একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩২

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩২
রনীতা তুশ্মি

আনায়াকে ইমারজেন্সি কেবিন থেকে আলাদা কেবিনে সিফট করানো হয়েছে। এতোক্ষণে জ্ঞানও ফিরে এসেছে ওর। তবে আনায়া একদম নিস্তেজ দেহে বেডে শুইয়ে রইছে এবং তার স্তব্ধ নজর হলো উপরে সিলিং এর দিকে। সেই কখন থেকে এক ধ্যানে কি যে ভেবে চলেছে সে নিজেও জানে না।
রাতটাও অনেক বেশি। ডাক্তারের অনুমতি পেলে কেনীথ আনায়ার কেবিনে প্রবেশ করলো। ভেতরে ঢুকে আনায়াকে এহেন অবস্থায় দেখে কেনীথ কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। আজ কেনীথকেও সম্পূর্ণ ভিন্ন মনে হচ্ছে। চোখগুলো অত্যধিক লাল।পানি এসে চোখের মধ্যখানে ভীর করছে। যেন আরেকটু আবেগপ্রবণ হলেই এক পশলা বৃষ্টি নামবে। এই অবস্থার কেনীথকে হয়তো আগে কেউ কখনো দেখেনি।
কেনীথ এমন এক পাগলাটে ধ্বং*সাত্মের নাম যার মাঝে আবেগ,করুনা কিংবা দয়া নামক বিষয়বস্তু গুলোর স্থাই হয়নি বললেই চলে। তার পাগলাটে মস্তিষ্কে যখন যা ভেবেছে সে তাই করেছে। পরিনতি ভালো হোক কিংবা মন্দ তা ভেবে দেখার সময় তার কাছে ছিলো না।

মানুষের মন হয় নরম। যথারীতি মনের বিচার বিধি কিংবা কথাও হয় অত্যধিক নমনীয়। যে কারণে কেনীথ সবসময় নিজের মনের কথা শুনতে নারাজ ছিলো। কিন্তু আজ সেই আবেগহীন কেনীথ আবেগে ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু সে এতোটাই বোকা যে এই আবেগের পরিচিতিও তার অজানা। সে জানে না আজ তার কেনো এতো বেশি নিজেকে অসহায় লাগছে। কই এমনটা তো কখনো হওয়ার কথা ছিলো না। কেনীথ তো এমনটা নয়। তবে আজ কেনো সে নিজের এই অনুভূতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
কেনীথ গিয়ে আনায়ার পাশে টুল টেনে বসলো। এরপর মুখ থেকে মাক্স আর ক্যাপটা খুলে পাশে টেবিলে রেখে দিলো। এদিকে কেবিনে যে কেউ প্রবেশ করে আনায়ার পাশে বসেছে, এ যেন আনায়ার ধ্যান জ্ঞানেও নেই। সে এখনো এক ধ্যানে পলকহীন নজরে উপরে দিকে তাকিয়ে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কেনীথ কিছুক্ষণ সময় আনায়া দিকে নিস্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো চুপচাপ। খানিকটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর কেনীথ কিছু বলার জন্য উদ্বেগ হলো। তবে সে খেয়াল করে দেখলো সে কিছু বলতে পারছে না। তার আওয়াজই যেন বের হচ্ছে। কেনীথ থমকালো, এসব কি হচ্ছে তার সাথে। এসব অনুভূতি ঠিক কার জন্য! আনায়ার এহেন অবস্থা নাকি তাদের জীবনে নতুন অস্ত্বিত্বের ভূমিষ্ট হবার আগেই অজানায় হারিয়ে গিয়েছে এই কষ্টের। আচ্ছা বাচ্চাটা তো তারই নিজস্ব অস্তিত্বের একটি অংশ ছিলো তাই না! যেমনটা আনায়ারও। তবে আনায়া এমনটা কেনো করলো।
কেনীথ পুরোনো ছোট খাটো অনেক কিছু একসাথে মিশিয়ে ভেবে দেখেছে যে আনায়া হয়তো এই বিষয়ে আগেই জেনেছিলো কিংবা বুঝতে পেরেছিলো। তবে একটিবারও কি তা জানানোর প্রয়োজন মনে হলো না! তারও তো অধিকার ছিলো, রাইট! সন্তানটা শুধু আনায়ার নয় বরং তারও ছিলো তবে আনায়া কেনো…

কেনীথ জোরে জোরে শ্বাস ফেললো। কয়েকবার খানিকটা জড়তা নিয়েই ঢোক গিললো। রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতিতে ডুবে যাচ্ছে সে। মনে মনে আবারও ভাবলো যে এইসবের জন্য সে দায়ী কিনা। এতোদিন পর্যন্ত নিজেকে কোনোকিছুর দায়ভার না দিলেও আজ দিতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এসব তার জন্যই হয়েছে। আনায়ার সাথে যা করার ছিলো তা সে প্রথমেই করে নিয়েছিলো। প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই হয়তো। কিন্তু পরবর্তীতে কেনো সে বুঝতে পারেনি যে দুটো বিপরীত লিঙ্গের অস্তিত্বের মিলনে আরো একটি অস্তিত্বের সৃষ্টি হয়। তার তো এই নিয়ে আগেই ভাবা উচিত ছিলো, তাই না! অথচ সে কিনা সবকিছুকে হেয়ালি ভেবেছে। সবকিছুতেই তার এই গা-ছাড়া ভাবনা চিন্তার জন্যই আজ এমন ফল ভোগ করতে হচ্ছে। হ্যাঁ,হয়তো সব দোষ শুধু তারই। তার পাগলামির জন্য কতগুলো অস্তিত্ব মিশে গিয়েছে, কতগুলো অস্তিত্ব আজ ভঙ্গুরে পরিণত হয়েছে তার হিসেব কি কেনীথ রেখেছে! নাহ, রাখেনি। কারণ কেনীথ কখনোই নিজের কোনো কাজের জন্যই অনুশোচিত হয়নি। সে যা করছে তা সবসময় তার কাছে একদম ঠিকঠাকই মনে হয়েছে।

কেনীথ হয়তো আজ তার মনের কথাগুলো শুনতে ব্যস্থ। যে মন শুধু তাকে প্রতিনিয়ত সবকিছুর জন্য দোষারোপ করে যাচ্ছে। কিন্তু তার পাগলাটে মস্তিষ্ক এতেও বাগড়া দিয়ে বসলো। কেনীথ আচমকা দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে গিয়ে ভাবতে লাগলো সব দোষ শুধু তার একা হয় কি করে। আনায়া যেসবে ভুক্তভোগী, সেও তা অনেক ছোট বয়সে সেসবের ভুক্তভোগী হয়েছে। মানা যায় যে কেনীথ আনায়ার সাথে যা করছে তা হয়তো অতন্ত্য বাড়াবাড়ি ছিলো কিন্তু সে কি পারতো না নিজের সন্তানের কথা ভেবে কিছুটা স্যাক্রিফাইস করার। কেনীথ কি তাকে এতোটাই কষ্ট দিয়েছিলো যে আনায়া তাকে এভাবে শাস্তি দিলো। কিভাবে নিজের সন্তানকে শেষ করলো ও। তবে কি আনায়াও ওর বাবার মতো, নিজ সার্থ্যে সবকিছু করতে পারে। নিজ সন্তানকে হ/ত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করে না!
কেনীথ আচমকা এসব ভাবতে গিয়ে অস্থির হয়ে উঠলো। নাহ অনেক হয়েছে, এসব আর ভাবা যাবে না। নয়তো আবারও সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাবে। কেনীথ শুষ্ক ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে কন্ঠে কাতরতা মিশিয়ে আনায়াকে ডাকলো,

“তারা!”
আনায়ার কোনো সাড়াশব্দ না দিয়েই একই রকম হাভভাবে রয়ে গেলো। কেনীথ এবার খানিকটা আনায়ার দিকে ঝুঁকে মাথা নিচু করে আনায়া নিস্তেজ হাতটা মুঠো করে ছুঁয়ে পুনোরায় কাতর স্বরে বললো,
“তারা!”
আনায়া এবার আলগোছে কেনীথের দিকে ফিরে তাকালো। আনায়া ফিরতেই কেনীথ মুখ তুলে ওর দিকে তাকালো। আনায়ার নিস্তব্ধ মলিন চেহারার চাহনিতে কেনীথ আকস্মিক মুচকি হাসলো। অথচ তার লাল রাঙ্গা চোখজোড়া হতে এই যেন জল গড়িয়ে পড়বে। অথচ কেনীথের অশেষ প্রচেষ্টার দরূন তা হচ্ছে না।
কেনীথ আনায়ার হাতটা দু’হাতের মুঠোয় আরো শক্ত করে ধরলো। অতঃপর বলতে লাগলো,
“তুই সব আগে থেকেই জানতি তাই না!”

আনায়া কিছু বললো না। একই স্তব্ধ নজর ফেলে কেনীথের দিকে তাকিয়ে সে।
“কেনো করলি এমনটা! খুব বেশি কষ্ট দিচ্ছিলাম কি। কই কখনো তো কিছু বলিসনি। তুই যাতে কষ্ট না পাস সে কারণে গত কয়েক মাস তোর আশেপাশেও ঘেঁষিনি আমি। বলেছিলাম তোর অনুমতি ব্যতীত আর তোর কাছে যাবো না। আর তোর অস্তিত্বে নিজের অস্তিত্ব মেশাবো না। আমি আমার কথা রেখেছিলাম তারা৷ তবে কেনো এমনটা করলি। কোনো আমাদের নতুন অস্তিত্বকে নিমিষেই শেষ করে দিলি। ওকে কেনো পৃথিবীতে আসতে দিলি না। মানলাম আমি অনেক খারাপ, পৃথিবীর জঘন্য মানুষরূপী জানো/য়ারটা আমি কিন্তু আমি… ওকে পৃথিবীতে নিয়ে এলে আমি ওকে কষ্ট দিতাম না। না ওর পৃথিবীতে আসা নিয়ে আমি ওর মাকে কোনো কষ্ট দিতাম।
আচ্ছা আমি না হয় সত্যি অনেক খারাপ। আমাকে কষ্ট দিতে হয়তো তুই এই কাজ করেছিস। সব মানলাম, কিন্তু ও তো তোরও সন্তান ছিলো। তুই তো ওর মা, তাই না! তাহলে মা হয়ে কি কেনো এমনটা করলি। কই অনু আন্টি, আমার মা কেউই তো এমন ছিলো না। তারাও মা ছিলো আর মা তো সন্তানের জন্য নাকি সব করতে পারে তবে তুই কেনো…!”

কেনীথ বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠলো। তার এটুকু বলতেই যেন শত কষ্ট পোহাতে হলো। শেষমেশ চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে আনায়ার হাত কেনীথের দু’হাত দ্বারা মুষ্ঠিতে পড়লো। কেনীথের সবকথাই আনায়া নির্বিকার চোখে পলকহীন কেনীথের দিকে তাকিয়ে শুনছিলো। অতঃপর কেনীথ থেমে যেতেই আনায়া অস্ফুটস্বরে বলতে লাগলো,
“কি করেছি আমি!”
কেনীথের মাথা নিচের দিকে ঝুঁকে ছিলো। আনায়ার কথা শুনে কেনীথ ওর দিকে তাকালো। মূহুর্তেই আনায়ার হাভভাবে কেনীথের চোখ-মুখে গম্ভীর্যের ছাপ পড়লো। কেনীথ কিছু বললো না বরং তার আগেই আনায়ার স্তব্ধ চোখ জোড়ায় পানি এসে ভীর করলো। আর আনায়াও বলতে লাগলো,
“ওরা কি চলে গিয়েছে? আর আসবে না? আমাকে নিতে আর আসবে না ওরা? তাহলে আমি কি আর যেতে পারবো না?”

কেনীথ বিস্ময়ের সুরে বললো,
“কি বলছিস এসব?”
আনায়ার চোখ হতে জল গড়িয়ে পড়লো। ও ঠোঁট উল্টে বলতে লাগলো,
“তারমানে ওরা আমাকে রেখেই চলে গিয়েছে। ওরা আর আসবে না আমাকে নিতে।”
কেনীথ উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,
“কি সব বলছিস। কার কথা বলছিস তুই। কে নিতে আসবে না?”
“বাবা আর…একটা ছোট্ট ছেলে। অনেক ছোট ও। আমায় মা বলে ডাকতো। বাবা আর ও বলতো আমাকে ওদের সাথে নিয়ে যাবে। ওই ছোট্ট ছেলেটাও বলেছিলো আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। আমি প্রথমে রাজি হয়নি যেতে। ওরা অনেক জোর করেছে। আমি বলেছি আপনি অনেক রাগ করবেন। তখন বাবা বললো আপনার খাবারে বি/ষ মিশিয়ে মে/রে ফেলতে। তাহলে নাকি আপনি আর আমাদের পথে বাঁধা দিতে পারবেন না। আমিও তাই করেছিলাম কিন্তু লাভ হলো না। এরপর ওরা আমাকে বারান্দা থেকে ঝাপ দিতে বললো। এমনটা করলেই নাকি আমি ওদের কাছে চলে যাবো কিন্তু…আমি ঝাপ দেওয়ার আগ পর্যন্তও ওরা আমার সাথেই ছিলো কিন্তু এখন পর্যন্ত ওরা আমার সাথে আর দেখা করতে আসেনি। এর মানে আমি আর ওদের সাথে যেতে পারবো না। ওরা আমায় সাথে নেয় নি। মিথ্যে বলেছে আমায়…”

আনায়া বলতে বলতেই আচমকা ফুপিয়ে উঠলো। এদিকে কেনীথ পুরো বিস্ময়ের চোখে আনায়াকে দেখছে। আনায়া এসব কি বললো! সে কি ভাবছিলো আর আনায়া…কেনীথ পুরো বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। এসব শুনে ঠিক কি প্রতিক্রিয়া করবে তাও বুঝে উঠতে পারছে না। একদম হিতাহিতজ্ঞানশূন্য সে।

দেখতে দেখতে আরো বিশ দিন কেটে গেলো। কেনীথ এখন আনায়াকে নিয়ে তার সেই মৃত্যুপুরী সরূপ বাড়ি থেকে সরে এসে শহরের তার নিজস্ব এপার্টমেন্টে থাকতে শুরু করেছে। যেখানেই মূলত কেনীথের থাকার কথা কিংবা ইন্ডাস্ট্রির মানুষজনের কাছে কেনীথের আসল বাসস্থান হিসেবে পরিচিত।
তবে অদ্ভুত বিষয় হলো চার তলা বিশাল এরিয়ায় অবস্থিত বড়সড় ব্লিডিং এর পুরো তিন তলা জুরে কেনীথের থাকার ব্যবস্থা কিংবা এপার্টমেন্টটা বানানো। চতুর্থ তলায় অনেকগুলো মিউজিক ইন্সট্রুমেন্ট দিয়ে ছোটোখাটো স্টুডিওর মতো সাজানো। দ্বিতীয় তলায় সকল কেনীথের প্রাপ্তি সরূপ এ্যাওয়ার্ড, আর্টওয়ার্ক সহ নানান এসথেটিক্স ভিন্টেজ জিনিস পত্রে সাজানো গোছানো। আর নিচ তলায় অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিংবা ফাঁকা বললেই চলে।তবে এতো সবকিছুই যেন শুধু লোক দেখানোর মতো। কেননা কেনীথ এখানে খুব কম সময়ই থেকেছে। তবে এখানে সে তার অনুপস্থিতিতে অন্য কাউকে থাকতেও দেয়নি। আবার এখানে সচারাচর তার বিশেষ অনুমতি ব্যতীত কেউ আসতেও পারেনি। যদিও এখানে তেমন বিশেষ কিছুই নেই।

আনায়াকে এখানে নিয়ে থাকার অবশ্য একটা বিশেষ কারণ রয়েছে। হসপিটাল থেকে আনায়াকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পর কেনীথ অনেক ভেবেচিন্তেই আনায়াকে সরাসরি এখানে নিয়ে এসেছে। তার মতে ও বাড়িতে আনায়াকে নিয়ে থাকাটা মোটেও ঠিক হবে না। সঙ্গে এখানে আসার পরদিনই একজন সাইক্রিয়াটিস্টকে সে তার এপার্টমেন্টেই নিয়ে এসে আনায়ার চেকাপ সহ ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করেছে।

কিন্তু মধ্যবয়স্ক সাইক্রিয়াটিস্ট আনায়াকে দেখতে এলে কেনীথের সাথে খানিকটা ভেজাল লেগে যায়। আনায়ার চেক-আপের পর ডক্টর যখন কেনীথের সঙ্গে কথা বলছিলো তখন ডক্টরের কিছু প্রশ্নের উওর দিতে গিয়ে কেনীথ উদ্ভট সব কথা বলে ফেলে। যার ফলে ডক্টর নিজেই তাকে ট্রিটমেন্টের কথা বললে কেনীথ খানিকটা ক্ষেপে যায়। যদিও তখন পাভেল বিষয়টা সামলে নিয়েছিলো। তবে ডক্টর খুব ভালো করে কেনীথকে বুঝিয়ে গিয়েছে যে আনায়াকে ঠিক করতে হলে আগে তার ঠিক হওয়াটা প্রয়োজন। নয়তো কাজের কাজ কিছুই হবে না। খুব বেশি খেয়াল রাখতে হবে যে কোনো ভাবেই যেন আনায়ার সাথে রাগারাগি কিংবা ক্ষি*প্ত ব্যবহার করা যাবে না। সবসময় ওর প্রতি সদয় আচরণ করতে হবে। যেহেতু ও একটা ট্রমায় রয়েছে তাই এই সময় ওর প্রায়ই হ্যালুসিনেশন হবে। কিন্তু এটা হতে দেওয়া চলবে না। ওর বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে, ওকে বেশিক্ষণ একা থাকতে দেওয়া যাবে না। যথাসম্ভব গল্প আলাপ করে যেতে হবে। মূলত ওকে এই বাজে ট্রমাটিক সিচুয়েশন থেকে বের করতে হবে। নয়তো শুধু শুধু ঔষধে তেমন কাজও যেমন হবে না তেমনি ঔষধের সাইড ইফেক্টও তো রয়েছেই।

সেদিন কেনীথ ডাক্তারের উপর খানিকটা রেগে গেলেও ডাক্তারের সব কথাই সে খুব মনোযোগ সহকারে শুনেছিলো এবং এখনও তা মনে রেখে যথাসাধ্য সে অনুযায়ী কার্যকর করার চেষ্টা চালাচ্ছে। পি*শাচ রু*পী ভ*য়ংকর কেনীথ আর এখনকার কেনীথের মধ্যে যেন আকাশ পাতাল তফাত। যদিও হঠাৎ তার এতো পরিবর্তন প্রকৃত ভাবে হয়নি, কারণ সে বলতে গেলে এসব নিজের উপর পুরোপুরি জোর খাটিয়েই করে যাচ্ছে।
কেনীথ কিচেনে দুপুরের খাবার রাঁধতে ব্যস্থ। কালো টি-শার্টের উপর সাদা কিচেন এপ্রন পড়ে পাক্কা শেফ এর মতো রান্নার তোরজোর শুরু করে দিয়েছে।
এদিকে আনায়া বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছোট-বড় নানান ফুলের গাছগুলো দেখছে। এসব মূলত পাভেল নিজেই আনায়ার জন্য ব্যবস্থা করে দিয়ে গিয়েছে। আর কেনীথের যেহেতু গাছপালা পছন্দ, এই কারণে সে এতে কোনো বাঁধা দেয়নি।

আনায়া গত কয়েকটা দিন এভাবেই বারান্দা কিংবা ঘরের বিভিন্ন জিনিসগুলোয় সাথেই চুপচাপ দিন কাটিয়ে দেয়। যদিও এসব করার সুযোগটা সে খুব কমই পায়, কেননা কেনীথ দিন রাতের বেশিরভাগ সময়ই একদম তার সাথেই থাকে। শুধু রান্না, গোসল কিংবা অন্যকোনো সময়েই আনায়া নিজের মতো একা থাকার সুযোগ পায়। মাঝেমধ্যে আবার কেনীথ রান্নার সময়টাতেও আনায়াকে নিজের সামনে বসিয়ে কথাবার্তা বলে। নিজের উপর জোর খাটিয়ে হলেও কেনীথ যেন নিজেকে ভিন্ন কেনীথে রুপান্তর করে ফেলেছে।
কেনীথের রান্না যখন প্রায় শেষের দিকে তখন সে ব্যস্থ ভাবসাবে কিচেন থেকে জোরে আনায়ার উদ্দেশ্যে ডেকে বললো,
“তারা! গিয়ে তাড়াতাড়ি গোসলটা সেরে নে। আমার রান্না হয়ে এলো প্রায়। খাবার খেয়ে ঠিকমতো ঔষধ খেতে হবে আবার”
কেনীথের এই সম্পূর্ণ কথা জুরে ছিলো একজন দায়িত্ববান পুরুষের শাসনের প্রভাব। কেনীথের এই স্বরে না ছিলো কোনো ক্ষি*প্ততা কিংবা রাগের আভাস। এ যেন এক ভিন্ন রুপের কেনীথ।
আনায়াও কেনীথের আদেশ শুনতে পেয়ে নিজের ধ্যান থেকে বেড়িয়ে এলো। তার মূল সমস্যা হলো সে খানিকটা সময় একা রইলেই কি যেন সব ভাবতে শুরু করেছে। আর সেগুলোই মূলত আনায়ার মস্তিষ্ক বিকৃত করার মূল কারণ।

তবুও আনায়ার মাঝে আগের চেয়ে অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন বললে ভুল হবে, বলা চলে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। কেননা আনায়া এখনো সেই আগের মতো চুপচাপ বাকরুদ্ধ হয়ে থাকে সবসময়। শুধু যখনই কেনীথ সেধে এসে তার সাথে হাজার খানেক বকবক করে তখন গিয়ে হয়তো কয়েকটা শব্দ তার মুখ থেকে নিজ ইচ্ছেতে বেড়িয়ে আসে। তবে কেনীথের জন্য এটাই বড়সড় সার্থকতা। কেননা হসপিটাল থেকে ফেরার পর প্রায় এক সপ্তাহ আনায়ার অবস্থা অত্যন্ত বাজে ছিলো। সেই অবস্থা থেকে আজ এই কয়েকদিনে প্রায় অনেকটাই উন্নতি হয়েছে।
আনায়া কেনীথের কথামতো চুপচাপ বাথরুমে চলে গেলো গোসল সারতে। এদিকে কেনীথের রান্নাও শেষ। কেনীথ সুন্দর করে খাবার গুলো সার্ভিং ডিশে তুলে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে সাজিয়ে রাখলো। এরপর খাবার গুলো ঢেকে রেখে দেখতে গেলো আনায়া গোসলে গিয়েছে কিনা।

ও গোসলে গিয়েছে তা বুঝতেই কেনীথ নিজেও গোসল করতে চলে গেলো। আনায়ার একটু আগে কেনীথ নিজেই গোসল শেষ করে বেড়িয়ে এলো। এরপর হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে নিজের বড়বড় চুল গুলো শুকাতে শুকাতেই আনায়াও বাথরুম থেকে বেড়িয়ে এলো।
কেনীথ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল শুকাচ্ছিলো। আর তখনই কাচুমাচু হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতে থাকা আনায়াকে দেখতে পেলো। আনায়াকে দেখতে পেয়ে কেনীথ পেছনে না ফিরে আয়নার দিকে তাকিয়েই বললো,
“এদিকে আয় তাড়াতাড়ি!”
আনায়াও আচমকা কেনীথের কথা শুনে খানিকটা কেঁপে উঠলো,অতঃপর আয়নায় নিজের নজর ফেলতেই সে কেনীথকে দেখলো। কেনীথ যতই নিজেকে আনায়ার জন্য বন্ধুসুলভ বানানোর প্রচেষ্টা করুক না কেনো তার হাস্যরসে ঘেরা কিংবা সাধারণ কথাতেও একটা গম্ভীর্যের আভাস থাকে।
“কি হলো এদিকে আয় তাড়াতাড়ি।”

আনায়া এবার আর দেরী না করে কেনীথের কাছে এগিয়ে গেলো। কেনীথের পাশে আর পেছনে গিয়ে চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। কেনীথ নিজের চুলগুলো একহাতে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে অন্যহাতের সাহায্যে নাড়াচাড়া করে উড়াতে উড়াতেই আয়নায় আনায়াকে পরখ করে দেখলো। মাথার চুলগুলো সাদা তোয়ালে দিয়ে পেছানো। পরনে কালো সাদার মিশ্রণের ঢিলেঢালা কুর্তি। ফর্সা চেহারা গোসলের পর আরো বেশি উজ্জ্বল ফর্সা হয়ে উঠেছে। মুখ আর গলায় বিন্দু বিন্দু পানির কণা যেন জ্বলজ্বল করছে। কেনীথ এসব পরখ করতে গিয়ে আচমকা ঢোক গিললো। অতঃপর নিজেকে সামলে নিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আনায়ার উদ্দেশ্য বললো,
“পেছনে দাঁড়িয়ে কি করছিস! আমার সামনে আয়।”

আনায়া কেনীথের কথা শুনে মুখ তুলে আয়নায় তাকিয়ে কেনীথকে দেখলো। এরপর চুপচাপ এগিয়ে গিয়ে কেনীথের একদম পাশে যেতেই কেনীথ ওর একবাহু ধরে টেনে নিয়ে নিজের সামনে এনে দাঁড় করালো।
বরাবরের মতো কেনীথের পরনে কালো রংএর টাওজার আর টিশার্ট। এটা আর নতুন কি। ওর কাছে কালো রংএর একই রকমের টিশার্ট যে কয়শোটা আছে সে নিজেও জানে। দেখলে মনে হবে সবগুলোই একই।
আনায়াকে নিজের সামনে দাঁড় করানোর সঙ্গে সঙ্গে মাথা থেকে সাদা তোয়ালেটা আলগোছে খুলে ফেললো কেনীথ। কেনীথের হাবভাব একদম স্বাভাবিক। কিন্তু আনায়াকে দেখলে মনে হয় ওর মাঝে কেনীথকে নিয়ে এক দৃঢ় সংকোচ কিংবা জড়তা রয়েছে। শুধু কেনীথের ক্ষেত্রে বললে ভুল হয়, আনায়া ইদানীং পাভেল কিংবা অন্যকারো সামনেও একই আচরণ করে।

কেনীথ নির্বিকারে আরেকটু এগিয়ে গেলো। যার ফলে আনায়ার পিঠটা কেনীথের প্রশস্ত বুকে গিয়ে ঠেকলো। কেনীথ নির্বিকারে আয়নাতে আনায়ার জড়তা-সংকোচে পূর্ণ মলিন মুখটাকে দেখে আড়ালে খানিকটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো।
অতঃপর আনায়ার চুলগুলো নিজ হাতে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকাতে লাগলো। আনায়া খানিকটা মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। কোনো নড়চড়ও করছে না। তখনই কেনীথ নির্বিকার স্বরে বললো,
“মাথাটা একটু উপরে তোল।”
কেনীথের কথা শোনা মাত্রই আনায়া মূহুর্তেই মাথাটা উঁচু করে তুললেই আয়নাতে কেনীথের চোখে চোখ পড়ে গেলো।
“আজ কি কোথাও ঘুরতে যাবি?”

আনায়া নির্বিকার চাহিতে কেনীথকে দেখতে থাকলো। তবে কিছু বললো না।যে কারণে কেনীথ নিজেই বললো,
“এখানে আসার পর এখন পর্যন্ত কোথাও যাওয়া হয়নি। তুই বললে আজ কোথাও ঘুরতে যাবো।”
কেনীথ আনায়ার চুলগুলো ধীরে ধীরে এপাশ ওপাশ করে প্রায় শুকিয়ে নিয়েছে। তবে এবারও আনায়া কিছুই বললো না। যে কারণে কেনীথের চুল শুকানো হয়ে গেলে আনায়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,
“খাবারটা না হয় এখানেই আনছি। তুই চুপচাপ এখানেই থাক।”
এই বলেই কেনীথ একটা প্লেটে তার রান্না করা কিছু খাবার যেমন ভাত, সবজি, মাংস সাজিয়ে সঙ্গে এক গ্লাস পানি সহ নিয়ে এলো। কেনীথ রুমে এসে দেখলো আনায়া সোফায় পা দুটো তুলে জড়সড় হয়ে বসে রইছে।
কেনীথ গিয়ে ওর পাশে বসতেই আনায়া পাশে ফিরে কেনীথকে দেখলো। কেনীথও আর কোনো ভনিতা না করে আরো খানিকটা আনায়ার কাছে এগিয়ে গিয়ে খাবার লোকমা তুলে আনায়ার মুখের সামনে ধরতেই আনায়া নির্বিকারে তা মুখে তুললো।

এসব নতুন নয়। এই কয়েকদিনে আনায়া কিংবা কেনীথ দুজনেই এসবে অভস্ত্য হয়ে গিয়েছে। গোসলের পর আনায়ার চুল শুকানো কিংবা তেল দিয়ে দেওয়া,যথা সময়ে রান্না করে খাবার খাইয়ে দেওয়া এগুলোই এখন কেনীথের নিত্যদিনের কাজে পরিণত হয়েছে। এই কয়েকদিনে অবশ্য অনেকটা কষ্ট করেই বাঙ্গালি বিভিন্ন রান্নাগুলোও শিখে ফেলেছে। খাবারের স্বাদ খুব বেশি আহামরি না হলেও একদম ফেলে দেওয়ার মতোও নয়। মোটামুটি আনায়া সেসব খাবার ভালো করেই খেয়ে নিতে পারে।
খাবার খাওয়ানোর সময় কিছুক্ষণ পর্যন্ত দুজনের মাঝে কোনো কথাবার্তা হলো। একটা পর্যায়ে কেনীথ বললো,
“একটা গল্প শোনা তো আমায়।”
আনায়া কেনীথের দিকে তাকালো। পুনোরায় মলিন মুখটা নিচু করে ধীর সুরে বলতে লাগলো,
“এক ছিলো রাজা। আর এক ছিলো রানী। তারা দুজন একটা সুন্দর প্রাসাদে থাকতো। কিন্তু রাজাটা রাণীকে অনেক বেশি কষ্ট দিতো। কারণ রানীকে কষ্ট দিলে রাজা অনেক খুশি হয়।”
আনায়া এইটুকু বলেই থেমে গেলো। তার মনে হলো এই গল্প বলাটা হয়তো ঠিক হয়নি। কিন্তু চোখে আচমকা কেন যেন জল এসে ভীর করলো। কেনীথ তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বললো,
“তোর গল্পের রাজাটা মনে হয় আমি, তাই না?”

আনায়া কেনীথের দিকে মুখ তুলে তাকাতেই কেনীথ ওর ছলছলে চোখ জোড়া দিকে তাকালো। আপাতত আর এই নিয়ে কিছু বলবে না। না বলাটাই ভালো। কেনীথ বাকি খাবার টুকু খাইয়ে দিয়ে বললো,
“একটু ওয়েট কর, আমি হাত ধুয়ে আসছি। তোর চুলে তেল দিতে হবে।”
এই বলেই কেনীথ হাতটা ধুয়ে আবারও রুমে ফিরে এলো। আনায়া এখনো সোফাতেই চুপচাপ বসে রইছে। কেনীথ তেল নিয়ে আনায়ার কাছে গিয়ে ওকে নিচে বসার জন্য বলতেই আনায়া নিচে চুপচাপ নিজেকে গুটিয়ে বসে পড়লো।
এদিকে কেনীথ সোফায় বসে নির্বিকারে আনায়াকে মাথায় তেল দিতে দিতে বললো,
“এভাবে চুপচাপ থাকা যায় না। কিছু বলা উচিত রাইট?”
আনায়া কিছু বললো না। যে কারণে কেনীথ নিজেই বলতে লাগলো,
“তোকে একটা সত্যি গল্প শোনাই। একটা প্রিন্সেসের গল্প।”
আনায়া আচমকা পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে কেনীথের দিকে তাকিয়ে বললো,

“সত্যি প্রিন্সেস?”
কেনীথ ওর উচ্ছ্বসিত মুখের দিকে চেয়ে মুচকি হাসলো।
“হুম, একদম সত্যি প্রিন্সেসের গল্প। এখন ঘাড় ঘুরা।”
কেনীথের আদেশ মতো আনায়া ঘাড় ঘুরিয়ে নিতেই কেনীথ বলতে লাগলো,
“রাশিয়ার বিশাল বড় এক প্রাসাদে সেই প্রিন্সেসের বসবাস। প্রিন্সেসের বাবা মা কেউ নেই। শুধু আছে তার দাদী। তার দাদী তাকে অনেক ভালোবাসে। প্রাসাদের সবাইও তাকে অনেক ভালোবাসে তবুও সে এসবে খুশি নয়। কারণ সে একটা অনেক বাজে, খারাপ, শয়তান ছেলেকে ভালোবাসে। যদিও প্রিন্সেস নিজে অনেক বেশি ভালো তবে ছেলেটা অনেক খারাপ হওয়া স্বত্বেও সে তাকে পেতে চায়। কিন্তু ছেলেটা এমনটা চায় না। ছেলেটা তার থেকে সবসময় দূরে সরে থাকে। এইজন্য প্রিন্সেসেরও আর কষ্টের শেষ হয়না।”

“এটা কি সত্যিই?”
কেনীথ অকপটে বললো,
“তোকে মিথ্যা গল্প শুনিয়ে আমার কি লাভ?”
—“তবে সেই প্রিন্সেসের নাম কি?”
—“ওর নাম তো রোজ।”
আনায়া খানিকটা ভাবুক চিত্তে কিছু একটা ভেবে কেনীথের দিকে ঘুরে ওর মুখের দিকে তাকালো। এদিকে কেনীথ গল্প শোনাতে শোনাতে আনায়ার চুলে একটা লম্বা বিনুনি গেঁথে দিয়েছে।
—” আপনি ওনাকে চেনেন?”
কেনীথ খানিকটা ভাবুক চেহারা বানিয়ে বললো,

“হুম, ওকে চিনি আমি।”
আনায়াকে খানিকটা উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে।
“আমাকে ওনার কাছে নিয়ে যাবেন?”
কেনীথ খানিকটা কপাল কুঁচকে বললো,
“তুই ওর কাছে গিয়ে কি করবি?”
আনায়া খানিকটা ইতস্তত হয়ে বললো,
“কিছু করবো না মানে… ওনাকে গিয়ে বলবো যেন খারাপ ছেলেটাকে ভুলে যায়। খারাপরা কখনো ভালো হয় না। উনি এখন যতটা কষ্ট পাচ্ছে, সে খারাপ ছেলেটাকে পেয়ে গেলে আরো বেশি কষ্ট পাবে। নয়তো আপনি গিয়ে তাকে বলে দিয়েন যে সে যেনো ঐ ছেলেটাকে ভুলে। তাহলে সে আর কষ্ট পাবে না।”
কেনীথ সোফার সাথে হেলান দিয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসলো।

“বাপরে… কতকিছু জানা তোর।”
—“আচ্ছা, আপনি ওই খারাপ ছেলেটাকেও কি চেনেন?”
কেনীথ নির্বিকারে বললো,
“হুম!”
—“কে সে?”
—“আমি।”
আনায়া বিস্ময়ের সুরে বললো,
“মানে?”
কেনীথ নির্বিকারে সোজা হয়ে বসে বললো,
“মানে আবার কি! রোজ আমার মামাতো বোন। ও যেখানে থাকে সেটা কোনো প্রাসাদের চেয়ে কম কিছু নয়। আর ও হলো সেই প্রাসাদের প্রিন্সেস। কিন্তু সমস্যা হলো গাধীটা আমায় পছন্দ করে। এখন তুই-ই বল আমি কি ভালো? নিশ্চয় না! তবে আমাকে পেলে তো ও শুধু কষ্টই পাবে। কেননা আমি তো খারাপ।”
আনায়া চুপচাপ কেনীথের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে কিছু একটা ভাবতে শুরু করলো।
“কি হলো, কি ভাবতে বসলি?”

আনায়া কেনীথের দিকে চেয়ে ইতস্তত ভাবে বললো,
“বলছিলাম,উনি কি আপনাকে অনেক বেশি ভালোবাসে?”
“হয়তো বা। আর হ্যাঁ, ও তোর বয়সে ছোটই হবে সেক্ষেত্রে তুমি সম্বোধন করতেই পারিস।”
আনায়া কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর আবারও বললো,
“সে যদি প্রিন্সেস হয় তবে সে তো অনেক বেশি সুন্দর, তাই না!”
—“হুম, তা তো বটেই।”
আনায়া আরো খানিকটা সময় ভেবে নিয়ে বললো,
“তবে আপনি ভালো হয়ে যান। তাহলেই তো আর কোনো… ”
আনায়া এটুকু বলে থেমে যেতেই কেনীথ ওর মুখের দিকে খানিকটা ঝুঁকে ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
“রোজকে নিজের সতীন বানানোর ইচ্ছে হয়েছে?”
আনায়া কিঞ্চিৎ ঢোক গিললো তবে কিছু বললো না। বরং কেনীথই আনায়ার উদ্দেশ্য তীক্ষ্ণ সুরে বললো,
“উঠে দাঁড়া!”

আনায়া কয়েকবার চোখের পলক ফেললো। অতঃপর কেনীথের কথা বুঝতে পেরেই ততক্ষণে উঠে দাঁড়ালো। আনায়া উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথেই কেনীথ ওর হাত টেনে নিয়ে নিজের উরুতে বসালো। আনায়াও চুপচাপ নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। কেনীথ আনায়ার কোমড়ে একহাতের সাহায্যে খানিকটা টেনে নিলো। অতঃপর দুহাত দিয়ে শক্ত করে কোমড় পেঁচিয়ে নিলো।
“এদিকে তাকা!”
আনায়া মাথাটা নিচু করে ছিলো বিধায় কেনীথ আনায়াকে নিজের দিকে তাকাতে বললো। আনায়াও যথারীতি কেনীথের দিকে তাকালো। কেনীথ খেয়াল করে দেখলো আনায়ার চোখেমুখে এখন যথেষ্ট জড়তা-সংকোচ ফুটে উঠেছে। কেনীথ খানিকটা পর্যবেক্ষণ করার পর আনায়ার উদ্দেশ্য বললো,
“আমি অনেক খারাপ তাই না?”
আনায়া ঠোঁট চেপে পলকহীন কেনীথের দিকে তাকিয়ে হইলো। তবে বলার মতো সে কিছু খুঁজে পাচ্ছে না।
“আচ্ছা বলতে হবে না। আমি নিজেও জানি কতটা খারাপ। তবে আজ তোর কাছে ভিন্ন কিছু জানতে চাই। আ…আমার এমন কোনো কিছু কি রয়েছে যেটা তোর পছন্দ? যে কোনো কিছু একটা। কথা বলবি, চুপ থাকবি না কিন্তু!”

কেনীথের শাসানো কন্ঠে আনায়া কিঞ্চিৎ ঢোক গিললো তবে খানিকটা জড়তা সংকোচ নিয়েই আচমকা কেনীথের চুলে হাত দিয়ে বললো,
“আপনার চুল গুলো… ভালো…লাগে।”
এই বলেই মাথা নিচু করে আনায়া চুল থেকে হাত সরিয়ে নিতে চাইলে কেনীথ খপাৎ করে ওর হাতটা ধরে ফেললো। অতঃপর খানিকটা ভ্রু উঁচিয়ে মুচকি হেসে বললো,
“শেষে কিনা আমার অগোছালো চুল? যাক, তাও ভালো। বউয়ের পছন্দের জিনিস, এখন থেকে একটু যত্ন-আত্তি নিতে হচ্ছে দেখি৷”
এই বলেই আনায়ার হাতটা ছেড়ে দিয়ে পুনরায় বলতে লাগলো,
“আজ সন্ধ্যায় শিকদার বাড়িতে যাবো। রেডি হয়ে থাকিস, বাপের বাড়ি তথা শ্বশুর বাড়ি বলে কথা।”

সন্ধ্যার দিকেই আনায়া আর কেনীথ বেড়িয়ে পড়েছে শিকদার বাড়ির উদ্দেশ্য। কেনীথ কার ড্রাইভ করছে আর আনায়া ওর পাশে চুপচাপ বসে রইছে। আনায়ার চুলগুলো ওভাবেই বিনুনি করা তবে পরিপাটি ভাবে। পড়নে সম্পূর্ণ কালো রংএর জামা, এদিকে কেনীথের ক্ষেত্রেও তার সেই চিরচেনা স্টাইল। তবে চুলগুলো খানিকটা মেসি বান করে পরিপাটি করে সাজানো। সঙ্গে আজ কালো রংএর একটা মোটা স্টাইলিশ জ্যাকেট। এই কাজটা অবশ্য কেনীথ আনায়াকে দিয়েই আজ করে নিয়েছে।
শিকদার বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই হঠাৎ রাস্তার পাশে বিশাল মাঠ জুরে বড়সড় মেলার দিকে নজর পড়লো তাদের। হঠাৎ এখানে এসে এমন মেলার দেখা পাবে তা কেনীথ ভাবেনি। কি যেন ভেবে মেলার কাছে রাস্তার পাশে গাড়িটা থামিয়ে কেনীথ আনায়ার উদ্দেশ্যে বললো,

“মেলা ঘুরতে যাবি?”
আনায়া কেনীথের দিকে তাকালো তবে কোনো উত্তর দিলো না। কেনীথ পুনোরায় কি যেন ভেবে নিয়ে বললো,
“ঠিক আছে, ঘুরতে না যাই তবে কিছু একটা কিনে নিয়ে আসি চল।”
এই বলেই কেনীথ আনায়াকে গাড়ি থেকে নামতে বললো সঙ্গে সে নিজেও গাড়ি থেমে নেমে পড়লো। গাড়ি থেকে নামতেই কেনীথ পুরো থতমত খেয়ে গেলো। মেলাতে তো মানুষজন গিজগিজ করছে সঙ্গে রাস্তাটাও একদম মানুষজনে ভরে গিয়েছে।কেনীথ মনে মনে মানুষের প্রতি কিছুটা বিরক্ত হলো। তার মতে অন্তত রাস্তাটা তো ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিলো।
তবে কেনীথ এসবে পাত্তা না দিয়ে আনায়ার পাশে ঘেঁষে বললো,
“এমন হিজিবিজির ভিতরে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে বল কি করবো?”
আনায়া এবারও চুপ। প্রতিবার কেনীথের কোনো কথার উত্তরে আনায়ার আদতে কি বলা উচিত তা সে খুঁজে পায় না। অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়ে।

“তোকেও বা কি বলছি। আ…এটা বল কিছু খাবি? কিনে নিয়ে যাবো, বাড়িতে গিয়ে ধীরেসুস্থে খেয়ে নিবি।দেখ আশেপাশে তাকিয়ে, কিছু খেতে ইচ্ছে করে নাকি!”
আনায়া কেনীথের কথামতো আশপাশে একবার তাকিয়ে দেখলো। মেলার খানিকটা ভেতরের দিকে একজন হাওয়ায় মিঠাইওয়ালা অনেক গুলো হাওয়ায় মিঠাই নিয়ে ঘুরছে। এমন হাওয়ায় মিঠাইওয়ালা মেলাতে অনেক দেখা যাচ্ছে তবে সেসব মেলার একটু বেশিই ভেতরে। আনায়া খানিকটা ভেবেচিন্তেই কেনীথের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বললো,
“হাওয়ায় মিঠাই!”
কেনীথ আনায়ার দিকে তাকিয়ে কয়েকবার চোখের পলক ফেলে বললো,
“হাওয়ায় মিঠাই মানে…ঐ যে ক্যান্ডি ফ্লস,ওগুলো?”
আনায়া হালকা মাথা ঝাঁকিয়ে নিচের দিকে তাকালো। কেনীথ তার উত্তর বুঝে নিয়ে বললো,
“ঠিক আছে, আমি গিয়ে নিয়ে আসছি। তুই এখানেই থাকবি। কোনো নড়চড় করবি না কিন্তু।”
এই বলেই কেনীথ আনায়াকে রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে হাওয়ায় মিঠাই নিতে হিজিবিজি মানুষের মেলার ভেতরে ঢুকে গেলো।

এদিকে কেনীথ চলে যেতেই আনায়ার পায়ের কাছে কিছু কুকুর এসে ডাকাডাকি করে বিরক্ত করতে শুরু করলো। আনায়া কিছুটা ভীতু রুপে গাড়ির কাছ থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে দাঁড়ালো।
আনায়া চুপচাপ দাঁড়িয়েই ছিলো। এরই মাঝে হঠাৎ এক অপ্রত্যাশিত ব্যক্তির সাথে তার সাক্ষাৎ হয়ে গেলো।
রেহান আনমনে মেলার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছিলো। কি যেন সব চিন্তা ভাবনায় বিভোর ছিলো সে। এরই মাঝে আচমকা তার নজর আনায়ার দিকে পড়ে। সে ভেবেছিলো এটা হয়তো তার ভ্রম হবে। কিন্তু পরবর্তীতে আরেকটু খেয়াল করে দেখলো, নাহ এটা তার ভ্রম নয়। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা আনায়াই।
রেহান জনসমাগমের মাঝেই খানিকটা সময় বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার পা জোড়া যেন থমকে গিয়েছে। রেহান কোনোমতে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলো। তবে কেনো যেন চোখজোড়ায় আপনাআপনি পানি চলে এসেছে। রেহান জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস ফেললো।
অতঃপর যতটা দ্রুত সম্ভব মানুষের ভীর ঢেলে আনায়ার কাছে এগিয়ে গেলো। রেহান উত্তেজনায় মৃদু কাঁপতে শুরু করছে। হাত পা যেন অবশ হয়ে আসছে। রেহান আনায়ার কাছে যেতেই পাশ থেকে অসহনীয় কন্ঠে ডাকলো,
—“বউ পাখি!”

আচমকা এমন এক সম্মোধনে আনায়া কেঁপে উঠলো। আনায়া পাশে ফিরে রেহানকে দেখে সম্পূর্ণ বিস্মিত। কিছুক্ষণ একদম হিতাহিতজ্ঞানশূন্যের ন্যায় থমকে দাঁড়িয়ে রেহানকে শুধু দেখলো। এদিকে রেহান আনায়ার বাহু ধরে উদ্বিগ্ন স্বরে বলতে লাগলো,
“কোথায় ছিলে তুমি? তোমাকে কত খুঁজেছি জানো? তোমাকে ছাড়া আমার পুরো জীবন তছনছ হয়ে গিয়েছে। পাগল হয়ে গিয়েছে আমি। তোমাকে হারানোর সাথে সাথে আমি আমার জীবনের সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি।
কি হলো তুমি কিছু বলছো না কেনো? তোমার কি হয়েছে? ঐ ভিকে তোমার কিছু করেনি তো? বউ পাখি কথা বলছো না কেনো? আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। প্লিজ কিছু তো…
রেহান বলতে বলতে প্রায় কেঁদে ফেলেছে। ওর চোখ থেকে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে। এদিকে আনায়া প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে না পেরে থম মে*রে রইলেও আচমকা রেহানের সাথে তার সকল স্মৃতিতে নিজেকে হারিয়ে ফেললো। শেষমেশ রেহানের কথা শেষ হওয়ার আগেই আনায়া ওকে শক্ত করে জড়িয়ে কেঁদে ফেললো। রেহানও খানিকটা হকচকিয়ে গেলেও সে নিজেও আনায়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। রেহানের কান্না থেমে গেলেও আনায়া ওর বুকে মুখ গুঁজে অনবরত হেঁচকি তুলে কাঁদছে। রেহান কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আনায়াকে শান্ত করতে খানিকটা হেসেই বলতে লাগলো,

” আনায়া কিচ্ছু হয়নি! প্লিজ কান্না থামাও। বউ পাখি কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলেছো এবার তো কান্না থামাও। এই তো তোমায় খুঁজে পেয়ছি। আর হারাতে দেবো না। প্লিজ কান্না থামাও।তোমায় কাঁদতে দেখে আমার ভালো লাগছে না।”
আরো খানিকটা সময় একই ভাবে অতিবাহিত হওয়ার পর আনায়া মুখ তুলে তাকালো। ও প্রায় অনেকটা হাঁপাচ্ছে। হেঁচকি এখনো বন্ধও হয়নি। সারা চোখমুখে চোখের পানিতে পুরো লেপ্টে গিয়েছে। রেহান ওকে ছাড়িয়ে শান্ত হতে বললো। কিন্তু আনায়া থামছে না। মূলত ওর হেঁচকি আর বন্ধ হচ্ছে না। রেহান পরিস্থিতির বেগতিক দেখে আনায়াকে বললো,
“পানি খাবে? দাঁড়াও আমি পানি নিয়ে আসছি। প্লিজ নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করো।আর এখান থেকে কোথাও যেও না প্লিজ। আমি এক্ষুনি পানি নিয়ে ফিরছি।”
এই বলেই রেহান দৌড়ে কাছেই একটা স্টল থেকে পানির বোতল আনতে গিয়ে মানুষের ভীরে মিশিয়ে গেলো। এদিকে আনায়ার হেঁচকি এখনো বন্ধ হওয়ার নাম গন্ধ নেই। আনায়া কেনো কাঁদছে তা সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। তেমনি নিজেকে সামলাতেও পারছে না।

এরই মাঝে হঠাৎ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নজর একজনের উপর নজর পড়তেই আনায়া থমকে গেলো। তার নজর কেনীথের দিকে পড়তেই কেনীথ তাচ্ছিল্যের সাথে মুচকি হাসলো। যা আনায়ার চোখে স্পষ্ট ধরা দিলো।
কেনীথ তিন-চারটা হাওয়ায় মিঠাই নিয়ে ফিরে এসেছিলো প্রায় অনেকক্ষণ আগেই। তবে উচ্ছ্বসিত মুখে হাওয়ায় মিঠাই নিয়ে আনায়ার দিকে এগোতে গিয়েই সে থমকে যায়। চোখের সামনে রেহান আর আনায়া একত্রে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আহ! কি দৃশ্য! কেনীথের কাছে এ যেন এক অপূর্ণ ভালোবাসার নানান প্রতীক্ষার পর ফিরে পাওয়ার দৃশ্য। কেনীথের এই দৃশ্য হয়তো ভালোই লাগছিলো। যে কারণেই এই সুন্দর দৃশ্য নির্বিকারে দাঁড়িয়ে উপভোগ করতে সে ভোলেনি।সে চাইলে তো বাঁধা দিতেই পারতো কিন্তু শুধু শুধু দুজন প্রকৃতি ভালোবাসার মিলনে বাঁধা দিয়ে কি লাভ। কেনীথ শুধু দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো। এই হাসি হয়তো তার নিজের জন্য। আজ সে নিজেই নিজেকে নিয়ে উপহাস করছে।
তার তো এটাই মনে হচ্ছিলো যে আনায়া আর রেহান হলো গল্পের নায়ক নায়িকা আর কেনীথ হলো ভিলেন। যে শুধু সবকিছু ধ্বং*স করতে জানে, কষ্ট দিতে জানে। কিন্তু ভালোবাসতে হয়তো জানে না। আর জানলেও সে ভালোবাসা মূল্য হয়তো কখনো পাওয়া যায় না।
কেনীথ নির্বিকারে আনায়ার কাছে হেঁটে গেলো। অতঃপর আনায়া দ্বিধাগ্রস্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,

“হেঁচকি এখনো বন্ধ হয়নি দেখছি। গাড়িতে পানি রয়েছে, চল গিয়ে খেয়ে নে।”
এটুকু বলেই কেনীথ আনায়ার হাতটা ধরে গাড়ির কাছে গেলো।
গাড়িতে আনায়াকে বসিয়ে সে নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো। এরপর গাড়িতে থাকা একটা পানির বোতল আনায়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বললো,
“রেহানকে এখনো অনেক বেশি ভালোবাসিস তাই না?”
আনায়ার হেঁচকি খনিকের জন্য থামিয়ে পাশে ফিরে কেনীথ দিকেতাকালো। কেনীথ নিজেও আনায়ার অশ্রু সিক্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো।

রেহান পানির বোতল নিয়ে এসেই স্তব্ধ হয়ে পড়লো। পাগলের মতো খানিকটা সময় এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে আনায়াকে খুঁজলো কিন্তু কোথাও আনায়ার দেখা মিললো না। রেহানের উপর যেন পুরো পৃথিবীর ভর এসে চেপে ধরেছে। সম্পূর্ণ অসহনীয় লাগছে তার। নিজেকে অপদার্থ মনে হচ্ছে। সে আনায়াকে আবারও হারিয়ে ফেলেছে। নেই, তার বউ পাখি আর নেই। তার বউ পাখি সত্যিই অতিথি পাখির মতো জীবনে এসে সবকিছু তছনছ করে পুনোরায় ফিরে গিয়েছে। রেহান রাস্তার পাশে হাঁটু গেঁড়ে মাটিতে বসে পড়লো। এতো জনসমাগমের মাঝে এক নিঃস্ব প্রেমিক আজ ভালোবাসা হারানোর তৃষ্ণায় কাঁদতে বসেছে। রেহান মাথা নুইয়ে দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে অঝোরে কেঁদে চলেছে। ছেলে মানুষের যে কাঁদতে নেই এই মন্ত্র তন্ত্র আর রেহানের জন্য প্রযোজ্য নয়। রেহান পুনোরায় সব হারিয়ে নিঃস্ব।

সাই-সাই করে গাড়ি চলছে। আনায়া অতিরিক্ত কান্নার রেশে মাঝেমধ্যে ফুঁপিয়ে উঠছে। তবে ও একদম চুপচাপ। সঙ্গে কেনীথও অকপটে সামনের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ গাড়ি চালাতে ব্যস্থ। কেনীথ আজ আনায়াকে নিয়ে ঠিক কোথায় যাচ্ছে তা সে নিজেও জানে না। আজ সে গন্তব্যহীন পথে রওনা হয়েছে। তাও সঙ্গে আজ আনায়া। এ
এক জনমানবহীন নির্জন রাস্তায় তার গাড়িটা চলছে। আশেপাশে অসংখ্য বড়বড় গাছপালা রইলেও মানুষের সংখ্যা হয়তো খুবই ক্ষীণ। মাঝেমধ্যে দু একটা গাড়ি ব্যতীত তেমন কোনো ঝঞ্ঝাট নেই।
আচমকা কেনীথ ভিন্ন এক রাস্তা ধরে এগোতে লাগলো। রাস্তাটাও বেশি সুবিধাজনক নয়। আশেপাশে তেমন আলো নেই তবে আনায়া গাড়ির হেড লাইটের জন্য মাঝেমধ্যে বাহিরটা খেয়াল করার পাশাপাশি কেনীথের গতিবিধি লক্ষ করছে। কিন্তু কিছু বলছে না। এরই মাঝে কেনীথ খানিকটা দূরেই রাস্তার পাশে ছোটখাটো কিংবা মাঝারি খাদ রয়েছে এমন জায়গায় এনে গাড়ি থামালো। অতঃপর গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চোখ বুজলো। আনায়া কিছু বলছে না। ও চুপচাপ গুটিয়ে বসে রইছে। এরই মাঝে কেনীথ চোখ বুঁজে থাকা অবস্থায় বললো,
“তখনকার প্রশ্নের উওরটা কিন্তু পায়নি আমি।”

আনায়া জানে না কেনীথের এই কন্ঠে কি ছিলো। তবে মূহুর্তেই অদ্ভুত ভাবে আনায়া কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো। তবে আনায়া পাশে ফিরে কেনীথকে দেখলো না। ও চুপচাপ মাথা নুইয়ে বসে রইলো।
“ভালোবাসা কি জিনিস তা আমি বুঝি না। এটার ঠিকঠাক সংজ্ঞাও জানা নেই আমার। আর সবচেয়ে বড় কথা আমি মানুষ রূপী একটা জানো*য়ার। এবং জা*নোয়াররা কখনো ভালোবাসাতে জানে না। কারণ তাদের মানুষের মতো সুন্দর কোনো মন থাকে না।”
কেনীথ এটুকু বলেই থামলো। আনায়া এবার পাশে ফিরে কেনীথের বন্ধ চোখজোড়ার দিকে তাকাতেই কেনীথ চোখ খুলে সটানভাবে বসলো। অতঃপর আনায়া দিকে তাকিয়ে পুনোরায় মুচকি হেসে বললো,
“কি অদ্ভুত তাই না! আমার মতো জানো*য়ারদের তোর মতো ভালো মানুষ গুলো ভালোবাসতে জানে না। আবার অদ্ভুত ভাবে তোর মতোই ভালো মনের কেউ যখন আমায় ভালোবেসে দিন-রাত কষ্টে ছটফটিয়ে যাচ্ছে। তখন আমি জানো*য়ারটা কিনা তাকেই পাত্তাই দেই না।
কি অদ্ভুত! কি অদ্ভুত! এটাকে কি বলা চলে? রিভেঞ্জ অব ন্যাচার নাকি জীবন চক্র? হবে হয়তো কিছু একটা।”
আনায়া স্তব্ধ চোখে কেনীথের দিকে তাকিয়ে। হয়তো কিছু বলতে চাইছে কিন্তু সেটা কি তা আনায়া নিজেও জানে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় বড় অসুখের মাঝে প্রধান হলো দ্বিধাগ্রস্ত মানসিক রোগ। এই রোগে মানুষ নিজেও জানে না যে তার সাথে কি হচ্ছে, তার কি করা উচিত, কি করলে পরিণতি ঠিক কি হবে; মূলত এসবের মারপ্যাচে মানুষ নিজেকে হারিয়ে ফেলে। ব্যক্তি জানে সে ঠিক নেই, তার আশপাশে যা হচ্ছে তাও হয়তো ঠিক নেই কিন্তু তার কাছে কোনো কিছুর সমাধানও নেই।

ভাষা হলো মানুষের মনের ভাব প্রকাশের একটি মাধ্যম। অথচ মানুষ কিনা এই রোগে আক্রান্ত হয়ে ভাষা জানা স্বত্বেও নিজের অনুভূতি গুলোকে আর কারো কাছে উপস্থাপন করতে পারে না। অন্যকারো কাছে প্রকাশ করার কথা না হয় বাদই দেওয়া যায়, ব্যক্তি তো নিজেই নিজেকে বোঝাতে পারে না সে কি চায়। উপলব্ধি করতে পারে না নিজের মনের গহীনের অনুভূতিকে।
আর এই একই রোগে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে আক্রান্ত হয়ে গিয়েছে কেনীথ আর আনায়া দুজনেই। দুজনেই জীবনকে এক দ্বিধাদ্বন্দ্বের পাল্লায় সাজিয়ে রেখেছে। যে পাল্লা এখন পর্যন্ত কোনোকিছুরই সঠিক পরিমাপ করে তাদের যথার্থ ফলাফলটা দিতে পারেনি।
দু’জনের নিরবতা কাটিয়ে কেনীথ আবারও বলতে লাগলো,
“সামনে একটা খাদ রয়েছে। যদি আজ কিছু একটা করি তবে দু’জনেই উপরে যাওয়াটা কনফার্ম হয়ে যাবে আশাকরি।”

কেনীথের কথা শুনে আনায়া খানিকটা আঁতকে উঠে কেনীথের দিকে তাকালো। কেনীথ নির্বিকার গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতে বললো,
“আশা রাখছি, আমার সাথে যেতে তোর কোনো আপত্তি নেই।”
এই বলতে না বলতেই কেনীথ প্রায় ফুল স্পিডে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সামনে এগোতে লাগলো। কেনীথ স্বাভাবিক হাবভাবের মাঝে আনায়া বিস্ময়ে কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না। চোখে জল চলে এসেছে সঙ্গে সে নিজেও হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে। আনায়া আঁতকে একবার বাহিরে দেখছে তো একবার কেনীথের দিকে। কেনীথ হাসছে, পাগলের মতো শব্দহীন হয়ে হাসছে।

আনায়া উপায় না পেয়ে কেনীথের হাতটা স্টিয়ারিং থেকে সরাতে নিলে কেনীথ স্পিডটা এবার সর্বোচ্চ করে স্টিয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে নিলো। এটা দেখে আনায়া আরো বেশি বিস্মিত। সামনে তাকিয়ে দেখলো হেড লাইটের হলুদ আলোতে প্রায় বড়সড় খাদের দেখা যাচ্ছে। আনায়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বললো,
“এমনটা কেনো করছেন,প্লিজ..থামান। আমি আর কখনো আপনাকে ছেড়ে… ”
কেনীথ আনায়ার কথা শেষ হবার আগেই ওকে হেঁচকা টানে নিজের কাছে টেনে নিলো। এবং খুব দ্রুত নিজের মোটা কালো জ্যাকেটের মাঝে আনায়ার মাথাটাকে ঢেকে দিয়ে ওকে নিজের সাথে শক্ত করে চেপে ধরলো। এরপর অসহনীয় কন্ঠে তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বললো,
“আমার গল্পের ইতি না হয় এখানেই ঘটলো। আর তুই বেঁচে রইলে ঐ রেহানের কাছে চলে যাস। ও তোকে অনেক ভালোবাসবে। আর তোদের সেই সুন্দর ভালোবাসায় এই জা*নোয়ারটা কখনো বাঁধা হতে আসবে না। ভালো থাকিস মাই…ব্লা…ড।”

কেনীথের কথা আনায়া শেষ পর্যন্ত শুনতে পেলো কিনা তার আগেই এক বিকট ভাংচুরের আওয়াজে ওর পুরো মস্তিষ্ক ঘুরে গেলো। বুঝতে পারছে না ওর সাথে ঠিক কি হলো তবে আনায়ার খেয়াল করলো তার চোখ জোড়া ক্রমশ বন্ধ হয়ে আসছে। সঙ্গে এও অনুভব করলো যে কেনীথের শক্ত বন্ধনটাও আগলা হয়ে এসেছে। আচ্ছা কেনীথ কি তাকে রেখেই চলে গেলো। যেভাবে তার বাবা আর সন্তান ছেড়ে গিয়েছে! না, না, এটা হয় না।
কেনীথের শক্ত বন্ধনে জ্যাকেটের মাঝে রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতির সঙ্গে সবকিছুই অন্ধকার তো লাগছিলোই তবে আনায়া মনে হলো এভাবে সারাজীবন কেনীথের জন্য রুদ্ধশ্বাস হয়ে বাঁচাটা মন্দ কিছু ছিলো না। কিন্তু এখন তো নিজেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের অসহায় লাগছে। চারপাশটা ইতিমধ্যে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে এসেছে। আনায়া ভাবলো সে কি কোথায় ব্যাথা পেয়েছে কিংবা কোথাও কেটে গিয়ে রক্ত ঝড়ছে? হতে পারে। এই নিয়ে তার আফসোস নেই। নিজেকে নিয়ে তার বিন্দুমাত্র কষ্টও হচ্ছে না।

তবে তার অসহনীয় লাগছে কেনীথের জন্য। ইতিমধ্যে যে ভাবেই হোক একবার অন্তত্য সে কেনীথকে দেখতে চাইছে। মনেপ্রাণে শেষবারের মতো হলেও সে কেনীথকে দেখতে চায়। আচ্ছা তার এই ইচ্ছেটা কি ঠিক? তার জীবনের সব কষ্ট, সব দুর্ভোগ কিংবা পুরো জীবনটা তো শুধু কেনীথের জন্যই ধ্বং*স হয়েছে। তবে এই মূহুর্তে কেনীথের জন্য যে অনুভূতি জন্মাচ্ছে তা কি আদতেও ঠিক হচ্ছে! আনায়া জানে না। এই শেষ সময়ে মস্তিষ্কের বিশ্লেষণে আর কোনো দ্বিধাদ্বন্দও তৈরি করতে চাইছে না।

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩১

এবার শুধু মনে হচ্ছে জীবনের শেষ সময়ে শেষবারের মতো অন্তত কেনীথের মুখটা দেখতে চায় সে। মা হয়ে নিজের সন্তানকে শেষ করার মতো জঘন্য পাপ করেছে। সে সময় না বুঝলেও জীবনের শেষসময়ে এসে মনে হচ্ছে সবকিছুর জন্য তারই দোষই ছিলো। এ বারে হয়তো প্রায়শ্চিত্ত করার আর কোনো সুযোগ রইলো না। তবে অভাগা সন্তানের পিতাকে কিংবা নিজের জানো*য়ার সরূপ স্বামীকে শেষ মূহুর্তে একবার দেখতে না পারার আফসোস যেন আনায়া মৃ*ত্যুর পরও শান্তি দিবে না। কিন্তু সত্যিই আফসোস,তার এই ইচ্ছে আর পূর্ণ হলো না। বরং এর আগেই কৃষ্ণগহ্বরের ন্যায় কালো অন্ধকারের ঘেরা অতল গভীরতায় ডুবে গেলো আনায়া। সঙ্গে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হলো জগৎ দুনিয়া থেকে সকল সংযোগ।

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩৩