একঝাঁক জোনাকি পর্ব ২৬

একঝাঁক জোনাকি পর্ব ২৬
ইশরাত জাহান অধরা

অনিমা দুই হাত পাততেই নিহান তার মুঠো করে রাখা দুই হাত অনিমার হাতের উপর রেখে ছেড়ে দিলো মুঠোয় থাকা সবগুলা শিউলি ফুল।অনিমা হাত ভর্তি শিউলি ফুল দেখে খুশিতে হেসে দিলো।
“আপনি এত রাতে সামান্য শিউলি ফুলের জন্য এখানে এসেছেন?”
নিহান দুই হাত ভাজ করে বলল,

“তো?গ্রামে এতো রাত।শহরেতো এই রাত কিছুই না।আর আপনার কাছে এই বিষয়টা সামান্য হতে পারে।কিন্তু আমার কাছে না!এইযে হাত ভর্তি শিউলি ফুল দেখে আপনার যে খুশি হবার ব্যাপারটা এই খুশি, হাসি কি আমি দেখতে পেতাম যদি সামান্য কাজটা না করতাম?”
অনিমা হেসে ফুলগুলার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ধন্যবাদ আপনাকে!আমার ইচ্ছা ছিল ফুলগুলাকে ছোয়ার।সে ইচ্ছা পুরন করার জন্য ধন্যবাদ।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অনিমা ফুলগুলার দিকে তাকিয়ে ছিলো।ইশ কি সুন্দর ফুলগুলা।ইচ্ছা করছে সারাজীবন এভাবেই রেখে দিতে।আর নিহান গাছের সাথে হেলান দিয়ে দুই হাত ভাজ করে অনিমার খুশি হওয়ার মুহুর্তটাকে দেখছিল।যদি এখানেই সময়টা থেমে যেতো! হঠাত গাছ থেকে একটা ফুল ঝড়ে নিহানের উপর পরল।চারদিকে পছন্দ বাতাস সেইজন্যই বোধহয়।নিহান ফুলটাকে নিজের হাতে নিলো।কি একটা ভেবে অনিমার দিকে এগিয়ে গেলো।কিছুটা এগিয়ে অনিমার সামনে দাঁড়ালো।অনিমা টের পায়নি নিহান যে ওর সামনে।ও ফুলগুলাকে দেখা নিয়ে ব্যস্ত।নিহান ফুলটাকে অনিমার ডান কানে গুজে দিলো।অনিমা অবাক হয়ে তাকাতেই নিহান মৃদু হেসে বলল,

“ভালোবাসি!”
অনিমা অবাক এবার সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে গেছে সেটা ওর মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
“আমি জানি এরকম একটা সিচুয়েশনে আমার এই কথাটা বলা উচিত হয় নি। আপনিও আমাকে সেরকম ভাবে দেখেননি।তবে আপনাকে এখনই আমাকে ভালোবাসতে হবে না। আমি অপেক্ষা করব আপনার জন্য! যদি আমাকে ভালোবাসতে আপনার সারাজীবন লাগে আমি অই সারাজীবনই ওয়েট করব।আমার কোন আফসোস থাকবে না।শুধু আপনি আমার পাশে থাকবেন।আমার সাথে থাকবেন।”

নিহানের কথাগুলো শুনে অনিমার কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে।ওর এখন এই মুহুর্তে কি বলা উচিত সেটাই বুঝতে পারছেনা।
“এত রাতে অইখানে কে?”

কথাটা শুনেই অনিমা চমকে পিছনে তাকিয়ে আবার নিহানের দিকে তাকালো।নিহান কিছু না ভেবেই অনিমার হাত ধরে গাছের পিছনে লুকিয়ে গেলো।আবির টর্চ লাইট ফেলল গাছের সামনে।ভ্রু কুচকে এলো আবিরের।সে স্পষ্ট জানলা থেকে ছায়া দেখেছে।এখানে তো কারোর থাকার কথা!কেও নেই কেন?ভুল দেখলো নাকি?কিছুক্ষন এদিক সেদিক খুজাখুজি করে কাওকে না পেয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বাড়ির ভিতর ঢুকে গেলো।আবিরকে চলে যেতে দেখে নিহান একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

এই ছেলে যদি নিহান আর অনিমাকে দেখে ফেলতো নির্ঘাত সারা বাড়িতে বলে বেড়াতো।পরে নিহানকে সবাই পিঞ্চ মেরে কথা বলতো।নিহান আর অনিমার দুর‍ত্ব মাত্র কয়েক ইঞ্চির।দুজম দুজনের নিঃশ্বাস শুনতে পাচ্ছে।অনিমা নিহানের দিকে তাকালো।নিহান সামনে তাকিয়ে আছে।অনিমার কানে শুধু নিহানের একটু আগে বলা কথাগুলো বাজছে।ওর কি করা উচিত এখন?কি বলা উচিত?ছেলেটা ওর জন্য অনেক করেছে।বিয়ের আগ থেকে এখন পর্যন্ত।যখন ওর পাশে কেও ছিলো না তখন শুধু নিহানই ছিল।

সবসময় ওকে ভরসা,সাহস দিয়ে গিয়েছে। নিজের মার সাথে পর্যন্ত যুদ্ধ করেছে।আচ্ছা ও কি নিহানকে ঠকাচ্ছে?অধিকার থেকে দুরে রাখছে?এসব কথা মাথায় আসতেই অনিমা একটা কাজ করে বসলো।নিহানের গালে নিজের ডান হাত দিয়ে ওর দিকে ফিরালো।একটু এগিয়ে গিয়ে নিহানের ঠোটে নিজের ঠোট ডুবিয়ে দিলো।অনিমার উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে নিহানের চোখ বড় হয়ে গেলো।এক্ষুনি যেন অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসবে।মনে হচ্ছে স্বপ্ন।হার্টবিট কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে নিহানের সাথে নিঃশ্বাসও।কয়েক সেকেন্ড পর অনিমার হুশ আসতেই সরে এলো নিহানের থেকে।এটা সে কি করে ফেলল?অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,

“অরিন কান্না করছে।আমি যাচ্ছি।”
বলেই চলে গেলো।এক প্রকার দৌড়েই চলে গেলো বাড়ির দিকে।নিহান এখনো স্তব্ধ হয়ে বসে আছে ঠোটে নিজের হাত দিয়ে। অনিমা কি সত্যিই একটু আগে নিহানকে স্পর্শ করলো?বিশ্বাস হচ্ছে না ওর।আচ্ছা ও জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে না তো?ভেবেই নিজের গালে চিমটি কাটলো।নাহ!অনিমা সত্যিই ওকে কিস করেছে!ভেবেই মন আনন্দে ভরে উঠলো।খানিকটা লজ্জাও লাগছে।জীবনের ফাস্ট কিস ওর!এত খুশি কই রাখবে ও?নাচতে মনে চাচ্ছে!কিন্তু নিজেকে দমিয়ে নিলো।এত রাতে নাচলে কেও দেখলে নির্ঘাত ভাববে ওকে জিনে ধরেছে!

অনিমা রুমে চলে এসে একটা বড় শ্বাস নিলো।এটা সে কি করলো, কেন করল মাথাতেই আসছেনা।অরিনের দিকে তাকালো।ঘুমাচ্ছে! ইচ্ছা করেই মিথ্যা বলেছে।নইলে আসতে পারতোনা।নিহানের আসার শব্দ শুনে অনিমা দৌড়ে বিছানায় শুয়ে পরল!অরিনের পাশে।চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল খিচে।যাতে নিহান ভাবে সে ঘুমিয়ে আছে।নইলে যদি প্রশ্ন করে তাহলে কি উত্তর দিবে?নিহান খুশি মনে ঘরে ঢুকতেই দেখলো অনিমা শুয়ে আছে চোখ বন্ধ করে!নিহান বুঝতে পারছে অনিমা আসলে যে ঘুমায়নি বরং ঘুমের বাহানা করছে।হাসি এলো ওর।নিচে শুতে শুতে বলল,
“আমি জানি আপনি ঘুমাননি।কারন আপনার চোখের পাতা দ্রুত নড়ছে।একজন ডাক্তারকে বোকা বানাচ্ছেন?”

নিহানের কথায় অনিমা পাত্তা দিলো না।এখন পাত্তা দিলেই বিপদ।অনিমার কোন উত্তর না পেয়ে নিহান চোখ বন্ধ করলো।এখন আর অনিমাকে ঘাটাতে ইচ্ছা করছেনা।তাই ঘুমটাকেই শ্রেয় মনে করলো।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নিহান দেখল অনিমা ঘুমাচ্ছে।তাই আর ডাক দিলো না।ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখল অনিমা ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে।

“নিচে ডাকছে আপনাকে ব্রেকফাস্টের জন্য।”
“অরিন?”
“আমার কাছে থাকবে।”
“আচ্ছা।”
“তাহলে ফ্রেশ হয়ে নিন।”
অনিমা কিছু না বলে ওয়াশরুমে চলে গেলো।দরজা বন্ধ করেই একটা শান্তি নিঃশ্বাস ফেলল।যাক গতকাল রাতের ব্যাপারে কোন কথা তুলেনি নিহান।
অনিমা ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখল নিহান বসে আছে বিছানায়।অনিমা মুখ ফুটে বলল,
“চলুন।”

নিহান বসা থেকে উঠে অরিনকে কোলে নিলো।জেগে আছে সে।নিচে নেমে অনিমাকে চেয়ারে বসিয়ে নিজে বাচ্চাটাকে নিয়ে পাশে বসে পরল।নিহান অরিনকে এক হাতে কোলে রেখেছে আরেক হাতে সে খাচ্ছে খাওয়ার মাঝেই আবির বলল,
“নিহান কালকে রাতে বাগানে চোর ঢুকেছিলো।টের পেয়েছিলি?”

ব্যাস এই কথা শুনেই অনিমার খাবার নাকে মুখে উঠে গেলো।নিহান সামনে থেকে একটা পানির গ্লাস অনিমার দিকে এগিয়ে দিলো।অনিমা পুরো পানির গ্লাসটা এক চুমুকেই শেষ করে ফেলল।আবির ভ্রু কুচকালো।চোরের কথা শুনে ভাবির কেন বিষম খেলো বিষয়টা মাথায় আসলোনা।
“না টের পাইনি।ধরতে পেরেছিস চোরটাকে?”
ঠোট উল্টে আবির বলল,
“নাহ!মনে হয় আমার আসার টের পেয়েছিল তাই পালিয়ে গেছে।”
“আহারে!”

“কথায় কথায় বিষম খাওয়াটা কি আপনার রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে অনিমা?”
নিহানের কথা শুনে নিহানের দিকে তাকালো। না বুঝে বলল,
“মানে?”
অরিনকে নিয়ে বিছানায় বসতে বসতে বলল,
“এই নিয়ে আপনি কয়বার বিষম খেয়েছেন আপনি জানেন?খাবার মাঝে কোন কথা উঠলেই আপনার বিষম উঠে!”
অনিমা কিছু না বলে চুপ করে রইল।
“আজকে বিকালেই আমরা চলে যাবো।রেডি থাকবেন।”
“হুম।”
“আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”
“বলেন!”

“অইদিন মারিয়া যে বলল আপনার ১৫ বছরের ভালোবাসা যাকে আপনি ১৫ বছর ধরে ভালোবেসে এসেছেন ওর এখন কি খবর?মানে কোন যোগাযোগ আছে?”
অনিমার কথা শুনে নিহান মনে মনে হাসলো।
“নাহ!”
” অহ আচ্ছা।”
“আপনার কোন ফাস্ট লাভ ছিলো?”
“নাহ!”
“সবার জীবনেই কেও না কেও প্রথমে আসে। আমার জীবনেও তেমনি মেয়েটা এসেছিলো।”

নিহানের কথা শুনে অনিমার রাগ হলো অনেক।মুখ ফুলিয়ে বলল,
“এতোই যখন ভালোবাসেন তখন ওকে বিয়ে করলেই পারতেন!”
“সুযোগ পেলে ওকেই বিয়ে করতাম কিন্তু সুযোগটাই ছিলো না। ”
“অহ আচ্ছা।মেয়েটার নাম কি?”
“বলা যাবে না।”
“কেন?অই মেয়ে মানা করেছে?”
অনিমার কথা শুনে নিহান এবার হেসে দিলো।নিহানকে হাসতে দেখে অনিমার ভ্রু কুচকে এলো।এটা কি হাসির কথা ছিলো যে নিহান হাসছে!

“আমি কি কোন হাসির কথা বললাম যে আপনি হাসছেন?”
নিহান হাসতে হাসতেই বলল,
“হ্যা!তা না হলে কি?”
“এটা কিভাবে হাসির কথা হলো?”
নিহান হাসি থামিয়ে বলল,
“আপনি যে মেয়েটার কথা বলছেন আইমিন আমার ফাস্ট লাভ অই মেয়েটার সাথে তো আমার যোগাযোগই নেই।তাহলে ও কি করে আপনাকে ওর নাম বলতে মানা করবে?”
অনিমা কিছু না বলে চুপ করে রইলো।নিহান বুঝল অনিমা জেলাস ফিল করছে।জেলাস ফিল আরও করানোর জন্য নিহান বলল,

“আসলে ওকে যেভাবে ভালোবেসেছিলাম সেভাবে এই পর্যন্ত কাওকেই ভালোবাসতেই পারি নি।”
“তাহলে গতকাল রাতে যে আমাকে বললেন আমাকে ভালোবাসেন সেটা কি মিথ্যা ছিলো?”
“আপনাকে ভালোবাসি না এটা কে বলল?আমি বলেছি ওর মতো কাওকে আর ভালোবাসতে পারি নি।”
“কথাটার মানে কি এটা বুঝায় না আপনি গতকাল রাতে মিথ্যা বলেছেন?”
“নাহ!আমি ওকে যেমন ভালোবাসি আপনাকে তেমন ভালোবাসি।”
অনিমার রাগ হলো।মনে হলো নিহান আসলেই ক্যারেকটারল্যাস!নইলে একসাথে দুইজনকে কিভাবে ভালোবাসে?মুখ গম্ভীর করে বলল,
“আমাকে আপনার ভালোবাসতে হবে না।অই মেয়েকে ভালোবাসেন তাহলেই হবে।”
“আচ্ছা।”

নিহানের কথা শুনে অনিমা অবাক হয়ে গেলো।ওর কথায় রাজিও হয়ে গেলো?অনিমা কথা বলা থামিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।এছাড়া আর কোন উপায় ছিলো না।অনিমার কান্ড দেখে নিহান হেসে দিলো।আহারে!বোকা মেয়েটা জানেও না সে কার উপর রাগ করছে!বাথরুমের আয়নার সামনে নিহানকে ইচ্ছামতো বকে বাথরুম থেকে বের হলো।সামনে তাকাতেই দেখল নিহান অরিনের সাথে খেলছে।কই লোকটাকে দেখে তো বুঝাই যায় না লোকটা তলে তলে এমন।বাইরে এমন ভাব দেখায় যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না!
“ওয়াশরুমের সামনে দাঁড়িয়ে কি ভাবছেন?”

একঝাঁক জোনাকি পর্ব ২৫

নিহানের কথায় হুশ আসলো অনিমার।হঠাত নিহান বসা থেকে উঠলো। এগিয়ে গেল অনিমার দিকে।অনিমার ভ্রু কুচকে এলো।এই লোক এখন ওর দিকে এগিয়ে আসছে কেন?কয়েক পা এগিয়ে অনিমার সামনে এসে দাঁড়ালো।ওদের মাঝে এখন আর কয়েক ইঞ্চির দুরত্ব।অনিমা পিছাতে পিছাতে ওয়াশরুমের দরজার সাথে পিঠ লেগে গেছে।অনিমাকে অবাক করে দিয়ে নিহান……

একঝাঁক জোনাকি পর্ব ২৭