একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৩৬
জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
‘তাহলে সেই ব্যক্তি অমিত নয় অয়ন?’
চোখ তুলে তাকাল অন্বিতা। সদ্য কান্নায় ভেজা পিঙ্গলবর্ণ চোখে চেয়ে কিঞ্চিৎ হাসল মাহির। অন্বিতার এক হাত টেনে নিজের মুঠোয় ভরল। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল,
‘এই যে ধরেছি, পৃথিবীর আর কোনো শক্তি এই বন্ধন ছিন্ন করতে পারবে না।’
বিষাদ সিন্ধু চিত্ত জুড়ে এক টুকরো স্বস্তির ঢেউ আছড়ে পড়ল। অন্বিতা অপর হাত এগিয়ে রাখল তাদের হাত জোড়ার উপর। প্রশ্ন করল,
‘সত্যি তো?’
মাহির ঠোঁট চেপে মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘তিন সত্যি।’
অন্বিতা পরম আবেশে তার মাথা হেলিয়ে দেয় মাহিরের বাহুতে। মাহিরের হাত যুগলের মাঝে এখনও তার হাত। অন্বিতা পরিশ্রান্ত স্বরে বলল,
‘অয়ন আমাকে পছন্দ করতেন। আমাকে এটা দুইদিন আগে অমিত জানিয়েছেন।’
মাহিরের মাঝে তেমন ভাবান্তর এল না। অন্বিতাকে সে পেয়ে গিয়েছে একেবারের জন্য। মেয়েটা এখন কেবল’ই তার অধিকার। কেউ চাইলেই তা হরণ করতে পারবে না। তাই কে পছন্দ করল বা না করল তাতে তার কিছু যায় আসে না। সে জানে, অন্বিতার জীবনে তার বাবার পর এখন সবথেকে প্রিয় পুরুষ তার স্বামী। এই স্থান কখনও দ্বিতীয় কেউ নিতে পারবে না। অন্বিতার হাতে আলতো হাত বুলিয়ে সে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘তোমার কি আফসোস আছে?’
মাথা তুলে চকিতে তাকাল অন্বিতা। ভীত সুরে বলল,
‘আফসোস? কীসের আফসোস?’
অন্বিতার ভয়ার্ত, চুপসানো মুখ দেখে হাসল মাহির। মনের মধ্যে তার বিশ্বাসের দৃঢ়তা বাড়ল। প্রসন্ন গলায় বলল,
‘অয়ন ভালো ছেলে। কয়দিনের পরিচয়ে আমার তাই মনে হয়েছে। ও তোমাকে পছন্দ করে সেটা ওর কোনো ব্যবহারে আমি বুঝতে পারিনি। তবে আজ তুমি আলাদা কথা বলতে চাওয়াতে আমি ব্যাপারটা টের পেলাম।’
অন্বিতা ক্ষীণ সুরে বলল,
‘আমি শুধু উনাকে বুঝিয়েছি, আর কিছুই না।’
মাহির এগিয়ে এসে অন্বিতার ললাটে গভীর চুম্বন এঁটে দিয়ে বলল,
‘তোমাকে আমি বিশ্বাস করি, অন্বি। তাই আর এত জড়তা দেখাতে হবে না।’
মাহিরের ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে ব্রীড়ায় আরক্ত হলো অন্বিতা। চোখ নামিয়ে ফের মাহিরের বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে বলল,
‘আমি তোমার এই বিশ্বাস আজীবন অক্ষুন্ন রাখব। তবে আপনার বোন শশী, সে তো ব্যাপারটা ঘোলাটে করতে চাইবে।’
‘চিন্তা করো না। আমি সামলে নিব সব।’
অন্বিতা মুচকি হেসে চোখ বুজল। মনে ভীষণ শান্তি অনুভূত হচ্ছে। সুখ সুখ আমেজ যেন চারদিকে। মাহির পাশে হেলান দিয়ে বসে তার প্রিয়তমার স্ত্রীর অস্তিত্ব অনুভব করছে। চিত্ত জুড়ে বয়ে চলছে অদ্ভুত শিহরণ। কত বিধ্বস্ত রাত, কত মুমূর্ষু দিন কাটিয়ে আজ এক হয়েছে তারা। এবার খুঁটি বসিয়েছে শক্ত করে, যেন ঝড় কিংবা ভূমিকম্প, কোনোকিছুতেই সেই খুঁটির অস্তিত্ব না সরে।
মাহিরের গাড়ির পেছনে আরেকটা গাড়ি যাচ্ছে। সেটাতে শশী। চিন্তা শক্তি সমস্ত খুইয়ে দিচ্ছে একটা ঘটনার বিবরণ সাজাতে। অন্বিতা কেন অয়ন নামের ছেলেটাকে আলাদা ডাকল? কী কথা বলল তারা দুজন? মাহির কেন কিছু বলল না? সামান্য প্রতিবেশীর সাথে এমন কী কথা থাকতে পারে তার? শশী চঞ্চল চোখে রাস্তায় তাকায়। উফ, বাসায় কখন যাবে। মা’কে সব না বলা অবধি শান্তি পাচ্ছে না সে।
পেছন পেছন হেঁটে যেতেই হঠাৎই থমকাল। পা থামিয়ে দিল আভা। খানিকটা ঘাবড়ে একটু সরে দাঁড়াল। পেছন ফিরে তাকাল অয়ন। ভ্রু কুঁচকাল। বলল,
‘আপনাকে আমি দেখতে পাচ্ছি, বেরিয়ে আসুন।’
একটা বৈদ্যুতিক খুঁটির পেছনে লুকিয়ে ছিল আভা। অয়নের কথা শুনে জিভ কাটল। কাচুমাচু করে বেরিয়ে এল সে। অয়ন আপাদমস্তক দেখল তাকে। জলদগম্ভীর স্বরে শুধাল,
‘আপনি অন্বিতার বান্ধবী না?’
আভা ত্বরিতে মাথা দুলায়। কুঁচকানো ভ্রু সোজা করে অয়ন। অন্বিতার বিদায়ের পর অমিত বাসায় চলে গেলেও সে আর যায়নি। মন মেজাজ ঠিক নেই বলে রাস্তার পাশে হাঁটছিল। আর তখন থেকেই মনে হচ্ছিল কেউ একজন অনুসরণ করছে তাকে।
সে গুমোট স্বরে বলল,
‘আমাকে ফলো করছিলেন কেন?’
আভা নতমস্তকে হাত কঁচলাচ্ছে। অস্থির অস্থির লাগছে তার। ঠোঁট কামড়ে একবার অয়নকে দেখে আবার চোখ নামায়। বিরক্ত হচ্ছে অয়ন। সে উত্তর না পেয়ে হাঁটা ধরে। আভার সংবিৎ ফেরে তখন। ছুটে যায় অয়নের কাছে। পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
‘একটা কথা ছিল।’
পা থামায় অয়ন। আভার দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করে,
‘কী কথা?’
আভা আমতা আমতা করে বলে,
‘আপনার ফেসবুক আইডি’টা একটু দেয়া যাবে?’
কপালে ভাঁজ পড়ে অয়নের। সন্দিগ্ধ চোখে আভাকে দেখে। আভা অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে। অয়ন স্বাভাবিক গলায় বলে,
‘আমার ফেসবুক নেই।’
বড়ো বড়ো চোখে তাকায় আভা। বিস্ময়াবিষ্ট সুরে বলে,
‘এই যুগে এসে আপনার ফেসবুক নেই? কী আশ্চর্য!’
অয়ন উত্তর না দিয়ে আবার হাঁটতে উদ্যত হয়। আভা ফের তাকে আটকে বলে,
‘হুয়াট’স অ্যাপ আছে নিশ্চয়?’
‘না।’
অয়নের স্বাভাবিক জবাবে অস্বাভাবিক বিরক্ত হলো আভা। ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
‘ফোন নাম্বার আছে তো, না-কি সেটাও নেই?’
অয়ন তপ্ত গলায় শুধায়,
‘এসব দিয়ে আপনার কী কাজ?’
ধমক দিল না-কি? আভার চোখ মুখ ম্লান হলো। সে ক্ষীণ সুরে বলল,
‘আপনার সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য।’
‘আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে চাওয়ার কারণ?’
আভা উত্তর পেল না এবার। যোগাযোগ রাখতে চাওয়ার কারণ অনেক। তবে সেসব এই ছেলেকে এখনই বলা যাবে না। তাই ছোট্ট করে শুধু বলল,
‘এমনি।’
‘উপযুক্ত কারণ ছাড়া আমি অপরিচিত কাউকে আমার ফোন নাম্বার দিই না।’
আভা উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘আমি অপরিচিত নয়। আমি অন্বিতার একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড।’
‘অন্বিতার বেস্ট ফ্রেন্ড অন্বিতার পরিচিত, আমার না। আসি।’
ফের হাঁটা ধরল অয়ন। মুখ ভার হলো আভার। হৃদয় ব্যথিত হলো সূক্ষ্ম ছ্যাঁকায়। চোখে মুখে উপচে পড়া দুঃখ নিয়ে বলল,
‘আপনার নাম্বার আমি নিয়েই ছাড়ব।’
অয়ন শুনতে পেল কি-না কে জানে। সে আর ফিরে তাকাল না। আভাও চলে গেল বিপরীত পথে।
অনিচ্ছা, অসম্মতিকে এক কোণে দমিয়ে রেখে জিনিয়া বেগম অন্বিতা আর মাহিরকে বরণ করে ঘরে তুললেন। মুখে তার কৃত্রিম হাসি আর কারো নজরে না পড়লেও অন্বিতার নজরে ঠিকই পড়ল।
নতুন বউ জুড়ে যেমন হৈ চৈ, হুল্লোর, উত্তেজনা, চঞ্চলতা থাকে এই বাড়িতে তা তেমন একটা নেই। বিয়ে বাড়িটা ম্লান। অন্বিতার শ্বশুরবাড়ির মানুষ বলতে আজ আছে মাহিরের দাদু, ফুপি, ফুপাতো বোন আর মামা। ঘরের কাজের লোকেরা একটু ব্যস্ত হলেও তেমন আড়ম্বরতা দেখাচ্ছে না। অন্বিতাকে ঘিরে নেই কোনো আয়োজন। জিনিয়া বেগম যে বরণ করে রুমে গিয়েছেন আর আসেননি। তার পেছন পেছন গিয়েছে শশীও।
বসার ঘরে সোফায় দাদু, মামা, অন্বিতা আর মাহির বসা। কাজের লোকেরা নাস্তা এনে সাজিয়েছে। অন্বিতার মধ্যে ঠিক বউ বউ জড়তাটা কাজ করছে না। এই বাড়িতে আগেও একবার এসেছিল। সেদিন এসেছিল প্রেমিকা হিসেবে। আর আজ এসেছে বউ হয়ে। বসার ঘরে ডানের খালি দেয়ালে বড়ো ছবিখানার দিকে তাকাল সে। ঠোঁট কোণে ঝুলাল অমায়িক হাসি। ছবিতে মাহিরের মা বাবা। শুনেছে, মাহির খুব ছোটবেলায় মা বাবা হারিয়ে এতিম হয়েছে। মা’র পক্ষে মামা আর বাবার পক্ষে দাদু, ফুপিকে ছাড়া সে তার এই জীবনে আর কাউকে চেনে না। এই মানুষগুলোই বড়ো করেছে তাকে। বিশেষ করে দাদু। ছোট থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া অবধি মানুষটা ঠায় তার পাশে ছিল।
নিগূঢ়, নিষ্পলক চোখে ছবিটা একটুক্ষণ দেখে মলিন হাসল অন্বিতা। ভাবল, “আজ এই দুজন মানুষ বেঁচে থাকলে হয়তো তাদের বিয়েটা আরো চমৎকার হতো। চমৎকার হতো তাদের সংসার জীবন।”
একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৩৫
মামা চশমাটা চোখে ঠেলে বললেন,
‘মাহির, অন্বিতাকে নিয়ে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।’
মাহির মাথা নাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। অন্বিতার দিকে চেয়ে বলল,
‘চলো।’
কেন যেন লজ্জা পেল অন্বিতা। সে এখন মাহিরের রুমে যাবে, যে রুমটা আজ থেকে তারও। অযথা লজ্জা পাওয়া বদনে উঠে দাঁড়াল সে। শম্বুক গতিতে এগুলো মাহিরের পেছন পেছন।