একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৫৩
জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
সময় এখন দ্বারপ্রান্তে। দুই কী তিন দিন আছে হয়তো অন্বিতার ডেলিভারির। মেয়েটার আজকাল মন ভালো থাকে না। কিছু একটা নিয়ে খুব বেশি দুশ্চিন্তা করে। তার দেখভালের জন্য এই সময়টাতে মাহিরও তার নার্সিংহোম থেকে ছুটি নিয়েছে। অন্বিতাকে সে চোখের আঁড়াল হতে দেয় না। তাও কী জানি কী হয়েছে, রাত হলেই মেয়েটা কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে যায়। মাহির বোঝে, হয়তো ভয় আর দুশ্চিন্তা থেকে এমন করে। সে বোঝায় অন্বিতাকে। তার কথা শুনে সে কিছুক্ষণ থ মেরে থাকলেও একটু পরেই আবার শুরু হয় এসব।
সকালেই মন ভালো করার জন্য অন্বিতার জন্য এক বক্স আইসক্রিম এনেছে মাহির। তবে একটা আইসক্রিমও তাকে ধরতে দেয়নি। বলেছে, দুই দিন পর তার ছেলে মেয়েকে সাথে নিয়ে যেন এই আইসক্রিম খায়। অন্বিতা তার সেই কথা শুনে হাসে। জিজ্ঞেস করে,
‘তোমার বাচ্চারা বুঝি পৃথিবীতে এসেই আইসক্রিম খাওয়া শুরু করবে?’
মাহির তখন আপ্লুত সুরে বলে,
‘তাদের মা খেলেই তাদের খাওয়া হয়ে যাবে।’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পেটে হাত রেখে বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে আছে অন্বিতা। মাহিরের কাজকর্মে সে হতভম্ব, হতবাক। এই ছেলে এক ঘর পুরো খেলনায় ঠেসে দিয়েছে। রুমে দাঁড়ানোর জায়গাটুকু নেই। আজও আবার এক কার্টুন এনেছে। অন্বিতা আর দাঁড়াতে পারল না। চেয়ারে বসল শ্লথগতিতে। বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,
‘খেলনার দোকান দিয়ে ক্ষান্ত হওনি, এখন কি গোডাউন দিতে চাও?’
মাহির খেলনাগুলো গুছিয়ে রাখছে। অন্বিতার কথা শুনে হাসে সে। মনটা আজকাল তার ভীষণ ফুরফুরে। এই তো আর দুটো দিন, তারপরে কোল জুড়ে দু’টো ছোট্ট তুলতুলে পুতুল নিয়ে সে বাড়িময় ঘুরবে। তাদের নরম গালে ভালোবাসার পরশ আঁকবে। এতসব খেলনা নিয়ে খেলতে বসবে। সেসব ভেবে তার যেন আর তর সইছে না।
জবাবে সে বলল,
‘পারলে তাই করব।’
অন্বিতা কপাল কুঁচকে বলল,
‘একদম না। অতিরিক্ত খেলনা কিনে টাকা অপচয় করার কোনো মানে হয় না। এমনিতেই ওদের অনেক খেলনা হয়ে গিয়েছে, আর একটাও কিনবে না।’
মাহির খেলনা রেখে অন্বিতার সমীপে হাঁটু ভাঁজ করে বসল। তার ভরাট পেটের দিকে চেয়ে বলল,
‘দেখেছিস, তোদের মা কী কিপ্টে! আমাকে দুটো খেলনা কিনতে দেয় না।’
‘দুটোর কথা বলে বলে আজ পুরো ঘর তুমি ভরিয়ে ফেলেছ।’
‘তাতে কী? আমার বাচ্চাদের জন্য আমি আরো খেলনা কিনবে। তুমি একদম বাঁধা দিবে না।’
অন্বিতা মাথা নাড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই লোককে বুঝিয়ে লাভ নেই। ইদানিং সে নিজেও বাচ্চা হয়ে গিয়েছে। বাচ্চারা পৃথিবীতে আসার আগেই তাদের জন্য আলমারি ভর্তি জামা কিনেছে। সেদিন তো পাগলামির মাত্রা ছাড়িয়ে ছিল সে। হুট করেই দুটো স্কুল ব্যাগ নিয়ে হাজির হয়। অন্বিতার চক্ষু কপালে। হতভম্ব হয়ে শুধায়,
‘তুমি স্কুল ব্যাগ কেন এনেছ?’
মাহির তখন মাথা চুলকে হেসে বলে,
‘না মানে, আসার পথে ব্যাগগুলো খুব পছন্দ হয়েছিল। তাই নিয়ে এলাম। বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করলে তো ব্যাগ লাগত’ই, তাই আগেই কিনে নিয়ে এসেছি।’
অন্বিতার সেই কথা শুনে মাথায় হাত। বাচ্চারা কবে বড়ো হয়ে স্কুলে যাবে, সেই চিন্তায় কি-না বাচ্চাদের বাপ এখনই স্কুল ব্যাগ নিয়ে দৌড়া দৌড়ি করছে!
বিভাবসুর পতন ঘটেছে। সেই অবসাদে ম্রিয়মান হয়েছে দিনের আলো। পাখিরা নীড়ে ফিরেছে আরো কয়েক পল আগেই। আজ অনেক দিন পর শশী আর তাইভিদ এসেছে এই বাড়িতে। সন্ধ্যাখানা তাদের আগমনে মুখরিত। জিনিয়া বেগম ব্যস্ত জামাইয়ের সমাদরে। সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে অন্বিতা তার রুমে গিয়ে বসেছে। শশীও এসেছে তার সাথে একটু গল্প করতে। অন্বিতার পেটে হাত রেখে সে বলে,
‘আমার মামুনিরা কেমন আছে?’
অন্বিতা প্রসন্ন হেসে জবাব দেয়,
‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আপু।’
‘যাক, আর দুটো দিন। তারপরেই তারা আমার কোলে।’
এই বলে শশী হাসল। অন্বিতাও হাসল তার তালে। বলল,
‘আপনি কেমন আছেন, আপু?’
‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।’
অন্বিতা তখন মুচকি হেসে বলল,
‘একটা আবদার রাখতে হবে।’
‘কী আবদার, বলো?’
‘আমার বাচ্চাদের জন্য বন্ধু আনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কিন্তু আপনাদের। আর সেটা যেন খুব শীঘ্রই হয়।’
অন্বিতার কথার মানে বুঝতে পেরে খানিকটা লজ্জা পেল শশী। বলল,
‘ওসব পরে ভাবা যাবে। আগে আমার মামুনিরা সুস্থ ভাবে পৃথিবীতে আসুক।’
আরো কিছুক্ষণ কথা হয় তাদের। এর মাঝেই জিনিয়া বেগম শশীকে ডাকেন। শশী উঠে যায়। বিছানায় একাই শুয়ে থাকে অন্বিতা।
বসার ঘরে তাইভিদের সাথে কথা বলছে মাহির। নার্সিংহোমে যাওয়া হয়না বিধায় তাইভিদের সাথে বেশ অনেকদিন পরেই তার দেখা। ছেলেটা আগের তুলনায় বেশ সুদর্শন হয়েছে। শরীরে মাংস হয়েছে বেশ। মাহির তাকে আগাগোড়া পরখ করে হেসে বলে,
‘আমার বোন তাহলে আপনাকে বেশ যত্নেই রাখছে।’
জুসের গ্লাস’টা ঠোঁট থেকে সরিয়ে তাইভিদ অবাক চোখে চাইল। বলল,
‘হঠাৎ এই কথা?’
‘বেশ সুদর্শন লাগছে কিন্তু।’
তাইভিদ সলজ্জ হাসে। তা দেখে মাহির হেসে বলে,
‘মেয়েদের মতো লজ্জা পাচ্ছেন দেখছি।’
‘এভাবে এর আগে আমাকে কেউ সুদর্শন বলেনি তো, তাই একটু লজ্জা পাচ্ছি।’
মাহির পুনরায় কিছু রগড় সুরে বলার আগেই ভেতর থেকে বিকট শব্দের এক চিৎকার এল। আচমকা চিৎকারে বসার ঘরে ছুটে এল সবাই। মাহির আর তাইভিদ উঠে দাঁড়াল। সবাইকে একবার পরখ করতেই আঁতকে উঠল মাহির। রুদ্ধশ্বাস ফেলে বলল,
‘অন্বিতা।’
ছুটে যায় সে। ঘরের ভেতর গিয়ে দেখে ওয়াশরুমের দরজার কাছটায় চিৎ হয়ে পড়ে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে অন্বিতা। তার পায়ের কাছটায় রক্তের স্রোত। আচানক মাহিরের মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়। সে বুঝতেই পারছে না, কী দেখছে। বাড়ির বাকি সদস্যেরা হন্তদন্ত হয়ে অন্বিতাকে উঠানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তার ভারী শরীরের ভর ছেড়ে দেওয়ায় কেউ উঠাতে পারছে না। মাহির এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। অন্বিতার মুখটা ক্রমশ আরক্ত হচ্ছে। ব্যথায় মেয়েটার জীবন যাচ্ছে যেন। শশী চেঁচিয়ে বলে,
‘মাহির, দাঁড়িয়ে আছো কেন? অন্বিতাকে তুলো। ওকে হাসপাতালে নিতে হবে।’
হুঁশ ফিরে মাহিরের। ছুটে যায় অন্বিতার কাছে। তাইভিদ ততক্ষণে যায় গাড়ি বের করতে। অন্বিতার নিশ্বাস আটকে আসছে। সাদা মেঝেতে লাল রক্ত দেখে দম যেন ফুরিয়ে আসছে তার। মাহিরকে কাছে পেয়ে ক্ষীণ সুরে শুধু বলল,
‘আমার বাচ্চাগুলো কি বাঁচবে না, মাহির?’
মাহির উত্তর দিতে পারল না। অন্বিতার হুঁশ আছে কি-না বলা মুশকিল। এরপর আর কোনো কথা বলেনি সে। পুরো বাড়ি রক্তে মাখামাখি হলো। অতঃপর নার্সিংহোমে নেওয়া হলো তাকে।
অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অসাড়, মূঢ় হয়ে বসে আছে মাহির। সে চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেছে বেমালুম। উপর দিকে চেয়ে কী যে দেখছে, সে’ই জানে। জিনিয়া বেগম আর অন্বিতার মা আসিয়া বেগম দুজনেই নামাজে দাঁড়িয়েছে। আল্লাহ’র কাছে মেয়ের সুস্থতা কামনায় কেঁদে কেটে ব্যাকুল তাঁরা। শশী দাদুকে নিয়ে এক কোণে বসা। অসুস্থ দাদুর লাঠি কাঁপছে ঠকঠক। চোখের সাদা পাপড়িগুলো ভিজে আছে। একবার অসহায় চোখে তাকাচ্ছেন নাতির দিকে আবার তাকাচ্ছেন অপারেশন থিয়েটারের দিকে।
কিছুক্ষণ বাদেই ভেতর থেকে তীক্ষ্ণ এক কান্নার স্বর এল। সম্বিত ফিরল সকলের। আকুল চোখে দরজার দিকে তাকাল মাহির। শশী মাহিরের দিকে চেয়ে হেসে বলল,
‘মাহির, তোমার বাচ্চাদের কান্না শুনছো?’
অমাবস্যা কেটে পূর্ণিমার দেখা পেল মাহির। ঠোঁটে ফুটল কিঞ্চিৎ তৃপ্তির হাসি। অস্থিরতা বাড়ল ভীষণ। বাচ্চাদের আর অন্বিতাকে দেখার জন্য মন চনমনে হয়ে উঠল তার।
নার্স বেরিয়ে আসে। সাদা তোয়ালে পেঁচানো তার হাতে এক ছোট্ট পুতুল। মাহির ছুটে আসে তার কাছে। নার্সের কোল থেকে বাচ্চা নিয়ে খুব করে আদর করে তাকে। দাদুকে নিয়ে শশীও উঠে দাঁড়ায়। আদুরে বাচ্চাটার লাল লাল গালে চুমু দেয়। খুশ মেজাজে বলে,
একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৫২
‘আমি মা আর আন্টিকে নিয়ে আসি।’
শশী তাঁদের আনতে যায়। মাহির নার্সের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘আমার ওয়াইফ আর আরেকটা বাচ্চা কেমন আছে?’