একঝাঁক জোনাকি পর্ব ২৫
ইশরাত জাহান অধরা
প্রায় অনেকটা সময় জার্নি করে অবশেষে কাংখিত জায়গায় পৌছালো।অনিমা আর নিহান বাস থেকে নেমেই একটা সিএনজিতে উঠে পরল।ততক্ষনে অরিনও ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে।সিএনজিতে নামার পর অনেকখানি রাস্তা হেঁটে যাওয়া লাগবে।অই রাস্তায় কোন রিকশা বা ভ্যানগাড়ি যাওয়া আসা করে না।একদম মাটির কাচা পথ।আশেপাশে তাকাতেই দেখল চারদিকে ক্ষেত আর গাছ গাছালি।এরকম পরিবেশে কতদিন আসেনি অনিমা।ঠিক কবে এসেছিলো মনেও পরছে না তার। শেষমেষ বাড়িতে এসে পৌছালো তারা।বাড়ির ভিতর ঢুকতেই দেখল বসার ঘরে সবাই বসে আছে।নিহান এক এক করে সবাইকে চিনিয়ে দিলো অনিমাকে।নিহানকে দেখেই নিহানের দাদী বসা থেকে সামনে এসে দাঁড়ালেন।নিহানকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“কতদিন পর এলি!তোর আম্মু ভালো আছে?”
নিহান জবাব দিতেই দাদী অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই মেয়েই বুঝি আমার নাতনির বউ?”
নিহান মাথা নাড়ালো।অনিমা সালাম দিতেই দাদী মিষ্টি হেসে সালামের উত্তর দিলেন।
“তোর তো আসার কোন নাম গন্ধই নাই!কত বছর পর আসলি!”
আবিরের কথা শুনে নিহান হেসে বলল,
“সময় থাকে না হাতে।সারাদিন ডিউটি করে সত্যিই সময় থাকে না।”
“হয়েছে আর এক্সিউজ দেওয়া লাগবে না।ফ্রেশ হো তোরা যা!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অনিমা বাচ্চাকে বিছানায় শুয়াতেই নিহান তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,
“খাবার নিচতলায় দেওয়া হবে। আপনার কি কোন অসুবিধা আছে?”
“না!আমার কি অসুবিধা হবে?”
“নতুন পরিবেশ অসস্তি লাগতেই পারে!আপনি বললে আমি এখানে খাবার আনার ব্যবস্তা করছি।তাহলে আপনাকে নিচে গিয়ে খেতে হবে না!”
“সবাই কি মনে করবে?”
“সবার মনে করাতে আমার কিছু আসে যায় না।তাছাড়া অরিন এখানে একা একা থাকবে।উপর থেকে কান্না করলে শুনাও যাবে না।তাই বলছি।আপনি বলুন! আমি ওদেরকে বুঝিয়ে বলব।”
“আচ্ছা।আপনার যা ভালো মনে হয়!”
“আজকে এখানে খান।কাল সকালে নিচে খাবেন!”
নিহান ভেজা তোয়ালে চেয়ারের উপর রেখে নিচে চলে গেলো। নিহান যেতেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল অনিমা।আসলেই নিচে গিয়ে সবার সাথে খেতে অসুবিধাই হতো ওর। এ বাড়ির অনেকেই যে ওকে পছন্দ করেনি সেটা সে বাড়িতে ঢুকে মুখ দেখার সাথে সাথেই বুঝে ফেলেছে।তাছাড়া শরীরও কুলাচ্ছিলো না নিচে যাবার।সারাদিন জার্নি করে এক ফোটাও শক্তি নেই ওর।বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখল অরিন ঘুমাচ্ছে।এই সুযোগে শাওয়ার নিয়ে নেওয়া যায়।গরম লাগছে অনেক।ভেবেই ব্যাগ থেকে কাপড় আর তোয়ালে বের করে বাথরুমে চলে গেলো।প্রায় ২০ মিনিট শাওয়ার নিয়ে বাথরুম থেকে বেরুতেই দেখল নিহান এখনো রুমে আসেনি।তোয়ালে দিয়ে চুলগুলাকে ভালো করে মুছে তোয়ালে দিয়ে চুলগুলাকে পেচিয়ে নিলো।নয়তো চুল থেকে পানি পরবে।পেচিয়ে খোপা বেধে পিছনে ফিরতেই নিহানকে বিছানায় বসা দেখলো।মোবাইল স্ক্রলিং করছে।অনিমা অবাক হলো।নিহান যে রুমে এসেছে টেরই পায়নি!
“আপনি কখন আসলেন?”
মোবাইলে চোখ রেখেই বলল,
“যখন চুল বাধছিলেন তখন।”
“অহ আচ্ছা।”
“বাসাতে থাকলে আপনাকে কষ্ট করে চুল মুছতে হতো না।আমিই হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে দিতাম।কিন্তু দুভাগ্যবশত এই জায়গায় হেয়ার ড্রায়ার নেই।”
“আমার কোন সমস্যা হয়নি!আগে তো চুল তোয়ালে দিয়েই মুছতাম।আপনাদের বাড়ি যাবার পর হেয়ার ড্রায়ার প্রথম ইউজ করলাম।”
কিছু একটা মনে পরতেই অনিমা বলল,
“জানেন আজকে সকালে কি হয়েছে?”
নিহান মোবাইল থেকে মাথা উঠিয়ে অনিমার দিকে তাকালো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে।
“মা চা চেয়েছিলেন আমার কাছে।আমার কাছে না বলেছিলেন রহিমা খালাকে গিয়ে বলতে যেন চা বানিয়ে দিয়ে যায় উনার নাকি অনেক মাথা ব্যাথা করছে।তো আমি গেলাম কিচেনে গিয়ে দেখলাম খালা মাছ কাটছেন।এই হাত দিয়ে উনি কি করে চা বানাবেন?তাই আমিই চা বানিয়ে কাপ নিয়ে রুমে ঢুকতেই দেখলাম মা অরিনের সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন!খেলছিলেন ওর সাথে,মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন।অরিনও হাসছিলো।ও অইদিনই হাসি দিয়েছিলো প্রথম।এর আগে আমি হাসতে দেখিনি ওকে।আমাকে দেখেই মা কেমন যেন চমকে গেলেন।অস্বস্তিতে পরে গেলেন।আমি না দেখার ভান করে চা দিয়ে চলে এসেছি রুম থেকে।”
নিহান সবগুলো কথা মনযোগ দিয়ে শুনে বলল,
“অরিন হাসতে পারে আর এই কথা আপনি আমাকে এখন বললেন?এখন তো আমার ওর হাসি দেখতে মন চাচ্ছে!”
কিছুক্ষন থেমে বলল,
“বলেছিলাম না আম্মু বাইরে থেকে কঠিন দেখালেও ভিতর ভিতর অনেক নরম।অরিনের প্রতি মায়া জম্মে গেছে আম্মুর।দেখবেন আস্তে আস্তে আপনাকেও মেনে নিবে।”
অনিমা হাসলো।হেসে পাশে জানলার দিকে তাকাতেই দেখলো একটা শিউলি ফুলের গাছ জানলার পাশেই।ছোটবেলা থেকেই ওর শিউলি ফুল অনেক পছন্দের।আলাদা একটা দুর্বলতা কাজ করে এই শিউলি ফুলের উপর।বসা থেকে উঠে গিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“এখানে যে শিউলি ফুলের গাছ আছে আগে বলেন নি তো?”
“শিউলি ফুলের গাছ?”
বসা থেকে উঠে অনিমার পাশে দাঁড়াতেই দেখল আসলেই বাইরে একটা শিউলি ফুলের বড় একটা গাছ আছে।
“আমি তো জানতামই না এখানে শিউলি ফুলের গাছ আছে!অনেকদিন হয়েছে আসি না।এর মধ্যেই মনে হয় কেও লাগিয়েছে এখানে।”
অনিমা মুগ্ধ হয়ে গাছটাকে দেখছে।ইচ্ছা করছে এক্ষুনি রুম থেকে বেরিয়ে দৌড়ে গাছটার কাছে চলে যেতে।ইশ চাঁদের আলোয় কি সুন্দরই না লাগছে গাছটাকে।একটা ফুল যদি ছুতে পারতো!নিহান অনিমার দিকে ফিরে তাকাতেই এক রাশ মুগ্ধতা দেখতে পেল অনিমার চোখে মুখে!গাছ থেকে একটা ফুল পরে যাওয়া দেখে অনিমা হাত বারালো ফুলটাকে ধরার জন্য। কিন্তু ব্যর্থ হলো সে।মুখ থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো অনিমার!একটা ফুল পরল সেই ফুলটাকে ধরতে পারলো না!নিহান দেখলো ব্যাপারটা!এরমধ্যে খাবার খাওয়ার জন্য নিচ থেকে ডাক আসলো।
“আমি খাবার নিয়ে আসছি আপনার জন্য! ”
অনিমা মাথা নাড়িয়ে বিছানায় গিয়ে বসল।কিছুক্ষন বাদেই নিহান খাবার নিয়ে রুমে এসে অনিমার সামনে বসলো।প্লেট থেকে ঢাকনা সরিয়ে ভাত মেখে লোকমা করে অনিমার দিকে এগিয়ে দিলো।
“আমি এখন আর অসুস্ত নেই!নিজের হাতে নিজে খেতে পারব।আপনি আপনার খাবার খান!কেও দেখে ফেললে কি হবে?”
“কেও দেখবে না।সবাই নিচে বসে খাচ্ছে।আর আপনাকে খাইয়ে দিতে আমার কোন অসুবিধা নেই।আপনি হা করুন।”
“কিন্তু….”
“কোন কিন্তু না! হা করুন।পরে খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
অগত্যা কোন উপায় না পেয়ে অনিমা হা করে লোকমাটা মুখের ভিতর নিয়ে নিলো।নিহান মুরগির মাংস ছিড়তে ছিড়তে বলল,
“আপনি অসুস্থ বলে আপনাকে খাওয়াচ্ছি এই কথা কে বলল?”
অনিমা অবাক হয়ে বলল,
“কেন আমি অসুস্থ বলে আপনি খাওয়াচ্ছেন না?”
নিহান লোকমা করে অনিমার গালে পুরে বলল,
“মোটেও না!আপনি অসুস্ত থাকুন আর সুস্ত থাকুন আমি সবসময় আপনাকে এভাবে খাইয়ে দিব।”
“কিন্তু কেন?”
“এতে আমি তৃপ্তি পাই!”
অনিমা গালে ভাত রেখেই অবাক হয়ে বলল,
“খাবার খাই আমি আর তৃপ্তি পান আপনি?”
“আপনি নিজের হাতে খেলে আমার মনে হয় কিছুই খাননি আপনি!পেট ভরেনি আপনার!কিন্তু আমি খাইয়ে দিলে মনে হয় আপনি পেট ভরে ভাত খেয়েছেন।আর এভাবে গালে খাবার রেখে কথা বলবেন না। ”
“কেন?”
“গালে খাবার রেখে কথা বললে আপনাকে অনেক কিউট লাগে।ফুলা ফুলা গালগুলাকে আপেলের মতো লাগে।আপেল ভেবে কখন খেয়ে ফেলি বলা যায় না।সবসময় তো আর নিজেকে কনট্রোল করা যায় না।তাই সাবধান করে দিলাম।”
কথাটা শুনেই ভাত গলায় আটকে গেল অনিমার কাশতে শুরু করলো।নিহান তাড়াতাড়ি করে গ্লাসে পানি ভরে অনিমার দিকে এগিয়ে দিলো।পানি খেতে কাশি কমলো অনিমার।গাল দুটো অলরেডি লজ্জায় লাল হয়ে গেছে।কান থেকে গরম ধোয়া বের হচ্ছে অনিমার।নিহান একটা শ্বাস ফেলে বলল,
“সামান্য কথাতেই আপনার এই অবস্তা!”
রাত ১২ টায় জানলায় ঠকঠক আওয়াজে অনিমার ঘুম ভেংগে গেলো।খাট থেকে নেমে নিচে তাকাতেই দেখলো নিহান নেই।একটু আগেই ফ্লোরে শুয়ে ছিলো।কোথায় গেলো?ভাবতে ভাবতে আবারও জানলায় আওয়াজ পরল।এত রাতে কে জানলায় নক করছে ভেবে পেলো না।জানলার দিকে এগিয়ে ভয়ে ভয়ে বলল,
‘কে?”
ওপাশ থেকে ফিসফিস করে কেও বলল,
“আমি নিহান!জানলা খুলুন।”
অনিমা অবাক হলো। এত রাতে নিহান বাইরে জানলার ওপাশে কি করছে?জানলা খুলতেই নিহান বলল,
“বাইরে আসুন।”
অনিমা অবাক হয়ে বলল,
“এত রাতে?আর তাছাড়া অরিন?”
নিহান দুই পা উচু করে উকি দিয়ে অরিনকে দেখে বলল,
“অরিন এখন ঘুমাচ্ছে।ও জাগবে না।আর জাগলেও কান্না করলে এখান থেকে শুনা যাবে।আপনি আসুন।তাড়াতাড়ি!”
অনিমা মাথায় ঘোমটা দিয়ে অরিনের দিকে একবার তাকালো।দরজা আস্তে খুলে বেরিয়ে গেলো।বাড়ির পিছনে যেতেই নিহানকে দেখলো।শিউলি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে।অনিমা কয়েক পা এগিয়ে সামনে যেতেই নিহান বলল,
” দুই হাত পাতুন।”
“কেন?”
“আহা যা বলছি তা করুন না!”
অনিমা দুই হাত পাততেই নিহান তার মুঠো করে রাখা দুই হাত অনিমার হাতের উপর রেখে ছেড়ে দিলো মুঠোয় থাকা সবগুলা শিউলি ফুল।অনিমা হাত ভর্তি শিউলি ফুল দেখে খুশিতে হেসে দিলো।
“আপনি এত রাতে সামান্য শিউলি ফুলের জন্য এখানে এসেছেন?”
নিহান দুই হাত ভাজ করে বলল,
“তো?গ্রামে এতো রাত।শহরেতো এই রাত কিছুই না।আর আপনার কাছে এই বিষয়টা সামান্য হতে পারে।কিন্তু আমার কাছে না!এইযে হাত ভর্তি শিউলি ফুল দেখে আপনার যে খুশি হবার ব্যাপারটা এই খুশি, হাসি কি আমি দেখতে পেতাম যদি সামান্য কাজটা না করতাম?”
অনিমা হেসে ফুলগুলার দিকে তাকিয়ে বলল,
একঝাঁক জোনাকি পর্ব ২৪
“ধন্যবাদ আপনাকে!আমার ইচ্ছা ছিল ফুলগুলাকে ছোয়ার।সে ইচ্ছা পুরন করার জন্য ধন্যবাদ।”
নিহান এগিয়ে এসে একটা ফুল অনিমার কানে গুজে দিয়ে বলল,
“ভালোবাসি।”