একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩৮ (২)

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩৮ (২)
রনীতা তুশ্মি

পাভেল কেবিনে প্রবেশ করতেই দেখে, বেডের এককোণায় কেনীথ কাত হয়ে শুয়ে রয়েছে। একটু নড়চড় হলেই ধুপ করে নিচে পড়বে। চারপাশের জিনিসপত্র সব ছড়ানো ছিটানো। যেন এইমাত্র ভুমিকম্পে সব লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে। পাভেল রুদ্ধশ্বাস অবস্থায় ছুটে কেনীথের কাছে যায়। তড়িঘড়ি করে কেনীথকে ঠিকঠাক মতো শুইয়ে, তার পালস্ চেক করে। নাকে আঙ্গুল রেখে বোঝার চেষ্টা করে শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিকঠাক চলছে কিনা। সবকিছু চেক করা হলে, পাভেল স্বস্তিতে ভারী শ্বাস ফেলে।

এদিকে খানিকটা সময়ের মাঝেই আনায়ার সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়৷ তার সাথে নার্স এবং একজন ডাক্তারও যায়। চারপাশের অবস্থা দেখে প্রত্যেকেই হতভম্ব। এসব কি হয়েছে এখানে! অথচ হসপিটালের এতোসব মানুষজন কেউ কিছু জানতেই পারলো না। ডাক্তার আর নার্সকে দেখে পাভেল ক্ষিপ্ত স্বরে বলে উঠল,
“কি হচ্ছে এসব এখানে? এতো বড় হসপিটালের, এই সব নমুনা? একটাকেও ছাড়বো না, পুরো হসপিটাল ডুবিয়ে ছাড়বো।”
পাভেলের রাগে ডাক্তার নার্স সকলেই খানিকটা আঁতকে উঠলেও, তারা দ্রুত নিজেদের কাজে লেগে পড়ে। আসলেই তো! এতো বড় হসপিটালে এতোকিছু ঘটে গেলো অথচ কেউই জানে না? বিষয়টা নিত্যান্তই অস্বাভাবিকও বটে। আবার এমন ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেওনি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রাক্তার কেনীথকে ভালোভাবে চেক করে দেখে, কোনো ক্ষত কিংবা অস্বাভাবিক কিছু হয়েছে কিনা। মোটামুটি ঠিকঠাকই রয়েছে। তবে তার ঘুমের ঔষধের রিয়াকশন এখনো সে অচেতন। ডাক্তার কিছুটা অবাক হয়, কেনীথের এতো ঘুমের তাগিদ দেখে। তাকে তো খুব কঢ়া ডোজের ঔষধ দেওয়া হয়নি। যার ফলে এতো কিছু হয়ে যাওয়ার পরও, সে ম”রার মতো ঘুমাবে। বিষয়টাতে ডক্টরের খানিক খটকা লাগে। সে দ্রুত আবারও কেনীথের বিভিন্ন অংশ আরো ভালো ভাবেই চেক করতে বুঝে যায় যে, কেনীথের ঘুমের মাঝেও তার মুখে চেতনানাশক স্প্রে ব্যবহার করা হয়েছে৷
ডাক্তার এক মূহুর্তও দেরি না করে, একজন নার্সকে বললো সিসিটিভি ফুটেজ রুমে লোক পাঠাতে। তার কথা শুনে নার্স তার কাজে ছুটে যায়, সেই সাথে পাভেল নিজেও যেতে লাগল। তবে দরজার কাছে আনায়াকে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখায় থেমে গিয়ে বলল,

“আপনি ঠিক আছেন?”
আনায়া কেনীথের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার মন মস্তিষ্ক চিন্তাভাবনা সব অন্য দিকে ছিল।আর পাভেলের কথা শোনা মাত্রই সে ঘোর থেকে বেড়িয়ে আনায়া খানিকটা নড়েচড়ে ওঠে। পাভেল আবারও জিজ্ঞেস করে,
“ইনায়ার কি অবস্থা?… তবে ইনায়াও কি…”
—“নাহ! না… ওর কিছু হয়নি। ডাক্তার বলেছে,ইরা এখন কিছুটা স্বাভাবিক।”
আনায়ার অস্ফুট উত্তরে পাভেল খানিকটা ভারী শ্বাস ফেলল। অতঃপর আর এক মূহুর্তও দেরী না করে সিসিটিভি রুমে ছুটে যায়। তবে সেখানে গিয়ে বুঝতে পারে, তাদের আসতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। প্রয়োজনীয় সকল সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব। গত কিছু সময়ের মাঝের আশেপাশের কোনো ফুটেজই আর নেই। এতো বড় কাজটা কে অথবা কিভাবে করলো তা কারোরই মাথায় আসছে না।

সকাল নয়টার দিকে কেনীথের জ্ঞান ফিরেছে। ডাক্তার এসে যথাযথ চেক-আপও করে গিয়েছে। মোটামুটি সবার চেয়ে কেনীথ যথেষ্ট সুস্থ। শরীরের ক্ষত গুলোতে নার্স পুনোরায় এসে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে গিয়েছে। কেনীথ চুপচাপ বেডের উপর আধশোয়া হয়ে বসে রয়েছে, এমন পর্যায়ে ট্রে হাতে, রুমে প্রবেশ করল আনায়া। আনায়াকে দেখমাত্রই কেনীথ চুপচাপ ওর দিকে তাকিয়ে রইল।কিন্তু আনায়ার তাতে ধ্যান জ্ঞান নেই। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত মলিন চেহেরায় সে কেনীথ কাছে এগিয়ে এলো। কেনীথের কাছে ওর ভাবগতিক স্পষ্ট নয়।দেখে মনে হচ্ছে, একটা খারাপ কিছু হয়েছে। কেনীথ কিছু বলতে নিবে,তার পূর্বেই আনায়া ভাঙ্গা গলায় কেনীথের উদ্দেশ্য বলল,

“এখন শরীরের কি অবস্থা?”
কেনীথ ওর আওয়াজে অনেকটাই অবাক হলো। মনে হচ্ছে, প্রচুর পরিমাণে কেঁদেছে সে। কেনীথ আঁতকে উঠল, এই ভেবে যে ইনায়ার কিছু হয়েছে কিনা। কেনীথ দ্রুত বলে উঠল,
“আমি…ঠিক আছি। কিন্তু কারো কিছু হয়েছে কি?”
আনায়া কেনীথের দিকে তাকিয়ে খানিকটা মুচকি হাসে। যে হাসির সম্পূর্ণটাতেই ছিলো তাচ্ছিল্যে পরিপূর্ণ। আনায়া ট্রেটা টেবিলের উপর রেখে,স্যুপের বাটিটা নিয়ে কেনীথের পাশে বসে। চামচ দিয়ে গরম স্যুপটা নাড়াচাড়া করতে লাগল। এক চামচ স্যুপ তুলে নিয়ে, কেনীথের মুখের সামনে ধরতেই কেনীথ বলল,
“ইনায়ার কি অবস্থা? ওর কিছু… ”
—“নাহ,ঠিক আছে ও।”

কেনীথ খানিকটা স্বস্তিতে শ্বাস ফেলে, স্যুপটুকু মুখে নেয়। ঠিক সেই মূহুর্তে আনায়া বিধ্বস্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
“আজকের পর থেকে, আমাদের মতো রেহানেরও আর কেউ রইলো না। ওর ছোট ভাই, রোহানকে চেনেন? ও আর নেই। ম”রে গিয়েছে।”
কেনীথ আনায়ার এলোমেলো কথাগুলো শুনে খানিকটা ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকায়।আনায়া খানিকটা মুচকি হেসে আবারও বলল,
“আপনি খুশি হননি? আমি তো ভাবলাম, এটা শুনে আপনি খুশি হবেন। কি অদ্ভুত এই দুনিয়া তাই না! যে কোনো দোষ করলো না সেও আজ সব হারালো।”
কেনীথ খানিকটা অস্থির হয়ে বলে উঠল,
“শুনেছিলাম, রোহানকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। হঠাৎ ও কিভাবে…কি হয়েছে, আমায় খুলে বল তো!”

—“ন”রখাদক ছিলো। জ”ন্তু জানো”য়ার আর মানু””ষের মাং””স খে”তো। আপনাকে আর ইনায়াকে যেখানে পেয়েছি, ওখানেই এতোদিন ছিলো। একদম অন্ধকার জগতে ছিলো তার বসবাস। হাস্যকর! ঐ ছেলেটার কপালেও কেনো এমন মৃত্যু ছিলো, বুঝলাম না।”
আনায়া এটুকু বলতেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। কেনীথের মুখের সামনে আবারও চামচ ধরতেই কেনীথ বলে উঠল,
—“আর খাবো না আমি।”
—“খাবেন না? কেনো খাবেন না? আরে খেয়ে নিন, খেয়ে নিন। আপনারই তো সময়। আগে শুনতাম, পৃথিবীটা হলো খারাপদের জন্য। যে যত বেশি খারাপ, তার জীবনটা তত বেশি সুন্দর। আসলেই তাই!
তাই এখন সুন্দর মতো খেয়ে নিন। খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে আবার অনেক মানুষের জীবন ধ্বং”স করতে হবে, তাই না?”

আনায়ার তাচ্ছিল্যে পরিপূর্ণ কথা আর ভাবভঙ্গিতে কেনীথের চোখমুখ শক্ত হলো। কিছু বলতে নিয়েও আর বললো না।ঠিক ঐ মূহুর্তেই আনায়া হিসহিসিয়ে বলল,
“রেগে যাচ্ছেন? আর রেগেই বা কি লাভ? সব তো শেষ, এখন শুধুমাত্র আমি রয়েছি। বাকি যারাও আজ বেঁচে রয়েছে, তারা ভেতরে ভেতরে কিন্তু পুরোটাই শেষ। আমাকেও শেষ করেছেন আপনি! চিরতরে শেষ করেছেন। এখন চাইলে জ্যান্ত হোক বা মৃত; যেভাবে ইচ্ছে দাফন করুন৷ কিচ্ছু যায় আসে না।”
—“………….
—“আমাকে একটা সাহায্য করতে পারবেন?”
—“কি?”

—“আমার সাথে একবার রাশিয়া যেতে হবে। হাতে সময় কম। খুব দ্রুত কাজ শেষ করতে হবে।”
আনায়ার এলোমেলো অভিব্যক্তিতে কেনীথ আর একটা কথাও বললো না। আনায়াও একটুও সময় নষ্ট না করে কেনীথকে খাবার খাইয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। পরবর্তী নার্স গিয়ে তাকে ঔষধ খাইয়ে দেয়।
আনায়া রুম থেকে বের হয়েই দেখল, রেহান করিডরে চুপচাপ বসে রয়েছে। চোখের চাহনিতে নির্লিপ্ততা। আশেপাশে কি হচ্ছে তাতে কোনো ধ্যান জ্ঞান নেই। বিধ্বস্ত চেহেরার অপলক চাহনিতে সামনে দিকে তাকিয়ে। নিশ্চিত কোনো ঘোরের মাঝে আঁটকে রয়েছে। আনায়া রেহানের কাছে গিয়ে ওর পাশে বসে। দুজনের মাঝে অনেকটাই দূরত্ব। রেহানকে আনায়া একবার নাম ধরে ডাকলেও তেমন কাজ হলো না।রেহান যেন তা শুনতেই পায়নি। আনায়া হাত বাড়িয়ে রেহানের হাতের উপর হাত রাখলে, আকস্মিক সে খানিকটা চমকে আনায়ার দিকে তাকায়। এবং ত্বরিত নিজের হাতটা সরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি নজরও সরিয়ে ফেলে। অতঃপর অদ্ভুত ভাবে বি”ক্ষিপ্ত স্বরে বলতে লাগল,
“আমাকে ছুঁয়ে আর নিজেকে পাপের ভাগীদার করো না।দূরে থাকো, দূরে থাকো আমার।”

আনায়া নিজের হাতটা সরিয়ে নেয়। রেহানের দিকে তাকিয়ে অপলক তাকিয়ে থাকার পর ভারী নিশ্বাস ফেলে। রেহান এসব কথা কিছুক্ষণ আগেও বলেছে। রেহান যখন রোহানের কাছে যায় তখন অবস্থা একদম পাগলের মতো ছিলো। কি করবে না করবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। যে রেহান শুরুতে রোহানের শরীরকে বিদঘুটে বলেছিলো, সেই পরবর্তীতে ওর বিদঘুটে শরীরটা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। কখনো পাগলের মতো সারা শরীরের হাত বুলিয়েছে, কখনো চুল দাড়িয়েতে পরিপূর্ণ বিশ্রী চেহেরাটায় অনবরত উম্মাদের মতো চুমু খেয়েছে। সেই সাথে করুণ স্বরে আর্তনাদ করে বারবার বলেছে,

“ভাই একবার চোখ খুলে তাকা আমার দিকে। তোকে আমার অনেক কথা বলার আছে। অনেক কথা জমা রয়েছে আমার। এবার তো তোকে খুজে পেয়েছি, প্রমিজ করছি আমারা দুজন মিলে সবার থেকে দূরে চলে যাবো। তখন দেখবি, আমাদের আর কেউ কষ্ট দেবে না। প্লিজ একবার শুধু চোখ খোল। তুই আমাকে এভাবে ছেড়ে গেলে আমি আর কিভাবে বাঁচব? সবার মতো তুইও আর আমাকে, এভাবে নিঃস্ব করে ফেলে রেখে যাস না। প্লিজ রোহান! প্লিজ! একবার শুধু চোখ খোল ভাই, আমার।
ওর কান্নায় আনায়া নিজেও নিজেকে সামলাতে পারেনি। সে নিজেও হু হু করে কেঁদেছে। আর রোহানকে সামলাতে গেলে তখন ঠিক এভাবেই তাকে দূরে সরে যেতে বলেছে। এমন পরিস্থিতিতে রেহানের অভিব্যক্তি অস্বাভাবিক নয়৷ কিন্তু সব মিলিয়ে আনায়া নিজেও আর কিছু সহ্য করতে পারছে না। আর কত হবে এসব, তা কেউ জানে না।
রেহান আর আনায়ার মাঝেই তাদের কাছে পাভেল এলো। দুজনের অবস্থা দেখে পাভেল আদতে কি বলবে তা নিজেও বুঝতে পারলো না। তবে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আনায়া বলল,

” কিছু হয়েছে?”
—“না না, কিছু হয়নি। বলছিলাম যে ডেড বডি চাইলে এখান থেকে সরাসরি নিয়ে যাওয়া যাবে। আমি সব ব্যবস্তা করে দিয়েছি, আলাদা কোনো ঝামেলা হবে না।”
পাভেলের কথা শুনে আনায়া চুপচাপ বসে রইল। পাভলেও সম্পূর্ণ চুপ থেকে বি”ধ্বস্ত রেহানের দিকে তাকিয়ে। আনায়া চাইলেও কিছু বলতে পারছে না, এরই মাঝে পাভেল অনেকটা নরম গলায় রেহানের উদ্দেশ্যে বলল,
“মিস্টার রেহান! ডেড বডিকে তবে…”
রেহানের যেন কেবল হুঁশ ফিরল।সে পাভেলের দিকে বিধ্ব”স্ত চোখে তাকিয়ে এলোমেলো কন্ঠে বলল,
“ডেড বডি নয়, ও আমার ভাই। ওর একটা নামও রয়েছে, রোহান! ওকে আমাদের বাবা মায়ের কবরের পাশে দাফন করব। আমাদের গ্রামের বাড়িতে।… এই শহর বিষাক্ত! আমি আর এখানে থাকতে চাইনা। সব কেড়ে নিয়েছে আমার,সব!”

রেহান এটুকু বলতে না বলতেই পুনরায় চুপ হয়ে নিজের খেয়ালে হারিয়ে গেল। সকালে এলোমেলো হয়ে থাকা চুলগুলো এখন পুরো পাখির বাসার মতো হয়ে আছে। কাঁদতে কাঁদতে চেহেরার হাল সম্পূর্ণ বেহাল। আনায়ার এর আগে কখনো এভাবে রেহানকে কাঁদতে দেখেনি। কিন্তু এবার যেন সম্পূর্ণ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছে। চোখের পানিও শুকিয়ে গিয়েছে। আর এখন সম্পূর্ণ পাথরের ন্যায় বসে রয়েছে।
—“তবে আমি বরং, আপনার গ্রামের বাড়ির ঠিকানাতেই রোহানকে পাঠানোর ব্যবস্তা করছি।”
এই বলেই পাভেল কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইল। রেহান হতে কোনো প্রতিত্তোর না আসায় সে চলে যেতে নিলে, পেছন থেকে অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,

“ধন্যবাদ! অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাদের। নয়তো আমার ভাইটাকে নিয়ে টা”নাহ্যাঁচ”ড়া করে,ওকে আরো বেশি কষ্ট দেওয়া হতো। আমি চাইনি কখনো এমনটা হোক।
অবশ্য, আমি যা চাইনি তা-ই তো হয়েছে। যা চেয়েছি তা চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে।”
এটুকু বলতে না বলতেই রেহান আবারও নিজের খেয়ালে হারালো। অন্যদিকে ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাভেল চলে যেতেই আনায়ার চোখ হতে না চাইতেও কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল।

দুদিন পেরিয়ে গিয়েছে।রোহানেও দাফন হয়ে গিয়েছে,তার বাবা মায়ের কবরের পাশে। আর রেহান এখন ছন্নছাড়া হয়ে তার গ্রামের বাড়িতেই রয়ে গিয়েছে।
আর এদিকে আনায়া নিজেকে কোনোমতে সবকিছু মানিয়ে সামলে নিয়েছে৷ অনেক কাজ বাকি তার। ইনায়ার অবস্থার খানিকটা উন্নতিও হয়েছে৷ আগের যে অনেকটাই ভালো। অবশ্য এই পুরো দায়িত্বটা পাভেলকে দেওয়া হয়েছে। ইনায়ার উপর যেন কঢ়া সর্তকতা অবলম্বন করা হয়। কোনো মতেই যেন ওর কিছু না হয়। সবমিলিয়ে পাভেল তার লোকজন দিয়ে সবকিছু সামলে নিয়েছে।
আপাতত আজ তাদের রাশিয়ায় যাওয়ার কথা। যদিও পাভেল কেনীথ আনায়ার উদ্দেশ্যের বিষয়ে তেমন কিছুই জানে না। তবে এক প্রকার আনায়ার জন্যই তাদের রাশিয়ায় যেতে হচ্ছে।

এদিকে গতকাল আনায়া গিয়ে সেই নার্সগুলোর সাথে দেখা করে এসেছে। এটা শুধু পাভেল আর আনায়াই জানে। কেনীথকে এসব বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি। তবে আনায়া নার্সগুলোর কাছ থেকে যা শুনেছে তাতে সে সম্পূর্ণ বিস্মিত। আদতেও যে এতোদিন ধরে বাচ্চাদের নিয়ে এতো জঘ”ন্যসব কাজ করা হচ্ছিল, তা তার কোনো মতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। যেন প্রত্যেকের কথাগুলো তার কাছে সপ্নের মতো লাগছিল। তবে আনায়া কারো কাছ থেকেই এই কোম্পানির সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতে পারেনি। তাদের কথা, তারা শুধু বাধ্য হয়ে কাজ করেছে। আর যারা অবাধ্য হয়েছে তাদের কঠিনের চেয়েও কঠিন শাস্তি হয়েছে। মূলত সেসব বিষয়ে অনেককিছু জানতে পারলেও কাজের তেমন কিছু সে পায়নি৷

নার্সদের কথা অনুযায়ী, অলিভার আর ইনায়া ছিলো এসব কাজের মূল কর্তা। তারা যা বলতো, তাদের তাই করতে হতো। এসবের মাঝে আনায়াকে সবচেয়ে বেশি অবাক করেছিল ইনায়ার বিষয়টা। ইনায়ার সম্পর্কে তাদের মুখ থেকে যতটুকু শুনেছে তাতে সে সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ। তার বোন, এতটা জঘ”ন্য, নৃশং”স কাজ করেছে তা তার কাছে এসব সম্পূর্ণ দুঃস্বপ্নের মতো। কি করে সম্ভব…!
ডবে সবকিছু শোনার পর আনায়া অনেকটাই চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। তার মাথায় যে আদতে কি চলছে তা কেউই বুঝতে পারছে না। আর এখন শেষমেশ কোনো কিছু না বলেই কেনীথ, পাভেলকে নিয়ে সোজা রাশিয়ায় চলে এলো।
আনায়া, পাভেল আর কেনীথকে দেখে মিসেস লুসিয়া নিত্যন্তই খুশি মনে তাদের আপ্যায়ন করে। কিন্তু আনায়ার এসবের কোনো কিছুতেই কোনো হেলদোল নেই। সে একদম নির্লিপ্ত, নিশ্চুপ। এদিকে আর সবার মতো আনায়ার ভাবগতিক কেনীথ নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। ও আদতে করতে চাইছেটা কি?

সারাদিন খাওয়াদাওয়া বলতে আনায়ার তেমন কিছুই হয়নি। সর্বক্ষণ কি একা একা কি ভেবেছে আর কি করেছে কেনীথ কিছুই টের পায়নি। কিন্তু এতটুকু তো বুঝেছে, আনায়া কোনো বড় কিছু করার উদ্দেশ্যেই এখানে এসেছে। রাতের বেলায় চুপচাপ বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে আনায়া। পরনে কালো কুচকুচে সাধারণ গাউন। একদম সাদামাটা, চুলগুলো এলেমেলো। তার নির্লিপ্ত চোখের চাহনি সামনের অন্ধকারের মাঝে।
ঠিক এমন সময়ে হঠাৎ বারান্দায় কেনীথ এলো। তার নির্লিপ্ত ভাবগতিক আনায়ার কাছে স্পষ্ট ছিল না।সে তার ঘোর এবং বাস্তবতার মাঝে আঁটকে রয়েছে। আশেপাশে হয়তো কেনীথ রয়েছে এটা বুঝতে পারলে তার থাকা না থাকায় যেন আনায়ার কিছুই যায় আসে না। সে বরাবরের মতোই নিজের ভাবনায় মত্ত।

তবে এরইমাঝে কেনীথ ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু ওর স্তব্ধ ভাবগতিক দেখে সে কিছুই বলে না, বরং পাশ থেকে চুপচাপ আনায়াকে দেখতে থাকে।কিছুক্ষণ সময় এভাবে অতিক্রম হওয়ার পর, কেনীথ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আনায়ার চুলে হাত দিতে নিলে,আনায়া খানিকটা শান্ত ভাবে সরে গিয়ে বলে উঠল,
“ছোঁবেন না আমায়! আপনার প্রতি আমার প্রচন্ড ঘেন্না হয়।”
কেনীথ হাতের মুঠো শক্ত করে বাড়িয়ে নেওয়া হাতটা সরিয়ে আনে। তার অভিব্যক্তি নির্লিপ্ত। এরইমাঝে আনায়া আবারও শক্ত চোখে কেনীথের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি জানেন? আপনি আমার আশেপাশে থাকলে আমার শরীর ঘিনঘিন করে। আপনার নামটা শুনলেও তো,এখন আমার ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসে।”
কেনীথ আনায়া এমন বি”দ্বেষপূর্ণ কথা শুনেও নির্লিপ্ত স্বরে বলল,
“ভালো।”
আনায়া আকস্মিক বিস্মিত হলো। হুরহুর করে তার রাগ বেড়ে ওঠে। দাঁত খিঁচে কপাল উঁচিয়ে বলল,
“ভালো?”
কেনীথ আবারও নির্লিপ্ত স্বরে উত্তর দেয়,

“হুম, ভালো! আর যাই হোক, তোর আমার মাঝে অন্তত একটা বি”দ্বেষের সম্পর্ক তো রয়েছে।”
—“লজ্জা করে না? এতোকিছুর পরেও একটুও লজ্জা হয় না? বেঁচে আছেন কিভাবে? আবার নির্লজ্জের মতো আমার কাছে স্বাভাবিক হতে আসেন। কিভাবে পারেন আপনি এসব? আমাকেও দয়া করে শিখিয়ে দেবেন তো! আমিও আপনার মতো হতে চাই।”
—“আমার মতো হয়ে, তোর কোনো কাজ নেই । যা রয়েছিস, তাই থাক! আর যে বিদ্বেষের পাহাড় গড়ে তুলেছিস আমার প্রতি, সেটাও কখনো ভাঙ্গতে দিস না। নয়তো তোর অবশিষ্ট অস্তিত্বটুকুও এই ভি.কে. নামক বিষাক্ত অগ্নিকু”ণ্ডের উ’ত্তাপে ঝলসে যাবে।”

—“কি বোঝাতে চাইছেন? এতোকিছুর পরেও আমি আপনার জীবনে স্বাভাবিক হয়ে ফিরতে পারবো? সবকিছু ভুলে আপনাকে ভালোবেসে, আপনার সাথে থাকব? এমন দুঃস্বপ্নের কথা কিভাবে ভাবেন?”
—“এইজন্যই তো ভাবি না। যেখানে জীবনগুলোই অস্বাভাবিক, সেখানে সম্পর্কগুলো কিভাবে স্বাভাবিক হতে পারে! আর তোর আমার মাঝে ভালোবাসা… এই শব্দটাকে ব্যবহার করাও হাস্যকর।”
আনায়া আর কিছু বলল না৷ চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর তার তীব্র অস্বস্তিতে সে অস্থির হয়ে ওঠে। সত্যি সত্যিই আর কেনীথে পাশে এখানে আর থাকতে চাইছে না।সে পেছনে ফিরে রুমে আসতে নিলে, কেনীথ আচমকা ওর হাত টেনে ধরে। আনায়া পেছনে ফিরে তাকালে, কেনীথ শীতল কন্ঠে বলে ওঠল,
“খাবারটা খেয়ে যা। সারাদিন কিছু খাসনি। অসুস্থ হয়ে পড়বি।”

আনায়ার চোখে আকস্মিক পানি চলে এলো৷সে জানে না এটা, অতিরিক্ত রাগ, ক্ষোভ কিংবা কষ্টের কারণে কিনা। তবে খানিকটা ক্ষোভ এবং অসহায় মিশ্রিত স্বরে বলল,
“কেনো করছেন এসব? কি লাভ এসব করে?”
—“কোনো লাভ নেই। তোর শরীর, তোর অসুস্থতা…অসুখ হলে তুই নিজেই ভুগবি।”
—“তবে এসব আমাকে বুঝতে দিন না! আমাকে নিয়ে আপনার কেনো চিন্তা? দোহাই আপনার, আর দয়া করে এসব ড্রামা করবেন না৷ এসব দেখতে দেখতে, অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছি আমি।”
—“দেখ যেটা ভালো বুঝিস।”
—“হাত ছাড়ুন আমায়।”
—“ঠিকঠাক নিজের খেয়াল রাখতে শিখে নে! ওয়াদা করছি, সারাজীবনের জন্য ছেড়ে দেবো তোকে।”
আনায়া কেনীথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে ফেলল। কেনীথের সবকিছুই যেন তার কাছে শুধু এক বাজে অভিনয়ই মনে হচ্ছে। আনায়া চুপচাপ খানিকটা চুপ থেকে আকস্মিক বলতে লাগল,
“আপনার বাবা মাকে ধন্যবাদ। এমন একটা মাস্টারপিস বানানোর জন্য। এখন তো আর, না ভয় হয়, না ঘৃণা! শুধু অবাক হই আমি।”

—“ধন্যবাদ তোর বাপকে দিস। আমাকে বানানোর কারিগর সে নিজেই। আমার বাপ মা আমাকে এমন বানায়ি।”
—“হ্যাঁ,অবশ্যই। এখন তো মনে হয় আমার বাপ যা করেছে ঠিকই করেছে। নয়তো তোমার বাপ মা বেঁচে থাকলে, ছেলের এমন রূপ দেখে নিজেদের কবর নিজেরাই খুঁড়ত।”
আনায়া রাগের মাথায় কি বলছে তা হয়তো নিজেও জানে না।কখনো তুমি তো কখনো আপনি। এদিকে কেনীথ খানিকটা কপাল কুঁচকে,আনায়ার হাত ধরে রাখা বাঁধনটা শক্ত করল। কিছুটা গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
“আনায়া! লিমিট ক্রস করিস না। আমি এই প্রসঙ্গে কিছু বলতে চাচ্ছি না।”
আনায়া যেন এই কথায় আরো কিছুটা রেগে যায়। এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে, হুট করেই প্রচন্ড তাচ্ছিল্যের সাথে বলতে লাগল,

“লিমিট ক্রস? এটুকুতেই আমার লিমিট ক্রস হয়ে গেল? তা তুমি যেসব করেছে সেসব কি?… আর রইল তোমার বাবা মায়ের প্রসঙ্গ…তারা কি এমন মহান কাজ করে গিয়েছেন শুনি? একটা জানো””য়ার, একটা কুলা/ঙ্গারকে পয়দা করে রেখে গিয়েছে। এই পাপের ফল তো তারা ম”রে গিয়ে ভোগ করছে হয়তো।”
আনায়া আর কিছু বলার সুযোগই পেল না। তার আগেই বজ্রাঘাতের ন্যায় কেনীথের বলিষ্ঠ হাতের সজোড়ে দেওয়া এক থাপ্পড় এসে পড়ল আনায়ার গালে।কেনীথের ডানহাতের আঘাতে আনার মাথা সম্পূর্ণ কেঁপে ওঠে, চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসে চারদিক। শরীরটা ছিটকে গিয়ে ধাক্কা খায় ব্যালকনির রেলিংয়ে।ধাতব রেলিংয়ের সঙ্গে তার পিঠের ধাক্কা লাগতেই একটা খাঁচায় আটকে পড়া পাখির মতো কেঁপে উঠল সে।
কিন্তু এখানেই থামল না কেনীথ।বরং তার চোখের ভেতর যেন তখনও আগুন জ্বলছিল। এদিকে আনায়া এখনও ব্যথায় কুঁকড়ে রয়েছে। আনায়া ঠিকমতো দাঁড়ানোর আগেই কেনীথ এগিয়ে আসে জড়ের গতিতে। আচমকা তার ডানহাত দিয়ে আনায়ার গলা চেপে ধরে।

এমন ভাবে চেপে ধরে, যেন গলার ভেতর থেকে নিঃশ্বাসটুকু ছিনিয়ে নিতে চায়। সেই সঙ্গে অন্য হাতে আনায়ার বামহাত মোচড় দিয়ে পেছনে টেনে নিয়ে, এমন ভাবে শক্ত হাতে চেপে ধরল যেন হাড় সম্পূর্ণ ভেঙে দেবে। অবশ্যই আকস্মিক এই আঘাতে আনায়া মনে হল, হাতটা যেন সত্যিই চিড়চিড় করে উঠেছে।
“আর একটা শব্দও বের হলে… সোজা খু’ন করে ফেলব তোকে!”
ফিসফিস করে কথাটা বলতেই কেনীথ আনায়ার উপর আরো বেশি বল প্রয়োগ করল। অথচ তার সেই কণ্ঠে এমন এক শীতলতা ছিল যা অগ্নি ঝড়ের চেয়েও বেশি ধ্বং”সাত্মক।
আনায়া শ্বাস নিতে পারছে না। তার গলা এখন কেনীথের লোহার মত শক্ত মুঠোয় বন্দী। চোখ দুটো বিস্ফোরিত হয়ে উঠছে, ঠোঁট কাঁপছে। চেষ্টা করছে কিছু একটা বলার, কিন্তু গলা দিয়ে শুধু ক্ষীণ শব্দ বের হচ্ছে। আনায়ার শরীর এতক্ষণে রেলিংয়ের গা ঘেঁষে বেঁকে রয়েছে।রেলিংয়ের ধাতব রেখা তার পিঠে কেটে বসছে। শরীরটা বেঁকে গিয়ে অস্বাভাবিকভাবে হেলে পড়েছে।

আনায়ার শরীর কাঁপছে… নিঃশ্বাস যেন বুকেই জমে আছে।কেনীথের চোখ তখন নিস্তেজ, অথচ সেই নিস্তেজতায় এক ভয়ানক উন্মত্ততা লুকানো। যেন সামনে থাকা মানুষটা তার কাছে কোনো অস্তিত্বই নয়।শুধু একটা শাস্তিযোগ্য উপাদান।
রাতের বাতাস থেমে গিয়েছে। ব্যালকনির চারপাশে এক নিঃসাড়, ঠান্ডা নীরবতা। আর সেই নিঃশব্দতার মধ্যেই আনায়া বুঝতে পারল, আজ হয়তো খারাপ কিছু একটা হতে চলেছে। কেননা এমন পরিস্থিতিতে তার নিজের রাগ একটুও কমেনি। বরং উল্টো বেড়ে চলেছে।
এর পরবর্তী মূহূর্ত যেম আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করল।একটা ছোট্ট ভুল ব্যালান্স এবং সেকেন্ডের ভগ্নাংশে ঘটল বিপর্যয়।

জান বাঁচাতে কেনীথের হাত থেকে ছাড়া পেতে আনায়া যখন তার উন্মুক্ত অন্য হাতের সাহায্যে জোর প্রয়োগ করেও বৃথা। এই সময় দুজনের অদ্ভুত সংঘর্ষের মাঝে ,আকস্মিক আনায়ার শরীর রেলিংয়ের উপর দিয়ে পুরোপুরি উল্টে যায়।নিচে এক বিশাল অন্ধকার।তার মাথার চুল বাতাসে উড়ছে, শরীর ভারহীন হয়ে শূন্যে পতন হতে শুরু করেছে। আনায়ার এক মূহুর্তের জন্য মনে হল,আজ যদি কোনোমতে সে ম”রে যায় তবে হয়তো সবচেয়ে বেশি খুশি সে নিজেই হবে। তবে তার এই ক্ষনিকের ইচ্ছে পূরণেও বাঁধা সাধল কেনীথ। ঠিক মৃত্যুর শেষ প্রান্তে একটা শীতল নিঃশ্বাসের মতো নিখুঁত ক্ষিপ্রতায়, কেনীথের হাত এসে ধরে ফেলল আনায়ার কবজি। কেনীথ যেন নিজের রাগের আগুনে নিজেই পুড়ছিল তখন।
আনায়া এখনো শূন্যে ঝুলে রয়েছে। কেনীথ তার কবজি ছেড়ে দিলেই সে সম্পূর্ণ নিচে। অন্য হাতটাও অবশ্য এখন বাতাসে ঝুলছে। যদিও তারা দোলতায় রয়েছে,তবে তাদের এই ক্যাসেলের প্রতিটা ফ্লোরের উচ্চতা এতোই বেশি যে, এই দুই তলাও ছয়তলা সমান মনে হবে।

এরই মাঝে আকস্মিক নিজের ভর ছেড়ে দিলে, কেেনীথের হাতের বাধন খানিটা নড়বড়ে হয়ে ওঠে। সেই সাথে কেনীথের রাগও খানিকটা কমে গিয়ে সে সিরিয়াস হয়ে ওঠে। আর ঠিক তখনই,কেনীথ আর এক মুহূর্ত দেরি না করে, সেই বলিষ্ঠ হাতের সাহায্যে,খানিকটা ঝাঁকুনি দিয়ে তাকে টেনে তোলে।অতঃপর একপ্রকার ছুড়ে দেয়ার মতো করে ফেলে দেয় ব্যালকনির মেঝেতে।
আনায়া সম্পূর্ণ মেঝেতে আছড়ে পড়ে। চুল তার এলোমেলো, চোখ মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। তবুও ফর্সা চেহেরায় ফেসে ওঠা রাগের লালিমা কাটেনি। শ্বাস চলছে, তবে বি”ক্ষিপ্তভাবে। কিন্তু চোখে তার উত্তপ্ত আগুনের ন্যায় ক্ষো”ভ স্পষ্ট।
এদিকে কেনীথ দাঁড়িয়ে থাকে নিঃশব্দে। তার চোখে তখনও জ্বলছে আগুন। সেই সাথে নেই বিন্দুমাত্র অনুশোচনা। শত চেষ্টা করেও কোনোমতেই যেন রাগই কমছে না।

আনায়া ততক্ষণে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ভাবভঙ্গিতে মনে হয়, তার দেহের প্রতিটি কোষে যেন আগুন জ্বলে উঠেছে। রক্তে সিক্ত মুখে লালিমা ছড়িয়ে, চোখে ক্ষোভের জ্বালা স্পষ্ট। এদিকে কেনীথ যখন খানিকটা অমনোযোগী হয়ে নিজের রাগ কমানোর খেয়ালে ডুবে গিয়েছে, ঠিক সেই মূহুর্তেই আনায়া কেনীথ গাল বরাবর নিজের সর্বোচ্চ শক্তি প্রযোগ করে চ”ড় লাগায়। আর চ”ড়ের সেই শব্দে যেন চারিদিকে নীরবতা চূর্ণ হয়ে যায়।
কেনীথ কিছু বলার আগেই, আনায়া সম্পূর্ণভাবে আরো বিকৃত হয়ে উঠল। পাগলির ন্যায় রাগ ও ক্ষোভের আগুনে দহন হয়ে, সে কেনীথের গলা, বাহু আর খামচে ধরে, ইচ্ছে মতো কি’ল, ঘু’ষি,আঘাত দিতে শুরু করল। সম্পূর্ণ বিকৃত মস্তিষ্কের অনিয়ন্ত্রিতহীন মানবের ন্যায় রাগের বশে অদ্ভুত সব আচরণ করতে শুরু করে। হাত কিড়মিড় করে কখনো কেনীথকে মারতে চাইছে তো কখনো নিজেকেই আঘাত করতে চাইছে। সেই সাথে আনায়ার প্রতিনিয়ত ফেলা অস্থির নিশ্বাস খানিকটা লোমহর্ষক আবহ তৈরি করল। কেনীথের উপর আনায়ার প্রতিটি আঘাত যেন তার অন্তরের গহীনে সঞ্চিত যন্ত্রণাকে প্রকাশ করে চলেছে।একদিকে ছিল নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাওয়া, অপরদিকে ছিল সেই ভেঙে পড়া মানবিক অনুভূতির নিদর্শন।

আর এই মুহূর্তে, কেনীথ হঠাৎ বুঝতে পারল—আনায়ার মোটেও স্বাভাবিক নেই। এমন অস্থির, ক্ষি”প্ত সত্তার আনায়াকে সে কখনোই দেখেনি।আনায়া যেন এক নিঃস্বার্থ ক্ষিপ্ত রাগে পূর্ণ এক অচেতন প্রাণবিকাশে পরিণত হয়েছে। তার রাগে, অশান্তিতে যেন তার নিজের অস্তিত্ব ধোঁয়াশার মতো মিলিয়ে যাচ্ছে। যা বুঝতেই, কেনীথ তাড়াহুড়া করে আচমকা আনায়াকে জড়িয়ে ধরল। শুরুতে কোনোমতেই আনায়ার হাত ছোটাছুটির জন্য তাকে সামলে নিতে পারল না। একের পর এক আনায়ার আঁচড়,আঘাতে কেনীথ ব্যথিত দেহটা আরেকটু বিষিয়ে উঠল। অবশ্য তার ক্ষতগুলো যে এখনোও সারেনি। তবে কেনীথ সেসব পাত্তা না দিয়ে অনেকটা শক্ত হাতে আনায়াকে সম্পূর্ণভাবে নিজের বাঁধনে আঁটকে ফেলল। সেই জড়িয়ে ধরার মধ্যে ছিল এক নিপুণ কৌশল, যেখানে কেনীথ জানত—এই মুহূর্তে শব্দের চেয়ে শরীরের ভাষা বেশি কিছু বলতে পারে। আশেপাশের বাতাস যেন তার ক্রোধের সঙ্গে মিশে এক অদ্ভুত সুরে ধ্বনিত হতে লাগল।

এই লড়াইয়ে, একদিকে আনায়ার বিদীর্ণ রাগ আর অন্যদিকে কেনীথের ঠাণ্ডা, সতর্ক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায়, মানবিকতা আর ক্ষোভের মিলিত প্রক্ষিপ্ত চিত্র ফুটে উঠল। এক ক্ষণ যেন সময় থমকে গিয়েছে। যেখানে উভয়েরই হৃদয়ে এক ভিন্ন ধরনের ব্যথা ও পরাজয়ের ছাপ রয়েছে।
কেনীথের একহাত আনায়ার পিঠের উপর, অন্যহাত মাথার পেছনের এলোমেলো চুলের মাঝে। কেনীথ শক্ত হাতে আনায়ার মাথা নিজের বুকের মাঝে আঁকড়ে নিয়েছে। বলতে গেলে, সম্পূর্ণ আনায়াকেই যেন নিজের মাঝে আঁকড়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে তার।আর প্রতিনিয়ত অদ্ভুত শীত কন্ঠে চুলে হাতে বুলিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি বলতে থাকল,

—“প্লিজ, শান্ত হ! প্লিজ! পাগলামি করিস না,তারা! এভাবে নিজেকে কষ্ট দিস না।”
তবে আনায়ার রাগ এক নিমিষেই কমে না বরং, কেনীথের বাঁধন থেকে শত মোচড়া মুচড়ি করে বেরোতে না পেরে, একটা সময় ধীরে ধীরে শান্ত হতে শুরু করে।কখনো অদ্ভুত স্বরে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে, আবার কখনো প্রচন্ড বিদ্বেষ নিয়ে কেনীথকে আঘাত করার চেষ্টা করা করে। আনায়া যখন প্রায় অনেকটাই শান্ত হয়ে গিয়েছে তখন কেনীথ পুনরায় ব্যাথিত স্বরে বলে উঠল,
“সরি! সরি! আমার বোঝা উচিত ছিলো…কোথায় ব্যাথা পেয়েছিস?…এমন পাগলামি কেনো করিস বলতো!”
আনায়া একদম নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে। কান্না আর রাগ মিশ্রিত স্বরে, কেনীথের বুকে মুখ গুঁজে থাকা অবস্থাতেই অস্ফুটস্বরে বলতে লাগল,
“কেনো করেন এসব? আপনি যে খারাপ, তা বারবার কেনো ভুলে যান? এসব ভালোমানুষি দেখিয়ে কি প্রমাণ করতে চান? এসব করলে আপনি ভালো হয়ে যাবেন?

শুনুন! আমি আপনাকে ঘৃণা করি। প্রচন্ড ঘৃণা করি। ম”রে যাবো, কিন্তু কখনোই ভালোবাসবো না আপনাকে! কখনো না, কোনোদিনও না। দেখবেন, পরের জন্মেও আমি আপনাকে ঘৃণা করবো। প্রচন্ড ঘৃণা। আপনার প্রতি জমা আমার বিদ্বেষ কোনো কালেই ফুরাবে না।”
কেনীথ দম আটকে একনাগাড়ে বলা আনায়ার কথাগুলো শুধু শুনে গেল। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর পুনোরায় বলে উঠল,
“যদি পূর্বজন্ম বলতে সত্যিই কিছু হয়, তবে আমি তখনও শুধুমাত্র একজনকেই ভালোবাসতে চাই। আর সে হলো একমাত্র তুই।”

আনায়া আকস্মিক মাথা উঁচিয়ে কেনীথের দিকে তাকায়। চোখে তার অদ্ভুত চাহনি। খানিকটা রাগ আর খানিকটা বিস্ময়। কেনীথ ওর চাহনির দিকে তাকিয়ে খানিকা মুচকি হাসল।অতঃপর চোখ ফিরিয়ে দূর অন্ধকার আকাশের মেঘে ঢাকা চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল,

—“মেয়েদের প্রতি আমার কখনোই বিশেষ কোনো ইন্টারেস্ট ছিল না। তবে শুধু এটুকু জানতাম, আমার একজন রয়েছে। যাকে আমার মা আমার জন্য রেখে গিয়েছে। কিন্তু তার প্রতি আমার ভালোবাসা জন্মানোর পূর্বেই, বিদ্বেষ জন্মে গিয়ছিল। কিন্তু দিনশেষে আমি তাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসতেও পারিনি। এটাকে ভালোবাসা বলে কিনা জানিনা। কিন্তু যদি হয়, তবে তাই!”
—“যদি আমাকে এতোই ভালোবাসতি, তবে শুরুতে আসলি না কেনো? বল আমাকে? কেনো সবকিছু ধ্বং”স করার জন্যই তোকে আসতে হলো?”

কেনীথ আনায়ার ক্ষিপ্ত কন্ঠ আর চাহনির দিকে অবাক চোখে তাকায়। আনায়ার তুইতোকারিতে কেনীথের কোনো হেলদোল নেয়। বরং সে অবাক হচ্ছে এই ভেবে, আনায়ার এহেন কথার পেছনে লুকিয়ে থাকা অনুভূতিগুলো সব ভিন্ন। এই কথাগুলোতেও যেন সে তার উপর অধিকার ফলাচ্ছে। সত্যিকারের অধিকার! যা আগে কখনো করেনি। বরং সেসব কথায় তো শুধু ছিলো তাচ্ছিল্যের আভাস।
কেনীথ খানিকটা সময় চুপ থেকে, ভেবে নিয়ে কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই, আনায়া এবার হাত দুটো কোনো মতে ছাড়িয়ে নিয়ে কেনীথের বুকের টিশার্ট খামচে ধরে বলে উঠল,

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩৮

“তুই যদি আমায় সত্যিই ভালোবাসতি তবে কখনো আমার জীবন ধ্বং”স করার জন্য আসতি না। যখনই দেখলি, আমার জীবনটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। তারেক শিকদারের মেয়েরা সুখে থাকতে শুরু করছে। তখন আর তোর সেসব সহ্য হলো না। আর ওমনি সবার জীবনটা তছনছ করতে চলে এলি। অথচ এখন বলছি, আমাকে ভালোবাসিস। কেনো মিথ্যে বলছিস? আর কত কষ্ট দিবি বল? আর কত?”

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩৮ (৩)