলো,,
—“আ….তুমি প্রায় অনেক বছর ধরেই এই বাড়িতে আসোনি। নিয়মিত পরিচর্যা না করলে তো রুম আর রুম থাকবে না, পুরো ভুতের ঘরে…….
কেনীথ কিছুটা গম্ভীর সুরে বললো,
—“যাই হোক না কেনো, তা পরবর্তী আমি বুঝে নিতাম!”
কেনীথ কথাটুকু বলে আর একমুহূর্তেও দেরী না করে সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে গেলো। অথচ শেষ প্রান্তে তার জন্য শত প্রতীক্ষা প্রত্যাশায় সেজেগুজে একগুচ্ছ গোলাপ নিজ হাতে সাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে সে আর একটিবারও ফিরে তাকানোরও প্রয়োজন মনে করলো না।

কেনীথ চলে যেতেই মেয়েটি লুসিয়ার দিকে তাকিয়ে কিছুটা ছলছলে চোখেই মুচকি হাসি হাসলো। ওদিকে লুসিয়ারও বুঝতে বাকি রইলোনা মেয়েটা আবারও অনেকটা কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু সে আর কি করবে। জোর করে তো কিছু হয় না। তার মতো রাশিয়ার এক নামকরা মাফিয়াও তার নাতী কেনীথের কাছে নির্বাক।
কেনীথ হলো লুসিয়ার একমাত্র মেয়ের একমাত্র ছেলে। এই অদ্ভুত নামটা মূলত সেই দিয়েছিলো। লুসিয়ার স্বামী একজন রাশিয়ার নাম করা মাফিয়া ছিলো কিন্তু অনেক বছর আগেই প্রকৃতির নিয়ম অনুসারেই তাকে পরলোকগমন করতে হয়। এরপর তার স্বামীর বিশাল এই মাফিয়ার সাম্রাজ্যকে আরো প্রশস্ত করে তোলে লুসিয়া নিজেই। কারণ সে কোনো সাধারণ ঘরের মেয়ে নয় বরং সে নিজেও এক মাফিয়ার মেয়ে।
অন্যদিকে সেই গাঢ় লাল রাঙ্গা চুলের রাজকীয় কন্যা হলো লুসিয়ার একমাত্র ছেলের একমাত্র কন্যা। মেয়েটির নাম আলেসিয়া ম্যারিনা রোজ । কিন্তু মেয়েটা রোজ নামে কাউকেই ডাকতে দেয় না। তাকে এই নামে ডাকার অনুমতি শুধু সে একজনকেই দিয়েছে আর আজ সেই ব্যক্তিই কিনা এতোগুলা বছর পর তাকে দর্শন দিয়েও অবজ্ঞা করলো। এই নিয়ে রোজ অনেকটা কষ্ট পেলেও নিজেকে সামলে নিয়েছে। এতোবছর পর যে কেনীথের দর্শন পেয়েছে এটাই তো অনেক।

রোজের মা কোনো রাশিয়ান নয় বরং স্কটল্যান্ডের এক অপরুপ সুন্দরী ছিলো সঙ্গে একটি সাধারণ ঘরের মেয়ে। কিন্তু রোজের বাবার সেই সাধারণ মেয়েকেই ভালোবাসে এবং পরবর্তীতে বিয়ে করে ফেলে। তবে এই ভালোবাসা আর দীর্ঘস্থায়ী হয় না। রোজের জন্মের পর থেকেই ওর মা অসুস্থ হয়ে যায় এবং কিছু মাস পর সেও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে।
এই মা হারা মেয়েটার কপালে বাবার আদরটাও বেশিদিন জোটেনি। শ*ত্রুপক্ষের কু*নীতির চক্রান্তে তাকেও অল্প বয়সে জীবন ত্যাগ করতে হয়। এরপর বাকি জীবনটা দাদী লুসিয়ার কাছেই বড় হয়। তবে সে আর সবার কিংবা পারিবারিক লোকদের মতো কোনো কঠিন অথবা বি**ষাক্ত হৃদয়ের মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারেনি।
প্রচন্ড নরম মনের মেয়ে সে। রা*গারা*গি চেঁ*চামে*চি কোনো কিছুই তার মাঝে ফুটে ওঠে না। সবসময় চেষ্টা করে নিজেকে প্রানবন্ত আর হাসিখুশি রাখার। দিন রাতের বেশির ভাগ সময়ই চলে যায় নিজ হাতে গড়ে তোলা বিশাল ফুলের বাগান, বাগানে বেড়াতে আসা পাখি আর প্রজাতির সাথে গান গেয়ে। কেনীথের গান গাওয়াটা দেখেই রোজ নিজেও গানের প্রতি আরো বেশি আকৃষ্ট হয়েছে।

তার জীবনে কেনীথের আগমন ছিলো ক্ষনিকের জন্য। যদিও সময়টা কয়েক বছরের তবুও রোজের কাছে সময়টা ক্ষনিকেরই। এই পুরো সময়টাতে সে কেনীথের উপর প্রচন্ড রকমের আসক্ত হয়ে পড়ে। যার রেশ কেনীথের চলে যাওয়াতে কমেনি বরং আরো শতগুণ বেড়ে গিয়েছে।
কাল রাতে শুধু একবার শুনেছে কেনীথ এখানে আসছে আর এতেই বেচারীর খাওয়া দাওয়া, ঘুম সব উড়ে গিয়েছে। সারারাত উত্তেজনায় পাগলের মতো করে আর ঘুমটা আসনি। কেনীথের রুম থেকে শুরু করে, ওর জানামতে কেনীথের সকল পছন্দের খাবার নিজ হাতে বানিয়েছে। তার জীবনের সবটা জুড়ে শুধু কেনীথই। কিন্তু কেনীথ তাকে কখনো তার মতো করে দেখবে কিনা এই নিয়ে তার মনে প্রগাঢ় সংশয়।
কেনীথ তো তাকে ছোট থেকে নিজের মামাতো বোন ব্যতীত অন্যকিছু হিসেবে কখনোই হয়তো ভাবেনি। কিন্তু সে যদি শেষমেষ কেনীথকে না পায় তো সে কি করে বাঁচবে।

এমনটা নয় যে সে কেনীথ আর তার পরিবার সম্পর্কে কিছুই জানে না।সে জানে, সে রাশিয়ার এক বড় মাফিয়া পরিবারের মেয়ে অন্যদিকে সে যাকে নিজের মন দিয়ে বসে রেখেছে সে শুধু একজন রকস্টার নয় বরং সেও এই মাফিয়াদের চেয়ে আরো বেশি ভ*য়ংকর।
এই বিষয়গুলো যেহেতু তার পছন্দ নয় তাই সে কখনোই না তার পরিবারের কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করেনি। না নিজেকে এসবের মাঝে জড়িয়েছে। সে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে নিজেকে এসব থেকে দূরে রাখার অন্যদিকে লুসিয়াও নিজের নাতনীর ইচ্ছে পূরণে কোনো বাঁধা দেয়নি।

রোজকে একটি স্বাভাবিক মেয়ে হিসেবেই বাঁচতে দিয়েছে যদি তা এই বিশাল বড় প্রাচীরে ঘেরা এক বন্দী রাজকন্যার মতো করে। কারণ তার মতো মেয়ের এই প্রাচীরের বাহিরে যাওয়া মানে শত্রুর কুনজরে মূহুর্তেই শেষ হয়ে যাওয়া। যা লুসিয়া কখনো হতে দিবে না।এজন্য তাদের পেশাগত কর্মকাণ্ডের কোনো বিষয়ও কখনো রোজকে জানানো হয় না।আর আজ যে কেনীথ ঠিক কোন উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে তাও রোজকে জানানো হয়নি।
কেনীথ রুমে ঢুকেই কিছুক্ষণ আশপাশটা তাকিয়ে দেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। যা ভেবেছিলো তাই, সে যেভাবে এই ঘর সাজিয়ে গিয়েছিলো তার ছিটেফোঁটার আবরণও আর এখানে নেই। শেষে তার ঘরটাকেও ছাড়েনি।
বাড়ির মতো পুরো রুম রোজ নিজের ইচ্ছে মতো একদম গাঢ় স্বর্ণালি আর গাঢ় লাল রং-এর সাজিয়েছে। সাথে লাল আর কালো রংএর গোলাপ ফুল গুচ্ছ বানিয়ে ফুলদানি গুলো একদম পূর্ণ করে সাজিয়ে রেখেছে। আবার বারান্দাতেও গোলাপের গাছ নজরে আসছে।

কেনীথেরও রোজের মতো র/ক্ত লাল রং টা বেশি পছন্দ করলেও সে সবসময় সাদামাটা পছন্দ করে আর তার পছন্দের কালারে কালোটাই মূখ্য। এদিকে রোজের সাথে পুরোটা মিললেও সে কালো নয় বরং সোনালীটাকে লালের সাথে বেছে নিয়েছে। এই কালার কম্বিনেশনটা তার একটু নয় বরং অনেক বেশি পছন্দের। সবসময় সাদামাটা গাউন আর সাজসজ্জাতে থাকলেও তার মাঝে এক আভিজাত্যর ঝলক সবসময় বিরাজ করে।
কেনীথ বিষয়টিকে বেশি পাত্তা দিলো না।যেহেতু কাজ শেষ হলেই চলে যাবে তাই এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। কেনীথ দেরী না করে সোজা বাথরুমে চলে গেলো সাথে মনে মনে ভাবতে লাগলো, ভাগ্যক্রমে লালের সাথে কালো গোলাপও যে রেখেছে তাই অনেক।

ধান্দাতে জামা কাপড় না নিয়েই রুমে ঢুকে গিয়েছে বিধায় শুধু টাওয়াল পেঁচিয়ে রুমে আসতে হলো কেনীথকে। রুমে ঢুকে কাবার্ড খুলে টিশার্ট বের করতে গিয়ে হঠাৎ চমকে উঠলো কারো চিৎকারের আওয়াজ শুনে।
ত্বরিৎ ভ্রু কুঁচকে পেছনে তাকিয়ে দেখলো বারান্দার দরজার কাছে রোজ দুহাত তুলে খিঁচে নিয়ে, চোখমুখ কুঁচকে বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে।
এটা দেখে কেনীথ বিরক্তি নিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রোজ বলতে লাগলো,
—“ইহ…..!!!তোমার লজ্জা বলতে কিছু নেই!”
কেনীথ কিছু বললো না বরং চোখমুখ স্বাভাবিক করে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
—“এখানে কি করছিস তুই।”
রোজ চোখমুখ কুঁচকে থাকা অবস্থাতেই বললো,
—“তুৃমি জামা পড়ো আগে!”
কেনীথ ধমক দিয়ে বললো,
—“তুই রুম থেকে বের হ আগে। ”
—” তুমি না সরলে এখন রুম থেকে বের হতে গেলে সমস্যা হবে। আর আমার তোমার সাথে কিছু কথা আছে। প্লিজ তাড়াতাড়ি জামা কাপড় পড়ো। ”
কেনীথ চরম বিরক্তি নিয়ে বললো,

—“তাহলে উল্টো ঘোর গাধী! ”
—“হা….ওহ হ্যাঁ!”
কেনীথের কথার অর্থ বুঝতেই রোজ চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই উল্টো ঘুরলো। তবে কেনীথ কালো প্যান্ট পড়ে যেই না কালো টিশার্টটা পড়তে যাবে ওমনিই উল্টো দিকে ঘুরে থাকা রোজ বলতে লাগলো,
—“ওয়েট! ওয়েট! তুমি টিশার্টটা পড়ো না! ”
কেনীথ ভ্রু কুঁচকে বললো,
—“কেনো তুই দেখবি! ”
রোজ চোখমুখ আরেকটু কুঁচকে বললো,
—“ছিহ!! আমি এমন না। ”
—“তাহলে কি চাস। ”
—“কিছু না! তুমি ওই বেডে রাখা টিশার্টটা পড়ো, প্লিজ। ”
কেনীথ ভ্রু কুঁচকে বেডের কাছে গিয়ে দেখলো লাল রং-এর একটা সিল্কের টিশার্ট সাথে সোনালী কারুকার্য করা। জিনিসটা হাতে নিয়েই কেনীথের চোখমুখ প্রচণ্ড ভাবে কুঁচকে গিয়ে বললো,
—“এটা কি! ”
এদিকে রোজা খুশি মনে বলতে লাগলো,
—“এটা আমি তোমার জন্য পছন্দ করেছি। সুন্দর না! ড্রেসটা এমনিতেই নরমাল ছিলো। পরে আমি সোনালী সুতো দিয়ে কাজ করে দিয়েছি। ”

উল্টো দিকে ঘুরে থাকা রোজের দিকে কেনীথ বিস্মিত চোখে তাকালো। তবে কোনো আওয়াজও করলো না।এদিকে কিছুক্ষণ সময় হওয়ার পরও যখন রোজ দেখলো যে কেনীথ কিছু বলছে না তখন যেই না পিছনে ঘুরতে গিয়েছে ওমনি মুখের উপর কিছু পড়তেই চমকে উঠলো। জিনিসটা মুখ থেকে সরিয়েই হাতে নিয়ে দেখলো তার পছন্দের সেই টিশার্ট। আর ওদিকে কেনীথ কালো প্যান্ট আর টিশার্ট পড়ে, পকেটে দুহাত গুঁজে সটানভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
রোজ হঠাৎ বুঝতে পারলো না কি হলো! তবে কিছুটা মনে মনে আন্দাজ করলো কেনীথের হয়তো জামাটা পছন্দ হয়নি। রোজ কিছু বলতে যাবে তার আগেই কেনীথ বললো,
—“তুই এটা কোথায় পেয়েছিস!”
—“আ…….
—“তুই আদোও জানিস এটা টিশার্ট নাকি অন্যকিছু! ”

রোজ এবার কিছুটা অবাক হয়ে জিনিসটা হাতে নিয়ে ঘুড়িয়ে পেছিয়ে দেখার পর বললো,
—“এটা টিশার্ট না! আমার তো দেখে টিশার্ট-এর মতোই লাগছিলো। এটা টিশার্ট না হলে এটা কি? ”
—“এটা একটা অসম্পূর্ণ ট্রেডিশনাল ড্রেস। যেটাকে তুই আলট্রা ডিজাইন করে বিয়ের ড্রেস বানিয়ে ফেলেছিস। আর যাই হোক, তুই এটা ভাবলি কি করে যে আমি এটা পড়তে যাবো। তোর চয়েস এতো খারাপ হয়েছে জানা ছিলো না।”
এবার আর রোজ মন খারাপ না করে নিজেকেই মনে মনে বকাবকি করতে লাগলো। না জেনে এতো বড় গাধামী!
কেনীথ আর কিছুই বললো না। সে রুম থেকে বের হতে নিলে রোজ তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নিজের হাতে বানানো গোলাপ ফুলের তোড়াটা এনে কেনীথের সামনে এসে দাঁড়ালো। তখন ভয়ে আর মন খারাপ হয়ে যাওয়ায় জিনিসটা দিতে পারেনি। এবার একবার ঢোক গিলে বিস্তৃত হেসে ফুলের তোড়াটা কেনীথের দিকে এগিয়ে দিলো,

—-“অপ্পা! ইট’স ফর ইউ।
কেনীথ ফুলের তোড়াটা না নিয়ে কপাল কুঁচকে কিছুটা তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
—“অপ…পা! রুশ, স্কটস,গ্যালিক,ইংলিশ ছেড়ে এখন কোরিয়ান? ”
কেনীথের কথা শুনে রোজ মুচকি হেসে বললো,
—“আমার আর কাজ কি! নতুন কিছু ট্রাই করছি। ইউ নো হোয়াট! আমি বাংলাও কিন্তু অনেক কিছুই পারি।আ….. লাইক, ভাইয়া! ইট’স ফর ইউ। ”
বলেই ফুলের তোড়াটা আবারও কেনীথের দিকে এগিয়ে দিলো। এদিকে কেনীথ ওর কার্যকলাপ শেষে শুধু একটা বাঁকা মুচকি হাসলো। আর এই হাসিই যেন রোজের মনে আবারও নতুন প্রত্যাশার জন্ম দিতে লাগলো। সে লুসিয়ার কাছে কেনীথের সম্পর্কে এটা ওটা জিজ্ঞেস করে জেনেছে যে কেনীথ নাকি আগের মতো কথা বলে না। এই নিয়ে তার অনেক মন খারাপও হয়েছে। যে মানুষটার সাথে নানা গল্প আড্ডা দিয়েই তার দিন কাটতো সেই এখন নাকি কথাই বলে না।তাহলে এই মানুষটার সাথে বাকি জীবনটা সে কি বোবার মতো কাটাবে!
এদিকে রোজের ভেতরে জমতে থাকা আশ্বাসের অর্ধেকটা ভাঙ্গলো যখন কেনীথ বললো,

—“আলেসিয়া!তুই……
মূহুর্তেই রোজের মুখখানা থমথমে হয়ে গেলো। ত্বরিত কেনীথের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
—“ওয়েট! এটা কি বলে ডাকলে আমায়? ”
মেয়েটার চোখে কন্ঠস্বর একদম কাটকাট হয়ে গিয়েছে। এতোটুকু বলতেই যেন প্রচন্ড কষ্ট হয়েছে তার। কেনীথ জানে সে কি করেছে তাই নির্বিকারে বললো,
—” সবাই যা বলে তাই! ”
মূহুর্তেই মেয়েটার কষ্টের পাশাপাশি যেন রাগও হতে লাগলো। কিন্তু সহজে রে*গে যাওয়ার মেয়ে তো সে নয়। তবে কেনীথ যা করেছে তাতে তো তার ভয়ংকর রাগ হচ্ছে যদিও তা কেনীথের সামনে প্রকাশ করার সাহস হবে কিনা জানা নেই।
ফর্সা ত্বকের রাগ আর কষ্টে মিশ্রিত লাল হয়ে যাওয়া মুখটায় ততক্ষণে বলতে লাগলো,
—“সবাই আর তুমি যে এক নও তা কিন্তু তুমি ভালো করেই জানো। আমাকে রোজ বলে ডাকার অধিকার শুধু আমি তোমাকে দিয়েছি কারণ আমার এই নামটা তুমি রেখেছিলে। বাগানের এতো ফুলের মধ্যে বেশিরভাগই গোলাপ আর এর কারণটাও তুৃমি। ”

—“কারণটা আমি হই কি করে।আমি কি কখনো বলেছিলাম এসব করার জন্য! ”
রোজ নিজের রাগ কন্ট্রোল করে বললো,
—“মজা করছো আমার সাথে! ভুলে গিয়েছো তুমি,ব্লা*ড রোজ তোমার বেশি পছন্দ, তুমিই আমাকে বাগানে এসব গাছ লাগানো শিখিয়েছিলে। এতোগুলো বছর শুধু তোমার স্মৃতিতেই আমি এসব করেছি। ”
কেনীথ মৃদু বাঁকা হেসে বললো,
—“সেসব ছোটবেলার ঘটনা ছোটবেলাতেই শেষ হয়ে গিয়েছে। এখনও ওসব নিয়ে মাতামাতি করলে সেটাকে বাচ্চামো বলে।”

—“আমার এসব করা তোমার বাচ্চামো মনে হয়!”
এবার রোজের চোখে পানি চকচক করছে। ফর্সা নাকটা লাল হয়ে গিয়েছে। অথচ কেনীথের এসব নিয়ে কোনো হেলদোল হলো না বরং নির্বিকারে বলতে লাগলো,
—-“আলেসিয়া! তুই বড় হচ্ছিস,যথেষ্ট বুদ্ধি হয়েছে। সঙ্গে এই পরিবারের সত্য পরিচয়টাও নিজের মধ্যে কখনো গড়ে তুলতে চাস নি। সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকতে চেয়েছিস এসব থেকে। এতে কেউ তোকে কখনো কোনো বাঁধাও দেয়নি। কিন্তু এছাড়াও তুই যেটা এতো বছর ধরে তীব্র প্রতীক্ষায় চেয়ে আসছিস তা কখনোই সম্ভব নয়। কারণ আমি চাই না এমন কিছু হোক।”

—“কেনো সম্ভব নয়! তোমার আমার ধর্ম ভিন্ন তাই। তোমার ধর্ম ভিন্ন হলেও তো তুমি কোনো ধর্মেই মানো না। মানলে কি আর সবার মতো অন্যায় করতে। এরপরও যদি বলো তবে আমি তোমার কথা মতো সব কিছু করবো।”
—“ব্রেইন লেসের মতো কথা বলিস না। কেনো সম্ভব নয় তার উত্তর তুই জানিস।”
রোজ ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না আর রাগকে আঁটকে কিছুক্ষণ কেনীথের দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর নিজেকে স্বাভাবিক করে ঠোঁট ভিজিয়ে কিছুটা জিজ্ঞেসা সূচক ভাবে বলতে লাগলো,
—” নিশ্চয় তার জন্যই আমি যা চাইছি তা কখনোই সম্ভব নয়। তাকে তুমি খুঁজে নিয়েছো, তাই না? ”
কেনীথ শুধু মুচকি হাসলো।
—“আমি তাকে খুঁজতে যাইনি, সে নিজেই আমার কাছে নিজেকে ধরা দিয়েছে।
এবার রোজও মুচকি হাসলো। গলায় মনে হয় অনবরত কাঁ*টা বিঁধ*ছে। নিজের উপর অনেকটা তাচ্ছিল্য করেই বললো,
—“লাকি গার্ল! লাস্ট একটা কোশ্চেন জিজ্ঞেস করবো, প্লিজ উত্তরটা দিও। তুমি… তুমি তাকে ভালোবাসো, তাই না! প্রচন্ড রকমের ভালোবাসো…….
এইটুকু বলেই আর বাকিটা বলার সামর্থ্য তার হলো না। ভেতর থেকে গলা সম্পূর্ণ চেপে ধরছে,কষ্ট দানাগুলো যেন এখন তার গলার স্বরকেও কেঁড়ে নিয়েছে।
অন্যদিকে কেনীথ ওর অবস্থায় একটু নিজের সত্তা থেকে নড়চড় হলো না।অকপটে বলতে লাগলো,
—“ইউ নো হোয়াট! আ’ম এ হার্ট লেস পারসোন। এন্ড শি ইজ নট আ লাকি গার্ল; কজ শি ইজ দ্য মোস্ট আনলাকি গার্ল ইন দ্য ইউনিভার্স।
রোজ হয়তো কেনীথের কথার অর্থটা এই মূহুর্তে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। সে এই মূহুর্তে এসব ছেড়ে কেনীথকে অকপটে জিজ্ঞেস করলো,

—“তবে কেনো এসেছো এখানে? আমাকে আবারও কষ্ট দিতে। তুমি না এলে তো নিজেকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে নিতে পারতাম। তবে কেনো এলে আমায় কষ্ট দিতে। ”
—“আলেসিয়া! সুখ, কষ্ট, লাভ, হোয়াট এভার! এসব অনুভতি প্রকাশিত হয় হৃদয় থেকে।তেমনি কাউকে কষ্ট দিতে হলেও হৃদয়ের প্রয়োজন। যার হৃদয় বহু আগেই কুৎ*সিত কালো আধারে ঢেকে গিয়ে বিষা*ক্ততা, পৈশা*চিকতা, হিং*স্রতায় পরিণত হয়েছে তার মাঝে থেকে এসব অনুভূতি প্রকাশ কিভাবে ঘটবে!
হৃদয় হতে হয় তোর মতো। যে লালকে ভালোবাসে কেননা সে লাল রং-কে বোঝে ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে।
যে কালো দুনিয়া থেকে সরে গিয়ে সুন্দর সব স্বর্ণালি অনুভূতি দিয়ে নিজের জগৎ সাজিয়েছে। এতো সুন্দর একটা সুসজ্জিত জগৎ-এ এমন কালো কুৎসিত হৃদয়ের মানুষের প্রবেশ মানেই ধ্বং*সয*জ্ঞ!
মূহুর্তেই সব সুন্দর সুন্দর অনুভূতির ধ্বং*স হয়ে তা স্বর্গ হতে নর*কে পরিণত হবে। তুই চাস তোর সাথে ঠিক এমন কিছুই হোক!”
কেনীথের কথাগুলো শুধু পলকহীন ভাবে রোজ শুনে গেলো তবে কিছুই বললো না।অন্যদিকে কেনীথ আবারও বললো,

—“তুই লাল আর স্বর্ণালিকে ভালোবাসিস নিজের স্নিগ্ধ অনুভুতি গুলোকে সোনার মতো উজ্জ্বল মূল্যবান ধাতু দিয়ে আবৃতর লক্ষে। তুই জানিস তোর অনুভূতির মূল্য সবকিছুর উর্ধ্বে। আর আমি লাল-কালো ভালোবাসি কারণ লাল মানে আমার কাছে প্র*লয়, ধ্বং*সযজ্ঞের, হিং*স্রতা আর তীব্র ক*ষ্টের পরিনাম র*ক্ত হিসেবে। যে রক্তে গা ভাগিয়ে আমি শান্তি পাই সেখানে তোর মতো স্নিগ্ধ অনুভুতির অধিকারী মানুষেরা ঘৃণায় নাক ছিটকায়।
আর এমন পি*শাচের কালো আধার ব্যতীত অন্যকিছু ভালোবাসবে না এমনটাই স্বাভাবিক।
আমি তোকে শুধু এতোটুকুই বুঝাতে চেয়েছি যে তুই আর আমি এক নই। আমি তোকে শুধু বোন হিসেবে দেখেছি আর ভবিষ্যতেও দেখবো। যত তাড়াতাড়ি নিজেকে বিষয়টি বুঝাতে পারবি ততই সেটা তোর জন্য মঙ্গল হবে।”
—“যদি তুমি হার্ট লেসই হও তবে আমাকে এতো সুন্দর করে এক্সপ্লেইন কেনো করতে যাচ্ছো।হার্ট লেসরা তো তাদের সব কথাতেই কষ্ট দেয়। এদের কোনো সাহিত্যেক জ্ঞান থাকে না।আবেগ, অনুভুতি কিছুই থাকে না।তবে তুমি কিভাবে এতোকিছু জানো বলো! হার্ট লেসরা কখোনো অন্যের মন রাখতে জানে না। তারা শুধু কষ্টই দিতে পারে। কে তার ভাই, বোন, আত্নীয় এসব তারা দেখে না। তবে তুমি কেনো আমাকে সরাসরি কষ্ট না দিয়ে নিজের বোন বলে ছাড় দিচ্ছো। এখনোও বলবে তুমি হার্ট লেস।
কেনীথ আবারও বাঁকা হেসে বললো,

—“অতিরিক্ত উত্তেজনা ভালো না।তুই বলছিস আমার কথায় তুই কষ্ট পাচ্ছিস না অথচ আমি তোকে রোজ না ডেকে আলেসিয়া বলে ডেকেছি আর এই সামান্য কথাতেই এতোটা কষ্ট পেয়েছিস যে এখন কি থেকে কি বলছিস তা নিজেও জানিস না।যদি এই কষ্টের পরিমাণটা আরেকটু বাড়িয়ে দেই তবে বাঁচতে পারবি না তো! ”
এবার মাথা নিচু করে পুরোটা শুনেই রোজ মাথা উঁচু করলো। ফোলা ফোলা ভেজালো চোখে তীক্ষ্ণ কন্ঠে কেনীথকে বললো,
—“চলে যাও তুমি! আর কখনো আসবে না এখানে। আর কখনো দেখতে চাইনা তোমার মুখ। আমি ম*রে গেলেও তুমি আসবে না, কখনো না! ”
কেনীথ রোজের দিকে তাকিয়ে ওর তীব্র কষ্টে জড়ানো কথাগুলো শুনে মুচকি হেসে বললো,
—“কাজে এসেছিলাম, কাজ শেষ হলে চলে যাবো। ভবিষ্যতে একেবারেই যে এখানে আসা হবে না, এমন নিশ্চিয়তা দিতে পারছি না। প্রয়োজন পড়লে আবার আসবো তবে তুই না চাইলে তোর সাথে আমার দেখা আর কখনো হবে না।”

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ১২

রোজ আর কিছু বললো না ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ছলছল করে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কেনীথ মুচকি হেসে ওর হাত থেকে ফুলের তোড়াটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখার পর তা সামনের এক ফাঁকা ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখলো। এটা দেখে যেন রোজ বাদ বাকিটুকুও ভেঙ্গে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। অন্যদিকে কেনীথ রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে লাগলো এবং যেতে যেতেই বলতে থাকলো,
—“কেউ যদি আমার জন্য নিজের মূল্যবান জীবন শেষ করে দিতে চায় তবে আমি কিন্তু কষ্ট পাবো না।”

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ১৪