একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৩৫
জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
চারদিকটা কপাল কুঁচকে দেখল শশী। মায়ের কাছে গিয়ে ক্ষীণ আওয়াজে বলল,
‘তোমার ভাতিজার কী এক পছন্দ! বাড়ি-ঘর দেখেছ?’
নাক ছিটকান জিনিয়া বেগম। কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
‘কম তো বোঝানো হয়নি? না বুঝলে আর কী করার?’
শশী আশেপাশে নজর বুলাতে বুলাতে বলল,
‘বুঝো না, ঐ মেয়ে জাদু করেছে। নয়তো ওর মতো মেয়ের কোনো যোগ্যতা আছে না-কি মাহিরের বউ হওয়ার।’
এই বলে সে সোফায় বসে থাকা মাহিরের দিকে তাকায়। শুভ্র রাঙা এক পাঞ্জাবী গায়ে সে। পাঞ্জাবীতে ভারী সুতার কাজ। মাথায় সাদা টুপি। মুখে প্রসন্ন হাসি। ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার খুশি চোখে মুখে যেন উপচে পড়ছে তার। ধারাল চিবুকে ছোট দাড়ির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে শশী তাকাল তার ঠোঁটের দিকে। বড্ড আফসোস হলো তার। একজন পুরুষ মানুষের ঠোঁট এত সুন্দর কেন? আর এই সুন্দর ঠোঁটের ছোঁয়া সে কেন পেল না? কী এমন কমতি আছে তার? শশীর চোখ মুখ দৃঢ় হয়ে আসে। সব হয়েছে ঐ অন্বিতার জন্য। এতকিছু করেও অন্বিতাকে মাহিরের জীবন থেকে সরানো গেল না। এসব ভাবলেই এখন রাগে গা রি রি করে তার।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কাজী সাহেব সহ আরো তিন চারজন ভদ্রলোক অন্বিতার রুমে গেলেন। মাঝে একটা চাদর ধরা হলো। অন্বিতার পাশে আভা। কাজী সাহেব নিকাহ নামা পড়ে “কবুল” বলতে বললেন। অন্বিতার শরীর কাঁপছে। হৃদস্পন্দন বেড়েছে। বুকের ধরাস ধরাস শব্দ যেন আভাও টের পাচ্ছে। সে এক হাতে অন্বিতার হাত যুগল আগলে ধরে তাকে আশ্বাস দিয়ে বলে,
‘ভয় পাস না। একটা চমৎকার ভবিষ্যতের সূচনা ঘটতে চলেছে।’
অন্বিতা ভয় পাচ্ছে না ঠিক, তবে সারা শরীরে অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করছে। মাথার উপর ফ্যান থাকা স্বত্ত্বেও ঘামছে সে। আভা টিস্যু দিয়ে মুছে দিচ্ছে সেই স্বেদজল। ওপাশ থেকে কাজী সাহেবের গলার স্বর এল। তিনি ক্রমাগত “কবুল” বলতে বলছেন। অন্বিতার খালাও পাশে ছিলেন তার। তিনিও অন্বিতাকে অভয় দিলেন। সিক্ত অন্বিতার অক্ষিযুগল। কান্না গলার কাছটাই আটকে আছে। ভালোবাসার মানুষকে পেতে চলেছে এর থেকে আনন্দের আর কী হতে পারে? তাও সেই চমৎকার সত্যটুকু স্বীকার করতে কেন এত জড়তা, এত দ্বিধা। সে ঢোক গিলল পরপর কয়েকটা। একবার তাকাল আভার দিকে আরেকবার খালার দিকে। বেদনাবিধু স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘মা কোথায়, খালামনি?’
খালামনি উত্তর দিলেন,
‘আপা আছেন। তুমি কবুল’টা বলে দাও। উনারা অপেক্ষা করছেন তো।’
অন্বিতা ধাতস্ত করল নিজেকে। মনের অস্থিরতা কমানোর মেকি চেষ্টা চালাল খানিক। একবার চোখ বুজল, অক্ষিপটে ভেসে উঠল মাহিরের হাস্যজ্জ্বল মুখখানা। তার প্রেম নিবেদনের মুহুর্তটা। কী চমৎকার করে সেদিন বলেছিল, “আমি তোমায় ভালোবাসি, অন্বি। ভীষণ ভালোবাসি।”
চোখ খুলল সে। ভয়, অস্থিরতা, জড়তা, ক্লেশ সব আস্ফালন করে সে বলে উঠল,
‘আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।’
তারপর আরো দুই বার। ততক্ষণাৎ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল খুশির আমেজ। এতক্ষণ নিরুত্তাপ হয়ে বসে ছিল মাহির। অন্য রুমে থাকলেও কান সজাগ ছিল তার। পাশের রুম থেকে হৈ হৈ শব্দ আসতেই হাসল সে। চিত্ত জুড়ে বয়ে গেল উন্মাদনা। অবশেষে তার প্রিয়তমাকে সে পেল তার স্ত্রী হিসেবে।
অন্বিতার রুম ছেড়ে সবাই বেরিয়ে যেতেই আসিয়া বেগম সেখানে এলেন। তাকে দেখা মাত্রই অন্বিতা বিছানা থেকে নেমে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাঁকে। কেঁদে ফেলল। বাধ ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ল মা আর মেয়ে। তাদের দেখে আভা আর অন্বিতার চোখও ভিজে উঠল যেন। অন্বিতা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘আমি এখান থেকে চলে গেলে তোমার খেয়াল রাখবে কে, মা? তুমি এখানে একা একা কী করে থাকবে?’
অন্বিতাকে ছেড়ে তার মুখ আগলে ধরলেন আসিয়া বেগম। কান্না দমিয়ে রেখে প্রসন্ন গলায় বললেন,
‘তুই কি একেবারের জন্য চলে যাচ্ছিস না-কি? যখন ইচ্ছে এখানে চলে আসবি। আর আমারও যখন ইচ্ছে হবে তোর কাছে চলে যাব। তাই একদম এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করবি না।’
‘আমি চলে গেলে তুমি কিন্তু ঠিক মতো ঔষধ খাবে। অনিয়ম করবে না একদম।’
নাক টেনে বলল অন্বিতা। কন্ঠে উপচে পড়ছে মা’কে ছেড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা। আসিয়া বেগম তার গালে হাত বুলিয়ে বললেন,
‘সব ঠিক মতো করব। তুই কোনো চিন্তা করিস না। শুধু নিজের জীবন আর সংসারটাকে সুন্দর ভাবে সামলে নিস, তাহলেই হবে।’
‘দোয়া করো, মা।’
আসিয়া বেগম তার কপালে চুমু দিয়ে বললেন,
‘মায়ের দোয়া সবসময় তোমার পাশে আছে।’
আভা অন্বিতাকে নিয়ে বসার ঘরে এল। মাহির তার মামার সাথে কথা বলছিল তখন। অন্বিতার আগমন অচিরাৎ কম্পন ধরাল তার চিত্তে। বাড়ির বড়োরা আছে বলে ঠিক মতো চেয়েও থাকতে পারছে না। মামা হেসে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,
‘অন্বিতা মা’কে এখানে এনে বসাও।’
মাহিরের পাশের জায়গাটা ছাড়লেন তিনি। আভা অন্বিতাকে মাহিরের পাশে বসাল। অপর পাশের একটা সোফায় জিনিয়া বেগম আর শশী বসা। দুজনেই বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে বসে আছেন। যেন পৃথিবীর তিক্ত এক সত্যকে নিজ চোখে দেখছেন তারা। তাদের এহেন মুখ দেখে মিটিমিটি হাসছে তাইভিদ। শশী নাক মুখ কুঁচকে অন্বিতাকে আপাদমস্তক পরখ করল। গায়ে লাল টুকটুকি বেনারসী দেখে বিড়বিড় করে বলল,
‘একটা শাড়ির পেছনেই বোধ হয় সব টাকা খরচ করে ফেলেছে।’
তারপর তাকাল মুখের দিকে। তার চোখে আহামরি কোনো সৌন্দর্য ঠেকল না। ঐ তো কাজলে ভাসা চোখ আর লাল আভার ঠোঁট। কী আছে এতে? মাহিরের মন এইটুকুতেই ভরে গেল? ফুঁস করে নিশ্বাস ফেলল সে। কাষ্ঠ হেসে মনে মনে ভাবল, এই ক্ষীণ রূপের আমেজ মজে গেলেই মাহিরের মনও উঠে যাবে। তখন অবহেলা, অবলীলায় জর্জরিত অন্বিতাকে দেখে মনে বড্ড প্রশান্তি আসবে তার।
জিনিয়া বেগম রোষপূর্ণ চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মেয়েকে ফিসফিসিয়ে বললেন,
‘অন্বিতার হাতে দেখ, আমার মায়ের বনেদী বালা। কত দামী এগুলো জানিস? ভেবেছিলাম তোর হাতে দেখব। তা আর হলো না।’
রাগে গলার স্বর কাঁপছে তার। শশী বালাগুলো একবার দেখে বলল,
‘নানু মারা যাওয়ার পর তুমি নিয়ে নিতে পারোনি? তাহলেই তো আজ এগুলো অন্যকারোর হাতে যেত না।’
জিনিয়া বেগম চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
‘আমি কি আর জানতাম না-কি, এই বালা এই মেয়ের হাতে উঠবে। জানলে তো কবেই সেগুলো হাতিয়ে নিতাম।’
অন্বিতার খালা এসে বললেন,
‘আপনারা এবার খেতে চলে আসুন। আভা, সবাইকে নিয়ে ডাইনিং-এ এসো।’
অন্বিতা একবার চোখ তুলে আশাপাশটা দেখল। তারপর ইতস্তত সুরে তার খালাকে বলল,
‘খালামনি, আরো দুজন মেহমান আসার কথা ছিল। উনারা বোধ হয় এখনও আসেননি। আমরা একটু উনাদের জন্য অপেক্ষা করি?’
বাইরের কেউ আসবে বলে খালা জানতেন না। তাই অবাক হলেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন,
‘কারা আসবেন, অন্বিতা?’
‘আমাদের প্রতিবেশী দুজন। আমি উনাদের দাওয়াত দিয়েছিলাম।’
‘আপা জানেন?’
‘জি। আমি মা’কে বলেছি।’
‘আচ্ছা আচ্ছা, তাহলে মাহির’রা বসে যাক। উনারা আসলে না হয় পরে বসবেন।’
মাহির প্রসন্ন গলায় বলল,
‘সমস্যা নেই, খালামনি। উনারা আসলে আমরা বরং একসাথেই বসব।’
‘আপনারা কি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন?’
দরজায় কারোর গলার স্বর পেয়ে সেদিকে তাকায় সবাই। আর কেউ চিনতে না পারলেও মাহির অন্বিতার চিনতে বেগ পোহাতে হয়নি। অন্বিতার ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি। মাহির অবাক হয়নি, সে যেন এমনটাই আশা করেছিল। অন্বিতা হেসে বলল,
‘জি, আপনাদের’ই অপেক্ষায় ছিলাম। ভেতরে আসুন।’
অমিত ভেতরে আসার পূর্বে একবার পেছনে চেয়ে বলল,
‘আয়, দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’
তার পেছন পেছন শম্বুক গতিতে আরো একজনের আগমন ঘটে। শশী ভ্রু কুঁচকে মায়ের দিকে চেয়ে বলে,
‘এরা কারা?’
একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৩২
জিনিয়া বেগম বিরক্তির সুরে বললেন,
‘তা আমি কী করে বলব?’
অন্বিতা উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘পরিচয় করিয়ে দেই, উনারা আমাদের প্রতিবেশী। উনি অমিত আর উনি অয়ন।’