একঝাঁক জোনাকি পর্ব ১০
ইশরাত জাহান অধরা
নিহান সবগুলা কথা শুনে কিছু না বলে চলে গেল।এক গ্লাস পানি এনে অনিমার সামনে দিয়ে বলল,
“পানিটা খান।ভালো লাগবে।”
গ্লাসের পানি খেতেই খালি গ্লাসটা নিয়ে পাশে রেখে কিছুক্ষন চুপ থেকে নিহান বলল,
“দেখুন আপনাদের সম্পর্কে কোন কথা বলার অধিকার আমার নেই।এবং আমি কোনদিন কথাও বলব না।আমি শুধু বলতে চাই আপনাকে এতো নরম হলে চলবে না অনিমা।শক্ত হতে হবে আপনাকে।যে কেও এসে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিলে আপনি তা ভেবে মন খারাপ করে থেকে কান্না কাটি করে কাকে কষ্ট দিচ্ছেন?নিজেকেই তো?সাথে আপনার বাচ্চাটাও কষ্ট পাচ্ছে।আপনাকে আপনার বাচ্চার জন্য হলেও শক্ত হতে হবে।কেও কথা শুনাতে আসলে আপনি কেন মেনে নিবেন?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আপনিও দু চারটা কঠোর কথা বলে দিবেন যাতে সামনের মানুষটা আপনাকে দ্বিতীয়বার কথা শুনাতে আসার আগে অন্তত একবার হলেও ভাবে!এইযে সারাদিন কিছু না খেয়ে বসে রইলেন এতে কে কষ্ট পেয়েছে?সোহানের কি কিছু হয়েছে?ও কি আদৌও জানে আপনি এভাবে বসে আছেন?আর জানলেও কি?ও কি আসবে আপনাকে শান্তনা দিতে?মানুষের কথা না ভেবে নিজের কথা ভাবুন অনিমা।নিজের বাচ্চাটার কথা ভাবুন।বাইরের মানুষের কথা ভেবে নিজেকে কষ্ট দিবেন না!এখন আর একটা কথাও না ভেবে রেস্ট নিন।এতদিন তো অন্যের কথা অনেক ভাবলেন এখন অন্তত নিজের জন্য ভাবুন মানুষের কথা না ভেবে!”
বলেই রুম থেকে বের হয়ে গেলো।কিছুক্ষন পর এক প্লেট খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকে বলল,
“দুপুরে তো কিছুই খাননি!যেরকম খাবার রেখে গিয়েছিলাম ঠিক সেরকম খাবারই পরে আছে।এভাবে নিজেকে তো কষ্ট দিচ্ছেনই সাথে বাচ্চাটাকেও কষ্ট দিচ্ছেন।আপনার কারনে বাচ্চাটা সারাদিন না খেয়ে আছে।এই খাবারটুকু খেয়ে নিন।”
অনিমা প্রথমে ভেবেছিলো খাবে না।ক্ষিধে ওর একদমই পায় নাই।সারাদিনে একবারও না।কে জানে কেন পায়নাই!কিন্তু নিহানের মুখে বাচ্চার কথা শুনে মানা করতে পেলো না।ক্ষিধে না পেলেও তাকে খেতে হবে। বাচ্চাটার জন্য হলেও তাকে খেতে হবে।এইসব ভেবে নিহানের হাত থেকে খাবারের প্লেট নিয়ে বলল,
“আপনি খাবেন না?”
নিহান মুচকি হেসে বলল,
“একটু পরে খাবো।আজকে তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে।নইলে আবার গেট আটকে দিবে। পরে যেতে পারব না।বাসায় গিয়ে খাবো।আপনি খেয়ে নিন।”
অনিমা মাথা নেড়ে খাবারে মনযোগ দিলো।
“আমি দুঃখিত।”
“কেন?”
নিহান একটা শ্বাস ফেলে বলল,
“আমি যদি সোহানকে বাসার ঠিকানাটা না দিতাম তাহলে উনি আসতে পারতেন না।অইসব কথা বলতেনও না।আর না আপনি মন খারাপ করে খালি পেটে থাকতেন!আমার একদমই উচিত হয়নি উনাকে বাসার ঠিকানা দেওয়া।”
“এতে আপনার কোন দোষ নেই।আপনার জায়গায় যেকেও থাকলেই এই সেইম কাজটাই করতো।”
“তা ঠিক বলেছেন।কিন্তু তাও আমি যদি ঠিকানা না দিতাম তাহলে উনি এই বাসা চিনতেন না আর না আপনাকে কথা শুনাতেন।যাইহোক আমাকে বাসায় যেতে হবে।আসছি আমি।আর নিজের খেয়াল রাখবেন।বেখেয়ালি হবেন না।”
অনিমা মাথা নাড়লো।নিহান হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খেয়েই মনে মনে ভাবলো এভাবে সারাদিন বসে থাকা যায় না।কিছু একটা করতে হবে।এসব ভেবেই আগে যেই অফিসে চাকরি করতো সে অফিসে যাবার সিদ্ধান্ত নিলো।অই অফিসের যে এমডি উনি জানেন অনিমা ইচ্ছা করে চাকরিটা ছাড়েনি। শশুড়বাড়ির কেউ চায়নি বলেই তাকে চাকরিটা ছাড়তে হয়েছিলো।এক প্রকার বাধ্য হয়েই চাকরিটা ছেড়েছে সে।রেডি হবার জন্য ড্রেস চুজ করতে যেতে দেখলো বাসা থেকে কোন ড্রেসই সে আনেনি।এক কাপড়েই চলে এসেছে।
এখন কিভাবে যাবে?আর নাই বা গেল কিন্ত এই এক কাপড় পরে তো আর থাকা যায় না!হঠাত পাশেই পরে থাকা আনপ্যাকিং করা শপিং গুলোর দিকে নজর গেলো অনিমার।নিহান শপিং ব্যাগগুলা অনিমার হাতে দেবার পর আর খুলে দেখা হয়নি।একটা শপিং ব্যাগ হাতে নিয়ে প্যাকেটটা খুলে ড্রেসটা খুলতেই অবাক হয়ে গেলো।ও অইদিন শপিংমলে যে জামাটা চুজ করেছিলো কিন্তু বেশি দামের জন্য কিনতে পারেনি সেই জামাটাই দেখলো।ভ্রু কুচকে বাকি শপিং ব্যাগগুলার দিকে হাত বারালো।প্রত্যেকটা শপিং ব্যাগ আনপ্যাক করতে ওর পছন্দের ড্রেসগুলার দেখাই পেলো।আচ্ছা নিহান জানলো কিভাবে এই ড্রেসগুলা আমার পছন্দ হয়েছিলো?ভাবনাগুলাকে দুরে ফেলে এতগুলা ড্রেসের মধ্যে কোন ড্রেস পরবে সেটাই বুঝতে পারছে না।একটা ড্রেস পরলেই হলো!এত ড্রেস বাছার দরকারটা কি?ভেবে সামনে থাকা নীল রঙের ড্রেসটাই বেছে নিলো।
অনিমা অফিসের এমডির রুমে বসে আছে।অনিমার সব কথা শুনে রায়হান হক মাথা নেড়ে বললেন,
“আপনি নিসন্দেহে একজন ভালো স্টাফ ছিলেন।আপনার করা সব কাজ সবাইকে মুগ্ধ করার জন্য এক কথায় যথেষ্ঠ ছিল।আপনি সবসময়ই আপনার কাজে সৎ,নিষ্ঠাবান,কর্তব্যপরায়ন ছিলেন।যেদিন আপনি লেটার দিয়ে বললেন আপনি আর চাকরি করবেন না!আপনার বাড়ির লোক মেনে নিচ্ছেন না বিষয়টা সেদিন অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম।কেওই চায়না এত দায়িত্ববান একজন স্টাফ অফিস থেকে চলে যাক। আমিও মন থেকে চাইনি।আপনি ফিরে আসবেন শুনে খুশি হলাম।কবে থেকে আপনার সুবিধামতো কাজ শুরু করতে চান?”
” আজকে থেকে শুরু করতে চাই।”
“আজকে থেকে?”
“কেন? কোন অসুবিধা হবে?”
রায়হান হক অপ্রস্তুত হেসে বললেন,
“না না!কি আর অসুবিধা হবে?আপনি চাইলে আজকেই শুরু করতে পারবেন তবে একটু সময় লাগবে।বুঝেনই তো আপনার আগের ডেস্কটা খালি নেই।ব্যবস্তা করতে হবে।আপনি একটু ওয়েট করুন। আমি এখনই সব ব্যবস্তা করছি।”
অনিমা সম্মতি জানালো কথায়।সারাদিন কাজ করতে করতে রাত হয়ে গিয়েছে।ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকাতেই দেখল প্রায় রাত আটটা বাজে এখন।
অফিস থেকে বের হয়ে বাস স্টেশনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বাস আসার অপেক্ষায়।আচ্ছা নিহান যদি জানতে পারে আমি উনাকে কিছু না বলে চাকরিতে জয়েন করেছি তখন উনার রিয়েকশন কেমন হবে?রাগ করবেন আমার উপর?কঠিন কথা শুনাবেন?উনাকে জানানো উচিত ছিল আমার।কেন যে জানালাম না।উনি যদি বিষয়টা ভালোভাবে না নেন?ভাবনার অবসান ঘটলো বাসের আওয়াজে।আর না ভেবে বাসে উঠে একটা সিটে গিয়ে বসে পরল।যা হবার হবে পরে দেখা যাবে ভেবেই নিজেকে সান্তনা দিলো।
নিহান হাসপাতাল থেকে বেরিয়েছে কিছুক্ষন হলো।বের হতেই বাড়ির ড্রাইভার কামালকে দেখলো।সামনে দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।নিহান ভ্রু কুচকে বলল,
“তুমি?এখানে কি করছো?”
“ম্যাডাম পাঠাইছে আপনাকে নিয়া যাওনের লাইগা।”
কামালের কথা শুনে নিহান বিরক্ত হলো।
“শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারো না?এইসব কি ভাষায় কথা বলো।”
কামাল মাথা নিচু করে বলল,
“সরি স্যার।ক্ষমা করে দেন।আর এভাবে কথা বলব না।”
“এখন বলো কেনো এসেছো?আম্মু পাঠিয়েছে তোমায়?”
“হো স্যার।ম্যাডাম কইলো কই নাকি এক্সিডেন্ট হইছে। হের লাইগা উনার নাকি দর লাগতাছে আপনের যদি কিছু হয়?হের লাইগা আমারে পাঠাইছে আপনেরে নিয়া যাওনের লাইগা।”
নিহান কামালের দিকে তাকাতেই কামাল জিভে কামড় দিলো।বারবার সে চায় শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে কিন্তু কি করে যেন জম্মগত ভাষাটা এসে পরে।নিহান আর কথা বারালো না।এই ছেলে যে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারবে না এটা বুঝা হয়ে গেছে।
“আচ্ছা!চলো। ”
বলেই পিছনের সিটে গিয়ে বসলো।এখন তো সে অনিমার কাছে যেতো।না জানি আবার মেয়েটা না খেয়ে আছে কিনা কে জানে!এখন কিভাবে যাবে?কামাল তো সোজা বাসায় নিয়ে যাবে।জানালার দিকে তাকিয়ে কথাগুলা ভাবছিলো।ট্রাফিক জ্যামে আটকে আছে এখন।হঠাত চোখ গেলো পাশে থাকা বাসের দিকে।অনিমার মতো কাওকে দেখলো মনে হয়!ভালো করে তাকাতেই দেখলো আরে অইটাতো অনিমাই!এখানে কি করছে?জানালায় মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে আছে।এই মেয়েটাও না!বাসে এভাবে কেও ঘুমায়?
“এই কামাল!আমার একটু কাজ আছে।এক্ষুনি যেতে হবে।তুমি বাসায় গিয়ে আম্মুকে এই কথা বলবে বুঝতে পেরেছো?”
“হ স্যার!কিন্তু…”
নিহান গাড়ি থেকে বেরিয়েই বাসে উঠে পরলো।নিহানের যাবার দিকে অবাক হয়ে গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে কামাল।অতঃপর মোটা মাথায় কিছু না আসায় আর মাথা ঘামালো না।নিহান বাসে ঢুকে চোখ বুলাতেই অনিমাকে নজরে পরল।আর দেরি না করে অনিমার পাশে গিয়ে বসে পরল।অনিমাকে ডাকতে গিয়েও ডাক দিলো না।ঘুমাচ্ছে মেয়েটা!ঘুমাকনা!
একঝাঁক জোনাকি পর্ব ৯
কি দরকার ঘুম ভাংগানোর?ভেবেই আর ডাক দিলোনা।একটু ভালো করে তাকাতেই দেখলো অনিমা দরজায় মাথা ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছে।ফলস্বরুপ বাসের ঝাকানিতে অনিমার মাথাটাও কাচের জানলায় ঠেকছে।ভ্রু কুচকে আসছে বারবার।নিহান আর উপায় না পেয়ে ধীরে ধীরে সযত্নে অনিমার মাথাটা হাত দিয়ে টেনে নিজের কাধে রাখলো।অনিমাও ঘুমের ঘোরে আরও ঝাপটে ধরল নিহানকে। নিহানের হার্ট দ্রুত বিট করা শুরু করেছে।অনিমার গরম নিঃশ্বাস নিহানের বুকে আছড়ে পরছে।নিহান খালি গলায় শুকনো ঢোক গিলল।এই প্রথম অনিমা নিহানের এত কাছে।অনিমার নিঃশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শুনা যাচ্ছে।হঠাত….