একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৫৫
জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
একটি চকচকে সকাল। কে বলবে, কাল রাতেই প্রকৃতি এমন তান্ডব চালিয়েছিল? নার্সিংহোমের ছাদের কয়েকটা টব ভেঙে গুড়িয়েছে এই তান্ডবে। রাস্তার ধারের গাছগুলোরও এবড়ো থেবড়ো অবস্থা।
বাহ্য জগতের ঘোর অমাবস্যা কাটলেও কাটেনি মাহিরের জীবনের। ডাক্তারের মুখ থমথমে। মাহির কিছুক্ষণ খুব চেঁচাল। ডাক্তারকে হুমকি দিল খুব। কেমন চিকিৎসা করছে তারা, যে কাল থেকে তার স্ত্রীর জ্ঞান’ই ফিরছে না! সবকটা ডাক্তারকে সে চাকরিচ্যুত করবে। তাইভিদ এসে শান্ত করল তাকে। সে ফোঁস ফোঁস করছে।
অয়ন সেই ডাক্তারের কাছে এল। উদ্বেগ দেখিয়ে বলল,
‘কিছুই কি করার নেই, ডক্টর? আপনারা এভাবে আশা ছেড়ে দিচ্ছেন?’
ডাক্তার মাথা নোয়ালেন। মাহির অন্বিতাকে কতটা ভালোবাসে তা এই কয়দিনে হাসপাতালে চাকরি করা সকলের’ই বোঝা হয়ে গিয়েছে। তাই অন্বিতার এই অবস্থায় মাহিরের এহেন রুক্ষ ব্যবহার খুব একটা আমলে নিলেন না তিনি। মৃদু সুরে বললেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘কাল থেকেই চেষ্টা করছি। ভোরের দিকে হালকা রেসপন্স পাওয়া গেলেও, এখন উনি একেবারেই রেসপন্স করছেন না। জীবিত আছেন এখনও, তবে কতক্ষণ থাকবেন তা বলতে পারছি না।’
যোহরের নামাজ’টা সেরে সবেই করিডোরে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন আসিয়া বেগম। ডাক্তারের মুখে এমন কথা শুনে পাযুগল টলে উঠল তাঁর। বুক কেঁপে উঠল। ছুটে গেলেন নিশ্চল বসে থাকা মাহিরের কাছে। তার পাশে বসলেন তিনি। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় গলা দিয়ে শব্দ বের হতেও যেন বাঁধা খাচ্ছে। তাও তিনি বললেন,
‘অন্য কোনো ডাক্তারের কথা আমি বিশ্বাস করব না, বাবা। তুমি ডাক্তার, আমি শুধু তোমাকে বিশ্বাস করব। অন্বিতার চিকিৎসা তুমি করো, তুমি আমার মেয়েকে সুস্থ করতে পারবে। আমার বিশ্বাস, তুমি পারবে।’
আসিয়া বেগম হু হু করে কেঁদে উঠলেন। মেয়ের চিন্তায় নাওয়া খাওয়া বন্ধ উনার। রাত দিন চোখের পানি, নাকের পানি এক করে শুধু মেয়ের জন্য দোয়া করেছেন। তাও সেসব দোয়া বিফলে যাচ্ছে দেখে ভীষণ তড়পাচ্ছেন তিনি।
শাশুড়িকে স্বান্তনা দেওয়ার উপযুক্ত ভাষা জানা নেই মাহিরের। সে নিস্তেজ, নিরুত্তাপ। আজ নিজেকে সবথেকে অক্ষম ডাক্তার মনে হচ্ছে। কী হলো এত ডাক্তারী জেনে, কী হলো এত ডিগ্রি নিয়ে, সেই তো আজ নিজের স্ত্রী’কে বাঁচাতে সে অসমর্থ।
আসিয়া বেগমকে আভা সামলাচ্ছে। যদিও গাল, নাক কেঁদে কেটে সেও আরক্ত করেছে, তাও এক অসহায় মা’কে শান্ত রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছে সে।
আই সি ইউ তে প্রবেশ পূর্বক সমস্ত প্রস্তুতি নেওয়া শেষ মাহিরের। ডাক্তারের সাথে কথা বলে ভেতরে প্রবেশ করল অতঃপর। দরজার বাইরে ব্যাকুল চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে কিছু মানুষ। সিক্ত নয়নে, ব্যথিত মনে কাঙ্খিত মানুষের সুস্থতা কামনায় ব্যস্ত তারা। আসিয়া বেগম নাক টেনে বললেন,
‘মাহির গিয়েছে না? দেখবে, আমার মেয়ে এখন সুস্থ হয়ে উঠবে।’
আভা ঠোঁট চেপে কান্না দমাল। বলল,
‘তাই যেন হয়, আন্টি।’
বিস্মিত চোখে নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে দেখছে মাহির। কী আশ্চর্য, দুদিন আগের সেই ব্যস্ত চটপটে মেয়েটা আজ কেমন অসাড় হয়ে এই বিছানায় পড়ে আছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক, হাতে স্যালাইন, আরো কত কী! অন্বিতার পুরো শরীরে একবার চোখ বুলাল মাহির। বসল একটা উঁচু চেয়ারে। অন্বিতার হাতের উপর হাত রাখল। ঢোক গিলল বার কয়েকবার। হাতটা এত ঠান্ডা কেন!
সে কম্পিত অধরে অন্বিতার হাতের পৃষ্ঠে ভালোবাসা আঁকল। বলল,
‘অভিমান করে এমন করছো, তাই না? তুমি তো আসলে আমাকে ক্ষমা করোনি। এখনও সেই পুরোনো রাগ রয়ে গিয়েছে। তাই তো এমন করছো। আমি ধরে ফেলেছি, অন্বি। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ থাকবে বলো তো? আমাদের মেয়েটা! একটাই মেয়ে, আরেকজনকে আল্লাহ নিয়ে নিয়েছেন। তবে তুমি কষ্ট পেও না, আমাদের একটা পরিকে নিয়েই আমরা আজীবন ভালো থাকতে পারব। কিন্তু সেই পরিটাও যে তোমার সান্নিধ্যে আসার জন্য ব্যাকুল। কাল থেকে কত কেঁদেছে, জানো? আর রাগ করে থেকো না, অন্বি। আমার মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে। অন্বি, তাকাও না।’
মাহিরের গলার স্বর ধরে আসে। চোখ ভিজে উঠে। ঠোঁট কাঁপে। ভীষণ রকম যন্ত্রণায় কাঁপে বুক। সে পারছে না আর এসব মেনে নিতে। সৃষ্টিকর্তা কেন এত পরীক্ষা নিচ্ছে তার কাছ থেকে? সে তার গালের সাথে অন্বিতার হাতটা চেপে ধরে। ফুঁপিয়ে উঠে। অন্বিতার পালস্ একেবারেই ক্ষীণ। প্রতি মুহুর্তে মনে হচ্ছে, এই যেন শেষ বার, এই যেন শেষ বার, এরপরেই এই ক্ষীণ পালস্ একেবারের জন্য থেমে যাবে।
মাহির চোখ বুজল। এত বীভৎস যন্ত্রণা তার আগে হয়নি। সে বিড়বিড় করে বলল,
‘আল্লাহ, আমার জীবনের বাকি হায়াতটুকু আমার স্ত্রীকে দিয়ে দাও। তাও, ফিরিয়ে দাও তাকে।’
চোখ খুলে অন্বিতার দিকে চাইল সে। অন্বিতার চোখের পাতা তখন হালকা কাঁপল। চমকে তাকাল মাহির। সঙ্গে সঙ্গেই তার পালস্ চেক করল ব্যস্ত ভঙিতে। অন্বিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ডাকল,
‘অন্বিতা, অন্বিতা, আমায় শুনতে পাচ্ছো।’
জবাব নেই কোনো। মাহির ফের বলল,
‘অন্বি, তাকাও। তাকাও, অন্বি। তোমার অপেক্ষায় তোমার পুরো পরিবার। একবার তাকাও, প্লিজ।’
মাহিরের কন্ঠে অস্থিরতা। সে পারছে না, কোনো এক জাদু প্রয়োগে অন্বিতাকে সুস্থ করে তুলতে।
পিটপিট করে তাকাল অন্বিতা। মাহিরের আত্মায় শান্তি এল। সে নিশ্বাস ফেলছে ঘনঘন। পালস্ চেক করল আবার। না, এখনও স্বাভাবিক না। শুষ্ক, নিস্তেজ ঠোঁটযুগল নাড়ানোর চেষ্টা চালাল অন্বিতা। মাহির বুঝতে পারল, অন্বিতা কিছু বলতে চাইছে। মুখের অক্সিজেন মাস্ক’টা সে সরিয়ে দিল। প্রথমেই এক প্রলম্বিত শ্বাস টানল অন্বিতা। গলার স্বর আসতে চাইছে না। তাও চেষ্টা চালাল খুব। ঠোঁট নাড়িয়ে ক্ষীণ সুরে বলল,
‘তোমার প্রতি আমার কোনো অভিমান, অভিযোগ নেই, মাহির। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। তোমাকে নিয়ে আমার আরও অনেকটা পথ পাড়ি দেবার কথা ছিল। তবে আল্লাহর তা ইচ্ছে হয়নি, তাই এত তাড়াতাড়ি’ই ডেকেছেন আমায়। শুনো, তুমি একদম কাঁদবে না। আমার এক মেয়ে এখানে আছে, তাকে তুমি দেখে রাখবে। আর আরেক মেয়ে, সে আমার অপেক্ষায়। আমাকে যে তার কাছে যেতে হবে। তুমি কাঁদবে না কিন্তু, মাহির। আমাকে মা’কে আগলে রেখো। আমার দেহ’টা তোমাদের মাঝে না থাকলেও আমি তোমাদের মাঝে আজীবন থাকব। আর তুমি চাইলেই আরেকটা বিয়ে করতে পারো, আমার আপত্তি নেই। তবে, বিয়ের আগে আমার মেয়েটাকে আভার কাছে দিয়ে দিও। আমার মেয়েটা সৎ মায়ের অনাদর সহ্য করতে পারবে না।’
থামল অন্বিতা। তার চোখের কার্ণিশ বেয়ে জল পড়ল। বুকে বড্ড ব্যথা অনুভব হলো যেন। সে নাক মুখ কুঁচকে বলল,
‘আমার খুব যন্ত্রণা হচ্ছে, মাহির। খুউব। মরে যেতে একটুও ইচ্ছে করছে না। তাও মনে হচ্ছে, দমটা ফুরিয়ে আসছে একটু একটু করে।’
সে তাকাল মাহিরের দিকে। ছেলেটার দুই চোখ ভয়ংকর লাল। নাক, মুখ ফুলে যা তা অবস্থা। অন্বিতা হাসল। বলল,
‘এত কেঁদেছ কেন? তোমাকে টমেটো লাগছে।’
‘আমাকে ছেড়ে যাবার কথা বলো না, অন্বি। তোমাকে ছাড়া আমার এই বেঁচে থাকা অর্থহীন।’
‘না না, তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। আমার মেয়ের জন্য তুমি বেঁচে থাকবে। প্রমিজ করো, আমার মেয়েকে কখনও আমার অভাব বুঝতে দিবে না।’
মাহির মুখ ঘুরিয়ে নিল। সে এসব মানতে পারছে না। অন্বিতা পাগলামি করছে। কিছুই হয়নি ওর, একটু দূর্বল বলে উল্টা পাল্টা বকছে সব। অন্বিতা অনুনয়ের সুরে বলল,
‘প্রমিজ করবে না?’
‘আমার এসব ভালো লাগছে না, অন্বিতা। কাল থেকে খুব জ্বালাচ্ছো।’
‘আর জ্বালাব না। এই তো আর কয়টা মুহুর্ত।’
মাহির এবার ধমকে উঠে। মেয়েটা মলিন হেসে বলল,
‘বিদায় বেলায়ও ধমকাবে? এখন তো একটু আদর দিতে পারো?’
মাহিরের ভীষণ কান্না পায়। তাও মেয়েটাকে দেখিয়ে কাঁদে না সে। তার হাতের পিঠে চুমু খেয়ে বলে,
‘ধমক খাওয়ার মতো কথা বলো কেন?’
‘আমার আরও চুমু লাগবে, মাহির। কপাল, নাক, গাল, ঠোঁট, আমার সবখানে তোমার স্পর্শ লাগবে।’
মেয়েটার কন্ঠে এত ব্যাকুলতা কেন? যেন শেষবারের মতো কিছু চাইছে। মাহির তাকে অভিযোগ করার সুযোগ দিল না। স্থাল, কাল না দেখেই মেয়েটাকে আয়েশ ভরে আদর করল। অন্বিতার আজ পরম সুখ লাগছে। সে মৃদু হেসে বলে,
‘শুনেছি, যে মেয়েরা স্বামীর উপস্থিতিতে মারা যায় তারা না-কি ভাগ্যবতী।’
মাহির তার ঠোঁটে আঙ্গুল ঠেকিয়ে বলে,
‘আর একটাও উল্টা পাল্টা কথা নয়। চোখ বুজে ঘুমাও, আমি অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দিচ্ছি।’
‘এত তাড়া কেন তোমার? একটু পর তো একেবারের জন্য ঘুমিয়েই পড়ব, এখন একটু জেগে থাকি না? আচ্ছা, আমার মেয়েটা কোথায়? ও কি খুব কেঁদেছে?’
‘হ্যাঁ, ভীষণ। এখন চাইল্ড রুমে রাখা হয়েছে। তুমি রেসপন্স করছিলে না বলে ওকে বাইরের খাবার দেওয়া হয়েছে।’
বিচলিত হলো অন্বিতা। বলল,
‘সেকি! মেয়েটা তার মায়ের থেকে প্রথম আহার টুকু খেতে পারল না। আমি মা হিসেবে কত জঘন্য।’
‘এভাবে বলছো কেন? এখানে তোমার কোনো দোষ নেই। ওকে নিয়ে আসি?’
‘না না, এনো না। শুনো, ওর নাম রাখবে নয়নতারা। ভেবেছিলাম, আমার দুই সন্তান হলে একজনের নাম রাখব নয়ন, আর অন্যজনের তারা। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব না। তাই তুমি ওর নাম রেখো, নয়নতারা। সুন্দর না নামটা?’
‘ভীষণ সুন্দর।’
অন্বিতা হাসল। বলল,
‘যাও, এবার বাইরে যাও। মা’কে গিয়ে বলো, তাঁর মেয়ে ভালো আছে।’
মাহির অন্বিতার কপালে চুমু এঁটে বলল,
একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৫৪
‘ঠিক আছে, তুমি এভাবে রেসপন্স করলে আমি আজ সন্ধ্যায়’ই তোমাকে কেবিনে দিতে পারব।’
অন্বিতা কোনো জবাব না দিয়ে নির্মল হাসল শুধু। অক্সিজেন মাস্ক ঠিক করে, বাকি সব চেক করে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল মাহির। তার যাওয়া নিবিড় চোখে দেখল অন্বিতা। মনে মনে খুব করে চাইল, এই দেখাই যেন তার সে দেখা না হয়।