একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ১৫

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ১৫
রনীতা তুশ্মি

আনায়া অফিসে এসে জানতে পারলো কেনীথ আজও অফিসে আসেনি। সে কোথায় গিয়েছে কিংবা কবে আসবে এই বিষয়েও কেউ কিছু জানে না। আনায়া ছোট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবলো,
“ভালোই হয়েছে। যতদিন আসবে না ততদিন একটু শান্তিতে কাজ করা যাবে। নাহলে এই লোকটা মানেই তো এক বড়সড় আ*তংক।”
আনায়া কেনীথের দিয়ে যাওয়া মোটামুটি অনেক কাজই পূর্বের দিনে সম্পন্ন করে রেখেছিলো যে কারণে আজ আর তার কাজ বলতে তেমন কিছুই নেই। এজন্য নিজের কেবিনে বসে বসে তার নিজের একাডেমিক বই পড়ছিলো। আনায়া প্রতিদিনই এমনটা করে। বাড়ি থেকে আসার সময় কোনো একটা একাডেমিক বই নিয়ে আসে, যদি কাজ না থাকে তবে ওসব পড়েই সময় কাটায় কিন্তু আজ এই মূহুর্তে আর একাডেমিক বই পড়ার কোনো ইচ্ছে জাগছে না। সবকিছুই প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে। কেমন এক বদ্ধ জায়গা যন্ত্রের মতো দিন পার করতে হচ্ছে। আবার এছাড়া করারও বা কি আছে।

আনায়া নিজের চেয়ারে বসে ডেস্কে একহাত ছড়িয়ে মাথা রেখে আনমনে নানা বিষয় নিয়ে ভেবে যাচ্ছে। খোলা চুলগুলো টেবিলের উপর এলোমেলো হয়ে পড়ে রইছে। পরণে সাদা আর বেবি পিংক কালার কম্বিনেশনের কুর্তি আর তার ভাবুক গালে ফুটে ওঠা টোল। যদিও ইনায়ার মতো খুব ধবধবে ফর্সা কিংবা অতিরিক্ত লাবন্যময়ী নয় তবুও সবমিলিয়ে মেয়েটা এক চমৎকার সৌন্দর্যের অধিকারী।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আনায়া একদিকে তারেকের কথা ভাবছে অন্যদিকে রেহানের কথা। সেই কতমাস হলো রেহানের সাথে তার সামনাসামনি দেখাসাক্ষাৎ নেই। ছেলেটাকে প্রচন্ড মনে পড়ছে তার। রেহান যদিও আগের চেয়ে অনেকটা সুস্থ তবুও আনায়ার মনে হচ্ছে একবার রেহানের তার কাছে আসা উচিত। কিন্তু এই বাইনা রেহানের কাছে এই মূহুর্তে করাটা একদম বোকামি। রেহানের আরো সুস্থতার প্রয়োজন তার উপর ওখানে ও তো বসে বসে নেই। পড়াশোনারও যথেষ্ট চাপ রয়েছে। সবকিছু ফেলে রেখে তার কাছে আসাটার কথা বলাটা কি অনেক বেশি গাধামি হয়ে যায় না! তবে এটাও ভেবেনিয়েছে যে এমাস কিংবা সামনে মাসের মধ্যেই একটা স্মার্ট ফোন কিনে নেবে। এই আধুনিক কালে এসেও এমন দুজন দুজনকে না দেখার মতো দুর্ভোগের কোনো মানো হয়!

অন্যদিকে আবার আনায়া কেনীথের বিষয়টিকে স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছে। কারণ কেনীথের পারসোনালিটি হিসেবে তার ওসব ব্যবহার খুব বেশি অস্বাভাবিক নয়। মূল কথা লাইফে অনেক কিছুই স্যাক্রিফাইস করতে হয় আর যেটা তাকেও করতে হবে। তবে এসবের মাঝে সবকিছুর উর্ধ্বে আরো একটি বিষয় রয়েছে যার প্রতি সবসময় সজাগ থাকা প্রয়োজন। আর যাইহোক, নিজের চারিত্রিক বিষয়ে কেউ আঘাত করলে কিংবা প্রত্যক্ষ ভাবে কোনো বাজে উদ্দেশ্যে ক্ষতি করলে চাইলে, তা কখনোই মুখ বুজে সহ্য করার ক্ষমতা আনায়ার নেই। তখনও যে ফ্যামিলির কথা ভেবে নিয়ে অন্যায় সহ্য করবে তা তো হতে পারে না।আনায়া এসব ভাবনা চিন্তা রেখে আবারও রেহানের ভাবনায় বুদ হলো।
রেহান যা করছে তা তো সব তার আর ওর ভবিষ্যতের জন্য। ওর লাইফ সেটআপ হয়ে গেলেই তো আর কোনো টেনশন নেই। তখন তো রেহানের বউ হতে আর কোনো বাঁধা নিষেধ থাকবে না।

হঠাৎ রেহানের বউ হওয়ার কথা চিন্তা করেই আনায়া কিঞ্চিৎ লজ্জায় মুচকি হেসে ফেললো। এখনোই কি না কি ভেবে যাচ্ছে। শুধু রেহানের লাইফ সেটআপ হলেই তো হবে না তারটাও তো করতে হবে। বিয়ের পর বাবা আর ছোট বোনের কি হবে সেটাও চিন্তার বিষয়। আর যাইহোক কখনো বোন আর বাবাকে অন্যের বোঝা বানানোর চিন্তা ভাবনা করার মেয়েতো আনায়া নয়। আপাতত এসব থাক, বিয়ে-শাদি না হয় পরেও সময়-সুযোগ করে করা যাবে। কোনো তাড়াহুড়ো করে দুটো ফ্যামিলির মধ্যে কোনো প্রবলেম ক্রিয়েট কিংবা কেউ কোনো কিছুতে কষ্ট পায়, এটা আনায়া চায় না। সবার মাঝেই যেন হাসিখুশির সামঞ্জস্যপূর্ণতা বজায় থাকে।
আনায়া মুচকি হেসে টেবিলে থেকে মাথা উঠাতে যাবে তখনই একজনের আওয়াজ কানে এলো।

—“ম্যাম আসবো! ”
আনায়া ঠিকঠাক মতো বসতেই তার নজরে এলো আয়াশ দরজাটা অর্ধেক খুলে তাতে মাথা উঁকি দিয়ে মুচকি হাসছে। আনায়া তা দেখে ত্বরিত বললো,
—“জ্বি, আসেন আসেন! এটা আবার বলতে হয়। ”
আয়াশও মুচকি হেসে কেবিনে ঢুকে দরজাটা কিছুটা চাপিয়ে দিয়ে ডেস্কের সামনে এসে বললো,
—“ম্যাম বসবো! ”
আনায় এবার ভ্রু কুঁচকে বললো,
—“এসব কেমন কথা! আপনি আমাকে বারবার ম্যাম কেনো বলছেন। আর এভাবে ভেতরে আসা, বসার জন্য পারমিশন নেওয়ারই বা কি আছে। আমি তো আপনার ছোট। ”
আয়াশ মুচকি হেসে বসতে বসতে বললো,
—“ছোট বললেই কি আর হবে! আপনি এখানকার পি.এ. এটাও তো মাথায় রাখতে হবে। রুলস বলে একটা কথা আছে না! ”
আনায়া তাচ্ছিল্যের সাথে বললো,

—“আগে আপনি আমায় তুমি করে বলুন, আর এখানকার আবার রুলস! ওটাও আছে নাকি, আমার তো জানাই ছিলো না। কতদিন ধরে আছি অথচ আমি কেনো আছি আর কি করছি তাই বুঝে উঠতে পারছি না। কেমন এক উদ্ভট জীবন হয়ে যাচ্ছে।
আয়াশ আনায়ার কথায় হাসলো।
—“কি আর বলবো,যার জন্য কাজ করি সেই তো উদ্ভট। সেখানে আমরা একটু আধটু উদ্ভট না হলে কি চলে! যাই হোক, দিনকাল কেমন চলছে তোমার। আসার সময় তো দেখলাম কি যেন ভেবে হাসছিলে। ”
—“ওহ! ও তেমন কিছুই না। কাজ কর্ম না থাকলে যা হয়। আপনিই বলুন, এভাবে কাজকর্ম ছাড়া রোবটের মতো জীবন ভালো লাগে? ”
আয়াশ হেসে বললো,

—” কি আজব! কেউ কাজ করতে চায় না আর তোমার কাজ না থাকায় বোরিং হচ্ছো। আ….. তুমি যেহেতু ভিকের পি.এ. সেক্ষেত্রে স্যারের কেবিনে হয়তো তার অগোছালো অনেক ফাইল পেয়ে যাবে। তুমি ওগুলো একবার চেক করতে পারো। পরবর্তীতে হয়তো দেখা যাবে ওসবও করতে দিতে পারে। এরচেয়ে ভালো হবে এখনই ওসব করে রাখো, তাহলে সময়ও কাটবে আর কাজও কিছুটা এগিয়ে যাবে। ইমন ভাইকেও দেখতাম নিজে নিজেই সব কি না কি করে রাখতো। ”
আনায়া আয়াশের কথাগুলো মনযোগ দিয়ে শুনে তার এই মতামতে সম্মতি দিলো। এরপর এসব নিয়ে আরো কিছুক্ষণ কথা বলার পর বললো,

—“আ…রুহি আপুর কি খবর। তাকে কয়েকদিন ধরে দেখছি না।উনার কিছু হয়েছে? ”
আনায়ার কথা শুনে আয়াশ কিছুটা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
—“ওর সাথে আমার সম্পর্কটা একটু গভীর আই মিন আমাদের কলিগদের মধ্যে ওর সাথে বন্ডিংটা ভালোই, একদম ফ্রেন্ডের মতো কিন্তু কয়েকদিন ধরে ওর কোনো খোঁজখবর না পেয়ে আমি নিজেও চিন্তিত। আর যাই হোক, কখনো ও নিজের কাজ ফেলে রেখে হুট করে এভাবে গায়েব হয়ে যায় না। কবে থেকে ফোনে ট্রাই করছি তাও ওর কোনো খবর নেই। ওর যেখানে থাকে, ওখানে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ওখানেও নাকি ও নেই।
এদিকে ওর বাবার তো বড় ক্ষমতার হাত কম নয়। প্রথমে ওর ফ্যামিলি ভেবেছিলো হয়তো তাদের জানাশোনার মাঝেই আছে কিন্তু এখন খবর নিয়ে জানতে পারছি ওর নামে পুলিশের কাছে মিসিং ডাইরি করা হয়েছে। তবে ওকে অনেক খুঁজেও নাকি কোথায়ও পাওয়া যাচ্ছে না।”
আনায়া পুরো বিস্মিত হলো এসব শুনে। লাস্ট সেদিনই মেয়েটাকে সুস্থ দেখেছিলো আবার হঠাৎ কি হলো। এরই মাঝে আয়াশ আবারও বললো,

—“শোনো আনায়া, এসব খবর যেন কারো সাথে শেয়ার করতে যেও না। এই পুলিশ আর ওর মিসিং এর বিষয়টি গোপনীয় ভাবে করা হচ্ছে। কারণ ওর বাবাই চাইছে না এই বিষয়টি জানাজানি হোক। কারণ এটা জানাজানি হলে রুহির বাবা মিডিয়ায় পরিচিত মুখ হওয়ায় তার নামে কাঁদা ছোড়াছুড়ি হবে।”
আনায়া কিছুটা অবাক হয়ে বললো,
—“এটা কেমন কথা! মেয়ে হারিয়েছে আর বাবা তাকে খুঁজতে পুলিশ লাগিয়েছে এতে মিডিয়ার কাঁদা ছোড়াছুড়ি করার কি আছে? ”

—“এটাই তো কাহিনি! রুহির কিছু বদ অভ্যাস রয়েছে। আমিও কিছুটা জানি। ঘটনা হলো লাস্ট রুহিকে মধ্যেরাতে শহরেরে নামীদামী নাইট ক্লাবে দেখা গিয়েছে। নাইট ক্লাবের অনেকেই ওর ওখানে থাকাটা নিশ্চিত করেছে। সমস্যা হলো পুলিশকে এতো কষ্ট করতে হতো না, যদি সিসিটিভি ফুটেজ গুলো থাকতো। নাইটক্লাবের আশেপাশের মোটামুটি যতগুলো সিসিটিভি ছিলো, ঐ রাতের সব ফুটেজ গায়েব করা হয়েছে।
ধারনা করা হয়েছে, সিসিটিভি হ্যাক করা হয়েছিলো৷ ”
—“এত্ত কিছু! তার মানে কেউ ইচ্ছে করে…… একমিনিট! রুহি আপু ওখান থেকে কোথায় গিয়েছে এটা কেউ দেখেনি? সিসিটিভি ছাড়াও তো কারো না কারো তার উপর নজর পড়া উচিত, কেউ তো খেয়াল…….
আনায়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই আয়াশ বললো,

—“আরে ওখানে যেগুলো যায় সব মাতাল! কে কার খবর নেবে, সব তো নেশায় বুদ হয়ে থাকে। তবে পুলিশ ইনভেস্টিগেশন করে কয়েকজনের থেকে জেনেছে যে, রুহি ক্লাব থেকে বের হওয়ার সময় সে একা বের হয়নি বরং তার সাথে আরো এক বড়সড় দেহের মানুষও ছিলো। এখন কে ছিলো সেটাই কেউ সঠিক ভাবে বলতে পারছে না। লোকটা নাকি একদম মুখে মাক্স ক্যাপ পড়া বলতে গেলে ছদ্মবেশী ছিলো।
বুঝতে পারছো, ঘটনাটা কোনো স্বাভাবিক কিছু নয়; ইট’স কমপ্লিকেটেড। ”
আনায়া এসব শুনে সত্যিই অবাক হলো। তারমানে মেয়েটার কেউ ক্ষতি…… উফ!এমন কিছু যেন না হয়। মেয়েটা যতই উগ্র হোক না কেনো ক্ষতির সম্মুখীন যেন না হয়। এমন কিছু প্রার্থনা করেই আনায়া আয়াশের সাথে এই বিষয়ে আরো কিছু কথা বললো একটা পর্যায়ে গিয়ে জানতে পারলো আজ আয়াশ হয়তো তাড়াতাড়িই কাজ শেষে চলে যাবে। এজন্য একটু পর আর ওর সাথে দেখাও হবে না। এদিকে রুহির ফ্যামিলির সাথে যোগাযোগ থাকায় ওর সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে তাই সেগুলোই ঘটনা শুনতে লাগলো।

বাহির থেকে ঠান্ডা বাতাস রুমে এসে প্রবেশ করছে। পর্দাগুলো মনের আনন্দে দোল খেয়ে যাচ্ছে। টেবিলের উপর মাথা হেলিয়ে পড়ে পড়ে ঘুমতে থাকা তরুনী ঠান্ডা বাতাসের দরূনো বারবার সেই শিহরণে শিহরিত হচ্ছে।
রাত কয়টা বাজে আনায়ার তা জানা নেই। কেনীথের কেবিনের ফ্লোরে আর টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অর্ধশত ফাইল। এসব নিয়েই অনেকক্ষণ আগে বসেছিলো আনায়া। নিজের কেবিনে না গিয়ে পাকনামি করে ওখানেই কাজ করতে বসে গিয়েছে।

কেনীথের চেয়ারের বসে ওর ডেস্কে মাথা এলিয়ে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে আনায়া। কেনীথ রুমে সবসময় একটা অন্ধকার আর আবদ্ধ থাকায় অনেকটা জেলখানার মতোই মনে হয়। কিন্তু আনায়া আজ সেসবও চেঞ্জ করতে গিয়েছিলো তবে তা আর হয়নি। বারান্দায় দরজাটা একদম খুলে রাখায় সেখান দিয়ে বাহির থেকে সাই সাই করে বাতাস ভেতরে প্রবেশ করলেও রুমে আর চকচকে আলোর ব্যবস্থা করতে পারেনি।
বাধ্য হয়েই নিজের রুম থেকে টেবিল ল্যাম্প এনে কাজে বসে গিয়েছিলো।
ঠান্ডা বাতাসের শিহরণে একটা সময় পর হঠাৎ আনায়ার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। হুট করেই ধরতে পারলো না সে ঠিক কোথায় রয়েছে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো রুমের সবজায়গা অন্ধকার শুধু তার সামনে রাখা টেবিল ল্যাম্পের কারণে আশেপাশে কিঞ্চিৎ পরিমাণ আলো ছড়িয়ে রয়েছে।
একে তো আচমকা ঘুম থেকে উঠেছে অন্যদিকে এতো বড় রুমটায় টেবিল ল্যাম্পের আলোর বিস্তারটা আনায়ার খুব সামান্যই মনে হলো।

আনায়া বুঝতে চেষ্টা করলো এখান সে ঠিক কোথায় আর কি কারণে রয়েছে। একটা সময় পর তার মনে পড়তেই চমকে উঠলো। তাড়াহুড়ো করে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ফাইলের মাঝ থেকে নিজের ফোনটাকে বের করে সময় দেখতেই মাথায় একহাত দিয়ে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। এসব কি! রাত বারোটার ছুঁইছুঁই । সে নেশা করে নাকি ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছিলো? আনায়া চোখে এখন সর্ষে ফুল দেখার মতো অবস্থা।
এতো রাত হয়ে গেলো অথচ তার সামান্য হুসও হলো না! এতো বড় গাধামি করলো কি করে। আশেপাশের সবাই হয়তো কাজ শেষে এতোক্ষণে চলেও গিয়েছে। এতোক্ষণ তো কারো থাকার কথা নয়। গাধামিটা তো সেই-ই করেছে। নিজের কেবিনে থাকলে নিশ্চয় গার্ড এসে দেখে যেত কেউ আছে কিনা কিন্তু কেনীথের রুমে থাকায় হয়তো দেখতেও আসেনি।

আনায়ার পুরো কান্না পাচ্ছে! কিন্তু এখন কান্নাকাটি করার সময় মোটেও না। তাড়াতাড়ি এখান থেকে যেতে হবে। অফিসে কেউ না থাকলে গার্ড বারোটার পর অফিসের ভেতরের মেইন গেইট বন্ধ করে দিতে পারে।
এই ভেবে আনায়া কোনো মতে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ওরনাটা ঠিক করে ফোনটা হাতে নিয়ে নিলো। তার ব্যাগ,তার কেবিনেই রেখে এসেছে।
আনায়ার আশেপাশে তাকানোর আর সময় নেই। প্রথমে ভাবলো ফাইলগুলো সব ঠিকঠাক করে রেখে যেতে হবে।এই ভাবনায় ফ্লোর আর ডেস্কের ফাইলগুলো গোছাতে গিয়ে একবার ফোন চেক করতে গিয়ে আবারও বেচারী চমকে উঠলো।

ত্বরিত ভাবলো এখন এসব ফাইলগুলো সব গুছিয়ে রেখে যেতে যেতে অনেক সময় লেগে যাবে। তখন আবার আরেক বিপদ। কি করবে,না করবে কিছু বুঝে উঠতে পারলো না৷ তবে বেশি সময় নষ্ট না করে ভাবলো আপাতত যতটুকু গুছিয়েছি ততটুকুই থাক, বাকিটা কাল সকালে তাড়াতাড়ি এসে ঠিক করা যাবে। আর কেনীথ যেহেতু কবে আসবে তার ঠিকঠিকানা নেই তাহলে এতো টেনশন করারও প্রয়োজন নেই।
আনায়া ফোনের ফ্লাশ লাইটটা অন করে টেবিল ল্যাম্পটা বন্ধ করে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্বেগ হলো।
—“ফাইলগুলো যেভাবে রাখা ছিলো, পুনরায় সেভাবেই থাকা চাই।”

কিন্তু মূহুর্তেই এক গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে আনায়া ভিষণ ভাবে চমকে যাওয়ায় তার হাত থেকে ফোনটা নিচে পড়ে গেলো। আনায়ার মূহুর্তেই কিঞ্চিৎ সময়ের জন্য দমটা বন্ধ হয়ে গেলো। সে যা শুনলো এটা কি সত্যি নাকি তার ভ্রম। আনায়া গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। আওয়াজটা তো মনে হলো সামনে থেকে এসেছে কিন্তু সামনে কিংবা আশেপাশে তো কেউ নেই। তাহলে কোথায় থেকে আওয়াজ এলো, বারান্দা থেকে! নাকি এখানে আবার ওসব ভুত আত্মা রয়েছে। এইজন্যই কি এই ঘর এমন অন্ধকার রাখা হয়। আনায়ার এবার এসব ভেবে সত্যিই কান্না পাচ্ছে। কিন্তু নিজের এমন বোকামি চিন্তা ভাবনা আর আচরণে বিরক্তও হচ্ছে। কিসব আজব চিন্তা ভাবনা।
আনায়া নিচু হয়ে আগে ফোনটা তুলে হাতে নিলো। এরপর কিছু বলতে চেয়েও দেখলো গলা থেকে আওয়াজ বের হচ্ছে না। আনায়া বিরক্ত হলো নিজের উপর। কিছুুটা নিজেকে তটস্থ করে বারান্দার দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। আর যেতে যেতে অনেকটা কষ্ট করেই গলা থেকে আওয়াজ বের করলো,

—“ওখানে… কে….!”
এটা বলেই আর আনায়া সামনের দিকে অগ্রসর না হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ বারান্দার দিকে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো আদোও ওখানে কেউ আছে কিনা তবে এতো রাতে বারান্দায় যাওয়ার আর সাহস হলো না।
কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও যখন কোনো সারাশব্দ এলো না তখন আনায়া নিজের বোকামির জন্য তাচ্ছিল্যর সাথে হেসে পিছনে ঘুরে যেতে নিলেই হঠাৎ বারান্দা থেকে আসতে থাকা কিছু পায়ের আওয়াজ শুনতেই ত্বরিত পিছনে ফিরে তাকালো।
এরপর যা হলো তার জন্য হয়তো আনায়া নিজেও প্রস্তুত ছিলো না।পিছনে ঘুরে তাকাতেই দেখলো বারান্দা হতে অন্ধকারে একটি ছায়া মানব তার দিকে দ্রুত গতিতে অগ্রসর হচ্ছে। আর এটা দেখেই আনায়ার মস্তিষ্ক আগে পিছনে ডানে বামে কিছু না ভেবেই ফোনটা নিচে ফেলে রেখেই জোরে চিৎকার দিয়ে ভয়ে দৌড়ে পালাতে নিলেই, ফ্লোরে পড়ে থাকা একটা ফাইলের পিচ্ছিল কভারের উপর পা পরায় নিজের ব্যালেন্স হারিয়ে সোজা ধপাৎ করে ফ্লোরে আঁচড়ে পড়লো।

—-“আ……………………………
কেনীথের রুমটা সাউন্ড প্রুভ যেহেতু তাই তার আওয়াজ আশেপাশে কারো কানে পৌঁছানোর সম্ভবনা ক্ষীণ। কিন্তু তার এমন উদ্ভট চিৎকার শুনে আনায়ার পেছনে সটানভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়া মানবটা গম্ভীর আর ক্ষী*প্ত সুরে বললো,
—“শাটআপ!!! ”
আওয়াজটা শুনে আনায়া নিজের চিৎকার থামিয়ে ভাবলো এই কন্ঠস্বর তো তার চেনা। কিন্তু সে যেটা ভাবছে ওটা কি করে সম্ভব। আজ সারাদিনও তো কেনীথ স্যার অফিসে ছিলো না তাহলে এখন কোথায় থেকে এলো। আচ্ছা উনি কি সত্যি, সত্যিই এসেছেন? তবে আমি কোনো এতো ভয়ে রাম ছাগলের মতো চেচাচ্ছি!
মনের মধ্যে অবাধ সাহস ঢুকিয়ে পেছনে ঘুরে তাকানোর সিন্ধান্ত নিলো। কিন্তু পিছনে তাকাতেই তার সব সাহস হাওয়ায় উড়ে গেলো।
তার ফোনটা নিচে পড়ে থাকায়, সেই ফ্লাশ লাইটের আলো উপরের দিকে প্রতিফলিত হওয়ায় ছায়া মানবের শারীরিক গঠনের দৃশ্যটা সম্পূর্ণ অস্পষ্ট ভয়ং*কর দা*নবের মতো দেখাচ্ছে।
আর এটা দেখেই আনায়ার হুস উড়ে যায় যায় অবস্থা। এবার আনায়া ফ্লোরে বসা অবস্থায় আবারও একই সুরে চিৎকার দিতে দিতে চোখ বন্ধ করে সামনে থেকে পেছনে দিকে অগ্রসর হতে লাগলো।

—“আ………….
—“যাস্ট শাট আপ “তারা”! ”
প্রচন্ড বিরক্তিপূর্ণ কন্ঠ বলা কথাটা শুনে আনায়া এবার চিৎকার থামিয়ে থম মেরে ফ্লোরেই বসে রইলো। এরপর ধীরে ধীরে চোখ খুলতেই তাকিয়ে দেখলো রুমে খুব সামান্য পরিমাণের অফ হোয়াইট কালারের লাইট গুলো জ্বালানোয় চারপাশটা কিছুটা আলোকিত হয়েছে আর আনায়ার সেই ছায়া মানবের জায়গায় কেনীথের বলিষ্ঠ দেখ আর চেহারা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
আনায়া কয়েকবার চোখের পাপড়ি ঝাপটে আমতাআমতা সুরে বললো,

—” স্যার, এটা কি সত্যিই আপনি নাকি…….. ”
আনায়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই কেনীথ বললো,
—“ফাইল গুলো যেভাবে ছিলো ঠিক সেভাবেই যেন থাকে। সময় মাত্র পাঁচ মিনিট।”
আনায়া হুট করেই কিছু বুঝতে পারলো না কিন্তু যখনই তার মস্তিষ্ক সক্রিয় হলো তখনই ত্বরিত বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কাজে লেগে পড়লো৷ একে একে আশেপাশে যতগুলো ফাইল ছরিয়ে ছিটিয়ে ছিলো তার সবগুলো গুছিয়ে ছোট কাভার্ডে সাজিয়ে রাখতে লাগলো।
এদিকে কেনীথ একই জায়গায় সটানভাবে দাঁড়িয়ে প্যান্টের পকেট দুহাত গুঁজে আনায়ার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। পরনে কালো রংএর জ্যাকেট আর কালো আর রেড কম্বিনেশনের টিশার্ট আর কালো প্যান্ট। চোখেমুখে একই সেই গাম্ভীর্যের ছাপ। চুল গুলোও প্রতিনিয়ত যেমন অবহেলায় এলেমেলো অগোছালো থাকে অনেকটা অমন করেই হাফ মেসি বান করা।
কেনীথ যে তার চোখমুখ শক্ত রেখেও তাকে পর্যবেক্ষণ করছে আনায়া তা ঠিকই বুঝতে পারছে। আড়চোখে সেও এসব মাঝেমধ্যে খেয়াল করলেও কখনো মুখ ঘুরিয়ে সরাসরি কেনীথের দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছে না। কিন্তু এদিকে আনায়ার কলিজার পানি শুকিয়ে গিয়েছে। কোনোমতে কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে পাড়লেই বাঁচে।
আনায়া সব কাজ শেষ করে পিছনে তাকিয়ে দেখলো কেনীথ তার দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে। যা দেখে আনায়া কেনীথের সাথে তার চোখাচোখি হওয়ার আগেই নজর নিচের দিকে ফেলে বললো,

—“স্যার সরি! ”
সামনে থেকে কোনো সারা শব্দ না এলে আনায়া কেনীথের দিকে কিঞ্চিৎ তাকিয়েও আবার চোখ নামিয়ে ফেললো আর বললো,
—“আ…ফাইল গুলো না গুছিয়েই চলে যাচ্ছিলাম এজন্য। সরি স্যার, হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ায় কিছু বুঝতে পারিনি। ”
—“I don’t like chaotic work.Make sure such mistakes don’t happen next time.”
আনায়া মাথা নিচু থাকা অবস্থাতেই মাথা আশেপাশে নাড়িয়ে বললো,
—“ওকে স্যার!……. আ…..
আনায়া কিছু বলা আগেই কেনীথ শান্ত সুরে বললো,
—“Leave now ”
এরপর আনায়া আর কিছুই বললো না। আর না কেনীথের দিকে তাকিয়ে তার গতিবিধি দেখার চেষ্টা করলো। সোজা পিছন দিকে ঘুরে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।

আনায়া কেনীথের রুম থেকে বেরোতেই দেখলো চারপাশ পুরো অন্ধকার ছেয়ে গিয়েছে। পুরো এরিয়ার যতগুলো লাইট ছিলো সব নিভে দেওয়া হয়েছে। কেমন যেন গা ছমছমে পরিবেশ। না চাইতেও ভয়ে কাটা দিচ্ছে।
আনায়া এসব আর বেশি ভাবতে চাইলো না। ফালতু মনে যত বেশি এসব ভাবা যায় এ যেন আরো তত বেশি ভয় ঢুকিয়ে দেয়। আনায়া তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি দিয়েই নিচে নেমে চলে গেলো। তার শুধু তার ফোনের ফ্লাশ লাইট অন করা আর আশেপাশে ছোট ছোট ডিজাইনার লাইট জ্বালানো। আনায়া চাইলে লিফটেই যেতে পারতো কিন্তু এই মূহুর্তে আর লিফটে করে যাওয়ার সাহস তার হবে না। এমনিতেই মন মস্তিষ্কের অবস্থা আ*তংকে সময়ের মতোই বারোটা বেজে গিয়েছে।

আনায়া নিচে আসতেই হুস হলো এখন সে বাড়ি যাবে কিভাবে। এখন যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। সবার প্রথমে উপায় হিসেবে ইমনের কথা মাথায় এলো কিন্তু ইমন যে শহরের বাহিরে এই কথা মাথায় আসতেই বেচারীর কান্না করতে ইচ্ছে হলো। এই মূহুর্তে ইমন ছাড়া আর কে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারবে।
আগে পিছে না ভেবে হাঁটা শুরু করতে চাইলে আবার নিজেই নিজের কাজে রেগে গেলো। মাথাটা মনে হয় তার পুরোই গিয়েছে। এতো দূর রাস্তা সে কোন গাধীর মতো হেঁটে যেতে চাইছে তাও আবার এতো নির্জন রাতে। এমনিতেই এখানকার আশেপাশের এরিয়া অন্য জায়গার চেয়ে আলাদা। কেমন যেন চুপচাপ আর নিস্তব্ধ।
আনায়া কিছু ভাবতে পারছে না। মাথা পুরো হ্যাং হয়ে গিয়েছে। এখন করবেটা কি। পার্কিং এরিয়ায় গিয়ে চিন্তায় অস্তিরতা নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলো। ভাবতে লাগলো কাকে ফোন করলে কাজ হতে পারে। তার সাহায্য করার মধ্যে শুধু তার ফ্রেন্ডরাই আছে কিন্তু ওদের এ বিষয়ে সাহায্য করতে বললে তো ওরা ওর সম্পর্কে সব জেনে যাবে। তখন তো আবার মহা ঝামেলা।

পরক্ষণেই ভাবলো একবার ইমনকেই ফোন দেবে। তার কোনো বিশস্ত ফ্রেন্ড থাকলে কাজ হয়ে যাবে।
এই ভাবনা নিয়েই আনায়া ইমকে ফোন করলো কিন্তু ভাগ্য তার এতোই খারাপ যে ইমনের ফোন পুরো সুইচঅফ। আনায়ার তো ইচ্ছে করছে রাগে দুঃখে চিৎকার করতে। দু’হাত খিঁচে নিজের রাগ কিছুটা কন্ট্রোল করে ভাবতে লাগলো এবার তার বন্ধু ছাড়া কোনো উপায় নেই।
প্রথমে ভাবলো এই বিষয়ে মেয়েদের বলে লাভ নেই। সাবাকে জানানো মানে তো মহা বিপদ, শিখা তো কিছু করতেই পারবে না আর আলো কি করবে তা ও নিজেই বুঝতে পারবে না। ওর বাবা মা এমনিতেই অনেক স্ট্রিট।
অন্যদিকে সায়েমের বাসা অনেক দূরে, তাজিম আর রনকই পারবে হেল্প করতে। কিন্তু কাকে ফোন করলে কাজ হবে তাই বুঝে উঠতে পারছে না। তাজিম একটু খোলামেলা স্বভাবের, ও না চাইতেও দেখা যাবে এই বিষয়ে তার পুরো ফ্রেন্ড সার্কেল জেনে গিয়েছে। আর এমনিতেই ওদের একজন জানা মানে পুরো দুনিয়া জানা।
তবে রনককে কিছুটা বিশ্বাস করা যায় আর এমনিতেও ও সন্দেহ করে বসে রয়েছে। ওকেই ভালো করে বুঝিয়ে বললেই কাজ হবে। এই ভেবেই আনায়া রনককে ফোন করে করলো। প্রথম বার ফোন উঠিয়েই বললো,

—“কি রে এতো রাতে ফোন করলি যে! ”
—“আ…একটু দরকার ছিলো। আচ্ছা তুই এখন কোথায় আছিস। ”
—“কেনো ভার্সিটি বললাম না, আজ সন্ধ্যায় মামা বাড়িতে যাবো। ভুলে গিয়েছিস?”
আনায়া থম মে*রে গিয়ে আশাহত কন্ঠ বললো,
—“ওহ! তারমানে তুই তোর মামা বাড়িতে, ওটা তো শহরের বাহিরে তাই না? ”
—“হুম!আচ্ছা কি হয়েছে বলতো। কোনো প্রয়োজন……কি দরকার তা তো বললি না। ”
আনায়া হাসি সুরে বললো,
–“নাহ, তেমন কিছু না। তুই এলে বলবোনি৷ ”
—“হ তাই করিস, আর রাতের বেলায় হবু জামাইরে ফোন না করে আমাকে ফোন দিস কোন আক্কেলে! কয়েকদিন পর বউ পালানো কিংবা পরকীয়ার মামলা দিবি এইজন্য? ”
রনকের কথা শুনে আনায়ার মেজাজ আরো খারাপ হলো। এমনিতেই টেনশনে বাঁচে না তার উপর ফালতু মার্কা সব কথাবার্তা। প্রচন্ড বিরক্ততে নিয়ে বললো,

—“নাউজুবিল্লাহ! উফ….চুপ থাক তুই। এমনিতেই মেজাজ গরম আর খারাপ করিস না। ”
—“হুম, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। আচ্ছা ভালো থাক।
এরপর সৌজন্যমূলক সব বিদায় শেষে আনায়া আবারও চিন্তিত হয়ে পড়লো। হঠাৎ তখনই মনে যে সে তার ব্যাগ না নিয়েই নিচে নেমে এসেছে। এখন যেন আনায়ার গড়াগড়ি করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। শেষে আর সময় নষ্ট না করে সেই সিঁড়ি বেয়েই উপরে চলে গেলো।
নিজের কেবিন থেকে ব্যাগটা নিয়ে যেই না আবারও সিঁড়ির উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়েছে অমনি অন্ধকারে কারো সাথে ধাক্কা লেগে ধপাৎ করে সোজা নিচে সঙ্গে তার ভুবন ভুলানোর মতো চিৎকার,
—-“আম…..মা……..
—“হোয়াট দ্যা হেল। এভাবে চেঁচানো বন্ধ কর। ”

হঠাৎ আবারও ধমক শুনতেই আনায়া চুপ। আশেপাশে এবার সত্যিই অনেকটা অন্ধকার। কেউ থাকলে তা ঠিক বোঝারও উপায় নেই আর এখানে আনায়া তো মাথায় বস্তা খানেক টেনশন নিয়ে ঘুরছে।
আনায়া নিজেকে ত্বরিত তটস্থ করে বললো এটা কেনীথ। আসলেই আজ সে গাধা, ছাগল, হাঁস,মুরগী সবকিছুর মতো কাজকর্ম করছে শুধু ব্রেইনটাই খাটাচ্ছে না। তবে এর মাঝে সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো দুইবার ধপাৎ করে নিচে পড়ে যাওয়ায় তার কচি কোমড় খানা যায় যায় অবস্থা। এসব নিয়ে নিজেকে যেমন গালাগালি করছে তেমন কেনীথকেও বাদ দিচ্ছে না৷ কেনীথের এমন ভুত পি*শাচদের মতো চলাফেরা করাটা কি খুবই জরুরি? স্বাভাবিক মানুষের মতো কি থাকা যায় না?বিষয়টি এমন হলে মানুষদের মধ্যে না থেকে নিমগাছ, তেঁতুল গাছ, বেল গাছে গিয়ে থাকলেই তো হয়।
আনায়া উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ফোনের লাইটটা ভালো করে ধরতেই কেনীথ আর আশপাশটা কিছুটা পরিষ্কার হলো এবং আনায়া আমতা আমতা করে বললো,

—” সরি স্যার! তাড়াহুড়োয় খেয়াল ছিলো না। আপনার কোথাও লাগেনি তো! ”
কেনীথ অকপটে বললো,
—“নিচে তুুই পড়ে গিয়েছিলি আমি না! ”
আনায়া বোকার মতো চেহারা বানিয়ে বললো,
—“ওহ হ্যাঁ!”
—” বাড়ি না গিয়ে এখানে কি করছিলি?”
—“বাড়ি যাবো তো! আ….ব্যাগটা ভুলে রেগে চলে গিয়েছিলাম আরকি।”
কেনীথ আর কিছু না বলে সোজা লিফটের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। এদিকে আনায়া থম মে*রে কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেই তার মস্তিষ্ক তাকে জানান দিতেই সে দৌড়ে সে সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হতে গিয়ে কেনীথের কন্ঠস্বর শুনে থেমে গেলো।
—“ওদিকে কেনো যাচ্ছিস। ”

আনায়া পাশে ফিরে তাকিয়ে দেখলো কেনীথ লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে। আনায়া ওর কথার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে ওর দিকে এগিয়ে যেতেই কেনীথ সামনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে লিফটের ভেতরে চলে গেলো। আনায়াও আর দেরী না করে লিফটের ভেতরে গিয়ে কেনীথের পাশে গিয়ে কিছুটা পেছনে দাঁড়ালো।
লিফটের ভেতরে হালকা আলোর মাঝে লিফট ক্রমশই নিচে নামছে আর এদিকে আনায়ার বুক ধকধক করে যেন উপরে উঠছে। লিফটের ভেতরে তো চলে এসেছে কিন্তু কেনীথ যে তার পাশে থাকলে কলিজা, ফুসফুস,হৃদপিণ্ড সব শুকিয়ে যায় ;একথা মাথায় রাখবে কে!
আনায়া নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো।আর মনে মনে বলতে লাগলো, এমন সিচুয়েশনে যেন তার শত্রুর কপালে ভুলেও না জোটে। গত কিছুক্ষণ ধরে জীবনটা তার যায় যায় উপক্রম।
এদিকে আনায়া যে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে নিজের দুহাত মুঠো করে কচলিয়ে যাচ্ছে এটা আর কেনীথের আড়চোখের আড়াল হলো না।মনের মাঝে নানান ভাবনার পর শুধু ওই বাঁকা হাসিই হাসলো, যাহাকে শয়তানি হাসি বললে ভুল কিছু হবে না। হয়তো এই হাসি বর্তমান কিংবা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্য।

নিচে নামতেই কেনীথ পার্কিং এরিয়া থেকে কেনীথের গাড়ি পর্যন্ত আনায়া কেনীথের পেছন পেছনই গেলো কিন্তু এরপর… এরপর সে কি করবে।
আনায়া চুপটি করে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চিন্তিত চিত্তে কিছু ভাবনা চিন্তায় অবস্থা নাজেহাল করছে আর এদিকে কেনীথ নিজের ব্রান্ড নিউ গাড়ি নিয়ে রাস্তায় এসে আনায়ার থেকে কিছুটা সামনে দাঁড়িয়ে।
কেনীথ গাড়ির ভেতর থেকে আনায়ার সকল কিছুই পর্যবেক্ষণ করছে। এদিকে আনায়া ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো যে পুরো সাড়ে বারোটা। এদিকে তার সামনে শেষ উপায় বলতে কেনীথ আর তার গাড়ি। কিন্তু সেটাও যে কখনো ফুড়ুৎ করে চলে যাবে কে জানে। গিয়ে যে কেনীথের কাছে হেল্প চাইছে তার সাহসও হচ্ছে না। যদিও এর আগে একবার হেল্প নিয়েছে তবুও এই কয়েকদিনে তার জীবনের লক্ষ বলতেই এই লোকটার থেকে দূরে থাকা। অথচ ঘুরেফিরে উদ্ভট কেনীথের কাছেই শরণাপন্ন হতে হয়।
আনায়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেনীথের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। গিয়ে মাথাটা কিছুটা নিচু করে কেনীথের উদ্দেশ্য বললো,

—“স্যার একটা হেল্প লাগতো, বাড়ি যেতে হবে।”
কেনীথ জানতো এমন কিছুই হবে,তাই সে কিঞ্চিৎ মুচকি হাসলো। কেনীথ স্টিয়ারিং এ এক হাত রেখে সামনে দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থাতেই বললো,
—“ফাস্ট! ”
আনায়া ভ্রু কুঁচকে আবার ত্বরিত সোজা করে বললো,
—“আ….হ্যাঁ। থ্যাংক ইউ স্যার। ”
এই বলে আনায়া তাড়াতাড়ি দরজা খুলে কেনীথের পাশে বসে পড়লো। আর মনে মনে অনেকটা খুশি হয়ে বলতে লাগলো,

—“বেডা কে যতটা তাঁরছেরা ভেবেছিলাম ততটা না!”
আনায়া সিট বেলটা লাগাতে কেনীথ গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার জন উদ্বেগ হলো। এরপর সাই-সাই করে গাড়ি চলতে লাগলো তার আপন গতিতে। গাড়ির স্পিডটা যথেষ্ট বেশিই ছিলো তবে সমস্যা বাঁধলো আজ কেনীথ গাড়ির জানালা আর বন্ধ করেনি বরং খুলেই রেখেছে। যে কারণে বাহির থেকে বাতাস গাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে আনায়ার খোলা চুলগুলো সব এলোমেলো করে দিচ্ছে।
দু’হাত দিয়ে কানের পাশে গুঁজেও কাজ হলো না তবে যখন বিরক্তিতে চুল ঠিক করতে গিয়ে পাশে নজর পড়লো তখনই সে আঁতকে উঠলো। তার চুলগুলো গিয়ে সব কিছুক্ষণ পরপর কেনীথের মুখে আঁচড়ে পড়ছে। অথচ কেনীথ নির্বিকারে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আনায়ার এটা দেখে কলিজা শুকিয়ে গিয়েছে।
মনে মনে দোয়া দুরূদ পড়ে ভাবতে লাগলো এই বেডায় এখনো কোনো রিয়েক্ট করেনি মানে, নিশ্চিত মারা*ত্মক ক্ষেপে আছে তার উপর। আনায়া চমকে উঠলো এই ভেবে যে, বেটায় আবার শেষমেশ তাকে গাড়ি থেকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে চলে যাবে না তো!

আনায়া আগে পিছনে ভাবনা চিন্তা রেখে ত্বরিত নিজের বড় বড় চুল গুলো নিয়ে খোপা করতে লাগলো। কিন্তু হঠাৎ পাশ থেকে খুকখুক করে কাশির আওয়াজ শুনতেই আনায়া আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো কেনীথ সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে আর কেশে যাচ্ছে।
সে ভাবলো বাহিরের ঠান্ডা বাতাসের জন্য হয়তো এমন হচ্ছে অথচ কাহিনি কিছু ভিন্ন। আর যাই হোক, আনায়ার দুহাত উঁচিয়ে চুল বাঁধার দৃশ্য আড়চোখে খেয়াল করতে গিয়েই কেনীথের বিপত্তি বেঁধে গিয়েছে।
এদিকে আনায়া তাড়াহুড়ো করে চুলগুলো খোঁপা করে বললো,
—“স্যার বাহিরের বাতাস বেশি ঠান্ডা লাগলে বন্ধ করে দিতে পারেন। ”
আনায়ার কথায় কেনীথ কিছুই বললো না উল্টো তার কাশিও কমছে না।এদিকে গাড়িও সে ভালোই স্পিডে চালিয়ে যাচ্ছে।

আনায়া কি করবে হঠাৎ বুঝতে না পেরে নিজের ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে সেটা খুলে কেনীথের মুখের সামনে ধরলো। ওমনিই কেনীথ গাড়ির স্পিডটা কমিয়ে দিয়ে আনায়ার দিকে তাকালো। আর আনায়া বেচারি কেনীথের হুট করে তাকানোতে ভরকে গেলো। তবুও স্বাভাবিক গলায় বলার চেষ্টা করলো,
—“স্যার গাড়িটা থামিয়ে পানিটা খেয়ে নিন। আ……অথবা আপনি হা করুন আমি বরং…….
এরই মূহুর্তেই কেনীথ নিজের মুখ হা করতেই আনায়া আর নিজের কথা সম্পন্ন করলো না। কয়েকবার চোখের পলক ফেলেই কেনীথের মুখে পানি ঢেলে খাইয়ে দিলো। কেনীথ একবার মুখে নিয়ে ত্বরিত মুখ সরিয়ে নিলো আর আনায়াও কিছু বললো না।যেহেতু কাশি থেমে গিয়েছে তবে সমস্যা আর কি!

তবে শেষ বারের মতো আনায়া আড়চোখে আরেকটি বার কেনীথকে আড়চোখে দেখে মনে মনে বললো,
–“যত যেমনই হোক না কেনো, লোকটা তার ছেঁড়া বড় ভাই হিসেবে কিন্তু একদম পারফেক্ট। ”
এই ভেবেই সে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো আর এদিকে কেনীথ নিজের প্রতি বিরক্ত। এভাবে উইক হওয়াটা মোটেও তার জন্য স্বাভাবিক বিষয় নয়। তার ক্ষেত্রে এমনটা মোটেও কাম্য নয়। তাকে নিজেকে নিজের কন্ট্রোল করতে হবে, এইভাবে দূর্বল হয়ে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
কেনীথ দশটার দিকে নিজের অফিসে এসে তার কেবিনে ঢুকেই আনায়াকে ওমন অবস্থায় দেখতে পায়। আর ঠিক তখনই ওর নিষ্পাপ ঘুমন্ত চেহারার উপর মূহুর্ত ক্ষণিকের জন্য আসক্ত হয়ে পড়ে। নিস্তব্ধ অগোছালো রুমটার সবকিছু এড়িয়ে আনায়ার ঠিক সামনা সামনি চেয়ারে বসে পড়ে। এরপর ঠিক আনায়া মতোই ডেস্কে একহাত ছড়িয়ে তাতে মাথা রেখে আনায়ার ঘুমন্ত চেহারা দেখতে থাকে।

আনায়ার সে ঘুমন্ত চেহারায় চিন্তার ছাপ আর গালে পড়া কিঞ্চিৎ টোল দেখে মাঝেমধ্যে মুখে মুচকি হাসিও ফোটে। তবে সেটা তার সেই বাঁকা কিংবা শয়তানি হাসি নয় বরং আনায়ার নিষ্পাপ ঘুমন্ত চেহারার মতোই এক প্রানবন্ত হাসি।
আর এসব নিয়েই কেনীথ নিজের উপর বিরক্ত। তখন ওমন সব কাজ করা আর এখন আবার সেই একই কাহিনি। এখনকার মতো তখনও অবশ্য আনায়া কিছু টের পাওয়ার আগেই সামলে নিয়েছে।
মনে মনে নিজের রাশিয়া যাওয়াটাকেই দোষারোপ করছে। ওখানে গিয়েই একদম ফ্যামিলি ম্যাটিরিয়ালের রোগ ধরেছে। তবে এই রোগ কিভাবে ছাড়াতে হয় তা কেনীথের ভালো করেই জানা আছে।

আনায়ার বাড়ির সামনে এসেই কেনীথ তার গাড়িটা থামালো। বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে এখন প্রায় রাত দুইটার ছুঁইছুই। এতো রাতে মানুষের আনাগোনা থাকার সম্ভবনা কম সেক্ষেত্রে আনায়াকে কেনীথের গাড়ি থেকে তার বাড়ির সামনে নামতে দেখাটাও।
আনায়া দেরী না করে কেনীথকে ধন্যবাদ দিলো ঠিকই কিন্তু কেনীথ আর ওসব পাত্তা দেয় নাকি! কোনোকিছু না বলেই সোজা গাড়িটা ঘুরিয়ে নিজ গন্তব্য চলে গেলো। এদিকে আনায়া আর এসবে কিছু মনে করে না। এসব তার কাছে অনেকটা নরমালই হয়ে গিয়েছে।
আধারে ঢাকা রাত আর আশেপাশে ঝিঁঝি পোকাদের গা ছমছম করার মতে আওয়াজ ভেসে বেড়াচ্ছে। তবে আনায়া এবার আর তেমব ভয় পেলো না। মুচকি হেসেই নিজের বাড়ির উদ্দেশ্য অগ্রসর হলো।

আনায়া বাড়ির বাগানের মেইন গেইট পার হয়ে সদর দরজার কাছে এসে চাবি দিয়ে দরজার লক খোলায় ব্যস্ত এমন সময় হঠাৎ আনায়ার চাবি ঘোরাতে থাকা হাতটা থেমে গেলো। চোখে মুখে আকস্মিক ভাবে সন্দেহ আর চিন্তার ছাপ পড়লো।চারপাশে ঝিঁঝিপোকাদের ডাক আর দমকা ঠান্ডা বাতাস যেন পরিবেশটাকে আরে ভীতিকর করে তুলেছে।
আনায়ার হুট করেই কেনীথের একটা কথা বারবার মনে হচ্ছে যা এতোক্ষণ মাথায় আসেনি।

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ১৪

কেনীথ তখন ধমক দেওয়ার সময় তাকে” তারা” নামে ডেকেছিলো। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব! এই নামটা তার পরিবার ব্যতীত আর কারো জানার কথা নয়। এরচেয়েও বড় বিষয় তার পরিবারে এই নামটা বহু বছরেও কেউ মুখে আনেনি। আর না এই নাম কখনো তার বার্থ সার্টিফিকেট, একাডেমিক কিংবা জব যাই হোক না কেনো কোথাও তার এই নাম ব্যবহার করা হয়নি। যদিও এসব তারা বাবার ইচ্ছেতেই হয়েছে কিন্তু এই নাম তো কারো জানার কথা নয়। এমনকি ইনায়াও হয়তো জানে না তার নাম তারা। সেখানে কেনীথ কি কিভাবে জানলো তার এই নাম! কিভাবে! কিভাবে!

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ১৬