একজোড়া আগুন পাখি শেষ পর্ব
রনীতা তুশ্মি
এই গল্পের সূচনা হয় বহু বছর পূর্বে। লুসিয়ার প্রথম কিংবা প্রাক্তন স্বামী — সের্গেই পেত্রিন হান্স। যার নামের সংক্ষিপ্ততেই মূলত এস.পি.হান্স নামক ভয়ং”কর এক কোম্পানির উৎপত্তি হয়েছিল৷ শুরুটা ভালোর উদ্দেশ্যেই গড়ে উঠলেও, কালের ক্রমান্বয়ে তা ধীরে ধীরে ভয়ান’ক অধিপত্যে রূপান্তরিত হয়। যার শুরুটা করে লুসিয়াস ছেলে নিকোলাই হান্স। আর শেষটা এখন হান্স কোম্পানির বর্তমান ও একমাত্র মালিক এস.পি.হান্স কিংবা সের্গেই পাভেল হান্সের কাছে।
ব্যাপারটা বিস্ময়ের হতে পারে। কিন্তু সত্য তো এটাই যে, সারাজীবন কেনীথের ছোট ভাই সরূপ পাভেলই মূলত—কেনীথের নানী লুসিয়ার বড় ছেলে নিকোলাই হান্সের একমাত্র ছেলে।
তখন পেত্রিন হান্স মা’রা গিয়েছে। ছেলে নিকোলাই নিজের মতো করে জীবন গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করছে। তবুও যেন সে তীব্র ছন্নছাড়া অগোছালো জীবনে জর্জরিত। যে ছেলের মা থেকেও নেই, সে আর কি-ই বা নিজেকে গুছিয়ে নেবে। এরইমাঝে তার জীবনেও সঙ্গী হয়ে এক সাধারণ ঘরের সুন্দরী রমণী। অল্পদিনের পরিচয় ও ভালোবাসা তাদের জীবনের গতিবিধিই যেন একদম বদলে যায়। খুব বেশি সময় নেয় না নিকোলাই।নিজেকে গুছিয়ে নিতে, সেই সুন্দরী নারীকেই বিয়ে করে এক সুন্দর জীবন গড়ার চেষ্টা করে। একবছর হতে না হতেই, তাদের জীবন আলো করে এক ফুটফুটে ছেলে সন্তানের আগমন হয়। বাচ্চা ছেলেটির কোঁকড়ানো চুলগুলো ছিল নিকোলাইের বাবা পেত্রিনের মতো। অবশ্য সে তার নিজের ছেলের মাঝে, সম্পূর্ণ ভাবে তার বাবাকেই দেখতে পেতো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নিকোলাই বরাবরই তার বাবাকে প্রচন্ড ভালোবেসে এসেছে। আর সে কারনেই হয়তো বাবার নামের সাথে নাম মিলিয়ে, একমাত্র ছেলের নাম রাখে এস.পি.হান্স (S.P. Hans) কিংবা ❝সের্গেই পাভেল হান্স❞।
তবে তার জীবনটাও খুব বেশি সুখকর হয়না। অল্পদিনের মাঝেই এক কঠিন অসুখে সে তার স্ত্রীকে হারিয়ে ফেলে। এদিকে ছেলেও তার একদম ছোট। অথচ সে তখন মানসিক ভাবে আরো বিধ”স্ত। চারপাশের কোনো কিছুই যেন মেনে নিতে পারছে না।
পাভেলের তখন সবেমাত্র বুঝ হতে শুরু করেছে। হাসিখুশি থাকা বাচ্চাটার আচমকা মা ম’রার শোক যতটা না গভীর ছিল, তার চেয়েও বেশি কঠিন ছিল নিজের মানসিক ভাবে অসুস্থ ভাবার কাছে সেই অল্পবয়সেই নানান টর্চারের সম্মুখীন হওয়া। শুরুতে পাভেল প্রচন্ড কান্নাকাটি করতো,নিজের বাবার অদ্ভুত বিহেভিয়ারকেই ভয় পেতে শুরু করে। তার বাবার উল্টোপাল্টা আদেশক্রম কিংবা অত্যাচার সবকিছুই অল্প বয়স হতে সহ্য করতে থাকে। তবে সে এটাও বুঝতে পারে যে, তার বাবা তাকেই হয়তো নিজের এক্সপেরিমেন্টের বিষয়বস্তু ভাবছে। এবং খুব শীঘ্রই তাকে শেষ করেও ফেলবে। কিন্তু তার সেই অল্প বয়সে করার মতো কিছুই ছিলনা। তার আত্নীয় স্বজন বলতে পৃথিবীতে রয়েছে কিনা তাও তার অজানা।
এভাবে আরো কয়েকটা বছর পেরিয়ে যায়। পাভেলের যখন প্রায় ছয়-সাত বছর — নিজের বাবার সকল ভয়ানক পাগলামির সাথে সে অভ্যস্ত…তখন প্রথমবারের মতো লুসিয়ার সাথে তার দেখা হয়। যদিও তখন সে জানত না,কে এই নারী। তবে তার বাবার কাছ হতে একপ্রকার জোর করেই তাকে সে নারীটি নিজের সাথে করে রাশিয়ায় নিয়ে আসে। অথচ তার বলা কিংবা বোঝার কিছুই নেই। একদিকে নিজের বাবার অত্যচার আর পাগলামির কার্যক্রম হতে মুক্তি পেয়ে যেমন আনন্দ হচ্ছিল, তেমনি লুসিয়া ও তার জগতের প্রতি বেড়ে চলেছিল তার নানান আগ্রহ।
আর শুরুতেই তাকে তার বড় ভাই হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় কেনীথের সাথে। তাকে বলা হয়, শুধুমাত্র কেনীথের জন্যই তাকে সেই জার্মান হতে এই রাশিয়ায় নিয়ে আসা হয়েছে। যথারীতি তাকে যা যা বলা হয়, সে তা-ই বিশ্বাস করে। কেনীথকে শুরুতে কিছুটা অদ্ভুত লাগলেও, একটা সময় পাভেল তার জন্য পাগল হয়ে যায়। যত যাই হোক না কেনো, সে ভুলেও কেনীথের সঙ্গ ছাড়ে না। ওদিকে রোজ নামের একটা বোন পেয়ে সে-ও প্রচন্ড খুশি।
তবে আরো কয়েকটা বছর ঘুরতে না ঘুরতেই, আবারও সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়৷ বহুবছর পর নিকোলাই একদিন তার সাথে দেখা করতে আসে। শুরুতে পাভেল তার বাবার সাথে দেখা করতে রাজি না হলেও,শেষমেষ সাক্ষাৎ করতে গিয়ে যখন বাবার আবেগঘন রূপ দেখে—তখন নিমিষেই যেন সে সবকিছু ভুলে যায়। আর এই ফাঁকেই শেষবারের মতো নিকোলাই কিছু বিষবাষ্পে ন্যায় কথাকে তার মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেয়। প্রথম বারের মতো পাভেল তার নিজস্ব অস্তিত্বকে খুঁজতে শুরু করে।
তার যেন বিশ্বাসই হয় না, এই লুসিয়া তার নিজের দাদি। নিজের সম্পূর্ণ পরিচয়টাই যেন তার কাছে অবিশ্বাস্য লাগতে শুরু করে। একইসাথে মনের মধ্যে তখন হতে গড়তে শুরু করে নানান হিসেব-নিকেশ। এতোদিন সবাইকে ভালো লাগলেও তখন তার সবার প্রতিই এক সুক্ষ্ম ক্ষোভ জমতে শুরু করে।
ওদিকে কেনীথ তখন নিজেই মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত। নিজ চোখে বাবা মায়ের নৃশংস মৃত্যুতে তার সবকিছুই এলেমেলো। আচরণে অদ্ভুত গাম্ভীর্য,রাগ, ক্ষোভের ছাপ। যথারীতি কাউকে মন হতে পছন্দ থাকলেও,তার বহিঃপ্রকাশ করতে সে নারাজ। যেমনটা হয় পাভেলের ক্ষেত্রে। দুজনেই তখন উঠতি বয়সের ছেলেপেলে। দুজনেই নিজেদের নানান চিন্তাভাবনায় মগ্ন। কেনীথ তখন অল্পতেই রেগে যায়। পাভেলকে নিজের ছোট ভাই হিসেবে মানলেও, ব্যবহারের রুক্ষতায় বরাবরই পাভেল প্রচন্ড বিরক্ত। একইসাথে তার চিন্তা ভাবনাও পরিবর্তন হতে থাকে। নিজেই নিজের হিসেব কষতে শুরু করে।
লুসিয়া তার দাদি হয়। লুসিয়ার সবচেয়ে বড় ছেলের একমাত্র ছেলে সে। ওদিকে কেনীথ তার মেয়ের ঘরে ছেলে। সম্পর্কে কেনীথের নানী। অথচ লুসিয়া সহ এখানের সবাই কেনীথকে বেশি আদর করে। সবাই সবসময় তার দেখভাল করে। যেন কোনো রাজ্যের মহারাজা। অথচ তার সাথে সকলের ব্যবহার এক দাসের মতো। লুসিয়া তার নিজের দাদি হবার পরও তাকে কিভাবে অন্য নাতীর জন্য দাস বানিয়ে নিয়ে আসে?
একে তে বাড়ন্ত বয়স, ওদিকে আবার বিকৃত মস্তিষ্কের বাবার নানান কুপরামর্শ। লুসিয়ার নিষেধ থাকা স্বত্বেও পাভেল তার বাবার সাথে লুকিয়ে দেখা সাক্ষাৎ করত। কারণ সে লুসিয়া তাকে রাশিয়াতে নিয়েই এসেছিল, তার বিকৃত মস্তিষ্কের বাবার হাত থেকে বাঁচাতে। সে-ও তাকে নিজের নাতী কেনীথের মতোই ভালোবাসতো, কিন্তু আর্তেমের জন্য কোথাও না কোথাও গিয়ে এই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশটা তেমন হতো। কেননা আর্তেমকে লুসিয়া, পাভেলের পরিচয় সম্পর্কে কিছুই জানায়নি। এবং নিকোলাইয়ের যে ঘরে ছেলে সন্তান হিসেবে পাভেল এসেছে, তাও সে জেনেছি পাভেলের জন্মের কয়েকবছর পর। কিন্তু তার এতো কিছুর পরও, সে কারোরই মন রাখতে পারেনি।
যে বাবা তার কাছে ছিল সবচেয়ে ঘৃণিত, তখন তার কাছে সে-ই প্রিয় হতে শুরু করে। একইসাথে তার সুস্থ মস্তিষ্কও তখন ধীরে ধীরে বিকৃত হতে শুরু করে। তবে তা ধীরে ধীরে,এক ঠান্ডা মাথার কৌশলী বিকৃত মস্তিষ্ক হিসেবে।
এভাবেই এক বিশ্বাসঘাতকের জীবন বেড়ে চলে।সবার মাঝে আজীবন স্বাভাবিক ভালোমানুষির বেশে সেজে থাকা পাভেল, আদতে কত বড় কলাকৌশলের পরিকল্পনা সাজাচ্ছিল, তা কেউই কখনো বুঝতে।
বছরের পর বছর যায়, কেনীথ-পাভেল একই সাথে বড় হতে শুরু করে। কেনীথের দুনিয়া যখন নানান পাপ কর্মের মাঝে আদ্যেপান্তে মিশে গিয়েছে, তখন সেসবের চেয়ে কোনো অংশে পাভেলের পাপের ভাগটাও কম নয়। বরং তা আর সবার চেয়ে বহু গুণে বেশি৷
সে যেমন একইসাথে কেনীথের হয়ে কাজ করত। তেমনি নিজ স্বার্থে তার বাপ-দাদার কোম্পানি তথা এস.পি.হান্স-এ নিজের বিকৃত মস্তিষ্কসম্পন্ন বাবার পরিকল্পনা অনুযায়ী সে কাজ করতে শুরু করে। দিনে দিনে তার পরিকল্পনা হয়ে ওঠে, তার বিকৃত মস্তিষ্কের বাবার চেয়েও ভয়নাক।
ছোট বেলায় মা-হারা ছেলে তার, নিজের বাবার এক্সপেরিমেন্ট উপকরণ হিসেবে যা যা টর্চার সহ্য করেছে,তাতে সে বাচ্চা প্রতি এমনিতেই এক সুক্ষ্ম ক্ষোভকে নিজ অন্তরালে পুষতে শুরু করেছে। অতঃপর বাবার মতো, তারও পরিকল্পনা মোতাবেক তাদের কোম্পানি চালানোর মূল উপকরণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় নবজাতক বাচ্চাদের।
তাদের পরিকল্পনা ছিল সাজানো গোছানো। পাভেল তার বাবার সাথে মিলেই সবসময় কোম্পানি বিষয়ক নানান আলোচনা করে ডিসিশন নিতো। তবে কিছু হুটহাট সিদ্ধান্ত গুলো কখনো কখনো অপরিপক্ক হতো। যার ফলস্বরূপ নানান সময়ে অনেক মানুষের জীবনও পর্যন্ত দিতে হয়েছে।
এই যেমন,পাভেলের একদম শুরু থেকেই নজর পড়েছিল আর্তেমের এতো বড় সাম্রাজ্যের উপর। বিশেষ করে যখন, আর্তেম অসুস্থতায় মারা যায় আর লুসিয়া সবকিছুর দেখভাল করতে শুরু করে। তবে এই আর্তেমের মৃত্যুর পেছনে আরো এক ঘটনা রয়েছে। সবার জানামতে এটি শুধু বার্ধক্যজনিত রোগের কারণে মৃত্যু হলেও,তা পুরোপুরি সত্য নয়। আর্তেমের অসুস্থতার খবর শুনে, নিকোলাই নানান বিষক্রিয়া জাতীত মেডিসিন—যা সহজেই প্রযুক্তি কিংবা উপসর্গের মাধ্যমে নির্নয়যোগ্য নয়—তা পাভেলের মাধ্যমে কৌশলে আর্তেমকে দেওয়া হতো। যার ফলে সে সময়ের তুলনায়, খানিকটা দ্রুতই পৃথিবীর মোহ ত্যাগ করেন।
আর্তেমের প্রতি এক সুক্ষ্ম ক্ষোভ হতেই মূলত নিকোলাই এর এই পদক্ষেপ। পাশাপাশি আর্মেতের কাছ থেকে সবসময় এক দাসের মতো সম্মোধন পেয়ে, পাভেলও প্রচন্ড অপছন্দ করত আর্তেমকে। যে কারণে প্রথম পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা তাদের পথের কাটাকে সরিয়ে দেয়।
এছাড়া তারা ভেবেছিল, লুসিয়া এসবের অংশীদার হিসেবে হয়তো তার ভাগের পুরো অংশটাই নিকোলাই কিংবা পাভেল পাবে। পাভেলের অল্প বয়সী মনের মাঝে এমন আশাকে সর্বপ্রথম তার বাবাই জাগ্রত করে। দুজনে মিলে নানান সব স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।
কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে যখন পাভেল আর্তেমের সকল প্রোপার্টির ডকুমেন্টস নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করে, তখন সে জানতে পারে আর্তেম তার সকল প্রোপার্টি-পাওয়ার কেনীথকে দিয়ে গিয়েছে— একইসাথে এক বিশেষ পদ্ধতিতে। যার ফলে কেনীথকে মে’রে কিংবা জোর জবরদস্তি করেও এই সম্পত্তি, ক্ষমতা তারা সেই মূহুর্তে পাবে না।
এর পরেই শুরু হয়, বাবা-ছেলের ধ্বং”সাত্মক খেলা। কোম্পানি হোক কিংবা প্রোপার্টি, সবকিছুই তারা নিজেদের করে আত্মসাৎ করতে চেয়েছে৷ আবারও তারা নতুন পরিকল্পনা সাজায়৷ কেনীথের বন্ধু কিংবা ভাই রূপে সে সর্বদা তার পাশে থাকে—তেমনি পরিকল্পনা মোতাবেক তার বাবা জার্মানিতে থেকে কোম্পানির শাখা প্রশাখাকে বিস্তৃত করার কাজে লেগে থাকে৷ অবশ্য পাভেল দূরে দূরে থেকেও সবসময় দু-দিকটাই সামলে নিতো।
এদিকে আর্তেম মৃত্যুর পূর্বেই হয়তো বিশেষ কিছু টের পেয়েছিল। লুসিয়ার ব্যক্তিগত পুরোনো ঘটনাগুলো সবসময় গোপন করার জন্য, সে তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারত না৷ যথারীতি ছেলের ঘরে এক মেয়ে সন্তান—রোজ,আর মেয়ের ঘরে একমাত্র ছেলে কেনীথ ব্যতীত সে আর কাউকেই নিজের উত্তরাধিকার হিসেবে পায়নি। আর এতে সবচেয়ে বেশি যোগ্য মনে হয়েছে কেনীথকে।
তাই সে তার চিন্তাভাবনা অনুযায়ী তার পুরো প্রোপার্টিস,অ্যাসেটস, পাওয়ার, এভ্রিথিং কেনীথের নামে করে দেয়।এবং সেটা পস্টহিউমাস ট্রান্সফার অব ওউনারশিপ এগ্রিমেন্টে।যার ফলে কেনীথ তৎক্ষনাৎ সবকিছুর মালিক হতে পারেনা। কেননা তিনি তার এগ্রিমেন্টে নিদিষ্ট করে সময়টাও উল্লেখ করে গিয়েছেন। আর্তেম দিমিত্রির সত্তর বছর কিংবা কেনীথের এই জন্মদিনেই মূলত সে সকল প্রোপার্টির মালিকানাধীন হবে। কিন্তু তার পূর্বে যদি কেনীথের কোনো ক্ষতি হয় কিংবা মারা যায়। সেক্ষেত্রে এ সকল সম্পত্তি কেউই কখনোই নিজের করে নিতে পারবে না এবং আর্তেমের সাম্রাজ্য পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে।
কিন্তু এসব নিজের নামে করার একটি মাত্র উপায় হলো, আজকের জন্মদিনে কেনীথ সবকিছুর প্রকৃত মালিকানার অধিকার পাওয়ার পর—যদি সে কাউকে তার নিজের সবকিছু অন্য কারো নামে স্বইচ্ছায় লিখে দেয়, তবেই তা কেনীথ ব্যতীত অন্য কেউ ভোগ করতে পারবে।
আর এই সুযোগটার জন্যই এত বছর ধরে, ঠান্ডা মাথায় অপেক্ষা করছিল পাভেল হান্স এবং তার বাবা নিকোলাই হান্স।
আর আর্তেমও জানতো যে, লুসিয়ার ছেলে নিকোলাইের কোনো ছেলে সন্তান রয়েছে। আর তার বিশেষ খেদমত করছে লুসিয়া নিজে। অথচ সেই ছেলেই যে, তার নাতী কেনীথের ছোট ভাই রূপে থাকা পাভেল—সে তা লুসিয়ার বুদ্ধিমত্তার কারণে একবারও বুঝতে পারেনি।
আর লুসিয়ার চিন্তাভাবনা ছিল বরাবরই স্বাভাবিক। সে দুজন নাতীকেই সমান ভালোবাসতো বিধায়,দুজনকেই নিজের কাছে রাখত সর্বদা। অথচ সে-ও শুরুতে বুঝতে পারেনি, জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা সে পাভেলকে তাদের কাছে এনেই করে ফেলেছে। বিশেষ করে যে কেনীথের জন্য পাভেলকে ছোট ভাই রূপে এনেছিল, সেই পাভেলই কেনীথকে শেষ করার জন্য,আপ্রাণ চেষ্টায় লেগে থাকে৷
পাভেল ও তার বাবার পরিকল্পনা মোতাবেক, সবকিছু ভালই চলছিল। তবে পাভেল নিতান্তই ঠান্ডা মস্তিষ্কের ব্যক্তি হলেও, তার বাবা ছিল সর্বদা উগ্র স্বভাবের। যে কারণে সে সবাইকে শেষ করে দিতে পারলেই, ভাবতো তার সকল পরীক্ষা কল্পনা সফল হবে।
এই দ্বিমতের জন্য একটা সময় পর হতে, পাভেল এবং তার বাবার মাঝে এক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। পাভেল চেয়েছিল তার পরিকল্পনার সাহায্যে সবকিছু ধীরে ধীরে নিজের আয়ত্তে আনবে। কিন্তু তার বাবা উগ্র হয়ে উঠেছিল। সে সবকিছু জানার পরেও বারবার চাইছিল, কেনীথকে অতি দ্রুত সরিয়ে দিয়ে যেন, সবকিছু তাদের আয়ত্তে নেওয়া যায়। কিন্তু পাভেল খুব ভালো করে জানত, এমনটা হলে আর্তেমের পাওয়ার প্রপার্টির একাংশ তারা ভোগ করতে পারবেনা। বরং চোখের সামনে সবকিছু ধ্বং”স হতে দেখতে হবে।
যে কারণে বাবা ছেলে দুই দলে বিভক্ত হয়ে যায়৷ নিকোলাই বিভিন্ন সময় নানান ভাবে, কেনীথকে মারার জন্য লোক পাঠাতো, বিভিন্ন ভয়ানক এক্সিডেন্ট ঘটানোর চেষ্টা করত। কিন্তু প্রতিবারই পাভেল আপন ভাইয়ের ন্যায় কেনীথকে নিকোলাইয়ের সকল পরিকল্পনা হতে জানে বাঁচিয়ে। অথচ তার সরলতা অভিব্যক্তি এমনই ছিল যে, না কখনো কেনীথ কিছু তার সম্মন্ধে টের পেয়েছে,আর না টের পেয়েছে বাকিগণ। যারা যারা তাদের দুজনকে চিনতো, সকলেই তাদের দুজনকে আপন ভাই-ই ভাবতো। অথচ সাদাসিধা মুখোশের আড়ালে কত ভয়ংকর পরিকল্পনা সাজিয়ে রেখেছিল পাভেল—তা কেউই কখনো টের পায়নি।
আনায়ার এক্সিডেন্ট এর পর সাত বছর কেনীথের নজর হতে গায়েব থাকার, পরিকল্পনায় সবচেয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে পাভেল। আনায়াকে সরানোর পরিকল্পনা তার বহু আগে থেকেই ছিল। সে সব সময় চাইত, কেনীথ একা থাকুক। সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করুক। তার বিপদে আপদে সে ব্যতীত যেন অন্য কেউ পাশে না থাকে। কিন্তু যখনই জানতে পারল কেনীথ আনায়াকে পেয়েছে এবং নিজের করে চাইছে—তখনই যেন তার মস্তিষ্কের পরিকল্পনার কার্যক্রমে তীব্র বিঘ্ন ঘটে।
যদি কোনো তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন সঙ্গী এসে কেনীথের জীবনকে পুরোপুরি পাল্টে দেয়, কেনীথের জীবন যদি আবারও স্বাভাবিক হয়ে যায়, তখন তো তার কোনো পরিকল্পনাই আর কার্যকর হবে না । এতদিনের অপেক্ষা, এত দিনের প্রচেষ্টা, সবকিছু ভেস্তে যাবে।
যে কারণেই মূলত সে আনায়াকে শুরু হতেই অপছন্দ করতো। কিন্তু আনা সম্পর্কে ভালোমতো খোঁজখবর নেয়ার পর, সে বুঝতে পারে এই মেয়ে তার খুব বেশি একটা ক্ষতি করবে না। তবুও সে যথাসাধ্য সতর্ক থাকে। কেনীথের চিন্তাভাবনাকে আরো বিগড়ে দিয়ে, আনায়াকে আনায়কের সম্পূর্ণ মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে তোলে। যেন কখনোই সে তার পথে, কোনো নতুন কাটা হয়ে না দাঁড়ায়।
কিন্তু একটা না একটা সংশয় তার মনের মধ্যে ছিলই। পাভেল কিংবা তার বাবার পরিকল্পনা কখনো সুস্পষ্ট ছিল না। তাদের বিকৃত মস্তিষ্কের চিন্তাভাবনায় সব সময় এক সংশয় ঘুরপাক খেতো। যে কারণে তারা,চেয়েও কখনো স্থির থাকতে পারতো না।
যথারীতি কেনীথের প্রথম পদক্ষেপ সরূপ,আনায়াকে তার পুরনো বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর—পাভেলও তার পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন আনে। ইনায়াকে যখন কেনীথ একটি সুরক্ষিত আশ্রমে রাখার চিন্তা ভাবনা করে, তখন তারও সুযোগ হাতছাড়া করে না পাভেল।
ইনায়ার সম্পূর্ন দায়িত্ব ছিল পাভেলের উপরে। এমনকি কেনীথের সব কিছুর দায়িত্বই ছিল পাভেলের উপর। যে কারণে সে তার সকল কাজ, খুব ভালো ভাবেই করে ফেলতে পারতো। এখানেও সে তার অপরিপক্ক পরিকল্পনা মোতাবেক, কেনীথের অগোচরে একটি কাজ করে ফেলে।
ইনায়াকে আশ্রম থেকে গায়েব মূলত পাভেলই করেছিল। তার মস্তিষ্কে নিদিষ্ট কোনো পরিকল্পনা ছিল না। আনায়াকে কিছু করার আগে, সে তার পরিবারকে শেষ করতে চেয়েছিল। যেন পরবর্তীতে সব দোষে কেনীথকে দোষী সাবস্ত করে হলেও, আনায়ার নজরে যেন কেনীথ সবসময় খাবারই থাকে। তাদের দু’জনের সম্পর্কের মিল যেন কখনোই না হয়।
এছাড়া ইনায়াকে সে তার নিজস্ব আরেকটি কাজে লাগিয়ে ফেলে। তাদের কোম্পানির বাংলাদেশী শাখায় বিশ্বস্ত ও কার্যকর মানুষের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেভাবে তারা কাউকে কাজে লাগাতে পারছিল না। তখন তারা ইনায়াকেই নিজেদের হাতিয়ার বানায়।
তাকে আশ্রম থেকে সরিয়ে নিজেদের আস্তানায় নেওয়ার পর—তার ওপর শুরু হয় নানান শারীরিক ও মানসিক নি”র্যাতন। অত্যাধিক পরিমানে ড্রাগস দেওয়া কিংবা অমানবিক মা”রধর— কোন কিছুই বাদ থাকেনা।
ইনারার মতো তেজী স্বভাবের মেয়ে, সহজেই যে কারো কাছে হার মানবে না, এটাই স্বাভাবিক। সেও যথারীতি,নিজের সর্বোচ্চ জেদ খাটাতে শুরু করে। তাতে পাভেলসহ সকল কর্মী তার প্রতি প্রচন্ড বিরক্ত হয়। একই সাথে তার ওপর নির্ম”ম, অত্যাচারও বাড়িয়ে দেয়।
ইনায়া ঠিকমতো খাবার খেতে না চাওয়ায়, একটা সময় পর হতে তাকে খাবার দেওয়াও বন্ধ করে দেওয়া হয়। অল্প পরিমাণে খাবারের সাথে, অত্যাধিক পরিমাণে ড্রাগ*স্—তাকে জোর করে দেওয়া হয়। কখনো কখনো বা ইনজেকশন এর মাধ্যমেও, নানান নেশাদ্রব্য তাকে দেওয়া হতো। এভাবে অনেকটা সময় যাওয়ার পর, ইনায়াও ধীরে ধীরে অত্যন্ত মানসিক ভাবে বিকৃত মস্তিষ্কের হতে শুরু করে।
একই সাথে, পাভেল ইনায়াকে তার প্ল্যানের অপশন বি বানানোরও চিন্তাভাবনা করে। যেনো কোনো এক সময় তার প্রয়োজনে, ইনায়া-ই কেনীথের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়। যার ফলে সে ইনায়ার মন-মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব ফেলার জন্য, কেনীথের সম্পর্কে নানান কটুকথা সহ, ইনিয়েবিনিয়ে তার জীবন,পরিবার ধ্বংসের সবকিছুর জন্য কেনীথকে দায়ী করে। আর এদিকে ইনায়া ততদিনে তাদের হাতের পুতুল। তারা যেভাবে চাইছে, ইনায়া সেভাবেই চলছে।
অবশ্য এইসকল ঘটনায় পাভেল বরাবরের মতোই এক ক্লিন ইমেজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে পুরো গেইমটা খেলে গিয়েছে। ইনায়ার সামনেও কখনো স্ব-সম্মুখে সাক্ষাৎ করেনি সে। তার সকল কাজ সে, তার লোকজন দিয়েই সবসময় করিয়েছে।
এদিকে প্রায় আরো কয়েকটা বছর যাবার পর যখন ইনায়া নিজেই এক যান্ত্রিক পুতুলের মতো সবকিছু করতে শুরু করেছে। ততদিনে পাভেলের পরিকল্পনা হতে ইনায়া হয়ে যায় এক ঐচ্ছিক বিষয়বস্তু। তার দিক হতে পাভেলের ধ্যান প্রায় সরে গিয়েছে। সে ব্যস্ত কোম্পানি সামলাতে। একইসাথে আনায়ার মৃত্যুতে বিধ্বস্ত হওয়া কেনীথকে পাশে থেকে তাকেও একপ্রকার নিজের হাতের পুতুল তৈরির প্রচেষ্টায়।
আর এই সময়ের মাঝেই ইনায়া নিজেই এক ঠান্ডা মস্তিষ্কের সাইকোপ্যাথ সরূপ দানবে পরিণত হয়। তার যখন যা ইচ্ছে তাই করতে থাকে। রোহান বয়সে তার খুব বেশি একটা বড় ছিল না। তবে তাদের অল্প দিনের সাক্ষাৎ এ, রোহান আর ইনায়ার মাঝে একটা ভালো বন্ধুত্বও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আর ইনায়া তখন তার বিকৃত মস্তিষ্কের চিন্তাভাবনা অনুযায়ী, রোহানকে নিজের সাথে রাখার সিন্ধান্ত নেয়। তবে তার এই পদক্ষেপেও পাভেলের আদেশ বাঁধা সাধে। পাভেল এবার রোহানকেও নিজের কাজে লাগাতে চায়। কোনো প্রয়োজন ব্যতীতই তাকে ইনায়ার আদেশ ক্রমে, একদিন এক সন্ধ্যায় হঠাৎ তুলে নিয়ে আসা হলেও — পাভেলের নির্দেশে পরবর্তীতে তার উপরও চলে ইনায়ার চেয়েও ভয়ংকর সব নির্মম অত্যাচারের পাশাপাশি কিছু সাইকোলজিক্যাল ও ফিজিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট।
মূল কথা, পাভেল ও তার বাবা তাদের আশেপাশে অহেতুক যাকে পেয়েছে তাকেই নিজেদের খেলার বলি বানিয়েছে। এইসময় অবশ্য ইনায়ার কিছুই করার থাকেনা। সে যেহেতু বাংলাদেশের হান্সদের শাখার প্রধান পরিচালক অলিভারের সাথে কাজ করে,এক প্রয়োজনীয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে—তাই ইনায়া তখনও পাভেলের প্রয়োজনীয় উপকরণ হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু রোহানের সাথে কিছু করতে গেলে—ইনায়া বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে বিধায়…সে তাকেই কিছুদিনের জন্য সম্পূর্ণ সেন্সলেস করে বদ্ধ ঘরে আঁটকে রাখে। কখনো অত্যধিক ড্রাগস্ কিংবা কখনো সেন্সলেস করার ইনজেকশন—প্রযোজন ভেদে যখন যা করা যায়, তাই করা হয়েছে।
এদিকে রোহানের উপর করা নিকোলাই এর সকল এক্সপেরিমেন্টই বৃথা যায়। নানান ইলেকট্রিক শক্, নিত্যনতুন মেডিসিন সহ নানান জিনিসে প্রযোগে সে শেষমেশ এক অকেজো পন্যের ন্যায় তাদের কাছে বিবেচিত হয়। রোহানের মস্তিষ্ক ততদিনে আর সবার মতোই বিকৃত। কিন্তু তাকে এমনি এমনি ফেলে দিলে তো আর হয় না। তাই পাভেল, রোহানকেও কোনো একটা কাজে লাগানোর পায়তারা করে। ফলাফল সরূপ, রোহানকে বানায় নরখাদক।
দিনের পর দিন বদ্ধ ঘরে আঁটকে রাখার পরও তাকে না খেতে দেওয়া সহ, নানান শারিরীক টর্চার করা হতো। একে তো বিকৃত মস্তিষ্ক, তার মাঝে না খেয়ে দেয় ফর্সা সুগঠনের ছেলেটা ততদিনে রোগা-সোগা কঙ্কালসারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তাতেও যেন সেই পিশাচদের মন ভরে না। অত্যধিক মারের ফলে সৃষ্ট ক্ষততে,সময়ের সাথে সাথে ঘা-পুঁচ হয়ে একটা সময় সমস্ত শরীর পঁচে যেতে শুরু করে। একইসাথে বহুদিন অনাহারে থাকার পর তাকে খেতে দেওয়া হতো পরিত্যক্ত, অকা”র্য কিংবা মৃ”ত বাচ্চাদের না”রী ভুঁ”ড়ি কিংবা কচি মাং”সের ছোট্ট ছোট্ট দেহ।
শুরুতে ইনায়ার বিকৃত মস্তিষ্কেও ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগত। সে যেন এসব সহজেই মেনে নিতে পারত না। প্রচন্ড অস্থিরতা কাজ করতো নিজের মাঝে। তবে এটার সলিউশন হিসেবেও অলিভার তার নিজের দায়িত্ব পালন করে। যখনই ইনায়া তার কাজ ব্যতীত, অস্থির কিংবা উগ্র হয়ে উঠতো—তখনই তাকে কঢ়া ডোজের ড্রাগস্ দেওয়া হতো। ফলাফল সরূপ, আবারও ইনায়া তাদের হাতের পুতুল।
তবে ইনায়ার মনে কেনীথকে নিয়ে শুরুতে বিরূপ ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়ার পর যেন, পাভেল এতে নিজেই ফেঁসে যায়। তার বাবা নিকোলাই এর মতো, ইনায়াও সবসময় চাইত কেনীথের ভয়ং”কর মৃত্যু হোক। এদিকে পাভেল একহাতে এতোকিছু সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে, ওদিকে ইনায়া নিজেই উগ্র হয়ে বারবার কেনীথকে মারার জন্য তাদেরই লোকচক্ষুর ফাঁকে নানান পরিকল্পনা চালাচ্ছে। শতবার চেষ্টা করেও যেন, পাভেলের আদেশক্রমে—অলিভার তাকে দমাতে পারছে না।
তবে সবকিছুর শেষেও, বরাবরের মতো পাভেল কেনীথের কাছে একজন ভালোমানুষ হয়েই থেকে যায়। আনায়ার বাবার মৃত্যুর ফুটেজ ইনায়াকে দেওয়া, কিংবা ইনায়াকে আশ্রম থেকে সরানোর পাশাপাশি আনায়াকে রাশিয়ায় পাঠানো—সবকিছুই সে সুকৌশলে ঠান্ডা মাথায় করে ফেলে।
এদিকে আনায়াকে রাশিয়ায় পাঠানোর উদ্দেশ্যটাও ছিল সাধারণ। সেরাতে হসপিটাল হতে আনায়ার পালিয়ে যাওয়াটা ছিল অপ্রত্যাশীত। পাভেলের পরিকল্পনা মোতাবেক, সন্তানহারা মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত আনায়া তখন তার বিষয়বস্তুর বাহিরে। তাকে নিয়ে পাভেলের তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। একইসাথে আনায়ার অসুস্থ হয়ে সন্তান নষ্ট করাতে তার কোনো মাথাব্যথা না থাকলেও,যথারীতি সুযোগ বুঝে আনায়ার অপরিপক্ক সন্তানের দেহাবশেষকে হসপিটাল থেকে গায়েব করে সে সহজেই নিজেদের কোম্পানিতে পাচার করে দেয়। কেননা, বাচ্চাদের প্লাজমা কিংবা যেকোনো অংশই তাদের জন্য প্রয়োজনীয়। যেটার সুযোগও পাভেল হাতছাড়া করেনি।
এছাড়া মূলত এই বিষয়টির পরিপ্রেক্ষিতে, আনায়া জার্মানিতে হান্সদের ল্যাবের স্ক্রিনে নিজের নামের পাশে অস্পষ্ট কিছু তথ্য দেখেছিল৷ কেননা, হান্স কোম্পানির সকল তথ্যই তারা সংরক্ষণ করে রাখত। কিন্তু আনায়া তখন কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি।
তবে এতোকিছুর মাঝেও পাভেল বারংবার একেকটার পর একেকটা ভুল করে গিয়েছে। অবশ্য এতে শেষমেশ তার কোনো ক্ষতি না হলেও, নির্দোষ জীবনগুলোর শেষ হয়েছে ঠিকই । নয়তো কারো সাজানো গোছানো জীবন ধ্বং”স হয়েছে। যথারীতি আনায়াকে দুর্বল ভেবে রাশিয়ায় পাঠানোটাও তার জন্য একটা মস্ত বড় ভুল ছিল। অবশ্য তার করারও কিছু ছিল না, লুসিয়ার কথামতো সে কখনোই আনায়ার কোনো ক্ষতি করতে পারত না। এমনিতেও তার কাছে অপ্রয়োজনীয় ও দুর্বল—তার পথে বাঁধা হবার মতো কোনো সংশয় নেই। একইসাথে কেনীথের স্ত্রী হওয়ার সুবাদে লুসিয়া তার কোনো ক্ষতিও হতে দেবে না। যদি সে এমন কিছু করে, তখন লুসিয়াই আবার তার রাস্তায় বিঘ্নতা ঘটাবে। সবমিলিয়ে পাভেলকে এই বিষয়ে লুসিয়ার অবাধ্য হয়েই, নতুন ঝামেলার সৃষ্টি হবে বিধায়—সে লুসিয়ার কথামতো আনায়াকে রাশিয়ায় পাঠিয়ে দেয়।
এদিকে লুসিয়া যে পাভেলের সম্পর্কে সব কিছু জানতো, এমনটা নয়! পাভেল তার নাতী হওয়ার পাশাপাশি যে, আর্তেমের সম্পত্তির ভাগীদার হতে চায়—এটা সে স্পষ্টভাবেই জেনেছিল। সে রাজিও ছিল, তার নিজের অংশটুকু পাভেলকে দিতে। কিন্তু বিপত্তি তখন বাধে, যখন সে পাভেলের কাছ থেকে এটাও জানতে পারে যে—আর্তেম তার সবকিছুর মালিকানার অধিকার কেনীথকে দিয়ে গিয়েছে। যথারীতি এখানে তার আলাদাভাবে কিছু করার ছিল না। কিন্তু নাতী হিসেবে পাভেলের জোরাজুরিতে সে চেয়েছিল, পাভেল সম্পর্কে কেনীথকে সবকিছু জানিয়ে দিতে। পাভেল কেনীথের এতো দিনের সম্পর্ক। কেনীথ নিশ্চয় তার নিজের প্রোপার্টির একাংশ পাভেলকে দিয়েই দেবে।
নাতীদের নিয়ে লুসিয়ার চিন্তাভাবনা ছিল সরলসোজা। কিন্তু পাভেল যে মূলত কি চাইছে, তা বোঝামাত্রই সে হতবিহ্বল হয়ে যায়। তার এতো চেষ্টার পরও, পাভেল যে তার বাবার মতো হবে—তা সে কল্পনাতেও আশা করেনি। যদিও তিনি তখনো পাভেলদের পুরো পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। কিন্তু এইটুকু বুঝতে পেরেছিল, তার নাতী কেনীথ ও আনায়ার জীবন সন্নিকটে। পাভেল আর তার বাবা যে কোনো সময় যা কিছু করতে পারে। কিন্তু ততদিনে যে সে-ও পাভেলের কাছে কোনো এক বিশেষ কারণে দায়বদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। এতো বড় মাফিয়া হয়েও, তার দূর্বলতা জন্য সে কিছুই করতে পারেনি।
কেনীথকে পুরোপুরি বাঁচাতে গেলে, রোজের জীবন ধ্বংস হবে। আবার রোজের জীবনের জন্য সে,কেনীথকেও অবজ্ঞা করতে পারেনা। সবমিলিয়ে চলছিল এক নিদারুণ দ্বিধাদ্বন্দ্ব। পাভেল যে একা নয়, তার পাশাপাশি আরো এক বিশেষ ব্যক্তি তাদের পুরো জীবন ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তার উর্ধ্বে গিয়ে, সে নিজেও চেয়ে কিছু করতে পারবে না।
এতোকিছুর মাঝে সে শুধু পাভেলের কাছে তার নাতী-নাতনীদের জীবন হাতজোড় করে ভিক্ষা চাওয়া ব্যতীত আর কিছুই করতে পারেনি। সে বিশেষ কারণে লুসিয়া এতোটাই দায়বদ্ধ হয়ে গিয়েছিল যে, সে কোনোভাবেই কেনীথকে পর্যন্ত এইসকল বিষয়ে জেনেও জানাতে পারেনি। হয়তো কেনীথের একটি পদক্ষেপে তারা বেঁচে গেলেও, হয়তো রোজের জীবন সংশয়ে রয়ে যাবে।
এসব ব্যতীতও আরো নানান ঘটনা ঘটেছে। যেমন হুট করে, ইনায়ার পরিকল্পনা সফল হওয়া। কেনীথকে তাদের আস্তানায় নিয়ে গিয়ে মা’রার চেষ্টা। এসবই ছিল পাভেলের জন্য অকল্পনীয়। কেনীথের কিছু হলে, তার কপালে একআনাও জুটবে না। যে কারণে কেনীথকে সে সর্বদা সোনার হরিণ ভেবে, নিজের জানের চেয়ে বেশি দেখভাল করেছে। কিন্তু শেষমেশ যখন ইনায়া কেনীথের সেই হাল করে ছাড়ল—তখন যেন তা-ই পাভেলের জন্য প্রচন্ড ক্রোধের সৃষ্টি করে।
সে নিজের ক্রোধের দরূন ইনায়াকেই সরিয়ে দেওয়ার চিন্তা করে। ফলাফল সরূপ, সবার সামনে সে-রাতে তাদের আস্তানায় দেরিতে পৌছে যখন আনায়াকে দেখতে পেল তখন…ঠিকই তার ভালোমানুষি দেখিয়ে, আনায়ার সাথে মিলে ইনায়া,কেনীথ আর রোহানকে হসপিটালে নেওয়া সহ, তাদের জন্য সকল অস্থিরতা — সবই তার নিত্যদিনের অভিনয়ের অংশ। কেননা পরবর্তীতে সে-ই তার লোকদের হসপিটালে পাঠিয়ে রোহান আর ইনায়াকে বিষ দিয়ে মা*রার চেষ্টা করে। যাতে ইনায়া অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও, একটি নির্দোষ প্রাণ—রোহানের হৃৎস্পন্দন সারাজীবনের জন্য থেমে যায়।
জানের পর জান নেওয়াটা তাদের কাছে কিছুই না। তেমনি রোহানের জীবনটাও ছিল পাভেল কিংবা তাদের লোকজনের কাছে অপ্রয়োজনীয়। উল্টো সে বেঁচে থাকলে, কিংবা কখনো সুস্থ হয়ে উঠলে তাদের পথেই কাটা হবে।আর এভাবনাতেই ইনায়া আর রোহানকে সরিয়ে দেবার পরিকল্পনা করেছিল সে। একইসাথে কেনীথের বিন্দুমাত্র ক্ষতি না করে, তার কেবিনেও নাটকীয় ভাবে ধ্বংসযজ্ঞে চিহ্ন রেখে যায়। যেন এই ঘটনা নিয়ে বিশেষ কারো সন্দেহ না থাকে। আর পাভেল বরাবরের মতো তার ঘটানো সকল ঘটনায় যেভাবে অনুপস্থিত থেকে, পরবর্তীতে নিজেই সাধুবেশে সকলের সামনে হাজির হয়েছে—সেদিনও ঠিক তাই ঘটে।
তবে ইনায়া বেঁচে যাওয়ায় সে তার পরিকল্পনা আবারও পরিবর্তন করে। এবার সে আর ইনায়াকে মা”রার জন্য কোনো অতিরিক্ত সময় নষ্ট করে চায়না। সে চাইলেই ইনায়াকে সরিয়ে দিয়ে তখন নিজের রাস্তা ক্লিয়ার রাখতে পারত। কিন্তু সবমিলিয়ে অনেক কিছু চিন্তাভাবনা বিবেচনার পর সে সিদ্ধান্ত নেয়, ইনায়াকে আপাতত জীবিত রেখেই নিজের রাস্তা সাফ করবে। পরবর্তীতে সুযোগ বুঝে সবার সাথে সাথে ওকেও সরিয়ে দেওয়া যাবে।
আর ঠিক এই ভাবনা থেকেই সে তার পরবর্তী খেলাটা খেলে। ইনায়ার সব দায়িত্বই, আনায়া পাভেলের কাছে দিয়েছিল। কারণ তখন তারা জার্মানিতে এস, পি, হান্সের কোম্পানির অভিজানে…যথারীতি সেই সময়টুকুতে পাভেল তার লোকজন দিয়ে, ইনায়ার যথাসাধ্য ভালো ট্রিটমেন্টের ব্যবস্তা করে।
কিন্তু পরবর্তীতে যখন আনায়া-ইনায়াকে নিয়ে কানাডায় চলে যায়।এবং ইনায়ার আরো ভালোমতো ট্রিটমেন্ট শুরু করে—কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে তার কোনো উন্নতি হয় না। এসবও মূলত পাভেলের সাজানোর পরিকল্পনার খেলা। ইনায়াকে যে ডক্টর ট্রিটমেন্ট করেছিল, সে পাভেলেরই লোক ছিল। যথারীতি ইনায়াকে পুরোপুরি সুস্থ হবার মেডিসিন না দিয়ে, তাকে জ্যন্ত লা-শ বানানোর চিকিৎসা দেওয়া হয় তাকে। এবং পরবর্তীতে যতজন ডক্টর তার ট্রিটমেন্ট করেছে, সকলেই ছিল পাভেলের কেনা লোকজন। ফলাফল সরূপ,জীবনের গল্পের শেষপর্যায়ে এসেও ইনায়া পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেনি।
অবশ্য যে ব্যক্তি নিজের স্বার্থ আত্মসাৎ এর জন্য,নিজের বাবাকেই নিজ হাতে খুন করে — বুলেটের পর বুলেট ছুঁড়ে, বাবার বুককে ঝাঁঝরা করে দেয়। সে ব্যক্তির দ্বারা এতোসব কিছু অসম্ভব মনে হলেও, অসম্ভব নয়।
গল্পের শেষটায় পাভেল নিজ স্বার্থেই, জার্মানির দুর্গে গোলাগুলিতে সুযোগ বুঝে, পেছন থেকে তার বাবাকে গুলি করে। কেননা বিকৃত মস্তিষ্কের বাবার হাত ধরেই তার খেলাটা শুরু হলেও, নানান সময়ে তার মতামতের বিপরীতে গিয়ে নিকোলাই হান্সের সকল পদক্ষেপই ছিল তার কাছে বিরক্তিকর। একটা সময় গিয়ে, বাবা ছেলের মাঝেই সুক্ষ্ম এক দ্বন্দ্ব চলতে শুরু করে। তার নিকোলাই এর কাছে বিশেষ কিছু না হলেও, সে চাচ্ছিল নিকোলাইও তার রাস্তা থেকে সরে যাক। তাহলে পরবর্তীতে পুরো এস.পি.হান্স কোম্পানিতে তারই রাজত্ব চলবে। সে যা চাইবে, করবে— তাই হবে। কিন্তু তার বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো এমনটা হবে না। কারণ এক রাজ্যে কখনো দুই রাজার রাজত্ব চলতে পারেনা৷
যথারীতি এক কাপুরুষের ন্যায় সে পিঠপিছে দাঁড়িয়ে সকল খেলার পাশাপাশি,তার বাবাকেও সে রাতে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়। আর বরাবরের মতো ভালো সেজে যায়,কেনীথ আনায়ার কাছে।
অবশ্য এটাকে পাভেলের সিগনেচার বিশেষত্বই বলা চলে। তার বোকা-সোকা হয়ে চলাফেরা করা কিংবা ঠান্ডা মাথায় শুরু থেকে পুরো গেইম খেলাটা—কোনো বীর পুরুষের পরিচয় বহন করে না৷ বরং সে ইতিহাসের আর পাঁচটা বিশ্বাসঘা”তক কাপুরষের জন্য দৃষ্টান্ত উদাহরণ। বারবারই পেছন হতে আঘাত করে, নিজের পথের কাটা সরিয়ে দেওয়াটা তার ব্যক্তিত্বের অন্যতম বিশেষত্ব। যেমনটা সে বরাবরই করে এসেছে। কখনো বাংলাদেশে তাদের আস্তায়, সুযোগ বুঝে পেছন হতে ইনায়াকে গুলি করা কিংবা অলিভারকে অপ্রোয়জনীয় ভেবে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া। আবার কখনো নিজের বাবাকেই চিরদিনের মতো শেষ করে দেওয়া। সবটাই করেছিল সে, এক কাপুরুষের ন্যায় পিঠপিছ থেকে আঘাত হানবার মতো করে।
আর সর্বশেষে এই বার্থডে পার্টিটা ছিল এক ব্ল্যা”ডি ট্র্যাপ। নিজের এতোদিনের পরিকল্পনার সফল হবার আনন্দ উদযাপনের জন্যই যেন, পাভেল আনায়াকে দিয়ে এই এতোবড় বার্থডে পার্টির আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে যেসকল অতিথিদের আসার কথা ছিল, তারা মূলত কেউই আজ আসেনি। কারণ পাভেল চায়নি এমনটা। সে তার প্ল্যান মতো বেশিরভাগ অতিথিদের নিমন্ত্রিত করেনি কিংবা সবকিছু স্বাভাবিক রাখতে, নিমন্ত্রনের পর পরবর্তীতে সবাইকে জানিয়ে বিষয়টা নিমন্ত্রণটা ক্যান্সেল করে দেয়। এভাবেই পদে পদে সে তার পরিকল্পনার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। যখন যা ঠিক মনে হয়েছে তাই করেছে। আর শেষপর্যন্ত রয়ে গিয়েছে সবার কাছে, এক সাধাসিধা অবলা ছেলে হিসেবে। কিন্তু খেলে গিয়েছে নানান সব ভয়ানক খেলা।
আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, যে কেনীথ আনায়া জানে এস.পি.হান্সকে তারা অনেক বছর আগেই ধ্বংস করে দিয়েছে—তা আজও দিনের পর দিন একইভাবে চলছে।হান্স ইন্ডাস্ট্রির ধ্বংস কখনোই হয়নি। লোকচক্ষুর অগোচরে তা এখন আরো কঠোর নিরাপত্তা, ও নিরাপদ আশ্রয়ে— আগের চেয়ে আরো বেশি ভ”য়ানক সকল কার্যক্রমের মাধমে এগিয়ে চলেছে। যেহেতু সবকিছুর মতো এসবের দায়িত্বও কেনীথ পাভেলকে দিয়েছিল—ফলাফল সরূপ, পাভেল তাকে বরাবরের মতো যা মিথ্যে ডকুমেন্টস ও তথ্য সাজিয়ে বলেছে,কেনীথ তা-ই বিশ্বাস করেছে। দিনশেষে আজ তার মাথা হতে এই ব্যাপারটাই সরিয়ে দিয়েছে পাভেল। এভাবেই দিনের পর দিন পাভেল, পুরো খেলায় নিজের একেকটা দান খুব নিখুঁত ভাবে দিয়েছে। ভুল করলেও,তাতে বেশি পস্তাতে হয়নি। সবকিছু ব্যলেন্স করেই আজ সে সফল।
অথচ এখন পর্যন্ত কেউই জানে না, এই ভয়ংকর খেলার শুরু মাত্র হয়েছে। যেটার শেষ কোথায়, কার হাতে, তা আজ রাতেই নির্ধারিত হবে। কেননা, আজ রাতের বিশেষ অতিথির আগমন তো এখনো ঘটেইনি। যার অপেক্ষা নিশ্চিত পাভেল নিজেই করছে।
—❝কি ব্রো! নাম শুনে অবাক হলে?❞
কেনীথ আনায়ার চোখের মুখে তীব্র বিস্ময়ের ছাপ। কেনীথের ভ্রু জোড়া কুঁচকে যায়। সে বিস্ময়ের চাহনিতে পাভেলের দিকে তাকিয়ে। এরইমাঝে পাভেল বিস্তৃত মুচকি হেসে বলে ওঠে,
❝হুম,ঠিকই শুনেছো। যে এস.পি.হান্সকে তোমরা মৃত হিসেবে জেনেছো, তারই একমাত্র নাতী ওরফে আমিই দ্বিতীয় এস.পি.হান্স। সে সের্গেই পেত্রিন হান্স ছিল,আর আমি সের্গেই পাভেল হান্স।
মূল কথায়, আমি তোমার প্রিয় বাবুশকার প্রথম স্বামীর ঘরের একমাত্র নাতী। সে হিসেবে, তুমি আমি ভাই-ভাই বলা চলে।ঐ দাদি-নানী আরকি।এক হিসেবে সবাইকে বাবুশকাই বলা হয়।❞
কেনীথ আনায়ার বিস্ময়ের মাঝেই পাভেল একেরপর এক সত্যি বলতে শুরু করে। শুরু থেকে শেষ অব্দি তার করা প্রত্যেকটা কুকর্ম সম্পর্কে প্রচন্ড গর্বের সহিত জানায়। আর কেনীথ আনায়া শুধু এক নাগারে তার কর্মের কথা শুনতে থাকে।
❝যাস্ট এই কয়েকটা প্রোপার্টি, পাওয়ারের জন্যই তোর এতোকিছু…?❞
—❝তোমার কাছে সামান্য হতে পারে। আমার কাছে নয়। বহু কষ্টের ফল আমার।❞
কেনীথ রাগ মিশ্রিত কন্ঠে তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলে,
❝বিশ্বাসঘাতকতাকে কষ্টের ফল বলছিস? কাপুরষ, জানোয়ার একটা।”
পাভেল গা দুলিয়ে বিস্তৃত হাসে। একহাতে কোঁকড়ানো চুলগুলো হাতের সাথে নাড়িয়ে এলোমেলো করে দিয়ে বলে,
❝যত যাই বলো না কেনো, আজ আমি খুব খুশি।❞
—❝তুই কি ভেবেছিস, তুই এসব করলেই আমি তোকে সবকিছু দিয়ে দেব? আমি মরে যাব, এই সবকিছু ধ্বং”স হবে। তবুও তো তোকে আমি এসবের একাংশও দেব না। তোর মতো জানো”য়ার সফল হোক তা আমি কখনোই চাই না।❞
কেনীথের তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বরে পাভেল এবার বিস্তৃত হো হো করে হেসে বলে ওঠে,
❝সিরিয়াসলি? তুমি তো দেখছি এখনো কিছুই বোঝোনি। ব্রো! তোমাকে আর কোনো কষ্ট করতে হবে না। সব কষ্ট আমি করে ফেলেছি।❞
কেনীথ সন্দিহান চাহনিতে পাভেলেদে দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ওমনি পাভেল হেসে বলে,
❝আজ সকালে দুষ্টু মিষ্টি কথা বলে পেপারস্ এ সাইন করিয়ে নিলাম না? বিশ্বাস করো, খেলাটা ওখানেই শেষ করে দিয়েছো তুমি। ওটা তোমার এতোসব প্রোপার্টির ডকুমেন্টস ছিল। কোনো আলাদা পার্টি, ইন্ডাস্ট্রিরও নয়।❞
এই বলেই সে, কেনীথের দিকে এগিয়ে আসে। হাত থেকে রডটা ফেলে দিয়ে, কেনীথের এলোমেলো চুলে হাত নাড়িয়ে দিয়ে বলে,
❝বড় ভাই! পৃথিবীর মানুষ, বড়ই নিষ্ঠুর।জীবনে কাউকেই এতোটাও অন্ধবিশ্বাস করা উচিত নয় যে—শেষ বেলায়, সেই তোমার সবকিছু ধ্বংস করে দেয়।❞
কেনীথের মেজাজ আর ঠিক থাকে না। সে আক্রোশে পা দিয়ে পাভেলের উরুর মাঝ বরাবর সজোরে আঘা”ত করে। তৎক্ষনাৎ যেন পাভেলের জান পাখি উড়ে যাবার উপক্রম। সে নিজেকে ব্যাথার চোঁটে সামলাতে না পেরে, পা-জোড়া কুঁচকে তীব্র রাগান্বিত চাহনিতে কেনীথের দিকে তাকায়। কিন্তু তার আগেই কেনীথ তাকে ধরে রাখা গার্ডদের এক ধাক্কায় সরিয়ে, মাটিতে ফেলে দিয়ে পাভেলের দিকে তেড়ে যায়। যা দেখমাত্রই পাভেলের জান যায় যায় অবস্থা। সে আর যাই হোক, কেনীথের শক্তির সাথে পারবে না এটা জানা কথা। সে আঁতকে পেছনের দিকে সরে যেতে নিলে, ধপাৎ করে মাটিতে পড়ে যায়। একইসাথে চেঁচিয়ে ওঠে,
❝গাধাগুলো তাকিয়ে তাকিয়ে কি দেখছিস? ধর এটাকে! ওরেএএএ আমায় মে’রে… ❞
এ বলতে না বলতেই, কেনীথ এসে তাকে ধরতে নিলেই,তড়িঘড়ি করে আশেপাশের সবগুলো বলিষ্ঠ দেহের বডিগার্ড কেনীথকে আটকানোর সর্বচ্চ চেষ্টা করে। কেনীথ এতে আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে পেছনে ফিরে যাকে হাতের কাছে পাচ্ছে, তাকেই নিজের সর্বশক্তিতে ক্ষ”তবি”ক্ষত করছে। তবে খানিকটা সময় যেতে না যেতেই আকস্মিক গুলির শব্দে চারপাশের সবাই নিস্তব্ধ হয়ে যায়। কেনীথের সর্বস্বরূপে থমকে দাঁড়ায়।
পাশে ফিরে তাকাতে না তাকাতেই, আচমকা তার সামনে ঢাল রূপে দাঁড়িয়ে থাকা আনায়া হেলে নিচে পড়ে যেতে নেয়। কেনীথের মস্তিষ্ক খানিকটা সময়ের ন্যায় সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যায়।সবকিছু ছাড়িয়ে সে আনায়াকে পড়ে যাওয়া হতে কোনোমতে দুহাতে আগলে জড়িয়ে ধরে।
আনায়ার চোখের দু-কিনায়ার জমে থাকা পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। কেনীথ তার দিকে স্তব্ধ চাহনিতে তাকিয়ে। আনায়ার পিঠে রাখা হাত তার—লাল তরলে ভিজে গিয়েছে। কেনীথ একপলক সামনে তাকিয়ে দেখে, পাভেল তাদের থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে। চোখেমুখে বিস্তৃত হাসি। হাতে থাকা কালো রাঙা পিস্তল তাদের দিকে তাক করা।
—❝কি হলো? সব তেজ শেষ হয়ে গেলো?❞
পাভেলের তাচ্ছিল্যের স্বর কেনীথের কানে পৌঁছায় না। বরং সে পুরোপুরি বুঝে ওঠার পূর্বেই পরপর আরো দুটো গুলি এসে কেনীথ বাহু ও কাঁধ বারবার বিদ্ধ হয়। এতে পাভেল আরো বিস্তৃত ভাবে মুচকি হাসে।
কেনীথ যখন গার্ডদের বেধরে পেটাতে ব্যস্ত,ঠিক সেই সুযোগে পাভেল তার পিস্তল বের করে তৎক্ষনাৎ কেনীথের দিকে তাক করে। যা দেখামাত্রই আনায়া বিস্ময়ে ছুটে গেলেও, ফলাফল বিপরীত হয়। কেননা ততক্ষণে পাভেল ট্রিগারে চাপ দিয়ে ফেলছে। যে কারণে শুরুতে কেনীথের গায়ে গুলি না লেগে—লেগে যায় আনায়ার পিঠে।
এবার কেনীথ আর আনায়াকে ধরে রাখতে পারেনা। পাভেলের নির্দেশে কেনীথকে লোকজন সজোরে চেপে ধরে, দূরে সরিয়ে নিতে চায়। কিন্তু কেনীথ সেসবে তোয়াক্কা না করে, আনায়ার নিস্তেজ শরীরটা নিয়ে হাটু গেঁড়ে নিচে বসে পড়ে।
—❝এই আনায়া! তুই এমন কেনো করছিস? এ বউ, উঠে যা প্লিজ। তোর কিছু হলে আমি শেষ হয়ে যাব।❞
আনায়া নিস্তেজ শরীর ধীরে ধীরে স্তব্ধ হয়ে যেতে শুরু করে। চোখজোড়া ক্রমশই বন্ধ হয়ে আসে। আনায়া কিঞ্চিৎ ঢোক গেলে, নিজেকে যথাসাধ্য সামলানোর চেষ্টা। কেনীথকে কিছু বলতে চাইছে কিন্তু বলতে পারছে না। এই কষ্টে তার নিমিষেই চোখ বেয়ে পানি ঝড়ে। চারপাশটা ক্রমশই ঝাপসা হয়ে আসছে। তবুও সে যথাসাধ্য চেষ্টা করে অস্ফুটস্বরে আওড়ায়,
❝মাফ করে দিয়ে দিও। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। সবটাই অসমাপ্ত রয়ে গেল। মাফ করে দিও আমায়৷❞
আনায়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতেই, কেনীথ তড়িঘড়ি করে অস্থির হয়ে ওঠে। আনায়ার গালে হাত চেপ্টে , দু’হাতে তাকে আগলে নেয়। হাতের একপাশটায় দুটো গুলি লাগায়, সে হাত যেন অবশ হয়ে এসেছে। তবুও কেনীথ প্রচন্ড অস্থিরতা সাথে বলে,
❝পাগল হয়ে গিয়েছিস? কিচ্ছু হবে না তোর। ঐ পাভেল! ভাই তোর যা যা লাগবে আমি সবকিছু দিয়ে দেব। প্লিজ ওকে বাঁচা। ওর কিছু হলে আমি ম”রে হবে যাব।❞
পাভেল সহ সকলেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে। পাভেলের কাছে বিষয়টা কেমন যেন অতিরিক্ত। সে কিছুটা বিরক্ত হয়ে, নিজের পিস্তল দিয়ে কপাল চুলকিয়ে নেয়। এদিকে আনায়া আবারও কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে,
❝আমার মেয়েটা!…ও অনেক ছোট। তুমি ছাড়া ওর… আর কেউ নেই। আমি জানি না আমার কি হবে। হয়তো আমাদের সন্তানটা আর পৃথিবীতে… মাফ করে দিও আমায়। আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো।❞
এই বলতে বলতেই আনায়া ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। মাথাটা তার আরো ভার হয়ে আসে। কেনীথের কাতর চেহেরাটাও ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যায়।
—❝কিচ্ছু হবে না তোর। কেনো এসব কথা বলছিস?❞
আনায়ার ঠোঁট কেঁপে ওঠে। সে অস্ফুটস্বরে আবারও আওড়ায়,
❝শুনছো…!❞
কেনীথ অস্থির হয়ে,আনায়াকে আরো শক্ত ভাবে আঁকড়ে বলে ওঠে,
❝হুম, বল… ❞
আনায়া ঠোঁট ভিজিয়ে, জোরে জোরে শ্বাস ফেলে আওড়ায়,
❝ভালোবাসি,জলহস্তী! ভীষণ ভালোবাসি।❞
এই পর্যায়ে কেনীথের চোখ বেয়ে পানি পড়ে। ওদিকে আনায়ার দম যেন ফুরিয়ে এসেছেন। সে শেষবারের মতো আবারও বলার চেষ্টা করে,
❝অরিন কোথায়? প্লিজ,ওদের বলে শেষবারের মতো একটিবার আমার মেয়েটাকে দেখার…❞
আনায়ার কথা আর সমাপ্ত হয়না। বরং তার পূর্বেই সে সম্পূর্ণ অচেতন হয়ে যায়। এদিকে কেনীথ এ দেখে যেন পাগল প্রায় অবস্থা। অনবরত আনায়ার গা ঝাঁকিয়ে বলতে লাগে,
❝এ তারা! না, না, এভাবে আমায় ফেলে যেতে পারিস না তুই। ওই কথা বলসি না কেন? তোর কিছু হলে আমি কিভাবে বাঁচব? আমি না তোকে বলেছিলাম, আমরা অনেক দূরে চলে যাব। সবার থেকে দূরে। ওখানে আমরা শান্তিতে একটা ছোট্ট সংসার গড়ব। তুই আর আমি সারাদিন ঝগড়া করব, মারামারি করব।আমাদের অনেকগুলো বাচ্চাকাচ্চা হবে। তুই আমাকে এভাবে ফেলে গেলে, এসব তবে কি করে সম্ভব হবে? তারা উঠে যা প্লিজ। কথা বল!”
এইসবকিছুই যেন পাভেলের কাছে প্রচন্ড বিরক্তিকর ঠেকল। সে খানিকটা বিরক্ত নিয়েই বলে উঠল,
❝ব্রো! তোমার কাহিনি তারাতাড়ি শেষ করো। এখন এভাবে বলে লাভ আছে? দেখো, হয়তো ম”রে গিয়েছে।❞
—❝যাস্ট শাটআপ। ওর কিচ্ছু হয়নি। হতে দেব না আমি। আমার মেয়েকে কি করেছিস? আমার লেডিবাগ কোথায়?❞
কেনীথের কথায় শুরুতে কেনীথ খানিকটা বিরক্ত হলেও, অরিনের কথা শোনা মাত্রই বিস্তৃত হেসে বলল,
❝লেডিবাগ? আ…অরিন মামুনি যে কোথায়…❞
কেনীথ চোখ তুলে, পাভেলের দিকে ক্ষিপ্ত চাহনিতে তাকিয়ে বলে,
❝হেলাফেলা করিস না পাভেল৷ বল অরিন কোথায়? ওর সাথে কি করেছিস তুই?❞
—❝ছিঃ, আমি কি ওর সাথে কিছু করতে পারি? যত যাই হোক, আমি ওর কি যেন…পাভলু আঙ্কেল। শ্লার বেটি, আমার নামটাকেও খেয়ে দিয়েছে।❞
পাভেলের উল্টোপাল্টা কথাকে কেনীথ গায়ে লাগায় না। সে আবারও অচেতন আনায়ার পালস্ চেক করতে থাকে। প্রচন্ড ধীরে ধীরে চলছে। একইসাথে সেও তীব্র অস্থির হয়ে উঠছে। এবার কেনীথ করুন স্বরে পাভেলের উদ্দেশ্য বলে,
❝এ পাভেল। ভাই আমার, ও-কে প্লিজ হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্তা কর। তোর সব রাগ ক্ষোভ তো আমার প্রতি, তাই না? তবে মেরে ফেল। আমি কিচ্ছু বলব না,আমার তোকে নিয়ে আর কোনো অভিযোগ নেই। শুধু আমার লেডিবাগ আর ব্লাডকে তুই বাঁচিয়ে রাখ।❞
পাভেল কেনীথের অভিব্যক্তিতে খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলে,
❝আরেহ বাহ, তুমি তো দেখছি গিরগিটির মতো মিনিটে মিনিটে নিজের রূপ পাল্টাচ্ছো।❞
কেনীথ পাভেলের কথাকে তোয়াক্কা না করে, আবারও বলে,
❝পাভেল! ওর পালস্ স্লো হয়ে আসছে। এভাবে থাকলে যখন-তখন বাজে কিছু হয়ে যাবে। ওর ভেতর আরো একটা নতুন প্রাণ…তারার কিছু হলে আমার সন্তানটাও পৃথিবীর আলো দেখতে পারবে না। প্লিজ তুই কিছু একটা কর।❞
এবার পাভেল ভাবে খানিকটা অবাক স্বরে বলে,
❝নতুন প্রাণ মানে…কবে আবার কি হলো? তারমানে এ তো আরো এক ঝামেলা।❞
এই বলেই সে হেসে ফেলল। এদিকে কেনীথ এবার দৃঢ় কন্ঠে বলে,
❝কি চাইছিস তুই? পেপার্সে তো সাইন করিয়ে নিসেছিস। এরমানে এখন সবকিছুই তোর। তবে আর কি চাস তুই? যা চাইবি, তাই দেব। বল কি চাস?❞
পাভেল খানিকটা নাটুকে ভঙ্গিতে ভাবুক স্বরে বলে,
❝উমমমমম! আর কি চাই আমার? আআআ…নাহ! আমার আর কিচ্ছু চাইনা। কিন্তু,কিন্তু…❞
কেনীথ খানিকটা কপাল কুঁচকে সন্দিহান কন্ঠে কিছু বলতে নেবে, তার পূর্বেই কোনো অপ্রত্যাশিত পরিচিত কন্ঠস্বরে শোনা যায়,
❝কিন্তু আমার চাই।❞
নিশুতি রাত। আকাশ ঢেকেছে দগ্ধ ধোঁয়ার ন্যায় ঘন কালো মেঘে। বাতাসে জ্বলন্ত ধাতবের গন্ধ। হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় দেহের বা পাশ থেকে সরে যায় কালো-রাঙা কাপড়ের একচিলতে ভাজ।উন্মোচিত হয়, পাজরের উপর আঁকা একটি মাঝারি আকৃতির স্করপিয়ন ট্যাটু।—বিষধর এক বিচ্ছুর ন্যায়, গভীর কালো ও কালচে লাল রঙের মিশ্রনে আঁকা।
সে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্থির— অভ্রান্ত রূপে। দেহ তার প্রাচীন শিলালিপির ন্যায় নির্মম, দৈত্যসম বলিষ্ঠ, এবং ভারসাম্যপূর্ণ। কালো-রাঙা আলখাল্লা, শরীর ঘিরে রয়েছে।যেন অন্ধকারই নিজ হাতে তাকে বস্ত্র দিয়েছে। চোখে-মুখের অভিব্যক্তি নির্লিপ্ত। শুধু ঠোঁটের কোণে একটি ক্ষীণ, রুক্ষ রেখা। তা হাসি নয়, বরং ফিরে আসার পূর্বঘোষণা। বিজয়ের পূর্বভাস।
চোখজোড়া অসামান্য তীক্ষ্ণতায় দগ্ধ, স্থির এবং নিরপেক্ষ। বাদামী তার চোখের মণি। অত্যধিক ফর্সা তার গায়ের ত্বক। কপালের একপাশে সিল্কি চুল এলোমেলো— অথচ নিয়ন্ত্রিত।যেন অবিন্যস্ততার মধ্যেও শৃঙ্খলা লুকিয়ে রয়েছে।
সে ধীর পায়ে হেঁটে এগিয়ে আসে।পায়ে কালো রাঙা বুট জুতো পড়া রইলেও তাতে শব্দ হয় না। অথচ ধরনীর ভূপৃষ্ঠ তার অশুভ উদ্যম, স্পষ্ট টের পায়। প্রতিটি পদক্ষেপ নিঃশব্দ অথচ ভারী—কোনো তাড়া নেই, প্রয়োজনও নেই। শুধু রয়েছে অনিবার্যতা। হাঁটার ছন্দে তার পরনের কাপড় কিছুটা সরে যায়, দৃশ্যমান হয় শক্ত হাতে ধরা কুড়োলটি।অত্যধিক লোহার ভারে ক্লান্ত নয় সে, বরং দৃঢ়তায় পরিপূর্ণ। ধারালো ফলায় গাঢ় লাল দাগ।এ কোনো রং নয় বরং টকটকে তাজা র”ক্ত— এখনও চুইয়ে পড়ছে নিখুঁত ভাবে। প্রতিটি ফোঁটা যেন একেকটি মৃ”তদেহের চিহ্ন বিশেষ।
অবশেষে, তার হাঁটার গতিবিধি থেমে যায়।কাঁধে কুড়োল তোলে। ডান হাত দিয়ে, মাথায় আলগাভাবে লেগে থাকা, আলখাল্লার টুপির কাপড়ের অংশটুকু পেছনের দিকে ঠেলে দেয়। নিমিষেই একগোছা চুলের পাশাপাশি, পিঠ ও ঘাড়ের মধ্যবিশেষে আঁকা, পাখির ডানা বিশিষ্ট বিস্তৃত কম্পাস্ ট্যাটুটাও দৃশ্যমান হয়।
সে শিরদাঁড়া সোজা করে সটানভাবে দাঁড়িয়ে, দৃঢ়তার সাথে মাথা উঁচিয়ে তীর্যক হাসে।সে নিশ্বাস ফেলে না, অথচ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।কেনীথের পাশাপাশি সকলেই তার দিকে বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে। শুধুমাত্র পাভেল ছাড়া, কেনোনা এই ব্যক্তিই তার আজ রাতের বিশেষ অতিথি। এমন মূহুর্তেই সেই আগুন্তকঃ বিস্তৃত তির্যক হেসে, স্পষ্টভাবে গাম্ভীর্যের সাথে আওড়ায়,
“I’m back.”
বলিষ্ঠ দেহের আগুন্তকঃ এর কন্ঠস্বরে কেনীথ তার দিকে বিস্ময়ের চাহনিতে তাকায়। সে এসে পাভেলের পাশাপাশি এসে দাঁড়ায়। পাভেল তাকে বিস্তৃত হেসে বলে ওঠে,
❝আরেহ্ বস! তোমারই তো অপেক্ষায় ছিলাম।❞
এদিকে কেনীথ বিস্ময়কর অভিব্যক্তিতে আগুন্তকঃ বিস্তৃত হেসে বলে,
❝কি খবর ভিকে? বহুদিন পর তোর আমার সাক্ষাৎ হলো, তাই না?❞
কেনীথ বিস্ময়ের ঘোর এখনো কাটেনি। এই ব্যক্তি যেন সম্পূর্ণই তার কাছে অপ্রত্যাশিত। যদিও তাদের সকল কথোপকথন চলে রুশ ভাষায়। কেননা আগুন্তকঃ নিজেই রুশ ভাষা পারলেও, বাংলাটা ঠিক বোঝে না। কেনীথ শুধু রুশ ভাষায় অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,
❝ভি! তুই কিভাবে…?তুই তো…❞
—❝হুম বল! আমি কি? আমাকে শেষ করা এতোই সোজা।… ভিকে! তোকে এতোটাও গাধা ভাবিনি আমি।❞
সবার মাঝে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে। কেনীথ এবার আলগোছে তির্যক হাসে। তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলে ওঠে,
❝কিসের জন্য এসেছিস? আমাকে শেষ করতে?❞
আগন্তুকঃ বিস্তৃত মুচকি হেসে বলে,
❝তো, তোর কি মনে হয়? আমি তোর বার্থডে পার্টিতে এসেছি নাচানাচি করতে?❞
এই বলেই সে কেনীথের দিকে এগিয়ে যায়। কুড়ালের সাথে হাত ঠেকিয়ে, নিচে পড়ে থাকা আনায়ার দিকে তাকায়। কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর, মুচকি হেসে বলে,
❝তোর বউ? আগের মতোই সুন্দর আছে।❞
আগুন্তকঃ এর কথা শুনে, কেনীথ তীব্র ক্ষোভের সহিত তার দিকে তাকায়। চাইলেই উঠে গিয়ে, মুখ বরাবর দুটো ঘুষি মারতে তার দুবার ভাবতে হবে না। কিন্তু এভাবে আনায়াকে ফেলে যাওয়াটা তার কাছে মোটেও ঠিক মনে হলো না। সে আনায়াকে নিজের সাথে আরেকটু আগলে রেখে বলে ওঠে,
❝নজর ঠিক কর, বা**স্টা*র্ড! নয়তো তোর ওই চোখ আমি উপ্রে ফেলব। আগেরবার কি করেছিলাম, মনে আছে নিশ্চয়?❞
কেনীথের অভিব্যক্তিতে ভি তথা আগুন্তকঃ আবারও বিস্তৃত হেসে ফেলে। ঘাড় এপাশ ওপাশ করতেই, তার সিল্কি চুল হেলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায়। সে কিছুটা তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,
❝মনে আছে দেখেই তো এসেছি বস! তোকে কঠিনের চেয়েও কঠিন কষ্টদায়ক মৃ*ত্যু দিতে না পারলে তো আমার ম’রেও শান্তি হবে না।❞
কেনীথ কিছুটা মুচকি হেসে বলে,
❝তো মা’র না! না করেছে কে? তোরা ভেবেছিস আমার দুটো সিগনেচারেই তোরা সবকিছু পেয়ে গিয়েছিস? এতোই সহজ? আমি বাঁচলেও যেমন তোরা এসবের একাংশও ভোগ করতে পারবি না। তেমনি আমি ম”রলে তো…হাহ্,পুরো খেলাটাই শেষ।❞
—❝একদম ঠিক বলেছিস! তোকে মা”রলেই তো গেইম শেষ। আর আমি এসেছি গেইম শেষ করতেই।❞
এই বলেই সে কয়েকজন গার্ডকে ইশারা করতেই, আচমকা পেছন হতে একজন বলিষ্ঠ দেহের ব্যক্তি কেনীথের মাথায় বাম পাশ বরাবর সজোরে লোহার রড দিয়ে আঘাত করে। ওমনি কেনীথের সমস্ত পৃথিবীটাই যেন ঘুরে যায়। কানের একপাশ হতে র*ক্ত গড়িয়ে গলা ভিজে যায়। তবুও সে আনায়াকে আরো শক্তভাবে জড়িয়ে আঁকড়ে ধরে থাকে। কেনীথ নিভু নিভু চোখে আগুন্তকঃ এর দিকে তাকিয়ে তির্যক হেসে বলে,
❝মে”রে ফেল, আমি কিচ্ছু বলব না৷ কিচ্ছু না। কারণ আমি জানি তুই আজ এখানে, আমার কাছে কি চাইতে এসেছিস। আর তুই যা চাইতে এসেছিস তা আমি কখনোই দেব না। কখনোই না!❞
এহেন পরিস্থিতিতে কেনীথের এহেন অভিব্যক্তিতে লোকটি প্রথমে ভ্রু কুঁচকে কেনীথের দিকে তাকিয়ে থাকে। পরক্ষনেই সে খানিকটা ক্রোধ নিয়েই কেনীথের দিকে ঝুকে,ওর র*ক্তাক্ত চুলের মুঠি শক্ত করে চেপে ধরে। কেনীথ মুখমণ্ডল খানিকটা উঁচিয়ে ধরে,তার হাস্যজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে হিসহিসিয়ে আওড়ায়,
❝তুই নিজেকে অনেক বেশি চালাক ভাবিস তাই না?❞
কেনীথ আনন্দের সাথে, মুচকি হেসে বলে,
❝হুম, অনেক বেশি।❞
কেনীথের এহেন অভিব্যক্তিতে লোকটির চোখমুখ আরো রাগের আভাসে ঢেকে যায়। ফর্সা চেহেরায় নিমিষেই রক্তিম হয়ে ওঠে। ওমনি সে কেনীথের উদ্দেশ্যে আবারও বলে,
❝তোর বোন রোজ আর তোর আদরের মেয়ে কেনায়া…দুটোই কিন্তু আমার কাছে।❞
কেনীথ এবারও একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে হেসে বলে ওঠে,
❝আমার ধারণা ভুল না হলে, তোরা এটাও জেনে গিয়েছিস যে আমার প্রোপার্টির দুটো বড় অংশ অরিন আর রোজের নামে দেওয়া। সেক্ষেত্রে ওদের কিছু হলে…আমার মনে হয়, ওদের আমার চেয়ে তোর বেশি প্রয়োজন।আর বাকি রইল, তোর সেই স্পেশাল জিনিস… ওটা তো আমি ম”রে গেলেও তোকে কখনো বলব বা। এখন দেখ, যেটা ভালো বুঝিস।❞
আগুন্তকঃ রূপে ভি মুচকি হাসে। এটা তার ক্রোধের হাসি। সে চেয়েছি আজকের দিনে অন্তত কেনীথ তার কাছে পরাজিত হোক। কিন্তু এবারও তেমন কিছু হয়নি। সে কয়েকপা পিছিয়ে আসে। পরক্ষণেই হাতের কুড়োলটা উঁচিয়ে, কেনীথের উদ্দেশ্য তীব্র ক্ষিপ্ত স্বরে বলে,
❝তবে প্রস্তুত হো,ভিকে! আমার কাজ ওদের দিয়ে, তোকে দিয়ে না। দ্যাটস্ হোয়াই, তোকে বাঁচিয়ে রেখেও আমার কোনো লাভ নেই।❞
ভি এর কথায়, কেনীথ মুচকি হেসে আওড়ায়,
❝এজ ইউ উইশ❞
এই বলেই সে আলগোছে চোখ বুঝে নেয়। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, স্বরণ করতে থাকে বহু বছর আগের কথা৷ আনায়ার বাবা তারেক শিকদারকে মা”রার সময়, শেষ বারের মতো অন্তিম প্রহরে সে কেনীথের কানে কানে কিছু কথা বলেছিল। কথাগুলো সেইসময় বিদ্রুপে পরিপূর্ণ এবং অযৌক্তিক লেগেছিল কেনীথের কাছে। তারেকের কথা অনুযায়ী সে বলেছিল,
❝এই দিন তোরও ফিরবে ভিভান। আজ যেভাবে তুই আমাকে শেষ করলি। ঠিক সেভাবে তুইও শেষ হবি। এবং ঠিক একই কারণে। আজ আমার মেয়ের কারনে তুই আমায় মা”রবি। কাল তোর মেয়ের জন্য তুই মর”বি। কথাটা মিলিয়ে নিস।❞
কেনীথের কাছে সেদিন কথাটা ছিল সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। না সে আনায়া ব্যতীত অন্য কোনো মেয়েকে নিয়ে সংসার গড়ার চিন্তাভাবনা রেখেছিল আর না করেছিল আনায়ার সাথে। সে সময় তার পাগল মস্তিষ্কের পরিকল্পনা ছিল, সে আনায়াকেই হয়তো কখনো শেষ করে দেবে। সেখানে তার মেয়ে আসবে কোথায় থেকে?
অরিনের জন্মের পর হতে কেনীথের এই ব্যাপারটা মাঝেমধ্যেই স্বরণ হতো। একইসাথে সে ব্যাপারটা নিয়ে মজাও নিতো। আজও নিতে হচ্ছে। চূড়ান্ত দিনে খেলায় বিজয়ীর মতো হেসে তারেক শিকদারের উদ্দেশ্য বলতে ইচ্ছে করছে,
❝দেখে নে তারেক। তোর কথা মেলেনি। এই ভিকে তার মেয়ের জন্য ম”রবে না। বরং বাঁচলে তার মেয়ের জন্যই বাঁচবে। অমর হবে এই কেনীথ। এবার এই কথাটা তুই মিলিয়ে নিস।❞
এরইমধ্যে বাতাসের নিস্তব্ধ ধ্বনির মাঝে ভেসে আসে কারো চিৎকারের আওয়াজ। আওয়াজটা কেনীথের অত্যন্ত পরিচিত। কেনীথ তৎক্ষনাৎ চোখ খুলে ফেলে। আশেপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখে শো শো করে দ্রুত বেগে কয়েকটি কালো রাঙা গাড়ি এড়িয়াটা থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে। আর তার মাঝেই একটা গাড়ির খোলা গ্লাস দিয়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে এক অল্প বয়সী বাচ্চা মেয়ে। কিন্তু তাকে যথাসম্ভব টেনে খিঁচে ভেতেরের লোকজন সামলাতে চাইছে।
—“পাপাআআআআআ!”
[আগুন্তকঃ ভি এর শুরু সংক্ষিপ্ত নামটাই প্রকাশ করা হলো। এক কে এবং তার সাথে কেনীথ সম্পর্ক কি, তা খুব শীঘ্রই সংস্করণ গল্পে জানতে পারবেন]
অরিনকে এভাবে দেখে কেনীথের ভেতরের সম্পূর্ণটা তোলপাড় হয়ে যায়।কিন্তু সে একনাগাড়ে চুপচাপ তাকিয়ে, চোয়াল শক্ত করে বসে থাকে। তার এহেন অভিব্যক্তিতে আগুন্তকঃ ভি বিস্তৃত হেসে বলে ওঠে,
❝কি রে, এখনো কিছু বলবি না? তোর মেয়ে যায় রে।❞
কেনীথ একটাও কথা বলে। শুধু চুপচাপ দূর হতে, গাড়িতে থাকা অরিনের ছটফটিয়ে চলে যাওয়াকে দেখতে থাকে।আর শুনতে পায় তার ছোট্ট নরম স্বভাবের মেয়েটি ক্ষ্যাপা কন্ঠস্বর,
❝ছেড়ে দে আমায়। আমার পাপা আর মাম্মামকে কিচ্ছু করবি না। নয়তো সবাইকে মে”রে ফেলব আমি।❞
এদিকে ভি আর সময় নষ্ট না করে, কুড়ালটা শক্ত ভাবে ধরে শূন্যে তুলে নেয়। অতঃপর কেনীথের উদ্দেশ্য বলে ওঠে,
❝তবে শুভ কাজটা তোর মেয়ে থাকতে থাকতেই সেড়ে ফেলি। কি বলিস?❞
নিমিষেই চারপাশটা স্তব্ধ হয়ে যায়। একটা জ্যান্ত মানুষের আস্ত মাথা, ঘাড় হতে ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়ে বিস্তৃত ঘাসের বুকে। আর ওদিকে শারি শারি গাছপালা ছাড়িয়ে, জানালা ঘেষে ছটফটিয়ে চলা অরিন এদিকটা দেখতে দেখতেই চিৎকার করে বলে ওঠে,
❝ধ্বংস করব আমি। সবকিছু শেষ করে দেব। আমি কাউকে বাঁচতে দেব না।❞
অন্ধকারে মোড়ানো এক ভুতুড়ে নিশীথ রাত। আকাশ ঢেকে আছে ধোঁয়াচ্ছন্ন মেঘে, আর চারদিকে গুমোট বাতাসে গাছপালার কান্নারত কাঁপুনি। দেখতে দেখতে সময়টা প্রায় চৌদ্দ বছর পেরিয়েছে।
আজ ৭ জুলাই, ঠিক সেই অভিশপ্ত রাতের পুনরাবৃত্তি। স্থানটা আর্তেমের বিশাল সাম্রাজ্যের ধ্বং*সাবশেষ। গোধূলির আলো আর রক্তিম আভায় ভেসে থাকা বাগান আজ শুধু স্মৃতির কবরস্থান। এই মৃত জমিনেই দাঁড়িয়ে আছে অশরীরির বেশে এক রহস্যময়ী তরুণী। বয়সটা আঠারো হলেও, চোখেমুখের অভিব্যক্তিতে যেন শতবর্ষের রক্তা”ক্ত অভি”জ্ঞতার আধার।
তার পরনে কালচে রাঙা সাধারণ একটা গাউন। অথচ সাধারণ গাউনটাও যেন, মেয়েটির পরনে থাকায় অসাধারণ এক রাজকীয়তার আভাস ছড়াচ্ছে।
গাউনের উপর জড়ানো এক দীর্ঘ কুচকুচে কালো রঙের আলখাল্লা। যার টুপিতে তার মুখ আড়াল করা। তবুও তার ফাঁকে দৃশ্যমান গাঢ় লালচে রক্তবর্ণ চুলের ঢেউ খেলানো রাশি। তার ডান হাতে একটি ধোঁয়ায় বিবর্ণ হ্যারিকেন। মৃদু হলদেটে রঙের আলো নিভু নিভু করে জ্বলছে।
আর বাম হাতে একটি ছোট্ট রুবিক্স কিউব। যেটি সে অদ্ভুত দক্ষতায় ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে চলেছে—মাত্র দু-তিনটে আঙুলের সুদক্ষ কৌশলে।
অথচ তার তীক্ষ্ণ ও দৃঢ় দৃষ্টি নিবদ্ধ সেই পুরনো ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদ সরূপ বাড়িটির দিকেই। চৌদ্দ বছর আগের রক্তাক্ত স্মৃতি যেন আজ আবার নিঃশব্দে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে।
এরইমাঝে তার ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কেঁপে ওঠে। ঘাড়টা খানিক কাত করে অরিন বাড়িটার দিকে তাকায়। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের বিশেষ সংকেতে, সে স্পষ্ট অনুভব করতে পায়— নিভৃত ধ্বংসস্তূপের মাঝেও যেন একজোড়া চোখ নিঃশব্দে লুকিয়ে তাকে দেখছে। হ্যাঁ, তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে—সেই দৃষ্টি তাকেই পরখ করছে। কিন্তু ঠিক কোথা থেকে,তা সে খুঁজে পেল না।
এক মুহূর্ত চুপ থেকে কিছু একটা ভেবে নিয়ে, সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। গলার স্বর একদম নিস্তরঙ্গ অথচ কঠিন রেখে অস্ফুটস্বরে আওড়াতে থাকে,
❝আমি ফিরে এসেছি, বাবা… আজও এই একই তারিখে… ঠিক এই দিনেই আমরা জন্মেছিলাম। তাও দু-দুবার করে। কিন্তু আজ, এই মৃত্তিকায় আমি আবার বাঁচতে আসিনি—প্রতিশোধের জন্যও নয়। বরং আমি এসেছি ধ্বং”সের জন্য। যে উপাখ্যান অসমাপ্ত রয়ে গিয়েছিল, আমি সেটাই ধ্বং”স করে ক্ষ্যান্ত হবো।❞
তার চোখজোড়ায় এমন ভাবে দৃষ্টি জ্বলছে, যেন জ্বলন্ত কয়লার প্রতিচ্ছবি। এরইমাঝে হাতের আঙুলের সাথে সাথে, রুবিক্স কিউবটা হঠাৎ থেমে যায়। কিউবের প্রতিটি রঙ নিখুঁতভাবে মিলেছে। চোখে না তাকিয়েই, নিঃশব্দে সে কিউবটা এক হাতে সজোরে চেপে ধরে।
চড়চড় শব্দ করে কিউবটা চূর্ণবিচূ”র্ণ হয়ে ছিটকে পড়ে মাটিতে। তার ভেতরের আগ্নেয় প্রতিজ্ঞার প্রকাশ যেন এই ক্ষুদ্র খেলনায় একবারেই শেষ হয়। তার চোখজোড়া ধীরে ধীরে লালচে হতে শুরু করে।তা মোটেও স্বাভাবিক নয় বরং ঠিক রক্তের ন্যায় গাঢ়— ভয়া”নক এক রঙ। সে অস্ফুটস্বরে ফিসফিস করে আবারও বলে ওঠে,
❝খেলা তো শুরু হয়েছিল বহুকাল আগেই। কিন্তু শেষটা এবার আমি করব …ঠিক এইখান থেকেই। র”ক্তের খেলা… ছায়ার খেলা। আমি ধ্বংস করে দেব…সবকিছু! পাপের উত্তর পাপই হবে। কিন্তু তবুও আমি থামব না।❞
তৎক্ষনাৎ হঠাৎ হাওয়ার দমকে হ্যারিকেনটা কিঞ্চিৎ কেঁপে ওঠে। তার আলো এক ঝলকে অশরীরী ন্যায় স্তব্ধরূপে দাঁড়িয়ে থাকা, তরুনীর মুখশ্রীকে আলোকিত করে তোলে। এক নিঃশব্দ রাজরক্তের প্রতিচ্ছবি যেন চাঁদের আলোর নিচে দাঁড়িয়ে, ইতিহাসের অভিশাপ হাতে তুলে নিয়েছে—নিঃসংকোচে, নিঃসংশয়ে। তখনই সে পুনোরায় স্পষ্ট স্বরে দৃঢ় কন্ঠে আওড়ায়,
একজোড়া আগুন পাখি শেষ পর্ব ৪২ (৬)
❝একজোড়া আগুন পাখি—তারা পুড়েছিল একত্রে। কিন্তু আমি জ্বলব একা।
শিখায় জন্ম, ছায়ায় মৃত্যু—আমি সেই মধ্যবর্তী এক গর্জন।
একজোড়া আগুন পাখির ইতিহাসে
আজ থেকে লেখা হবে গল্পের শেষ অধ্যায়—
রক্তে, অভিশাপে, ও নিঃশব্দ ধ্বংসয”জ্ঞে।
না কেউ বাঁচবে, আর না আমি থামব।
ইতিহাসের নিকট আমার দাবী একটাই—রক্তের উত্তর রক্ত, আগুনের উত্তর ছাই। সবাই মরবে, সবাই!❞
